মুহাদ্দিস জিয়াউর রহমান হিন্দ মাদানী ও তাঁর “আল জামিউল কামিল”
মুহাদ্দিস জিয়াউর রহমান হিন্দ মাদানি এর “আল জামিউল কামিল”
এই শায়েখ মূলতঃ ভারতের। তিনি উচ্চশ্রেণীর হিন্দু ব্রাহ্মণ পরিবার থেকে এসেছেন যাকে মুসলিমদের ঘৃণা করার শিক্ষা দেওয়া হয়েছিল।কিন্তু তিনিই এখন মুসলিম তৈরির ক্ষেত্রে এক কিংবদন্তীর নাম। তিনি সৌদি আরবেরও নাগরিকত্ব পেয়েছেন। বই এবং তাঁর জীবনী বলার পূর্বে অতি সংক্ষেপে বলতে চাই যে, আমি শায়েখের সাথে কয়েকবার কথা বলেছি এবং সর্বশেষ যখন আমি তাঁর সাথে কথা বলি তিনি আমাকে বলেছিলেন আমি তাঁর বইয়ের ইংরেজি অনুবাদের দায়িত্ব নিতে পারবো কিনা।
তিনি এটাও বলেছিলেন, “এর জন্য তুমি তোমার কিছু বন্ধু সংগ্রহ করো। আমি তোমাকে কিছু পারিশ্রমিকও দেবো।” সুবহানআল্লাহ! এমন বিখ্যাত শায়েখের কাছ থেকে এটা ছিল এক অন্য রকম পাওয়া। লোকেরা তাদের অনেক মুল্য দেয়। জ্ঞান প্রচারের প্রতি শায়েখের ভালোবাসার জন্যই তিনি আমাকে ঐ চমৎকার সুযোগটি দিয়েছিলেন। আমি তাঁকে বলেছিলাম যে, কিছু লোক সংগ্রহ করা হলে আমি তাঁর কাছে যাবো। কিন্তু কাজের চাপ আর নানা দায় দায়িত্বের কারণে সেটা করা হয়ে ওঠে নি। এই শায়েখ একজন উচ্চমানের যোগ্যতাসম্পন্ন শায়েখ।
আমি ছাত্রজীবনে মুসতালাহ বা উলুমুল হাদীস সংক্রান্ত সংশয়ের ব্যাপারে আলোচনার জন্য তাঁর কাছে যেতাম। তিনি এতই ব্যস্ত থাকেন যে সচরাচর কারো সাথে সাক্ষাত করেন না। কুয়েত থেকে যখন মদীনায় যাই তখন আমি তাঁর সাথে সাক্ষাতের চেষ্টা করেছিলাম কিন্তু সেটা সম্ভব হয় নি।
আল্লাহ’র কাছে শায়েখের সুস্বাস্থ্য কামনা করি। আল্লাহ যেন আখিরাতে তাঁর মর্যাদাকে বাড়িয়ে দেন এবং তাঁর প্রচেষ্টাকে যেনো সারা বিশ্বের মুসলিমদের জন্য বরকতের উৎস করে দেন।
ভাই মোহাম্মদ আল সিদ্দিক আল মালিযি (মালয়েশিয়া) তাঁর ফেইসবুক পোস্ট এ বলেন যেঃ
রমযানের দুই সপ্তাহ আগে যখন শায়েখের বইটা নিয়ে মসজিদে নববীর নিচে পার্ক করা তাঁর গাড়ির দিকে যাচ্ছিলাম, আমি আমাদের পরীক্ষা শেষে তাঁর বাড়িতে যাওয়ার অনুমতি চেয়েছিলাম। কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলে আমরা একটা তারিখ ঠিক করলাম।
এরপর আমি মসজিদে নববীতে তাঁর ক্লাস করতে থাকি। প্রথম সেমিস্টারের একদম শুরু থেকেই তিনি পড়ানো শুরু করেন। তিনি মুসতালাহ আল হাদীস বিষয়ে পড়াতেন যেখানে তিনি হাফিজ ইবনে কাসির (৭৭৪ হি.) এর ইখতিসার উলুমুল হাদীস বই থেকে পড়াতেন।
পরের সেমিস্টারে তিনি সহীহ বুখারি পড়ানো শুরু করেন। এটাতে আমাদের মাত্র এক খণ্ড বাকি ছিল। নিচে শায়েখের সংক্ষিপ্ত জীবনবৃত্তান্ত তুলে ধরা হলো যা নেওয়া হয়েছে তাঁর অতি সম্প্রতি প্রকাশিত কর্ম এবং বিশাল রচনা “আল জামিউল কামিল ফিল হাদীস আস সহীহুল শামিল” থেকে।
