মুসলিম জাহান

বদলে যাওয়া কাতার

পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চলের ছোট একটি দেশ কাতার। তেলের অর্থে নিজেকে বদলে দিতে শুরু করেছে দেশটি সামাজিক, রাজনৈতিক সব দিক থেকে। বদলে যাওয়ার সেই গল্প তো শুধু গল্প নয়, যেন রূপকথা। বিদেশী সাময়িকী থেকে সাংবাদিক মেরি অ্যান ওয়েভারের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার বয়ান ভাষান্তর করেছেন হুমায়ুন সাদেক চৌধুরী। এই লেখাটি পড়ে পাঠক কাতারের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে ধারণা লাভ করতে পারবেন।

এ এক নতুন রূপকথা। তবে এর শুরুটাও সেই আদ্যিকালের রূপকথার মতোই : এক ছিল রাজা। তার ছিল পাঁচ ছেলে…। হ্যাঁ, সত্যিই তাই। এই কাহিনী রূপকথার মতোই বটে, তবে কোনো অজানা সময়ের, অচেনা দেশের নয়। এ কাহিনী কাতারের। তেলসমৃদ্ধ পারস্য উপসাগরীয় ছোট্ট দেশ কাতার, যেখানে লাখ লাখ বাংলাদেশীও কর্মব্যাপদেশে বসবাস করে। যে দেশের টিভি চ্যানেল আলজাজিরা পৃথিবীব্যাপী পরিচিত। সে দেশেরই ‘আধুনিক রূপকথা’ এটা।

১৯৯৫ সালের জুন মাসের এক দিন। পারস্য উপসাগরের কোল ঘেঁষে গড়ে ওঠা রাজধানী দোহায় তখন প্রত্যুষ। আঁধার কেটে গেছে, কিন্তু সূর্যের আলো ফোটেনি। চার দিকে স্নিগ্ধ আলোর আভা। এমন সময়ও রাজপ্রাসাদ কর্মব্যস্ত। কারণ, আমির শেখ খলিফা বিন হামাদ আল-থানি সুইজারল্যান্ড যাবেন। তার নানা আনুষ্ঠানিকতা রয়েছে।

তার অনুপস্থিতিতে দেশ চালানোর ভার জ্যেষ্ঠপুত্র হামাদের হাতে অর্পণ করে ভোর সাড়ে ৫টায় বিমানে চড়ে বসলেন আমির। ৪৫ বছর বয়সী জ্যেষ্ঠপুত্র রাতভর বিনিদ্র ছিলেন এবং রাজদরবারের সদস্যদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। দেশের সবচেয়ে প্রভাবশালী পরিবার এবং গুরুত্বপূর্ণ গোত্রগুলোর প্রতিনিধিদের নিয়ে এই রাজদরবার গঠিত। তরুণ হামাদ ঘোষণা দিলেন যে, তিনি দেশের শাসনভার গ্রহণ করছেন। তার এই ঘোষণায় কেউ প্রতিবাদ করলেন না, এমনকি অবাকও হলেন না। তারা তার প্রতি আনুগত্যের শপথ নিলেন। বাদামি রঙের আলখেল্লা ও সাদা শিরাভরণ পরিহিত শ’খানেক অভিজাত মানুষ এগিয়ে এসে তার কপাল অথবা নাকে আলতো করে ঠোঁট ছুঁইয়ে বেদুইন রীতিতে একাত্মতা প্রকাশ করলেন।

সে দিনের সূর্য যখন রাজপ্রাসাদের গায়ে রোদের চাদর বিছিয়ে দিয়েছে, ঠিক তখনই শেখ খলিফার ২৩ বছরের শাসনের সূর্য অস্ত গেছে। কারণ, এর কয়েক সপ্তাহ আগেই শাসক আল-থানি পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠ সদস্যরা বসে ঠিক করে ফেলেছেন, শেখ খলিফা আর নন। তিনি মদ ও বিলাসিতায় অতিমাত্রায় ডুবে গেছেন। অতএব তাকে সরানো জরুরি। তারা ঠিক করলেন, যুবরাজ হামাদই হবেন কাতারের পরবর্তী শাসক। শেখ খলিফা যে দিন ভোরে সুইজারল্যান্ড যাত্রা করলেন, তার আগের রাতেই এভাবেই ‘রক্তপাতহীন অভ্যুত্থানে’ এবং বৈধভাবে মসনদে আসীন হলেন হামাদ।

নতুন আমির এই খবর পিতাকে জানাতে সুইজারল্যান্ডে টেলিফোন করলেন। কিন্তু তার আগেই সব কিছু জেনে গেছেন শেখ খলিফা। ক্রুদ্ধ পিতা আর পুত্রের টেলিফোন ধরলেনই না।

পিতার সিংহাসনে বসে নতুন আমির ‘সুখে-শান্তিতে বসবাস করিতে লাগিলেন’ প্রাচীন রূপকথার মতো তেমনটি কিন্তু ঘটল না। সিংহাসনচ্যুত শেখ খলিফা সুদূর সুইজারল্যান্ডে বসে কলকাঠি নাড়াতে লাগলেন। তার অনুগতরা ছয় শ’ বেদুইন উপজাতির একটি দল গঠন করেছিল। এক সকালবেলায় সৌদি সীমান্ত অতিক্রম করে তারা কাতারে ঢুকে পড়ল। একদল ফরাসি ভাড়াটে যোদ্ধাকে এনে রাখা হয়েছিল দোহা-র একটি ফাইভ স্টার হোটেলে। তারাও বেরিয়ে পড়ল। কিন্তু শেখ হামাদকে ক্ষমতাচ্যুত করবে কে? দেখা গেল তারা রাজপ্রাসাদ কোথায় এবং কোনটি তা-ই জানে না।

