মা-খালা-বোনেরা রমজানে এসব কী দেখছেন?
রমজান হচ্ছে সংযমের মাস। দিনভর পানাহার থেকে বিরত থাকার আবহ, ইফতার উৎসব, ইবাদত বন্দেগী, ছেহেরি খাওয়া আনন্দ। অথচ সারাদিন রোজা রেখে রাতে টিভির সামনে বসে আমাদের মা, খালা, চাচী, বোন, মেয়ে, ভাবীরা জল নূপুর/জল পরী/ ইষ্টিকুটুম নামের এসব কী দেখছেন? স্টার জলসা, স্টার প্লাস, জি বাংলা আর সোনি টিভির গল্পহীন হিন্দুয়ানী সিরিয়ালের চিন্তা চেতনা কী রমজানের পবিত্রতার সঙ্গে যায়? সারাদিন রোজা রেখে আমাদের মা-বোনেরা ভারতীয় টিভির সিরিয়াল দেখতে মরিয়া হয়ে উঠছেন। এসব সিরিয়াল-নাটকে শঙ্খধ্বনি, উলুধ্বনি, মন্দিরের ঘণ্টা, ঢোলবাদ্য, পূজার সরঞ্জাম প্রাধান্য দেয়া হয়। রমজান আত্মশুদ্ধির মাস। আকাশ সংস্কৃতি নামে ভারতীয় সংস্কৃতির আগ্রাসন কি আমাদের মা-বোন-ভাবী-চাচীদের রুচি-মানসিকতার বিকৃতি ঘটিয়েছে? ধর্মীয় মূল্যবোধ নষ্ট হয়ে যাওয়ায় কি তারা পবিত্র রমজানে সারাদিন রোজা রাখার পর ভারতীয় টিভির সিরিয়াল দেখতে অস্থির হয়ে পড়ছেন? প্রগতিশীলতার নামে সাংস্কৃতির আগ্রাসন শুরু হয়েছে অনেক আগেই। দেশীয় সংস্কৃতিকে চাপা দিয়ে ভাইফোঁটা, ভালবাসা দিবস, উল্কি, হোলিখেলা, রাখি ইত্যাদির প্রতি ঝুঁকে পড়েছে কিছু শিক্ষিত ব্যক্তি। তদের কারণে আকাশ সংস্কৃতি উন্মুক্ত করায় ভারতীয় চ্যানেলগুলোতে প্রচারিত অনুষ্ঠানসমূহ দেখে আমাদের দেশের দর্শকদের মাঝে ইতিমধ্যে নানা রকমের নৈতিক, পারিবারিক ও সামাজিক অবক্ষয় শুরু হয়েছে। সর্বত্র এর বিরূপ প্রভাব পড়ছে। সরকারি সহায়তার পাশাপাশি গণমাধ্যম, বিজ্ঞাপন, সঙ্গীত শিক্ষালয়, নাট্যবিদ্যালয়, নাট্যশালা, আর্টস্কুল, ফ্যাশন-শো, সঙ্গীত-অভিনয়-সুন্দরী প্রতিযোগিতা, পাঠ্যপুস্তক, সাহিত্য, সেমিনার, এনজিও, হাসপাতাল, রূপচর্চা কেন্দ্র, শিক্ষাবৃত্তি, ক্লাব-সমিতি, সাংস্কৃতিক সফর, চলচ্চিত্রের মাধ্যমে ভারতীয় সংস্কৃতি আমাদের দেশে প্রবেশ করছে। কোলকাতার টিভি চ্যানেলগুলোতে বছরব্যাপী গল্পবিহীন সিরিয়ালে কপটতা, অনৈতিকতা, পারিবারিক কলহ, কুটিলতা, শিশুদের মিথ্যা বলা, ছলাকলা, চাতুরি শেখানোর কৌশল দেখানো হচ্ছে। সিরিয়ালের প্রতি মা-বোনেরা এমন আসক্ত যে অনেকের মতে ভারতীয় টিভি চ্যানেলের আগ্রাসনে বাড়ছে পারিবারিক কলহ। ভাইয়ে ভাইয়ে বিরোধ, মা ছেলে বিরোধ, বউ শাশুড়ির ঝগড়া, বউ-ঝি’র হিংসা বিদ্বেষ ওই সব টিভির সিরিয়ালে