“তিনি হলেন মুহাম্মদ আব্দুল্লাহ আল আযমী, আবু আহমাদ, (প্রাতিষ্ঠানিকভাবে মুহাম্মদ জিয়াউর রহমান আল আযমী হিসেবেও পরিচিত)। তিনি হিজরি ১৩৬২ মুতাবেক ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি মদিনা ইসলামিক ইউনিভার্সিটি থেকে অনার্স এবং কিং আব্দুল আজিজ ইউনিভার্সিটি (বর্তমান নাম, উম্মুল কুরা ইউনিভার্সিটি), মক্কা শাখা থেকে মাস্টার্স ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি কায়রো’র আল আযহার ইউনিভার্সিটি থেকে ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেন। এরপর তিনি মদিনা ইসলামিক ইউনিভার্সিটি’র হাদীস অনুষদে প্রোফেসর হিসেবে নিযুক্ত হন। এছাড়াও তিনি মক্কা’র মুসলিম ওয়ার্ল্ড লীগসহ বিভিন্ন শিক্ষামূলক এবং প্রশাসনিক পদে নিযুক্ত হন। তিনি মদিনা ইসলামিক ইউনিভার্সিটি’র ডিন হন এবং অবসর নেওয়ার আগ পর্যন্ত উক্ত পদে বহাল থাকেন। এরপর তিনি সম্পুর্ণভাবে মুক্ত হয়ে গবেষণাকর্ম ও লিখনি চালিয়ে যান। তাঁর রচিত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ লিখনি হলো “আল জামিউল কামিল ফিল হাদীস আস সহীহুশ শামিল”। মসজিদে নববী’র প্রধানের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী হিজরি ২২/০২/১৪৩৫ তারিখে তিনি শিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত হন।
মাস্টার্স এ তাঁর গবষণার শিরোনাম ছিল “আবু হুরায়রা: তাঁর বর্ণনার আলোকে” যা ছিল হাদীসের উপর মোডারেট মুসলিম ও পাশ্চাত্যবাদিদের অভিযোগের বিরুদ্ধে এবং সাহাবীদের সমর্থনে একটি সফল প্রচেষ্টা। এই গবেষণা কর্মটির তত্ত্বাবধানে ছিলেন শায়েখ মুহাম্মদ মুসতফা আল আযমী যার রচিত গ্রন্থগুলির মধ্যে রয়েছে ‘On Schacht’s Origins of Muhammadan Jurisprudence’, ’The History of the Qur’anic Text’, Cambridge PhD thesis ‘Studies in Early Hadith Literature’ ইত্যাদি। এছাড়াও তিনি মুয়াত্তা মালিক এবং সহীহ ইবনে খুজাইমা’রও তাহকীক করেছেন। মৌলিক সমালোচনা এবং হাদীসের ব্যাপারে আমার আগ্রহ বৃদ্ধিতে তাঁর ভুমিকা অপরিসীম।
শায়েখ জিয়াউর রহমান আল আযমী’র ছাত্রদের মধ্যে ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক ইউনিভার্সিটি মালয়েশিয়া’র ড. আবু আল-লাইস অন্যতম যাকে তিনি মদীনায় অনার্স করার সময় শিক্ষাদান করেন।
এই মহৎ ব্যক্তি সম্পর্কে বলার মত লক্ষটা বিষয় আছে। কিন্তু আমি এখানে শায়েখ জিয়াউর রহমান আল আযমী’র ঐতিহাসিক কর্ম সম্পর্কে বলবো যেটা অভূতপূর্ব। নিচে রমজানের এক সপ্তাহ আগে শায়েখের বাড়িতে আমার আর শায়েখের কথোপকথনের কিছু অংশ তুলে ধরবো (অর্থ পরিষ্কার করার জন্য সামান্য সংযোজন করা হবে)। আমরা বিভিন্ন বিষয়ের উপর কথা বলেছিলাম। এখানে শুধুমাত্র “আল জামিউল কামিল ফিল হাদীস আস সহীহুশ শামিল” এর সাথে সম্পর্কিত কথাগুলোই যথাসম্ভব সংক্ষিপ্ত ভাবে উল্লেখ করবো।
প্রশ্ন – ০১
আপনি কেনো “আল জামিউল কামিল ফিল হাদীস আস সহীহুশ শামিল” বইটি লিখেছেন?