এর ফল যা হওয়ার তা-ই হলো। ক্যু ব্যর্থ হলো। শেখ হামাদ শতাধিক ষড়যন্ত্রীকে গ্রেফতার করলেন এবং পিতার কাছে দাবি জানালেন রাষ্ট্রের কয়েক শ’ কোটি ডলার ফেরত দেয়ার (১৯৯৭ সালে শেখ খলিফা ১০০ কোটি ডলারের মতো ফেরত দেন)। শুধু তা-ই নয়, সিংহাসনে বসে তিনি যা করলেন তা অভূতপূর্ব। যে অঞ্চলে আত্ম-অহমিকা ও আড়ম্বরই ক্ষমতার স্মারক বলে বিবেচিত হয়, সেখানে এই তরুণ শাসক (আশপাশের সব দেশের শাসকদের গড় বয়স ৮৬) দেশের রাজনীতি ও সমাজে একের পর এক সংস্কার আনতে লাগলেন। এর ফলে মাত্র ক’বছরের মধ্যেই জন্ম নিলো এক নতুন কাতার, যা তার পিতার আমলের চেয়ে অনেকাংশে ভিন্ন।

অথচ কাতার ছিল আরব দুনিয়ার সবচেয়ে ছোট ও অপরিচিত দেশগুলোর একটি। সৌদি আরবের পর উপসাগরীয় অঞ্চলে এটাই ছিল সবচেয়ে রক্ষণশীল সমাজ। রাষ্ট্রীয়ভাবে এখানে ওয়াহাবি মতবাদের পৃষ্ঠপোষকতা করা হতো। বাজপাখি শিকার ও উটের দৌড়ই ছিল এই সমাজের একমাত্র বিনোদন। তবে বিপুল তেল ও গ্যাসের ভাণ্ডার নিয়ে কাতার ছিল বিশ্বের অন্যতম ধনী দেশ। আর এখন অপেক্ষাকৃত কম বয়সী আমিরের শাসনে কাতার হয়েছে আরব বিশ্বের সবচেয়ে বিপ্লবী দেশ।

নবীন আমির বিপ্লব ঘটিয়েছেন নারীদের ভোটাধিকার দিয়ে, যা আরব বিশ্বে বিরল। তিনি শুধু তাদের ভোটাধিকারই দেননি, তাদের প্রতি আবেদনও জানিয়েছেন যেন তারা এই অধিকারটি পেয়েই খুশি হয়ে বসে না থাকে, বরং অধিকারটি যেন প্রয়োগ করে, অর্থাৎ ভোট দেয়। আমির তার দেশে দু’টি আমেরিকান কলেজের ক্যাম্পাস খোলারও ব্যবস্থা করেছেন। এর একটি হচ্ছে মেডিক্যাল স্কুল। এর ফলে কাতারের শিক্ষার্থীরা আধুনিক ধ্যানধারণা ও প্রযুক্তির সঙ্গে সহজে পরিচিত হতে পারছে। এ ছাড়া আরো দু’টি বিষয় কাতারকে বিশ্ব রঙ্গমঞ্চের অংশীদারে পরিণত করেছে। এর একটি হলো আমেরিকার সেনাঘাঁটি স্থাপনের অনুমতি দেয়া এবং অপরটি আলজাজিরা টেলিভিশন। শেষেরটি যেন সিএনএনের প্রতি আরব বিশ্বের জবাব।

শেখ হামাদের এসব সংস্কার তার দেশের তরুণদেরই সবচেয়ে বেশি আলোড়িত করার কথা। কিন্তু দেখা যায়, পাশ্চাত্যে লেখাপড়া করা কাতারের রাজনীতিসচেতন তরুণেরা বরং মুসলিম বিশ্বে প্রবহমান ভাবধারা দিয়েই বেশি প্রভাবিত। আর তরুণীরা তো আরো বেশি রক্ষণশীল। সবার মনোভাব অনেকটা এ রকম : আমরা তো তার প্রাসাদ দখল করতে চাই না। কেউ তাকে সংস্কার করতে বলেনি, নারীদের ভোটাধিকার দিতেও নয়। কেউ তার ক্ষমতার ভাগ চায়নি। এ সবই তিনি নিজের ‘বুঝ’ থেকেই করেছেন। এমন প্রশ্নও উঠেছে, একটি ঐতিহ্যবাহী আরব দেশের কি রাজকীয় ফরমান জারি করে সংস্কার সম্ভব, না উচিত?

এসব প্রশ্নের উত্তর জানতে আমি, মেরি অ্যান ওয়েভার, কাতারের রাজধানী দোহা যাই। এর আগেও আমি দেশটিতে গিয়েছিলাম। তার দেড় বছর পর এই নবযাত্রা। বলে রাখি, ২০০০ সালের শেষের দিকে কাতার মুসলিম বিশ্বের প্রভাবশালী সংগঠন ওআইসির নেতৃত্ব পায়। ২০০১ সালের নভেম্বরে দেশটি সফলভাবে সম্পন্ন করে বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার সম্মেলন। এর মধ্যে তারা সন্ত্রাসবাদী হামলার ‘স্বাদ’ও গ্রহণ করে। এই ঘটনায় কাতারে মার্কিন বিমানঘাঁটিতে হামলা চালায় এক সশস্ত্র ব্যক্তি। পাল্টা গুলিতে অবশ্য হামলাকারীও নিহত হয়।

গতবার এসে যেমন দেখেছিলাম, এবার মনে হলো, কাতার তার চেয়ে আরো ধনী হয়ে গেছে। এর যৌক্তিক কারণ অবশ্যই আছে। যেমন, কাতার এমনিতেই বিশ্বের দ্রুততম প্রবৃদ্ধি অর্জনকারী দেশ। গ্যাস থেকে অর্জিত রাজস্ব এর অর্থনীতিকে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে দিয়েছে। এর ফলে শেখ হামাদের দেশটির জনসাধারণের গড় বার্ষিক মাথাপিছু আয় দাঁড়িয়েছে ২৮ হাজার মার্কিন ডলারেরও বেশি। ফলে কাতার এখন বিশ্বের সবচেয়ে ধনাঢ্য দেশগুলোর একটি। আর এই সম্পদের পাহাড়ও দেশটিতে ‘একধরনের বিপ্লব’ ঘটিয়ে ফেলেছে।

