অনন্ত পথের সাথী
‘আসসালামু আলাইকুম, আমার বাবামা কি তোমাদের বাসায়?’
হামাদ কোনো জবাব দিলোনা, চেহারায় দ্বিধা। সে দরজাটা পুরোপুরি খুলছেনা, ফলে মুমতাহিনা পাশ কাটিয়ে ঘরে ঢুকবে সে উপায় নেই।
মুমতাহিনা আবার জিজ্ঞেস করল, ‘ভাইয়া ভাবী সম্ভবত বাইরে গেছে, আমার কাছে বাসার চাবি নেই। বাবামা কি এখানে?’
‘কে এলো হামাদ?’, ভেতর থেকে চাচীর গলা শোনা গেল।
এবার হামাদ ওকে দরজা খুলে দিলো। মুমতাহিনা ঘরে ঢুকতে ঢুকতে হামাদ পাশ থেকে ফিসফিসিয়ে বলল, ‘আর যাই কর মুনা, প্লিজ না বলবে না’।
‘মানে?’
মুমতাহিনা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাল হামাদের দিকে, কিন্তু সে চোখ ফিরিয়ে নিল। হামাদ সেই তিন বছর বয়স থেকেই ওকে মুনা ডাকে। বড় হয়েও সে সিদ্ধান্ত নিলো এত্তবড় নাম সে কিছুতেই ডাকতে পারবেনা, তাই পৃথিবীতে মাত্র এই একজনই ওকে মুনা ডাকে। হামাদের সাথে ওর একটা সহজ বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছে ছোটবেলা থেকে। কিন্তু আজ সে ওর হাবভাব কিছুই বুঝতে পারছেনা।
দরজা পেরোতেই চোখে পড়ল বাবামা ড্রয়িং রুমের বারান্দায় বসে চাচা চাচীর সাথে গল্প করছেন, ভাইয়া ভাবী ডাইনিং রুমে হামাদের বড়বোন হুসনা আর ওর দুলাভাইয়ের সাথে গল্পে মশগুল। বাবা আর মারুফ চাচা ছোটবেলার বন্ধু। সারাজীবন দ’জন দু’জায়গায় কাজ করেছেন, কিন্তু যোগাযোগ ছিল অক্ষুন্ন। রিটায়ারমেন্টের সময় হয়ে এলে দু’জনে সিদ্ধান্ত নেন কাছাকাছি বাড়ি করে থাকবেন। বছর তিনেক হোল ওরা পাশাপাশি বাড়িতে থাকে। দিনরাত হয় বাবামা মারুফ চাচাদের বাসায় নয় চাচা চাচী ওদের বাসায়। তাই অনার্সের শেষ পরীক্ষাটা দিয়ে এসে যখন মুমতাহিনা বাসায় কাউকে পেলোনা তখন স্বাভাবিকভাবেই ধারণা করল বাবামা এ’বাসায়।
মুমতাহিনা ঘরে প্রবেশ করতেই ভাবী আর চাচী দু’জনে এগিয়ে এসে ওকে ড্রয়িং রুমে নিয়ে বসাল, সবাই এসে ওর চারপাশে ঘিরে বসল। একেকজন জিজ্ঞেস করছে পরীক্ষা কেমন হোল, প্র্যাক্টিকাল কবে, ভাইভা কবে- মনে হচ্ছে যেন অনার্স না, পিএইচডি শেষ করে এলো। হামাদ দরজার কাছে একটা পিলারে হেলান দিয়ে ওদের পাগলামী পর্যবেক্ষণ করছে, কিন্তু এমন কিম্ভূত দৃশ্যেও ওকে হাসতে দেখা যাচ্ছেনা যদিও সে অল্পেই হাসিতে ফেটে পড়ে, কেমন যেন একটা চিন্তিত চিন্তিত মূর্তিসদৃশ ভাব।
সবাইকে থামিয়ে দিয়ে চাচী বললেন, ‘মেয়েটা সকাল বেলা পরীক্ষা দিতে গেছে, আগে ওকে কিছু খেতে দাও, তারপর সবাই কথা বল’।
চাচী হরেক রকম নাস্তা পানি শরবত নিয়ে এলেন, ক্ষিদেও পেয়েছে বটে, কিন্ত খেতে গিয়ে দেখে সবাই ড্যাবড্যাব করে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। হচ্ছেটা কি এইসব? এভাবে কি খাওয়া যায়? কোনমতে পেটটা ঠান্ডা করেই সে খাওয়ায় ক্ষান্ত দিল। এরা সব চলে গেলে হাপুস হুপুস করে খেতে হবে। পানি খেয়ে চোখ তুলতেই হামাদের বোন হুসনা আপু বলল, ‘মুমতাহিনা, তোমার কি কোথাও পছন্দ আছে?’
