অস্থিতিশীল বাংলাদেশ : উত্তরণের উপায়
-আকরাম হুসাইন
শুরুর কথা :
১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে বিগত প্রায় ৪২ বছর যাবৎ আমরা তথাকথিত গণতন্ত্রের ফাঁদে বসবাস করছি। প্রত্যেক নির্বাচনের সময় দেশের রাজনৈতিক পরিবেশ চরম অস্থিতিশীল হয়। এবারও আসন্ন নির্বাচন উপলক্ষে এক অশনি সংকেত দৃশ্যমান। এখন তা এক চরম অস্থিতিশীলতার রূপ ধারণ করেছে। একদিকে চলছে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোটের দফায় দফায় ডাকা সহিংস, জ্বালাও-পোড়াও হরতাল ও অবরোধ; অন্যদিকে আওয়ামী লীগ নেতারা চালাচ্ছেন কথিত নির্বাচনী অপতৎপরতা। ফলে নির্বাচনকে ঘিরে দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব, মানবাধিকারসহ সব কিছুই আজ চরম হুমকির মুখে। তাই জাতি আজ চরম সঙ্কটে নিমজ্জিত। অথচ ক্ষমতাসীন দল সর্বদলীয় সরকার গঠন করে সংবিধান অনুযায়ী আগামী ৫ জানুয়ারী ২০১৪ রবিবারে জাতীয় নির্বাচন করবে মর্মে ঘোষণা করেছে।
প্রধানমন্ত্রী বারবার বলছেন, আসন্ন জাতীয় নির্বাচন বর্তমান সরকারের অধীনেই অনুষ্ঠিত হবে। এদিকে বিএনপি চেয়ারপারসন ও বিরোধীদলীয় নেত্রী বলছেন, শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন কোন সরকারের অধীনে অনুষ্ঠেয় নির্বাচনে বিএনপি অংশগ্রহণ করবে না। বিএনপির জ্যেষ্ঠ নেতৃবৃন্দ বারবার বলছেন, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া কোন দলীয় সরকারের অধীনে কিংবা রাষ্ট্রপতি বা স্পীকারের নেতৃত্বে গঠিত সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে বিএনপি তো অংশগ্রহণ করবেই না; বরং ওই ধরনের কোন নির্বাচন হতেও দেওয়া হবে না। ফলে নির্বাচনী তফসীল ঘোষণার পর থেকে টানা অবরোধ পালন করে ১৮ দলীয় জোট দেশকে অকার্যকর রাষ্ট্রে পরিণত করেছে। ধারাবাহিক কঠোর কর্মসূচীতে স্থবির হয়ে পড়েছে দেশের মেরুদ- অর্থনৈতিক কাঠামো।
অপরদিকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলেছেন, কোন্ সরকারের অধীনে নির্বাচন হবে তা প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণায় পরিষ্কার নয়। অন্যদিকে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসাইন মুহাম্মাদ এরশাদ বলেছেন, সব দল অংশ না নিলে আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তার দল অংশগ্রহণ করবে না। ফলে নির্বাচন বয়কট করার ঘোষণায় তাকে বাগে পেতে মরিয়া হয়ে উঠেছে ক্ষমতাসীন দল। মনে হচ্ছে দুর্গন্ধময় রাজনৈতিক অঙ্গন এখন উন্মাদদের আখড়ায় পরিণত হয়েছে। ফলে সমঝোতার কোন লক্ষণই পরিলক্ষিত হচ্ছে না।
এমতাবস্থায় রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা পুনরায় ১/১১-এর আবির্ভাবের আশঙ্কা ব্যক্ত করছেন। তাই বর্হিবিশ্বের বিভিন্ন অংশ এবং আন্তর্জাতিক সংস্থা একটি গ্রহণযোগ্য সমাধানের লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে। ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, বৃটেন, ফ্রান্স, কানাডা, রাশিয়া, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও জাতিসংঘসহ আর্ন্তজাতিক সংস্থাগুলো প্রকাশ্য বা অপ্রকাশ্য বিভিন্নভাবে সমঝোতার প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে। জাতিসংঘের সহকারী মহাসচিব অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকো বাংলাদেশে তার ছয় দিনের সফরে প্রধান দুই রাজনৈতিক দলসহ বিভিন্ন সামাজিক ও রাজনৈতিক দলের সাথে দফায় দফায় বৈঠক করেও কোন সমাধান না করেই অবশেষে নিরাশ হয়ে ফিরে গেছেন।
রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের কুৎসিত চরিত্র :
