আলোচনা-সমালোচনা

ডা. জাকির নায়েকের সমালোচনা ও বাস্তবতা

হৃদয় ক্ষরিত রক্তাক্ত ভাষা থেকে…

এতোদিন ড. জাকির নায়েক শুধু আলোচনার বিষয় থাকলেও বর্তমানে তিনি আলোচনার পাশাপাশি অনেকের সমালোচনার পাত্রও বটে। ভারতের আল্লামা সাইয়্যিদ খালিক সাজিদ বোখারী কর্তৃক ড. জাকির নায়েকের বিপক্ষে ‘হাকীকতে ড. জাকির নায়েক’ নামক একটি বই লেখার পর আমাদের দেশের কয়েকজন শীর্ষ আলেম এবং কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ইসলামী পত্রিকা ড. জাকির নায়েকের কঠোর সমালোচনা করে বই ও প্রতিবেদন প্রকাশ করেছেন। তাই বর্তমানে আমাদের ইসলামী অঙ্গনে আলোচনার ঝড় তোলা এ বিষয়টি খুবই স্পর্শকাতর একটি বিষয়। মূল বিষয়ে আলোচনায় যাওয়ার পূর্বে মুসলিম উম্মাহ্র বর্তমান সময়ে এ বিষয়টিতে গুরুত্বারোপের প্রয়োজনীয়তা কতটুকু বা আদৌ এর দরকার ছিলো কি না, সে বিষয়ে কয়েকটি কথা বলে নেয়া অপরিহার্য মনে হচ্ছে।

রাসূলুল্লাহ সা. তার এক হাদীসের মাঝে ইরশাদ করেছিলেন,

عَنْ ثَوْبَانَ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ -صلى الله عليه وسلم- يُوشِكُ أَنْ تَدَاعَى عَلَيْكُمُ الأُمَمُ مِنْ كُلِّ أُفُقٍ كَمَا تَدَاعَى الأَكَلَةُ إِلَى قَصْعَتِهَا . قِيلَ يَا رَسُولَ الله : فَمِنْ قِلَّةٍ يَوْمَئِذٍ ؟ قَالَ لاَ ، وَلكِنَّكُمْ غُثَاءٌ كَغُثَاءِ السَّيْلِ يُجْعَلُ الْوَهْنُ في قُلُوبِكُمْ وَيُنْزَعُ الرُّعْبُ مِنْ قُلُوبِ عَدُوِّكُمْ لِحُبِّكُمُ الدُّنْيَا وَكَرَاهِيَتِكُمُ المَوْتَ.

অর্থ: হযরত সাওবান রা. থেকে বর্ণিত, মহানবী সা. বলেছেন, “এমন একটি সময় আসবে যখন (অমুসলিম) জাতিসংঘ একে অপরকে প্রতিটি অঞ্চল থেকে তোমাদের উপর আক্রমণ করার জন্য আহ্বান করতে থাকবে, যেভাবে একই পাত্রে রাতের খাবার খাওয়ার জন্য একে অপরকে আহ্বান করা হয়ে থাকে। একজন জিজ্ঞাসা করলেন যে, ‘এটা কি এই কারণে হবে যে আমরা তখন সংখ্যায় কম হবো?’ তিনি বললেন- ‘না, (তোমরা সংখ্যায় তখন অনেক থাকবে কিন্তু) তোমরা হবে বন্যার পানির উপর ভেসে যাওয়া ময়লার মতো। আল্লাহ তোমাদের অন্তরের মধ্যে ‘ওয়াহন’ ঢুকিয়ে দেবেন এবং তোমাদের শত্র“দের অন্তর থেকে তোমাদের প্রভাব ও ভয়কে উঠিয়ে নিবেন।’ জিজ্ঞাসা করা হল, ‘হে আল্লাহর রাসূল! ‘ওয়াহন’ কি?’ তিনি বললেন, ‘দুনিয়ার প্রতি ভালোবাসা আর (আল্লাহর পথে) মৃত্যুকে ঘৃণা করা।” (আবু দাউদ হাঃ- ৪২৯৭, আহমদ- হাঃ-২২৪৫ উত্তম সনদে ‘কিত্বালের প্রতি ঘৃণা’- এই শব্দ সহকারে, বায়হাকী হাঃ -১০৩৭২)

প্রিয়নবী সা. এর উপরোক্ত হাদীসের প্রত্যক্ষ সাক্ষী হয়ে আজ মুসলিম উম্মাহ্ বিশ্বজুড়ে কি ভীষণ দূরাবস্থার মধ্য দিয়ে বর্তমান সময় অতিক্রম করছে তা সচেতন পাঠক আর বিদগ্ধ জ্ঞানী মহল ভালো করেই জানেন এবং উপলব্ধি করছেন। বিশ্বের প্রায় প্রতিটি প্রান্তে প্রতিদিন মুসলিমরা জুলুম আর নির্যাতনের ষ্টিমরোলারে পিষ্ট হচ্ছে। ইরাক, আফগান, ফিলিস্তিন, বসনিয়া, চেচনিয়া, সোমালিয়া, আরাকান, কাশ্মীর, লেবানন, পাকিস্তানসহ মুসলি ভূখন্ড গুলোতে আজ মুসলিমদের লাশের স্তুপ পরে আছে।

আবূ গারীব আর গুয়ান্তানামোর বন্দি শিবির গুলো লাখো লাখো ফাতেমা আর আব্দুল্লাহদের আর্তনাদে প্রতি মুহূর্ত ভারী হয়ে উঠছে, কিন্তু তাদেরকে এই দূরাবস্থা থেকে মুক্ত করার জন্য বিশ্বের কোন প্রান্ত থেকেই আজ আর কেউ এগিয়ে আসছে না। একেকটি ভূখন্ডে আগ্রাসন শুরু হওয়ার সময় মুসলিমদের সারি সারি লাশ, ছিন্ন-ভিন্ন দেহ আর রক্তস্রোত দেখে তাৎক্ষণিকভাবে আমরা মৌন কিছু প্রতিবাদ জানাই, কিন্তু দু’দিন পর মিডিয়ায় আর তাদের খবর আসা বন্ধ হয়ে গেলে আমরাও নিরব হয়ে যাই। ইস্যু শেষ মনে করে আমরা আবার ঘুমিয়ে পরি গাফলতীর গভীর ঘুমে। কিন্তু সাম্রাজ্যবাদী কুফুরী শক্তির আগ্রাসন মিডিয়ার আড়ালে চলতে থাকে নিজ অব্যাহত গতিতে। খানিক ব্যবধানে তা বিস্তৃত হয় আরেক ভূখন্ডে। আবার প্রথম কয়েকদিন মুসলিম বিশ্বে খানিকটা বিক্ষোভ এরপর নিরব।

