নির্বাচনী দ্বন্দ্ব নিরসনে একটি প্রস্তাব
১৯৭১-এর ডিসেম্বরে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে বিগত প্রায় ৪২ বছর আমরা কথিত গণতন্ত্রের দেশে বসবাস করছি। গণতন্ত্রের অর্থ যদি কেবল ভোটাভুটি হয়, তবে সেটা ইংরেজ ও পাকিস্তান আমলেও ছিল। যার যুলুম থেকে বাঁচার জন্য বহু রক্তের ও ইয্যতের বিনিময়ে দেশ স্বাধীন হ’ল। পাকিস্তানী গণতন্ত্র ছেড়ে আমরা বাঙ্গালী ও বাংলাদেশী গণতন্ত্রের অভিজ্ঞতা হাছিল করেছি। ফলাফল সকল যুগে সমান। বরং আরও অধঃপতন। সবচেয়ে বড় অধঃপতন হ’ল নৈতিকতার অধঃপতন। বৃটিশ ভারতের রাজনীতিকদের যতটুক নৈতিকতা ও দায়িত্ববোধ ছিল, দেশ ভাগের পরে পাকিস্তানী নেতাদের মধ্যে তা অনেক হ্রাস পেল। অতঃপর বাংলাদেশী নেতাদের নৈতিকতা তলানিতে গিয়ে ঠেকল। এখন রাজনীতির উদ্দেশ্য হয়েছে কেবল ক্ষমতা দখল, প্রতিপক্ষ দমন ও দু’হাতে লুটপাট ও শোষণ।
দেশের ভৌগলিক স্বাধীনতা ও রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্বের উপর ক্রমেই হুমকি বাড়ছে। সংবিধানে ঘোষিত পররাষ্ট্র নীতির সাথে বাস্তবতার কোন মিল নেই। আইন-আদালত-শিক্ষা ও প্রশাসন সর্বত্র দলীয় স্বৈরাচার স্পষ্ট। দেশের নেতৃত্ব সর্বদা দু’টি দলের মধ্যেই ঘুরপাক খাচ্ছে। একদলের যুলুমে অতিষ্ট হয়ে মানুষ আরেক দলকে ভোট দিচ্ছে। পরে তাদের যুলুমে অতিষ্ট হয়ে কোন পথ না পেয়ে পুনরায় পূর্বের দলটিকে ভোট দিচ্ছে। এভাবে সাধারণ মানুষ দু’দলের কাছে যিম্মী হয়ে পড়েছে। দু’দলই ভাবছে আমরাই দেশের ত্রাণকর্তা। অথচ তারা যে কেবল নেগেটিভ ভোটই পেয়ে থাকেন, সেটা তারা মানতে নারায। যুলুম-শোষণ ও নির্যাতনের দিক দিয়ে উভয় দল ও জোটের মধ্যে ঊনিশ ও বিশ-এর পার্থক্য মাত্র।
প্রশ্ন হ’ল, যুগ যুগ ধরে কি এভাবে দলীয় স্বেচ্ছাচার চলবে? ভোটের সময় নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার চাওয়ার অর্থ কি এটা নয় যে, নির্বাচিত সরকার নিরপেক্ষ নয়? অতএব যদি নববই দিনের জন্য নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ সরকার চাওয়া হয়, তাহ’লে পাঁচ বছরের জন্য সেটা চাইতে আপত্তি কোথায়? আর এখন তো স্পষ্ট যে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারই ভাল নির্বাচিত সরকারের চাইতে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দশ জন উপদেষ্টা সুন্দরভাবে দেশ চালাতে সক্ষম হ’লে প্রায় সাড়ে তিনশ’ দলীয় এমপি নির্বাচন করে হাতি পোষার কি দরকার? এমপিরা ভোটের সময় জনপ্রতিনিধি। ভোটের পর হয় জনবিচ্ছিন্ন ও