রাজনৈতিক নেতাদের আসল চরিত্র ফুটে উঠে নির্বাচনের সময়। তারা নিজেদের স্বার্থ উদ্ধারের জন্য হেন কাজ নেই যা করতে পারে না। যেমন আজকে মতিয়া চৌধুরী, হাসানুল হক ইনু, রাশেদ খান মেনন হলেন বর্তমান সরকারের পরম বন্ধু ও অভিভাবক। তারা একই মঞ্চে বসে দেশ পরিচালনা করছেন। আর জামায়াত হল তাদের চরম শত্রু। অথচ এক সময় জাসদের হাযার হাযার তরুণকে বঙ্গবন্ধুর রক্ষীবাহিনী হত্যা করেছিল। অন্যদিকে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের নামে গণবাহিনী সৃষ্টি করে বহু আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীকে নৃশংসভাবে হত্যা করে যার হাত এক সময় রক্তাক্ত হয়েছিল, সেই হাসানুল হক ইনুই এখন আওয়ামী লীগের কর্ণধার। আজকের কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী, ১৯৭৩ সালে বায়তুল মুকাররমের এক জনসভায় ভাষণে বলেছিলেন, ‘শেখ মুজিবের চামড়া দিয়ে ডুগডুগি বাজাব’। যারা গোপনে বঙ্গবন্ধুর শত্রু বা বৈরী ছিল, এখন তারাই আওয়ামী সরকারের সবচেয়ে বেশী প্রিয় ও কাছের মানুষ। গত ১৫ বছর পূর্বেও জামায়াত ছিল আওয়ামী লীগের সুহৃদ বন্ধু। ১৯৮৬ সালে এরশাদের পাতানো নির্বাচনে বিএনপিকে বাদ দিয়ে আওয়ামী লীগ ও জামায়াত একসঙ্গে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছিল। এরপরই এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জামায়াত একসঙ্গে যুগপৎ আন্দোলন করেছেন। এরূপ কৃৎসিত চরিত্রের প্রশংসা করার ভাষা খুঁজে পাওয়া যাবে কি? জামায়াত বিএনপিকে সমর্থন দিলে তাদের উপর আওয়ামী লীগ ক্ষুব্ধ হয়। ফলে ১৯৯২ সালে জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে ‘ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি’ গঠন করে গোলাম আযমের ফাঁসির দাবীতে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের সামনে গণ আদালত বসানো হয়। সে কারণেই বিএনপি সরকার জামায়াতের গোলাম আযমকে গ্রেফতার করে। তখন বিএনপির উপর জামায়াত ক্ষুব্ধ হয়। ফলে ১৯৯৬ সালে বিএনপির বিরুদ্ধে যৌথ আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে জামায়াত ও আওয়ামী লীগ। শেখ হাসিনা গোলাম আযমকে তাসবীহ, জায়নামায ও কুরআন মাজীদ উপহার দিয়ে দো‘আ নেন। এই হল আমাদের দেশের সেক্যুলার ও ইসলামী রাজনীতির প্রকৃত চরিত্র। ক্ষমতার মোহে কে স্বৈরাচার, কে দেশদ্রোহী, কে যুদ্ধাপরাধী, কে সন্ত্রাসী পরস্পরকে চিনতে পারে না। সময়ে সবাই একাকার হয়ে যায়।
১৯৯৬ সালে বিএনপির বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ, জামায়াত ও জাতীয় পার্টি যুগপৎ আন্দোলন করে। দেশে এক নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। ফলে বিএনপির পতন হয়। সেই জামায়াতই আজ বিএনপির প্রাণের বন্ধু আর আওয়ামী লীগের জানের শত্রু। সে শত্রুতা এমনই যে, আওয়ামী লীগ জামায়াত নেতাদের একে একে ফাঁসিতে ঝুলানোর আয়োজন সম্পন্ন করে ফেলেছে। ইতিমধ্যেই জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারী জেনারেল আব্দুল কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকর করেছে। কাজেই চলমান রাজনীতি হল ‘সঙ্গে থাকলে সঙ্গী আর বিরোধী হলে জঙ্গী’। ফলে সঙ্গীকে রক্ষা করতে এবং জঙ্গী অর্থাৎ বিরোধীকে দমন করতে মাঠে নেমেছে রাজনৈতিক নেতা নামধারী গু-ারা। এই চরিত্রহীন রাজনীতিতে বন্দী হয়ে মানুষ আজ দিশেহারা (তথ্য : তাওহীদের ডাক, মে-জুন ২০১৩)।
রাজনৈতিক অস্থিরতা :
