সাম্প্রতিক প্রসঙ্গ

এই শীতে…

Sharif Abu Hayat Opu

১১ই মুহাররম, ১৪৩৪ হিজরি, ঢাকা।

বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম

বাবা হিসেবে আমার অভিজ্ঞতা বেশী দিনের নয়। বিদেশ থেকে ফিরে দেখলাম ছেলের বয়স আড়াই বছর হয়েছে। ইতমধ্যে সে শুধু কথা বলতেই শেখেনি, আবদার করতেও শিখেছে। যে আমি পারতপক্ষে মিষ্টির ধারে ঘেঁষিনা সে আমিও ‘মিষ্টি খাব, মিষ্টি খাব’ – ধ্বনির ক্রমাগত অত্যাচারে হাটা দেই দোকানপানে। বাবা হওয়ার পর থেকে রাস্তাঘাটে ছোট বাচ্চা দেখলে আমার সন্তান দু’টোর কথা মনে পড়ে যায়। আমি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে মিল খুঁজতে থাকি। কাউকে দেখি একটা চৌকোণো কাগজের টুকরো চাটতে পেরে খুশিতে গদগদ। কাউকে দেখি মায়ের শাড়ির আঁচল ধরে কাঁদছে। হয়ত ছেলেটা একটা ভাপা পিঠা খেতে চেয়েছিল। মাসের শেষ। মা বাড়ী ফিরছে চার বাসায় কাজ করে। হয়ত বাসায় চাল বাড়ন্ত। হয়ত গৃহকর্ত্রী মুখ ঝামটা দিয়েছেন। হয়ত অসুস্থ স্বামীর ওষুধ কেনা হয়নি। হয়ত এমন অনেক হয়ত-এর পাল্লায় পড়ে ভাপা পিঠের বদলে ছেলেটা একটা চড় খেয়েছে। তখন আমার চোখের সামনে আমার ছেলেটার ছবি ভাসে। সে সোফায় পা মেলে বসে পোড়াবাড়ির চমচম খাচ্ছে। যে আল্লাহকে চেনেনি, যে জানেনা তিনি আর-রহমান, যে বোঝেনি আল্লাহ যে কোন মানব সন্তানদের প্রতি তার বাবামা’র চেয়ে অনেক অনেক বেশী গুণে দয়াপরবশ; সে সমাজের সম্পদের বৈষম্য দেখে অবিশ্বাসী হয়ে উঠতে পারে। কিন্তু যে বোঝে আল্লাহ আল আদ্‌ল, তিনি কাজের বুয়ার বাচ্চাটার প্রতি সামান্যতম অবিচারও করেননি সে চিন্তা করতে বসে কেন কারো কারো জন্য দয়াময় আল্লাহ ক্ষুধাময় চোখের জল লিখে রেখেছেন।
 
পদার্থবিজ্ঞানের একদম গোড়ার পড়া – বিভব। বিদ্যুৎ কখন প্রবাহিত হবে? যখন বিভব পার্থক্য থাকবে। পজিটিভ আর নেগেটিভ চার্জের মাঝে যতক্ষণ বিভব পার্থক্য না থাকলে তড়িতের যাবার কোন দিক নেই। বাংলা ভাষায় বিভবের আরেক মানে বিত্ত, সম্পদ। ধনী আর গরিবের ভিতরে থাকে বিভব পার্থক্য। যে আল্লাহ ভৌতবিজ্ঞানের নিয়মগুলো নির্ধারণ করেছেন তিনি অর্থনীতির সূত্রও ঠিক করেছেন। ধনী-গরীবে ব্যবধান এ দুনিয়াতে থাকবেই। থাকবে বলেই পরীক্ষা করে দেখা যাবে যে ধনীর ঐশ্বর্য বেশী, সে কী বিভব পার্থক্য কমাতে তা ব্যয় করে নাকি সিন্দুকে লুকিয়ে রাখে। আল্লাহ তাকে সম্পদ দিয়েছেন, ইচ্ছেশক্তিও দিয়েছেন। বিভব পার্থক্য আছে বলেই ইচ্ছেশক্তিটার পরীক্ষা আছে। যার ইচ্ছেশক্তি নেই সেই ইলেকট্রিক চার্জ বিভব পার্থক্য নিঃশেষ না হওয়া অবধি ইলেকট্রন বিলিয়েই যাবে। তড়িৎ প্রবাহ আল্লাহর নিয়ম মানে, মানুষের সম্পদের প্রবাহ মানেনা।
 