এভাবে চলছে গত অর্ধ শতাব্দীরও অধিক সময় ধরে। মুসলিম উম্মাহ আজ বিশ্বজুড়ে নির্যাতিত, নিপীড়িত এবং নিষ্পেষিত কিন্তু কেন? তাদের কি সম্পদের অভাব? না, বরং গ্যাস সম্পদের ক্ষেত্রে বর্তমান বিশ্বের ৪৫% এককভাবে তাদের হাতে, তেলের ক্ষেত্রে পৃথিবীর ৭৫% তেল মুসলিম ভূমি থেকে উত্তোলন হয়, দেশ হিসেবে মুসলমানদের ৫৭ টি ভুখন্ড আছে, জনসংখ্যার দিক থেকে দেড়শত কোটিরও বেশি। মুসলিম ভূখন্ডগুলো খনিজ সম্পদের উপর ভাসমান। মুসলিমদের রয়েছে ৬৭ লক্ষেরও অধিক প্রশিক্ষিত এবং নিয়মিত মুসলিম সেনাবাহিনী।

এতো এতো কিছু আছে মুসলিমদের কিন্তু নেই শুধু একটি ইসলামিক রাষ্ট্র। নেই একজন মুসলিম খলীফা বা আমিরুল মু’মিনীন। যার ফলে আদর্শিক রাষ্ট্রব্যবস্থা ও অভিভাবকহীন মুসলিম উম্মাহ আজ বিশ্বজুড়ে পরিগণিত হচ্ছে ‘গণীমতের’ মাল হিসেবে। মুসলিমদের তেল, গ্যাস, খনিজ সম্পদ কাফিররা লুটে নিচ্ছে। মুসলিমরা আজ দুনিয়ার প্রতি অধিক ভালোবাসার কারণে ভুলে গেছে জিহাদকে। তাই এই উম্মাহর শ্রেষ্ঠ সন্তান, নবীন-যুবকেরা আজ আর ভাবে না তার অপর মুসলিম ভাইয়ের কথা, নির্যাতিত বোনকে কাফিরদের হাত থেকে মুক্ত করার কথা চিন্তাও করে না।

যে জাতির কান্ডারীরা একজন উসমান হত্যার বদলা নেয়ার জন্য ১৪০০ লোক প্রিয় রাসূলের হাতে হাত রেখে বাইআত নিয়েছিলো, আমরণ জিহাদের দৃপ্ত শপথ করেছিলো, প্রয়োজনে মৃত্যু বরণ করে নিতে চেয়েছিলো; আজ কি হলো সেই জাতির?

যে জাতির একজন সদস্য বোন ফাতেমার আর্তনাদে সাড়া দেয়ার জন্য সূদুর আরব থেকে সিন্ধুনদের অববাহিকায় ছুটে এসেছিলেন মুহাম্মাদ ইবনে কাসিম, সে জাতির হাজারো বোন, হাজারো ফাতেমা আর আফিয়া সিদ্দিকী আজ কাফিরদের কারাগারে নিজেদের সম্ভ্রম হারাচ্ছে, প্রতিদিন অসংখ্য বার নির্যাতিত হচ্ছে; জেল থেকে রক্তমাখা পত্র পাঠাচ্ছে উম্মাহর নবীনদের কাছে, মুহাম্মাদ বিন কাসিম আর সালাহউদ্দীন আইয়ূবীর উত্তরসূরীদের কাছে, কিন্তু তাদের ডাকে সাড়া দেয়ার কথা কেউ চিন্তাও করছে না। একজন উসমানের শাহাদাত বরণের সংবাদে যে জাতির ১৪০০ শত সাহাবীর খাওয়া-ঘুম হারাম হয়ে গিয়েছিলো, সেই জাতির লক্ষ লক্ষ উসমান আজ নির্মমভাবে নিহত হচ্ছে; মুসলিম শিশুদের সারি সারি রক্তাক্ত লাশের মিছিল যাচ্ছে, কিন্তু আমাদের গভীর নিদ্রার কোন ব্যাঘাত ঘটছে না।

আজ মুসলিমদের ৫৭ টি ভুখন্ড আছে, কিন্তু একটি ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থা নেই। অনেক শাসক আছে, কিন্তু একজন খলীফা বা ইমাম নেই। ৬৭ লক্ষ প্রশিক্ষিত এবং নিয়মিত মুসলিম সেনাবাহিনী আছে, কিন্তু মুসলিমদের নিরাপত্তা নেই। কারণ মুসলিম সেনাবাহিনীকে জালিম কাফিরদের বিরুদ্ধে মার্চ করার নির্দেশ দেয়ার কেউ নেই। তাইতো রাসূল সা. বলেছিলেন,

عَنْ اَبِيْ هُرَيْرَ اَنْهُ سَمَعَ رَسُوْلَ اللهِ صَلَّى اللهُ يَقُوْلُ …. وَاِنَّمَا الاِمَامُ جُنَّةٌ يَقا تَلُ مِنْ وراءه وَيُتقى بِهِ – بخارى ج١ كتاب الجهاد باب يقاتل من وراءالامام

অর্থ: “হযরত আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছেন, আর ইমাম (খলীফা) হলো ঢাল। তার অধিনে যুদ্ধ পরিচালিত হবে এবং তার মাধ্যমেই আত্মরক্ষা হবে।” (বুখারী – কিতাবুল জিহাদ, ইমামের নেতৃত্বে জিহাদ অধ্যায়], হাঃ ২৭৫৭, মুসলিম হাদীসঃ ১৮৩৫, নাসাই হাদীসঃ ৪১৯৩)

আজ পীর-মুরিদীর বাইআত আছে, কিন্তু খিলাফতের বাইআত নেই। অনেক ধরণের সংগ্রাম আছে, কিন্তু জিহাদ নেই। উপরন্তু মুসলিমদেরকে নিরাপত্তাদানকারী আদর্শিক রাষ্ট্রব্যবস্থা এবং ইমাম হিসেবে মুসলিমদের অভিভাবকের দায়িত্ব গ্রহণকারী খলীফা না থাকার কারণে মুসলমানদের এই সকল সম্পদ আর সম্ভাবনা ‘হরিনের দেহের মূল্যবান মাংসের’ মতোই হায়েনাদের কাছে মুখরোচক ‘গণীমতের মাল’ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। মুসলিম উম্মাহর এতো সম্পদ, এতো সেনাবাহিনী সঞ্চালক বিহীন থাকার ফলে জমাট বাধা রক্তে পরিণত হয়েছে। যা দেহে প্রাণ সঞ্চালন করতো, তাই আজ মৃত্যুর ক্রিয়া করছে। মুসলমানদের সেনাবাহিনী আজ মুসলমানদের বিরুদ্ধেই কাফিরদের ইচ্ছে মতো ব্যবহৃত হচ্ছে। ইরাক, আফগান, পাকিস্তান যার জ্বলন্ত উদাহরণ।