মুমতাহিনা থতমত খেয়ে বলল, ‘মানে?’
দুলাভাই স্ত্রীর সহায়তায় এগিয়ে এলেন, ‘মানে আজকালকার ছেলেমেয়েদের তো প্রায়ই অ্যাফেয়ার ট্যাফেয়ার থাকে। তোমার কি তেমন কাউকে পছন্দ আছে?’
চেহারাটা লাল হয়ে গেল ওর, মনে মনে বলল, ‘থাকলেও কি আমি তোমাদের বলব?’
কেবল মাথা ঝাঁকিয়ে না-বোধক উত্তর দিল মুমতাহিনা। অস্বস্তি লাগছে ওর, ওরা কি এমন কিছু শুনেছে যাতে তাদের সন্দেহ সৃষ্টি হয়েছে? সেজন্যই কি এই আদালতের আয়োজন?
ওর চিন্তায় ছেদ ঘটিয়ে চাচী বললেন, ‘তোমাদের যা কথার ছিরি, মনে হচ্ছে বেচারীকে কাঠগড়ার আসামীর মত ইন্টারোগেশন করা হচ্ছে! ভাই, আপনি একটু সুন্দরভাবে বুঝিয়ে বলুন প্লিজ। এরা বেচারীকে টেনশনে মেরেই ফেলবে’।
বাবা ফ্লোর পেয়ে তাঁর চিরাচরিত ভঙ্গিতে লেকচার শুরু করলেন, ‘মা, মেয়ে বড় হলে বাবামার চিন্তা বাড়তে থাকে…’
মানে সে এখন আরো কনফিউজড হয়ে যাবে, কারণ বাবা বিরাট এক ভূমিকা দেবেন যার সাথে উপসংহারের কোন সম্পর্ক থাকবেনা, মা ভাইয়া ভাবী সব মুখ টিপে হাসতে থাকবে, মারুফ চাচা এবং চাচী এমনভাবে মনোযোগ দিয়ে শুনবেন যেন এগুলো পৃথিবীর সবচেয়ে দামী কথা, হুসনা আপু আর দুলাভাই মুখ নিচু করে সব কথা গিলবে যেন এই অমিয় বাণী কেবল তাদের জন্যই উৎসর্গিত, হামাদ অবশ্য হো হো করেও হেসে ফেলতে পারে, আর এতকিছুর মধ্যে ওকে সুবোধ হয়ে বসে থাকতে হবে, এ’কাজ যেন কমেডি দেখেও বাধ্যতামূলকভাবে চেহারা সোজা রাখার মত কষ্টকর।
মাঝপথে ভাইয়া উদ্ধার করল ওকে, ‘মুমি, শোন। বাবা যেটা বলতে চাইছেন সেটা হোল, আমরা হামাদের সাথে তোর বিয়ের চিন্তা করছি। তুই কি বলিস?’
মুমতাহিনা সত্যিকার অর্থেই আকাশ থেকে পড়ল, পড়ে সম্ভবত হাড়গোরও ভেঙ্গে গেল। গত এক বছর যাবত দুই পরিবার মিলে হামাদের জন্য মেয়ে দেখছে। মুমতাহিনা নিজেও অন্তত তিনটা মেয়ে দেখে দিয়েছে। হামাদের কোন মেয়েই পছন্দ হয়না। এখন কি নিরুপায় হয়ে ওকে …?