এই ‘ধনবিপ্লবের’ অংশই বুঝিবা, রাতের দোহা নগরীতে পরিভ্রমণে বেরোলেই দেখা যাবে রাস্তার দুই পাশের আলোকমালার ঝলকানি, দেখে মনে হবে মুক্তার নেকলেস। এখন তার সাথে যুক্ত হয়েছে ম্যাকডোনাল্ডস ও ক্যানটাকি ফ্রায়েড চিকেনের নিয়ন আলোর খেলনা। এ তো গেল রাতের দিক। সকালবেলা আমি যখন প্রাতঃরাশ করতে স্টারবাকে যাই, তখন একদল তরুণ কাতারি আমাকে বলে কেমন আশ্চর্য মানুষ ছিলেন ওসামা বিন লাদেন। কফি হাউসে গিয়েও সেই একই অভিজ্ঞতা। একদল প্রবীণ আমাকে জানান, কী আশ্চর্য মানুষ ছিলেন সাদ্দাম হোসেন।

কাতার থেকে তরুণ-তরুণীরা দলে দলে পাশ্চাত্যের বিভিন্ন দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যাচ্ছে। দেশে ফিরে তাদের একাংশ ঢুকছে সরকারি চাকরিতে। হচ্ছে ইয়াং টেকনোক্র্যাট। আবার কেউ অন্য পেশা বেছে নিচ্ছে। কেউবা হচ্ছে ছোট-বড়-মাঝারি কোনো সংস্থার ম্যানেজার। তবে পেশা যা-ই হোক, সবার মধ্যে একটা মিল আছে এরা সবাই জগিং করতে এবং টেনিস কিংবা গল্ফ খেলতে ভালোবাসে। এ সবই তাদের শাসক শেখ হামাদের প্রভাব (যিনি নিজ দেশকে ব্যবসাবাণিজ্যের কেন্দ্ররূপে গড়ে তুলতে কাজ করে যাচ্ছেন। তিনি মাঝে মধ্যেই তার কালো মার্সিডিজে চড়ে বেরিয়ে পড়েন। নির্মীয়মাণ জাদুঘর ও স্পোর্টস ক্লাবগুলোর নির্মাণকাজ পরিদর্শন করেন)। তাই তো আজকাল প্রায়ই দেখা যায়, আপাদমস্তক কালো আবায়া পরিহিত তরুণীরা, রানিং স্যু পরে দোহা উপসাগরের তীর ঘেঁষে দৌড়াচ্ছে তো দৌড়াচ্ছেই।

কাতার নামের দেশটি, আগেই বলা হয়েছে, খুবই ছোট। এতই ছোট যে, এক অর্থে বলা যায়, দেশটির সবাই সবাইকে কমবেশি চেনে-জানে। কাতারের মোট জনসংখ্যা ছয় লাখের মতো। তার মধ্যে কাতারির সংখ্যা দুই লাখেরও কম। বাকিরা বিদেশী শ্রমজীবী, যারা নিজেদের বৃত্তে থাকতেই ভালোবাসে। কাতারের তেল ও গ্যাস শিল্প মূলত পরিচালিত হয় আমেরিকান, কানাডিয়ান, ব্রিটেন ও ফরাসিদের দ্বারা। সরকারি অফিসগুলোতে গিজ গিজ করছে ফিলিস্তিনি, সিরীয় ও মিসরীয় কর্মী। ট্যাক্সিক্যাব ও রেস্তোরাঁ চালায় কারা? কেন, ফিলিপিনো, ইন্ডিয়ান ও পাকিস্তানিরা!

বিমান থেকে দেখলে কাতার দেশটিকে সমতল মনে হবে, কিন্তু ভূমিতে নামলে দেখা যায়, এর মরুভূমিতে তরঙ্গায়িত বালির পাহাড়। ভৌগোলিকভাবে কাতার হচ্ছে একটি উপদ্বীপ, যা সৌদি আরব থেকে পারস্য উপসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত এবং আয়তনে জ্যামাইকার সমান : ৪,৪০০ বর্গমাইল বা ১১,৪০০ বর্গকিলোমিটার।

আরব দেশগুলোর সীমান্ত চিহ্নিত হওয়াটা খুব বেশি দিন আগের কথা নয়। এর আগে এই সীমান্ত ছিল পরিযায়ী গোত্রগুলোর টেনে দেয়া কল্পিত রেখামাত্র। সপ্তদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে শেখ হামাদের পূর্বপুরুষ আল-থানিরা যেখানে এসে বসতি গড়েন, সেটাই আজকের কাতার। যদি এই আল-থানি ১৮৬৮ সালে ব্রিটিশ শাসনাধীনে না আসত এবং ১৯১৬ সালে যদি তারা ব্রিটেনের সাথে একটি চুক্তিতে উপনীত না হতো, যে চুক্তিবলে ১৯৭১ সালে কাতার ঘটনাক্রমে স্বাধীনতা পেয়ে যায়, তাহলে কাতার এখন সৌদি আরবের একটি প্রদেশ হয়েই থাকত।

একটা সময় ছিল যখন কাতার উপদ্বীপের সম্পদ বলতে মুক্তা ছাড়া কিছুই ছিল না। অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে দেশটি পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি মুক্তা উৎপাদনকারীতে পরিণত হয়। এখানে তেল পাওয়া যায় ১৯৩৯ সালে। দেশটি এখনো নতুন নতুন তেলের খনি আবিষ্কার করেই চলেছে। কাতারের উত্তর-পশ্চিম উপকূলে রয়েছে পৃথিবীর বৃহত্তম গ্যাসক্ষেত্র। এই ক্ষেত্রে মজুদ গ্যাসের পরিমাণ কত, তা অনুমান করাও শক্ত। ধারণা করা হয়, এই ক্ষেত্রের আয়তন কাতার দেশটির প্রায় অর্ধেক এবং এর মজুদ ৯০০ ট্রিলিয়ন কিউবিক ফুট বা ২৫ ট্রিলিয়ন কিউবিক মিটার। বুঝতে কষ্ট হচ্ছে? সহজ ভাষায় বলি : এই পরিমাণ গ্যাস জ্বালিয়ে আমেরিকার সব বাড়ি ১০০ বছরেও বেশি সময় গরম রাখা যাবে। এর বাইরেও গ্যাস পেয়ে চলেছে দেশটি, যা তাকে পরিণত করেছে বিশ্বের বৃহত্তম জ্বালানি সরবরাহকারীতে।কাতারের বর্তমান শাসক শেখ হামাদের পিতা শেখ খলিফা ক্ষমতায় আরোহণ করেন ১৯৭২ সালে। ক্ষমতা পেয়েই তিনি তেল থেকে অর্জিত রাজস্ব দিয়ে দেশকে একটি কল্যাণ রাষ্ট্রে পরিণত করেন। রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে নাগরিকদের সবরকম প্রয়োজন মেটানো হতে থাকে। কিন্তু তার শাসনপদ্ধতি দেশে একধরনের উদ্যমহীনতার জন্ম দেয়।

