তিব্বত মহাচীনের স্বায়ত্তশাসিত একটি অঞ্চল। পশ্চিম চীনে অবস্থিত এই অঞ্চলের উত্তরে চীনের স্বায়ত্তশাসিত এলাকা ঝিনঝিয়াং ও কিংহাই প্রদেশ, পূর্বে সিচুয়ান প্রদেশ, দক্ষিণ-পূর্বে চীনের ইউয়ান ও বার্মা এবং দক্ষিণে ভারত, ভুটান ও নেপাল। এর আয়তন ২.৫ মিলিয়ন বর্গকিলোমিটার। শত শত বছরের ঐতিহ্যে লালিত তিব্বতের জনগণের রয়েছে পৃথক ভাষা, ধর্মবিশ্বাস ও আচারপ্রথা। তিব্বতি জনসংখ্যা ৭৮ লাখের মতো ধরা হয়। এরা বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। তাদের মধ্যে স্বায়ত্তশাসিত এলাকা গানসু, কিংহাই ও সিচুয়ান অঞ্চলে বসবাস করে ২২ লাখের মতো। তা ছাড়া ভারত, নেপাল, ভুটানে বাস করে যথাক্রমে এক লাখ ৮৯ হাজার, ১৬ হাজার ও চার হাজার ৮০০ তিব্বতি। বহির্বিশ্বে আমেরিকা, ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়াসহ বিভিন্ন দেশেও তিব্বতি মানুষ রয়েছে।
তিব্বতের জনগণ বহু বছর যাবৎ স্বাধিকারের জন্য লড়াই করলেও পরিশেষে তারা চীনের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। চীনের স্বায়ত্তশাসনের আড়ালে তিব্বতি জনগণের ওপর চলেছে নানা প্রকার নিপীড়ন। ফলে নির্যাতিত মানুষ দেশ ত্যাগ করে ছড়িয়ে পড়ে ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, ভুটান, মঙ্গোলিয়া, ইউরোপ, আমেরিকাসহ দুনিয়ার নানা দেশে। তিব্বতি মানুষের বেশির ভাগই বিশেষ ধরনের বৌদ্ধ ধর্মমতের অনুসারী। সপ্তম শতকে তিব্বতে এই ধর্ম পৌঁছেছিল। দালাই লামা হলেন তিব্বতি বৌদ্ধদের আধ্যাত্মিক ও দুনিয়াবি প্রধান।
তিব্বতে ইসলাম ধর্ম যে থাকতে পারে, সেটা চট করে কারোরই চিন্তায় আসে না। রহস্যময় পাহাড়ে ঘেরা তিব্বতের কথা উঠলেই সকলে প্রথমে ভাবে বৌদ্ধধর্মের কথা। কিন্তু আদতে তা নয়। প্রায় ১০০০ বছর আগে তিব্বতের পাহাড় ঘেরা অঞ্চলে পা রেখেছিল ইসলাম। তার নিদর্শন এখনও খুঁজে পাওয়া যায় বিখ্যাত লাসা শহরে।
তিব্বত ও মুসলিম দুনিয়া
মধ্যযুগের মুসলিম ভূগোলবিদ ও ইতিহাসবিশারদের মধ্যে ইবনে খালদুন, আল-বিরুনি, তাবারি, ইয়াকুবি, রশিদুদ্দিন, ইয়াকুত আল-হামাভি প্রমুখের লেখায় তিব্বতের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। তাঁরা তিব্বতকে ‘তেহরাত’ বা ‘খেতাব’ বলে পরিচয় দিয়েছেন। খলিফা উমর বিন আবদুল আজিজের খেলাফতকালে (৭১৭-৭২০) চীন ও তিব্বতে ধর্ম প্রচারের জন্য একটি প্রতিনিধিদল পাঠানোর অনুরোধ পান। তাই তিনি সালিত বিন আবদুল্লাহ আল হানাফিকে তিব্বতে প্রেরণ করেন। তিনি সেখানকার মানুষের মধ্যে দ্বিনের দাওয়াত প্রচার করেন। তাই সেই সময় কিছু না কিছু লোক ইসলাম গ্রহণ করে। ফলে এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে অষ্টম শতকের দিকে তিব্বতে ইসলামের আগমন ঘটে।
মুসলিম শাসক মুহাম্মদ বিন কাসিম ৭১২ সালে সিন্ধু বিজয় করলে তিব্বতের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক সম্প্রসারিত হয়। আর এই সম্পর্ক ভারত, চীন ও মালয় উপদ্বীপ পেরিয়ে ইসলামী বিশ্বের সঙ্গে যুক্ত হয়। আব্বাসীয় মুসলিম শাসনামলে তিব্বত ও ইসলামী বিশ্বের সঙ্গে কূটনৈতিক, রাজনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক বহাল ছিল। ইতিহাস থেকে জানা যায়, অষ্টম শতাব্দীতে তিব্বতের রাজা মুসলিম শাসক খলিফা আল মাহদির (৭৭৫-৭৮৫) কর্তত্ব স্বীকার করে নিয়েছিলেন। ফলে অষ্টম শতাব্দী থেকে তিব্বতের স্বর্ণ মুসলিম বিশ্বে রপ্তানি হয়। এই স্বর্ণ দিয়েই মুসলিম শাসকরা দিনার বা স্বর্ণমুদ্রা তৈরি করতেন।
