অ্যারিস্টটলের ঈশ্বর
১.
খুব বেশিদিন আগের কথা হয়ত নয়। পৃথিবীর আকাশটা তখনও কলের ধোঁয়া চিনতে শেখেনি, তাই তার রং তখন রূপকথার মত নীল। সেই নীল আকাশটাকে মানুষ ভালবাসত।
ব্যবসা-বাণিজ্য ভাল চললে যেটা হয়- সদাগরের জাহাজে চড়ে শুধু চাল নুন যে আসে তা নয়, আসে সাগরের ওপারের মানুষগুলোর চিন্তাভাবনাও। এত চিন্তাভাবনা একজায়গায় টক্কর খেলে মানুষ তার নিজের মত সম্পর্কে খুব বেশি নিঃসন্দেহ থাকতে পারেনা, সে ভাবতে শেখে। নিন্দুকেরা বলে, দর্শন হচ্ছে খেয়ালিপনার অন্য নাম। তখনকার গ্রীস ছিল মানুষের খেয়ালিপনায় ক্লান্ত। মানুষ শুধু প্রকৃতি নিয়ে কবিতা লিখে ক্ষান্ত হয়নি, তারা একে বুঝতেও চেয়েছিল। প্রকৃতিও স্বচ্ছন্দ্যে মানুষের যুক্তিতর্কের ছুরিকাঁচির নিচে গা এলিয়ে দিল- ইউরোপের ইতিহাসে এই প্রথম।
তো খেয়ালি অ্যারিস্টটল একদিন তার ভালবাসার পৃথিবীর দিকে তাকিয়ে ভাবলেন- ধরা যাক, কিছু মানুষ জন্মের পর থেকে মাটির নিচে আটকা আছে। হঠাৎ ভূমিকম্প হোক আর যে কারণেই হোক, এরা বাইরে বেরিয়ে এল। এই পৃথিবী দেখে তাদের প্রথম ভাবনাটা কীরকম হবে? [অ্যারিস্টটলের সম্মানার্থে সাধু ভাষা]
“ধরিয়া লই, মাটির তলায় এমন কিছু মানুষের বাস, যাহারা সুন্দর আলোকিত বাসস্থানে স্বচ্ছন্দ্যে দিবস যাপন করে। উহাদের কক্ষসমূহ ভাস্কর্য, চিত্রাদি এবং সহস্র বিলাসী জীবনোপকরণ দ্বারা পূর্ণ- সকল মিলাইয়া তাহারা খুবই আনন্দে থাকে। তাহারা কখনো মাটির উপরে আগমন করে নাই অথবা দেবতাদের নাম পর্যন্ত শ্রবণ করে নাই। এমতাবস্থায় যদি একদিন মৃত্তিকামধ্যে গহবর সৃষ্টি হয়, তবে উহারা আমাদিগের জগতে বাহির হইয়া আসিয়া সহসাই দেখিবে পৃথিবীরে, দেখিবে ইহার সমুদ্র আর আকাশকে। উহারা চিনিবে মেঘমালিকার বিশালতা আর বায়ুপ্রবাহের শক্তি; দেখিবে সূর্যকে, শুধু উহার আকার আর সৌন্দর্যই নহে, বরং উহার ক্ষমতাকেও- যাহার দ্বারা সে আকাশ জুড়িয়া আলো ছড়াইয়া দেয়। আর রাত্রি যখন পৃথিবীকে অন্ধকারে আচ্ছন্ন করিয়া দেয়, তখন তাহারা দেখিবে সমগ্র আকাশ নক্ষত্রে পরিপূর্ণ, দেখিবে চন্দ্রালোকের পরিবর্তন- হ্রাসবৃদ্ধি, ইহা ছাড়াও দেখিবে গগনজোড়া সকল বস্তুর উদয় এবং অস্ত। অসীম কাল ধরিয়া ইহাদের মধ্যে আদৌ কোন পরিবর্তন নাই। যখন উহারা এইসব দেখিবে, নিশ্চয়ই তাহারা ভাবিয়া লইবে যে দেবতারা সত্য, আর এই সকল বিচিত্র বিস্ময় দেবতাদের কর্ম ব্যাতীত কিছু নহে।” [১]
অ্যারিস্টটলের কাছে প্রকৃতি ছিল কারিগরের যত্নে গড়া- কাজেই মানুষ পৃথিবীর দিকে প্রথম দৃষ্টি মেলে দিয়েই বুঝবে, সৃষ্টিকর্তা না থেকে উপায় নেই। অ্যারিস্টটল যদিও ঠিক আজকের মানুষ নন, কিন্তু তার অজস্র ভাবনার মত এই ভাবনাটাও ঠিক পুরোনো হয়নি। মানুষ প্রকৃতিকে আরও বেশি বুঝেছে ঠিকই, কিন্তু বিজ্ঞান আর দর্শনে অ্যারিস্টটলের ঈশ্বর ঘুরে ফিরে বার বার দেখা দিয়ে গেছেন। সেই সতেরশ’র দিকে উইলিয়াম পেইলি লিখেছেনঃ
