সাম্প্রতিক প্রসঙ্গ

ওরা সুন্দরী ভয়ঙ্কর

নিজেকে কুমারি পরিচয়ে সরাসরি বিয়ে করা। কিছু দিন যেতে না যেতেই স্বামীর বিরুদ্ধে নারী নির্যাতন ও যৌতুকের মামলা। অতঃপর কাবিনের অর্থ নিয়ে রফাদফা। খোদ রাজধানীতে এভাবেই চলছে বিয়ে বাণিজ্য। আবার কখনো যৌন সম্পর্ক করার প্রলোভন দেখিয়ে বিত্তবানদের ব্লাকমেইল, কখনো প্রেমের ফাঁদে ফেলে অপহরণের পর মুক্তিপণ আদায়ের মত ভয়ঙ্কর অপরাধে জড়িয়ে পড়েছে সুন্দরী তরুণীরা। উদ্দেশ্য একটাই, প্রতারণার মাধ্যমে অর্থ হাতিয়ে নেয়া।

সমাজ বিশ্লেষক এবং ঢাকা বিশ্বদ্যিালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মাসুদা এম রশীদ চৌধুরী বলেন, ধর্মীয় মূল্যবোধ এবং পারিবারিক অনুশাসন না থাকায় উচ্চাবিলাসি কিছু নারী প্রতারণায় নেমেছে। তবে এ ধরনের প্রতারণা করা একার পক্ষে সম্ভব নয়। এর পেছনে রয়েছে শক্তিশালী সিন্ডিকেট। ওই সব তরুণীদের অবৈধ আয়ের ভাগ পায় সবাই। এটি প্রশাসনের অজানা থাকার কথা নয়। এ ধরনের অপরাধ বিষ বাষ্পের মতো ছড়িয়ে পড়ার আগেই রোধ করা না গেলে দেশ এবং নতুন প্রজন্মের জন্য হতে পারে অশনি সংকেত।

কেস স্ট্যাডি-১ : রাজধানীর উত্তর যাত্রাবাড়ির মেয়ে কান্তা মনি (২৩)। প্রেমের অভিনয় করে যুবক ইয়াছিন হোসেন কিরণকে বিয়ে করেন। সূত্রাপুরের কুলুটোলা কাজী অফিসে ৫ লাখ টাকায় বিয়ের কাবিন হয় ২০১২ সালের ১ অক্টোবর। কিরণের সঙ্গে বিয়ের সময় কান্তা নিজেকে কুমারি দাবি করেন। বিয়ের কয়েকদিন পর আসল রূপে ফিরেন কান্তা। মদ্যপ অবস্থায় বাসায় ফিরতে শুরু করেন। এ নিয়ে স্বামীর সঙ্গে মনোমালিন্যের এক পর্যায়ে কান্তা কাবিনের ৫ লাখ টাকা দাবি করেন। টাকা আদায় করতে না পেরে কিরণ ও তার পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে মামলা করেন। এক পর্যায়ে কিরণ জানতে পারেন এর আগেও কান্তার সঙ্গে নারায়ণগঞ্জের সুজন ভূঁইয়ার বিয়ে হয়। ২০১০ সালের ২৮ জানুয়ারি ওই বিয়েতে কাবিন হয় এক লাখ টাকা। সেখানেও একইভাবে টাকা নিয়ে সটকে পড়েন কান্তা মনি।

কেস স্ট্যাডি-২ : বয়স ত্রিশের কোটায়। ভেরি স্মার্ট। চলনে বলনে আধুনিকতার ছোঁয়া। নিজেকে কখনো কলি, কখনো ছবি আবার কখনো রুমা নামে পরিচয় দেন। বাংলালিংকসহ বিভিন্ন পণ্যের মডেল এমনকি চলচ্চিত্রের পরিচালক দাবি করেন। এ সুন্দরীর বিশেষ যোগ্যতা অতি অল্প সময়ে যে কোন বয়সের পুরুষকে কাছে টানা। প্রথম পরিচয়েই তিনি যে কোন পুরুষকে তুমি বলে সম্বোধন করেন। আদুরে ব্যবহারে যিনি ভাববেন মেয়েটি তার প্রেমে পড়েছেন, তিনিই ডুবেছেন। কলির বসবাস ঢাকার খিলগাঁও। তবে বাসা পরিবর্তন করেন কিছু দিন পর পর। বিয়ে করেছেন কয়টি সে হিসেব হয়তো নিজেকেই গুনে উত্তর দিতে হবে। একটি ঘরে সন্তান জন্ম নিলেও আর কোথাও সংসার করেননি। নিজেকে কুমারি পরিচয়ে গত এক বছরেই তিনি বিয়ের কথা বলে ৩ ব্যক্তিকে ফাঁদে ফেলে হাতিয়ে নিয়েছেন মোটা অঙ্কের টাকা। এর মধ্যে একজন ভুক্তভোগী ঢাকা কলেজের ছাত্র। ভুয়া বিয়ের কাবিননামা দেখিয়ে মিথ্যা মামলা দায়ের করে ওই ছাত্রের পরিবারের কাছ থেকে হাতিয়ে নিয়েছেন কয়েক লাখ টাকা। এরপর লাপাত্তা। কিছু দিন পরেই অপর এক ব্যবসয়ীকে বিয়ে করে বসবাস করতে থাকেন চট্টগ্রামে। সেখান খেকে স্বর্ণালঙ্কার ও টাকা পয়সা নিয়ে পালিয়ে আসেন। উল্টো ওই ব্যবসায়ীকে নারী নির্যাতন মামলার ভয় দেখিয়ে আপোষের নামে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেন। বর্তমানে অপর এক ব্যবসায়ী যুবককে নিয়ে সবুজবাগে বাসা নিয়েছেন।