স্বার্থসর্বস্ব। এর জন্য তারা নিজেরা যতটা না দায়ী, তার চাইতে বেশী দায়ী হ’ল বর্তমান সিস্টেম। এই সিস্টেমে ঐ এমপি জনপ্রতিনিধি নন, বরং তিনি হয়ে পড়েন দলনেতার প্রতিনিধি। ফলে তাকে দল ও দলনেতার তোষণে জীবনপাত করতে হয়। বহু কিছুর বিনিময়ে তাকে প্রথমে মনোনয়নপত্র হাছিল করতে হয়। অতঃপর ভোটে জিতলেও নেতার মর্যি বিরোধী কোন কথা বা আচরণ প্রমাণিত হ’লেই সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী তার সংসদ সদস্যপদ বাতিল করা যায়। ফলে জাতীয় সংসদ মূলত ‘জী হুযুর’ সংসদে পরিণত হয় এবং সেটা সরকারী ও বিরোধী দলের দুই নেতার পরস্পরের বিরুদ্ধে খেস্তি-খেউড়ের কেন্দ্রে পরিণত হয়। লোভ বা ভয় দেখিয়ে ভোট আদায় করতে হয়। যাতে অবশ্যম্ভাবীরূপে তাদেরকে সশস্ত্র একদল গুন্ডাবাহিনী পুষতে হয়। ফলে পুরা সমাজ এখন দলীয় সন্ত্রাসীতে ভরে গেছে। সম্মানী মানুষ প্রতিনিয়ত অসম্মানিত হচ্ছেন। সম্ভাব্য প্রতিদ্বন্দ্বীকে গুম, খুন, অপহরণ অথবা মিথ্যা মামলায় পুলিশী রিম্যান্ডে নিয়ে পিটিয়ে হত্যা করা হচ্ছে। অতঃপর বলা হচ্ছে হার্টফেল করে মারা গেছে। এছাড়াও নিরপরাধ লোকদের মিথ্যা মামলায় ধরে নিয়ে হাজতের নামে বছরের পর বছর কারা নির্যাতন করা হচ্ছে। হাযার হাযার পরিবার এভাবে সর্বদা নিঃস্ব ও ধ্বংস হচ্ছে। মেধা ও মননের কোন মূল্য গণতান্ত্রিক সমাজে নেই। বর্তমান নেতৃত্ব নির্বাচন ব্যবস্থা সমাজকে পরস্পর হানাহানিতে পূর্ণ একটি শতধাবিভক্ত রাজনৈতিক কুটিল সমাজে পরিণত করেছে। এই ব্যবস্থা যতদিন থাকবে, ততদিন দেশের পরিণতি আরও করুণ হবে।
দেশ ও সমাজকে বাঁচাতে গেলে এই অপরাজনীতি থেকে অবশ্যই ফিরে আসতে হবে এবং নেতৃত্ব নির্বাচনের ইসলামী নীতির কাছে আত্মসমর্পণ করতে হবে। তাই এ বিষয়ে আমাদের প্রস্তাব হ’ল :
অনতিবিলম্বে দল ও প্রার্থীবিহীন নেতৃত্ব নির্বাচন ব্যবস্থা চালু করুন। কেউ প্রার্থী হবেন না, ভোট চাইবেন না, ক্যানভাস করবেন না। জনগণকে ছেড়ে দিন। তারা স্বাধীনভাবে তাদের নেতা নির্বাচন করুক। যিনি কমপক্ষে ৫৫% ভোট পাবেন। অতঃপর তিনি বিভিন্ন বিষয়ে দক্ষ ও অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের নিয়ে ছোট্ট একটি মন্ত্রীসভা গঠন করবেন। যারা নিজেরা ও অন্যান্য দক্ষ ব্যক্তিদের পরামর্শ নিয়ে দেশ চালাবেন। এছাড়াও নেতা দেশের অভিজ্ঞ ওলামায়ে কেরামের মধ্য থেকে নিজের জন্য একটা ওলামা কাউন্সিল গঠন করবেন। ইসলামী শরী‘আতের অনুকূলে আইন রচিত হচ্ছে কি-না তারা সেটা যাচাই ও অনুমোদন করবেন। অতঃপর তা কার্যকর হবে। দেশে ইসলামী পরিবেশ বজায় রাখার জন্য সরকার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাবে। যাতে হিংসা-হানাহানি বন্ধ হয়ে যায় ও নাগরিকদের মধ্যে পরস্পরের মহববতের বন্ধন দৃঢ় হয়।