“মনে করুন, বাগানে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ একটা পাথরে আমার পা ঠেকল। কেউ যদি জিজ্ঞেস করে ওখানে পাথরটা কীভাবে এসেছে, আমি হয়ত বলব ওটা এখানেই চিরকাল ছিল। উত্তরটাকে ভুল প্রমাণ করাও খুব সহজ হবে না। কিন্তু মনে করুন, আমি যদি মাটিতে একটা ঘড়ি খুঁজে পাই আর কেউ জিজ্ঞেস করে ওটা কিভাবে এল, এবার কিন্তু আমার আগের উত্তর খাটবে না। কিন্তু কেন? যে উত্তর পাথরের জন্য ঠিক সেটা ঘড়ির জন্য ভুল হবে কেন? কারণ একটাই- ঘড়িটাকে যদি আমি পর্যবেক্ষণ করি তবে দেখব এর মধ্যে অনেকগুলো অংশ একত্রে কাজ করে চলেছে, আর অংশগুলো বসানো হয়েছে কোন একটা উদ্দেশ্যে। এই ব্যাপারটা পাথরের মধ্যে নেই. . . ঘড়িটার মধ্যে যতটা না কারিগরি আছে, ততটা প্রকৃতিতেও আছে- পার্থক্য শুধু এখানে যে প্রকৃতির কারিগরি তার সহস্রগুণ বেশি।” [২]
পেইলির বক্তব্যঃ একটা ঘড়ি দেখলে যেমন সহজেই বোঝা যায় যে তা আপনা-আপনি আসেনি, এসেছে কোন কারিগর বা designer এর যত্নে, ঠিক একইভাবে প্রকৃতির দিকে তাকালেই বোঝা যাবে এর পেছনে নির্ঘাৎ কেউ কলকাঠি নেড়ে রেখেছেন।
অ্যারিস্টটল—অ্যাকোয়াইনাস-পেইলির যুক্তি ঠুনকো তো নয়ই, এখনকার বিজ্ঞানের কাছে তার আকর্ষণ আরো বহুগুণ বেড়ে গেছে। লাপ্লাস তার নেবুলার হাইপোথিসিসের মাধ্যমে দেখিয়েছিলেন, সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক উপায়ে কিভাবে সৌরজগত এসে থাকতে পারে। কেউ কেউ তখন ভেবেছিল- বিশ্ব সৃষ্টির জন্য ঈশ্বরের দরকার খুব বেশি তাহলে নেই। এই শতকে আবার দেখা গেল মহাবিশ্বের সৃষ্টিতেই বিশাল রহস্য রয়ে গেছে- মহাবিশ্বের মৌলিক ধ্রুবকগুলোর (যেমন gravitational constant, G কিংবা cosmological constant, lambda) মান যদি এতটুকু এদিক ওদিক হত তাহলেই এই বিশ্ব সৃষ্টি হতে পারত না, অথবা হলেও তাতে প্রাণের উৎপত্তি সম্ভব হত না। পৃথিবীতে প্রথম প্রাণ সৃষ্টির ব্যাপারেও একই কাহিনী- ডারউইন সেই রহস্যের সমাধান করে যেতে পারেননি, হাক্সলি আর হেকেলরা মনে করেছিলেন একটা এককোষী প্রাণ সৃষ্টি আর কতই বা ঝামেলার বিষয়। শতক ঘুরতে না ঘুরতেই মানুষ জানল, কোষের মধ্যে সহস্র এনজাইম লাখো বিক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করে চলেছে। পঞ্চাশের দিকে বিজ্ঞান বায়োকেমিস্ট্রি আর মলিকিউলার বায়োলজিকে চিনল, তেপ্পান্নতে ওয়াটসন-ক্রিক পৃথিবীকে দেখালেন ডিএনএর চেহারা, যাতে কিনা দেহের সমস্ত তথ্য ঠিক বই লেখার মত করে লেখা রয়েছে। মাইক্রোস্কোপের নিচের আর টেলিস্কোপের ওপাশের পৃথিবীতে অ্যারিস্টটলের ঈশ্বর সগৌরবে বিরাজমান।
দর্শন-বিজ্ঞান একটু দূরে থাক। কুর’আনের কথায় আসি।
২.