মুসলিম উম্মাহর যুব-তরুণদেরকে বিজাতীয় অপসংস্কৃতির বাঁধ ভাঙ্গা জোয়ার ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। তাদেরকে নিজ বিশ্বাসের উপর থেকে সরিয়ে দিচ্ছে। তাদের সামনে জীবনের চাওয়া পাওয়া আর স্বপ্ন হিসেবে বিপথগামিতাকে মেলে ধরছে। রেডিও, টিভি, ইন্টারনেট এমনকি মোবাইলের মতো দৈনন্দিন জীবনের অপরিহার্য্য প্রযুক্তিও আজ ব্যবহৃত হচ্ছে মুসলমানদের চরিত্র ধ্বংসের জন্য। এর মাধ্যমে প্রতিনিয়ত মুসলিমদের মাঝে ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে ভোগবাদী ও পুঁজিবাদী জীবন-দর্শন।

রাসূলুল্লাহ সা. এর উত্তরসূরী এবং মুসলিম জাতির রাহবার ও অভিভাবক আলেম সমাজ ও জাতির যুব-তরুণদের মধ্যে যোগাযোগ ও সম্পৃক্ততা প্রায় শূন্যের কোটায়। অভিভাবক আর তার সন্তান একে অপরকে চিনে না। ফলে দৈনন্দিন কাজের ক্ষেত্রে তারা আলেমদের দিক-নির্দেশনা নিতে পারছে না এবং আলেম সমাজও মিডিয়া ও অন্যান্য মাধ্যম থেকে দূরে থাকার কারণে নিজ সন্তানদেরকে সঠিক দিক-নির্দেশনা দিতে পারছে না। তাদেরকে বিজাতীয় অপসংস্কৃতি থেকে রক্ষা করতে হিমশিম খাচ্ছে।

নবীর উত্তরসূরী উলামায়ে কিরামের কাছে এখনও বিরাট সুযোগ আছে। এদেশেই ৪০ হাজার মাদ্রাসা মকতব দীনের দূর্গ হিসেবে এখনও মাথা উচু করে আছে। ৩ লক্ষ মসজিদের মিনার আর মিম্বার আছে। যদি তারা আজ আবারও ঘুরে দাঁড়ায়, নিজের অতীতের গৌরবজ্জ্বল ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে উম্মাহকে নেতৃত্ব দেয়ার জন্য উদ্যোগ হয়, আভ্যন্তরীন বিবাদ আর বিভক্তিতে নিজেদের শক্তি বিনষ্ট না করে নতুন শতাব্দীর বিশ্ব নেতৃত্ব দেয়ার জন্য ঐক্যবদ্ধভাবে একে অপরের সাথে সহযোগিতা ও সহমর্মিতার মাধ্যমে এক ঐশী ভ্রাতৃত্ব বন্ধন রচনা করে, তবে বিশ্ব প্রেক্ষাপট পরিবর্তন হওয়া কেবল সময়ের ব্যাপার মাত্র। জাতির রাহবার, রাসূলের সুযোগ্য উত্তরসূরী আলেম সমাজ যদি আজ আবারও একযোগে ইসলাম প্রতিষ্ঠার জন্য দীনের ব্যাপকতর দাওয়া ও তাবলীগের কাজে উদ্যোগী হন, এদেশের ৪০ হাজার মাদ্রাসা মক্তব যদি দীনের দূর্গ ও যোগ্য রাহবার তৈরীর লক্ষ্যে অবিরাম ভূমিকা পালন করা শুরু করে, ৩ লক্ষ মসজিদের মিম্বার গুলো যদি আজ জেগে উঠে, সর্বজন শ্রদ্ধেয় আলেম, ইমাম ও খতীবদের হৃদয়স্পর্শী আহ্বান যদি এক যোগে ৩ লক্ষ মিনার থেকে সারা দেশে ছড়িয়ে পরতে থাকে, কোটি কোটি মুসলিম জনতা যদি তাদের আকীদা বিশ্বাসের ভিত্তিতে একটি আদর্শিক রাষ্ট্রব্যবস্থার লক্ষ্যে রাজপথে নেমে আসে, তবে রবের শপথ করে বলতে পারি, ইসলামের পুনর্জাগরণ সময়ের ব্যাপার মাত্র। আর এই জাগরণের মাধ্যমে শুধু এই বঙ্গভূমিতেই নয়, বরং পুরো এশিয়া এবং পুরো বিশ্বজুড়েই পরিবর্তনের ঢেউ জাগতে পারে। তবে এজন্য সবার আগে প্রয়োজন হলো নিজের মধ্যে আর বিভক্তি না বাড়িয়ে বৃহত্তর ঐক্যের লক্ষ্যে কাজ করা। নিজেদের চিন্তার জগতকে শানিত করা। ইসলামকে সকল সমস্যার একমাত্র সমাধান হিসেবে যৌক্তিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক উপায়ে জাতির সামনে তুলে ধরা। আধুনিক প্রযুক্তি ও মিডিয়ার মাধ্যমে জাতিকে পরিস্কারভাবে জানিয়ে দেয়া যে, তাদের দৈনন্দিন জাতীয় ও আন্তর্জার্তিক সকল সমস্যার সমাধান পাওয়ার জন্য ইসলামের পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নের কোন বিকল্প নেই।

তবে আমি জানি না যে, এক ব্যথিত হৃদয়ের এ করুণ আকুতি জাতির কর্ণধারদের কাছে পৌঁছবে কি না। এক নগন্যের হৃদয় ক্ষরিত রক্তাক্ত ভাষা থেকে ঝরা ক’ফোঁটা তিক্ত শব্দ তাদের অন্তরকে ছুঁয়ে যেতে পারবে কি না। না উল্টো নিজেই আবার গোমরাহ ও ভ্রান্ত মতবাদের প্রতিনিধি বলে আখ্যায়িত হবো। তবে সত্যের প্রয়োজনে এই অধমের উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া ঝরের রেশ ধরে দু’ একজনের অন্তরও যদি দুলে উঠে, কারো চিন্তার জগতে সামান্য নতুনত্ব আসে কিংবা গতবাঁধা জীবন চলার ক্ষেত্রে ন্যুনতম ছন্দপতন ঘটাতেও যদি আমার এই শ্রম সামান্য উপলক্ষ্য হিসেবে কাজে লাগে এবং তা অনাগত কোন সুবহে সাদিকের আগমনী বার্তার অগ্রদূত হিসেবে সামান্যও বিবেচিত হয় -তবে এ রকম শত অধমের আত্মত্যাগ শতভাগ সফল।