আমার পরিবারের জন্য আমি খরচ করি – স্ত্রী-সন্তান, বাবা-মার জন্য। নিজের জন্যও করি। সারাদিনের ধকল শেষে বাসায় ফেরার সময় মাঝেমধ্যে রিকশায় চাপি। দশটাকায় আরাম কিনে নেই। ভাবতে থাকি –আমার মাও কর্মজীবি মহিলা ছিলেন। তিনি তেজঁগা থেকে হেটে বাড়ী এসেছিলেন ছোট্ট আমাকে নিয়ে। তার রিকশা তো দূরের কথা সেদিন বাসভাড়াটাও সাথে ছিলনা। আজ আল্লাহ আমাকে কত দিয়েছেন। কত্ত দিয়েছেন যে আমার ছেলেকে আমি দোকান থেকে মিষ্টি কিনে খাওয়াই। আমার ঘর বড় হয়েছে। ফ্রিজ খুললে খাওয়ার কিছু না কিছু পাওয়া যায়। আমি দুপুরে নান-সব্জি খেয়ে নির্দ্বিধায় চল্লিশ টাকা খরচ করে ফেলি। যে রিকশাওয়ালাটা আমাকে বয়ে নিয়ে যায় সে হয়ত দুপুরে কিছু খায়নি, একেবারে সন্ধ্যায় গিয়ে ভাত খাবে বলে। পেটে ক্ষুধা তারও আছে, অভাব আছে, কিন্তু বিভব নেই। এককালে আমার পরিবারে বিভব ছিলনা, এখন আছে। ধীরে ধীরে চারপাশের মানুষ আর আমার মধ্যে বিভব পার্থক্য বেড়েছে। সেটা মেটাতে আমি কী করি তা আল্লাহ পরখ করে দেখছেন। হঠাৎ আল্লাহ আমাকে নিঃস্ব করেও দিতে পারেন। কিন্তু যতদিন কিছু উদ্বৃত্ত সম্পদ দিয়ে রেখেছেন ততদিন খুব কঠিন একটা পরীক্ষার মাঝে আছি। পরীক্ষাটা কঠিন এ কারণে যে সম্পদকে মানুষ পরীক্ষা মনে করেনা, আল্লাহর কাছে তার ন্যায্য পাওনা মনে করে।
 
ইসলাম যতগুলো অদেখাতে বিশ্বাস করতে বলে তার মধ্যে পরকালের বিশ্বাস অন্যতম। পরকালে বিশ্বাস মানে এ পৃথিবীতে আল্লাহ আমাকে যা দিয়েছেন তার সবগুলোর কি ব্যবহার আমি করলাম সে জবাব আল্লাহর কাছে আমাকে দেয়া লাগবে। যারা মুসলিম নয়, যাদের কাছে আখিরাতের দায়বদ্ধতা কেবলই কথার কথা তাদের এ দুনিয়াতে কোন সমস্যা নেই। নারী আন্দোলনের নেত্রীরা নারী অধিকার নিয়ে কথা বলে বাসার কাজের মানুষটাকে নির্দয় পেটাই করতে পারে। শ্রমিক নেতারা খাটুনী ছেড়ে পুঁজিবাদীদের কাছে শ্রমিকদের বিশ্বাস বিক্রি করতে পারে। কালো বেড়ালরা বস্তা বস্তা টাকা হাপিস করতে পারে। মার্কামারা গ্রুপ অফ ইন্ড্রাস্ট্রির মালিকেরা সাধারণ মানুষের গচ্ছিত টাকায় মোচ্ছব করতে পারে। কিন্তু আমি মুসলিম। অন্যের সম্পদ স্পর্শ তো দূরের কথা, নিজের হালাল টাকা কিভাবে খরচ করলাম – এই হিসেব আল্লাহর কাছে দিতে হবে এই চিন্তায় আমাকে গলদঘর্ম হতে হয়। আমার প্রতিবেশী না খেয়ে থাকলে আমার ঈমান নিয়ে টানাটানি পড়ে যায়। সমাজের অনাচার ঠেকানো আমার জন্য ঐচ্ছিক বিষয় নয়, আবশ্যক। অন্যায় দেখে যদি চুপ থাকি তাহলেও আমার ঈমান ফিকে হয়ে আসে।
 