বাংলাদেশ এখন এক মৃত্যুপুরিতে পরিণত হয়েছে। শিক্ষিত-অশিক্ষিত, ধনী-দরিদ্র, নারী-পুরুষ ও শিশু-কিশোর সবাই জীবনযাপন করছে মহা আতঙ্কে। যার মূল কারণ রাজনৈতিক অস্থিরতা। এর প্রভাব পড়েছে আইন-শৃঙ্খলা, অর্থনীতি, ব্যবসা-বাণিজ্য, শিক্ষা প্রভৃতি সেক্টরে। বিরোধী দলের ডাকা সিরিজ হরতাল-অবরোধ এবং ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ দেশের উন্নয়ন কর্মসূচীতে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। হরতালের আওতার বাইরে থাকা অ্যাম্বুলেন্সও আক্রমণ থেকে রেহায় পাচ্ছে না। আদালতের নথি, ফেরি, ট্রেন ও লঞ্চে আগুন দেওয়া হচ্ছে। সংবাদ মাধ্যমের অফিস, গাড়ি বোমা হামলার শিকার হচ্ছে। দায়িত্বপালনরত সাংবাদিকও আহত হচ্ছেন। অথচ যেকোনো মৃত্যুই বেদনার, যেকোনো নৈরাজ্যই নিন্দনীয়।
হরতাল এদেশে নতুন কোন রাজনৈতিক কর্মসূচী নয়। শোনা যায় বৃটিশ আমলে মিঃ গান্ধী এদেশের মানুষকে সর্বপ্রথম সাধারণ ধর্মঘটের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। তারপর থেকে বাংলাদেশে হরতাল একটা কমন ইস্যু হয়ে দাঁড়ায়। যেকোন কারণে বিরোধী দল প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার জন্য হরতাল আহবান করে থাকে। এতে প্রতিপক্ষের কিছু হোক বা নাহোক। ক্ষতি হয় সাধারণ জনগণের। নেতাদের কাজ হল শুধু হরতাল আহবান করা। তারপর এয়ারকান্ডিশন রুমে শুয়ে কিংবা বসে টিভি দেখে সময় কাটান। আর সাধারণ কর্মীরা রাস্তা-ঘাটে, মাঠে-ময়দানে কিছু প্রাপ্তির লোভে জীবন বিলিয়ে দেয়। হরতাল শেষে তারা বলেন, হরতাল সফল হয়েছে। জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে হরতাল পালন করেছে। এই হল রাজনৈতিক নেতাদের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের আসল চেহারা। এক পরিসংখ্যানে জানা যায় যে, ১৯৯১-৯৬ সালে বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালে রাজনৈতিক সহিংসতায় ১৭৪ জন মারা যায়। ১৯৯৬-২০০১ আওয়ামী লীগের প্রথম শাসনামলে মারা যায় ৭৬৭ জন মানুষ। বিএনপি দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় থাকাকালে ২০০১-২০০৭ সালে হরতাল সহ অন্যান্য কারণে মৃত্যুবরণ করে ৮৭১ জন। তত্ত্বাবধায়ক আমলে ২০০৭-০৮ সালে মারা যায় ১১ জন। এবার আওয়ামী লীগ আমলে ২০০৯ থেকে ৮ নভেম্বর ২০১৩ সাল পর্যন্ত মারা গেছে ৫৬৪ জন। হরতালের সহিংসতায় গত ২৬ অক্টোবর থেকে ১৬ নভেম্বর পর্যন্ত মোট ১০ দিনে নিহত হয়েছে ২৭ জন, আহত হয়েছে এক হাযারেরও বেশি। ককটেল, পেট্রোল, বোমায় অগ্নিদগ্ধ হয়েছে ৭৬ জন। এদের মধ্যে ১৩ শিশু ও তিনজন প্রতিবন্ধী রয়েছে। শুধু আগুনে পুড়েই মারা গেছে ৬ জন। ৪৯০টি যানবাহনে আগুন দেওয়া হয়েছে। দেড় হাযারের বেশি ককটেল বিস্ফোরণ ঘটেছে এবং উদ্ধার হয়েছে আট শতাধিক (দৈনিক সকালের খবর, ১৭ নভেম্বর ২০১৩)।
এখন আবার হরতালের আগের দিনও ভয়-ভীতি দেখানোর জন্য নানা হিংসাত্মক কর্মকান্ড চালানো হয়। এছাড়া দলের কর্মী এবং ছোট নেতারা শীর্ষ নেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য এ ধরনের হরতালের সহিংসতার কাজে লিপ্ত হয়ে থাকে বলে শোনা যায়। এমনও দেখা গেছে গাড়িতে আগুন দিয়ে তা নিজের মোবাইল ফোনে ভিডিও করে পাঠানো হয় নেতার কাছে। এ ধরনের কর্মকান্ড দলে ভবিষ্যৎ উচ্চপদ পাওয়ার ‘যোগ্যতা’ হিসাবে বিবেচিত হয়। শুধু বিরোধী দল নয়, ক্ষমতাসীন দলের অনেক কর্মীর একই ধরনের মানসিকতা রয়েছে। পুরান ঢাকায় দর্জি দোকানের কর্মচারী বিশ্বজিত হত্যার ঘটনা যার জাজ্বল্য প্রমাণ। যে রাজনীতি কল্যাণের কথা চিন্তা না করে মানুষকে আতঙ্কগ্রস্ত করে এবং দলের ‘ভাল’ পদ পাওয়ার লিপ্সা দেখায়, সে রাজনীতি মানুষের কতটা কল্যাণ বয়ে আনতে পারবে?
শুধু তাই নয়, যানবাহনে বোম হামলা আর অগ্নি সংযোগের কারণে সিএনজি চালক, দিনমজুর প্রাণ হারাচ্ছে, চোখ হারাচ্ছে। ককটেলের আঘাতে শিশুর হাত উধাও হয়ে যাচ্ছে। মিডিয়ায় বাবার পোড়া বুকে ১৮ মাসের ঘুমন্ত মেয়ে মরিয়মের ছবিটি দেখে দেশের মানুষ প্রশ্নবিদ্ধ, আসলে রাজনীতি কার জন্য?’ যদিও রাজনীতিবিদরা বলে থাকেন, দেশ ও জনগণের স্বার্থরক্ষায় তাদের রাজনীতি। কিন্তু এ রাজনীতি যদি চলন্ত বা স্থির বাসে আগুন দিয়ে মানুষ হত্যা করা হয়, যদি হয় সিএনজি চালিত অটোরিকশায় পেট্রোল বোমা ছুড়ে চালককে জীবন্ত দগ্ধ করা, যদি হয় রাস্তাঘাটে ককটেল রেখে শিশুসহ পথচারীদের ঝলসে দেওয়া, তাহলে সেই রাজনীতি দেশ ও মানুষের অভিশাপ।
