ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল (রহঃ)-এর উপর নির্যাতন
ভূমিকা : ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল (রহঃ) একটি নাম, একটি ইতিহাস। যুগে যুগে হক্ব প্রচারে যারা রাষ্ট্রীয় নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল (রহঃ) অন্যতম। তিনি পরম ধৈর্যের সাথে সকল নির্যাতন সহ্য করেছিলেন। তার নির্যাতন-নিপীড়নের ঘটনা থেকে মুসলিম উম্মাহর জন্য অনেক শিক্ষণীয় বিষয় রয়েছে। বিশেষকরে যারা কঠিন মুহূর্তে দিশেহারা হয়ে যান এবং সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করাকেই একমাত্র সমাধান মনে করেন তাদের জন্য ইমাম আহমাদের জেল-যুলুমের ইতিহাস পাঠ করা যরূরী।
ইমাম আহমাদ (রহঃ) ১৬৪ হিজরীর রবীউল আউয়াল মাসে জন্মগ্রহণ করেন। মাত্র ৩ বছর বয়সে তাঁর পিতা মৃত্যুবরণ করেন। অতঃপর তাঁর মা তাঁকে লালন-পালন করেন।[1] তিনি প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করে মাত্র ষোল বছর বয়সে হাদীছ অনুসন্ধানে কূফা, বছরা, শাম প্রভৃতি দেশে ভ্রমণ করেন।[2]
ইমাম আহমাদের উপর রাষ্ট্রীয় বা সরকারী নির্যাতন :
‘কুরআন আল্লাহর সৃষ্টি’ দাবীর বিরোধিতা করায় ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল (রহঃ)-কে রাষ্ট্রীয়ভাবে চরম নির্যাতনের স্বীকার হ’তে হয়েছিল। এটি ছিল কুরআন-সুন্নাহ বিরোধী আক্বীদা, যার বিরুদ্ধে ইমাম আহমাদ কঠোর ও অনড় অবস্থান নিয়েছিলেন। মূলতঃ কুরআন হ’ল আল্লাহর কালাম। এটা সৃষ্ট নয়।
নির্যাতনের বিবরণ :
হাফেয ইবনু কাছীর (রহঃ) লিখেছেন, ‘খলীফা মামূন[3] বাগদাদের প্রতিনিধি ইসহাক্ব বিন ইবরাহীম বিন মু‘ছআবকে পত্র মারফত নির্দেশ দেন যে, তিনি যেন মানুষকে ‘খলকে কুরআন’-এর দিকে আহবান জানান। পত্র পেয়ে ইসহাক্ব বিন ইবরাহীম একদল হাদীছ বিশারদকে তলব করে তাদেরকে খলকে কুরআনের প্রতি সমর্থন করার আহবান জানান। কিন্তু তারা তা প্রত্যাখ্যান করেন। ইসহাক্ব বিন ইবরাহীম তাদেরকে প্রহার ও ভাতা বন্ধ করে দেয়ার হুমকি দেন। ফলে তাদের অধিকাংশ অনিচ্ছা সত্ত্বেও তাতে সমর্থন ব্যক্ত করেন। কিন্তু ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল ও মুহাম্মাদ বিন নূহ আল-জুনদ তাদের মতের উপর অটল থাকেন। ফলে খলীফার নির্দেশে দু’জনকে এক উটে চড়িয়ে খলীফার নিকট পাঠিয়ে দেওয়া হয়। তখন তারা দু’জন শৃঙ্খলাবদ্ধ ছিলেন।
তার সাথী মুহাম্মাদ বিন নূহ (রহঃ) পথিমধ্যেই মারা যান। ইমাম আহমাদ (রহঃ) তাঁর জানাযা পড়ান। কয়েদখানায় ইমাম আহমাদ পায়ে বেড়ি বাঁধা অবস্থায় কয়েদীদের ছালাতে ইমামতী করতেন। ইতিমধ্যে খলীফা মামূন মারা যান এবং মু‘তাছিম বিল্লাহ খলীফা হন।[4]