শেখ হামাদ ছিলেন শেখ খলিফার প্রথম পুত্র। শেখ খলিফার প্রিয়পত্নীর একমাত্র পুত্রও তিনি। তাকে জন্ম দিয়েই এই নারী ইন্তেকাল করেন। সেটা ১৯৫০ সালের কথা। মাতৃহারা সন্তানকে আপন স্নেহচ্ছায়ায় লালন-পালন করেন শেখ খলিফা। তার লেখাপড়াও দোহায়। সেখানে তিনি পবিত্র কুরআন অধ্যয়ন এবং শরিয়া আইন সম্বন্ধে শিক্ষালাভ করেন। ১৭ বছর বয়সে উচ্চশিক্ষার্থে তাকে পাঠানো হয় লন্ডনে। সেখানে তিনি পড়াশোনার পাশাপাশি রাজনীতি সম্বন্ধেও বাস্তব জ্ঞান লাভ করেন। অবশ্য তার রাজনীতি-সচেতনতা নতুন নয়। দোহায় পড়াশোনার সময় স্কুলের কয়েকজন সহপাঠীকে নিয়ে আরব জাতীয়তাবাদীদের পক্ষে মিছিল করায় জেল খাটতে হয় তাকে, যদিও খুব কম সময়। তার পিতা শেখ খলিফা সিংহাসনে আসীন হওয়ার পর শেখ হামাদ দেশে ফিরে আসেন এবং সশস্ত্রবাহিনীর কমান্ডার-ইন-চিফ হন। এই সময়েই পিতার উত্তরাধিকারী হিসেবে তার নাম ঘোষিত হয়।

পিতা-পুত্রের ক্ষমতার দ্বন্দ্বটি প্রথম প্রকাশ্যে আসে ১৯৯১ সালে পারস্য উপসাগরীয় যুদ্ধের সময়। এ সময় কয়েক হাজার আমেরিকান সৈন্যের একটি দল কাতারে ঘাঁটি করে ইরাকে বিমান হামলা চালাতে থাকে। শেখ হামাদ এমনিতেই কাতারে ব্যাপক হারে বিনিয়োগের পক্ষপাতী ছিলেন। এবার প্রতিরক্ষামন্ত্রী হিসেবে তিনি আমেরিকার সাথে সামরিক জোট গড়ার উদ্যোগ নেন, যার ফলস্বরূপ দেশটিতে এখন অনেক আমেরিকান সৈন্য অবস্থান করছে।

দোহায় রাজপ্রাসাদে ২০০০ সালে শেখ হামাদের সাথে আমার সাক্ষাৎ হয়। তার পরনে ঐতিহ্যবাহী পোশাক সাদা দিশদশা, মুখটিকে ঘিরে আছে সাদা কফিয়াহ, নাকের ওপর চশমা। মধ্যপ্রাচ্যের আরো ক’জন রাজপুরুষের সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হয়েছে। তাদের তুলনায় শেখ হামাদ অনেক ঘরোয়া। কথা বলছিলেন চোস্ত ইংরেজি। তার উচ্চারণে স্যান্ডহার্স্ট ও ক্যামব্রিজের শুদ্ধতা লক্ষণীয়। সৌদি আরবে আমেরিকান সৈন্যদের উপস্থিতি অনেক সমস্যার জন্ম দিয়েছে, তার সূত্র ধরে আমি আমিরের কাছে জানতে চাইলাম তিনি কাতারে আমেরিকান সেনাঘাঁটি করতে দেবেন কি না।

কোনো দ্বিধা না করেই উত্তর দিলেন আমির : ‘আমেরিকা যদি চায় তো আমাদের কোনো আপত্তি নেই।’৯/১১-এর পর বুশ প্রশাসন সেটাই ‘চেয়েছিল’। ফলে আজ প্রায় তিন হাজার তিন শ’ মার্কিন সৈন্য আছে কাতারে, যাদের বেশির ভাগই বিমানসেনা। এদের কেউ কেউ আছে ক্যাম্প স্নুপিতে। দোহার উপকণ্ঠে অবস্থিত এই ঘাঁটির নিরাপত্তাব্যবস্থা নজিরবিহীন কড়া। আবার কেউ কেউ আছে আস-সাইলিয়াহ-তে। এটি কাতারের পূর্বাঞ্চলীয় মরুভূমিতে অবস্থিত। নিজ দেশের বাইরে মার্কিনিদের যত সামরিক ঘাঁটি আছে, তার মধ্যে এটিই সর্ববৃহৎ। আরেক দল আছে আল-উদেইদে। মরুভূমির মাঝখানে অবস্থিত এই বিমানঘাঁটি নির্মাণে শেখ হামাদ ১০০ কোটি ডলারেরও বেশি অর্থ ব্যয় করেন। সম্প্রতি তিনি আরো এক ধাপ এগিয়ে গিয়ে মার্কিন সেন্ট্রাল কমান্ডকে কাতারে বড় ধরনের সামরিক মহড়া চালানোর অনুমতি দিয়েছেন। তারই ফলে ২০০২ সালে আস-সাইয়াহয় মহড়া অনুষ্ঠিত হয়।

৯/১১-এর কয়েক মাস পরের কথা। কাতার বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতিবিজ্ঞান বিভাগের প্রফেসর মুহাম্মাদ আল-মুসফিরকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, এখানে মার্কিন উপস্থিতির ফলাফল কেমন? প্রফেসরের সাফ জবাব ছিল : ‘ভালো না।’ ব্যাখ্যা দিয়ে বলেছিলেন তিনি, ‘তোমাদের সৈন্যরা খুবই উসকানিমূলক কাজকর্ম করে থাকে। এ কথা শুধু আমার ছাত্ররা বলবে, তা নয়। তুমি যেকোনো রেস্তোরাঁয় যাও, ক্যাফেতে যাও, বাজারে যাও সবখানেই দেখবে সবার মনোভাব মার্কিনবিরোধী।’