ড. জাকির নায়েকের সমালোচনার জবাব প্রসঙ্গে লিখে অহেতুক তর্ক-বিতর্কের এই ময়দানে কোন পক্ষভুক্ত হওয়ার কোন ইচ্ছা আমার আগেও ছিলো না এখনও নেই। কারণ এটি এই মুহূর্তে মুসলিম উম্মাহর জন্য উল্লেখযোগ্য তো নয়ই সাধারণ কোন সমস্যাও নয়। ড. জাকির নায়েকের সমালোচনা যারা করেছেন তারা সাধারণ কেউ হলে এ বিষয়ে আমি ভুলেও ফিরে তাকাতাম না।

কিন্তু এক্ষেত্রে এমন কয়েকজন অত্যন্ত শ্রদ্ধেয় ও প্রভাবশালী আলেম কলম ধরেছেন, যাদের অনেকের সম্পর্কে আমি নিজেও অত্যন্ত শ্রদ্ধা ও আস্থাশীল ধারণা পোষণ করি। আমার বিশ্বাস তারা যা লিখেছেন তার অনেকাংশই অন্যের ‘কান কথা’র উপর ভিত্তি করে লিখেছেন। তারা যে এই কাজ শতভাগ ইখলাসের সাথে এবং উম্মাহর কল্যাণের জন্য করেছেন তাতে আমার কোন সন্দেহ নেই। আর এ কারণেই আমার মতো তাদের অন্যান্য ভক্ত ও গুনগ্রাহীগণও নিশ্চয়ই এবার এক ভুলের উপর ভিত্তি করে আরো শত ভুলের জন্ম দিবেন। প্রায় নিশ্চিতভাবেই বলা যায় যে অচিরেই এ সম্পর্কে আরো অনেক আলোচনা-সমালোচনা হবে। হয়তো আমার এই বই প্রকাশের আগেই জাকির নায়েকের সমালোচনায় আরো অনেকের লেখা প্রকাশিত হবে। তাই এক্ষেত্রে সমালোচনা গুলোর বাস্তবতা কি এবং ড. জাকির নায়েকের বিষয়ে আমাদের না পরে থেকে বরং উম্মাহর ঐক্য এবং দূরাবস্থা নিরসনের উপরোক্ত পয়েন্ট গুলোর দিকে বেশি মনোযোগ দেয়া উচিত -মূলত: এই কথাটা বলার জন্যই আমার এই লেখা।

জাকির নায়েকের সমালোচনার এ বিষয়ে লেখার পূর্বে এ বিষয়ে এ পর্যন্ত সমালোচনাকারী সকলের লেখা বই এবং প্রতিবেদন সংগ্রহ করা হয়েছে। তাদের অভিযোগের যথার্থতা অনুসন্ধানের জন্য ড. জাকির নায়েকের ৫০ হাজার মেগাবাইটেরও অধিক পরিমাণ, ২০০ ঘন্টারও অধিক আলোচনা, অনেক গুলো বই সংগ্রহ করে এবং সরাসরি তার প্রতিষ্ঠানেও যোগাযোগ করা হয়েছে। তাই এ বিষয়ে কোন মন্তব্য করার পূর্বে কষ্ট করে পুরো লেখাটি একবার পড়ে নেয়ার জন্য সকলের প্রতি বিনীত অনুরোধ রইল। এরপরও যদি ড. জাকির নায়েক সম্পর্কে যদি কারো দ্বিমতও থাকে, থাকুক। এটাকে তার অবস্থায় রেখে আসুন আমরা এই উম্মাহর জন্য সবচেয়ে প্রয়োজনীয় বিষয় তাদের ঐক্য ও আদর্শিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার সর্বসম্মত কাজে নিজেদেরকে সম্পৃক্ত করি। মহান আল্লাহ আমাদের সকলকে তার দীনের জন্য কবুল করুন। আমীন।

কে এই জাকির নায়েক?

৯/১১ এর ঘটনার পর যখন বিশ্ব জুড়ে তোলপাড় হচ্ছে, মুসলিম মানেই সন্ত্রাসী বলে চতুর্দিকে প্রচার করা হচ্ছে। পৃথিবীর সকল এয়ারপোর্টে যাত্রীদেরকে বিশেষত: মুসলিমদেরকে সীমাহীন হয়রানি করা হচ্ছে, ঠিক তেমনি এক সময়ে ২০০৩ সালের ১২ অক্টোবর দাঁড়ি-টুপি আর মুসলিম অবয়বের এক ব্যক্তি আসলেন আমেরিকার লস এঞ্জেলস এয়ারপোর্টে। এমনিতেই মুসলিম তার উপরে আবার দাঁড়ি-টুপি। আর যায় কোথায়। পুরো এয়ারপোর্টে চাঞ্চল্য ছড়িয়ে পড়লো। তাকে অন্যদের থেকে আলাদা করে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য বিশেষ ঘরে নিয়ে আসা হলো। শুরু হলো জিজ্ঞাসাবাদ।

অফিসার : আপনি এখানে কেন এসেছেন? আগন্তুক : একটি পুরস্কার নিতে এসেছি।

অফিসার : পুরস্কার? কিসের জন্য কি পুরস্কার?

আগন্তুক : মানবতার জন্য পুরস্কার। International Islamic Internet University নামক লস এঞ্জেলস এর একটি প্রতিষ্ঠান আমাকে মানবতার জন্য একটি পুরস্কার দিবে, তাই নিতে এসেছি।

অফিসার : কেন আপনাকে পুরস্কার দেয়া হচ্ছে? আপনি কি করেছেন? আগন্তুক : আমি সত্যকে ভালোবাসি এবং তাকে ছড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করি। আপনাদের যিশু নিজেও গসপল অব জন, ৮ম অধ্যায়ের ৩২ অনুচ্ছেদে বলেছেন, “তোমরা সত্যকে খুঁজে বেড়াও এবং তাকে ছড়িয়ে দাও। সত্যই তোমাকে মুক্ত করবে।” -আমিও এভাবে সত্যকে ছড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করি। আমি একজন দায়ী। দীনুল হককে ছড়িয়ে দেয়াই আমার ধর্ম।

এরপর ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষ তাকে আরো বিভিন্ন রকম প্রশ্ন করতে লাগলো। তার ব্যাগ নিয়ে খোলা হলো। ব্যাগে একটি ভিডিও ক্যাসেটও পাওয়া গেলো যাতে লেখা ছিলো “জিহাদ এন্ড টেরোরিজম।” এটা দেখে কর্তৃপক্ষের প্রশ্নের ধরণও পাল্টে গেলো।

অফিসার : আপনি কি জিহাদে বিশ্বাস করেন?

আগন্তুক: হ্যাঁ। অবশ্যই। এমনকি যিশু নিজেও জিহাদের কথা বলেছেন। সত্যের জন্য চেষ্টা ও সংগ্রাম করতে বলেছেন। আমিও তাতে বিশ্বাস করি।

অফিসার : না না, জিহাদ বলতে আপনি কি যুদ্ধ করায় বিশ্বাস করেন?

আগন্তুক : হ্যাঁ, একথা তো বাইবেলেই উল্লেখ আছে। বুক অফ এক্সোডাস এর ২২ অধ্যায়ের ২০ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, “আপনাকে যুদ্ধ করতে হবে।” বুক অফ এক্সোডাস এর ৩২ অধ্যায়ের ২৭-২৮ অনুচ্ছেদে, বুক অব নাম্বারস এর ৩১ অধ্যায়ের ১-১৯ অধ্যায়েও বলা হয়েছে, “যুদ্ধ করতে হবে।” হিন্দুদের ধর্মগ্রন্থ ভগবত গীতার ২ নং অধ্যায়ের ৩১-৩৩ অনুচ্ছেদে কৃষ্ণ বলেছেন, “ধর্মের পক্ষ থেকে যুদ্ধ করা, সেটা তোমার দায়িত্ব। যদি যুদ্ধ না করো তাহলে পাপ হবে। যদি যুদ্ধ করো তাহলে স্বর্গে প্রবেশ করতে পারবে।” আপনাদের যিশু নিজে গসপল অব লুক, ২২ অধ্যায়ের ৩৬ অনুচ্ছেদে বলেছেন, “তরবারী নিয়ে তোমরা যুদ্ধ করো।”

তখন সেখানকার একজন খৃষ্টান অফিসার বললো : সেটি তো আত্মরক্ষার জন্য।

আগন্তুক বললেন : হ্যাঁ, আমিও তাই বলি, আত্মরক্ষার জন্য।

এভাবে আলোচনার ফলে সেই কাস্টমস অফিসাররা আরো কৌতুহলী হয় এবং তাকে আরো প্রশ্ন করে। তিনি তার মেধা, জ্ঞান ও প্রজ্ঞা দ্বারা সবটারই সুন্দর উত্তর দিয় দেন। তখন তাকে যেতে অনুমতি দেয়া হয়। দেখা গেল, তিনি যখন রুম ত্যাগ করছিলেন তখন তার সাথে এয়ারপোর্টের প্রায় ৭০ জন অফিসার তাকে ঘিরে তাদের নিজ ধর্ম ও ইসলাম সম্পর্কে জানতে আগ্রহী হয়ে ওঠে। তারা বলতে থাকে তারা খুবই বিস্মিত হয়েছে এবং তারা তার মতো এরকম জ্ঞানী লোক কখনো দেখেনি।

-এভাবে সত্যকে অস্বীকার না করে সুন্দর ভাষার উত্তম জবাবের দ্বারা এয়ারপোর্ট থেকে যেই ব্যক্তিটি বেরিয়ে আসলেন তিনিই হলেন ড. জাকির নায়েক।

ড. জাকির নায়েক ও তার কার্যক্রম:

ডা. জাকির নায়েক ১৮ অক্টোবর ১৯৬৫ সালে ভারতের মুম্বাইয়ে জন্ম গ্রহণ করেন। তিনি মুম্বাইয়ের সেন্ট পিটার’স হাই স্কুল (আই.সি.এস.ই) থেকে মাধ্যমিক এবং চেল্লারাম কলেজ, মুম্বাই থেকে উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা লাভ করেন। এরপর টপিওয়ালা ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ, নায়ের হসপিটাল, মুম্বাই থেকে পড়াশুনার পর মুম্বাই ইউনিভার্সিটি থেকে চিকিৎসা শাস্ত্রে ডিগ্রি অর্জন করেন। ডা. জাকির নায়েক বর্তমানে ইসলামিক রিসার্চ ফাউন্ডেশন (আইআরএফ) এর প্রেসিডেন্ট। তিনিই এর মূল চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করছেন। তিনি বর্তমানে আইআরএফ এডুকেশনাল ট্রাষ্ট, মুম্বাইয়ের চেয়ারম্যান এবং ইসলামিক ডাইমেনশন মুম্বাইয়ের প্রেসিডেন্ট। এছাড়াও তিনি ইসলামি রিসার্চ ফাউন্ডেশন নামক আইআরএফ নামক একটি অলাভজনক প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা যেটি পিস টিভি পরিচালনা করে থাকে।

ড. জাকির নায়েক চিকিৎসা শাস্ত্রের উপর পড়াশোনা করে একজন সফল ডাক্তার হিসেবে পেশাগত জীবন শুরু করলেও তার আগ্রহের বিষয় ছিলো ইসলাম। বিশ্বখ্যাত সুবক্তা ও তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বের বিশ্লেষক শেখ আহমাদ দীদাতের প্রাঞ্জল ভাষার অনলবর্ষী বক্তব্য এবং ইসলাম বিষয়ে তার জ্ঞানগর্ভ আলোচনা ড. জাকির নায়েককে আরো উদ্বুদ্ধ করে।

দক্ষিণ আফ্রিকায় বসবাসকারী ভারতীয় বংশোদ্ভূত শেখ আহমদ দিদাত ছিলেন একজন খ্যাতনামা ইসলামী চিন্তাবিদ। ইসলামের উপর তার পড়াশুনা ছিল ব্যাপক। ইসলাম ও মুসলমানদের সম্পর্কে ইসলাম বিদ্বেষীদের ছড়ানো সমালোচনা ও কটুক্তি খন্ডন করতেন ও অকাট্য জবাব দিতেন। বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থের সুন্দর উদ্ধৃতির মাধ্যমে ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব তুলে ধরতেন সন্দেহাতীতভাবে। দীনের অক্লান্ত দায়ী শেখ আহমাদ দীদাতের জীবন ও কর্মে অনুপ্রাণিত হয়ে ড. জাকির নায়েকও এগিয়ে আসেন দীন প্রচারে। বিশ্বের কোটি কোটি মানুষের কাছে ইসলামের অবস্থান ও সত্য দীনকে তুলে ধরতে ডা. জাকির নায়েক আত্মনিয়োগ করেছেন। একজন ডাক্তারের পরিবর্তে আত্মপ্রকাশ করেন দীনের একজন দায়ী হিসেবে।

