আল্লাহর সঙ্গে সাক্ষাৎ
আল্লাহ এক, অদ্বিতীয় ও অকল্পনীয় সত্তা। তাঁর সৌন্দর্যের কোন তুলনা নেই। তাঁর অবয়বের বর্ণনা দেয়ার কোন ক্ষমতা কারো নেই। তাঁকে কেউ কোন দিন দেখেনি। তিনি একমাত্র মহাপবিত্র সত্তা, তাঁর সত্তার সঠিক বা আনুমানিক বর্ণনা দেয়ার কোন অবকাশ নেই। তাঁর সুন্দর সুন্দর নাম, সৌন্দর্য, পবিত্রতা ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ প্রভৃতির বর্ণনা রয়েছে পবিত্র কুরআনে। এগুলো মহাজ্ঞানী মহান আল্লাহর সত্তার সুনিশ্চিত প্রমাণ।
যারা আল্লাহর অস্তিত্ব নিয়ে সন্দেহ পোষণ করে কিংবা আল্লাহর কোন আকার নেই (নিরাকার) বলে মনে করে, আল্লাহর অস্তিত্বে অবিশ্বাস করে, তারা মুমিন নয়। তাদের ভ্রান্ত ধারণা দূরীকরণার্থে মহাপ্রজ্ঞাময় আল্লাহ তাঁর পবিত্র সত্তার বর্ণনা দ্বারা মানুষের জ্ঞানচক্ষুর উন্মেষ ঘটিয়েছেন। অপরদিকে যারা আল্লাহকে না দেখেই তাঁর সত্তায় বিশ্বাস স্থাপন করে তারা আল্লাহর নিকটে আত্মসমর্পণ পূর্বক নিরাপদ আশ্রয় প্রার্থনা করে।
মানুষকে সৃষ্টি করা হয়েছে আল্লাহর ইবাদত করার জন্যে। এ বিষয়ে তিনি মানুষকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে বহু আদেশ, উপদেশ ও জ্ঞান দান করেছেন এবং সেগুলি মেনে চলার কঠোর আদেশ দিয়েছেন। কোন কারণবশতঃ মানুষ ভুল করে ফেললে, তওবার মাধ্যমে নিজেকে সংশোধন করে সঠিক পথে ফিরে আসার সুযোগ রয়েছে। এরপরেও কেউ আল্লাহর আদেশ অমান্য করলে সে শাস্তিযোগ্য অপরাধী হিসাবে গণ্য হবে। মহাজ্ঞানী আল্লাহর আদেশ-নিষেধ সমূহের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করতঃ বহু বান্দা আল্লাহর ইবাদতে আত্মনিয়োগ করে এবং আল্লাহর কঠোর শাস্তির ভয়ে ভীত হয়ে আল্লাহর আদেশ পালনে ব্রতী হয়। আবার অনেকে ভুলবশতঃ বা অজ্ঞতাবশতঃ আদেশ পালনে ত্রুটি-বিচ্যুতি করে বা অন্যায় করে নিজের ভুল বুঝতে পারে। তখন অনুতপ্ত হয়ে তওবা করে ক্ষমাপ্রার্থী হয়। অতঃপর আল্লাহর প্রতি গভীর আত্মবিশ্বাস নিয়ে সৎপথ অবলম্বন করে। কিন্তু শয়তানসহ মানুষের মধ্যে একটি বিরাট দল আল্লাহর সত্তা ও আদেশের প্রতি সন্দেহ পোষণ করে বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে আল্লাহর বিরোধী ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। অদৃশ্যের একমাত্র জ্ঞাতা, অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের মালিক মহান আল্লাহ তা‘আলা মানুষের এসব অকৃতজ্ঞতার কথা, অহংকারের কথা, ঔদ্ধত্য ও সীমালংঘনের কথা সৃষ্টির পূর্বেই জানতেন।
আল্লাহ তা‘আলা মানুষকে কিয়ামতের মাধ্যমে ইহজগত হ’তে পরজগতে নিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। কিয়ামতের ময়দানে সমস্ত মানুষের কর্মের হিসাব হবে। পরকালে আল্লাহর সাথে বান্দার সাক্ষাৎ হবে। তিনি মানব জাতিকে তাঁর সাক্ষাতের কথা জানিয়েছেন। হতভাগ্য মানুষের একটি বড় দল আল্লাহর এ সাক্ষাতের সুসংবাদকে অবিশ্বাস করে। কিন্তু তাঁর বিশ্বস্ত বান্দারা এ মহাসংবাদকে মনে প্রাণে বিশ্বাস করে তাঁর সাক্ষাতের প্রতীক্ষায় থাকে।
মানুষের সঙ্গে আল্লাহর এ সাক্ষাৎকার তাঁর প্রিয় বান্দার জন্য কতটা মর্যাদাপূর্ণ ও আনন্দদায়ক তা ভাষায় প্রকাশ করা কখনই সম্ভব নয়। পক্ষান্তরে তাঁর অপ্রিয় বান্দার জন্য যে কত অপমানজনক, লাঞ্ছনাকর, ভয়াবহ শাস্তিদায়ক সেটাও অবর্ণনীয়। উভয় প্রকারের বান্দার সঙ্গে সেদিন আল্লাহ তা‘আলা সাক্ষাৎ করবেন। আলোচ্য প্রবন্ধে আল্লাহর সঙ্গে বান্দার সেই সাক্ষাৎকার সম্পর্কে আলোকপাত করা হল।-
মানুষ আল্লাহর শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি। তবে সব মানুষ সমান নয়, তিনি মানুষকে পরীক্ষা করেন। কেননা মানুষকে অবশ্যই চিন্তা ও বিবেচনা করতে হবে, কে তাদেরকে সুখ-শান্তি ও মান-সম্মান দিয়ে পৃথিবীর বড় আসনে বসিয়েছেন এবং অন্যদেরকে দরিদ্রতা ও দুঃখের মধ্য দিয়ে জীবন যাপনে অভ্যস্ত করেছেন। যিনি এসব সৃষ্টি করেছেন, তিনি আমাদের প্রতি কি ধরনের বিধি-বিধান জারি করেছেন তা ভেবে দেখতে হবে।
আল্লাহর নিকট প্রত্যাবর্তন বা সমবেত হওয়ার জন্য একটি সময় নির্ধারিত আছে। কোন মানুষ বা ফেরেশতা কূলের কেউ তা জানে না। নির্ধারিত সেই সময়েই কিয়ামত সংঘটিত হবে এবং মানুষের অজান্তেই হঠাৎ তা এসে যাবে। কিয়ামত দিবসের ভয়াবহতা অবর্ণনীয়। আল্লাহর নিকট মানুষের সমবেত হওয়াও সেদিনের জন্য একটি কঠিন কাজ।
