সাম্প্রতিক প্রসঙ্গ

তবে কি বাংলাদেশ একটি ব্যর্থ রাষ্ট্র?

জান-মাল-ইযযতের নিরাপত্তা,  খাদ্য-পানীয়-চিকিৎসা-বাসস্থান ও স্বাভাবিক মৃত্যুর নিশ্চয়তা এবং সর্বোপরি অধিকতর  উন্নত জীবন যাপনের জন্য রাষ্ট্র গঠিত হয়। কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশে এর কোনটাই কি  খুঁজে পাওয়া যাবে? রাস্তায় বের হ’লে বোমাবাজ ও চাঁদাবাজদের আতংক, ঋণ নিতে গেলে  সূদখোর ও অফিসে গেলে ঘুষখোরদের আতংক, বাজারে গেলে বিষ ও ভেজালের আতংক, আদালতে গেলে  রিম্যান্ড ও কারাগারের আতংক, নেতাদের কাছে গেলে মিথ্যা আশ্বাস অথবা ক্যাডার লাগিয়ে  স্বার্থ উদ্ধারের আতংক, র্যাব পুলিশের কাছে গেলে আযরাঈলের আতংক, এভাবে সার্বিক  জীবনে আতংক নিয়ে যে দেশের মানুষ সদা তটস্থ, সে দেশ কি সফল রাষ্ট্র? ব্যবসা-বাণিজ্য  স্থবির, চাকুরী থেকে কর্মী ছাটাই, শ্রমিক-মজুরদের কর্মহীন জীবন, নারীর ইযযত ও  মানুষের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলা, সর্বত্র দুর্বৃত্তায়ণ যে দেশকে আষ্টে-পৃষ্ঠে  গ্রাস করেছে, সে দেশকে আমরা কি বলব? ‘একটি ফুলকে বাঁচাতে মোরা যুদ্ধ করি’-  মুক্তিযুদ্ধের সেই গান এখন বেসুরো মনে হয়। পত্রিকা খুললেই বন্দুক যুদ্ধে র‌্যাব ও  পুলিশের মানুষ হত্যা আর দুবৃত্তদের ককটেল ও পেট্রোল বোমা মেরে মানুষ পোড়ানোর খবর।  ক্ষমতালোভী দু’টি দলের নেতা ও ক্যাডারদের হানাহানিতে দেশ এখন ধ্বংসের  দ্বারপ্রান্তে। উভয় দলই গণতন্ত্র উদ্ধারের জন্য লড়ছে। অথচ উভয় দলেরই সস্তা শিকার  হ’ল এদেশের জনগণ। কথিত ক্রসফায়ারে মরছে সাধারণ মানুষ, পেট্রোল বোমায় পুড়ছে সাধারণ  মানুষ, মিথ্যা মামলায় কারাগারে যাচ্ছে সাধারণ মানুষ। গত ৩রা জানুয়ারী থেকে এযাবত  যে ১২/১৪ হাযার মানুষকে পুলিশ গ্রেফতার করে জেলে পাঠিয়েছে, তাদের মধ্যে কয়জন  প্রকৃত দোষী? দোষীরা তো দোষ করে পালিয়ে যায় বা তারা শেল্টার পায়। পরে পুলিশ গিয়ে  নিরীহ মানুষ ধরে এনে পিটায় ও ডজন খানেক মিথ্যা মামলা দিয়ে জেলে পাঠায়। গত ১৫ই  জানুয়ারী শিবগঞ্জের মহদীপুর, রসূলপুর ও চন্ডিপুরে র্যাব-পুলিশ যৌথবাহিনী যে  ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে, ’৭১-এর ধ্বংসযজ্ঞের পরে তার কোন তুলনা আছে কি? রাস্তায় কারা  ককটেল ফাটিয়েছে তার জন্য কি গ্রামবাসী দায়ী? দিনে-দুপুরে বাড়ী-ঘরে ঢুকে  নারী-পুরুষ-শিশু সবাইকে বেধড়ক পিটানো, ঘরের আসবাব-পত্র, টিভি, ফ্রিজ, শোকেস  ইত্যাদি ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে দেওয়া, ধানের গোলায় আগুন দেওয়া, হোন্ডা পুড়িয়ে দেওয়া,  এগুলি স্রেফ সন্ত্রাস ও গুন্ডামি ছাড়া আর কি? কয়েকটি গ্রামের আতংকিত মানুষের  কাঁথা-বালিশ নিয়ে এক কাপড়ে নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে রাস্তায় হাঁটার দৃশ্য পত্রিকায়  দেখে কে বলবে যে, এরা স্বাধীন বাংলাদেশের স্বাধীন মানুষ? নিরীহ নিরপরাধ ছেলেটিকে  ধরে নিয়ে রাতের বেলায় ঠান্ডা মাথায় নিজেরা গুলি করে হত্যা করে হাসপাতালে রেখে আসা।  অতঃপর বন্দুক যুদ্ধের (!) মিথ্যা বিবৃতি সাজিয়ে পত্রিকায় দেওয়াই হ’ল এখন বিচার সম্মত  শাস্তি ব্যবস্থা। অথচ ‘দেখামাত্র গুলি’ ‘জিরো টলারেন্স’ ইত্যাদি ভাষা তো কোন  দায়িত্বশীল সরকার বা আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর হ’তে পারে না। তাহ’লে ৭১-এর  খানসেনাদের সাথে এদের পার্থক্য কোথায়? তাই জিজ্ঞেস করতে মন চায়- হে গণতন্ত্রের  ধ্বজাধারীরা! আর কত মানুষ খুন করলে, আগুনে পোড়ালে আর জেলে ভরলে তোমাদের গণতন্ত্র  উদ্ধার হবে?