ড. জাকির নায়েকের গভীর অধ্যয়ন আর পান্ডিত্যপূর্ণ শালীন ও সুন্দর উপস্থাপনায় ইসলামের স্বরূপ সম্পর্কে অমুসলিম বিশ্ব এবং ইসলাম সম্পর্কে উদাসীন মুসলিম সমাজ আকৃষ্ট হয় আবারও দীনের প্রতি। এভাবে দীনের দাওয়াত দেয়ার মাধ্যমে ড. জাকির নায়েকও ধীরে ধীরে নিজ আধ্যাত্মিক গুরু আহমাদ দীদাতকে এক সময় ছাড়িয়ে যেতে লাগলেন। ড. জাকির নায়েকের এতো অগ্রগতি দেখে স্বয়ং শেখ আহমদ দিদাত ১৯৯৪ সালে ডা. জাকির নায়েককে ‘দিদাত প্লাস’ হিসেব উল্লেখ করেন। জাকির নায়েকের দাওয়ার উপর যে বুুৎপত্তি অর্জিত হয়েছে এবং ধর্মসমূহের তুলনামূলক বিশ্লেষণের উপর তার যে পড়াশুনা তাতে জনাব দিদাত ২০০০ সালের মে মাসে জাকির নায়েককে দেয়া এক স্মারক উপহারের খোদাই-করে লিখেছিলেন, “”Son what you have done in 4 years had taken me 40 years to accomplish – Alhamdullilah.”

৪৬ বছর বয়সের ড. জাকির নায়েক ইতোমধ্যেই কুরআন-হাদীস এবং বিভিন্ন ধর্ম গ্রন্থের আলোকে ইসলামের বিভিন্ন বিষয়াবলীর উপর প্রায় ১০০০ এরও বেশি বক্তব্য দিয়েছেন। গত ১০ বছরে ড. জাকির নায়েক কানাডা, ইউ কে, সৌদি আরব, মিশর, ইউ এক ইউ, ইতালি, কুয়েত, কাতার, বাহরাইন, ওমান, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যাণ্ড, দক্ষিণ আফ্রিকা, বতসোয়ানা, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, হং কং, থাইল্যাণ্ড, গায়ানা, (দক্ষিণ আমেরিকা), ত্রিনিদাদ, ভারতসহ বিশ্বের প্রায় ১৫০ টি দেশে ইসলাম সম্পর্কে বিভিন্ন প্রশ্ন ও ভুল ধারণার অপনোদন কল্পে যুক্তি, বিশ্লেষণ ও বিজ্ঞানের দ্বারা অত্যন্ত প্রাঞ্জল ভাষায় বক্তব্য দিয়েছেন।

ড. জাকির নায়েক অন্যান্য ধর্মের পন্ডিত ব্যক্তির সাথে সংলাপ ও বিতর্কে অংশ নিয়ে থাকেন। এর মধ্যে অন্যতম একটি বিতর্ক অনুষ্ঠান হয়েছিলো আমেরিকার শিকাগোতে ২০০০ সালের ১ এপ্রিল। ‘দি বাইবেল এন্ড দি কোরআন ইন দি লাইট অব সায়েন্স’ শীর্ষক এই বিতর্কে ড. জাকিরের প্রতিপক্ষ ছিলেন আমেরিকার একজন চিকিৎসক ও মিশনারি ব্যক্তিত্ব ডা. উইলিয়াম ক্যাম্পবেল। এই অনুষ্ঠানে ড. জাকির অত্যন্ত সফলভাবে উইলিয়াম ক্যাম্পবেলকে পরাজিত করতে সক্ষম হন।

ড. জাকির নায়েকের আরেকটি ঐতিহাসিক বিতর্ক হয়েছিলো ভারতের ব্যাঙ্গলোরে। ‘প্রধান ধর্ম গ্রন্থের আলোকে হিন্দুইজম এবং ইসলাম’ শীর্ষক এই বিতর্কে তার প্রতিপক্ষ ছিলেন ভারতের আর্ট অব লিভিং ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা শ্রী রবী শংকর। এই বিতর্ক অনুষ্ঠানেও ড. জাকির নায়েক অত্যন্ত সুন্দরভাবে তাকে পরাস্ত করেন। তার এসব বক্তৃতার অডিও ও ভিডিও ক্যাসেট দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে পড়েছে। ফলে ইসলামপ্রিয় মানুষের কাছে তিনি প্রতিনিয়ত জনপ্রিয় হয়ে উঠছেন। বাংলাদেশেও সম্প্রতি তিনি পরিচিতি পেয়েছেন। তাকে স্যাটেলাইট টিভি চ্যালেন ‘পিস’ টিভিতে প্রায় প্রতিদিনই দেখা যায়। এছাড়াও ডা. জাকির নায়েক ইসলামের উপর এবং তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বের উপর বেশ কয়েকটি বই লেখেন। তার প্রকাশিত গ্রন্থসমূহ মধ্যে আছে, পিপলস টু দি মোস্ট কমন কোশচেনস আস্কড বাই নন-মুসলিম, কোরআন এন্ড মডার্ন সায়েন্স – কম্পেটিবল অর ইনকম্পেটিবল, উইমেনস রাইটস ইন ইসলাম – প্রোটেক্টেট অর সাবজুগেটেড, আল-কোরআন -শূড ইট বি রেড উইথ আন্ডারস্টান্ডিং, ইস দি কোরআন গডস ওয়ার্ড, ইসলাম এন্ড টেররিজম, কনসেপ্ট অফ গড ইন মেজর রিলিজিয়নস।

সহজ ও সাবলীল ভঙ্গিমায় আলোচনাকারী প্রখ্যাত এই মনিষী নিজেকে সব সময় ইসলাম ও অন্যান্য ধর্মগ্রন্থ অধ্যয়নকারী একজন ছাত্র হিসেবে পরিচয় দিতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ বোধ করেন। সত্যের সাহসী উচ্চারণে তিনি বর্তমান বিশ্বের শীর্ষ সন্ত্রাসী আমেরিকার সন্ত্রাসবাদ সম্পকেও স্বরব। তিনি বলেন, বিন লাদেন যদি যুক্তরাষ্ট্রের মতো সন্ত্রাসী রাষ্ট্রকে সন্ত্রাসের মাধ্যমে হুমকির সম্মুখীন করে তাহলে তিনি বিন লাদেনের পক্ষে। এমনকি ইসলামের শত্র“ বা যুক্তরাষ্ট্রকে যে কোন উপায়ে কাঠগড়ায় দাঁড় করানোকে সন্ত্রাস বলা হলে তিনি প্রত্যেক মুসলিমেরই সন্ত্রাসী হওয়া উচিত বলে মন্তব্য করেন। তার এমন সাহসী উচ্চারণের জন্য ব্রিটেনের কয়েকটি অনুষ্ঠানে তিনি যেতে পারেন নি। এছাড়াও মাযহাব ও মাসআলা সংক্রান্ত বিভিন্ন বক্তব্যের কারণে তিনি ভারত ও বাংলাদেশের কয়েকজন আলেম ও প্রতিষ্ঠানের দ্বারা সমালোচিত হয়েছেন। তবে সমালোচকরাও ভিন্ন ধর্মের লোকদের সাথে ড. জাকির নায়েকের যুক্তিপূর্ণ ও তথ্যবহুল বিতর্কের প্রশংসা করেছেন এবং তাকলীদ, মাযহাব ও ইখতিলাফপূর্ণ মাসআলার বিষয় বাদ দিয়ে অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে গবেষণা ও আলোচনায় অধিক মনোযোগ দেয়াই তার জন্য শ্রেয় বলে মন্তব্য করেছেন।