খলীফা মু‘তাছিম বিল্লাহর[5] (১৮০-২২৭ হিঃ) আমলে ইমাম আহমাদের উপরে নির্যাতন :
ইমাম আহমাদকে কয়েদখানা হ’তে বের করে খলীফা মু‘তাছিম-এর সম্মুখে উপস্থিত করা হয়। ইমাম আহমাদ বলেন, ‘আমি শিকলগুলোর জন্য হাঁটতে পারছিলাম না। আমি মু‘তাছিমের ভবনে উপস্থিত হ’লাম। আমাকে একটি ঘরে ঢুকিয়ে দেয়া হ’ল। সেখানে কোন বাতি ছিল না। আমি ওযূ করার জন্য মনস্থ করলাম। হাত বাড়িয়ে পানি ভর্তি একটি পাত্র পেলাম। আমি তা দ্বারা ওযূ করলাম। তারপর ছালাতের জন্য দাঁড়ালাম। কিন্তু কিবলা ঠিক করতে পারলাম না। ভোর হ’লে বুঝতে পারলাম যে আমি কিবলামুখী হয়েই ছালাত আদায় করেছি। আল-হাম্দুলিল্লাহ।
পরের দিন মু‘তাছিম বিল্লাহ আব্দুর রহমান নামের একজনকে বললেন, তুমি তার সাথে কথা বল। আব্দুর রহমান আমাকে বললেন, কুরআনের ব্যাপারে আপনার অভিমত কি? আমি বললাম, ইলম সম্পর্কে আপনার অভিমত কি? তিনি নিশ্চুপ রইলেন। আমি বললাম, পবিত্র কুরআন আল্লাহর জ্ঞান বিশেষ। আর যে ব্যক্তি বিশ্বাস করল যে, আল্লাহ মাখলূক, সে আল্লাহ্কে অস্বীকার করল। আব্দুর রহমান বলল, আল্লাহ ছিলেন। কিন্তু কুরআন ছিল না। আমি বললাম, আল্লাহ ছিলেন কিন্তু তাঁর ইলম ছিল না। এবার তিনি চুপসে গেলেন। এভাবে দীর্ঘ তর্ক-বিতর্ক চলল।
তারপর দ্বিতীয় ও তৃতীয় দিনও তারা ইমাম আহমাদের সাথে বির্তক করে। প্রতিটি ক্ষেত্রেই ইমাম আহমাদের কন্ঠ সুউচ্চ ছিল এবং তাঁর দলীল তাদেরকে পরাজিত করে। বিতর্কে নানা বিষয়ে আলোচনা হয়। কিন্তু পবিত্র কুরআন-সুন্নাহর উদ্ধৃতি দেয়ার মত যোগ্যতা তাদের কারো ছিল না। আলোচনার মধ্যে খলীফা বলেন, আহমাদ! আপনি প্রশ্নের জবাব দিন। আমি বললাম, হে আমীরুল মুমিনীন! তারা আমার সামনে মহান আল্লাহর কিতাবের একটি আয়াত বা রাসূল (ছাঃ)-এর একটি হাদীছ পেশ করুক। আমি তাদেরকে জবাব দিব। অবশেষে তাঁর দলীল-প্রমাণের সাথে পেরে না উঠে তারা খলীফাকে উত্তেজিত করে তুলল এই বলে যে, হে আমীরুল মুমিনীন! লোকটি কাফের ও বিভ্রান্ত-বিভ্রান্তকারী।
তাদের উস্কানিতে খলীফা ক্রোধান্বিত হ’লেন। ইমাম আহমাদ বলেন, ‘খলীফা আমাকে বললেন, আল্লাহ তোমাকে অভিশপ্ত করুন। আমি আশা করেছিলাম, তুমি আমার প্রশ্নের জবাব দিবে। কিন্তু তুমি কোন জবাব দিলে না। তারপর বললেন, একে ধরে বিবস্ত্র করে ফেল। তারপর (মাটিতে) হেঁচড়াও’।