নিশ্চয়ই আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর সৃষ্টিতে,
আর রাত ও দিনের পরিক্রমায়-
আর জাহাজসমূহে- যারা সমুদ্রে চলাচল করে মানুষের কল্যাণের জন্য,
আর আল্লাহ আকাশ থেকে যে বৃষ্টি পাঠান তাতে-
যা দিয়ে [তিনি] মৃত পৃথিবীতে প্রাণের সঞ্চার করেন
আর তাতে বিস্তৃতি ঘটান সকল প্রকারের প্রাণীর,
আর বাতাসের গতিপ্রবাহে-
আর আকাশ ও পৃথিবীর মাঝে নিয়ন্ত্রিত মেঘমালিকায়-
চিন্তাশীল সম্প্রদায়ের জন্য নিদর্শন রয়েছে। [৩]
একটা ব্যাপার আমরা হয় বুঝিনা, অথবা বুঝলেও মনে রাখিনা; সেটা হচ্ছে কুর’আন বিজ্ঞান বা দর্শনের বই নয়। এটা হচ্ছে মানুষের কাছে স্রষ্টার বক্তব্য। বক্তব্যের বিষয় হচ্ছে মানুষের জীবনের উদ্দেশ্য আর তার আত্মিক সার্থকতা। কাজেই কুর’আনের কথাগুলো মানুষের মনস্তত্ত্বের খাপে বসানো, যে কথা যেভাবে বললে কাজ হবে কুর’আনে সে কথা সেভাবেই এসেছে। যে কথা অর্ধেক ভেঙ্গে বললেও মানুষ বুঝে নেবে, সেটা কুর’আন খোলাসা করতে যায়নি; আবার যেকথা চৌদ্দবার বললেও মানুষ শুনবে না, অসংখ্যবার সেকথার পুনরাবৃত্তি করতেও কার্পণ্য করেনি। যেহেতু এর বক্তব্য গোটা মানবজাতির প্রতি, তাই কুর’আনের উপদেশ এসেছে সহজ ভাষায়। একারণেই কুর’আনে syllogism নেই, বিজ্ঞানের সমীকরণ নেই, অবরোহী যুক্তির সোপানমালা নেই। কুর’আনে প্রকৃতি নিয়ে আয়াত এসেছে প্রায় আটশ’ এর কাছাকাছি। কোনটাতেই আল্লাহ যে কোন যুক্তি-প্রমাণ দিচ্ছেন- এরকমটা স্পষ্ট বোঝা যায় না। তার জায়গায় কুর’আনে যে কথাটা সাধারণত এসেছে তা হল “নিদর্শন”।
কিন্তু সমস্যাটা এখানেই। অনেকের মনে হতে পারে- আর সেজন্য তাদের দোষ দেওয়া চলে না- কুর’আনে গাছপালা নদনদী নিয়ে যে বর্ণনাগুলো এসেছে, তা দেড় হাজার বছর আগের বেদুইনদের মুখে হয়ত রুচত, এখনকার যুক্তিবাদী রসনায় তার স্বাদ নেই। এখন মানুষের জগতটাই অন্য- তার চিন্তা এগোয় দর্শনের কাঁটাতার বুঝে, বিজ্ঞান আর অঙ্কশাস্ত্রের চোখরাঙ্গানি মেনে। এরকম একটা জগতে গাছপালা-তরুলতা-পাহাড় পর্বত-মেঘের পাঁচালী খাপ খাচ্ছে কোথায়?