দীনের এই দায়ী সকল প্রকার বিতর্কের উর্ধ্বে উঠে ইসলামের খেদমত করুন এবং মহান আল্লাহ তাকে হায়াতে তাইয়্যিবা দান করুন এই প্রত্যাশা করছি।

ড. জাকির নায়েকের ব্যাপারে অভিযোগ সমূহের গতি-প্রকৃতি

মিডিয়ার কল্যাণে দ্রুত থেকে দ্রুততার সাথে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়া নামটি হলো ড. জাকির নায়েক। বর্তমানে আমাদের দেশেও ড. জাকির নায়েকের সমর্থক, শুভাকাঙ্খীর সংখ্যা একেবারে কম নয়। দিন দিন এ সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বাড়ছে।

আমাদের দেশের ইসলামী অঙ্গনে এতোদিন ড. জাকির নায়েক কেবল আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে অবস্থান করলেও বর্তমানে তিনি আলোচনার পাশাপাশি সমালোচনার লক্ষ্যবস্তুতেও পরিণত হয়েছেন। ড. জাকির নায়েকের বিপক্ষে আমাদের দেশের শীর্ষ উলামায়ে কিরাম বলে পরিচিত এবং হক্কানী আলেম বলে সুবিদিত বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান থেকে বেশ কড়া ভাষায় সমালোচনা ও বিরুদ্ধাচারণ শুরু হয়েছে।

ভারতের আল্লামা সাইয়্যিদ খালিক সাজিদ বোখারী কর্তৃক ড. জাকির নায়েকের বিপক্ষে ‘হাকীকতে ড. জাকির নায়েক’ নামক একটি বই লেখার পর তার সূত্র ধরে আমাদের দেশে এব্যাপারে প্রথম কলম ধরেন, আমাদের সকলের শ্রদ্ধেয় আলেম ও শীর্ষ ইসলামী চিন্তাবিদ হযরত মাওলানা নূরুল ইসলাম ওলীপুরী দা. বা.। তিনি সিলেট থেকে প্রকাশিত ‘কালকণ্ঠ’ নামক আঞ্চলিক একটি ম্যাগাজিনে পর পর দু’বার ’ড. জাকির নায়েক আলেম বলে আমি কোনো প্রমাণ পাইনি’ এবং ‘জাকির নায়েক সম্পর্কে আমার বক্তব্যের ব্যাখ্যার প্রয়োজন নেই’ শিরোনামে সাক্ষাতকার দেন। এরপর তার এই সাক্ষাতকারটির বক্তব্য লিফলেট আকারে দেশের বিভিন্ন মসজিদে ছাড়া হয়। আরো কিছু সংযোজনী দিয়ে এটিকে একটি ছোট বই আকারে ‘জাকির নায়েকের আসল চেহারা’ নামে প্রথম এডিশনেই ১২ হাজার কপি ব্যাপকভাবে বাজারে ছাড়া হয়।

এরপর এ বিষয়ে গত মে মাসে ড. জাকির নায়েক সম্পর্কে ভারতের বেশ কিছু শীর্ষ উলামায়ে কিরামের কিছু মন্তব্য ও অভিব্যক্তি একত্র করে মুফতী মীযানুর রহমান কাসেমী দা. বা. “ডা. জাকির নায়েকের ভ্রান্ত মতবাদ : পর্যালোচনা ও বিশ্লেষণ” নামে একটি বই প্রকাশ করেন।

আমাদের দেশের ইসলামী অঙ্গনে বহুল প্রচলিত একটি গুরুত্বপূর্ণ ইসলামী ম্যাগাজিন ‘মাসিক আদর্শ নারী’ মত্রিকায়ও গত মে মাসে “ডা: জাকির নায়েকের দ্বীনী কথাবার্তা কতটুকু গ্রহণযোগ্য?” শিরোনামে একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। উপরোক্ত বই ও প্রতিবেদন গুলোতে বেশ কিছু পয়েন্ট উল্লেখ করে ড. জাকির নায়েকের ব্যাপারে সমালোচনা করা হয়েছে। কিন্তু দু:খজনক হলো অধিকাংশ পয়েন্টের ক্ষেত্রেই কোনো সূত্র উল্লেখ করা হয়নি।

মাওলান নূরুল ইসলাম ওলীপুরীকে প্রায় ১০ বার ফোন করার পর তিনি কল রিসিভ করেন। এপাশ থেকে সাংবাদিক শুনে অনেকটা ক্ষেপে গিয়ে বলেন, আপনি সাংবাদিক না ওসি আমি বুঝব কি করে। আমি আপনাকে চিনিনা তাই কথা বলতে চাই না। এ পাশ থেকে দ্বিতীয়বার অনুরোধ করা হয়, স্যার আপনার সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়ে আমরা কথা বলতে চাই, প্লিজ এক মিনিট সময় দিন। এ কথা শুনে তিনি বলেন আমার অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ রয়েছে। আপনার সঙ্গে বাজে কথা বলার সময় আমার নেই। এই বলেই ওপাশ থেকে লাইন কেটে দেন।

মুফতী মীযানুর রহমান কাসেমী’র কাছে ‘রাসূল সা. এর একাধিক বিবাহ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে’ কথাটি কোথায় আছে কিভাবে পেয়েছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটা ভারতের ওলামায়ে কেরাম এভাবে লিখেছেন। আমার বইটি আংশিক অনুবাদ। আমি ওলামায়ে দেওবন্দের অনুসরণ করেই বইটি লিখেছি। কিন্তু নিজে যাচাই না করে এভাবে লিখা কি ঠিক হয়েছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা অবশ্যই যাচাই বাচাই করেছি। কিন্তু তার বইতে দেয়া অনেক বক্তব্যেরই কোন সূত্র তিনি দিতে পারেন নি। মাসিক আদর্শ নারী পত্রিকার কর্তৃপক্ষের কাছে তাদের গবেষণা প্রতিবেদনে প্রদত্ত জাকির নায়েক সম্পর্কে কয়েকটি মন্তব্যের দৃষ্টি আকর্ষণ করে তার সূত্র জানতে চাইলে তারা পরে জানাবেন বলে আশ্বস্ত করেন।