ইমাম আহমাদ বলেন, আমাকে তারা বিবস্ত্র করে ফেলল এবং মাটিতে হেঁচড়াল। আমি চরম নির্যাতনের শিকার হ’লাম। আমি বললাম, আমীরুল মুমিনীন! মহান আল্লাহ্কে ভয় করুন। আল্লাহ্কে ভয় করুন। রাসূল (ছাঃ) বলেছেন,لاَ يَحِلُّ دَمُ امْرِئٍ مُسْلِمٍ يَشْهَدُ أَنْ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ ‘যে মুসলিম সাক্ষ্য দেয় যে, আল্লাহ ব্যতীত কোন উপাস্য নেই, তার রক্ত প্রবাহিত করা হালাল নয়’।[6] এমতাবস্থায় আপনি কিসের ভিত্তিতে আমার রক্তকে হালাল ভাবছেন, অথচ আমি তো সেরূপ কোন অপরাধ করিনি? হে আমীরুল মুমিনীন! স্মরণ করুন, আজ আমাকে যেমন আপনার সামনে দাঁড়াতে হয়েছে, তেমনি আপনাকেও একদিন আল্লাহর সামনে দাঁড়াতে হবে। মনে হ’ল, একথা শুনে তিনি থমকে গেলেন। কিন্তু খলীফার পাশে থাকা লোকেরা বলতে লাগল, আমীরুল মুমিনীন! নিশ্চয়ই লোকটি ভ্রান্ত, বিভ্রান্তকারী ও কাফের। ফলে খলীফা আমাকে নানা রকম শাস্তি দিতে লাগলেন। জল্লাদদের আনা হ’ল। তারা একেকজন আমাকে দু’টি করে চাবুক মারতে শুরু করল। একজন দু’টি চাবুক মেরে সরে যাচ্ছে, আর অপরজন এসে অনুরূপ দু’টি চাবুক মারছে। তারা আমাকে আঘাতে আঘাতে জর্জরিত করে ফেলে। আমি কয়েকবার বেহুঁশ হয়ে পড়ি। আঘাত থেমে গেলে আমার চেতনা ফিরে আসে। মু‘তাছিম তার মতাদর্শ গ্রহণ করার আহবান জানাচ্ছেন। কিন্তু আমি তার আহবানে সাড়া দিলাম না। তারা পুনরায় প্রহার করতে শুরু করে। খলীফা তৃতীয়বারের মত আমার নিকটে এসে আহবান জানালেন। কিন্তু বেদম প্রহারের চোটে আমি তার বক্তব্য বুঝতে পারিনি। তারা আবারো আমাকে মারতে শুরু করে দিল। আমি বেহুঁশ হয়ে গেলাম। আমি প্রহারও অনুভব করতে পারছিলাম না। খলীফা ভয় পেয়ে যান এবং আমাকে ছেড়ে দিতে নির্দেশ করেন। এটা ছিল ২২১ হিজরীর ২৫শে রমযানের ঘটনা।
এরপর খলীফা ইমাম আহমাদকে মুক্তি দিয়ে দেন। সেদিন ইমাম আহমাদ বিন হাম্বলকে ত্রিশের অধিক চাবুক মারা হয়। কেউ বলেন, আশিটি। কিন্তু আঘাত ছিল বেদম ও তীব্র।
ইমাম আহমাদ বিন হাম্বলকে যখন দারুল খেলাফত হ’তে ইসহাক্ব বিন ইবরাহীমের গৃহে নিয়ে যাওয়া হ’ল, তখন তিনি ছায়েম ছিলেন। ছিয়াম ভেঙ্গে দুর্বলতা দূর করার জন্য তাকে ছাতু এনে দেয়া হয়। কিন্তু তিনি ছিয়াম ভাঙ্গতে অস্বীকার করেন এবং ছিয়াম পূর্ণ করেন। যোহরের সময় তিনি লোকদের সাথে ছালাত আদায় করলেন।
বর্ণিত আছে যে, ইমাম আহমাদকে যখন প্রহার করার জন্য দাঁড় করানো হয় তখন তাঁর পায়জামার ফিতা ছিঁড়ে গিয়েছিল। তিনি শংকিত হয়ে পড়লেন পায়জামা খসে পড়ে যায় কি না। তাই তিনি সতর ঢেকে নিয়ে আল্লাহর কাছে দো‘আ করলেন। ফলে মহান আল্লাহ তাঁর পায়জামা পূর্বের ন্যায় করে দেন। আরো বর্ণিত আছে যে, তিনি বলেছিলেন, হে সাহায্যপ্রার্থীদের সাহায্যকারী! হে বিশ্বজগতের মা‘বূদ। তুমি যদি জেনে থাকো, আমি তোমারই সন্তুষ্টি লাভে সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত আছি তাহ’লে আমার ইযযত ক্ষুন্ন হ’তে দিও না।[7]
নিজ গৃহে প্রত্যাবর্তন ও চিকিৎসা গ্রহণ :