উত্তরঃ
আমাদের (মুসলিম) প্রাথমিক উৎস দুইটি। কুরআন এবং সুন্নাহ। আমাদের সাথে কুরআন আছে। কিন্তু সুন্নাহ শত শত বই পুস্তকে বিক্ষিপ্তভাবে রয়েছে যার সহীহায়েন বা সহীহ বুখারি এবং সহীহ মুসলিম বাদে কিছু সহীহ, কিছু যঈফ। আর তাই আমার মনে হয় আমাদের উচিৎ এগুলো সব সংগ্রহ করে সহীহ হাদীসগুলোকে বাছাই করা। বিভিন্ন দেশ ভ্রমণের সময় আমাকে এই ব্যাপারে অনেকবার প্রশ্ন করা হয়েছে যেখানে আমি কুর’আন এবং সুন্নাহ থেকে আলোচনা করেছি। আমাকে প্রশ্ন করা হতঃ
আপনাদের (মুসলিমদের) কি সুন্নাহ’র উপর এমন কোনো বই আছে যা পূর্ণাংগ, বিস্তারিত এবং নির্ভুল? অর্থাৎ কুরআনের মত?
তখন আমি উত্তর দিতে গিয়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে যেতাম। আমার কিইবা বলার ছিলো? আমি উত্তরে বলতামঃ “না, আমাদের এমনটি নেই। তবে বিভিন্ন বই পুস্তকে সমস্ত হাদীস রয়েছে।”
এই উত্তরটা সন্তোষজনক নয়। এখান থেকেই আমি একটা ধারণা পেলাম। কেনো আমি বিভিন্ন বই থেকে সমস্ত সহীহ হাদীসগুলো বাছাই করে একটি বইয়ে জমা করছি না? আর তাই, গত পনের বছর ধরে আমি এই কাজটাই করছি।
প্রশ্ন – ০২
এই বইয়ে কত সংখ্যক হাদীস রয়েছে?
উত্তরঃ
আমার মনে হয় পুনরাবৃত্তিসহ পনের হাজারের বেশি হাদীস রয়েছে। সম্ভবত বিশ হাজার হবে। কিন্তু এতে সহীহ হাদীস রয়েছে বারো থেকে পনের হাজার। এতে আমি তিন হাজারের মত যঈফ হাদীস যোগ করেছি। কিন্তু সেটা করেছি শুধুমাত্র হাদীসগুলোর দুর্বলতা দেখানো এবং তা ব্যাখ্যা করার জন্য। এছাড়াও প্রতিটি অধ্যায়ে বিষয়ভিত্তিক কিছু বিখ্যাত/বহুল প্রচলিত যঈফ হাদীস এনেছি এবং সেগুলোর দুর্বলতা ব্যাখ্যা করেছি।
প্রশ্ন – ০৩
এই সহীহ হাদীসগুলো জমা করার কাজে কতগুলো হাদীস গ্রন্থের সাহায্য নিয়েছেন?
উত্তরঃ
এর কোনো সীমা নেই। যেকোনো বই থেকে যখনই জানতে পেরেছি হাদীসটা সহীহ, সেটাই নিয়েছি। আর আমরা সেটা জেনেছি প্রতিটা হাদীস নিয়ে সতর্কতার সাথে গবেষণা করে। আমরা শত-সহস্র ইসনাদ (বর্ণনা পরম্পরা) পড়েছি। আর এই বই, “আল জামিউল কামিল” এর হাদীসগুলো প্রায় ৩০০ হাজার ইসনাদের উপর গঠিত।
প্রশ্ন – ০৪
বইটি কবে নাগাদ পাওয়া যাবে?
উত্তরঃ
দারুসসালাম (প্রকাশক) অনুযায়ী এই রমজানেই পাওয়া যাবে। কিন্তু আমার সেটা মনে হয় না। তবে যেভাবেই হোক এটা হজ্জ্বের আগে বের হবে, ইনশাআল্লাহ্। আল্লাহ’র কাছে প্রার্থনা তিনি যেনো এটা কবুল করেন।
প্রশ্ন – ০৫
মোট কত খণ্ডে এই জামিউল কামিল বইটি সমাপ্ত?
