স্রষ্টা ও সৃষ্টি

কৃতজ্ঞতার বর্ষণে সিক্ত হবার আহবান

১. প্রিয় মানুষগুলোর মায়াবী মুখ, ভরা পূর্ণিমায় পাগল করা জোছনার প্লাবন, শরতের আকাশে ভেসে ভেসে যাওয়া মেঘমালা, মেঘের আড়ালে লুকিয়ে থাকা চাঁদ,  সবুজের নয়নকাড়া অপার সমারোহ, সমুদ্রের উত্তাল ঢেউ, পাহাড়ের বুকে বেয়ে চলা ঝর্ণাধারা, হঠাৎ করে উড়ে আসা টিয়ে কিংবা চড়ুই, অর্ধ প্রস্ফুটিত গোলাপ, মাটিতে পড়ে থাকা কৃষ্ণচূড়া। আরও কত কী! মন চাইলেই প্রাণ ভরে দেখে নিতে পারি অজস্র পার্থিব সৌন্দর্য। আমাদের দু’টো চোখ অবিরাম দেখে চলেছে। কিন্তু জানেন তো, আমার আপনার মতো মিলিয়ন মিলিয়ন মানুষ আছে যারা দু’ চোখে কিছুই দেখতে পায় না। কেউ বা  মায়ের গর্ভ থেকেই অন্ধ, কেউবা কিছুদিন অনুগ্রহ উপভোগ করার পরে অন্ধ। পবিত্র কুর’আনটা দেখে দেখে পড়ার ক্ষমতাটুকুও তার নেই। হয়তোবা সে গোপনে একবার শুধু মায়ের মুখটা দেখার প্রার্থনা করেছে নিভৃতে আল্লাহ্‌র কাছে। সর্বশক্তিমান আল্লাহ্‌ কি পারতেন না আমদের দৃষ্টি শক্তিটাও কেড়ে নিতে? এটা কি আল্লাহ্‌র অশেষ অনুগ্রহ নয়? তাঁর অপার ভালবাসায় কি তিনি আমদের সিক্ত করে রাখেননি? অথচ এ নিয়ামাতের কৃতজ্ঞতা আদায় না করে উল্টো ব্যবহার করেছি কতো নিষিদ্ধ কাজে। কতো আপত্তিকর- অশোভনীয়- নিকৃষ্ট কাজে। চোখে চোখে কতো বিষবাষ্প ছড়িয়ে পড়ছে।

২. সবচাইতে প্রিয় মানুষ ‘মা’-এর কণ্ঠে ‘সোনা- মাণিক’, সবচাইতে শ্রদ্ধেয় মানুষ ‘বাবা’ –এর ভরাট গলায় ‘খোকা’, প্রিয়তমা অর্ধাঙ্গিনীর সোহাগী সম্বোধন, কলজের টুকরো সন্তানের আদুরে কণ্ঠে ‘বাবা’ ডাক, প্রিয় ক্বারীর সুললিত কণ্ঠের তিলাওয়াত, পাখির কলতান, বসন্তের কোকিলের কুহু কুহু ডাক, বহমান স্রোতের ‘কলকল’ শব্দ, দখিনা বাতাসের ‘শনশন’ শব্দ, বর্ষা-দুপুরে টিনের চালে বৃষ্টির ‘রিমঝিম’ শব্দ, সমুদ্রের গর্জে ওঠার শব্দ , নূপুরের ঝংকার কিংবা কাঁচের চুড়ির ‘টুংটাং’ শব্দ। আমার- আপনার কাছে এগুলো শুনতে পাওয়া খুব সাধারণ বিষয় বলে বিবেচিত হয়। কিন্তু ভাবুন তো একবার, সে মানুষটির কথা, যে জন্ম থেকেই  শ্রবণশক্তিহীন- বধির। তার কাছে তো এ শব্দগুলো পরম আরাধ্য। সন্তানের মুখের ‘বাবা’ ডাকটি একবার শুনতে পারলে হয়তো জীবনটা ধন্য মনে করতো সে। আর আমরা এই অশেষ অনুগ্রহ পেয়েও অশ্রাব্য- অশালীন নিষিদ্ধ শব্দমালা প্রতিনিয়ত ইচ্ছাকৃতভাবে কর্ণকুহরে প্রবেশ করাচ্ছি।