আমেরিকার সঙ্গে সামরিক জোট কাতারকে আরো নিরাপদ করবে বলে যে ধারণাটি সরকার সাধারণ্যে ছড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করছে, সে প্রসঙ্গে প্রফেসর মুসফিরের ভাষ্য : ‘কাতারের তো কোনো শত্রু নেই। আমাদের সামনে কোনো হুমকিও নেই। সত্যি বলতে কি, আমাদের নিরাপত্তা বিধানে মার্কিন বাহিনীর করার কিছু নেই। শেখ হামাদের জন্য সবচেয়ে বড় নিরাপত্তাচাদর হবে তার সংস্কারকার্যক্রম।’

এক শুক্রবারে, জুমার নামাজের খানিক আগে, এক বন্ধুকে নিয়ে আমি গেলাম বাজপাখির মার্কেটে। জানুয়ারি হচ্ছে বাজপাখি বিক্রির ভরা মওসুম। বিক্রিও হচ্ছে ধুমসে। দামও চড়া। পাখিবিক্রেতা হুসেইন চওড়া হাসি হেসে ইরান থেকে আসা একটি বাজপাখি দেখিয়ে জানালেন, এর দাম উঠেছে ৩০ হাজার মার্কিন ডলারের সমান। হুসেইন আমাদের বসতে দিলেন। ছোট ছোট পোর্সেলিনের কাপে বেদুইন স্টাইলের কফি চলে এলো। আমাদের চার পাশে একটা ছোটখাটো ভিড়ও জমে উঠল।

ভিড়ের মধ্যে ছিল বাজপাখি শিকারি একটি পরিবার : পিতা, পুত্র এবং ছয় বছর বয়সী নাতি। সাধারণত এই সময় কাতারের বাজপাখি শিকারিরা দলে দলে পাকিস্তান চলে যায়। সেখানে এ সময় মধ্য এশিয়া থেকে আফগানিস্তান হয়ে আসে হুবারা নামে এক জাতের পরিযায়ী পাখি। বাজপাখি দিয়ে এই পাখি ধরে শিকারিরা। এবার নাকি ওই পাখি খুব কমই এসেছে। তা নিয়ে ক্রেতাদের মনোকষ্টের সীমা নেই। পুত্রটি সেটাই আমাকে বলল, ‘এটা তোমাদের সরকারের দোষ। তোমরা আফগানিস্তানে যেভাবে বোমা ফেলে চলেছ, তাতে ওই পাখিরা দিক হারিয়ে অন্য দিকে চলে গেছে।’

আমি কথা ঘুরিয়ে আমিরের সংস্কারের দিকে টেনে নিতে চাইলাম। কিন্তু লোকজন তাতে ভুলবার পাত্র নয়। তখন, এবং এর পরে যখন যেখানে আলাপে রত হয়েছি, দেখেছি কাতারবাসী যুক্তরাষ্ট্রের ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’কে ‘ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ ছাড়া আর কিছুই ভাবে না।ভাবার কারণও আছে। ইসলাম এদের জীবনের পরতে পরতে ছড়িয়ে আছে, জড়িয়ে আছে। যদিও মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য অংশের মতো ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ বায়ু হয়ে নয়, ইসলাম এখানে শান্তির সুশীতল পরশ। অথচ কী আশ্চর্য, সৌদি আরবের পর কাতারই পৃথিবীর একমাত্র ওয়াহাবি দেশ। পাঠক নিশ্চয়ই জানেন, মুহাম্মাদ ইবনে আবদ আল-ওয়াহহাব প্রবর্তিত ভাবধারাটি ইসলামের সব অনুশাসন কঠোরভাবে মেনে চলার পক্ষপাতী। তার পরও এই দেশে কোনো কট্টরপন্থী ইসলামি গোষ্ঠীর অস্তিত্ব নেই। এখানকার কোনো মসজিদে জুমার নামাজের খুতবায় কোনো ইমাম জিহাদের ডাক দেন না।

তবে তাই বলে কাতারে ধর্মীয় প্রচার-প্রচারণা নেই, তা নয়। এখানে ছোট ছোট অনেক মিশনারি গ্রুপ আছে, যারা দাওয়া নামে পরিচিত। এরা ইসলামের মৌলিক অনুশাসন মানুষের মাঝে প্রচার করে। তারা তরুণদেরও দলে টানে, সৌদি আরবের ওয়াহহাবিদের মতো লম্বা জুব্বা পরে, লম্বা দাড়ি রাখে। এ ছাড়া আরেক দল কাতারবাসী আছে, এরাই সংখ্যাগুরু। এদের এক কথায় বলা হয় ‘ঐতিহ্যবাদী’। তাদের এখন পর্যন্ত নিরাপদ বলে বিবেচনা করা হয়, যদিও তারা স্থিতাবস্থার পক্ষে এবং আমিরের সংস্কারের বিরুদ্ধে। এ ছাড়া ওসামা বিন লাদেনের প্রশংসাকারী কাতারবাসীও কিছু আছে, যদিও তারা সংখ্যায় খুব কম।

কাতারে একাধিকবার এসে আমি দুই কাতারি নারীকে বন্ধুরূপে পেয়ে যাই। সত্যি বলতে কী, তারা আমার চোখ ও কানে পরিণত হয়। আমি তাদের হাত ধরে কাতারি সমাজের অনেক ছবি দেখতে পাই, অনেক কথা শুনতে পাই। তাদের মাধ্যমে আমি ঢুকতে পাই কঠোর পর্দানশীন পরিবারের ভেতরভাগে, উদীয়মান নারী ক্ষমতায়ন গোষ্ঠীতে এবং জানতে পাই আধুনিক বিশ্বে প্রবেশের পথ অšে¦ষণকারী কাতারি নারীসমাজের অনেক অন্তর্দ্বন্দ্ব ও সংশয়ের কাহিনী।