পুলিশ বলছে, সুন্দরী তরুণীরা ধনাঢ্য ব্যক্তিদের টার্গেট করে তাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি করে। নিজেদের অবিবাহিত বা কুমারি দাবি করে ধনাঢ্য ব্যক্তিকে বিয়ে করে। বিয়েতে মোটা অংকের কাবিন করে। পরে ঠুনকো অজুহাতে স্বামীর পরিবারকে মামলার ভয় দেখিয়ে আদায় করে নেয় কাবিনের টাকা। অনেকে বিয়ে করে কিছুদিন পর টাকা, সোনা ও মূল্যবান জিনিসপত্র নিয়ে সটকে পড়ে।

কেস স্ট্যাডি-৩ : রাজধানীর শ্যামপুর থেকে প্রেমের ফাঁদে ফেলে দু’ যুবককে অপহরণ করে ৭ লাখ টাকা মুক্তিপণ আদায়ের চেষ্টা করেছিল তরুণী প্রতারক সীমা আক্তার (২২) নামে এক তরুণী। ঘটনাটি ২০১১ সালের এপ্রিলে। পুলিশের তৎপরতায় অপহরণের ৭ দিন পর শরীয়তপুর জেলা থেকে অপহৃত দু’ যুবক হাসু শেখ (৩০) ও কামরানকে (২০) উদ্ধার করতে সক্ষম হয়। তবে কথিত সীমা নামের প্রতারকের নাগাল পায়নি পুলিশ। ভুক্তভোগী অপহৃত হাসু শেখের ভাই আওলাদ শেখ জানান, হাসুর মোবাইলে মিস কলের সূত্র ধরে পরিচয় হয় কথিত সীমার। এরপর থেকে মোবাইলে প্রেমালাপ। ওই বছরের ৮ এপ্রিল জুরাইনের শিকদার নার্সিং হোমের সামনে নির্দিষ্ট সময়, পোশাক ও হাতে লাল গোলাপের মাধ্যমে তাদের প্রথম সাক্ষাৎ। সৌজন্যতার খাতিরে একত্রে হোটেলে খাওয়া-দাওয়া। এরপর সীমা খালি বাসায় একান্তে অভিসারের কথা বলে হাসুু ও তার বন্ধুকে নিয়ে যায়। সীমার সঙ্গে ট্যাক্সি ক্যাবে ওঠার পর থেকে নিখোঁজ হাসু ও তার বন্ধু কামরান। দু’দিন পর কথিত সীমা অপহৃত হাসু ও কামরানের পরিবারের সদস্যদের মোবাইলে ফোন করে ৭ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে। ভুক্তভোগীর পরিবারের পক্ষ থেকে শ্যামপুর থানায় একটি অপহরণ মামলা দায়ের করা হয়। পুলিশ আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে শরীয়তপুর জেলার একটি বাড়ি থেকে অচেতন অবস্থায় দু’যুবককে উদ্ধার করে।

মডেল রেজোয়ানা খালিদ ইমা কাহিনী : গত বছরের জুন মাসে ব্লাকমেইল ও প্রতারণার মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা আত্মসাতের মামলায় ডিবির হাতে গ্রেফতার হন মডেল নামধারী নিশিকন্যা রেজোয়ান খালিদ ইমা। পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে একে একে বেরিয়ে আসে সিনেমাকেও হার মানানো প্রতারণার কারিগর ইমার মূল চরিত্র। জামালপুরের এ মেয়ে ঢাকার গুলশানে বিউটি পার্লারের ব্যবসা করতে গিয়ে পরিচয়ের পর ধনাঢ্য ব্যবসায়ীকে বিয়ে করেন। এরপর র‌্যাম্প মডেল। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই স্বামীকে ত্যাগ। নাম লেখান নিশিকন্যার খাতায়। এরপর কখনো র‌্যাম্প মডেল, কখনো বিনোদন পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে নিজেকে জাহির করে ধনাঢ্য ব্যবসায়ী, ব্যাংকারদের সঙ্গে মডেল সেজে প্রতারণা। ফাঁদে ফেলে হাতিয়ে নেন অর্থ। রাতারাতি হন কোটি কোটি টাকার মালিক।