৩. ভাবুন তো, এই মুহূর্ত থেকে আমার আপনার কণ্ঠ থেকে কোন স্বর বের হচ্ছে না! কী করতাম আমরা? আমাদের চাহিদা-প্রয়োজন-ভালোলাগা-মন্দলাগা-ভাব-ভালোবাসা কীভাবে প্রকাশ করতাম আমরা? আর যারা জন্ম থেকেই বাক-শক্তিহীন, সমাজ যাদের ‘বোবা’ বলে ডাকে তাদের কি অবস্থা? কাউকে কুর’আনটা তিলাওয়াত করে শোনাতে পারে না। বন্ধুদেরকে আমার-আপনার মতো হাসির কথা বলে হাসাতে পারে না। ভীষণ বড় রকমের এক ক্ষমতা এই ‘বাকশক্তি’। এত বড় ক্ষমতার কতটুকু আমরা ভালো কাজে ব্যয় করি? অহেতুক-অসার-অপ্রয়োজনীয়-অসত্য কথা বলে কি আমরা অপচয় করছি না এ ক্ষমতার?

৪. ফার্মগেট ওভারব্রীজে নিথর- অচল- অকর্মণ্য হয়ে পড়ে থাকে কতগুলো দেহ। দু’টো-পাঁচটা টাকা সাহায্য চায়। মানুষগুলো পঙ্গু-বিকলাঙ্গ। এই বাংলার বুকেই তো কত সহস্র মানুষ পঙ্গু হয়ে জন্ম নেয়। লোকগুলো পড়াশোনা তো দূরের কথা, কাজ করেও খেতে পারে না। নিজ হাতে মুখে খাবারটা তুলতে পারে না। অন্যের সাহায্য ছাড়া প্রাকৃতিক কর্ম সেরে পবিত্রও হতে পারে না। অথচ আল্লাহ আমাদের কতো সুঠাম স্বাস্থ্যের অধিকারী করে সৃষ্টি করলেন। গায়ে কত বল দিলেন, শক্তি দিলেন। এর কতটুকু ব্যবহার করছি আল্লাহর সন্তুষ্টির কাজে? দু’রাকাত সলাত আদায় করতেও তো আলস্যের অন্ত নেই। আমাদের হাতগুলো- পাগুলো আমরা নিষিদ্ধ বস্তু স্পর্শে, অহেতুক মারামারি-হানাহানি-ভাঙচুরে ব্যবহার করছি না তো?

৫. কোন একটা উপলক্ষ পেলেই তো আমরা পার্টি দিতে চলে যাই বি.এফ.সি.-কে.এফ.সি.-পিৎজা হাট কিংবা বসুন্ধরা সিটির ফুডকোর্টে। আমার এই লেখার মধ্যে এমন কেউ কি আছেন যারা প্রতিনিয়ত অনাহারে-অর্ধাহারে দিনাতিপাত করেন? একবেলাও ঠিক মতো খেতে পারেন না দিনে, ডায়েট কন্ট্রোলের জন্য নয় – খাবারের অভাবে?  সকালের নাস্তা করতে পারেন না, দুপুরের খাবার খেতে পারেন না, হয়তোবা রাতে একটু-আধটু খাবার জোটে? যদি উত্তর ‘না’ হয়ে থাকে, তাহলে তথ্যটা শুনে চোখ ছানাবড়া হয়ে যেতে পারে আপনার। ২০১১ সালে করা World Bank এর এক জরিপে দেখা গেছে পৃথিবীতে প্রায় এক বিলিয়ন মানুষ দিনের পর দিন, অনাহারে ক্ষুধার্ত থেকে দিনাবসান করে; ‘Chronically Hungry’ থাকে তারা এক ষষ্ঠাংশ মানুষ। আবার বলছি, প্রতি ৬ জনের মধ্যে ১ জন! আলহামদুলিল্লাহ্‌! সেই ৬ জনের একজন আমি বা আপনি নই। ক্ষুধার কষ্ট যে কত বড় কষ্ট তা হয়তো আমাদের অনেকেরই জানা নেই। রমাদান মাসে বোধহয় খানিকটা অনুভব করা যায়।