উত্তরঃ
আমরা প্রকাশকদের কাছে ২০ খণ্ডে বইটি পাঠিয়েছিলাম। প্রতিটা খণ্ডে ৬০০-৭০০ পৃষ্ঠা করে রয়েছে। মুদ্রণজনিত কিছু সংযোজন শেষে তাঁরা এটি ১২ টি বিশাল খণ্ডে প্রকাশ করছে। গত দুই মাস ধরে আমরা এর সারাংশ লিখতে শুরু করে ৪ খণ্ডে তা শেষ করেছি। সংক্ষিপ্ত সংস্করণটিতে তাখরীজ (হাদীসটা আরও কোথায় কোথায় আছে) থাকবে না। শুধুমাত্র উদ্ধৃতির উল্লেখ থাকবে। ইসনাদ (বর্ণনা পরম্পরা) ও বাদ থাকবে। সংক্ষিপ্ত সংস্করণটি হবে ৪,৫০০ পৃষ্ঠার, যেখানে “আল জামিউল কামিল” প্রায় ১৪,০০০ পৃষ্ঠার।
প্রশ্ন – ০৬
এই সংক্ষিপ্ত সংস্করণটি কখন প্রকাশিত হবে?
উত্তরঃ
এটা প্রকাশিত হবে না। এটা শুধু অন্য ভাষায় অনুবাদ করার জন্য। আমরা এটি ইংরেজি, উর্দু এবং বাংলায় অনুবাদ করা শুরু করেছি। মুসলিমদের উচিৎ তারা যেন এটাকে তাদের নিজেদের ভাষায় অনুবাদ করে, কারণ জন সাধারণ স্বাভাবিকভাবেই “আল জামিউল কামিল” এর ২০ খণ্ড একত্রে বুঝে পড়তে পারবে না।
প্রশ্ন – ০৭
আমরা যদি “আল জামিউল কামিল” এর সংক্ষিপ্ত সংস্করণ অনুবাদ করতে চাই তাহলে কী করতে হবে?
উত্তরঃ
তোমার দেশের কোনো সংগঠন বা সংস্থার খোজ করো। তারা যদি এটা অনুবাদ করতে চায়, তাহলে আমরা তাদের কাছে এই বইয়ের একটা কপি পাঠাবো। তবে ঐ সংগঠন বা সংস্থাটি এমন হতে হবে যারা এটা অনুবাদ ও মুদ্রণ করতে সক্ষম। আমরা তাদেরকে এটা বিনামূল্যে দেবো এবং কোনো বিনিময় চাইবো না। আর এই বইয়ের গ্রন্থস্বত্ব সংরক্ষিত নয়। এটা প্রকাশের অধিকার সমস্ত মুসলিমদের।
প্রশ্ন – ০৮
এই “আল জামিউল কামিল” এ কীভাবে হাদীসগুলো জমা করেছেন? একটা সহীহ হাদীসও কি বাদ পড়েনি?
উত্তরঃ
আমরা পরিপূর্ণতার দাবি করি না। নিশ্চয়ই পরিপূর্ণতা কেবলমাত্র আল্লাহ’র জন্য। কিন্তু আমি এটা লেখা শেষ করেছি। এখনো গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছি এবং বার বার পূনর্পাঠ চালাচ্ছি। এটা হলো বইটার প্রথম সংস্করণ। এর দ্বিতীয় সংস্করণে কিছু যোগ হবে (যার প্রক্রিয়া চলছে)। আর তৃতীয় সংস্করণ হবে শেষ এবং চূড়ান্ত সংস্করণ, ঠিক ইমাম বুখারি’র মতো। তিনিও তাঁর বইয়ের তিনটিই সংস্করণ বের করেছিলেন। সুতরাং আমিও সেটাই করতে যাচ্ছি।
তিনি এমন একটা কাজ সম্পাদন করেছেন যা লক্ষ লক্ষ বছর ধরে কেউ ধারণাও করেন নি। আমার কাছে শায়েখের লেখা একটা প্রবন্ধ আছে যেটা তিনি বিভিন্ন লোকের সাথে তাঁর কথোপকথনগুলোকে বর্ণনা করে লিখেছিলেন যখন তিনি মদীনায় অনার্সের ছাত্র ছিলেন। আমি যদি সেটা অনুবাদ করার সময় পেতাম!