উত্তরটা বুঝতে হলে আমাদের আগে কুর’আনের চোখ দিয়ে মানুষকে দেখতে হবে।
মুসা নবী ছিলেন সংসারী মানুষ, মরুভূমির মাঝে প্রিয়তমা স্ত্রীকে নিয়ে কাটছিল তার শান্ত জীবন। কোন এক ঠাণ্ডা রাতে দূরে দেখলেন আগুনের মত কি-একটা যেন জ্বলছে। স্ত্রীকে বললেন, তুমি বোস, আমি খবর নিয়ে এক্ষুণি আসছি।
রইল পড়ে তাঁর শান্ত জীবন। ভেবেছিলেন হয়ত কোন কাফেলা ছোট্ট আগুন জ্বালিয়ে বসেছে, কিন্তু নাঃ
“আর যখন সে [মুসা] [আগুনের] কাছে পৌঁছল, তাকে আহবান করা হলঃ
‘হে মুসা! নিঃসন্দেহে আমিই তোমার প্রভু,
সুতরাং [আমার উপস্থিতিতে] তোমার জুতো খুলে রাখ
নিশ্চয়ই তুমি আছ তু’আর পবিত্র উপত্যকায়।
আর আমি তোমাকে নির্বাচন করেছি-
কাজেই শোন (তোমাকে) যা প্রত্যাদেশ করা হচ্ছে. . .তুমি আর তোমার ভাই আমার নিদর্শনসমূহ নিয়ে যাও
আর আমার স্মরণে শিথিল হয়ো না,
তোমরা দু’জনে ফিরাউনের কাছে যাও,
নিঃসন্দেহে সে সীমা ছাড়িয়ে গেছে।
আর তার সাথে নম্রভাবে কথা বল, হয়ত সে স্মরণ করবে
অথবা (আল্লাহকে) ভয় করবে।” [৪]
গল্পের বাকি অংশ সবারই জানা, কিন্তু এখানে মুসার উপাখ্যান টানার কারণ গল্প নয়।
উপরের কথোপকথনটার শেষ দিকটায় আল্লাহ বলছেনঃ ফেরাউনের সাথে নম্রভাবে কথা বল, হয়ত সে স্মরণ করবে। কি স্মরণ করবে? ফেরাউনের কাছে তো মুসার আগে অন্য কোন নবী আসেন নি, কাজেই আল্লাহর বাণীর সাথে তার পরিচয় এই প্রথম। তাই যদি হয়, তাহলে স্মরণ করার কি আছে এখানে?
ব্যাপারটা সংক্ষেপে এরকম। মুসলিমদের বিশ্বাস- মানুষের প্রকৃতিই এরকম যে তার মনস্তত্ত্বে আল্লাহর জন্য একটা জায়গা বেঁধে দেওয়া থাকে। মানুষ পুরোপুরি blank slate হয়ে জন্মায় না, আল্লাহ এবং তাঁর একত্ববাদ সম্পর্কে কিছু প্রাথমিক ধারণা সবার এমনিতেই থাকে, তা নবী-রাসূল আসুন বা না আসুন। এই বিশ্বাসটা কিন্তু মুসলিমদের একার নয়- টমাস অ্যাকোয়াইনাস আর জন ক্যালভিনরাও এরকম কথা বলে গেছেন। মানুষের মনে আল্লাহ-চিন্তা তাই সবসময়ই ছিল, সবসময়ই আছে। তবে পাথরে খোদাই করা চিত্রের গায়ে যেমন ধূলো জমে জমে অস্পষ্ট হয়ে যায়, তেমনি পারিপার্শ্বিকতার ঘষা লেগে মানুষের এই চিরন্তন ধারণাটাও আস্তে আস্তে মলিন হয়ে পড়ে। তা বলে যে তা একেবারে নিভে যায় তা নয়। মনের শত জঞ্জালের ভিড়েও কান পেতে দিলে আত্মার ডাক শোনা যায়। নবী-রাসূলদের দায়িত্ব ছিল এই- মানুষকে তাদের প্রভুর কথা মনে করিয়ে দেওয়া, যে প্রভুর কথা প্রতিটি আত্মায় খোদাই করা আছে। মুসাও ফেরাউনের কাছে তাই খুব নতুন কিছু আনেন নি, তিনি গিয়েছিলেন স্রেফ স্মরণ করিয়ে দিতে।
মানুষের মাঝে আল্লাহ সম্পর্কে “এমনিতেই থাকা” এই প্রাথমিক ধারণার ব্যাপারটা নেহায়েতই বিশ্বাস নয়, দর্শনেও এর একটুকরো স্থান আছে। আমাদের জীবনের বেশ গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিশ্বাস আছে, যার পক্ষে আদৌ কোন যুক্তি নেই। একটা ছোট্ট Thought experiment করে ব্যাপারটাকে বোঝার চেষ্টা করা যাক।
অতীত বলতে আমরা বুঝি পুরোনো কোন ঘটনা। অতীতের অনেক ঘটনাই- হতে পারে তা ছোটবেলার স্মৃতি- আমাদের মস্তিষ্কে স্মৃতি হয়ে জমা আছে। এখন একটু ভাবুন- আপনার শৈশবকালের সেই বাইসাইকেল থেকে আছড়ে পড়ার স্মৃতিটার কথাই ভাবুন- এমন কি হতে পারে না যে ঘটনাটা ঘটেছে মাত্র পাঁচ মিনিট আগে, কিন্তু সবজায়গায় বয়সের ছাপ ফেলে আর আমাদের (আর প্রত্যক্ষদর্শীদের) মাথায় স্মৃতি বসিয়ে এমন একটা কায়দা করা হয়েছে, যাতে মনে হয় ঘটনাটা আসলে পুরোনো? ভেবে দেখুন, ব্যাপারটার বিপক্ষে কিন্তু আদৌ কোন যুক্তি নেই, কারণ যদি আসলেই আমাদের সাথে এরকম একটা জালিয়াতি করা হয়ে থাকে, তবে আমাদের সেটা বোঝার (এবং ভুল প্রমাণ করার) কোন উপায় নেই। তাই বলে কি কেউ আসলেই বিশ্বাস করবে যে অতীত বলে কিছু নেই? অবশ্যই না। অতীত জিনিসটার অস্তিত্বের পক্ষে কোন যুক্তি নেই বটে, কিন্তু তা সত্ত্বেও আমরা বিশ্বাস করি যে অতীত আছে, আর করাই স্বাভাবিক। এরকম memory belief বা স্মৃতিধর্মী বিশ্বাস হচ্ছে একটা উদাহরণ- যা গড়ে ওঠে কোনপ্রকার যুক্তিতর্ক ছাড়াই।
আরেকটা experiment হয়ে যাক। আপনার চারপাশের জগতটা যে আসলেই বাস্তব, সে ব্যাপারে কি কোন যুক্তি আছে? এমনকি হতে পারে না যে আপনি আসলে কোন পরীক্ষাগারের জারে রাখা একটা মস্তিষ্ক, যেখানে হাজারো রকমের ইমপালস দিয়ে আপনাকে বাস্তবতার অনুভূতি দেওয়া হচ্ছে? এখানেও ব্যাপারটা কিন্তু আগের মতই, যদি এরকম বিটকেল পরীক্ষাগার আসলেই থেকে থাকে, তবে সেই মস্তিষ্কের কাছে মনে হবে সে আসলেই বাস্তব জগতে আছে।
যত অসম্ভবই শোনাক, এই সিনারিওগুলোকে বিশ্বাস না করার পক্ষে কিন্তু আমাদের কোন যুক্তি নেই। তারপরেও আমরা অম্লানবদনে বিশ্বাস করে যাচ্ছি যে অতীত সত্যিই আছে, আমাদের চেনা শোনা এই জগত আসলেই আছে। অর্থাৎ কিছু কিছু ব্যাপার আছে যেগুলো আমাদের কাছে এত বাস্তব যে আমরা কোনরকম যুক্তিতর্ক ছাড়াই তাদের সত্যতা মেনে নেই। কোন কোন দার্শনিক এরকম বিশ্বাসের নাম দিয়েছেন properly basic belief. এধরণের বিশ্বাসের ক্ষেত্রে মানুষ যুক্তি ব্যবহার না করে যেটা ব্যবহার করে তার নাম intuition. সাধারণ কথাবার্তায় intuition মানে আন্দাজ জাতীয় কিছু, কিন্তু দর্শনের ভাষায় intuition হচ্ছে তীব্র, তাৎক্ষণিক কোন বিশ্বাস। কোনরকম যুক্তি প্রমাণ না থাকা সত্ত্বেও আপনি জোর দিয়ে দাবি করবেন- হ্যাঁ অতীত আছে, হ্যাঁ আমাদের চারপাশের জগত আছে, না Descartes এর দানো আমাদের ঘাড়ে চেপে বাস্তবতা সম্পর্কে স্রেফ একটা মায়া সৃষ্টি করে নেই। এই বিশ্বাসগুলোর ভিত্তি যুক্তি নয়, intuition. যুক্তির পাশাপাশি তাই intuition ও আমাদের জ্ঞানের উৎস।
কোন কোন দার্শনিকের মতে, আল্লাহ বা ঈশ্বরে বিশ্বাস ব্যাপারটা properly basic belief এর উদাহরণ। যুক্তি দিয়ে হয়ত আল্লাহর অস্তিত্ব প্রমাণ করা যায়, কিন্তু আল্লাহ যে আছেন- সেটা জানার আরেকটা প্রধান উপায় হচ্ছে intuition. যেমন অনেকেই বলবেন, তাদের জীবনে আল্লাহর উপস্থিতি অনেক বেশি তীব্র, এত তীব্র যে সেটাকে অগ্রাহ্য করার উপায় নেই। একজন মুসলিম ব্যাপারটার ব্যাখ্যা দেবেন এভাবেঃ আল্লাহ আমাদের মধ্যে তাঁর সম্পর্কে কিছু প্রাথমিক ধারণা এঁকে দিয়েছেন, যেটার কারণে কোনরকম যুক্তিতর্ক ছাড়াই মানুষ তীব্রভাবে অনুভব করে- আল্লাহ আছেন। অতীত কিংবা বাস্তবতার অস্তিত্বে বিশ্বাস যতটা যৌক্তিক, আল্লাহর প্রতি এধরণের intuitive বিশ্বাসও ঠিক ততটাই যৌক্তিক।
৩.
অ্যারিস্টটলের মানুষগুলো মাটির নিচ থেকে বেরিয়ে যখন প্রথমবারের মত পৃথিবী দেখল, তখন তাদের প্রতিক্রিয়া হতে পারত ছিল দু’ধরণেরঃ
১. এই প্রকৃতির কিছু বৈশিষ্ট্য পর্যবেক্ষণ করে আমরা যে যুক্তিনির্ভর সিদ্ধান্তে উপনীত হচ্ছি তা হল- এর পেছনে একজন কারিগর আছেন (অথবা নেই);
২. এই প্রকৃতির প্রতি দৃষ্টি মেলে দেওয়ার সাথে সাথে এক তাৎক্ষণিক, তীব্র অনুভূতি হয় যে- এর পেছনে কোন কারিগর না থেকে পারে না।
প্রথমটা প্রজ্ঞানির্ভর বা rational প্রতিক্রিয়া, আর দ্বিতীয়টা intuitive প্রতিক্রিয়া। দু’টোই খাঁটি জ্ঞান। কুর’আনে যুক্তির প্রতি নজর আছে ঠিকই, কিন্তু এর ফোকাস হচ্ছে মানুষের intuition এর উপর। ক’টা মানুষেরই আর অত সামর্থ আছে দর্শন পড়ে প্রকৃতি দেখা? তার চেয়ে সহজ, সার্বজনীন উপায় হচ্ছে প্রকৃতিকে intuition এর চোখ দিয়ে দেখা। কুর’আন তাই অবিশ্বাসীদের ডেকে বলল- উটে তো চড়ে বেড়াও ঠিকই, ভেবে কি দেখেছ এর সৃষ্টি হল কীভাবে? আর আকাশ- ঐ সুউচ্চ আকাশ কিভাবে এল? পাহাড়-পর্বত-নদী-নালা যেদিকেই দেখ, ফলমূলের বাহার দেখ, দিন-রাত আর বাতাস-মেঘের নিয়ন্ত্রণ দেখ; মনে কি হয় না এর পেছনে কোন সৃষ্টিকর্তার কারিগরি আছে? কুর’আনের বিশ্বাস, এর শ্রোতাদের অন্তরে আল্লাহ কিছু ব্যাপার গেঁথে দিয়েছেন, যার কারণে এরা প্রকৃতি দেখেই সৃষ্টিকর্তাকে চিনে নেয়।