অর্থনৈতিক ক্ষতি :
যে কোন দেশের সার্বিক উন্নতির পূর্বশর্ত হ’ল অর্থনৈতিক উন্নয়ন। আর সার্বিক অর্থনৈতিক উন্নতির পূর্বশর্ত হচ্ছে দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা। কিন্তু দুর্ভাগ্য, আমাদের দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার নামে চলছে রাজনৈতিক বিপর্যয়। এতে দেশ ক্রমেই পিছিয়ে যাচ্ছে। এক দিনের হরতালে দেশের সামগ্রিক অর্থনীতির কী ক্ষতি হচ্ছে তার সঠিক কোনো পরিসংখ্যান নেই। যদিও ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ (ডিসিসিআই) এক পরিসংখ্যানে বলেছে, এক দিনের হরতালে ক্ষতি হয় ১ হাযার ৬০০ কোটি টাকা। বিজিএমই-এর তথ্য মতে, একদিনের হরতালে পোশাক খাতে ক্ষতির পরিমাণ ১৪০ কোটি টাকা। পরিবহণ মালিকদের মতে, গাড়ি চলাচল বন্ধ থাকায় ১ দিনে কমপক্ষে ২৫০ কোটি টাকার ক্ষতি হচ্ছে। ক্ষয়-ক্ষতির হিসাব কম-বেশি যেটাই হোক, হরতাল দেশের অর্থনীতির মেরুদ- ভেঙে দিচ্ছে। গাড়ি-ঘোড়া চলছে না। আমদানী-রফতানী বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এখন দফায় দফায় টানা তিন, চার দিন কিংবা এক সপ্তাহ অবরোধ কর্মসূচীতে দেশের অর্থনীতি সর্বনাশের দিকে এগিয়ে চলেছে। একদিকে যেমন কৃষকের কষ্টের ফসল নষ্ট হচ্ছে, অন্যদিকে হু হু করে বাড়ছে দ্রব্যমূল্য। শিল্প, কল-কারখানায় উৎপাদন বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। আগের হরতালের চেয়ে এখন ক্ষয়-ক্ষতির পরিমাণ অনেক বেশী।
সম্ভাবনাময় গার্মেন্টস শিল্পে গত কয়েক বছরে নানা বিপর্যয়ের পর এখন রাজনৈতিক অস্থিরতা ও হাঙ্গামায় অবস্থা শোচনীয়। হরতালের কারণে রফতানিযোগ্য গার্মেন্টস পণ্য যথাসময়ে শিপমেন্ট করা সম্ভব হচ্ছে না। বিলম্বিত সরবরাহের কারণে বিদেশী আমদানিকারকরা বিরক্ত হচ্ছে। ইতিমধ্যে তারা বাংলাদেশের বিকল্প গার্মেন্টস রফতানিকারক দেশের সন্ধানে রয়েছে। রাজনৈতিক অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তার কারণে গার্মেন্টস ক্রেতারা বাংলাদেশে এসে এয়ারপোর্ট থেকে আবার ফিরে গেছে। এমন ঘটনা হরদম ঘটছে। এভাবে দেশীয় অর্থনীতির অন্যতম অনুষঙ্গ গার্মেন্ট শিল্পের সম্ভাবনার দুয়ারগুলো বন্ধ হওয়ার দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়েছে।
শিক্ষাক্ষেত্রে ক্ষতি :
শিক্ষাই জাতির মেরুদ-। ছাত্ররাই জাতির ভবিষ্যৎ। এই ভবিষ্যৎ নাগরিকদেরকে গড়ে তোলার প্রধান কারিগর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। কিন্তু আজকে সেই শিক্ষাঙ্গন নানা সমস্যায় জর্জরিত। গণতন্ত্রের অশুভ থাবা, বস্তাপচা রাজনীতির হিংস্র ছোবলে শিক্ষাঙ্গন কলুষিত। তথাকথিত ছাত্র রাজনীতির নামে ছাত্র নেতারা শিক্ষাঙ্গনে বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয় ও বড় বড় কলেজগুলোতে সন্ত্রাসী কার্যকলাপ চালিয়ে যাচ্ছে। ক্যাম্পাসে আধিপত্য বিস্তারের নামে সাধারণ শিক্ষার্থীদের হয়রানি, শারীরিক ও মানসিক টর্চার, চোরাগুপ্তা হামলা, হাত-পায়ের রগ কর্তনসহ হত্যার মত জঘন্য কাজ তারা করে যাচ্ছে। এহেন অবস্থায় ছাত্রদের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ অনির্দিষ্ট কালের জন্য ক্যাম্পাস বন্ধ ঘোষণা করতে বাধ্য হচ্ছে। এতে শিক্ষার্থীরা সেশনজটে পড়ছে এবং তাদের লেখা-পড়ায় বিঘ্ন ঘটছে। রাজনৈতিক নেতারা নিজেদের আধিপত্য বিস্তার ও ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য কোমলমতি ছাত্রদের হাতে নির্দ্ধিধায় অস্ত্র তুলে দিচ্ছে এবং তাদেরকে ব্যবহার করছে।