৬. সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্মেছি আমরা। মা-বাবার আদর-ভালোবাসা-যত্ন তো আছেই, আরও আছেন চাচা-চাচী, ফুফা-ফুফু, মামা-মামী, খালা-খালু, দাদু-বুবু, নানা-নানী ইত্যাদি। স্নেহ আর যত্নের শেষ নেই একেকজনের। কখনও হয়তোবা তাদের ভালোবাসার অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছি। কিন্তু জানেন কি, ২০১১ সালে করা UNICEF এর এক জরিপে উঠে এসেছে প্রায় ২২০ মিলিয়ন শিশু এই পৃথিবীতে একেবারে ইয়াতিম-নিঃস্ব। বাবা মা কেউ নেই তাদের। এমনকি অন্য কোন আত্মীয় স্বজনও নেই তাদের লালন-পালন করার জন্য। সকাল হলেই মা স্কুলের ইউনিফর্ম পড়িয়ে কপালে চুমু এঁকে তাদের স্কুলে পাঠায় না, মুখে তুলে খাবার খাইয়ে দেয় না, প্রিয় খাবারটা বিকেল বেলা তৈরি করে দেয় না, জ্বর হলে সারারাত মাথার কাছে উদ্বিগ্ন হয়ে বসে থাকে না।

তাদের বাবার হাত ধরে স্কুলে যেতে পারে না। ক্রিকেট ব্যাট-বল কিনে দেয় না ওদের কেউ। ঈদে বন্ধুদের নূতন জামা দেখে চোখটা সজল হয়ে উঠলেও, কারো কাছে একটু আবদার করতে পারে না।

বন্ধুগণ, আল্লাহর নিয়ামত যদি আমরা একটা একটা করে গণনা করতে চাই, এরকম কোটি কোটি জীবনের পক্ষেও তা সম্ভবপর নয়। চারিদিকে যা দেখি, যা শুনি, যা অনুভব করি, যা স্পর্শ করি সবই তো আল্লাহ তায়ালার অপার অনুগ্রহ। কারো মাথায় প্রশ্ন আসতে পারে, ঐ প্রতিবন্ধী দুঃখী মানুষগুলোর বেলায় কি তবে আল্লাহর অনুগ্রহ নেই? আপাতদৃষ্টিতে মনে হয়, আল্লাহ তাদেরকে আমাদের চেয়ে কম দিয়েছেন। এ ব্যাপারটা বুঝতে হলে আমাদের মাথায় রাখতে হবে- আল্লাহ এই জীবনটা বানিয়েছেন একটা পরীক্ষাক্ষেত্র হিসেবে। ক্লাসের পরীক্ষায় সবার জন্য প্রশ্নপত্র একই হতে পারে, কিন্তু জীবন নামের পরীক্ষায় একেকজনের জন্য পরীক্ষা একেক রকম। কারো ক্ষেত্রে পরীক্ষাটা এরকম- কষ্টের মধ্যে থেকেও কি সে ভাল মানুষ থাকতে পারবে? আবার কারো ক্ষেত্রে ঠিক উলটো- দুনিয়ার সব সুখ স্বাচ্ছন্দ্যের মধ্যে ডুবে থেকেও সে কি তার প্রভুর প্রতি কৃতজ্ঞতা দেখাবে? এমন হতেই পারে যে কষ্টে থাকা মানুষটা হয়ত শেষবিচারের দিন হাসতে হাসতে পার পেয়ে গেল- কারণ তার এত কষ্টই তাকে আল্লাহর সামনে বিনয়াবনত রেখেছে, অল্পতেই তুষ্ট থাকার ক্ষমতা দিয়েছে। আয়্যুব (আ) এর উপাখ্যান এখানে চমৎকার একটা দৃষ্টান্ত- কাহিনীর শুরুতে তার পার্থিব সম্পদের কমতি ছিল না, সে অবস্থায়ও তিনি আল্লাহর প্রতি সদাসর্বদা কৃতজ্ঞতা দেখিয়েছেন। হঠাত আল্লাহ তার ধনসম্পদ সন্তান-সন্ততি সুস্বাস্থ্য সব কেড়ে নিয়ে একদম নিঃস্ব পঙ্গু পথের ফকির বানিয়ে দিলেন- সেই অবস্থায়ও তাঁর মুখ দিয়ে আল্লাহর প্রতি একটি কটুবাক্য উচ্চারিত হয়নি, বরং তিনি  প্রার্থনা করেছেন- দয়াময় প্রভু আমার, কঠিন পরীক্ষা উপস্থিত হয়েছে সামনে; তোমার করূণার তো আদি অন্ত বলে কিছু নেই! কাজেই প্রতিবন্ধী বলেই যে আল্লাহ তাকে কোনভাবে ঠকিয়ে দিয়েছেন- ব্যাপারটা আদৌ সেরকম নয়। কে যে প্রকৃত সৎ আর ভাগ্যবান তা শুধু তিনিই জানেন। কারো বাহ্যিক অবস্থা দেখে আমাদের বলা সম্ভব নয় সে কি হৃদয়ের দিক থেকে খাঁটি কিনা অথবা সামনের জীবনে তার জন্য কি আসছে। আমার বক্তব্য শুধু এতটুকুঃ আমরা অনেকেই এত এত পেয়েও কিছুই পেলাম না বলে হা-হুতাশ করি। দয়ার নবী শিখিয়ে গেছেন- দুনিয়াতে যারা তোমার চেয়ে কম পেয়েছে, তাদের দিকে তাকাও। এই দৃষ্টিহীন শ্রুতিহীন প্রতিবন্ধী মানুষগুলোর দিকে তাকালে আমরা বুঝব,আমাদের আল্লাহ এই দুনিয়াতে কত অজস্র অনুগ্রহ দিয়েছেন।