মহান স্রষ্টা আল্লাহ তা‘আলার মহাপবিত্র সত্তার চিন্তা-গবেষণা করা অপেক্ষা তাঁর সত্তার প্রতি অকৃত্রিম বিশ্বাসই হ’ল শ্রেষ্ঠ পথ ও পাথেয়। কারণ পবিত্র কুরআনে তাঁর বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ও তাঁর সাক্ষাতের মহাসত্য বাণী অবতীর্ণ হয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন, صِبْغَةَ اللهِ وَمَنْ أَحْسَنُ مِنَ اللهِ صِبْغَةً وَنَحْنُ لَهُ عَابِدوْنَ ‘তোমরা আল্লাহর রং (অর্থাৎ আল্লাহর দ্বীন) কবুল কর। আর আল্লাহর রঙের চাইতে উত্তম রং কার হ’তে পারে’ (বাক্বারাহ ২/১৩৮)। অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন,قُلِ ادْعُواْ اللهَ أَوِ ادْعُواْ الرَّحْمَـنَ أَيّاً مَّا تَدْعُواْ فَلَهُ الأَسْمَاء الْحُسْنَى ‘তুমি বল, তোমরা ‘আল্লাহ’ নামে ডাক বা ‘রহমান’ নামে ডাক, তোমরা যে নামেই ডাক না কেন, সকল সুন্দর নাম তো কেবল তাঁরই’ (বনী ইসরাঈল ১৭/১১০)। একই মর্মার্থে তিনি ঘোষণা করেন, اللهُ نُوْرُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ ‘আল্লাহ নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলের জ্যোতি’ (নূর ২৪/৩৫)। অপর এক প্রত্যাদেশে তিনি তাঁর প্রিয় হাবীব (ছাঃ)-কে প্রত্যাদেশ করেন, فَسَبِّحْ بِحَمْدِ رَبِّكَ وَكُن مِّنَ السَّاجِدِيْنَ، وَاعْبُدْ رَبَّكَ حَتَّى يَأْتِيَكَ الْيَقِيْنُ- ‘অতএব তুমি তোমার প্রতিপালকের প্রশংসা বর্ণনা কর এবং সিজদাকারীদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাও। আর তুমি তোমার প্রতিপালকের ইবাদত কর, যতক্ষণ না মৃত্যু তোমার নিকট উপস্থিত হয়’ (হিজর ১৫/৯৮, ৯৯)। অতঃপর আল্লাহ তাঁর সত্তা ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের বর্ণনায় বলেন, وَاللهُ يُحْيِـي وَيُمِيتُ وَاللهُ بِمَا تَعْمَلُوْنَ بَصِيْرٌ ‘আল্লাহ জীবন ও মৃত্যু দান করে থাকেন। আর আল্লাহ তোমরা যা কর সবই দেখেন’ (আলে ইমরান ৩/১৫৬)। অন্যত্র তিনি বলেন, إِنَّ اللهَ كَانَ سَمِيْعاً بَصِيْراً ‘নিঃসন্দেহে আল্লাহ সর্বশ্রোতা ও সর্বদ্রষ্টা’ (নিসা ৪/৫৮)। মহান আল্লাহ আরও বলেন, إِنَّ اللهَ سَمِيْعٌ بَصِيْرٌ ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ সবকিছু শোনেন, সবকিছু দেখেন’ (লোকমান ৩১/২৮; হজ্জ ২২/৭৫)। তাঁর শক্তির বর্ণনায় তিনি বলেন, وَالْأَرْضُ جَمِيْعاً قَبْضَتُهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ وَالسَّماوَاتُ مَطْوِيَّاتٌ بِيَمِيْنِهِ ‘কিয়ামতের দিন গোটা পৃথিবী থাকবে তাঁর হাতের মুঠোয় এবং আসমান সমূহ ভাঁজ করা অবস্থায় থাকবে তাঁর ডান হাতে’ (যুমার ৩৯/৬৭)। আল্লাহ তা‘আলা হ’লেন সর্বোত্তম সুন্দর সত্তা। উপরের আয়াত কয়টি তাঁর সুন্দরতম আকৃতির নমুনা স্বরূপ পবিত্র কুরআনে লিপিবদ্ধ হয়েছে। তিনি সর্বশক্তির আধার। এসব আল্লাহর ক্ষমতার বহিঃপ্রকাশ।
মহিমাময় আল্লাহর পক্ষ হ’তে আরও একটি মহাসুসংবাদ রয়েছে। তিনি বলেছেন, কিয়ামতে বিচারের দিনে কোন একক (সুনির্দিষ্ট) সময়ে তিনি প্রতিটি বান্দার বা ব্যক্তির সাথে পৃথক বা একাকী সাক্ষাৎ করবেন। তাঁর এই অমূল্য বাণীর অন্তরালে যে অসীম তাৎপর্য লুক্কায়িত আছে, তা একমাত্র তিনিই জানেন। আমরা শুধু তাঁর প্রচারিত ও ঘোষিত উপদেশ ভান্ডার হ’তে প্রাপ্ত জ্ঞানের আলোচনা করব। মহাবিজ্ঞ আল্লাহ তা‘আলা জানিয়েছেন বিচারের দিনে তিনি প্রতিটি বান্দার সাথে পৃথক পৃথকভাবে বা একাকী সাক্ষাৎ করবেন, তার সাথে কথাবার্তা বলে তার দোষগুণ জানতে চাইবেন। প্রকৃত ঈমানদার বান্দা অতীব ভীত ও বিনীত স্বরে আল্লাহর সম্মুখে সত্য কথা বলবে। এমনকি অনেক দোষ ও পাপের কথাও স্বীকার করবে এবং অনেক অপরাধের পরও জান্নাতে স্থান পাবে। কিন্তু যারা মিথ্যাবাদী তারা মিথ্যা কথা দ্বারা নিজেদের অপরাধ ঢাকতে চাইবে, এতে অসন্তুষ্ট হয়ে আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে চরম শাস্তি দেয়ার জন্য জাহান্নামে প্রেরণ করবেন।
মহান আল্লাহ বলেন, وَاتَّقُواْ اللهَ وَاعْلَمُواْ أَنَّكُم مُّلاَقُوْهُ وَبَشِّرِ الْمُؤْمِنِيْنَ ‘আল্লাহকে ভয় কর। জেনে রেখ তোমাদের সবাইকে তাঁর সম্মুখে হাযির হ’তে হবে। আর তুমি বিশ্বাসীদের সুসংবাদ দাও’ (বাক্বারাহ ২/২২৩)।
অন্যত্র মহান আল্লাহ বলেন, إِنْ كُلُّ مَنْ فِي السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ إِلَّا آتِي الرَّحْمَنِ عَبْداً، لَقَدْ أَحْصَاهُمْ وَعَدَّهُمْ عَدّاً، وَكُلُّهُمْ آتِيهِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ فَرْداً- ‘নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলে এমন কেউ নেই, যে দয়াময়ের নিকটে উপস্থিত হবে না দাস রূপে। তিনি তাদেরকে গণনা করেছেন এবং তাদেরকে ভালভাবে গুনে রেখেছেন। আর কিয়ামত দিবসে তাদের সবাই তাঁর নিকটে আসবে একাকী অবস্থায়’ (মারিয়াম ১৯/৯৩-৯৫)।
এ বিষয়ের প্রতি আরও অধিক দৃষ্টি আকর্ষণের প্রয়াসে সর্বজ্ঞ আল্লাহ বলেন, اللهُ الَّذِيْ رَفَعَ السَّمَاوَاتِ بِغَيْرِ عَمَدٍ تَرَوْنَهَا ثُمَّ اسْتَوَى عَلَى الْعَرْشِ وَسَخَّرَ الشَّمْسَ وَالْقَمَرَ كُلٌّ يَجْرِيْ لأَجَلٍ مُّسَمًّى يُدَبِّرُ الأَمْرَ يُفَصِّلُ الآيَاتِ لَعَلَّكُم بِلِقَاءِ رَبِّكُمْ تُوقِنُوْنَ ‘আল্লাহ তিনি, যিনি ঊর্ধ্বদেশে স্তম্ভ ছাড়াই আকাশ মন্ডলীকে স্থাপন করেছেন যা তোমরা দেখছ। অতঃপর তিনি আরশে সমুন্নীত হন এবং সূর্য ও চন্দ্রকে অনুগামী করেন। প্রতিটি নির্দিষ্ট মেয়াদ পর্যন্ত সন্তরণ করবে। তিনি সকল বিষয় নিয়ন্ত্রণ করেন। তিনি নিদর্শন সমূহ ব্যাখ্যা করেন যাতে তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের সাথে সাক্ষাতের ব্যাপারে দৃঢ় বিশ্বাসী হ’তে পার’ (রা‘দ ১৩/২)।