একদিকে জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহের মধ্যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সব পরীক্ষা শেষ করার জন্য নির্বাচন কমিশনের তাকীদ ও সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর হল ভ্যাকান্ট করার পায়তারা, অন্যদিকে দাবি আদায়ে বিরোধী দলের লাগাতার হরতাল-অবরোধ ও অসহযোগ আন্দোলনের ঘোষণা। এই দুই মিলিয়ে পরীক্ষার সময়সূচী নিয়ে বিপাকে পড়েছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহ। আর এই পরীক্ষার প্রস্ত্ততি নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে প্রথম শ্রেণী থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায় পর্যন্ত বিভিন্ন শ্রেণী ও বর্ষে অধ্যয়নরত দেশের প্রায় সাড়ে ৩ কোটি শিক্ষার্থী এবং তাদের অভিভাবকরা। কারণ এবারে জেডিসি ও জেএসসি নামে বড় দু’টি পাবলিক পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়েছে, একের পর এক হরতাল-অবরোধের মধ্যে। ফলে নির্ধারিত সময়ে পরীক্ষা নেওয়া সম্ভব হয়নি। দেশের সরকারী ও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েরও বেহাল অবস্থা। বারবার পরীক্ষার সিডিউল পরিবর্তন করা হচ্ছে। ফলে শিক্ষার্থীরা তাদের মানসিক মনোবল হারিয়ে হতাশা ও দুর্দশাগ্রস্ত হয়ে পড়ছে। অভিভাবকগণও তাদের সন্তানদের অনাগত ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্নে দিন কাটাচ্ছে। হরতালের কারণে নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে স্কুলেও যেতে পারছে না শিক্ষার্থীরা। আর শিক্ষার্থীরা না আসায় পড়াতেও পারছেন না শিক্ষকরা। সিলেবাসও শেষ হচ্ছে না।
পর্যালোচনা : প্রেক্ষিত ইসলাম
প্রথমতঃ গণতন্ত্র। ইসলাম গণতন্ত্র সম্পর্কে কী বলে? ইসলাম কি আদৌ এ পদ্ধতি অনুমোদন করে? ইসলামপন্থী দলগুলো সাধারণভাবে এই ধারণা পোষণ করে থাকে যে, রাষ্ট্র ক্ষমতা ব্যতীত যেহেতু ইসলাম প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়, সেহেতু বিভিন্ন নির্বাচনী এলাকার বাছাই করা সৎ ও যোগ্য ব্যক্তিদেরকে প্রার্থী হিসাবে মনোনয়ন দেওয়া হবে। অতঃপর তারা নির্বাচিত হয়ে জাতীয় সংসদে এসে ইসলামী বিধি-বিধান কায়েম করবে। চিন্তাটি বড়ই সাধু। কিন্তু প্রচলিত গণতন্ত্রকে ইসলাম কখনো সমর্থন করে কি? এক কথায় না। কেননা গণতন্ত্রে বিধান দেয় পার্লামেন্ট মেম্বার। অথচ আল্লাহ তা‘আলা বলেন, إِنِ الْحُكْمُ إِلَّا لِلَّهِ أَمَرَ أَلَّا تَعْبُدُوا إِلَّا إِيَّاهُ ذَلِكَ الدِّينُ الْقَيِّمُ وَلَكِنَّ أَكْثَرَ النَّاسِ لَا يَعْلَمُونَ ‘বিধান দেওয়ার অধিকার শুধু আল্লাহরই। তিনি নির্দেশ দিয়েছেন যে, তোমরা শুধু তাঁরই ইবাদত করবে, আর কারো ইবাদত করবে না। এটাই সরল সঠিক দ্বীন; কিন্তু অধিকাংশ মানুষ তা জানে না’ (ইউসুফ ১২/৪০)। অতএব যারা বলে আইন প্রণয়নের নিরংকুশ ক্ষমতা জন প্রতিনিধিদের (মন্ত্রী/এমপিদের), তারা আল্লাহর জায়গায় মন্ত্রী/এমপিদেরকে তাদের রব হিসাবে মেনে নিল (নাঊযুবিল্লাহ)।
বর্তমান পৃথিবীতে এখন নারী নেতৃত্বের জয়জয়কার চলছে। বাংলাদেশেও এর ব্যতিক্রম নয়। যে দেশে শতকরা ৯০% মানুষ মুসলমান, সে দেশে এ রকম অবস্থা হওয়া বড়ই দুঃখজনক ও লজ্জাকর। এ দেশের প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী (সাবেক), পররাষ্ট্র মন্ত্রী, কৃষিমন্ত্রীর ন্যায় ঊর্ধ্বতন মন্ত্রীত্বে সবাই নারী। অথচ আল্লাহ তা‘আলা বলেন, الرِّجَالُ قَوَّامُونَ عَلَى النِّسَاءِ ‘পুরুষরা নারীদের উপর কর্তৃত্বশীল’ (নিসা ৪/৩৪)। অথচ তাদের থাকা উচিত ছিল বাড়ীতে পর্দার অন্তরালে।