সেই দুই কাতারি নারী বন্ধুর কথা একটু বলি। তাদের একজন হচ্ছেন মোজা আল-মালকি (৪৪) এবং অপরজন জাকিয়া মালাল্লাহ (৪২)। প্রথমজন হচ্ছেন কাতারের প্রথম নারী, যিনি মনস্তত্ত্বে মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেছেন এবং মনোচিকিৎসাকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন। পরে তিনি এ বিষয়ে পিএইচডিও অর্জন করেন। একই রকম কৃতিত্বের অধিকারী জাকিয়াও। তিনি লেখাপড়া করেছেন মিসরে। তিনি ফার্মাকোলজিতে পিএইচডি। ওই দেশে এ ক্ষেত্রে তিনিই প্রথম। এখন তিনি রাজধানীতে একটি সরকারি ফার্মাসিউটিক্যাল ল্যাবের প্রধান।কাতারের ইতিহাসে প্রথম নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৯৯ সালে। সেটা ছিল পৌরসভা নির্বাচন। ওই নির্বাচনে প্রার্থী হন মোজা আল-মালকি। অন্য দিকে জাকিয়া মালাল্লাহ একজন কবি। তিনিই কাতারের প্রথম নারী কবি, যার কাব্য দেশের বাইরে থেকে প্রকাশিত হওয়ার কথা রয়েছে।

এই দুই বন্ধু একদিন আমাকে তাদের সঙ্গে পিকনিকে যাওয়ার আমন্ত্রণ জানান। কাতারি জীবনের আরেকটি চিত্র দেখার আশায় আমি তৎক্ষণাৎ সম্মতি জানাই। পিকনিকটি হবে খোর আর-উদেইদে। এটি হলো কাতারের সর্বদক্ষিণে অবস্থিত একটি জনমানবহীন সৈকত। নির্ধারিত দিনে পেটভর্তি পিকনিক-সরঞ্জাম নিয়ে আমাদের গাড়ি যাত্রা শুরু করল। গাড়ি দোহার বাইরে যেতেই শুরু হলো নাশতা পরিবেশন। দেখলাম, পরনে নীল জিন্সের প্যান্ট ও মাথায় একধরনের টুপি পরে আমার বন্ধু মোজা চিত্রবিচিত্র প্লেটে পরিবেশন করছেন প্রাতঃরাশ নানা ধরনের শিম, সিরকা দিয়ে ভেজানো। সঙ্গে আছেন জাকিয়া। তার হাতে পটেটো চিপসের ব্যাগ।

এক ঘণ্টা চলার পর আমরা হাইওয়ে ছেড়ে নামলাম। আমরা যেখানে আছি এবং যেখানে যাচ্ছি তার মাঝখানে কোনো রাস্তা নেই, আছে শুধু মরুভূমি আর তাতে ধুলোর মেঘ। চলতে চলতে আমাদের গাড়ির দুই পাশে দেখি বালির পাহাড় আর পাহাড়। এর কোনো কোনোটি ৩০ ফুট পর্যন্ত উঁচু। এর মাঝখান দিয়ে গাড়ি চালানো যেন রোলার কোস্টার চালানো, কিংবা তার চেয়েও খারাপ। বাতাসের ধাক্কায় বালিয়াড়িগুলো মুহূর্তে মুহূর্তে রূপ পাল্টাচ্ছে। কখনো কখনো নানা রঙের বালির আস্তরণ পড়ছে আমাদের গাড়িতে।

এভাবে ৪৫ মিনিট চলার পর আমরা আমাদের গন্তব্য খোর আল-উদেইদ সৈকতে পৌঁছে গেলাম। নেমেই মনটা ভালো হয়ে গেল। কী সুন্দর, যেন ছবি! বাসিন্দা বলতে ফ্লেমিংগোর ঝাঁক। এখানেই, যেন হঠাৎ করেই, কাতারের সীমানা শেষ। চার দিক তাকিয়ে দেখি, দূরে দূরে আরো পিকনিক পার্টির শামিয়ানা, দু-চারজন মানুষের জটলা, বাঁশের তৈরি চেয়ার-টেবিল। বালিয়াড়ির ঠিক ওপারে, দিগন্তরেখার কাছে সৌদি আরবের পাহাড়।

আমরা সৈকতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বসে পড়লাম। আমি আর মোজা সমুদ্রের ঢেউয়ের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। জাকিয়াও বসেছিল সমুদ্রমুখী হয়ে। মাতাল হাওয়া তার আবায়াকে (পোশাক) বারবার এলোমেলো করে দিচ্ছিল। আমি মোজার কাছে তার নির্বাচনের গল্প শুনতে চাইলাম। ওই নির্বাচনে ছয়জন নারী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। আমার মনে আছে, এক রক্ষণশীল ব্যক্তি নারীদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা নিষিদ্ধ করতে আমিরের কাছে দরখাস্ত করেছিলেন। আমির সেই দরখাস্ত নামঞ্জুর করে দেন এবং তার ‘পরিকল্পনা’ অনুযায়ী নির্বাচন অনুষ্ঠানে এগিয়ে যান। তার পরিকল্পনাটি ছিল, উপসাগরীয় এলাকায় দেশগুলোর মধ্যেই এটাই হবে প্রথম নির্বাচন, যে নির্বাচনে নারীরা ভোটও দেবেন, প্রার্থীও হবেন। নির্বাচনী প্রচারকালে মোজা তার এলাকার ভোটারদের কাছে একটি প্রশ্নপত্র পাঠান, যাতে একটি প্রশ্ন ছিল : ‘তোমরা কি কখনো গণতন্ত্রের কথা শুনেছ?’ যে উত্তর এসেছিল তার অর্ধেকই ছিল : ‘না।’ সেই নির্বাচনে মোজাসহ ছয় নারী প্রার্থীর সবাই হেরে যান।‘কেন?’ আমি জানতে চাই মোজার কাছে, ‘হারলেন কেন?’