হাযারো মানুষের আবেদন উপেক্ষা করে বলা হচ্ছে,  ‘সংলাপে লাথি মারো’। সরকারী দলের মন্ত্রী-এমপিদের এ ধরনের হুমকি ও ফালতু কথন যে  দেশটাকেই ফালতু বানিয়ে দেয়, সে হুঁশ কি নেতাদের আছে? দেশটা কি কেবল সরকারী দলের?  নাকি কেবল বিরোধী দলের? যারা দু’দলের কোনটাতে নেই, তারা কি এদেশের নাগরিক নয়? তারা  কি সরকারকে ট্যাক্স দেয় না? দু’দলের কামড়া-কামড়িতে দেশ রসাতলে যাচ্ছে। এরপরেও  নেতাদের হুঁশ ফিরছে না। সরকার যেখানে শতভাগ জনপ্রিয়, সেখানে দেশে শান্তির স্বার্থে  সংসদ ভেঙ্গে দিয়ে এখনি নির্বাচন দিতে সমস্যা কোথায়? বিরোধী দলের স্বাভাবিকভাবে  সভা-সমিতি করায় বাধা কেন? মনগড়া সংবিধানের একটি পৃষ্ঠার চাইতে একটি মানুষের জীবনের  মূল্য কি বেশী নয়? সরকার ও সরকারী দল যখন একাকার হয়ে গেছে এবং দু’টি দলের নেতারা  যেখানে চরমপন্থায় চলে গেছেন, তখন প্রেসিডেন্টের ‘ভূমিকা’ রাখাটা অপরিহার্য হয়ে  দাঁড়িয়েছে। তিনি তাঁর সাংবিধানিক ক্ষমতা প্রয়োগ করুন। নইলে ইহকালে ও পরকালে তাঁর  জওয়াবদিহী করার কোন পথ থাকবে না। প্রধান বিচারপতিরও এক্ষেত্রে করণীয় আছে। দয়া করে  তা প্রয়োগ করুন সর্বোচ্চ মানবিক তাকীদে। নইলে অন্ধকার ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করছে সকলের  জন্যে। সবাই দেখতে পাচ্ছেন দু’দলই এখন তাদের বিদেশী প্রভুদের দিকে তাকিয়ে আছে। কে না  জানে যে, বিদেশীরা এই সুযোগেরই অপেক্ষায় আছে। আর তাদের মধ্যস্থতায় মীমাংসা হওয়া  অর্থ দেশের স্বার্থ তাদের কাছে বিকিয়ে দেওয়া। তাদেরই ষড়যন্ত্রে ইতিমধ্যে সূদান, ইরাক,  লিবিয়া অকার্যকর রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে এবং ইয়ামেন হবার পথে।