তিনি আরো বলেন, الم، أَحَسِبَ النَّاسُ أَنْ يُتْرَكُوْا أَنْ يَقُوْلُوْا آمَنَّا وَهُمْ لَا يُفْتَنُوْنَ، وَلَقَدْ فَتَنَّا الَّذِيْنَ مِنْ قَبْلِهِمْ فَلَيَعْلَمَنَّ اللهُ الَّذِيْنَ صَدَقُوْا وَلَيَعْلَمَنَّ الْكَاذِبِيْنَ، أَمْ حَسِبَ الَّذِيْنَ يَعْمَلُوْنَ السَّيِّئَاتِ أَن يَسْبِقُوْنَا سَاء مَا يَحْكُمُونَ، مَن كَانَ يَرْجُو لِقَاء اللهِ فَإِنَّ أَجَلَ اللهِ لَآتٍ وَهُوَ السَّمِيْعُ الْعَلِيْمُ- ‘মানুষ কি মনে করে যে, তারা একথা বলেই অব্যাহতি পেয়ে যাবে যে, আমরা বিশ্বাস করি এবং তাদেরকে পরীক্ষা করা হবে না? আমি তাদেরকেও পরীক্ষা করেছি, যারা তাদের পূর্বে ছিল। আল্লাহ অবশ্যই জেনে নিবেন যারা সত্যবাদী এবং নিশ্চয়ই জেনে নিবেন মিথ্যুকদেরকে। যারা মন্দ কাজ করে, তারা কি মনে করে যে, তারা আমার হাত থেকে বেঁচে যাবে? তাদের ফায়ছালা খুবই মন্দ। যে আল্লাহর সাক্ষাৎ কামনা করে, আল্লাহর সেই নির্ধারিতকাল অবশ্যই আসবে। তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞানী’ (আনকাবূত ২৯/১-৫)।
শয়তান বান্দার সাথে আল্লাহর সাক্ষাতকেও মিথ্যা বলে তার অনুগত লোকদের নিয়ন্ত্রণ করছে। এমতাবস্থায় আল্লাহ তা‘আলা তাঁর প্রিয় হাবীব (ছাঃ)-কে উদ্দেশ্য করে প্রত্যাদেশ করলেন,قُلْ إِنَّمَا أَنَا بَشَرٌ مِّثْلُكُمْ يُوحَى إِلَيَّ أَنَّمَا إِلَهُكُمْ إِلَهٌ وَاحِدٌ فَمَن كَانَ يَرْجُو لِقَاء رَبِّهِ فَلْيَعْمَلْ عَمَلاً صَالِحاً وَلَا يُشْرِكْ بِعِبَادَةِ رَبِّهِ أَحَداً- ‘তুমি বল, আমি তোমাদেরই মত একজন মানুষ। আমার নিকটে অহী করা হয় যে, তোমাদের ইলাহ মাত্র একজন। অতএব যে ব্যক্তি তার প্রভুর সাক্ষাৎ কামনা করে, সে যেন সৎকর্ম সম্পাদন করে এবং তার পালনকর্তার ইবাদতে কাউকে শরীক না করে’ (কাহাফ ১৮/১১০)।
আলোচ্য আয়াতের মধ্য দিয়ে আরও একটি বিষয় সুস্পষ্ট হয়েছে যে, একমাত্র আল্লাহকেই উপাস্য হিসাবে গ্রহণ করতে হবে। শয়তানের প্ররোচনায় বহু মানুষ তাদের ইবাদতে আল্লাহর সঙ্গে অন্য কিছুকে শরীক করে থাকে। তাই দয়াশীল ও ক্ষমাশীল আল্লাহ তা‘আলা মানুষকে জানিয়ে দিয়েছেন যে, যে ব্যক্তি তাঁর সাক্ষাতের আশা করে, সে যেন পার্থিব জীবনে ভাল কাজ করে, একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর ইবাদত করে এবং উক্ত ইবাদতে কাউকে শরীক না করে। এতে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে, যারা ইবাদতের মধ্যে আল্লাহ ব্যতীত অন্যান্য ব্যক্তি বা বস্ত্তকে প্রাধান্য দেয় তারা আল্লাহর সাক্ষাৎ পাবে না।
পার্থিব জীবনে বিভিন্ন প্রতিকূলতা, প্রতিবন্ধকতা প্রতিটি মানুষের সঙ্গে নিবিড়ভাবে মিশে আছে। এরই মধ্য দিয়ে আল্লাহ তা‘আলা তাঁর প্রিয় বান্দাদের প্রতিযোগিতায় জয়যুক্ত করে তাঁর সান্নিধ্যে তুলে নিবেন। কিন্তু আল্লাহর সঙ্গে শরীক করার মত অপরাধ থেকে মুক্ত থাকতে হবে। কারণ আল্লাহ তা‘আলা কঠোর ভাষায় শরীক করতে নিষেধ করেছেন। তিনি তাঁর প্রিয় বান্দাদের আশ্বস্ত করে বলেন, يَا أَيُّهَا الْإِنسَانُ إِنَّكَ كَادِحٌ إِلَى رَبِّكَ كَدْحاً فَمُلَاقِيهِ ‘হে মানুষ! তোমাকে তোমার পালনকর্তা পর্যন্ত পৌছতে কষ্ট স্বীকার করতে হবে, অতঃপর তার সাক্ষাৎ ঘটবে’ (ইনশিক্বাক ৮৪/৬)।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন, أَلا إِنَّ لِلّهِ مَا فِي السَّمَاوَاتِ وَالأَرْضِ أَلاَ إِنَّ وَعْدَ اللهِ حَقٌّ وَلَـكِنَّ أَكْثَرَهُمْ لاَ يَعْلَمُونَ، هُوَ يُحْيِيْ وَيُمِيْتُ وَإِلَيْهِ تُرْجَعُوْنَ، يَا أَيُّهَا النَّاسُ قَدْ جَاءتْكُم مَّوْعِظَةٌ مِّن رَّبِّكُمْ وَشِفَاء لِّمَا فِي الصُّدُوْرِ وَهُدًى وَرَحْمَةٌ لِّلْمُؤْمِنِيْنَ- ‘মনে রেখ, নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলে যা কিছু আছে সবই আল্লাহর। মনে রেখ, আল্লাহর ওয়াদা সত্য। কিন্তু তাদের অধিকাংশ তা জানে না। তিনিই জীবন ও মৃত্যু দান করেন এবং তাঁর কাছেই তোমরা ফিরে যাবে। হে মানব জাতি! তোমাদের নিকট তোমাদের প্রতিপালকের পক্ষ হ’তে এসে গেছে উপদেশবাণী (কুরআন) এবং অন্তরের রোগসমূহের নিরাময়কারী এবং বিশ্বাসীদের জন্য পথ প্রদর্শক ও রহমত’ (ইউনুস ১০/৫৫-৫৭)।
যারা আল্লাহতে বিশ্বাসী তারা আল্লাহর সাথে সাক্ষাতেও দৃঢ় বিশ্বাসী। এই কারণে ঈমানদার বান্দারা ইহজগতে যথাসাধ্য সৎকাজ করে। মহান আল্লাহ বলেন,وَاسْتَعِيْنُواْ بِالصَّبْرِ وَالصَّلاَةِ وَإِنَّهَا لَكَبِيْرَةٌ إِلاَّ عَلَى الْخَاشِعِيْنَ، الَّذِيْنَ يَظُنُّوْنَ أَنَّهُم مُّلاَقُوْا رَبِّهِمْ وَأَنَّهُمْ إِلَيْهِ رَاجِعُوْنَ- ‘তোমরা আল্লাহর সাহায্য কামনা কর ধৈর্য ও ছালাতের মাধ্যমে। আর তা অবশ্যই কঠিন কাজ, তবে বিনীত বান্দাগণ ব্যতীত’। যারা দৃঢ় বিশ্বাস পোষণ করে যে, তারা তাদের প্রভুর সাথে মুলাক্বাত (সাক্ষাৎ) করবে এবং তারা তাঁর কাছেই ফিরে যাবে’ (বাক্বারাহ ২/৪৫-৪৬)।