হামাদের দিকে তাকায় সে। নাহ, সে কিছু বলছেনা। কিন্তু ওর চোখে এক করুন আকুতি, ‘আর যাই কর মুনা, প্লিজ না বলবে না’। কিন্তু এ’ কি করে হয়? ওরা ছোটবেলা থেকে পরস্পরের বন্ধু, এত দূর পথ পাড়ি দিয়ে এসেছে পরস্পরের পাশাপাশি, কোনদিন কোন আকর্ষন বোধ হয়নি। বিয়ে মানে বন্ধুত্ব, কিন্তু বিয়ে মানে ভালবাসাও তো বটে! বন্ধুত্ব আছে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু এমন সহজ সম্পর্কের মাঝে কি ভালবাসার উদ্ভব হতে পারে? যদি আদৌ তা সম্ভব হয় তাহলে এতদিন ঘটেনি কেন? তার মানে নিশ্চয়ই ওদের মাঝে ভালবাসা সম্ভব নয়। মুমতাহিনা সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয়, এটা একটা উদ্ভট প্রস্তাব, এটা হতেই পারেনা।
কথাটা বলার জন্য মুখ খোলে মুমতাহিনা, আবার ওর কানে বাজে, ‘আর যাই কর মুনা, প্লিজ না বলবে না’। সবার সামনে ব্যাপারটা দৃষ্টিকটু বুঝতে পেরেও আবার হামাদের দিকে তাকায় মুমতাহিনা। সে কিছু বলেনা, কিন্তু ওর চোখ বলে, ‘ট্রাস্ট মি, ট্রাস্ট মি, ট্রাস্ট মি’।
হামাদ মুখে না বললেও মুনা ওর সব কথা বুঝতে পারে। সে হামাদকে বিশ্বাস করে, পরিপূর্ণভাবে বিশ্বাস করে, কিন্তু সে তো বন্ধু হিসেবে! তাই বলে বিয়ে! সারা জীবনের জন্য এক ভালোবাসাহীন বন্ধন? আবার ওর মনে অনুরণিত হয়, ‘ট্রাস্ট মি, ট্রাস্ট মি, ট্রাস্ট মি’।
মুমতাহিনা নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে পারেনা যখন নিজের গলা শুনতে পায়, ‘তোমরা যা ভাল মনে কর’।
প্রথমে সবাই চুপ। তারপর সম্মিলিত এক দীর্ঘশ্বাস। তারপর হুসনা আপু ওর গায়ের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে আনন্দে চিৎকার! বেচারী মানুষটা খারাপ নয়, কিন্তু গুছিয়ে কথা বলতে পারেনা, দুলাভাইটা বৌকে সাহায্য করতে গিয়ে আরো তালগোল পাকিয়ে ফেলে, এক্কেবারে ‘মেড ফর ইচ আদার’। ঘরের ভেতর তখন একটা শোরগোল শুরু হয়ে গিয়েছে। হামাদকে কোথাও দেখা যাচ্ছেনা।
প্রথমে হুসনা আপু আর দুলাভাই বিরাট প্ল্যান ফেঁদে বসলেন- এঙ্গেজমেন্ট, তারপর আকদ, তারপর হলুদ, তারপর বিয়ে, তারপর বৌভাত। ভাইয়া ভাবী বলল, ‘এঙ্গেজমেন্টের কোন নৈতিক ভিত্তি নেই, হলুদেরও তাই। আকদ হতে পারে, আর বিয়ের একটা অনুষ্ঠানই যথেষ্ট ’। বাবামা বললেন, ‘যেহেতু ছেলেমেয়ে এত কাছাকাছি থাকে, আকদ আজই হলে ভাল হয়’। মারুফ চাচা আর চাচী বললেন, ‘আজই ছোটখাটো করে বিয়ে হয়ে যাক’। মুমতাহিনা মনে মনে ভাবছে, ‘আমাদের দুই পরিবারই পাগল!’ এই পাগলামীর ভিড়ে ওর টেনশন কোথায় যেন হারিয়ে গেল।
উভয় পরিবারের পাগলামীর মধ্যে কিভাবে যেন অসাধ্য সাধন হয়ে গেল, ওদের সবচেয়ে কাছাকাছি একশ আত্মীয়সহকারে সত্যি সত্যি বিয়ে হয়ে গেল! মুমতাহিনার সবকিছু স্বপ্নের মত মনে হচ্ছে, দিনটা যেন একশ বছরের সমান লম্বা। রাত দু’টোর সময় সে চাচীকে বলল, ‘চাচী, আমার ঘুম পাচ্ছে, আমি বাসায় গেলাম’।
মা ছিলেন পাশে, তিনি জিভ কেটে বললেন, ‘বলে কি মেয়ে! এটাই তো এখন তোর বাসা মুমি!’