দল এবং সরকার আলাদা বস্ত্ত। সরকারকে সর্বদা  নিরপেক্ষ থাকতে হয়। তাদেরকে দলীয় স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে দেশ ও জনগণের স্বার্থ  দেখতে হয়। এর ফলে শেষ বিচারে সরকারী দলেরই লাভ হয়। কিন্তু এ দূরদর্শিতা এদেশে বিরল।  তবুও উভয় দলকে বলব, মানুষ হত্যার ও লুটপাটের রাজনীতি বাদ দিন। মানুষকে ভালবাসুন।  মানুষ আপনাদের ভালবাসবে। আল্লাহ খুশী হবেন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মানুষ পুড়িয়ে মারতে  নিষেধ করেছেন (বুখারী)। অথচ বন্দুকের গুলির আগুনে আর ককটেল ও পেট্রোল  বোমার আগুনে আপনারা হর-হামেশা মানুষ পুড়িয়ে মারছেন। এর ফলে আপনারা ইহকাল ও পরকাল  দু’টিই হারাচ্ছেন। সারা জীবন রাজনীতি করে তাহ’লে কি নিয়ে আপনারা কবরে যাবেন?

এ বিষয়ে আমাদের একটা ছোট্ট প্রস্তাব আছে : সরকার  ও বিরোধী দল যদি নিশ্চিত হন যে, তারাই এদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় দল, তাহ’লে নির্বাচন  কমিশনকে নির্দেশ দিন, তারা দল ও প্রার্থীবিহীন ভাবে নেতৃত্ব নির্বাচন দিন। কোন  এমপি নয়, কেবল সর্বোচ্চ নেতার নির্বাচন হবে। নির্বাচনের দিন ছুটি ঘোষণা করবেন না। কেউ  কোনরূপ ক্যানভাস করবেন না। শূন্য ব্যালটে বা ই-মেইল যোগে জনগণ তাদের মতামত ব্যক্ত  করুক। দেখা যাক কোন নেতা কত জনপ্রিয়। সর্বোচ্চ ভোটপ্রাপ্ত ব্যক্তি হবেন  প্রধানমন্ত্রী। পরের জন হবেন উপ-প্রধানমন্ত্রী। অতঃপর উভয়ে যোগ্য লোক বাছাই করে  পারস্পরিক পরামর্শক্রমে দেশ চালাবেন। সরকারী বা বিরোধী দল বলে কোন কিছুর নাম-গন্ধ  থাকবে না। উভয় দলের নেতাদের মধ্যে কারু এ সৎসাহস আছে কি?

আমরা  একটি কার্যকর ও সফল রাষ্ট্র হিসাবে বাংলাদেশকে দেখতে চাই। আমরা আমাদের জান-মাল ও  ইযযত নিয়ে এদেশে নিরাপদে বসবাস করতে চাই। নেতাদের মারামারির দায় আমরা গ্রহণ করতে  চাই না। পেট্রোল বোমায় দগ্ধীভূতদের কান্না আর কথিত বন্দুকযুদ্ধে সন্তান হারানো  মায়েদের কান্না কি নেতা-নেত্রীরা শুনতে পান? আল্লাহ  তুমি দেশকে হেফাযত কর- আমীন!

মন্তব্য করুন

Back to top button