জনগণের সঙ্গে সরকারের সংশ্লিষ্টতা বৃদ্ধির জন্য প্রতিটি যেলায় একাধিক এডিসি ও প্রতি উপযেলায় একাধিক সহকারী ইউএনও এবং ইউনিয়ন ও গ্রাম প্রশাসক ও সহকারী প্রশাসক নিযুক্ত হবেন। যারা জনগণ ও সরকারের কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য থাকবেন। তারা ও তাদের সাথী পুলিশ বাহিনী জনগণের সেবক হবেন। আইন সবার জন্য সমান থাকবে। যেকোন সমস্যা তারা স্থানীয়ভাবে শালিসের মাধ্যমে মিটিয়ে ফেলার চেষ্টা করবেন। এতে আদালতের উপর চাপ কমে যাবে। এভাবে সারা দেশ একটি কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের অধীনে শাসিত হবে।
সরকারের জনপ্রিয়তা যাচাই করার জন্য পাঁচ বছর অপেক্ষা করার দরকার নেই। প্রতি বছর আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন প্রতিষ্ঠান দেশের সার্বিক উন্নয়ন ও সাথে সাথে সরকারের জনপ্রিয়তা জরিপ করবে। সেখানে কেবল মাথাপিছু আয় ও দারিদ্র্য বিমোচনের হার দেখা হবে না। বরং জনগণের সত্যিকারের সুখ-শান্তির হার কত বৃদ্ধি পেল, সেটাই দেখা হবে। এই হার ক্রমাবনতিশীল হ’লে এবং তা পরপর তিনবছর চলতে থাকলে পুনরায় নির্বাচন হবে। যদি জরিপ রিপোর্ট সরকারের পক্ষে যায় এবং দেশের অবস্থা ক্রমোন্নতিশীল থাকে, তাহ’লে পুনরায় নেতা নির্বাচনের কোন প্রয়োজন নেই। কিন্তু যদি অবনতিশীল হয় এবং জনমত নেতিবাচক হয়, তাহ’লে সরকারকে সংশোধনের সুযোগ দিয়ে এক বছরের মধ্যে নির্বাচন হবে। সবকিছুরই দায়িত্ব থাকবে কেবল নির্বাচন কমিশনের। নির্বাচন ব্যবস্থা সহজ হবে। যাতে জনগণ অতি সহজে ও চাপমুক্তভাবে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারে। ভোট দেওয়ার জন্য দেশে ছুটি ঘোষণার কোন প্রয়োজন নেই। নিজ বাড়ীতে বা কর্মস্থলে বসে এমনকি ব্যবসা ও বিপণীকেন্দ্রে অবস্থান করেও যাতে ভোট দেয়া যায় সে ব্যবস্থা করতে হবে। মোটকথা নেতৃত্বের পরিবর্তন ও জনমত প্রকাশের পন্থা সহজ থাকতে হবে। তাহ’লে মিছিল-হরতাল-গাড়ীভাঙ্গা বন্ধ হয়ে যাবে। নেতার সঙ্গে জনগণের দূরত্ব দূর হবে এবং সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হবে। নেতাদের অহংকারী মেযাজ পাল্টে গিয়ে তারা জনগণের খাদেমে পরিণত হবেন। আল্লাহ আমাদের তাওফীক দিন- আমীন!
– প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব