মনীষী চরিত

দানবীর শায়খ আব্দুর রহমান বিন হামূদ আস সুমাইত

আমরা অনেকেই কলকাতায় অবস্থানকারী আলবেনিয়ান পরলোকগত ক্যাথলিক যাজিকা মাদার তেরেসার কথা জানি। কিন্তু ক’জন আমরা জানি ড. আব্দুর রহমান আস-সুমাইতের কথা? এক অসাধারণ মানবপ্রেমী মুসলিম দা’ঈ ইলাল্লাহ ছিলেন ড. আস-সুমাইত। ত্যাগ, কুরবানী আর দাও’আতের ক্ষেত্রে অনন্য সফলতা অর্জনকারী এক মহান ভাই আমাদের এই ডাক্তার।শাসকদের বিরাগভাজন হয়ে জেল খেটেছেন; নিজের মেডিক্যাল ফিল্ডে মূল্যবান গবেষণা করেছেন; দাতব্য সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেছেন অনেক; আফ্রিকান সমাজে দা’ওয়াতের কাজ করার জন্য সেখানকার গোত্রগুলোর জীবন-প্রণালী নিয়ে বই লিখেছেন; ১২৪টা হাসপাতাল, ৮৪০টা স্কুল, ২০৪টা ইসলামিক সেন্টার, ২১৪টা নারী প্রশিক্ষণ কেন্দ্র এবং ২২০০ মসজিদ প্রতিষ্ঠা করেছেন। সর্বোপরি আফ্রিকার ২৯টা দেশে ১১ মিলিয়ন [১ কোটি ১০ লাখ] মানুষ তাঁর অনুপ্রেরণায় ইসলাম গ্রহণ করেছে।

দানবীর শায়খ আব্দুর রহমান বিন হামূদ আস সুমাইত:

একজন কুয়েতী আলেম ও দাওয়াত-কর্মী। কুয়েতে তাঁর জন্ম, ইরাক, ইংল্যান্ড, ক্যানাডায় শিক্ষা লাভ করেন। আর জীবন অতিবাহিত করেন একজন মানবদরদী হিসেবে। তিনি আফ্রিকার মুসলিমদের সাহায্যে নিবেদিত কুয়েত ভিত্তিক সংগঠন আল আওনুল মুবাশির সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা। এ সংস্থাটি আফ্রিকার ছয় মিলিয়ন মানুষের মাঝে ইসলাম প্রচার করেছে। আফ্রিকায় তাঁর সংস্থাটি (আল আওনুল মুবাশির) ২২ বছর কাজ করছে।

শায়খের জীবনী :

ড. আব্দুর রহমান হামূদ আস সুমাইত ১৯৪৭ সালে জন্ম গ্রহণ করেন। শিশুকাল থেকেই তিনি মানবসেবায় আত্মনিয়োগ করেন। উচ্চ মাধ্যমিকের ছাত্র থাকা অবস্থায় তিনি নিজেদের সাথীদের মধ্যে টাকা জমা করে তা দিয়ে একটি গাড়ী কিনেন। তাদের মধ্য থেকে একজন গাড়ী চালাতেন। তারা বিনা পয়সার মানুষের মালামাল পরিবহন করে দিতেন।

বাগদাদ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চিকিৎসা ও সার্জারিতে অনার্স ডিগ্রী অর্জন করেন। বিশ্ব বিদ্যালয়ে থাকা অবস্থায় তিনি বিভিন্ন দান সংগ্রহ করে, নিজের বৃত্তির পয়সা দিয়ে বই-পত্র কিনে বিভিন্ন মসজিদে বিতরণ করতেন। আর নিজে খুব মিতব্যায়ীতার সাথে জীবন যাপন করতেন।  ১৯৭৪ সালে তিনি লিভারপুল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পেট ও পাকস্থলীর রোগ সম্পর্কে ডিপ্লোমা অর্জন করেন। তিনি সেখানেও প্রত্যেক মুসলিম ছাত্রের কাছ থেকে মাসিক এক ডলার করে আদায় করতেন। তা দিয়ে তিনি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও আফ্রিকার মানুষদের জন্য বই-পত্র কিনে পাঠাতেন।


কর্ম জীবন :

তিনি আস সাবাহ হাসপাতালে ১৯৮০ থেকে ১৯৮৩ সাল পর্যন্ত কাজ করেন। তখন তিনি শল্যবিদ্যা, পেটের ক্যানসার বিষয়ে বেশ লেখালেখি করেন। ১৯৭৬ সালে তিনি আমেরিকা ও কানাডার মুসলিম ডাক্তারদের নিয়ে একটি সংস্থা গঠন করেন। এমনিভাবে তিনি ১৯৮৪-৮৬ সালে মন্ট্রিলে মুসলিম ছাত্র সংস্থা, মালাবী মুসলিম সংস্থা ও কুয়েত জয়েন্ট রিলিফ কমিটি (১৯৮৬ সালে) প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখেন।

