বিভ্রান্তির সমাধান

জান্নাতে পুরুষের জন্য একাধিক হূর থাকবে কেন?

জান্নাতে স্বামী-স্ত্রীর ব্যাপারে কী ঘটবে? শুনেছি একজন স্ত্রী ছাড়াও স্বামীর জন্য সত্তরটি হূর থাকবে তার খেদমতের জন্য, এটা আমার জন্য ইনসাফের বিষয় হতে পারে না, যদি স্বামীর সম্ভাগে এ পদ্ধতিতে অন্যকে শরীক করা হয়।

আলহামদুলিল্লাহ,

প্রথমত: একজন মুমিনের উপর কর্তব্য হচ্ছে, আল্লাহ তা‘আলার শরী‘আতগত বিধি-বিধান ও তাকদীরগত বিধি-বিধানসমূহকে নির্দ্বিধায় মেনে নেয়া। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

“মুমিনদের উক্তি তো এই—যখন তাদের মধ্যে বিচার-ফয়সালা করে দেয়ার জন্য আল্লাহ্ এবং তাঁর রাসূলের দিকে ডাকা হয়, তখন তারা বলে, ‘আমরা শুনলাম এবং আনুগত্য করলাম।’ আর তারাই সফলকাম।” [সূরা আন-নূর: ৫১]

আর যখন আল্লাহর বিধি-বিধান, হুকুম আহকাম সম্পর্কে কোনো মুমিনের কোনো প্রশ্ন থাকে, আর সে উক্ত বিধানের প্রকৃত অর্থ বা হেকমত তথা রহস্য না জানে, তখন তার উপর কর্তব্য হচ্ছে তা বলা, যা জ্ঞানে সুদৃঢ় ব্যক্তিগণ বলে থাকেন, তারা বলেন,

“আমরাতো তাতে ঈমান এনেছি, সবই আমাদের রবের পক্ষ থেকে এসেছে”। [সূরা আলে ইমরান: ৭]

কোনো মুমিনের জন্য আল্লাহর কোনো হুকুমের ব্যাপারে এটা বলা কখনও জায়েয নেই যে ‘এটা ইনসাফপূর্ণ নয়’, কারণ আল্লাহ এর থেকে অনেক উর্ধ্বে ও বহু উচ্চে।

মহান আল্লাহ বলেন,

“আর আপনার রব্ব বান্দাদের উপর সামান্যতমও যুলুম করেন না”। [সূরা ফুসসিলাত: ৪৬]

আর এটা একজন মুমিনকে অবশ্যই মেনে নিতে হবে যে, আল্লাহ তা‘আলার হুকুম বা বিধি-বিধানের চেয়ে উৎকৃষ্ট ও উত্তম বিধি-বিধান আর কিছু হতে পারে না। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

“আল্লাহ কী সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ বিচারক নন?”। [সূরা আত-তীন: ৮]

আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন,

“তবে কি তারা জাহেলিয়াতের বিধি-বিধান কামনা করে ? আর দৃঢ় বিশ্বাসী সম্প্রদায়ের জন্য বিধান প্রদানে আল্লাহ্র চেয়ে আর কে শ্রেষ্ঠতর?”। [সূরা আল-মায়িদাহ: ৫০]

দ্বিতীয়ত: এ প্রশ্নে দু’টি ভুল ও একটি বিভ্রান্তি রয়েছে। তন্মধ্যে প্রথম ভুল হচ্ছে, প্রশ্নকারিনীর একথা বলা যে, প্রতিটি মানুষের জন্য জান্নাতে সত্তরটি ডাগর নয়না হূর রয়েছে। কারণ, সহীহ হাদীস দ্বারা শুধু আল্লাহর পথের শহীদগণের ব্যাপারেই বলা হয়েছে যে, তাদের জন্য ৭২ বাহাত্তরটি ডাগর নয়না হূর থাকবে। এর বাইরে হাদীসে একজন সাধারণ জান্নাতী লোকের জন্য মাত্র দু’জন স্ত্রী থাকার কথা বলা হয়েছে। যদিও তাদের কারও কারও ব্যাপারে এরচেয়ে বেশি থাকার কথাও বলা হয়েছে। (তবে সত্তরটি হূর শুধু আল্লাহর পথের শহীদদের ব্যাপারেই এসেছে), যেমন হাদীসে এসেছে, মিকদাম ইবন মা‘দীকারেব রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহু সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

“শহীদের জন্য থাকবে ছয়টি বিশেষ বৈশিষ্ট্য, তাকে প্রথমবারেই ক্ষমা করে দেওয়া হবে, জান্নাতে তার অবস্থান তাকে দেখানো হবে, কবরের আযাব থেকে তাকে মুক্তি দেওয়া হবে, মহা ভীতিপ্রদ সে অবস্থায় তাকে নিরাপত্তা দেওয়া হবে, তার মাথায় সম্মানের মুকুট পরানো হবে, যার একটি ইয়াকুত পাথর দুনিয়া ও তাতে যা আছে তা থেকে উত্তম, এবং তাকে বাহাত্তর জন ডাগর নয়না হূর স্ত্রীর সাথে বিয়ে দেওয়া হবে, আর তার নিকটস্থ সত্তর জন্য ব্যাপারে তার সুপারিশ গ্রহণ করা হবে।”
[তিরমিযী, (হাদীস নং ১৬৬৩); ইবন মাজাহ, (হাদীস নং ২৭৯৯); আলবানী সহীহ আত-তিরমিযীতে তা সহীহ বলেছেন।]