নিজ গৃহে ফিরে আসার পর চিকিৎসক এসে তার দেহ হ’তে থেতলে যাওয়া নষ্ট গোশত কেটে ফেলেন এবং তাঁর চিকিৎসা করতে থাকেন। খলীফার প্রতিনিধি ইমাম আহমাদের খোঁজ-খবর রাখছিলেন। আল্লাহ তাঁকে সুস্থতা দান করার পর তিনি কিছুদিন জীবিত থাকেন। যারা তার উপর অত্যাচার চালিয়েছিল তন্মধ্যে বিদ‘আতীদের ব্যতীত তিনি সবাইকে ক্ষমা করে দিয়েছিলেন। এ প্রসঙ্গে তিনি কুরআনের নিম্নোক্ত আয়াতটি তেলাওয়াত করতে থাকেন- وَلْيَعْفُوْا وَلْيَصْفَحُوْا ‘তারা যেন তাদের ক্ষমা করে এবং তাদের দোষ-ত্রুটি উপক্ষো করে’ (নূর ২৪/২২)।
নির্যাতনের পর ইমাম আহমাদের অবস্থান :
দারুল খেলাফত হ’তে ইমাম আহমাদ নিজ বাড়িতে ফিরে এসে অবস্থান করতে থাকেন। নিজ সম্পদ থেকে প্রতি মাসে প্রাপ্ত মাত্র সতের দিরহাম দিয়ে পরিবার-পরিজনের জন্য ব্যয় নির্বাহ করতেন এবং তাতেই তুষ্ট থাকতেন।[8]
এরপর খলীফা মুতাওয়াক্কিল[9] যখন খেলাফতের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তিনি নির্যাতনের ধারা তুলে নেন। কিন্তু ইবনুল বালখী নামক এক বিদ‘আতী খলীফার নিকটে নালিশ করল যে, ইমাম আহমাদ বিন হাম্বলের আশ্রয়ে জনৈক ব্যক্তি গোপনে লোকদের থেকে বায়‘আত নিচ্ছে। ফলে খলীফার নির্দেশে রাতে আহমাদ বিন হাম্বলের ঘরে তল্লাশী চালানো হয়। খলীফার লোকেরা ইমাম ছাহেবের গৃহে তল্লাশী করে বুঝতে পারে যে, ইমাম আহমাদের উপরে অপবাদ দেয়া হয়েছে।
খলীফা মুতাওয়াক্কিল-এর নিকটে যখন এ সংবাদ গেল এবং জানতে পারলেন যে, ইমাম আহমাদ নির্দোষ, তখন তিনি দশ হাযার দিরহাম ইমাম আহমাদের নিকটে প্রেরণ করেন। কিন্তু ইমাম আহমাদ মুদ্রাগুলি গ্রহণ করতে অস্বীকার করলেন। খলীফার দূত ইয়াকূব বিন ইবরাহীম বললেন, ‘হে আবূ আব্দুল্লাহ![10] মুদ্রাগুলি গ্রহণ করাই আপনার জন্য কল্যাণকর মনে করছি’। এই বলে তিনি দিরহামগুলি ইমাম আহমাদের নিকটে রেখে চলে গেলেন।
ইমাম আহমাদ মুদ্রাগুলি দরিদ্রদের মাঝে বণ্টন করে দেন। এমনকি তিনি একটি দিরহামও রাখেননি। মুদ্রাগুলি যে থলেতে ছিল তিনি সেটাও দান করে দেন। অথচ তার পরিবারের লোকজন তখন চরম অভাব-অনটনে জীবন যাপন করছিল।
খলীফা মুতাওয়াক্কিল ইমাম আহমাদকে তার নিকটে যাওয়ার জন্য বলেন। বিষয়টি ইমাম আহমাদকে অবহিত করা হ’ল। ইমাম আহমাদ বললেন, আমি বৃদ্ধ ও দুর্বল। কিন্তু খলীফা পুনরায় সংবাদ পাঠালেন যে, যেকোন প্রকারেই হোক তাঁকে আমার কাছে আসতেই হবে।