– তিনি আফ্রিকায় ২৯ বছর ধরে ইসলামের প্রচার করেন। আফ্রিকার গরিব দুঃখীদের কষ্ট লাঘবের জন্য তাঁর অকাতর চেষ্টা কেমন ছিল?
– আফ্রিকার ২৯টা দেশে ১১ মিলিয়ন [১ কোটি ১০ লাখ] মানুষ তাঁর হাতে [অনুপ্রেরণায়] ইসলাম গ্রহণ করেছে।
– তিনি ২৯ বছর আফ্রিকায় ইসলাম প্রচার প্রসারের কাজ করেন।
– আফ্রিকার মুসলিমদের জন্য Direct Aid নামে একটি ইসলামি ত্রাণ সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেন।
– ১৫০০০ অধিক অনাথ ইয়াতিমের ভরন পোষণ দেন বা লালন পালন করেন।
– ৫৭০০ এর অধিক মসজিদ নির্মান করেন।
– ১২৪ টি হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেন।
– ৯৫০০ বিশুদ্ধ পানির কূপ বা কুয়া নির্মাণ করেন।
– ৮৬০ স্কুল নির্মাণ করেন।
– ৪ টি ইউনিভার্সিটি নির্মাণ করেন।
– ৯৫০০০ মুসলিম ছাত্রের পড়াশুনার খরচ বহন করেন।
– ২১৪ টা নারী প্রশিক্ষণ কেন্দ্র
– ২০৪ টি ইসলামিক দাওয়া সেন্টার নির্মাণ করেন।
– ৮৪০ টি কুরআন শিক্ষা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেন।
– ৬ মিলিয়ন কুরআন মাজীদ নতুন মুসলমানদের মধ্যে বিতরণ করেন।
– ৪০ টি দেশে গরিবদের জন্য ইফতারীর ব্যবস্থা করতেন।

শুধু নিজের তৈরী সংস্থার দাওয়ার মাধ্যমে, মাশাআল্লাহ, আফ্রিকার ৭ মিলিয়নের বেশী মানুষকে তিনি ইসলামের সুশীতল ছায়ায় আনতে পেরেছেন। যখন তাঁর সম্পর্কে কেউ ভাল কিছু বলত, তিনি উত্তর দিতেন:

‘প্রিয় ভাই, আমরা কোন ব্যক্তির কাছ থেকে প্রতিদানের জন্য অপেক্ষা করিনা। আমরা ফিল্ড ওয়ার্কে ব্যস্ত। আমরা শুধু অপেক্ষা করি এবং দুআ করি যে সর্বশক্তিমান আল্লাহ আমাদের একান্ত প্রচেষ্টাকে কবুল করেন এবং আমাদের কাজে সাহায্য করেন”। আমিন, আমিন, আমিন।

কখন তিনি সুখ অনুভব করতেন এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেনঃ আমি সুখ আস্বাদন করি যখন কোন তরুণকে দেখি শিক্ষা লাভ করতে, তার ভাল কর্ম সংস্থান হতে, সদাচারী হতে, এবং আমার মনে পড়ে সেই সময়ের কথা যখন তাকে আমরা দারিদ্র, ক্ষুদা আর রোগশোকের মধ্যে থেকে আমরা তাকে কুড়িয়ে পেয়েছিলাম। আমি সুখ আস্বাদন করি যখন কোন জায়গায় একটা স্কুল গড়তে পারি, যেখানে শিক্ষা কি জানা ছিল না। আমি সুখ অনুভব করি তখন যখন কেউ প্রথমবারের মত তার তর্জনী আকাশের দিকে উঠিয়ে এক আল্লাহর সাক্ষ্য (শাহাদা) দেওয়ার সুযোগ পায়। তিনি তার কাজের স্বীকৃতি হিসাবে বহু পুরস্কার লাভ করেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল, বাদশা ফয়সল পুরস্কার। যার মুল্য সাত লক্ষ পঞ্চাশ হাজার সৌদী রিয়াল।

আমাদের জন্য তার উপদেশ:

১) কারো দৃঢ়তা আর ইচ্ছা থাকলে তার পক্ষে লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব, ইনশাআল্লাহ, শর্ত একটিই – আশা ছাড়া যাবে না।
২) ডোনেশন/ফান্ড যোগাড়, প্রাসাদ নির্মাণ, পোষাক পরিচ্ছদ আর গাড়ি কিনার মধ্যে সত্যিকারের সুখ নিহিত নেই। বরং, অন্যদের হৃদয়ের মাঝে আনন্দ এনে দিতে পারার মধ্যেই সুখ রয়েছে।
৩) ব্যর্থতা আসলে আশা ছাড়া যাবেনা, কারণ এই ব্যর্থতা বোঝায় যে, আপনি সাফল্যের পথে রয়েছেন।
৪) মানুষের হাতে কি প্রাচুর্য আছে, তার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পিছে ছুটেন না। তাহলে মানুষ আপনাকে ভালবাসবে।


ইসলামের খিদমতকারী এই শেখ আব্দুর রহমান বিন হামূদ আস সুমাইত ২০ ডিসেম্বর, ২০১১ তারিখে, এই এক সপ্তাহ আগে মারা গেলেন। ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্নাইলাইহি রাজিউন। তার সদকার কথা চিন্তা করুন, যুগ যুগ ধরে ইনশাআল্লাহ জারি থাকবে। আমরাও কি ইসলামের খিদমত করতে পারিনা? আমাদের সামর্থ্য অনুযায়ী? আল্লাহ আমাদের সেই তাওফিক দান করুন। আমিন।

(waytojannah.com)

ইসলামিক ইমেইল নিউজলেটার
নতুন পোস্ট প্রকাশিত হলে সরাসরি আপনার ই-মেইল ইনবক্সে পেতে সাবস্ক্রাইব করুন।
icon

মন্তব্য করুন

Back to top button