অবশ্য কোনো কোনো বর্ণনায় এর থেকেও বেশি এসেছে, আবু নু‘আইম তাঁর ‘সিফাতুল জান্নাহ’ গ্রন্থে আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহু সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

“জান্নাতী একজন পুরুষ একই দিনে একশত কুমারীর কাছে গমন করবে, অতঃপর যখন সে তার কাছ থেকে উঠে আসবে, তখনই সে নারী আবার পবিত্রা ও কুমারী হয়ে যাবে।”
অর্থাৎ জান্নাতে, শাইখ আল-আলবানী সিলসিলাতুস সহীহায় (৩৬৭, ৩৩৫১) এটাকে সহীহ বলেছেন।

তবে সাধারণভাব সকল জান্নাতীর ব্যাপারে হাদীসে দু’জন স্ত্রীর কথা এসেছে, আবু সাঈদ আল-খুদরী রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহু সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

“সবচেয়ে নিম্নমানের সাধারণ একজন জান্নাতের অধিকারী ব্যক্তির ব্যাপারে এসেছে, যার চেহারাকে আল্লাহ্ জাহান্নাম থেকে জান্নাতের দিকে ফিরিয়ে দিবেন, আর তার সামনে একটি ছায়াদার বৃক্ষ দেখাবেন, … তারপর সে তার ঘরে প্রবেশ করবে, তখন তারজন্য সংরক্ষিত জান্নাতী দু’জন হূর স্ত্রী তার কাছে প্রবেশ করে বলতে থাকবে, আল্লাহর প্রশংসা যে তিনি আপনাকে আমাদের জন্য জীবিত করেছেন, আর আমাদেরকে আপনার জন্য জীবিত রেখেছেন, তখন সে জান্নাতী বলবে, আমাকে যা দেওয়া হয়েছে তা কাউকে দেওয়া হয় নি”, [মুসলিম, হাদীস নং ১৮৮]

হাফেয ইবন হাজার রহেমাহুল্লাহ বলেন, ‘এ হাদীস থেকে প্রকাশ হয় যে, প্রত্যেক জান্নাতীর জন্য কমপক্ষে দু’জন স্ত্রী থাকবে।

তৃতীয়ত: প্রশ্নকারিনীর দ্বিতীয় ভুল হচ্ছে, এ কথা বলা যে, ডাগর নয়না হূরীরা খেদমতে নিয়োজিত থাকবে। এটা শুদ্ধ নয়। বরং যারা জান্নাতীদের খেদমত করবে, তারা তো ‘গিলমান’ যারা চিরস্থায়ী। মহান আল্লাহ বলেন,

“আর তাদের সেবায় চারপাশে ঘুরাঘুরি করবে কিশোরেরা, তারা যেন সুরক্ষিত মুক্তা।” [সূরা আত-ত্বূর: ২৪]

আরও বলেন,

“আর তাদের উপর প্রদক্ষিণ করবে চির কিশোরগণ, যখন আপনি তাদেরকে দেখবেন তখন মনে করবেন তারা যেন বিক্ষিপ্ত মুক্তা”
আর ডাগর নয়না হূরীগণ; তারা তো জান্নাতে একজন পুরুষের স্ত্রী হবে। এটা দুনিয়ায় তাদের যে সকল স্ত্রী থাকবে সেটার অতিরিক্ত।

মহান আল্লাহ বলেন,

“এভাবেই আমরা তাদেরকে বিয়ে দিয়ে দিব ডাগর নয়না হূরদের সাথে” [সূরা আদ-দুখান: ৫৪]

আরও বলেন,

“তারা বসবে শ্রেণীবদ্ধভাবে সজ্জিত আসনে হেলান দিয়ে; আর আমরা তাদের মিলন ঘটাব ডাগর চোখবিশিষ্টা হূরের সংগে”। [সূরা আত-ত্বূর: ২০]

চতুর্থত: যে বিভ্রান্তিটি প্রশ্নকারিনী লিপ্ত তা হচ্ছে, মহিলার কথা, ‘এটা আমার জন্য ইনসাফের বিষয় হতে পারে না, যদি স্বামীর সম্ভাগে এ পদ্ধতিতে অন্যকে শরীক করা হয়’ কারণ, শরী‘আতের হুকুম-আহকাম ও বিধি-বিধানেই ইনসাফ, তার ধারণা বা কথায় নয়, যে শরী‘আত জানে না, জানে না তার বিধি-বিধান; আর শরী‘আতের বিধানের হেকমত ও রহস্য সম্পর্কে যে বেশী অজ্ঞ।