দেখানো হয়। সন্ধ্যে হলে সেসব সিরিয়াল দেখার জন্য অস্থির হয়ে পড়েন আমাদের মা-বোনেরা। নানা কারণে রাজধানীর বেশির ভাগ মানুষের টিভি স্ক্রিনেই চোখ রেখে কেটে যাচ্ছে দিনের অধিক সময় সময়। যৌথ পরিবারের ঐতিহ্য থেকে সরে এসে একক পরিবারে বসবাসরতদের টিভিই হয়ে গেছে বিনোদনের মাধ্যম। চলছে রমজান মাস। ব্যবসায়ীক স্বার্থেই হোক আর যে কোনো কারণেই হোক দেশের অধিকাংশ টিভিতে নানা ধরনের ইসলামী অনুষ্ঠান প্রচার হচ্ছে। তথাকথিত প্রগতিশীল এবং ইসলাম বিদ্বেষী মানসিকতার কারণে কিছু টিভি রমজান নিয়ে তেমন কিছু না করলেও অধিকাংশ টিভিতে কোরআন শিক্ষা, হামদ-নাত প্রতিযোগিতা, কোরআন খতম, ইসলাম-রমজান নিয়ে আলোচনা, ইসলামী প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শনসহ অসংখ্য অনুষ্ঠান হচ্ছে দেশের চ্যানেলগুলোতে। রমজানে ইফতার, তারাবি নামাজ ও ছেহেরি নিয়েও অনুষ্ঠান হচ্ছে। অথচ অধিকাংশ বাসায় দেখা যায় ইফতারের পর পরই মা, চাচী, খালা, বোন, ভাবীরা টিভির রিমোট দখল করে বসে আছেন। তারা সন্ধ্যা থেকে গভীর রাত পর্যন্ত ভারতীয় চ্যানেল স্টার জলসা, স্টার প্লাস, জি বাংলা, সনি, তারা বংলা, সাহারা টিভিতে প্রচারিত একটির পর একটি ধারাবাহিক সিরিয়াল দেখছেন। খোঁজ-খবর নিয়ে জানা গেছে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত নারীদের অধিকাংশই ভারতীয় সিরিয়ালে আসক্ত। তারা বিবিসি, ডিসকভারি, ন্যাশনাল জিওগ্রাফি, এনিমেল প্যানেট, কিডস চ্যানেল, নিও স্পোর্টস, স্টার স্পোর্টস বা টিভির শিক্ষামুলক অনুষ্ঠান দেখেন না। তারাও ভারতীয় টিভির সিরিয়াল দেখতে বেশি উৎসাহী। ওই সব সিরিয়ালের গল্পে পারিবারিক কলহ, কুটিলতা, কপটতা, হিংসা-বিদ্বেষ থাকে বেশি। অভিনেত্রীদের মেকাপ-গেটআপে অর্ধনগ্ন-অশ্লীলতায় ভরপুর এসব সিরিয়ালের মূল বিষয়বস্তু হলো হিন্দুদের ধর্মীয় সাংস্কৃতি সারাবিশ্বে ছড়িয়ে দেয়া। সঙ্গে যোগ হয়েছে আধুনিক যুগের অসুস্থ সেকুলার ধ্যান-ধারণা। বাংলা-হিন্দি সিরিয়াল যাই প্রচার করুক না কেন, তাদের মূল উদ্দেশ্য হলো হিন্দুত্ববাদী চেতনাকে হিন্দু তো বটেই মুসলমানদের মন ও মস্তিস্কে গ্রোথিত করা। অধিকাংশ সিরিয়াল শুরু হয় মঙ্গল প্রদীপ জ্বালানোসহ ব্যাকগ্রাউন্ডে হিন্দু শ্লোক বা ধর্মসংগীত দিয়ে। আবহসঙ্গীতে থাকে শঙ্খধ্বনি, উলুধ্বনি, মন্দিরের ঘণ্টা, ঢোলবাদ্য, পূজার সঙ্গীত ইত্যাদি। ঘরে ঘরে ওই সব সিরিয়াল দেখায় রমজান মাসের পবিত্রতা নষ্ট হচ্ছে। যে মা, বোন, ভাবী বা চাচি সারাদিন রোজা রেখেছেন তিনিই সন্ধ্যায় টিভি সেটের সামনে বসেই সিরিয়াল দেখা শুরু করেন। ফলে বাসার সবাই রোজা রাখলেও পারিবারিক আবহে আর ‘রমজানের পবিত্রতা’ থাকে না। আগে দেখা যেত রমজানে বিভিন্ন বাসা-বাড়িতে মা-বোনেরা রোজা রেখে সকাল-বিকেল কোরআন তেলাওয়াত করতেন। রমজান উপলক্ষে কোরআন খতম দিতেন। ভারতীয় টিভির সিরিয়াল যেন সেই আবহ নষ্ট করে দিয়েছে। বাংলাদেশের প্রায় ঘরে ঘরে পৌঁছে গেছে ডিস ক্যাবল লাইন, চলছে স্যাটেলাইট সংস্কৃতির রাজত্ব। প্রত্যন্ত গ্রামে এখন ডিশের মাধ্যমে স্যাটেলাইট চ্যানেল দেখা যায়। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে খবর শুনতে এবং অবসর পেলেই টিভির সামনে বসেন। খবর অতঃপর ভারতীয় চ্যানেল চালু ও বাকিটা সময় ভারতীয় চ্যানেলে সিরিয়াল দেখে দেখে সময় পার করেন। ভারতীয় হিন্দি ও বাংলা (কলকাতা) সিরিয়ালের মূল দর্শক হয়ে গেছে আমাদের দেশের নারী এবং কিছু শিশু কিশোর-কিশোরী। এমনকি বাধ্য হয়েই আজকাল অনেক পুরুষও এসব সিরিয়াল দেখছেন। ভুক্তভোগী একাধিক পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তাদের পরিবারের মহিলাদের দুনিয়ার সব কাজকর্ম বাদ দিয়ে রাতে একটাই কাজ ‘সিরিয়াল দেখা’। প্রতিদিনই নতুন নতুন পর্ব আর ঘটনার চমকের কারণে নেশা ধরে গেছে সিরিয়ালে। সিরিয়ালের এই আসক্তি ঢাকার পাশাপাশি মফস্বল শহরগুলো এবং গ্রামের মা-বোনদের মধ্যেও ভয়াবহ আকারে ছড়িয়ে পড়েছে। অপ্রিয় হলেও সত্য যে ভারত প্রাচীন সংস্কৃতির দেশ হলেও আমরা ভারতের পর্নো সংস্কৃতির নামে অপসংস্কৃতির আগ্রাসনের শিকার। আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব, মিডিয়া ব্যবসায়ীরা ওই পর্নো সংস্কৃতি উপভোগ করছে। এতে এ দেশের সংস্কৃতি বিকাশে বাধা পাচ্ছে। মা-খালাদের আসক্তি দেখে প্রশ্ন উঠেছে ইতোমধ্যেই কী ভারতীয় অপসংস্কৃতির আগ্রাসনে আমরা নিজস্ব সাংস্কৃতির স্বকীয়তা হারিয়ে ফেলেছি? রাজধানীর কর্মজীবী মানুষের ব্যস্তজীবন এবং যৌথ পরিবার ভেঙে যাওয়ার ফলে টিভি সব পরিবারে অত্যাবশ্যকীয় উপকরণ হয়ে গেছে। চাকরিজীবী অভিভাবকরা ছেলে-মেয়েদের যথেষ্ট সময় দিতে না পরায় তারা একাকিত্ব বোধ করেন। ঢাকায় পর্যাপ্ত খেলাধুলার সুযোগ না থাকার সেই একাকীত্ব বোধ দূর