অসুস্থতা সত্ত্বেও ইমাম আহমাদ ছেলে ও এক স্ত্রীকে নিয়ে খলীফার দরবারে পৌঁছলেন। শীর্ষনেতৃবর্গ প্রতিদিন ইমাম আহমাদের নিকট উপস্থিত হয়ে খলীফার সালাম পৌঁছাতেন। খলীফা তার নিকট উক্ত গৃহের উপযোগী কোমল বিছানা ও অন্যান্য সরঞ্জামাদী পাঠিয়ে দেন। খলীফা প্রতিদিন তাঁর নিকটে ঝুড়ি ভর্তি রকমারী খাদ্য, ফল-ফলাদি ও বরফ পাঠিয়ে দিতেন। খলীফা ভাবতেন, তিনি তা থেকে আহার করছেন। কিন্তু ইমাম আহমাদ তা থেকে কিছুই খেতেন না। বরং তিনি লাগাতার ছিয়াম রাখতেন। এভাবে কোন খাদ্য গ্রহণ না করে তিনি আটদিন অবস্থান করেন। এছাড়াও তিনি ছিলেন অসুস্থ। ওবায়দুল্লাহ বিন ইয়াহ্ইয়া বিন খাকান খলীফার পক্ষ থেকে উপঢৌকন হিসাবে বিপুল সম্পদ নিয়ে উপস্থিত হন। কিন্তু ইমাম আহমাদ সেগুলি গ্রহণ করতে অস্বীকার করেন। ওবায়দুল্লাহ বিন ইয়াহ্ইয়ার পীড়াপীড়ি সত্ত্বেও তিনি তা গ্রহণ করলেন না। অগত্যা আমীর সম্পদগুলি নিজ হাতে ইমাম আহমাদের পরিবার-পরিজনের মাঝে বণ্টন করে দেন।
খলীফা তাঁর জন্য প্রতি মাসে চার হাযার দিরহাম নির্ধারিত করে ভাতা চালু করলে ইমাম আহমাদ (রহঃ) খলীফাকে নিষেধ করেন। তিনি তার পরিবারকে বলেন, ‘আমার আর অল্প কটা দিন বাকী। আমার মরণ চলে এসেছে। তারপর হয়ত জান্নাতে যাব বা জাহান্নামে যাব। আমরা কি এমন অবস্থায় দুনিয়া থেকে যাব যে আমাদের পেট এসব সম্পদ গ্রহণ করেছে’। কিন্তু পরিবারের লোকেরা ছহীহ হাদীছের মাধ্যমে তার বিপক্ষে দলীল দেন যে, ‘প্রার্থনা ও মোহ ব্যতীত এই সম্পদ থেকে যা কিছু তোমার নিকট আসবে, তা তুমি গ্রহণ করবে’।[11]
তাছাড়া তারা এই যুক্তিও পেশ করে যে, ইবনু ওমর ও ইবনু আববাস (রাঃ) বাদশাহর হাদিয়া গ্রহণ করেছেন। জবাবে তিনি বললেন, ‘এটা আর ওটা সমান নয়। আমি যদি জানতাম যে, এই সম্পদ যোর-যুলুম ব্যতীত বৈধভাবে সংগৃহীত হয়েছে, তাহ’লে আমি পরওয়া করতাম না’।[12]
রোগবৃদ্ধি :
ইমাম আহমাদ বিন হাম্বলের দুর্বলতা বাড়তে থাকে। খলীফা ডাক্তার প্রেরণ করেন। ডাক্তার বললেন, ‘আমীরুল মুমিনীন! তার রোগ হ’ল খাদ্যের স্বল্পতা এবং ছিয়াম ও ইবাদতের আধিক্য। তারপর খলীফার মা ইমাম আহমাদকে দেখার জন্য তার নিকটে আবেদন পাঠালেন। ইমাম আহমাদ প্রথমে অপরাগতা প্রকাশ করলেও পরে এই আশায় সম্মতি প্রদান করেন যে, তাতে হয়ত তিনি তাড়াতাড়ি বাগদাদে ফিরে যেতে পারবেন। ইমাম আহমাদের নির্দেশে একটি খচ্চর নিয়ে আসা হ’ল। ইমাম আহমাদ তাতে আরোহণ করে খলীফার মজলিসে এসে উপস্থিত হ’লেন।
খলীফার মা বললেন, বৎস! এই লোকটির ব্যাপারে মহান আল্লাহ্কে ভয় কর। তুমি লোকটাকে তার পরিজনের কাছে ফিরিয়ে দাও।
খলীফা তাকে চলে যাওয়ার অনুমিত দেন এবং তার জন্য একটি জাহায প্রস্ত্তত করেন। কিন্তু ইমাম আহমাদ তাতে আরোহণ করতে অস্বীকৃতি জানান। তিনি একটি ছোট নৌকায় চড়ে গোপনে বাগদাদে প্রবেশ করেন। ইমাম আহমাদ কিছুদিন যাবত খলীফা ও তার লোকদের সাথে মেলামেশার জন্য আক্ষেপ করতে থাকেন এবং বলতে থাকেন, আমার জীবনের দীর্ঘ সময় তাদের থেকে নিরাপদ ছিলাম। কিন্তু শেষ বয়সে এসে বিপদগ্রস্ত হ’লাম।