ব্যাপারটা এতক্ষণ ওর মাথায় ঢোকেনি। সারা বিকাল সবাই মিলে রান্নাবাড়া, সন্ধ্যা থেকে মেহমানদারী, রাতে সবাই খেয়ে দেয়ে বসে গল্পগুজব করছে, হুজুরকে নিয়ে একটা পর্ব ছিল বটে কিন্তু আর দশটা দাওয়াত থেকে এটা যে আলাদা বোঝার সুযোগই হয়নি মুমতাহিনার।
হুসনা আপু বললেন, ‘মা, মেয়েটা সকালে পরীক্ষা দিতে গেল, তারপর থেকে বেচারীর বিশ্রামের কোন সুযোগ হয়নি। হামাদ তো মেহমান যাওয়া পর্যন্ত ব্যাস্ত থাকবে, ও গিয়ে ঘুমাক না’।
চাচীও বললেন, ‘ঠিক। চল, ওকে ওপরে দিয়ে আসি’।
মারুফ চাচার বাসায় শোবার ঘর আর পড়ার ঘর ওপরতলায়, ড্রয়িং ডাইনিং রান্নাঘর নীচে। সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে নীচে মেহমানপরিবেষ্টিত হামাদের সাথে একবার চোখাচোখি হোল মুমতাহিনার, কিন্তু তেমন বিশেষ কিছু মনে হোলনা। ধাক্কাটা খেল হামাদের রুমে ঢুকতে গিয়ে। এত বছরের বন্ধুত্বেও মুমতাহিনা কোনদিন হামাদের রুমে ঢোকেনি, হামাদও কোনদিন ওর রুমের ধারেকাছেও আসেনি। কথাবার্তা হত নীচতলায় বা বাগানে, সর্বসমক্ষে। জীবনে প্রথম ওর রুমে ঢুকতে গিয়ে কেমন যেন দ্বিধা বোধ হয় মুমতাহিনার, পা আটকে আসে, হুসনা আপু আর চাচী মিলে কাঁধে হাত দিয়ে উৎসাহ দেয় ওকে। ভেতরে গিয়ে দেখে কোন এক ফাঁকে ভাবী আর হুসনা আপু মিলে পুরো ঘরটা ফুল দিয়ে সাজিয়েছে, পরিমাণে খুব বেশি না, কিন্তু জায়গায় জায়গায় গুচ্ছ আকারে সাজানোয় পুরো ঘরটা সুবাসে মৌ মৌ করছে।
হুসনা বলল, ‘মুমি, কষ্ট হলেও এখন জামাকাপড়, গহনা খুলে ফেলোনা। আর অল্প কিছুক্ষণ পরে থাকো। আমার ভাইটা তোমাকে এখনও বধূবেশে দেখেনি, মেহমানদারী করতে করতে বেচারার জান শেষ। একটু কষ্ট করে এভাবেই ঘুমাও’।
কি ঘুমাবে মুমতাহিনা, ক্লান্তিতে শরীর এলিয়ে এলেও বিছানার কাছে যেতে অস্বস্তি বোধ হয় ওর, ওটা তো ওর বিছানা নয়! রুমের একপাশে জানালার সামনে একটা প্রশস্ত সোফা, একজন বসার মত। ওখানেই পা তুলে আধশোয়া হয়ে বসে পড়ে সে। হুসনা আপা আর চাচী আঁতকে ওঠে, ‘এভাবে কি ঘুম আসবে নাকি? তুমি বিছানায় আরাম করে শোও, জামাকাপড় ভাঁজ ভেঙ্গে গেলেও কিছু হবেনা’।
মুমতাহিনা বলে, ‘আমি ঠিক আছি’।
চাচী হুসনাকে বকা দেন, ‘দিলি তো মেয়েটার আরাম শেষ করে? মা, তুমি নাহয় জামাকাপড় বদলে শোও’।
মুমতাহিনা কিছু বলেনা, কেবল গ্যাঁট হয়ে সোফায় বসে থাকে। ওরা কিছুক্ষণ বলেকয়ে ওকে নাড়াতে না পেরে দরজা বন্ধ করে দিয়ে চলে যায়। মুমতাহিনার মনে হয় যেন আজ সে হঠাৎ আবিষ্কার করল ওর বাসার পেছনে বাগানটা আসলে একটা সবুজ বনভূমি যেখানে আছে হরেকরম ফুল পাখীদের মেলা, সে বাগানের প্রতিটা ফুল চিনত কিন্তু এখন মনে হচ্ছে সে বনভূমিতে প্রবেশের পথটুকুও চেনেনা। যে হামাদকে ওর কাঁচের মত স্বচ্ছ মনে হত, সে যেন কাঁচের ওপাশে এক অনাবিষ্কৃত পৃথিবী! এক অজানা শিহরণ দোলা দিয়ে যায় মনে। ক্লান্ত চোখ দু’টো জানালা দিয়ে বিশাল পূর্নিমার চাঁদটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে কখন যে বুজে আসে নিজেই টের পায়না মুমতাহিনা।