করতে অগত্যা টিভি বেছে নেয়। দেখেন কাটুন। আর মা যদি কর্মজীবী হন, তখন স্বভাবতই শিশু গৃহপরিচালিকার কাছে বড় হয়, এবং অনেক সময় গৃহপরিচারিকারা শিশুকে ব্যস্ত রাখার জন্য টিভি দেখতে উৎসাহিত করে। ছোট শিশুরা সহজেই বিজ্ঞাপন ও ভারতীয় কার্টুনের প্রতি আকৃষ্ট হয়। ডোরেমন, নিনজা হাতুড়ি, ওগি এন্ড ক্রজেস, মিস্টার বিন, পাকদাম পাকদাই, টম এন্ড জেরি, জিং এন্ড সার্ক, ডোরা, মোটু-পাতলু। এসব কার্টুন বাংলা, ইংলিশ, হিন্দী ভাষায় ডাবিং করা। ডোরেমন এবং টম এন্ড জেরি কার্টুন শিশুদের চাতুরি-কপটতা শেখায়। রমজান মাসেও সেটা চলছেই। শিশুরা বাসায় কিভাবে সময় কাটায় এবং তারা কী শিখছে সে সম্পর্কে আমাদের কর্মজীবী মা, খালা, চাচী, বোন, মেয়ে, ভাবীদের সতর্ক হওয়া জরুরী। বর্তমান সংসদ নিয়ে দেশের মানুষের তেমন আগ্রহ না থাকলেও সাবেক প্রেসিডেন্ট এরশাদের একটি বক্তব্য নিয়ে বেশ হৈচৈ পড়ে যায়। সংসদে বাজেট অধিবেশনের সমাপনী বক্তৃতায় তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী, স্পীকার, বিরোধী দলীয় নেতা, সংসদ উপনেতা নারী হলেও এদেশের নারীরা কার্যত শোপিস। নারীদের শোপিস বলায় অপমানবোধ করে নারী এমপিরা প্রতিবাদ করেন। পরিস্থিতি বেগতিক দেখে ঝোপ বুঝে কোপ মারতে অভ্যস্ত সুচতুর এরশাদ বক্তব্য প্রত্যাহার করে নেন। অথচ তিনি অপ্রিয় সত্য কথাই উচ্চারণ করেছিলেন। দেশের প্রকৃত চেহারা কী। ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা, সিটি কর্পোরেশন, উপজেলা পর্যায়ে যে নারীরা জনগণের ভোটে জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হয়েছেন তাদের জিজ্ঞাসা করলেই প্রকৃত চিত্র পাবেন ভোট বিহীন নির্বাচনের পর মনোনীত এই মহিলা এমপিরা। কতজন মহিলা জনপ্রতিনিধি মতামত দেয়া ও কাজ করার সুযোগ পাচ্ছেন। তৃর্ণমূলের ভোটে নির্বাচিত ওই মহিলা জনপ্রতিনিধিদের অধিকার নিশ্চিত করতে পারেন মনোনীত মহিলা এমপিরা। অপসংস্কৃতির হাত থেকে দেশের সাংস্কৃতি কৃষ্টি কালচার রক্ষা করার দায়িত্ব নিতে পারেন তারা। তারা দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে দেশী সংস্কৃতির বিকাশের স্বার্থে আমাদের মা-বোন-ভাবী-চাচীদের রমজানে ভারতীয় টিভির হিন্দুয়ানী সিরিয়াল দেখা নিরুৎসাহিত করে অপসংস্কৃতির হাত থেকে তাদের রক্ষা করতে পারেন। এতে করে রমজানের পবিত্রতা রক্ষা পাবে।
ইনকিলাব