পুলিশ জানায়, বিভিন্ন উচ্চপদস্থ পেশাজীবী লোকের কাছ থেকে ইমা অন্তত ১০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। বিয়ে করেছেন ৪টি। সকলকেই তিনি ডিভোর্স দিয়েছেন। অনর্গল ইংরেজি বলায় পারদর্শী ইমা কখনো কখেনো নিজেকে লন্ডনী কন্যা পরিচয়ে পাত্রী সাজতেন। আবার কাউকে স্বামী হিসেবে বিদেশে নেয়ার কথা বলে এক সাথে কিছুদিন থেকে তার সহায় সম্বল নিয়ে কেটে পড়তেন। নিজের রূপ-যৌবনকে কাজে লাগিয়ে সবই সম্ভব করেছেন বহুরূপী ইমা। প্রতারণার গডমাদার ইমা সুন্দরী তরুণীদের নায়িকা বানানোর কথা বলে নিয়ে যেত ডিওএইচএস’র বিলাসবহুল ফ্ল্যাটে। সেখানে অভিনয়ের নামে কখনও নায়কের শয্যাসঙ্গী করে গোপন স্টুডিওতে তা ভিডিও করে রাখতো। পরে তা ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেয়ার ভয় দেখিয়ে ভুক্তভোগী তরুণী ও তার শয্যাসঙ্গী উভয়ের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নিতো।

ইমার ইন্দ্রজালে আটকে পড়েছেন অনেক ব্যবসায়ী, সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তা। আমেরিকা প্রবাসী এক যুবককে বিয়ের ফাঁদে ফেলে ১২ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে ইমা। পারিবারিকভাবে আংটি বদলের পরদিনই তাদের আর খুঁজে পাননি তিনি। একইভাবে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী মামুন ও সাগরের কাছ থেকে ৬ লাখ, স্বপ্নার কাছ থেকে ১ লাখ ২০ হাজার, নাহারের কাছ থেকে ৯ লাখ, সায়েমের কাছ থেকে ২ লাখ, রহমত উল্লাহ ও ওয়াকিলের কাছ থেকে ৯ লাখ, মনি’র কাছ থেকে ২ লাখ ও আনোয়ারের কাছ থেকে ২ লাখ ২০ হাজার টাকা হাতিয়ে নেয়। তার অন্ধকার জগতের সঙ্গীদের তালিকায় রয়েছে একাধিক র্যাম্প মডেল।

ব্লাকমেইলের জন্যই অভিজাত ফ্ল্যাট ব্যবহার : গত জানুয়ারিতে ডিবির হাতে ধড়া পড়ে এক নারী অপরাধী চক্রের সদস্য। সেই নারী টিমে রয়েছে একাধিক ক্যামেরাম্যান, ভিডিও ক্যামেরাসহ সংলাপ ধারণের জন্য উচ্চমানের ডিজিটাল টেপরেকর্ডার। এরা কৌশলে লোভী পুরুষদের প্রেমের ফাঁদে ফেলে নিয়ে যায় নিজের ভাড়া করা অভিজাত ফ্ল্যাটে। পরে জোর করে আপত্তিকর ছবি তুলে, ভিডিও চিত্র ধারণ করে ব্ল্যাকমেইল করে। সূত্র মতে, এরকম একটি নারী চক্রের খপ্পরে পড়ে প্রায় ৮ কোটি টাকা খুঁইয়েছেন ইউনিপেটুইউ নামের একটি মাল্টিলেভেল মার্কেটিং কোম্পানির কর্ণধার। আহসান উল্লাহ ইউনিভার্সিটির ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক এ চক্রের সদস্য এক সুন্দরীকে ২০ লাখ ১ টাকার কাবিনে বিয়ে করেন। কয়েক দিনের কথিত স্ত্রী কৌশলে ১০ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়ে কেটে পড়ে।

নারীদের এ ধরনের প্রতারণা সম্পর্কে ঢাকা মেট্রোপরিটন পুলিশের ডিসি (মিডিয়া) মো. মাসুদুর রহমান বলেন, রাজধানীতে এরকম বেশ কিছু প্রতারক চক্র আছে। এসব প্রতারকদের হাত থেকে রক্ষার জন্য প্রয়োজন সতর্কতা। পারিবারিক, সামাজিক ও আর্থিক কারণে নারীরা এ ধরনের প্রতারণার সাথে যুক্ত হয়ে পড়ছে।

(ইনকিলাব)

ইসলামিক ইমেইল নিউজলেটার
নতুন পোস্ট প্রকাশিত হলে সরাসরি আপনার ই-মেইল ইনবক্সে পেতে সাবস্ক্রাইব করুন।
icon

মন্তব্য করুন

Back to top button