এখন আবার এক ধরনের তথাকথিত সুশীল সমাজ নারীদের সমধিকারের দাবী নিয়ে মাঠে নেমেছে। হায়রে দেশ! হায়রে স্বাধীনতা! এ ধরনের দেশে শান্তি আসবে কি কখনো? এর একটিই জবাব, না। কেননা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, لَنْ يُفْلِحَ قَوْمٌ وَلَّوْا أَمْرَهُمُ امْرَأَةً ‘ঐ জাতি কখনও উন্নতি লাভ করতে পারবে না, যে জাতি তাদের নেতৃত্ব অর্পণ করবে কোন নারীর উপরে’ (বুখারী হা/৪৪২৫)। দেশ বর্তমানে অশান্তির দাবানলে জ্বলছে। খুন, হত্যা, চুরি, ডাকাতি, ধর্ষণ, দুর্নীতি এখন নিত্যদিনের ঘটনা। ইসলামী রাষ্ট্র কয়েমের শ্লোগানধারী ইসলামী রাজনৈতিক দলগুলো এই নারী নেতৃত্বের ছায়াতলে আশ্রয় গ্রহণ করেছে ইসলামের অপব্যাখ্যা করে। অথচ বর্তমানে প্রচলিত সকল রাজনৈতিক দল মুদ্রার এপীঠ আর অপীঠের ন্যায়। কোন দলই ইসলামের কল্যাণে বিশ্বাসী নয়। তারা তাদের দল ও ব্যক্তি বিশেষের আদর্শ অনুযায়ী দেশ পরিচালনা করে থাকে। অথচ ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের দলের স্বার্থে সবই করে যাচ্ছে। একবার আওয়ামীলীগের সাথে কোয়ালিশন করছে, একবার বিএনপির সাথে লেজুরবৃত্তি করছে। ইসলামী দলের এরূপ দ্বিমুখী নীতি হবে কেন? অথচ আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
أَلَمْ تَرَ إِلَى الَّذِينَ يَزْعُمُونَ أَنَّهُمْ آمَنُوا بِمَا أُنْزِلَ إِلَيْكَ وَمَا أُنْزِلَ مِنْ قَبْلِكَ يُرِيدُونَ أَنْ يَتَحَاكَمُوا إِلَى الطَّاغُوتِ وَقَدْ أُمِرُوا أَنْ يَكْفُرُوا بِهِ وَيُرِيدُ الشَّيْطَانُ أَنْ يُضِلَّهُمْ ضَلَالًا بَعِيدًا
‘আপনি কি তাদেরকে দেখেননি, যারা দাবী করে যে, আপনার প্রতি যা অবতীর্ণ হয়েছে এবং আপনার পূর্বে যা অবতীর্ণ হয়েছে আমরা সে বিষয়ের উপর ঈমান এনেছি। তারা মূলতঃ ত্বাগূতকে ফায়ছালা দানকারী বানাতে চায়। অথচ তাদেরকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে, যাতে তারা ওকে অমান্য করে। মূলতঃ শয়তান তাদেরকে প্রতারিত করে পথভ্রষ্ট করতে চায়’ (নিসা ৪/৬০)।
গণতন্ত্রের উদ্দেশ্য হল ক্ষমতার লড়াই। তথা ‘জোর যার মুল্লুক তার’। আর এটা ইসলামে সম্পূর্ণরূপে হারাম। ক্ষমতার জন্য বর্তমান রাজনীতিবিদরা এমন কোন হীন কাজ নেই, যা সে করে না। আমরা বলতে চাই, প্রথমে নিজের মধ্যে দ্বীন ইসলাম প্রতিষ্ঠা করতে হবে। আল্লাহ ইচ্ছা করলে শাসন ক্ষমতা দান করলেও করতে পারেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
وَعَدَ اللَّهُ الَّذِينَ آمَنُوا مِنْكُمْ وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ لَيَسْتَخْلِفَنَّهُمْ فِي الْأَرْضِ كَمَا اسْتَخْلَفَ الَّذِينَ مِنْ قَبْلِهِمْ وَلَيُمَكِّنَنَّ لَهُمْ دِينَهُمُ الَّذِي ارْتَضَى لَهُمْ وَلَيُبَدِّلَنَّهُمْ مِنْ بَعْدِ خَوْفِهِمْ أَمْنًا يَعْبُدُونَنِي لَا يُشْرِكُونَ بِي شَيْئًا وَمَنْ كَفَرَ بَعْدَ ذَلِكَ فَأُولَئِكَ هُمُ الْفَاسِقُونَ
‘তোমাদের মধ্যে যারা বিশ্বাস স্থাপন করে ও সৎকর্ম করে, আল্লাহ তাদেরকে ওয়াদা দিয়েছেন যে, তাদেরকে অবশ্যই পৃথিবীতে খেলাফত দান করবেন। যেমন তিনি দান করেছেন তাদের পূর্ববর্তীদেরকে এবং তিনি অবশ্যই সুদৃঢ় করবেন তাদের দ্বীনকে, যা তিনি তাদের জন্য পসন্দ করেছেন এবং তাদের ভয়-ভীতির পরিবর্তে অবশ্যই তাদেরকে নিরাপত্তা দান করবেন। তারা আমার ইবাদত করবে এবং আমার সাথে কাউকে শরীক করবে না। যারা এরপর কুফরী করবে তারা ফাসেক’ (নূর ২৪/৫৫)।
যারা শুধু শিরকমুক্ত ঈমানের সাথে ইবাদত করবে তাদেরকেই আল্লাহ শান্তি ও নিরাপত্তা দেওয়ার অঙ্গীকার করেছেন। উক্ত শর্ত পূরণ করা ছাড়া অঙ্গীকার বাস্তবায়িত হবে এমন আশা করা যায় না। ক্ষমতা দখলের কাজে যারা নিয়োজিত তারা শিরকমুক্ত ঈমান ও আমল প্রতিষ্ঠার কাজে নিয়োজিত হতে পারে না। স্বতঃসিদ্ধ হল যে, শিরকমুক্ত ঈমান ও আমলই দিতে পারে জান্নাতের চিরশান্তি ও নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার গ্যারান্টি। ক্ষমতা নয় কিংবা ক্ষমতায় গিয়ে ইসলামের নাম ব্যবহার করেও নয়।
রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, لاَ تَسْأَلِ الإِمَارَةَ فَإِنَّكَ إِنْ أُوتِيتَهَا عَنْ مَسْأَلَةٍ وُكِلْتَ إِلَيْهَا وَإِنْ أُوتِيتَهَا مِنْ غَيْرِ مَسْأَلَةٍ أُعِنْتَ عَلَيْهَا ‘তুমি নেতৃত্ব চেয়ে নিয়ো না। কারণ যদি চাওয়ার মাধ্যমে তোমাকে তা দেওয়া হয়, তাহলে তুমি তাতেই পতিত হবে। আর যদি না চাইতে দেওয়া হয়, তাহলে তুমি সাহায্যপ্রাপ্ত হবে’ (বুখারী হা/৬৬২২; মিশকাত হা/৩৬৮০)। তিনি আরও বলেন, ‘দুনিয়ায় যে ব্যক্তি নেতৃত্বের লোভ করে, ক্বিয়ামতের দিন তার জন্য তা লজ্জার কারণ হবে’ (বুখারী, মিশকাত হা/৩৬৮১)। আর এই ক্ষমতা লাভের জন্য রাজনৈতিক নেতারা একে অপরের নামে কুৎসা, গীবত, মিথ্যাচার, অশ্লীল বাক্য প্রয়োগ করতে ছাড়ে না। অথচ রাসূল (ছাঃ) বলেছেন,
الْمُسْلِمُ أَخُو الْمُسْلِمِ لاَ يَظْلِمُهُ وَلاَ يُسْلِمُهُ وَمَنْ كَانَ فِى حَاجَةِ أَخِيهِ كَانَ اللَّهُ فِى حَاجَتِهِ وَمَنْ فَرَّجَ عَنْ مُسْلِمٍ كُرْبَةً فَرَّجَ اللَّهُ عَنْهُ كُرْبَةً مِنْ كُرُبَاتِ يَوْمِ الْقِيَامَةِ وَمَنْ سَتَرَ مُسْلِمًا سَتَرَهُ اللَّهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ
‘এক মুসলিম অপর মুসলিমের ভাই। সে তার উপর যুলুম করবে না, তাকে লজ্জিত করবে না। আর যে ব্যক্তি তার ভাইয়ের সাহায্যে থাকবে, আল্লাহ তার সাহায্যে থাকবেন। যে ব্যক্তি কোন মুসলিমের কষ্ট দূর করবে, আল্লাহ তাকে ক্বিয়ামতের দিনে বিপদ সমূহের একটি বড় বিপদ দূর করে দিবেন। যে ব্যক্তি কোন মুসলিমের দোষ-ত্রুটি গোপন রাখে, আল্লাহ ক্বিয়ামতের দিন তার দোষ-ত্রুটি গোপন রাখবেন’ (বুখারী হা/২৪৪২; মুসলিম হা/৬৭৪৩)। অন্য বর্ণনায় এসেছে, ‘আল্লাহ বান্দার সাহায্যে ততক্ষণ থাকেন, যতক্ষণ বান্দা তার ভাইয়ের সাহায্যে থাকে’ (বুখারী, মিশকাত হা/৪৯৫৮)।
দ্বিতীয়তঃ হরতাল। গণতন্ত্রের কুফল হল হরতাল। গণতন্ত্রে বিক্ষোভের স্বীকৃত বৈধ পন্থা হ’ল হরতাল ডেকে গাড়ী ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগ করা, প্রতিপক্ষকে হত্যা ও যখম ইত্যাদি করা। ইসলামী দলগুলো হরতাল পালন করছে ইসলামের নাম ভাঙ্গিয়ে। তারা বলছে এটা যুদ্ধক্ষেত্র। এই যুদ্ধে যারা মারা যাবে, তারা শহীদ হয়ে যাবে। অথচ একদা এক খুৎবায় ওমর ফারূক (রাঃ) বলেন, কেউ যুদ্ধে নিহত হ’লে বা মারা গেলে তোমরা বলে থাক ‘অমুক লোক শহীদ হয়ে গেছে’। তোমরা এরূপ বলো না। বরং তোমরা অনুরূপ বল, যেরূপ রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলতেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর রাস্তায় নিহত হ’ল সে ব্যক্তি শহীদ এবং যে আল্লাহর রাস্তায় মৃত্যু বরণ করল সে ব্যক্তি শহীদ’ (আহমাদ হা/২৮৫, ১০৭৭২; ইবনু মাজাহ হা/২৯১০; মুসলিম, মিশকাত হা/৩৮১১)।
হরতাল প্রতিবাদের কোন ইসলামী ভাষা নয়। হরতাল হ’ল প্রতিবাদের নামে শয়তানের অনুসরণ মাত্র। অনেকে হরতাল পালন করে আর বলে, এই হরতাল হ’ল মানবতার উদ্দেশ্যে। এর মাধ্যমে দেশে শান্তি কায়েম হবে। কিন্তু আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَإِذَا قِيلَ لَهُمْ لَا تُفْسِدُوا فِي الْأَرْضِ قَالُوا إِنَّمَا نَحْنُ مُصْلِحُونَ- أَلَا إِنَّهُمْ هُمُ الْمُفْسِدُونَ وَلَكِنْ لَا يَشْعُرُونَ ‘যখন তাদের বলা হয় পৃথিবীতে ফাসাদ সৃষ্টি কর না। তখন তারা বলে, আমরাইতো সংস্কারবাদী। সাবধান! তারাই ফাসাদ সৃষ্টিকারী; কিন্তু তারা তা উপলদ্ধি করে না’ (বাকারা২/১১-১২)।