আমি মুসলিম বলেই যখন সুরা মা’আরিজে পড়ি – “তাদের প্রত্যেকেই কি আশা করে তাকে নিয়ামতপূর্ণ জান্নাতে প্রবেশ করানো হবে?” – তখন আমার বুকটা কেমন কেঁপে যায়। আসলেই তো – আমাদের কর্মে তো আকাঙ্খার প্রতিফলন ঘটে না। অনন্তকাল সুখে থাকব এই আশা করে চলেছি কিন্তু আল্লাহ যে মুসল্লিনদের কথা বর্ণনা করেছেন তাদের মধ্যে আমি পড়ি কি? আমার সম্পদ থেকে ‘সাঈল’ অর্থাৎ ভিক্ষুক আর ‘মাহরুম’ অর্থাৎ বঞ্চিতদের হক আমি তাদের ঠিক মত বিতরণ করছি তো? হঠাৎ হিসেব করতে বসলাম মাসে কত আয় করি আর কত আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় করি। নিজের আর পরিবারের পেটে যা যায় তার সাথে আল্লাহর রাস্তার বরাদ্দটার একটা অনুপাত বের করলাম। খুব লজ্জায় পড়ে গেলাম, খুব। যে শৌখিন জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত হয়ে গেছি সেটা ধরে রাখতে গিয়ে আল্লাহর রাস্তায় খরচ করার অংশটা সম্মানজনক থাকেনা। খাতওয়ারী হিসেবে করলে ‘ফি সাবিলিল্লাহ’র  অঙ্কটাতে এখনই লজ্জা লাগছে। হাশরের মাঠে যখন ফিরে আসার পথ থাকবেনা তখন আল্লাহর সামনে মুখ তুলব কেমন করে?
 
আল্লাহ কুরআনে বলছেন তোমরা আল্লাহর রাস্তায় খরচ কর। ‘খরচ’ কথাটা কেন বললেন? খয়রাত কেন নয়? ভিক্ষা কেন নয়? আল্লাহর রাস্তায় খরচ মানে কী? দুশ টাকা খরচ করলে এক কেজি মিষ্টি মেলে, দশ টাকা খরচ করলে পায়ের আরাম। আল্লাহর রাস্তায় ব্যয়ের ফল কী? যারা পরকালে অবিশ্বাসী তারা বলবে -লবডঙ্কা। আমরা বলি – না, আল্লাহর রাস্তায় খরচ করলে আল্লাহর সন্তুষ্টি পাওয়া যায়। সেটার জন্যই এই পৃথিবীতে আসা। একমাত্র আল্লাহর ইবাদাত করতে। তাকে সন্তুষ্ট করতে। তিনি যা দিয়েছেন সেখান থেকে তার জন্যে খরচ করতে হবে। তার আর যেসব বান্দাদের দেননি তাদের জন্য ব্যয় করতে হবে। দান আল্লাহ মানুষকে করে, মানুষ মানুষকে করতে পারেনা। মানুষ বড়জোর এক সম্পদবঞ্চিত ভাইয়ের সাথে আল্লাহর দানটা ভাগাভাগি করে নিতে পারে। বিভব পার্থক্য কমানোর চেষ্টা মানুষকে করতে হবে। সমাজতন্ত্রীদের মত গায়ের জোরে নয়। আল্লাহকে ভালোবেসে, তার সৃষ্টিকে ভালোবেসে। আমরা আল্লাহর সৃষ্টির প্রতি সদয় হব, তিনিও যেন আমাদের প্রতি সদয় হন – এই আশায়।
 