শায়েখ সম্পর্কে শায়েখ ইয়াসির কাজী বলেন:
শায়েখের যে বিষয়টা সত্যিই অভিভূত হওয়ার মত সেটা হচ্ছে, তিনি একটা হিন্দু পরিবারে জন্ম নিয়েছিলেন এবং একজন ধর্ম পালনকারী, উদ্দীপ্ত আর উৎসাহী হিন্দু হিসেবে বেড়ে উঠেছিলেন। অথচ তিনি তাঁর পেশা থেকে অবসর নেওয়ার আগ পর্যন্ত সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ ইসলামিক ইউনিভার্সিটির হাদীস অনুষদের ডিন ছিলেন (অবশ্য আযহার থেকে ডিগ্রিধারীরা বলবে যে, আযহারই হলো সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ। যাই হোক এটা আমাদের আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব। আমার মনে হয় মদীনা ইসলামিক ইউনিভার্সিটিই হলো সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ। আর সেটা না হলেও সেরা তিনের মধ্যে এটা আছে) ।
বলার অপেক্ষা রাখে না যে, ইসলামি বিশ্বে হাদীসের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুবই অসাধারণ। কারণ হাদীসের উপর স্নাতক ডিগ্রিধারী তেমন একটা দেখা যায় না। ইসলামের সবচেয়ে অগ্রসর বিজ্ঞান হলো হাদীস। বিশ্বের অধিকাংশ ইউনিভার্সিটিতেই কেবলমাত্র মাস্টার্স এবং পিএইচডি এর জন্য হাদীস বিভাগ রয়েছে। এক্ষেত্রে মদীনা ইসলামিক ইউনিভার্সিটি বিশেষ অবস্থানে রয়েছে। বিশ্বে মদীনাই অন্যতম ইউনিভার্সিটি যেখানে অনার্স লেভেলেই প্রকৃত অর্থে হাদীসের অনুষদ রয়েছে। শায়েখ হাদীস অনুষদের ডিন ছিলেন যিনি কিনা একসময় ধর্ম পালনকারী হিন্দু ছিলেন।
আলহামদুলিল্লাহ! আমি শায়েখের খুব কাছের ও একান্ত ছাত্র ছিলাম এবং তাঁর থেকে ইযাযত পেয়েছি। আমি প্রায়ই তাঁর বাড়িতে যেতাম এবং সরাসরিভাবে তাঁর কাছ থেকেই তাঁর জীবন কাহিনী জানতে চাইতাম। একদিন আমি বললাম, “শায়েখ, এতকিছু কীভাবে হলো?” তিনি তাঁর স্বভাবসুলভ অমায়িকতার সাথে পুরো গল্পটার সারমর্ম বললেন। তাঁর এবং অন্যান্যদের থেকে যেটা জেনেছি তা এখানে উল্লেখ করছিঃ
শায়েখ একটি ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন যেটা হিন্দুদের মধ্যে অভিজাত। তাঁকে ধার্মিক এবং উদ্দীপ্ত হিন্দু হিসেবে গড়ে তোলা হয়। তাঁকে মুসলিমদের অবজ্ঞা করতে শেখানো হয়েছিল আর তাঁর কোনো মুসলিম বন্ধু ছিল না। ব্রাহ্মণগণের অ-ব্রাহ্মণদের সাথে মেলামেশা করার অনুমতি ছিল না। তাঁকে ব্রাহ্মণ ব্যতীত অন্যদের থেকে সম্পুর্ণভাবে পৃথক এবং বিচ্ছিন্ন থাকার শিক্ষা দেওয়া হয়েছিলো।
ভারতে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর তিনি একজন মুসলিম রুমমেট পান। তিনি ঘৃণা, হিংসা-বিদ্বেষে বিশ্বাসী ছিলেন না। তাই তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন তাকে দাওয়াহ দেবেন এবং হিন্দু ধর্মে ধর্মান্তরিত করবেন। তাই তিনি সেই মুসলিম বন্ধুর ধর্ম সম্পর্কে পড়াশুনা করার সিদ্ধান্ত নিলেন। তিনি কুর’আন পড়তে শুরু করলেন এবং তারপর তিনি মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর জীবনী পড়েন। তিনি মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর জীবনী পড়ে মুগ্ধ হয়ে যান। তাই তিনি জানতে চান কীভাবে তিনি মহানবী (সাঃ) এর পূর্ণাঙ্গ জীবনী জানতে পারবেন। তখন তাঁকে হাদিসের বই পড়তে বলা হলো।