মোজার জবাব, ‘কারণ নারীরা আমাদের ভোট দেয়নি।’ তার ব্যাখ্যা : তিনি যে ভোট পেয়েছেন তার ৮০ শতাংশই দিয়েছে পুরুষরা। তিনি নারীদের ভোট পেয়েছেন মাত্র ১৫টি। এই ১৫ ভোটের মধ্যে একটি তার নিজের, ১২টি তার পরিবারের নারী সদস্যদের। বাকি দুই ভোট? নির্বাচনের চার বছর পরও মোজার জানা হয়নি, কারা ওই দুই নারী, যারা তাকে ভোট দিয়েছিলেন।

জাকিয়া এবার এসে বসেছে আমাদের কাছে। সঙ্গে তার ছয়-সাতজন পুরুষ সহকর্মী। সরকারি অফিসে তারা একসঙ্গে কাজ করেন। আমরা যখন সৈকতে বসে কথা বলছিলাম, তখন মাঝে মাঝেই আমাদের মাথার ওপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছিল মার্কিন সামরিক বিমান। আমার চার পাশে যারা বসা, তাদের প্রত্যেকেরই সব বিষয়ে একটা-না-একটা চূড়ান্ত মতামত আছে তা সে উপসাগরীয় অঞ্চলে আমেরিকার ক্রমবর্ধমান সামরিক উপস্থিতি হোক কিংবা নিজ দেশের আমিরের সংস্কার।

আলাপের ফাঁকে এক তরুণ উত্তেজিত গলায় বলল, ‘আলজাজিরার জন্য আমরা কেন প্রতি বছর তিন কোটি ডলার ঢালছি?’ তার যুক্তি : ‘আমরা সবার ব্যাপারে নাক গলাচ্ছি এবং নিজেদের অন্যের আক্রমণের শিকারে পরিণত করছি। আসলে আগেই আমরা সুখে ছিলাম।’‘সুখে ছিলাম না।’ এবার মুখ খুললেন অপেক্ষাকৃত বয়সী একজন, ‘আমাদের ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছিল।’

যদি তা-ই হয়ে থাকে, তবে আলজাজিরাকে কাতার ও আরব বিশ্বের ‘ঘুমভাঙানি ডাক’ বলতে হয়। শেখ হামাদ ১৯৯৬ সালে এই চ্যানেলটির সূচনা করেন। সে সময় তিনি একে ১৪ কোটি ডলার দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। একই সঙ্গে বিলুপ্ত করেন তথ্য মন্ত্রণালয় ও সেন্সর ব্যবস্থা। নতুন চ্যানেলটিকে দেন সংবাদ প্রচারের অনুমতি।

এসবের ফল মিলছে এখন। দেখা যাচ্ছে, মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ থেকে বিরোধী মতের নেতারা ছুটে আসছেন কাতারে আলজাজিরা স্টুডিওতে। জানাচ্ছেন নিজ সরকারের বিরুদ্ধে যত অভিযোগ। সরাসরি না-এসেও অনেকে নিজ বক্তব্য প্রচারের সুযোগ পাচ্ছেন ভিডিও টেপের মাধ্যমে। ওসামা বিন লাদেন এবং তার আলকায়েদা গোষ্ঠীর অন্য নেতারা এ সুযোগটি নিয়েছেন বা পেয়েছেন। আলজাজিরার পর্দায় তুমুল আলোচনা ও উত্তপ্ত বিতর্কের সুযোগ পেয়েছেন প্যানেল আলোচকেরা। রাষ্ট্রীয় নির্যাতন নিপীড়নের মতো বিষয়াবলি, যা নিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে মুখ খোলার চিন্তাও করা যায় না, সে সবই অবলীলায় আলোচিত হয়েছে আলজাজিরায়। আলোচকরা পরস্পরের সঙ্গে বিবাদে জড়িয়ে গেছেন আর তাদের সঙ্গে প্রশ্ন ও মতামত নিয়ে যোগ দিয়েছেন দর্শকেরা। এভাবে আলজাজিরা মধ্যপ্রাচ্যে প্রচলিত সাংবাদিকতার ধারা বদলে দিয়েছে, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক ঘটনাপ্রবাহে কাতারকে যুক্ত করেছে একটি নিয়ামক শক্তি হিসেবে এবং স্থিতাবস্থাকে দিয়েছে প্রবল ঝাঁকুনি।

কাতারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শেখ হামাদ বিন জাসিম বিন জাবর আল-থানি জোর দিয়ে বলেন, প্রতিবেশী শাসকদের বিব্রত করার জন্য কিন্তু আমির এই চ্যানেল চালু করেননি। কিন্তু তিনি যা-ই বলুন, এটা ওপেন সিক্রেট যে, আলজাজিরার কোনো প্রোগ্রামের কারণে কোনো প্রতিবেশী দেশ যখন বিরক্ত বা বিব্রত হয়, বিশেষ করে যদি নিকটতম প্রতিবেশী সৌদি আরবের সুখনিদ্রা ভঙ্গ হয়, তবে এ দু’জনেরই (আমির ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী) আনন্দের সীমা থাকে না।

আলজাজিরার সবচেয়ে ‘উসকানিমূলক’ অনুষ্ঠানগুলোর একটি হচ্ছে ‘দ্য অপোজিট ডিরেকশন’। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালন করেন ফয়সাল আল-কাসিম। ৪১ বছর বয়সী এই মানুষটি সিরিয়ান। সিএনএনের জনপ্রিয় ‘ক্রসফায়ার’ অনুষ্ঠানের আদলে সাজানো এই অনুষ্ঠানে নানা বিতর্কিত বিষয়কে সামনে আনা হয়। আনা হয় পরস্পরবিরোধী মতের মানুষদেরও। একটা উদাহরণ দিলেই বোঝা যাবে। একবার অনুষ্ঠানের আলোচ্য বিষয় ছিল বহুবিবাহ। ইসলামে বিষয়টি বৈধ। কিন্তু জর্দান পার্লামেন্টের এক বামপন্থী সদস্য বলে বসলেন, বিষয়টি এখন ‘টোটালি রাবিশ’। অনুষ্ঠানে উপস্থিত মিসরের ইসলামপন্থী ও ঐতিহ্যবাদী আলোচক তীব্র ক্ষোভে ‘ব্লাসফেমি’ (খোদাদ্রোহিতা)! বলে বেঁচিয়ে উঠলেন এবং অনুষ্ঠান থেকে বেরিয়ে গেলেন।