দুনিয়ার সব গাছ যদি কলম হয় আর সমুদ্র (কালি হয়) আর তার সাথে আরও সাত সমুদ্র যুক্ত হয়, তবুও আল্লাহর (প্রশংসার) কথা (লেখা) শেষ হবে না। আল্লাহ মহাপরাক্রমশালী, মহাপ্রজ্ঞার অধিকারী। (সূরাহ লুকমানঃ ২৭)

আল্লাহ আমাদের এত ভালোবাসা দেয়ার পরেও তাঁর প্রতি আমরা কতটুকু ভালোবাসা দেখিয়েছি? কতটুকু কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছি আমরা? দিনে কতবার ‘আলহামদুলিল্লাহ্‌’ বলি আমরা এত সহস্র নিয়ামতের জন্য? কৃতজ্ঞতা তো আমরা ঠিক মত আদায় করিই না, উল্টো পদে পদে তাঁর অবাধ্যতা পোষণ করি, অকৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি। তিনি যদি আর রাহিম(পরম দয়ালু), আর রহমান(পরম দয়াময়), আল গাফফার(মহাক্ষমাশীল), আল কাবির(মহৎ), আল আজিম(মহিমাময়), আল হালীম(সহিষ্ণু), আল ওয়াদুদ(প্রেমময়), আর রাউফ(কোমল হৃদয়) না হতেন, তবে হয়তো আমরা কবেই ধ্বংস হয়ে যেতাম।

জিজ্ঞেস করতে পারেন, আমরা যদি নিয়ামতের শুকরিয়া আদায় করি, তাহলে আল্লাহ আমাদের কি দেবেন? আর যদি শুকরিয়া আদায় না করি, তবে আমাদের কি পরিণতি হবে?

এর উত্তর আল্লাহই সূরাহ ইবরাহীমের ৭নং আয়াতে দিয়েছেন,

স্মরন কর, যখন তোমাদের প্রতিপালক ঘোষণা করেন, যদি তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর তাহলে আমি অবশ্যই তোমাদের জন্য (আমার নিয়ামত) বৃদ্ধি করে দেব, আর যদি তোমরা অকৃতজ্ঞ হও (তবে জেনে রেখ, অকৃতজ্ঞদের জন্য) আমার শাস্তি অবশ্যই কঠিন।

আল্লাহ সর্বপ্রথম আমাকে এবং আমার ভাই বোনদেরকে তাঁর কৃতজ্ঞতার বর্ষণে সিক্ত হওয়ার তাওফিক দিন। আসুন না, এখনই একবার অন্তরের গহীন থেকে বলে ফেলি- আলহামদুলিল্লাহি রব্বিল আলামীন।

(ahobaan.com)

ইসলামিক ইমেইল নিউজলেটার
নতুন পোস্ট প্রকাশিত হলে সরাসরি আপনার ই-মেইল ইনবক্সে পেতে সাবস্ক্রাইব করুন।
icon

মন্তব্য করুন

Back to top button