মুমিন বান্দাগণ অকৃত্রিম বিশ্বাস ও শিরকমুক্তভাবে খালেছ অন্তরে সৎ আমল সম্পাদন করে এবং সর্বোপরি আল্লাহভীতির মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে সদা সচেষ্ট থাকে। মহান আল্লাহ বলেন,إِنَّ الَّذِيْنَ هُم مِّنْ خَشْيَةِ رَبِّهِم مُّشْفِقُوْنَ، وَالَّذِيْنَ هُم بِآيَاتِ رَبِّهِمْ يُؤْمِنُوْنَ، وَالَّذِيْنَ هُم بِرَبِّهِمْ لَا يُشْرِكُوْنَ، وَالَّذِيْنَ يُؤْتُوْنَ مَا آتَوْا وَّقُلُوْبُهُمْ وَجِلَةٌ أَنَّهُمْ إِلَى رَبِّهِمْ رَاجِعُوْنَ، أُوْلَئِكَ يُسَارِعُوْنَ فِي الْخَيْرَاتِ وَهُمْ لَهَا سَابِقُوْنَ- ‘নিশ্চয়ই যারা তাদের পালনর্তার ভয়ে সন্ত্রস্ত। যারা তাদের পালনকর্তার আয়াত সমূহে বিশ্বাস স্থাপন করে। যারা তাদের প্রতিপালকের সাথে কাউকে শরীক করে না। আর যারা তাদেরকে যা দেওয়া হয়েছে সেখান থেকে ভীত-কম্পিত হৃদয়ে (আল্লাহর পথে) দান করে এজন্য যে, তারা তাদের প্রতিপালকের কাছে ফিরে যাবে। এরাই দ্রুত কল্যাণ কাজে ধাবিত হয় এবং তারা তার প্রতি অগ্রগামী হয়’ (মুমিনূন ২৩/৫৭-৬১)।
অন্য আয়াতে তিনি বলেন, رَفِيْعُ الدَّرَجَاتِ ذُو الْعَرْشِ يُلْقِي الرُّوْحَ مِنْ أَمْرِهِ عَلَى مَنْ يَشَاءُ مِنْ عِبَادِهِ لِيُنذِرَ يَوْمَ التَّلَاقِ ‘তিনিই সুউচ্চ মর্যাদার অধিকারী, আরশের মালিক, তাঁর বান্দাদের মধ্যে যার প্রতি ইচ্ছা তত্ত্বপূর্ণ বিষয়াদি নাযিল করেন, যাতে সে সাক্ষাতের দিন সম্পর্কে সকলকে সতর্ক করে’ (মুমিন ৪০/১৫)।
আল্লাহ তাঁর সাক্ষাতের প্রতি বিশ্বাস স্থাপনের জন্য পূর্ববর্তী নবী-রাসূলগণকেও অহী প্রেরণ করেছেন। তিনি বলেন, ثُمَّ آتَيْنَا مُوْسَى الْكِتَابَ تَمَاماً عَلَى الَّذِيْ أَحْسَنَ وَتَفْصِيْلاً لِّكُلِّ شَيْءٍ وَهُدًى وَّرَحْمَةً لَّعَلَّهُم بِلِقَاءِ رَبِّهِمْ يُؤْمِنُوْنَ ‘অতঃপর (ইতিপূর্বে) আমরা মূসাকে দিয়েছিলাম কিতাব (তাওরাত), যা ছিল সৎকর্মশীলদের জন্য পূর্ণাঙ্গ এবং সকল বস্ত্তর বিশদ ব্যাখ্যা, পথনির্দেশ ও অনুগ্রহ স্বরূপ। যাতে তারা তাদের প্রভুর সাথে সাক্ষাতে বিশ্বাসী হয়’ (আন‘আম ৬/১৫৪)।
উল্লেখ্য, নবী-রাসূলগণের মধ্য হ’তে মূসা (আঃ)-এর সাথে আল্লাহ কথা বলেছেন। তাই এক সময় মূসা (আঃ) আল্লাহ তা‘আলার সাক্ষাৎ প্রার্থনা করেছিলেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘আমি মূসাকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছি ত্রিশ রাত্রির এবং সেগুলো পূর্ণ হয়ে গেছে। আর মূসা তাঁর ভাই হারূণকে বলল, আমার সম্প্রদায়ে তুমি আমার প্রতিনিধি হিসাবে থাক। তাদের সংশোধন করতে থাক এবং হাঙ্গামা সৃষ্টিকারীদের পথে চলো না। অতঃপর মূসা আমার প্রতিশ্রুত সময় অনুযায়ী এসে হাযির হ’লে তার সাথে তাঁর পরওয়ারদেগার কথা বললেন। তখন সে বলল, হে আমার প্রভু! আপনার দীদার (সাক্ষাৎ) আমাকে দিন, যেন আমি আপনাকে দেখতে পাই। তিনি বললেন, তুমি আমাকে কস্মিনকালেও দেখতে পাবে না। তবে তুমি পাহাড়ের দিকে দেখতে থাক, সেটি যদি স্বস্থানে দাঁড়িয়ে থাকে, তবে তুমিও আমাকে দেখতে পাবে। তারপর যখন তাঁর পরওয়ারদেগার পাহাড়ের উপর আপন জ্যোতির বিকিরণ ঘটালেন, সেটিকে বিধ্বস্ত করে দিলেন এবং মূসা অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেল। অতঃপর যখন তাঁর জ্ঞান ফিরে এল, বলল, হে রব! আপনার সত্তা পবিত্র, আপনার দরবারে আমি তওবা করছি এবং আমি সর্বপ্রথম বিশ্বাস করছি। পরওয়ারদেগার বললেন, وَكَتَبْنَا لَهُ فِي الأَلْوَاحِ مِنْ كُلِّ شَيْءٍ مَّوْعِظَةً وَتَفْصِيْلاً لِّكُلِّ شَيْءٍ فَخُذْهَا بِقُوَّةٍ وَأْمُرْ قَوْمَكَ يَأْخُذُواْ بِأَحْسَنِهَا سَأُرِيْكُمْ دَارَ الْفَاسِقِيْنَ ‘আর আমরা তার জন্য ফলক সমূহে (তাওরাতের পৃষ্ঠা সমূহে) লিখে দিয়েছিলাম সকল বিষয়ে উপদেশ ও (হালাল-হারামের) সর্ববিষয়ে বিস্তারিত ব্যাখ্যা। অতএব তুমি তা দৃঢ়ভাবে ধারণ কর এবং তোমার সম্প্রদায়কে উক্ত কল্যাণময় বিধানসমূহ মেনে চলতে আদেশ কর। আর সত্বর আমি তোমাদেরকে অবাধ্যদের ঠিকানা (পরিণতি) দেখাব’ (আ‘রাফ ৭/১৪৫)।
মানুষের মৃত্যুর পরই পরকাল শুরু হয়ে যায়। পবিত্র কুরআনের বর্ণনা হ’তে আমরা জেনেছি, কিয়ামত হ’ল পৃথিবী ধ্বংসের দিন, ইহকালের শেষ দিন, শান্তি বা শাস্তির দিন যা মানুষের অজান্তে হঠাৎ আগমন করে। কিয়ামত কখন হবে তা কোন মানুষেরই জানা নেই। তবে এটা একটা কঠিন ধ্বংসরূপ বা কল্পনাতীত ভয়াবহ রূপ তাতে কোন সন্দেহ নেই। সেদিনের কর্মসূচী প্রধানত পরাক্রমশালী আল্লাহর মহাজ্ঞানে পরিচালিত হবে।
মহান আল্লাহ বলেন, فَإِذَا نُقِرَ فِي النَّاقُوْرِ، فَذَلِكَ يَوْمَئِذٍ يَوْمٌ عَسِيرٌ، عَلَى الْكَافِرِيْنَ غَيْرُ يَسِيْرٍ- ‘যেদিন শিংগায় ফুঁক দেয়া হবে; সেদিন হবে কঠিন দিন। কাফেরদের জন্য এটা সহজ নয়’ (মুদদাচ্ছির ৭৪/৮-১০)। অন্যত্র আল্লাহ বলেন,
وَنُفِخَ فِي الصُّوْرِ فَصَعِقَ مَنْ فِي السَّمَاوَاتِ وَمَنْ فِي الْأَرْضِ إِلَّا مَنْ شَاءَ اللهُ ثُمَّ نُفِخَ فِيْهِ أُخْرَى فَإِذَا هُم قِيَامٌ يَنظُرُوْنَ، وَأَشْرَقَتِ الْأَرْضُ بِنُوْرِ رَبِّهَا وَوُضِعَ الْكِتَابُ وَجِيءَ بِالنَّبِيِّيْنَ وَالشُّهَدَاء وَقُضِيَ بَيْنَهُم بِالْحَقِّ وَهُمْ لَا يُظْلَمُوْنَ، وَوُفِّيَتْ كُلُّ نَفْسٍ مَّا عَمِلَتْ وَهُوَ أَعْلَمُ بِمَا يَفْعَلُوْنَ-
‘শিংগায় ফুঁক দেয়া হবে, ফলে আসমান ও যমীনে যারা আছে সবাই বেহুঁশ হয়ে যাবে, তবে আল্লাহ যাকে ইচ্ছা করেন। অতঃপর আবার শিংগায় ফুঁক দেয়া হবে, তৎক্ষণাৎ তারা দন্ডায়মান হয়ে দেখতে থাকবে। পৃথিবী তার পালনকর্তার নূরে উদ্ভাসিত হবে, আমলনামা স্থাপন করা হবে, পয়গাম্বরগণ ও সাক্ষীগণকে আনা হবে এবং সকলের মধ্যে ন্যায় বিচার করা হবে, তাদের প্রতি যুলুম করা হবে না। প্রত্যেকে যা করেছে, তার পূর্ণ প্রতিফল দেয়া হবে। তারা যা কিছু করে, সে সম্পর্কে আল্লাহ সম্যক অবগত’ (যুমার ৩৯/৬৮-৭০)।
সেদিন সব মানুষ বাধ্যতামূলকভাবেই আল্লাহর দরবারে (সামনে) হাযির হবে। মহান আল্লাহ বলেন, وَإِن كُلٌّ لَّمَّا جَمِيْعٌ لَّدَيْنَا مُحْضَرُوْنَ ‘ওদের সবাইকে সমবেত অবস্থায় আমার দরবারে উপস্থিত হ’তেই হবে’ (ইয়াসীন ৩৬/৩২)। প্রায় একই মর্মার্থে অন্যত্র আল্লাহ বলেন, إِنْ كَانَتْ إِلَّا صَيْحَةً وَاحِدَةً فَإِذَا هُمْ جَمِيْعٌ لَّدَيْنَا مُحْضَرُوْنَ، فَالْيَوْمَ لَا تُظْلَمُ نَفْسٌ شَيْئاً وَلَا تُجْزَوْنَ إِلَّا مَا كُنْتُمْ تَعْمَلُوْنَ- ‘এটা তো হবে কেবল এক মহানাদ। সে মুহূর্তেই তাদের সবাইকে আমার সামনে উপস্থিত করা হবে। আজকের দিনে কারও প্রতি যুলুম করা হবে না এবং তোমরা যা করেছে কেবল তারই প্রতিদান পাবে’ (ইয়াসীন ৩৬/৫৩-৫৪)। সেদিন নিজ নিজ সঞ্চিত কর্মফল ও আমলনামা অনুযায়ীই মানুষ আল্লাহর নিকট হ’তে প্রতিদান পাবে। তবে কখনও তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ ও কথোপোকথনের বিষয় পরিবর্তন হবে না। মহান আল্লাহ বলেন, يَوْمَ يَدْعُوْكُمْ فَتَسْتَجِيبُوْنَ بِحَمْدِهِ وَتَظُنُّوْنَ إِن لَّبِثْتُمْ إِلاَّ قَلِيْلاً ‘যেদিন তিনি তোমাদেরকে আহবান করবেন। অতঃপর তোমরা (পুনর্জন্মের খুশীতে) প্রশংসচিত্তে তাঁর ডাকে সাড়া দিবে এবং ভাববে যে, স্বল্প সময়ই কবরে অবস্থান করেছিলে’ (বনী ইসরাঈল ১৭/৫২)।
কিয়ামতের দিন আল্লাহ সৃষ্টির প্রথম হ’তে শেষ পর্যন্ত প্রতিটি মানুষকে তার ইহজগতের রক্ষিত আমলনামা দেখাবেন, যাতে মিথ্যার কোন লেশ থাকবে না। আর সে আমলনামা বোধগম্য হ’তে কোন মানুষেরই বিন্দুমাত্র দেরী হবে না। এ বিষয়ে আল্লাহ বলেন, وَكُلَّ إِنْسَانٍ أَلْزَمْنَاهُ طَآئِرَهُ فِيْ عُنُقِهِ وَنُخْرِجُ لَهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ كِتَاباً يَلْقَاهُ مَنشُوْراً، اقْرَأْ كَتَابَكَ كَفَى بِنَفْسِكَ الْيَوْمَ عَلَيْكَ حَسِيْباً- ‘প্রত্যেক মানুষের কৃতকর্মকে আমরা তার গ্রীবালগ্ন করে রেখেছি। আর কিয়ামতের দিন আমরা তাকে বের করে দেখাব একটি আমলনামা, যা সে খোলা অবস্থায় পাবে। (সেদিন আমরা বলব,) তুমি তোমার আমলনামা পাঠ কর। আজ তুমি নিজেই নিজের হিসাবের জন্য যথেষ্ট’ (বনী ইসরাঈল ১৭/১৩-১৪)।
অন্যত্র তিনি বলেন, وَوُضِعَ الْكِتَابُ فَتَرَى الْمُجْرِمِيْنَ مُشْفِقِيْنَ مِمَّا فِيْهِ وَيَقُوْلُوْنَ يَا وَيْلَتَنَا مَالِ هَذَا الْكِتَابِ لَا يُغَادِرُ صَغِيْرَةً وَلَا كَبِيْرَةً إِلَّا أَحْصَاهَا وَوَجَدُوْا مَا عَمِلُوْا حَاضِراً وَلَا يَظْلِمُ رَبُّكَ أَحَداً ‘অতঃপর পেশ করা হবে আমলনামা। তখন তাতে যা আছে তার কারণে তুমি অপরাধীদের দেখবে আতংকগ্রস্ত। তারা বলবে, হায় আফসোস! এটা কেমন আমলনামা যে, ছোট-বড় কোন কিছুই ছাড়েনি, সবকিছুই গণনা করেছে? আর তারা তাদের কৃতকর্ম সামনে উপস্থিত পাবে। বস্ত্ততঃ তোমার প্রতিপালক কাউকে যুলুম করেন না’ (কাহফ ১৮/৪৯)।
আল্লাহ আরও বলেন, يَوْمَئِذٍ يَصْدُرُ النَّاسُ أَشْتَاتاً لِّيُرَوْا أَعْمَالَهُمْ، فَمَنْ يَّعْمَلْ مِثْقَالَ ذَرَّةٍ خَيْراً يَّرَهُ، وَمَن يَعْمَلْ مِثْقَالَ ذَرَّةٍ شَرّاً يَّرَهُ- ‘সেদিন মানুষ বিভিন্ন দলে প্রকাশ পাবে, যাতে তাদেরকে তাদের কৃতকর্ম সমূহ দেখানো যায়। অতঃপর কেউ অণু পরিমাণ সৎকর্ম করলে তা সে দেখতে পাবে। আর কেউ অণু পরিমাণ অসৎকর্ম করলে তাও সে দেখতে পাবে’ (যিলযাল ৯৯/৬-৮)।
আল্লাহর সাক্ষাতে অবিশ্বাসীদের নিয়ে বহু আলোচনা রয়েছে, যেমন, ‘তাদের মন্দ কর্মগুলো তাদের সামনে প্রকাশ হয়ে পড়বে এবং যে আযাব নিয়ে তারা ঠাট্টা-বিদ্রূপ করত, তা তাদেরকে গ্রাস করবে। বলা হবে, আজ আমি তোমাদেরকে ভুলে যাব, যেমন তোমরা এ দিনের সাক্ষাতকে ভুলে গিয়েছিলে। তোমাদের আবাসস্থল জাহান্নাম এবং তোমাদের সাহায্যকারী নেই’ (জাছিয়া ৪৫/৩৩-৩৪)।
অপর এক আয়াতে আল্লাহ বলেন, وَقَالَ الَّذِيْنَ لَا يَرْجُوْنَ لِقَاءَنَا لَوْلَا أُنْزِلَ عَلَيْنَا الْمَلَائِكَةُ أَوْ نَرَى رَبَّنَا لَقَدِ اسْتَكْبَرُوْا فِيْ أَنْفُسِهِمْ وَعَتَوْ عُتُوّاً كَبِيْراً، يَوْمَ يَرَوْنَ الْمَلَائِكَةَ لَا بُشْرَى يَوْمَئِذٍ لِّلْمُجْرِمِيْنَ وَيَقُوْلُوْنَ حِجْراً مَّحْجُوْراً، وَقَدِمْنَا إِلَى مَا عَمِلُوْا مِنْ عَمَلٍ فَجَعَلْنَاهُ هَبَاء مَّنثُوْراً- ‘আর যারা আমাদের সাক্ষাৎ কামনা করে না তারা বলে, কেন আমাদের কাছে ফেরেশতা নাযিল করা হয় না অথবা কেন আমরা আমাদের প্রতিপালককে দেখি না? তারা নিজেদের অন্তরে অহংকার লুকিয়ে রাখে এবং গুরুতর অবাধ্যতায় লিপ্ত হয়। যেদিন তারা ফেরেশতাদের দেখবে, সেদিন পাপীদের জন্য কোন সুসংবাদ থাকবে না এবং তারা বলবে, বাঁচাও বাঁচাও। আর আমরা সেদিন তাদের কৃতকর্মসমূহের দিকে মনোনিবেশ করব। অতঃপর সেগুলিকে বিক্ষিপ্ত ধূলিকণায় পরিণত করব’ (ফুরকান ২৫/২১-২৩)।
কিয়ামত দিবসের মহাসংকটপূর্ণ পরিবেশের বর্ণনায় এসেছে,
فَإِذَا جَاءَتِ الطَّامَّةُ الْكُبْرَى، يَوْمَ يَتَذَكَّرُ الْإِنْسَانُ مَا سَعَى، وَبُرِّزَتِ الْجَحِيْمُ لِمَنْ يَرَى، فَأَمَّا مَنْ طَغَى، وَآثَرَ الْحَيَاةَ الدُّنْيَا، فَإِنَّ الْجَحِيْمَ هِيَ الْمَأْوَى، وَأَمَّا مَنْ خَافَ مَقَامَ رَبِّهِ وَنَهَى النَّفْسَ عَنِ الْهَوَى، فَإِنَّ الْجَنَّةَ هِيَ الْمَأْوَى، يَسْأَلُوْنَكَ عَنِ السَّاعَةِ أَيَّانَ مُرْسَاهَا، فِيْمَ أَنْتَ مِنْ ذِكْرَاهَا، إِلَى رَبِّكَ مُنْتَهَاهَا، إِنَّمَا أَنْتَ مُنْذِرُ مَنْ يَخْشَاهَا، كَأَنَّهُمْ يَوْمَ يَرَوْنَهَا لَمْ يَلْبَثُوْا إِلَّا عَشِيَّةً أَوْ ضُحَاهَا-
‘অতঃপর যখন মহাসংকট এসে যাবে, সেদিন মানুষ তার কৃতকর্মসমূহ স্মরণ করবে এবং দর্শকের জন্য জাহান্নামকে উন্মুক্ত করে দেওয়া হবে। তখন যে ব্যক্তি সীমালংঘন করেছে এবং পার্থিব জীবনকে অগ্রাধিকার দিয়েছে জাহান্নাম তার ঠিকানা হবে। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি তার প্রভুর সম্মুখে দন্ডায়মান হওয়ার ভয় করেছে এবং নিজেকে প্রবৃত্তির গোলামী হ’তে বিরত রেখেছে, জান্নাত তার ঠিকানা হবে। তারা তোমাকে জিজ্ঞেস করে, ক্বিয়ামত কখন হবে? এ বিষয়ে বলার জন্য তুমি কে? এর চূড়ান্ত জ্ঞান তো তোমার প্রভুর নিকটে। তুমি তো কেবল সতর্ককারী ঐ ব্যক্তির জন্য যে ক্বিয়ামতকে ভয় করে। যেদিন তারা তা দেখবে, সেদিন তাদের মনে হবে যেন তারা দুনিয়াতে ছিল একটি সন্ধ্যা বা একটি সকাল’ (নাযি‘আত ৭৯/৩৪-৪৬)।
উপরোক্ত আলোচনায় একটা বিষয় সুস্পষ্টরূপে প্রতিভাত হয়েছে যে, পরকালে আল্লাহর সাথে মানুষের সাক্ষাৎ ঘটবে। সে সময় আল্লাহর রহমত ও ক্ষমা লাভের জন্য পার্থিব জীবনে সাধ্যমত সৎকাজ করতে হবে। আর পরকালীন ভয়াবহতার কথা বিভিন্নভাবে উপস্থাপন করে মহান আল্লাহ মানুষকে সৎ আমল করতে উৎসাহিত ও অনুপ্রাণিত করেছেন।
আল্লাহ তা‘আলা তাঁর আদেশ ও উপদেশ বাণী কোন বিশেষ বান্দার জন্য প্রেরণ করেননি। বরং তিনি সবার জন্যই একই উদ্দেশ্যে প্রেরণ করেছেন। যেমন- সকল বান্দার উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, أَلَا يَظُنُّ أُولَئِكَ أَنَّهُم مَّبْعُوْثُوْنَ، لِيَوْمٍ عَظِيْمٍ، يَوْمَ يَقُوْمُ النَّاسُ لِرَبِّ الْعَالَمِيْنَ- ‘তারা কি চিন্তা করে না যে, তারা পুনরুত্থিত হবে? সেই মহা দিবসে, যেদিন মানুষ দন্ডায়মান হবে বিশ্বপালকের সম্মুখে’ (মুতাফফিফীন ৮৩/৪-৬)।
প্রকৃত আল্লাহভীরুদের সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, وَلِمَنْ خَافَ مَقَامَ رَبِّهِ جَنَّتَانِ ‘যে ব্যক্তি তার পালনকর্তার সামনে দন্ডায়মান হওয়ার ভয় রাখে, তার জন্যে রয়েছে দু’টি উদ্যান’ (আর-রহমান ৫৫/৪৬)।
আল্লাহভীতির এরূপ বাস্তব দৃষ্টান্ত আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। কিন্তু হৃদয়ের আকর্ষণ ছাড়া আল্লাহভীতির কোন মূল্যায়ণ হবে না। কারণ আল্লাহ হচ্ছেন অন্তর্যামী, তাঁর কাছে অন্তরের বিষয়ই অধিক গ্রহণীয়। এমনকি তিনি কোন কোন ক্ষেত্রে অন্তরের বিষয়াদি ছাড়া মৌখিক বিষয়ের বা কথার কোন মূল্য দেন না। আল্লাহ বলেন, لاَّ يُؤَاخِذُكُمُ اللهُ بِاللَّغْوِ فِيْ أَيْمَانِكُمْ وَلَكِنْ يُؤَاخِذُكُمْ بِمَا كَسَبَتْ قُلُوْبُكُمْ وَاللهُ غَفُوْرٌ حَلِيْمٌ ‘অর্থহীন শপথের জন্য আল্লাহ তোমাদের ধরবেন না। তবে ঐসব শপথের জন্য তিনি তোমাদের পাকড়াও করবেন, যা তোমরা মনের সংকল্প অনুযায়ী করে থাক। বস্তুতঃ আল্লাহ বড়ই ক্ষমাশীল ও সহনশীল’ (বাক্বারাহ ২/২২৫)।
পরিশুদ্ধ হৃদয়ের অধিকারী ব্যক্তি সফলকাম হবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, يَوْمَ لَا يَنفَعُ مَالٌ وَلَا بَنُونَ، إِلَّا مَنْ أَتَى اللهَ بِقَلْبٍ سَلِيْمٍ- ‘সেদিন ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি কোন কাজে আসবে না। কেবল যে ব্যক্তি বিশুদ্ধ অন্তর নিয়ে আল্লাহর নিকটে আসবে, সে ব্যতীত’ (শো‘আরা ২৬/৮৮-৮৯)।
আল্লাহর সঙ্গে বান্দার সাক্ষাৎ সম্পর্কে আমাদের নবী (ছাঃ) অনেক হাদীছ রেখে গেছেন। এখানে কয়েকটি হাদীছ উল্লেখ করা হ’ল- জারীর ইবনে আব্দুল্লাহ হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘একদিন পূর্ণিমার রাতে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আমাদের মাঝে আসলেন। তিনি বললেন, অচিরেই ক্বিয়ামতের দিন তোমরা তোমাদের রব (আল্লাহর)-কে দেখতে পাবে, যেমন এ চাঁদকে দেখতে পাচ্ছ’ (বুখারী হা/৭৪৩৬)।
আদী ইবনে হাতেম (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘তোমাদের প্রত্যেকের সাথে তাঁর রব (আল্লাহ তা‘আলা) কথা বলবেন। তার এবং আল্লাহর মধ্যে কোন দোভাষী থাকবে না। সে তার ডানে তাকিয়ে আমল ছাড়া আর কিছুই দেখতে পাবে না। সামনে তাকিয়ে জাহান্নাম ছাড়া আর কিছুই দেখতে পাবে না। তাই এক টুকরো খেজুরের বিনিময়ে হ’লেও জাহান্নামকে ভয় কর’ (বুখারী হা/৬৫৩৯)।
ছাফওয়ান ইবনে মুহরিয হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেছেন, এক ব্যক্তি আব্দুল্লাহ ইবনে ওমরকে জিজ্ঞেস করল যে, আল্লাহর সাথে তাঁর ঈমানদার বান্দার নির্জনে কথাবার্তা সম্পর্কে আপনি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে কি বলতে শুনেছেন? তিনি বললেন, তোমাদের কেউ তার রবের কাছে গেলে তিনি তাঁর উপর পর্দা দিয়ে জিজ্ঞেস করবেন, এসব কাজ কি তুমি করেছ? সে বলবে, হ্যাঁ করেছি। আল্লাহ আবার জিজ্ঞেস করবেন, তুমি কি একাজ ও একাজ করেছ। সে বলবে, হ্যাঁ। আল্লাহ এভাবে তার স্বীকৃতি নিবেন, তারপর বলবেন, আমি দুনিয়ায় তোমার এসব কাজ গোপন করে রেখেছিলাম, আর আজকে তা মাফ করে দিলাম’ (বুখারী হা/২৪৪১)।
মহান প্রতিপালক আল্লাহর সামনে তাঁর বান্দার হাযির হওয়ার প্রথম নির্ধারিত স্থান হবে ইহজগত ও পরজগতের মধ্যস্থল হাশর। ঐ দিন সমস্ত মানুষ সমবেত হবে এবং প্রত্যেকের আমল পরীক্ষা করে বিচার হবে। ঐ দিনের দীর্ঘতা পঞ্চাশ হাযার বছর হবে। যা কল্পনা করাও এক অসম্ভব ব্যাপার। ঐ দিনের ভয়াবহতা অবিশ্বাসীদের জন্যে যে শোচনীয় পরিণতি ডেকে আনবে তা সেদিনের দীর্ঘতাকে আরও অসম্ভব দীর্ঘ করে তুলবে।
এসব আলোচনা মানুষকে সৎপথে আনার প্রচেষ্টা মাত্র। আল্লাহ মানুষকে সেই দিবসে হাযির করবেন, যেদিন মানুষ তার কর্ম অনুযায়ী জান্নাতী বা জাহান্নামী হবে। আল্লাহ বলেন, ‘যখন শিংগায় ফুৎকার দেয়া হবে, একটি মাত্র ফুৎকার এবং পৃথিবী ও পর্বতমালা উত্তোলিত হবে ও চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দেয়া হবে। সেদিন কিয়ামত সংঘটিত হবে। সেদিন আকাশ বিদীর্ণ ও বিক্ষিপ্ত হবে এবং ফেরেশতাগণ আকাশের প্রান্তদেশে থাকবে। আট জন ফেরেশতা আপনার পালনকর্তার আরশকে তাদের ঊর্ধ্বে বহন করবে। সেদিন তোমাদেরকে উপস্থিত করা হবে। তোমাদের কোন কিছু গোপন থাকবে না। অতঃপর যার আমলনামা ডান হাতে দেয়া হবে, সে বলবে, নাও, তোমরা আমলনামা পড়ে দেখ। আমি জানতাম যে, আমাকে হিসাবের সম্মুখীন হ’তে হবে। অতঃপর সে সুখী জীবন-যাপন করবে, সুউচ্চ জান্নাতে। তার ফলসমূহ অবনমিত থাকবে। (বলা হবে,) বিগত দিনে তোমরা যা প্রেরণ করেছিলে, তার প্রতিদানে তোমরা খাও এবং পান কর তৃপ্তি সহকারে। যার আমলনামা তার বাম হাতে দেয়া হবে, সে বলবে, হায় আমায় যদি আমার আমলনামা না দেয়া হ’ত, আমি যদি না জানতাম আমার হিসাব! হায়, আমার মৃত্যুই যদি শেষ হ’ত! আমার ধন-সম্পদ আমার কোন উপকারে আসল না। আমার ক্ষমতাও বরবাদ হয়ে গেল। ফেরেশতাদেরকে বলা হবে, ধর একে, গলায় বেড়ি পরিয়ে দাও, অতঃপর নিক্ষেপ কর জাহান্নামে। অতঃপর তাকে শৃঙ্খলিত কর সত্তর গজ দীর্ঘ এক শিকলে। নিশ্চয়ই সে মহান আল্লাহতে বিশ্বাসী ছিল না এবং মিসকীনকে আহার্য দিতে উৎসাহিত করত না’ (হাককাহ ৬৯/১৩-৩৪)।
কিয়ামত দিবসের মহাব্যাপক কর্মসূচীর কথা আল্লাহ ব্যতীত কেউ জানে না। ঐ দিবসের সমস্ত কর্মসূচী তিনি একাকীই পরিচালনা করবেন। পৃথিবীর সমস্ত মানুষ ঐদিন নীরব হয়ে যাবে। শুধু আমাদের নবী (ছাঃ) আল্লাহর সাথে কথা বলার অনুমতি পাবেন। মহানবী (ছাঃ) তাঁর পবিত্র বাণীতে মানুষের সাথে আল্লাহর সাক্ষাতের কথা বলে গেছেন। আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, ‘লোকেরা বলল, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! আমরা কি কিয়ামতের দিন আল্লাহর দর্শন লাভ করব? তিনি বললেন, মেঘমুক্ত সূর্যের দিকে তাকাতে তোমাদের কি কোন অসুবিধা হয়? তারা বলল, না। তিনি বললেন, নিশ্চয়ই তোমরা এমনিভাবে কিয়ামতের দিনে আল্লাহকে দেখতে পাবে। আল্লাহ মানুষকে একত্রিত করে বলবেন, যে ব্যক্তি যে বস্ত্তর দাসত্ব করেছে, সে যেন তার অনুসরণ করে। তখন যে সূর্যের পূজা করত সে সূর্যের অনুসরণ করবে, আর যে চাঁদের পূজা করত, সে চাঁদের অনুসরণ করবে। শুধুমাত্র অবশিষ্ট থাকবে এই উম্মত, তাদের মধ্যে মুনাফিকরাও থাকবে (যারা প্রকাশ্যে নিজেদেরকে উম্মতে মুহাম্মাদী বলে পরিচয় দিত)। তখন আল্লাহ তাদের অজ্ঞাতরূপে তাদের সামনে হাযির হবেন এবং বলবেন, আমি তোমাদের রব, তারা বলবে, তোমার থেকে আমরা আল্লাহর আশ্রয় চাই। আমরা এখানেই থাকব, আমাদের রব আমাদের নিকট আসা পর্যন্ত। আমাদের রব আমাদের নিকট আসলে আমরা তাঁকে চিনতে পারব। তারপর তিনি তাদের পরিচিত রূপে তাদের সামনে হাযির হবেন। তখন তারা বলবে, আপনি আমাদের রব, এরপর তারা তাঁর অনুসরণ করবে, অতঃপর জাহান্নামের উপর পুল স্থাপন করা হবে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, পুল অতিক্রমকারীদের মধ্যে আমিই প্রথম ব্যক্তি হব।
আর সেদিন রাসূলের দো‘আ হবে, ‘আল্লাহুম্মা সাল্লিম সাল্লিম’ হে আল্লাহ! শান্তি দাও, শান্তি দাও। সে পুলে সাদান বৃক্ষের ন্যায় অনেক হুক থাকবে, তোমরা কি সাদান বৃক্ষের কাঁটা দেখনি? তারা বলল, জি হ্যাঁ, ইয়া রাসূলুল্লাহ! তিনি বললেন, সেগুলো সাদান বৃক্ষের কাটার ন্যায় হবে। তবে এদের বিরাটত্বের পরিমাণ আল্লাহ ব্যতীত কেউ জানে না। তারপর এগুলো মানুষকে তাদের কর্ম অনুযায়ী ছিনিয়ে নিয়ে যাবে। কেউ তো নিজ কর্মের কারণে ধ্বংস হবে, আর কাউকে খন্ড বিখন্ড করে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। তারপর নাজাত দেয়া হবে। শেষ পর্যন্ত আল্লাহ তাঁর বান্দাদের ব্যাপারে চূড়ান্ত ফায়ছালা করবেন। ‘আল্লাহ ছাড়া কেউ মাবূদ নেই’ যারা এ কথার সাক্ষ্য দিয়েছে, তাদের মধ্যে যাদেরকে তিনি জাহান্নাম থেকে বের করতে চান, ফেরেশতাদেরকে তাদের বের করার নির্দেশ দিবেন। তখন তারা তাদের সিজদার চিহ্ন দেখে মুমিন বলে চিনবে। কারণ আল্লাহ আগুনের জন্য আদম সন্তানের সিজদার চিহ্নকে ভক্ষণ করা হারাম করে দিয়েছেন। তখন তারা তাদেরকে বের করে নেবে এমন অবস্থায় যে, তারা জ্বলে-পুড়ে অঙ্গার হয়ে গেছে। তখন তাদের উপর জীবন বারি নামক এক প্রকার পানি নিক্ষেপ করা হবে। ফলে তারা বন্যায় নিক্ষেপিত (পলি আবর্জনায়) সদ্য গজানো বীজের চারার ন্যায় উদিত হবে। শুধু বাকী থাকবে এক ব্যক্তি, যার চেহারা আগুনের দিকে থাকবে। সে বলবে, হে পরওয়ারদেগার! জাহান্নামের আগুনে বাতাসে আমাকে বিষাক্ত করে ফেলেছে এবং এর তেজ আমাকে জ্বালিয়ে দিয়েছে। কাজেই দয়া করে আমার চেহারাকে আগুন থেকে ফিরিয়ে দিন। এভাবে সে সর্বদা আল্লাহকে ডাকতে থাকবে, তখন আল্লাহ বলবেন, যদি তোমাকে এটা দান করি, তুমি হয়ত আবার অন্য কিছু প্রার্থনা করবে। তখন সে বলবে, আপনার সম্মানের কসম, হে আল্লাহ! আমি এটা ছাড়া আর কিছু চাইব না। তখন তার চেহারাকে আল্লাহ আগুন থেকে ফিরিয়ে দিবেন। এরপর সে বলবে, আমাকে জান্নাতের দরজার কাছে পৌঁছে দিন, তখন তাকে আল্লাহ বলবেন, তুমি না স্থির করেছিলে যে, অতিরিক্ত আর কিছুই চাইবে না? বড় দুঃখজনক তোমার জন্য, হে বনী আদম! কি জন্য তুমি বিশ্বাসঘাতকতা করলে? এমনি করে সে বার বার দো‘আ করতে থাকবে। তখন আল্লাহ বলবেন, যদি তোমাকে এটা দান করি তুমি হয়ত আবার অন্যকিছু প্রার্থনা করবে। তখন সে বলবে, না। আল্লাহর কাছে পাকাপাকি কথা দিবে যে, এর অতিরিক্ত আর কিছু চাইবে না। তখন তাকে জান্নাতের দরজার নিকট নিয়ে নিবেন। তারপর যখন সে জান্নাতের ভিতরের দৃশ্য দেখবে, তখন যতদিন আল্লাহ চুপ রাখেন সে চুপ থাকবে। তারপর বলবে, হে আল্লাহ! আমাকে জান্নাতে প্রবেশ করিয়ে দিন। তখন আল্লাহ বলবেন, তুমি না বলেছিলে যে, আর কিছু চাইবে না। আবারও তুমি ওয়াদা ভঙ্গ করলে? তখন সে বলবে, হে আমার রব! আমাকে সৃষ্টির মাঝে সবচেয়ে হতভাগ্য করবেন না, এমনি করে সে চাইতেই থাকবে। শেষ পর্যন্ত আল্লাহ হেসে দিবেন, যখন তিনি হাসবেন তখন তাকে জান্নাতে দাখেল হওয়ার অনুমতিও দিয়ে দিবেন। যখন সে জান্নাতে প্রবেশ করবে তাকে বলা হবে, তুমি এটা চাও, সে চাইবে। আবার বলা হবে, এটা কামনা কর। আবার সে কামনা করবে। শেষ পর্যন্ত তার সব চাহিদা ফুরিয়ে যাবে। আল্লাহ তখন তাকে বলবেন, এটা তোমার জন্য দেয়া হ’ল আরও এতটা দেয়া হ’ল। আবু হুরায়রা (রাঃ) বলেন, ঐ ব্যক্তি জান্নাতে প্রবেশকারীদের মধ্যে একেবারে শেষের লোক হবে’ (বুখারী হা/৮০৬, ৬৫৭৩, ৭৪৩৭; মুসলিম হা/১৮২)।
মূলতঃ শ্রেষ্ঠত্বের কারণেই আল্লাহ তাদের রক্ষা করবেন। সর্বশেষ জান্নাতে প্রবেশকারী ব্যক্তি তার জাজবল্যমান প্রমাণ। আল্লাহ তাঁর সর্বশেষ আদেশ পালনকারীর প্রতি শেষ পর্যন্ত সন্তুষ্ট হয়েই অনেক কথপোকথনের মাধ্যমে তাকে জান্নাতে অফুরন্ত নে‘মত দান করবেন। সুতরাং যারা তাঁর সমুদয় আদেশের অনুসারী এবং তাঁর রাসূলের অনুসারী তাদের সাথে কথপোকথনের বিষয়টি সম্পূর্ণ ভিন্ন। জান্নাতে প্রবেশকালে তাদের প্রত্যেককে পরম দয়ালু প্রতিপালকের পক্ষ থেকে অভ্যর্থনা স্বরূপ বলা হবে ‘সালাম’।
পরিশেষে বলব, আল্লাহর সাথে যেহেতু সাক্ষাৎ হবে এবং পার্থিব জীবনের কর্মের হিসাব দিতে হবে, সেহেতু প্রত্যেক বিশ্বাসী-মুমিন বান্দাকে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে সৎকাজ করতে হবে। আল্লাহ আমাদের সকলকে সেই তাওফীক দান করুন- আমীন!
-রফীক আহমাদ