এই হরতালে যারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, মারা যাচ্ছে তাদের চোখের পানি ও বদ দো‘আর ভাগিদার কে হবে? আল্লাহ কি দেখছেন না? অবুঝ শিশুটির অঙ্গহানী, অগ্নিদগ্ধ ফযীলার কান্না, সিএনজি চালকের করুণ আর্তনাদ আল্লাহ কি শুনছেন না? নিশ্চয়ই তিনি শুনছেন। রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘মযলূমের ফরিয়াদকে তোমরা ভয় কর। কারণ তার ও আল্লাহর মাঝে কোন পর্দা নেই’ (বুখারী ও মুসলিম)।
উত্তরণের পথ :
প্রচলিত গণতন্ত্রের মরণ ফাঁদ থেকে উত্তরণের লক্ষ্যে আমরা বলতে চাই, অনতিবিলম্বে দল ও প্রার্থীবিহীন নেতৃত্ব নির্বাচন ব্যবস্থা চালু করুন। কেউ প্রার্থী হবেন না, ভোট চাইবেন না, ক্যানভাস করবেন না। জনগণকে ছেড়ে দিন। তারা স্বাধীনভাবে তাদের নেতা নির্বাচন করুক। যিনি কমপক্ষে ৫৫% ভোট পাবেন, তিনি বিভিন্ন বিষয়ে দক্ষ ও অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের নিয়ে ছোট একটি মন্ত্রীসভা গঠন করবেন। যারা নিজেরা ও অন্যান্য দক্ষ ব্যক্তিদের পরামর্শ নিয়ে দেশ চালাবেন। এছাড়াও নেতা দেশের অভিজ্ঞ উলাময়ে কেরামের মধ্য থেকে নিজের জন্য একটা উলামা কাউন্সিল গঠন করবেন। ইসলামী শরী‘আতের অনুকূলে আইন কার্যকর হচ্ছে কি-না তারা সেটা যাচাই ও অনুমোদন করবেন। দেশে ইসলামী পরিবেশ বজায় রাখার জন্য সরকার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাবে। যাতে হিংসা-হানাহানি বন্ধ হযে যায় ও নাগরিকদের মধ্যে পরস্পর মহববতের বন্ধন সুদৃঢ় হয়।
জনগণের সঙ্গে সরকারের সংশ্লিষ্টতা বৃদ্ধির জন্য প্রতিটি যেলায় একাধিক এডিসি ও প্রতি উপযেলায় একাধিক সহকারী ইউএনও এবং ইউনিয়ন ও গ্রাম প্রশাসক ও সহকারী প্রশাসক নিযুক্ত হবেন। যারা জনগণ ও সরকারের কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য থাকবেন। তারা ও তাদের সাথী পুলিশ বাহিনী জনগণের সেবক হবেন। আইন সবার জন্য সমান থাকবে। যেকোন সমস্যা তারা স্থানীয়ভাবে শালিসের মাধ্যমে মিটিয়ে ফেলার চেষ্টা করবেন। এতে আদালতের উপর চাপ কমে যাবে। এভাবে সারা দেশ একটি কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের অধীনে শাসিত হবে।
সরকারের জনপ্রিয়তা যাচাই করা জন্য পাঁচ বছর অপেক্ষা করার দরকার নেই। প্রতি বছর আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন প্রতিষ্ঠান দেশের সার্বিক উন্নয়ন ও সাথে সাথে সরকারের জনপ্রিয়তা জরিপ করবে। সেখানে কেবল মাথাপিছু আয় ও দারিদ্র বিমোচনের হার দেখা হবে না। বরং জনগণের সত্যিকারের সুখ-শান্তির হার কত বৃদ্ধি পেল, সেটাই দেখা হবে। এই হার ক্রমাবনতিশীল হ’লে এবং তা পরপর তিনবছর চলতে থাকলে পুনরায় নির্বাচন হবে। যদি জরিপ রিপোর্ট সরকারের পক্ষে যায় এবং দেশের অবস্থা ক্রমোন্নতিশীল থাকে, তাহ’লে পুনরায় নেতা নির্বাচনের কোন প্রয়োজন নেই। কিন্তু যদি অবনতিশীল হয় এবং জনমত নেতিবাচক হয়, তাহ’লে সরকারকে সংশোধনের সুযোগ দিয়ে এক বছরের মধ্যে নির্বাচন হবে। সবকিছুরই দায়িত্ব থাকবে কেবল নির্বাচন কমিশনের। নির্বাচন ব্যবস্থা সহজ হবে। যাতে জনগণ অতি সহজে ও চাপমুক্তভাবে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারে। ভোট দেওয়ার জন্য দেশে ছুটি ঘোষণার কোন প্রয়োজন নেই। নিজ বাড়ীতে বা কর্মস্থলে বসে এমনকি ব্যবসা ও বিপণীকেন্দ্রে অবস্থান করেও যাতে ভোট দেয়া যায় সে ব্যবস্থা করতে হবে। মোটকথা নেতৃত্বের পরিবর্তন ও জনমত প্রকাশের পন্থা সহজ থাকতে হবে। তাহ’লে মিছিল-হরতাল-গাড়ীভাঙ্গা বন্ধ হয়ে যাবে। নেতার সঙ্গে জনগণের দূরত্ব দূর হবে এবং সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হবে। নেতাদের অহংকারী মেযাজ পাল্টে গিয়ে তারা জনগণের খাদেমে পরিণত হবেন (সম্পাকদীয়, মাসিক আত-তাহরীক, অক্টোবর ২০১৩)। আল্লাহ আমাদের তাওফীক দিন- আমীন!