এটা পঞ্চাশের দশকের কথা এবং তিনি তখন ভারতে ছিলেন। তিনি জানতে চাইলেন, “হাদীস কী?” তাঁকে জানানো হলো মহানবী (সাঃ) এর কথাকে হাদীস বলে। তিনি যখন বইয়ের নাম জানতে চান তখন তাকে বলা হলো আরবিতে লেখা। তিনি জানতে চাইলেন কোথায় আরবি শিখতে পারবেন। তাকে বলা হলো তাকে বিদেশে গিয়ে ইউনিভার্সিটিতে লেখাপড়া করতে হবে আর আরবি শিখার অনুমোদন পাওয়ার জন্য তাকে মুসলিম হতে হবে।
তিনি বুঝতে পারলেন যে, ইসলামে যৌক্তিকতা আছে। আর তাই তিনি ইসলাম গ্রহণ করলেন যাতে করে বিদেশে গিয়ে আরবি শিখে হাদীস অধ্যয়ন করতে পারেন। পঞ্চাশের দশকের শেষ এবং ষাটের দশকের শুরুতে তাঁকে বলা হয় যে, সম্প্রতি মদীনায় একটি ইউনিভার্সিটি খোলা হয়েছে। তাকে সেখানে আবেদন করতে বলা হলো যাতে হয়তো তারা তাঁকে আরবি শেখাবে এবং তিনি হাদীস অধ্যয়ন করতে পারবেন। তিনি নও মুসলিম হিসেবে আবেদন করেন প্রথম ব্যাচেই পড়ার সুযোগ পান। হিন্দু থেকে ধর্মান্তরিত প্রথম মুসলিম তিনি, যিনি মদীনায় পড়াশুনার সুযোগ পান।
তিনি মদীনায় পড়াশুনা শুরু করেন এবং অনেক বড় বড় শায়েখের (শায়েখ বিন বায রহঃ, শায়েখ আল শানক্বিতী রহঃ এবং অন্যান্য) সংস্পর্শে আসেন। তিনি তাঁর শ্রেণীতে সবচেয়ে ভালো রেজাল্ট করে অনার্স ডিগ্রী লাভ করেন। তিনি শায়েখ বিন বাজের নিকট যান এবং আরো বেশি পড়াশুনা করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। শায়েখ বিন বাজ তখন বলেন যে, তাঁদের মদীনা ইউনিভার্সিটিটি নতুন এবং সেখানে শুধুমাত্র অনার্স কোর্স চালু আছে। তাই তাঁকে অন্যত্র গিয়ে পড়াশুনা করতে হবে।
তিনি জানতে চাইলেন তিনি কোথায় যাবেন। শায়েখ বিন বাজ তাঁকে বলেন যে, ঐ সময় ঐ রকম ইউনিভার্সিটি ছিল একমাত্র মিশরের আল আযহার ইউনিভার্সিটি। ষাটের দশকে মদীনা থেকে অনার্স ডিগ্রি নিয়ে আল আযহার এ যান। তিনি মদীনা ইউনিভার্সিটির প্রথম স্নাতকদের অন্যতম যারা আল আযহার থেকে মাস্টার্স এবং পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেছে। তাঁর পিএইচডিকে বলা হয় “আবু হুরায়রার সমর্থনে”। ষাটের দশকের দিকে আবু হুরায়রাকে সমালোচনার মাধ্যমে হাদিসের প্রকৃতি নিয়ে সমালোচনা করা হত।
তিনি তখন এতই সুপিরিচিত ব্যক্তিত্ব ছিলেন যে, তাঁকে মদীনায় একজন প্রোফেসর হিসেবে আনা হয়। প্রোফেসর হিসেবে যোগদানের জন্য তাঁর সৌদি’র নাগরিক হওয়ার প্রয়োজন পড়ে। তাই শায়েখ সৌদি’র বাদশাহ’র কাছে চিঠি লেখেন যাতে তাঁকে সৌদি’র নাগরিকত্ব দেওয়া হয়। এভাবে শায়েখ সৌদি’র নাগরিকত্ব পান।
১৯৭৩/৭৪ সালে মদীনায় হাদীস অনুষদ খোলা হয় আর তাঁর পিএইচডিও ছিলো হাদীসের উপর। তিনি হাদীস অনুষদের সহকারী প্রোফেসর হিসেবে নিযুক্ত হন। পরবর্তি বিশ বছরে তাঁর পদমর্যাদা উন্নিত হয়। তিনি সিনিয়র পদের প্রোফেসর এবং ডিন হন।
____________
উৎসঃ Al Jamiul Kamil – Muhaddith Ziaur Rahman Madani Al Hindi
সংকলনঃ ওমর ইবনে সেলীম | অনুবাদঃ মুজাহিদুল ইসলাম স্বাধীন
সম্পাদনাঃ সত্যান্বেষী রিসার্চ টীম