খলীফার নিকট থাকাকালে ইমাম আহমাদ তীব্র অনাহারে কাতর হয়ে পড়েছিলেন এবং মৃত্যুমুখে পতিত হওয়ার উপক্রম হয়েছিলেন। এরপরও তিনি খলীফার দেয়া কোন খাদ্য ও উপহার গ্রহণ করেননি। ইমাম আহমাদের পুত্র আব্দুল্লাহ বিন আহমাদ বলেন, আববাজান ছামুর্রা থেকে ফিরে আসার পর আমরা দেখতে পেলাম, তার চক্ষুদ্বয় কোটরে ঢুকে গেছে। ছয় মাসের আগে সুস্থ ও সতেজ হননি।[13]
মৃত্যু :
২৪১ হিজরীতে রবীউল আউয়াল মাসের জুম‘আর দিনে এই মহান মুজতাহিদ, সুন্নাতের ধারক ও হাদীছের রক্ষক আল্লাহর ডাকে সাড়া দিয়ে জগতবাসীকে কাঁদিয়ে পরপারের যাত্রী হন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৭ বছর। তাঁর মৃত্যুতে মানুষের এত ভিড় হয়েছিল যে, রাজপথ সব বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।[14]
খলীফা তাঁর জন্য কাফনের কাপড় পাঠালে ইমাম ছাহেবের ছেলেরা তা গ্রহণে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করেন। কেননা ইমাম আহমাদ জীবদ্দশায় খলীফার কোন কিছু গ্রহণ করতেন না। বরং তার ছেলেরা একটি কাপড়ের ব্যবস্থা করেন, যা ইমাম ছাহেবের বাড়ির চাকরাণী বুনন করেছিল। তাঁর জানাযায় বিপুল সংখ্যক লোকের সমাগম হয়েছিল বিধায় একাধিকবার তার জানাযা অনুষ্ঠিত হয়।[15]
শিক্ষণীয় বিষয়সমূহ :
উপরোক্ত ঘটনা থেকে নিম্নরূপ শিক্ষা মেলে-
(১) ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল (রহঃ) সুন্নাতের ধারক-বাহক হওয়ায় নিদারুণ কষ্ট সহ্য করেছিলেন। তারপরও তিনি হক্ব হ’তে বিন্দুমাত্র হটে যাননি।
(২) নিজেদের স্বার্থ হাছিলের জন্য বিদ‘আতীরা সরকারের অনুগামী গোলাম হয়ে থাকে। নিজেদের স্বার্থে তারা সুন্নাত ও সুন্নাতের বাহককে দুনিয়া হ’তে বিদায় দিতেও কোনরূপ দ্বিধা করে না।
(৩) শাসক শ্রেণী কর্তৃক ইমাম ও শীর্ষস্থানীয় আলেমগণ নির্যাতিত হয়েছেন। যা আজও অব্যাহত আছে।
(৪) ইমাম আহমাদের লাখো সমর্থক থাকা সত্ত্বেও তিনি ছবর করেছেন। তিনি চরম ধৈর্যের মাধ্যমে খলীফার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা থেকে বিরত থেকেছেন।
(৫) আজকে যারা অধৈর্য হয়ে মুসলিম সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করছে তাদের উচিৎ ইমাম আহমাদের জীবনী থেকে শিক্ষা গ্রহণ করা।
(৬) যালেম সরকারের হাতে এক সময় ক্ষমতা থাকলেও শেষে তাদেরই পরাজয় ঘটে।
উপসংহার :
আল্লাহ আমাদেরকে ইমাম আহমাদের জীবনী হ’তে শিক্ষা গ্রহণে তাওফীক্ব দান করুন। আর আমাদেরকে বিপদে-আপদে ছবর করার তাওফীক্ব দিন। অন্যদিকে শাসকদেরকে হেদায়াত দান করুন, যেন তারা প্রকৃত আলেমদেরকে যথাযথভাবে সম্মান করতে পারেন-আমীন!