প্রকৃতির প্রতি মানুষের এরকম intuitive আকর্ষণ একটা চিরসবুজ ব্যাপার। বিজ্ঞান যতই এগিয়েছে, প্রকৃতির আবেদন বেড়েছে বই কমেনি। ব্যাকটেরিয়া আগে দেখাই যেত না, এখন বিজ্ঞানীরা জেনেছেন কোন কোন ব্যাকটেরিয়ার ফ্ল্যাজেলাম বলে একটা লেজ-মার্কা ব্যাপার থাকে, যেটা হেলিকপ্টারের প্রোপেলারের মত বনবন করে ঘুরিয়ে ব্যাকটেরিয়া ঘোরাঘুরি করে। এখন ফ্ল্যাজেলাম জিনিসটার গঠন, এনার্জি ব্যবহার, ঘোরার কায়দা ইত্যাদি এত হাজারো রকম কারদানি আছে যে প্রযুক্তির দিক দিয়ে স্পীডবোটের মোটর নাকি তার তুলনায় কিছুই না। মানুষের দেহে রক্ত জমাট বাঁধা থেকে শুরু করে আয়ন লেভেল নিয়ন্ত্রণ পর্যন্ত প্রত্যেকটা ব্যাপার এত সাঙ্ঘাতিক সূক্ষ্মভাবে সাজানো যে সৃষ্টিকর্তাকে শুধু বিশ্বাস করতেই নয়, বরং ভালবাসতে মন চায়। এগুলো থেকে আল্লাহর অস্তিত্বের পক্ষে হয়ত যুক্তি দাঁড় করানো অসম্ভব নয়, কিন্তু আমরা যদি এগুলোর ব্যাপারে আমাদের তীব্র, তাৎক্ষণিক ইমপ্রেশানটাকে বিশ্বাস করি, তবে প্রকৃতির আবেদন আমাদের কাছে আরও সহস্রগুণ বেড়ে যাবে। কুর’আনের দর্শন এটাই। আর তাই কুর’আনে আঁকা প্রকৃতি বেদুইনকে যেমন নাড়া দিয়েছিল, আজকের যুক্তিবাদীকেও সেভাবে নাড়া দিয়ে যাওয়ার সামর্থ রাখে।
ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হল, প্রকৃতিবাদী দার্শনিক আর বিজ্ঞানীরা কিন্তু বারবার প্রকৃতির intuitive আবেদনের কথাই বলেছেন। অ্যারিস্টটলের মানুষগুলো মাটির ওপর উঠে কোন যুক্তি খাটানোর আগেই তৎক্ষণাৎ বুঝেছিল- সৃষ্টিকর্তা আছেন। আর্গাইলের ডিউক একবার ডারউইনকে বলেছিলেন, প্রকৃতির অদ্ভুত সুন্দর কারিগরি পর্যবেক্ষণ করার পর এটা ভাবা অসম্ভব যে এখানে কোন স্রষ্টার হাত নেই। ডারউইন ডিউকের দিকে তাকিয়ে বললেনঃ “Well, (the idea of design) often comes over me with overwhelming force; but at other times…it seems to go away.” [৫] “Overwhelming force” সাধারণত আসে intuition থেকে, যুক্তি থেকে নয়। ডিএনএর মাথা-নষ্ট-করা সৌন্দর্য দেখেই হয়ত ক্রিক মন্তব্য করেছিলেন- “biologists must constantly keep in mind that what they see were not designed, but rather evolved.” [৬] প্রকৃতির intuitive আবেদন এতটাই তীব্র, এতটাই সার্বজনীন।
গ্রীসের শান্ত লাইসিয়ামে লোভের তেমন জায়গা ছিল না। আজকের মানুষের কাহিনী অন্য, তার লোভের ছোটার জন্য সে পিচের রাস্তা আর রেলপথ গড়ে দিয়েছে। চিন্তার ঘোড়া সেই রেলের ধোঁয়ায় শুধু অন্ধকার দেখে, প্রকৃতির দিকে ফিরে তাকানোর সময় কই আমাদের? তবে একটু নিশ্চিন্তির সামান্য অবসরে ভাবনার ডানাগুলো মেলে দেখুন- হয়ত intuition আপনাকে নতুন, আশ্চর্য কিছু শেখাবে।
ফুটনোটঃ
[১] অ্যারিস্টটল, On Philosophy
[২] পেইলি, Natural Theology
[৩] কুর’আন, সূরা বাক্বারাহ, ২:১৬৪
[৪] কুর’আন, সূরা ত্ব-হা, ১১-১৩, ৪২-৪৪
[৫] http:/plato.stanford.edu/entries/teleological-arguments/notes.html
[৬] ফ্র্যান্সিস ক্রিক, What Mad Pursuit
ahobaan.com