হাল্কা একটা শব্দে ঘুম ভেঙ্গে যায়। হঠাৎ স্থান কাল বুঝে উঠতে পারেনা মুমতাহিনা। আবছা আলোয় হামাদকে দেখে সব মনে পড়ে ওর। নিমেষে এক রাশ লজ্জা ওকে গ্রাস করে, অথচ হামাদকে কিসের লজ্জা সেটাই সে বুঝতে পারেনা। ওর দিকে চোখ পড়তেই হামাদ বলে, ‘সরি, আমি তোমার ঘুম ভাঙ্গাতে চাইনি। টেবিল ল্যাম্পটা নিভাতে গিয়ে টেবিলে পা লেগে শব্দ হোল’।
সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় মুমতাহিনা। চাঁদের আলোয় বধূর সাজে ওকে অপরূপ লাগে, হামাদ চোখ ফেরাতে পারেনা। মুমতাহিনা লজ্জা পেয়ে চোখ নামিয়ে নেয়। হামাদ অপ্রস্তুত হয়ে বলে, ‘একটু পর ফজরের আজান হবে। চল, আমরা জামাকাপড় বদলে প্রস্তুতি নেই’।
ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে এক এক করে গহনা খুলতে শুরু করে মুমতাহিনা, হামাদ আলো জ্বালিয়ে দেয়। মুমতাহিনার গহনার শখ নেই, অনভ্যস্ত হাতে কিছু গহনা খুলতে সক্ষম হলেও কানের দুলের পদ্ধতিটাই বুঝে আসে না ওর। ওর চেহারা দেখে হামাদ এগিয়ে আসে, ‘সাহায্য লাগবে?’
‘কানের দুলটা খুলতে পারছিনা’।
‘মাথার ওড়নাটা সরাও, আমি চেষ্টা করে দেখি’।
বুকের ভেতর ধক করে ওঠে মুমতাহিনার, সাত বছর বয়সের পর হামাদ ওকে অনাবৃত মস্তকে দেখেনি, ওর সামনে মাথার ওড়না সরাবে ভাবতেই পারেনা সে। হামাদ বুঝতে পারে, ‘মুনা, এখন আর আমাদের পরস্পরের সাথে পর্দার প্রয়োজন নেই’।
ভারী কানের দুলগুলো খুলে কি যে আরাম লাগে মুমতাহিনার! কিন্তু দু’টো আংটি আর দু’টো চুড়ি কিছুতেই খুলতে পারছেনা সে। হামাদ ওকে বেসিনের সামনে নিয়ে বেশি করে সাবান মাখিয়ে জিনিসগুলো আলতোভাবে খুলে দেয়, ব্যাথা পায়না মুমতাহিনা। কিন্তু ওর হাতের স্পর্শে যেন ইলেকট্রিক শক খায় সে, হৃৎকম্প বেড়ে যায়, পেটের ভেতর প্রজাপতি ওড়ে মুমতাহিনার। আসলেই তো, বড় হবার পর থেকে ওরা কখনো পাশাপাশি বসেনি, স্পর্শ করা ত অনেক দূরের কথা। অথচ ও ভেবে নিয়েছিল এত বছর বন্ধুত্বের পর ওদের আর পরস্পরের সম্পর্কে জানার কিছু বাকী নেই! ওর মনের ভাব বুঝতে পারেনা হামাদ, আন্দাজ করে বলে, ‘তুমি কি ভাবছ আমি কি করে মেয়েদের গহনা খোলায় এক্সপার্ট হয়েছি? আমার মা আর বোনের মত নার্ভাস লোকজন বাসায় থাকলে বাড়ীর পুরুষদের গহনা খুলতে না শিখে উপায় নেই, বুঝলে?’