আমির শেখ হামাদকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, আলজাজিরার এসব অনুষ্ঠানের কারণে সমস্যা হচ্ছে কি?তিনি বলেছিলেন, ‘মাথাব্যথা তো আছেই। তবে আমি মনে করি, সমস্যার তো কোনো শেষ নেই। আর দেখুন, যে লোক অনুষ্ঠানে কোনো কিছুর বিরোধিতা করল, বাইরে কিন্তু ওই কাজটিই সে করছে। আমাদের এসব নিয়েই বেঁচে থাকতে হয়।’আমার মনে পড়ল, ১৯৯৭ সালে প্রথম আমেরিকা সফরে গিয়ে এক বক্তৃতায় আমির শেখ হামাদ উদ্ধৃতি দিয়েছিলেন প্রেসিডেন্ট কেনেডির একটি জনপ্রিয় উক্তির : যারা শান্তিপূর্ণ বিপ্লবকে অসম্ভব করে তুলছে, তারা সহিংস বিপ্লবকেই অনিবার্য করছে। তিনি আমাকে বললেন, কাতার কিন্তু বাকি দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে বাঁচতে পারবে না। পৃথিবী প্রতিনিয়ত বদলে যাচ্ছে। এই পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে চলতে গেলে সংস্কার ছাড়া উপায় নেই।

এই সংস্কারসাধনের লক্ষ্যেই ১৯৯৭ সালে শেখ হামাদ ৩২ সদস্যের এক কমিশন গঠন করেন, যে কমিশনের কাজ হয় একটি নতুন সংবিধান প্রণয়ন এবং ওই সংবিধান মোতাবেক দেশে একটি নির্বাচিত পার্লামেন্ট প্রতিষ্ঠিত হবে।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী শেখ হামাদ বিন জাসিম বলেন, ‘যখন আমাদের সম্পদ ছিল না, তখনকার কাতারকে তিনি (আমির) দেখেছেন। আমাদের কোনো হাসপাতাল ছিল না। ওষুধ ছিল না। খাদ্য ছিল না। এ সময় আমরা তেলের সন্ধান পেলাম। যে দেশের মানুষ টাকা কী জিনিস চিনত না, তাদের হাতে চলে এলো অঢেল অর্থ। সেই অর্থ স্বাভাবিক কারণেই অপচয় হতে থাকল। আমির দেখলেন, কাতার পথ চলছে, কিন্তু কোথায় যাবে সে জানে না। তার মতে, টিকে থাকার জন্য যতটা দরকার, কাতার ততটা আধুনিক নয়।’

এই ভাবনা থেকেই আমীর শেখ হামাদ সংস্কারের পদক্ষেপ নিলেন। সত্যি বটে, কাতারের মতো একটি প্রথাশাসিত সমাজে সংস্কার করতে বছরের পর বছর লেগে যাবে, কিন্তু তার পরও দেশটি এখন একটি নতুন ও অপ্রত্যাশিত পথ বেয়ে এগিয়ে চলেছে। আমার সাম্প্রতিক সফরকালে রাজধানীর সিটি সেন্টারকে আমার সবচেয়ে ‘বিপ্লবী’ পদক্ষেপ মনে হয়েছে। কেননা, কাতারে এখনো একটি পরস্পরবিচ্ছিন্ন সমাজব্যবস্থা বিদ্যমান। এখানে বেশির ভাগ বিয়ে হয় পারিবারিকভাবে, তারও একটি বড় অংশ হয় জ্ঞাতি ভাই-বোনদের মধ্যে। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়েও ছেলেমেয়েদের মধ্যে দেখাসাক্ষাৎ ও কথাবার্তার সুযোগ নেই।

এ-ই যখন অবস্থা, তখন উপসাগরীয় অঞ্চলের বৃহত্তম শপিং মল দোহা সিটি সেন্টারের চলন্ত সিঁড়ি হয়ে উঠেছে একটি বড় সামাজিক গোাযোগমাধ্যম।

এক সন্ধ্যায় আমি কয়েকজন কাতারি বন্ধুকে নিয়ে সিটি সেন্টার ঘুরতে যাই। দেখি, দলে দলে তরুণীরা চলন্ত সিঁড়ি বেয়ে উঠছে-নামছে। তাদের শরীরে ঐতিহ্যবাহী পোশাক, কিন্তু চিরাচরিত নিয়মে মুখ ঢাকা নয়, খোলা। তাদের পাশ দিয়ে ওঠানামা করছে তরুণের দলও। দুই দলের মধ্যে চকিত দৃষ্টিবিনিময় হচ্ছে, কখনো কখনো মুচকি হাসিও। কফি হাউস বা রেস্তোরাঁয় দেখা গেল, নারী ও পুরুষেরা একসঙ্গে বসে আছে এবং কথা বলছে। দূরে ম্লান মুখে বসে তাদের দিকে তাকিয়ে আছে তাদের ভাই, চাচা, মামা কিংবা মা।

কাতার বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস প্রেসিডেন্ট শেখ আল-মিসনাদের সঙ্গে কথা হয় এসব নিয়ে। তিনি বলেন, ‘শপিং মল হওয়ার আগে পরিবারের সবাই নিজেদের বাড়িতে একসঙ্গে বসত। এখন লোকজন বাইরে যাচ্ছে, অন্য পরিবারকে দেখছে এবং তাদের মধ্যে চেনা-পরিচয় ও সম্পর্ক হচ্ছে। আসলে শপিং মলে যাওয়া, উদ্দেশ্যবিহীন ঘোরাঘুরি অথবা ক’জন বসে শুধু গল্প করা (আড্ডা) এসব আমাদের সমাজে অজানাই ছিল।

সেই অজানার নিদ্রা ভেঙে ক্রমেই জেগে উঠছে কাতার। অন্তত এই একটি ক্ষেত্রে হলেও শেখ হামাদের সংস্কারকে খুশিমনে মেনে নিয়েছে কাতারের অনেক তরুণ।

চলন্ত সিঁড়ি বেয়ে ওঠানামায় রত তরুণ-তরুণীদের মুখের দিকে তাকিয়ে আমার অন্তত তা-ই মনে হলো। কাউকে মনে হলো না অসুখী বা অখুশি।

মন্তব্য করুন

Back to top button