দশম শতাব্দীতে ফারসিতে লিখিত ‘হুদুদ আল-আলম’ গ্রন্থ থেকে জানা যায়, তিব্বতের কেন্দ্রীয় শহর ‘লাসাতে’ একটি মসজিদ ছিল। যদিও এই শহরে মুসলিম জনসংখ্যা ছিল খুবই কম। একাদশ শতাব্দীর প্রায় শেষ দিকে বাংলার শাসক ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বখতিয়ার খিলজি (মৃত্যু ১২০৫ সাল) তিব্বতসহ ওই অঞ্চলের কিছু অংশ অধিকার করেন। বাদাখশান ও কাশ্মীরের মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থিত বাল্টিস্তানসহ তিব্বতের কিছু অংশ পঞ্চদশ শতকের শেষ দিকে এবং ষোড়শ শতকের গোড়ার দিকে মুসলিম সেনাদল জয় করেছিল। এরপর সপ্তদশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে তিব্বত ছিল মঙ্গোল-তুর্কি বংশোদ্ভূত কালমাক শাসকদের অধীনে।
তিব্বতের মুসলমান
বিশ্বের অন্যতম অর্থনীতি ও বিশাল ভৌগোলিক অংশের দাবিদার চীন ও ক্ষুদ্র তিব্বত পাশাপাশি দুটি অঞ্চল। এ কারণেই হয়তো অঞ্চল দুটির ইতিহাস, অর্থনীতি ও সংস্কৃতির মেলবন্ধন রয়েছে। অন্যদিকে আরব দেশগুলোর সঙ্গে চীনের সম্পর্ক ইসলামের আগমনের অনেক আগে থেকেই বহাল ছিল। চীনা সওদাগররা তাঁদের পণ্য বেচাকেনার জন্য আরবের বিভিন্ন অঞ্চলে সমুদ্রপথে নিয়ে যেতেন। চীনের এক সূত্র মতে জানা যায়, ৬৫১ সালে আরবের একটি বাণিজ্য প্রতিনিধিদল চীনের ক্যান্টন (বর্তমানে গুয়াংজু) নগরী সফর করেছিল। তখন ইসলামী খেলাফতের কর্ণধার ছিলেন হজরত উসমান ইবনে আফফান (রা.)। মুসলিম ইতিহাসবিদরা বলেন, মুসলমানদের ওই বাণিজ্য কাফেলার নেতৃত্ব দিয়েছিলেন মহানবী (সা.)-এর অন্যতম সাহাবি হজরত সাদ বিন আবি ওয়াক্কাস (রা.)। তিনি বাণিজ্য কাফেলার সঙ্গে এসে চীনে ইসলাম প্রচারের সুযোগ পান। তাঁর সংস্পর্শে এসে চীনাদের অনেকে ইসলাম ধর্মের দীক্ষা লাভ করে। মুসলমানের ইবাদতের জন্য সাদ (রা.) ক্যান্টনে একটি মসজিদ নির্মাণ করেন।
উল্লেখ্য, চীন ও তিব্বতের প্রথম দিকের মুসলমানরা আরব, পারস্যবাসী, মধ্য এশিয়া ও মঙ্গোলীয় মুসলিম ব্যবসায়ী ও সৈনিকদের বংশধর। এরা সপ্তম ও দশম শতাব্দীতে চীনের দক্ষিণ-পূর্ব উপকূলে বসতি স্থাপন করেছিলেন। এসব মুসলমানের অনেকে চীন ও তিব্বতের নারীদের সঙ্গে বিয়েবন্ধনে আবদ্ধ হন। স্বাভাবিকভাবেই ওই সব নারী ইসলামে দীক্ষিত হন।
মহাচীনের সমাজে নৃতাত্ত্বিক, ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক ও ভাষাগত বৈচিত্র্য ব্যাপক। ‘হানরা’ চীনের বৃহত্তম নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী। দেশটির বর্তমান জনসংখা ১৩৫ কোটি। এর ৯১.৫৯ শতাংশই হান জনগোষ্ঠীর লোক। চীনা সরকার ৫৫টি নৃতাত্ত্বিক সংখ্যালঘু গোষ্ঠীকে স্বীকৃতি দিয়েছে। সরকারিভাবে এরা ‘মিনজু’ বা সংখ্যালঘু হিসেবে চিহ্নিত। তাদের সংখ্যা ১২ কোটি, যা মোট চীনা জনসংখ্যার মাত্র ৮.৪৯ শতাংশ।