আমাদের উচিত আয়ের একটা সম্মানজনক অংশ আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় করা। তাতে আরাম যদি একটু কমে কমুক। পৃথিবীতে তো আসলে আরাম করার কথা ছিলনা। যাদের লক্ষ্য দুনিয়াতেই জান্নাত তাদের জন্য আখিরাতে জাহান্নাম ঘাপটি মেরে বসে আছে। দুনিয়াতে সুখের জোয়ারে ভাসার কথা মুসলিমের নয়। অন্তত বিভব পার্থক্য যখন আকাশ ছুঁইছে তখন তো নয়ই। যারা আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার জন্য বিলাসিতা ছেড়ে দেবে তাদের আল্লাহ পরকালে বলবেন – “খাও এবং পান করো তৃপ্তি সহকারে, এটা তোমাদের কর্মের প্রতিদানস্বরূপ।” আর যারা দুনিয়া নিয়ে মশগুল তাদের আল্লাহ কিছুটা বিদ্রুপই করছেন – “খাও এবং আনন্দফুর্তি কর অল্প কিছুদিনের জন্য; নিশ্চয়ই তোমরা অপরাধী।” সূরা মুরসালাতের এই দু’টি চিত্রকল্প আমাদের ধাক্কা দেয়, আমাদের অপরিণামদর্শীতাকে উপহাস করে।
 
খাদ্যের পরে যে মৌলিক চাহিদা মানুষকে তটস্থ রাখে তা হল পোশাক। এই আভরণ দেহে জড়িয়ে মানুষ উলঙ্গ পশুদল থেকে আলাদা হয়, শীত-গ্রীষ্মের প্রখরতা থেকে আত্মরক্ষা করে। ঢাকার জনসংখ্যা আর যন্ত্রসংখ্যার তোড়ে শৈত্যপ্রবাহ টের পাওয়া যায়না। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে অবশ্য ‘আরবান হিট আইল্যান্ড’ নেই। সেখানে একটি রাত থাকলে শীতের কামড় কাকে বলে বোঝা যায়। আমেরিকায় যখন বরফের মধ্যে দিয়ে পথ চলতাম তখন অপেক্ষা করতাম কখন ইউনিভার্সিটির সেন্ট্রাল হিটেড বিল্ডিংটাতে ঢুকতে পারব। বান্দরবানের পাহাড়ে কোন হিটিং সিস্টেম নেই। লালমনিরহাটের ভাঙ্গা বেড়ার বাড়ীগুলোতে হিট ইনসুলেটর নেই। তিস্তার নদীভাঙ্গা এলাকার মানুষেরা চরে ঝুপড়ি বানিয়ে থাকে। উত্তুরে হাওয়া যখন বয় তখন নর্থফেস কিংবা কলম্বিয়া জ্যাকেটের উষ্ণতা তাদের কাছে জান্নাতের স্বপ্নের মতই। কচুঘেচু খেয়ে হয়ত দিন চলে যায়, কিন্তু হিমময় লম্বা রাতটা যেন আর কাটেনা।
 
শীত এসে পড়েছে দেশের বিভিন্ন স্থানে। ফোনে অনুরোধ আসছে – কিছু যেন করি। গতবার লাইনে দাঁড়ানো দু’হাজার মানুষের মাঝে দেয়ার মত অবশিষ্ট ছিল মাত্র দুশ কম্বল। কিছু দিতে না পারার লজ্জায় গা থেকে গরম কাপড় খুলে দিয়েছিলেন আমাদের ভাইয়েরা। লজ্জাটা যারা বিতরণ করতে গিয়েছিল তাদের একলার না, আমাদেরও। এই লজ্জা ঘরের ভারী পর্দা ঠেলে ঢুকতে পারেনা। এই লজ্জা পেতে হলে শহর ছেড়ে অন্তত একটাবার গ্রামে যেতে হবে। মানুষ যে কষ্টে আছে এটা নিজে শীতে না কাঁপলে বোঝা যায়না। লজ্জা না পেলে আল্লাহর রাস্তায় যে ব্যয় করতে হবে এ বোধটাও জন্মেনা। যাদের পক্ষে নিজেদের যাওয়া নেহায়তই অসম্ভব তারা যোগাযোগ করতে পারেন আমার সাথে – [email protected].
 
যে আল্লাহ আমাদের সম্পদ দিয়েছেন তার জন্য খরচ করা ন্যুনতম সৌজন্যবোধের মধ্যে পড়ে। আল্লাহর কাছে দু’আ করি তিনি যেন আমাদের মুসলিম ভাইদের মধ্যে এ লজ্জাটা তৈরী করে দেন। তিনি যেন মানুষের কষ্ট বোঝার, তাদের জন্য কিছু করার তৌফিক দেন। আমিন।
 

মন্তব্য করুন

Back to top button