প্রশ্নকারিনী মহিলা মনে করেছে যে, তার অন্তরে যে ‘ঈর্ষাকাতরতা’ রয়েছে, আর তা সংশ্লিষ্ট দুঃখ-কষ্ট, ক্লেশ, মন-ভারাক্রান্ত হওয়া, এসবই তার সাথে জান্নাতেও থাকবে। তার এ ধারণা ঠিক নয়। এ ভুল ধারণার বশবর্তী হয়েই সে এ বিভ্রান্তিকর প্রশ্ন করেছে।

মহান আল্লাহ বলেন,

“আর আমরা তাদের অন্তর থেকে ঈর্ষা দূর করব , তাদের পাদদেশে প্রবাহিত হবে নদীসমূহ। আর তারা বলবে, ‘যাবতীয় প্রশংসা আল্লাহ্রই যিনি আমাদেরকে এ পথের হিদায়াত করেছেন। আল্লাহ্ আমাদেরকে হিদায়াত না করলে, আমরা কখনো হিদায়াত পেতাম না। অবশ্যই আমাদের রবের রাসূলগণ সত্য নিয়ে এসেছিলেন।’ আর তাদেরকে সম্বোধন করে বলা হবে, ‘তোমরা যা করতে তারই জন্য তোমাদেরকে এ জান্নাতের ওয়ারিস করা হয়েছে”

সুতরাং জান্নাতে শুধু নেয়ামত ও খুশী থাকবে। সেখানে হিংসা, হানাহানি, ঈর্ষার জান্নাতীদের অন্তরে স্থান হবে না। আর ডাগর নয়না হূরীগণ, তারা তো মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে জান্নাতীদেরকে তাদের নে‘আমতের মধ্যে বর্ধিত সম্মান প্রদানের জন্য সৃষ্ট। তাছাড়া একজন পুরুষকে জান্নাতে একশত জন পুরুষের মত সহবাসের ক্ষমতা দেওয়া হবে, সুতরাং সেখানে মহিলা বেশি হলে তার প্রভাব অন্যদের উপর পড়বে না। দুনিয়ার বুকে একজন নারী যেভাবে তার সতীন বা স্বামীর ক্রিতদাসীর উপর ঈর্ষার্ণিত হয়, বা মন খারাপের মত ঘটনা ঘটে, সেটা সেখানে থাকবে না।

যায়েদ ইবন আরকাম রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহু সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে বলেছেন,

“জান্নাতী একজন লোককে একশত লোকের খাওয়া, পানীয়, প্রবৃত্তির চাহিদা ও সহবাসের ক্ষমতা দেওয়া হবে। তখন এক ইয়াহূদী বলে বসল, যে বেশী খায় ও পান করে, তাকে বেশি পেশাব পায়খানার বেগ নিতে হবে, তখন রাসূলুল্লাহু সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বললেন, তাদের প্রয়োজনীয় বেগ তো শুধু এটুকুই হবে যে, তাদের চামড়ার উপর একটু ঘাম দেখা দিবে, যাতে তাদের পেটের অভ্যন্তরের সব কিছু হজম হয়ে যাবে।”

অর্থাৎ, তার পেটে যা খাবার ঢুকেছে তাতেই তা হজম হয়ে যাবে।

[হাদীসটি ইমাম বর্ণনা করেছেন যথাক্রমে, ইমাম আহমাদ, তার মুসনাদে (১৮৮২৭); ইবন হিব্বান, ১৬/৪৪৩; শাইখ আল-আলবানী, সহীহুল জামে‘ (১৬২৭)]

আল্লাহ বলেন,

“তবে কি তারা জাহেলিয়াতের বিধি-বিধান কামনা করে ? আর দৃঢ় বিশ্বাসী সম্প্রদায়ের জন্য বিধান প্রদানে আল্লাহ্র চেয়ে আর কে শ্রেষ্ঠতর?” [সূরা আল-মায়িদাহ: ৫০]

অনুরূপভাবে আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহু সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে বলেছেন,

“জান্নাতে একজন মুমিনকে সহবাসের এমন এমন শক্তি দেওয়া হবে, বলা হল, ইয়া রাসূলাল্লাহ্! সে কি তাতে সক্ষম হবে? তখন রাসূল বললেন, তাকে একশত ব্যক্তির ক্ষমতা দেওয়া হবে।” [হাদিসটি বর্ণনা করেছেন, যথাক্রমে তিরমিযী (২৫৩৬); ইবন হিব্বান, (১৬/৪১৩); আর শাইখ আল-আলবানী, তার সহীহুল জামে‘ গ্রন্থে (৪১০৬)]

-আল্লাহই সর্বজ্ঞ।

শাইখ মুহাম্মাদ সালেহ আল-মুনাজ্জিদ
অনুবাদ ও সম্পাদনা : ড. আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া

ইসলামিক ইমেইল নিউজলেটার
নতুন পোস্ট প্রকাশিত হলে সরাসরি আপনার ই-মেইল ইনবক্সে পেতে সাবস্ক্রাইব করুন।
icon

মন্তব্য করুন

Back to top button