মধ্যপ্রাচ্যে একনায়কতন্ত্রই কি ভালো ছিল?
ঐতিহ্যগতভাবে দীর্ঘকাল রাজতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণে থাকা মধ্যপ্রাচ্যে কি একনায়কতন্ত্রই উত্তম শাসনব্যবস্থা? ইয়েমেন থেকে লিবিয়া কিংবা সিরিয়ার চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়া সাম্প্রতিক সংঘাত দেখে এ প্রশ্নটাই এখন সামনে আসছে। ২০১১ সালের কথিত আরব বসন্তের পর থেকে এই তিনটি দেশের পথ-পরিক্রমা ভিন্ন হলেও সংঘাত সবখানেই রয়েছে। একটা বিষয় স্পষ্ট, এই অস্থিতিশীলতা থেকে বের হওয়ার স্বল্পমেয়াদি কোনো রাস্তা সামনে দেখা যাচ্ছে না।
মধ্যপ্রাচ্যের এই অস্থিরতায় পশ্চিমা বিশ্ব বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র দৃশ্যত বেশ অস্বস্তিতে রয়েছে। যদিও এ অঞ্চলের বর্তমান করুণ অবস্থাটি তাদেরই গর্ভজাত ফসল। একনায়কতন্ত্রের প্রতি আরব বসন্তের আগে-পরে পশ্চিমা দৃষ্টিভঙ্গির দ্বৈত অবস্থা ও তাদের আধুনিক ইতিহাসের অদূরদর্শিতা আজকের এ বিপর্যয়কর পরিস্থিতি তৈরি করেছে।
২০১১ সালের আগে মধ্যপ্রাচ্যে গণতন্ত্রের চেয়ে স্থিতিশীলতা বেশি মূল্যবান ছিল। দশকের পর দশক ধরে আরব একনায়তন্ত্র সহ্য করা হয়েছে, কারণ তারা পশ্চিমাদের নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থ করতে দিয়েছিলেন। মিসরে হোসনি মোবরককে ইসরাইলের সঙ্গে শান্তির প্রতীক হিসেবে দেখা হয়েছিল। লিবিয়ায় মুয়াম্মার গাদ্দাফি সম্ভাব্য বিনিয়োগ ও বাণিজ্যচুক্তিতে রাজি ছিলেন। সিরিয়ার বাশার আল আসাদকে গোলান হাইটস নিরাপত্তার রক্ষক বিবেচনা করা হয়েছিল। আর ইয়েমেনের আলী আবদুল্লাহ সালেহ ছিলেন আল কায়দাবিরোধী মিত্র। সরকারের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে গণমাধ্যম, সুশীল সমাজ কিংবা মানবাধিকার কর্মীদের ততটা উচ্চবাচ্য ছিল না। এ অবস্থা দেখে পশ্চিমা বিশ্ব খুশি ছিল তাদের স্বার্থ অনন্তকাল নিরাপদ।
বিনিময়ে আরবের একনায়করা পশ্চিমাদের আর্থিক ও সামরিক সহায়তা পেতেন। নিজেদের রাজনৈতিক নেতৃত্বের নিশ্চয়তাও পেতেন। এর মধ্যে ইয়েমেন ছিল গতিশীল চুম্বক। সালেহর ব্যক্তিস্বার্থে করা নানা উচ্চাভিলাষী অপকর্মের অন্ধ সমর্থন করতেন পশ্চিমা কূটনীতিকরা। অস্ত্র চোরাকারবারি থেকে ব্যবসায়িক পার্টনারও ছিলেন তিনি। অথচ ইয়েমেনের অধিকাংশ জনগণ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে। সালেহর আবেদন আরও বেড়ে যায়, যখন আরব উপদ্বীপে আল কায়দার বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের ড্রোন হামলা চালানোর সুযোগ দিয়েছিলেন।
একনায়কতান্ত্রিক বাস্তবতা উল্টে গেল যখন আরব বসন্ত শুরু হল। পশ্চিমা বিশ্ব তা উপেক্ষা করতে পারিনি। প্রকাশ্যে তারা বিপ্লবকে সমর্থন দিল। কিন্তু একনায়কতন্ত্র পরবর্তী অবস্থা সামলানোর মতো দীর্ঘমেয়াদি কৌশল ঠিক করতে পারেনি। বর্তমান অরাজকতার জন্য দায় তাই পশ্চিমাদেরই। লিবিয়াকে স্থিতিশীল করার স্পষ্ট কোনো ভিশন ছাড়াই তড়িঘড়ি করে তারা আন্তর্জাতিক সামরিক অপারেশন চালালো। যার পরিণতিতে এখন ধুঁকে ধুঁকে মরছে দেশটি। কূটনৈতিক নানা হম্বিতম্বিতে সত্ত্বেও সিরিয়া নোংরা যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছে।
ইয়েমেনের গণঅভ্যুত্থানের মীমাংসা হল এভাবে, উপসাগরীয় সহযোগিতা কাউন্সিলের (জিসিসি) উদ্যোগে সালেহ তার ডেপুটি আব্দো রাব্বো আল মানসুর হাদির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর হবে। কিন্তু এর পাল্টা প্রতিক্রিয়া ভেবে দেখা হয়নি। যার মূল্য এখন শোধ করছে ইয়েমেন। যুক্তরাষ্ট্র ও সৌদি আরব ইয়েমেনের জাইদি হুথি ও সুন্নিদের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বকে আমলে নেয়নি। হুথিদের ওপর একনায়ক সরকারের অবদমনকে গুরুত্ব দেয়নি। মার্কিন ড্রোন হামলায় বেসামরিক মানুষ নিহত হওয়ার এক ধরনের জনঅসন্তোষও ছিল। হুথিদের সঙ্গে ইরানের ঘনিষ্ঠতা ও সমর্থন বিবেচনা না করে তাদের অধিকার অগ্রাহ্য করা হয়েছিল।
এখন অনেকেই বলছেন, ওটা ‘আরব বসন্ত’ ছিল না, ছিল ‘আরব শীত’। একনায়কতন্ত্র থেকে গণতন্ত্রে উত্তরণের পথ কখনও সোজাসাপ্টা হয় না। ইয়েমেনের বর্তমান বিপর্যয় এটাই দেখিয়ে দিচ্ছে যে, একনায়কতান্ত্রিক শাসনেই স্থিতিশীলতা ও স্বস্তি ছিল। যদিও ভেতরে অগ্ন্যুৎপাতের আয়োজন ছিল।
কিন্তু একনায়করা তাদের জনগণের ওপর কড়াকড়ি করলেও বিনিময়ে দেশকে নিরাপদ রাখে। পশ্চিমা সাহায্য নিলেও একনায়কদের নিজস্ব স্বার্থে যখন আঘাত লাগে, তারা ঘুরে দাঁড়ায়। মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে এই যে সংঘাত, তা একনায়কদের রাজনৈতিক অর্থনৈতিক ও সামাজিক স্বৈরাচারের ফল। একনায়কী সেই ঢাকনা খুলে যাওয়ায় তা বের হয়ে পড়েছে। তাই মনে হচ্ছে ওই সব লৌহ মানবরাই ‘সাময়িক’ নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতার চাদরে মুড়ে রেখেছিল। সেই ‘সাময়িক’ সময়টাই তো কয়েক দশক।
যুগান্তর