হেসে ফেলে মুমতাহিনা, সত্যটা বুঝতে পারার চেয়ে এই ধারণা ওর জন্য কম লজ্জাজনক।
দু’জনে তাহাজ্জুদ পড়ে ফজরের জন্য অপেক্ষা করছে। হামাদের তিলাওয়াত শুনে মুগ্ধ মুমতাহিনা। নামাজের পর ওর পড়া শুনতে চায় হামাদ। মুমতাহিনাও ভাল পড়ে। একটু পর মুমতাহিনা বলে, ‘আমার মাথা এখনও ক্লিয়ার হয়নি, সবকিছু এত তাড়াতাড়ি ঘটল যে আমার সব তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। ব্যাকগ্রাউন্ডটা কি একটু বলবে আমাকে?’
হামাদ দেয়ালে হেলান দিয়ে জায়নামাজে পা ছড়িয়ে বসে, ‘গত এক বছর যাবত তোমরা সবাই আমার জন্য মেয়ে দেখছ, কার ব্যাপারে আমার কি ধারণা তুমি সবচেয়ে ভাল জানো যেহেতু আমাদের চিন্তার ধরনটা একই। আমি কিছু একটা খুঁজছিলাম যেটা ওদের কারো মাঝে ছিলোনা। আজ সকালে আবার আমার বিয়ে নিয়ে মিটিং হচ্ছিল। সবাই জানতে চায় আমি আসলে কি চাই। আমি বললাম, আমি চাই এমন একজন সাথী যে আমার মত করেই ভাবে, আমার মনের কথা আমার মত করেই বুঝতে পারে। ভাবী বললেন, মনে হচ্ছে যেন তুমি মুমির কথা বলছ! আমি নিজেও ধাক্কা খাই। তাই তো! চোখের সামনে থেকেও আমার কখনো তোমার কথা মনে হয়নি। আমাদের বন্ধুত্ব তেমনই যেখানে কথা না বলেও আমরা পরস্পরের সব কথা বুঝতে পারি, কিন্তু এটা কি বিয়ের জন্য যথেষ্ট? আমরা এত বছরে কখনো পরস্পরের প্রতি কোন আকর্ষন বোধ করিনি, তাহলে এটা কেমন বিয়ে হবে? কিন্তু ভাবতে ভাবতে এক সময় বুঝতে পারলাম আমরা অন্য কোনপ্রকার চিন্তা করিনি কারণ আমরা উভয়েই কঠোরভাবে পর্দা মেনে চলেছি, শারীরিক এবং মানসিক উভয়ভাবে। কিন্তু যদি আমরা তেমনটা না হতাম তাহলে আমাদের হয়ত বিয়ের চিন্তা এতটা অস্বাভাবিক মনে হতনা। ওদিকে আমাদের উভয় পরিবার ততক্ষণে একই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে। এমন সময় তুমি দরজায় বেল দিলে। আমি জানতাম ওরা তোমাকে ছেঁকে ধরবে, তুমিও আমার মত অথৈ সাগরে পড়বে। আমি তোমার সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করতে চাচ্ছিলাম না … না, সেটা বললে মিথ্যা বলা হবে, কিন্তু আমি চাচ্ছিলাম তোমাকে সম্ভাবনার দিকটা দেখাতে। সময় ছিলোনা, তাই তোমাকে শুধু একটা ইশারা দিলাম যেন তুমি আমার মত ভুল করে না ভাবো যে আমাদের বিয়ে হলে সেটা হবে প্রেম ভালোবাসাবিহীন। তুমি যখন বার বার আমার দিকে তাকাচ্ছিলে, বিশ্বাস কর, আমার হৃৎপিন্ডটা বুক চিরে তোমার কাছে চলে যেতে চাইছিল। মুরুব্বীদের সামনে আমি কি করে তোমাকে এত কথা বলি? আমি জানতাম আমার কথাটা তোমার মনের ভেতর ঢেউ তুলছে, তাই আমার হৃদয় শুধু বলছিল, ‘ট্রাস্ট মি, ট্রাস্ট মি, ট্রাস্ট মি’। কিন্তু তুমি হ্যাঁ বললে কি ভেবে আমার জানা হয়নি’।
স্মিত হেসে মুনা বলল, ‘বিকজ আই ট্রাস্টেড ইউ!’
ফজরের আজান শোনা যায়, অনন্তকালের দুই বন্ধু একত্রে পথ চলার সংকল্পে উঠে দাঁড়ায়।
– রেহনুমা বিনতে আনিস