চীনের ৫৫টি সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠীর ১০ শতাংশ ইসলামের অনুসারী। এদের মধ্যে রয়েছে উই, উইঘুর, কাজাখ, কিরগিজ, সালার, বাওয়ান (বোনান), দংজিয়াং, উজবেক, তাজিক ও তাতার। তাদের মধ্যে অপেক্ষাকৃত বৃহৎ গোষ্ঠীগুলো হলো হুই, উইঘুর ও কিরগিজ। এরা সংখ্যায় যথাক্রমে এক কোটি পাঁচ লাখ, এক কোটি ও দুই লাখ। বেশির ভাগ হুই জনগোষ্ঠীর বাস চীনের উত্তর ও পশ্চিম অংশের প্রদেশগুলোতে। এসব জনগোষ্ঠীর পেশা কৃষি, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ও কারুকাজ। এসব জনগোষ্ঠীর লোকেরা আরব, মধ্য এশিয়া ও পারস্যের ব্যবসায়ীদের বংশধর। এরা সপ্তম শতাব্দী থেকে চীনে আগমন করে এবং এখানে বসতি স্থাপন করে। হুই সম্প্রদায়ের লোকেরা অনেকে স্থানীয় চীনা নারীদের বিয়ে করার ফলে ক্রমেই তারা চীনা সমাজের সঙ্গে মিশে গেছে। এখন তারা ম্যান্ডারিন বা অন্য কোনো ভাষায় কথা বলে। হুই মুসলমানরা যে চীনের মূলধারার সঙ্গে মিশে গেছে, তার প্রমাণ হলো তাদের সবাই চীনা নাম ধারণ করেছে। চীনাদের হুই সমাজে মুহাম্মদকে ‘মা’ বা ‘মু’ বলা হয়। একইভাবে হুইদের নামে ‘হুসাইন’ হয়ে ‘হু’, ‘সাঈদ’ হয়ে গেছে ‘সাঈ’, ‘শামস’ হয়ে গেছে ‘ঝেং’ এবং ‘উসমান’ হয়ে গেছে ‘কারি’।
তিব্বতি মুসলমানদের বংশধারা মিশ্রিত। তাদের পূর্বপুরুষরা কাশ্মীর, লাখাদ ও মধ্য এশিয়া থেকে তিব্বতে গিয়ে বসতি স্থাপন করে। তারা সেখানকার তিব্বতি মহিলাদের বিয়ে করে। এভাবে মুসলমানরা তিব্বতের সমাজের অংশে পরিণত হয়।
তিব্বতের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ বৌদ্ধ। ইতিহাসের পর্যায় অবলোকন করলে দেখা যায়, তিব্বতের বৌদ্ধ নেতারা সাধারণত সহিষ্ণু। সেখানকার মুসলমানদের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক পরিচিতির প্রতি বৌদ্ধ নেতারা উদার মনোভাব পোষণ করেন। পঞ্চম দালাই লামার (১৬১৭-১৬৮২) শাসনামলে মুসলমানরা ধর্মীয়, আইনগত, শিক্ষা, অর্থনীতি ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে ব্যাপক অধিকার ভোগ করতেন। ধর্মকর্ম পালন, মসজিদ-মাদরাসা নির্মাণ প্রভৃতি ক্ষেত্রে মুসলমানরা ব্যাপক স্বাধীনতা লাভ করেছিলেন। পঞ্চম দালাই লামা একটি মসজিদ ও গোরস্থানের জন্য মুসলমানদের কিছু জমি বরাদ্দ দিয়েছিলেন। মুসলমানরা তাদের ধর্মীয়, আইনগত ও শিক্ষা-সংস্কৃতি বিষয় ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনার জন্য পাঁচ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করতে পারত। মুসলমানদের অভ্যন্তরীণ বিবাদ-কলহ বা বিরোধ মীমাংসার জন্য তারা নিজস্ব ইসলামী আইনের প্রয়োগ করতে পারত। তারা সরকারের পক্ষ থেকে কর অবকাশও লাভ করেছিল। প্রথম যুগে বৌদ্ধদের পবিত্র মাস ‘সাকাদাওয়ার’ সময় তিব্বতে গোশত বিক্রি ও ভক্ষণ নিষিদ্ধ থাকলেও মুসলমানদের জন্য এই নিষেধাজ্ঞা প্রযোজ্য ছিল না। সরকারের সব অনুষ্ঠানে মুসলিম নেতারা আমন্ত্রিত হতেন।
সম্প্রতি চীনা সমাজে মুসলমানদের অধিকার কিছুটা হলেও সীমিত করা হয়েছে। তাদের নানাভাবে পীড়িত করছে সমাজ ও রাষ্ট্র। ধর্মীয় অধিকারের বিষয়টি সরকার কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করছে বলেই মনে হয়। তার পরও মুসলমানরা যতটা সম্ভব নিজেদের ধর্মীয় বিধি-বিধান পালন করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।