– আহমাদুল্লাহ / সৈয়দপুর, নিলফামারী।
[1]. ইবনু খাল্লিকান, ওফায়াতুল আ‘ইয়ান ক্রমিক ২০, ১/৬৪; ইবনু কাছীর, আল-বিদায়াহ ওয়ান-নিহায়াহ ১০/৩৫৯; হাফেয মিযযী, তাহযীবুল কামাল ফী আসমাইর রিজাল, ক্রমিক ৯৬, ১/৪৩৭; হাফেয যাহাবী, তাযকিরাতুল হুফফায ক্রমিক ৪৩৮, ২/১৫।
[2]. তাহযীবুল কামাল ফী আসমাইর রিজাল ক্রমিক ৯৬, ১/৪৩৭।
[3]. আবুল আববাস আব্দুল্লাহ বিন হারূণুর রশীদ বিন মুহাম্মাদ মাহদী বিন আবূ জা‘ফর মনছূর আববাসী। তিনি ১৭০ হিজরীতে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি আববাসীয় ৫ম খলীফা হারূণুর রশীদের পুত্র ছিলেন। তার মায়ের নাম ছিল মারাজিল। তিনি ১৮৯ হিজরীতে খলীফা হিসাবে বায়‘আত নেন। তিনি ২১৮ হিজরীতে মারা যান। দ্রঃ হাফেয যাহাবী, সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা, ক্রমিক ১৬০৯, ১০/২৭২-২৯০; তারীখে বাগদাদ, ক্রমিক ৫৩৩০, ১০/১৮১।
[4]. আল-বিদায়াহ ওয়ান-নিহায়াহ ১০/৩৬৫, ৩৬৬; ইফাবা ১০/৫৬০-৬২।
[5]. তার নাম আবূ ইসহাক্ব মুহাম্মাদ ইবনু রশীদ হারূন বিন মুহাম্মাদ মাহদী বিন মানছূর আববাসী। তিনি ১৭০ হিজরীতে জন্ম গ্রহণ করেন এবং ২২৭ হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেন। খলীফা হারূণুর রশীদ তার পিতা ছিলেন। মায়ের নাম মারিদাহ। তিনি খলীফার দাসী ছিলেন। খলীফা মামূন ছিলেন তার সৎ ভাই ছিলেন (দ্রঃ সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা, ক্রমিক ১৬১০, ১০/২৯০-৩০৬)।
[6]. মুসলিম হা/১৬৭৬।
[7]. ইবনুল জাওযী, মানাকিবুল ইমাম আহমাদ পৃঃ ৫২২-৩৯; আল-বিদায়াহ ওয়ান-নিহায়াহ ১০/৩৬৯।
[8]. ঐ, ১০/৩৭১।
[9]. তিনি খলীফা মু‘তাছিমের পুত্র। তাঁর মায়ের নাম শুজা। তিনি ২০৫ হিজরীতে জন্মগ্রহণ করেন এবং ২৪৭ হিজরীতে নিহত হন। তিনি সুন্নাতের প্রচারক ছিলেন। তিনি খলকে কুরআনের ফেতনাকে কঠোরহস্তে দমন করেন। দ্রঃ সিয়ারু আলামিন নুবালা, ক্রমিক ১৯৭০, ৯/৪৪৪; ওফায়াতুল আ‘ইয়ান ১/৩৫০।
[10]. ইমাম আহমাদের পুত্রের নাম আব্দুল্লাহ। সেজন্য তাকে আবূ আব্দুল্লাহ উপনামে ডাকা হয়।
[11]. বুখারী হা/১৪৭৩; মুসলিম হা/১০৪৫; নাসাঈ হা/২৬০৭।
[12]. আল-বিদায়াহ ওয়ান-নিহায়াহ ১০/৩৭১, ৩৭৩।
[13]. মানাক্বিবুল ইমাম আহমাদ পৃঃ ৫৪০-৪৯; আল-বিদায়াহ ওয়ান-নিহায়া ১০/৩৭৩-৩৭৪।
[14]. তাযকিরাতুল হুফফায, ক্রমিক ৪৩৮, ২/১৬; বিস্তারিত দ্রঃ আব্দুল গনী আদ-দাক্কার, ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল পৃঃ ২৯৮; মানাক্বিবুল ইমাম আহমাদ পৃঃ ৫৪০।
[15]. আল-বিদায়াহ ওয়ান-নিহায়াহ (ইফাবা) ১০/৫৭৫-৭৮ দ্রঃ।