এই সকল পত্রিকা, বই ও তার লেখক-প্রতিষ্ঠান সমূহ নি:সন্দেহে অত্যন্ত শ্রদ্ধেয় ও সম্মানীত হলেও তাদের বক্তব্যের বেশ কিছু অসঙ্গতি, দূর্বল ও অসত্য তথ্যের উপস্থিতি আমাদেরকে ব্যথিত করেছে। ড. জাকির নায়েকের প্রতি অতিরিক্ত কোন দরদ কিংবা পার্থিব স্বার্থ সংশ্লিষ্টতা আগেও ছিলো না, এখনও নেই। কিন্তু একজন মুসলিম এবং দায়ী হিসেবে তিনি এখন পর্যন্ত যেই চেষ্টা-প্রচেষ্টা করে যাচ্ছেন -একজন পর্যবেক্ষক হিসেবে অবশ্যই তার নির্মোহ মূল্যায়ন হওয়া উচিত।

একইভাবে ইসলামী আকীদা কিংবা কুরআন ও সুন্নাহর সুস্পষ্ট কোন বক্তব্যের ক্ষেত্রে তার কোন ভিন্নমত বা ভুল বক্তব্য পাওয়া গেলে অবশ্যই তার বিরোধী করতে হবে ঈমানের তাগিদেই। কিন্তু নফল ও মুস্তাহাব পর্যায়ের কোন বিষয়ের জন্য কিংবা ইমামদের মতবিরোধপূর্ণ কোন মাসআলায় নিজ ইমামের মতের কোন অংশের সাথে তার মিল না হলেই কাউকে ‘ষড়যন্ত্রকারী’ ‘ভিন্ন ধর্মের এজেন্ট’ বা তার বক্তব্যকে ‘অমার্জনীয় ধৃষ্টতা’ বলে কটাক্ষপূর্ণ মন্তব্য বা যৌক্তিক ও তথ্য প্রমাণহীন কেবল বিদ্বেষ মূলক আক্রমণাত্মক বক্তব্য প্রদান কোন মতেই সমর্থন যোগ্য হতে পারে না। কিন্তু সমালোচনা গুলোতে প্রায় তাই করা হয়েছে।

একজন মু’মিন মুসলিমের জন্য অত্যন্ত আবশ্যকীয় বিষয় হলো অপর কোন মুমিন, মুসলিম ভাইয়ের ব্যাপারে কোন মন্তব্য করার আগে বিষয়টি যাচাই করে নেয়া। এ নির্দেশ দিয়েছেন স্বয়ং মহান আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা। পবিত্র কুরআনে তিনি ইরশাদ করেছেন,

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا إِنْ جَاءَكُمْ فَاسِقٌ بِنَبَأٍ فَتَبَيَّنُوا أَنْ تُصِيبُوا قَوْمًا بِجَهَالَةٍ فَتُصْبِحُوا عَلَى مَا فَعَلْتُمْ نَادِمِينَ.

অর্থ: “হে ঈমানদ্বার গণ! যদি কোন ফাসিক তোমাদের কাছে কোন সংবাদ নিয়ে আসে, তাহলে (সে ব্যাপারে কিছু বলা বা সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে) তোমরা তা যাচাই করে নাও। না হলে, তোমরা অজ্ঞতাবশত: কোন কওমকে আক্রমণ করে বসবে, অবশেষে তোমরা তোমাদের কৃতকর্মের জন্য লজ্জিত হবে।” (সূরা হুজুরাত, আয়াত: ০৬)

এই আয়াতের দ্বারা এটা সুস্পষ্ট যে, কেবল মাত্র ধারণা প্রসূত এবং তৃতীয় পক্ষের কোন কথা শুনেই কারো সম্পর্কে সিদ্ধান্ত দেয়া উচিত নয়। কোন মন্তব্য করাও ঠিক নয়। কারণ অনেক সময়ই মাধ্যম বাড়ার কারণে মূল বিষয় পরিবর্তিত হয়ে যায়। একারণেই যে কোন বক্তব্যের ক্ষেত্রে বা কারো সমালোচনার ক্ষেত্রে সরাসরি তার সাথে কথা বলা, সুনির্দিষ্টভাবে তার আলোচনা উদ্ধৃত করা কিংবা তার লেখা থেকে রেফারেন্স না দিয়ে কিছু বলার অর্থ অনেক সময়ই মিথ্যাচারে পরিণত হয়। এজন্যই মহানবী সা.ও তার হাদীসের মাঝে সুস্পষ্টভাবে ইরশাদ করেছেন,

عن أبي هريرة رضي اللّه عنه أن النبيّ صلى اللّه عليه وسلم قال: ” كَفَى بالمَرْءِ كَذِباً أنْ يُحَدِّثَ بِكُلِّ ما سَمِعَ “

অর্থ: হযরত আবূ হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, প্রিয়নবী সা. বলেছেন “মানুষের মিথ্যা বলার জন্য এতোটুকুই যথেষ্ট যে, সে কিছু শুনবে আর যাচাই-বাছাই না করেই তা অপরের কাছে বর্ণনা করবে।” (সহীহ মুসলিম, প্রথম খন্ড হাদীস নং ৮)

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا اجْتَنِبُوا كَثِيرًا مِنَ الظَّنِّ إِنَّ بَعْضَ الظَّنِّ إِثْمٌ

অর্থ: “হে ঈমানদ্বার গণ! তোমরা কেবলমাত্র ধারণাপ্রসূত ও অনুমান নির্ভর বিষয় হতে বেঁচে থাকো। কেননা, অধিকাংশ ধারণা ও অনুমানই পরিশেষে গুনাহের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।” (সূরা হুজুরাত, আয়াত: ০৬)

ড. জাকির নায়েকের ব্যাপারে সমালোচকদের বক্তব্য কথা-বার্তায় দেখা যাচ্ছে যে, আসলে তারা অনেকেই ড. জাকির নায়েক সম্পর্কে অনেক ক্ষেত্রেই না জেনে, ধারণা প্রসূত এবং তৃতীয় কারো বক্তব্যে প্রভাবিত হয়ে মন্তব্য করেছেন এবং অবশ্যই গুনাহগার হচ্ছেন। ড. জাকির নায়েকের ব্যাপারে আমাদের দেশে সবচেয়ে বেশি সমালোচনাকারী হযরত মাওলানা নূরুল ইসলাম ওলীপুরী সাহেব তার ‘জাকির নায়েকের আসল চেহারা বইতে স্পষ্টভাবে এটা স্বীকার করেও নিয়েছেন। এতে তিনি বলেছেন, “আমি তার কোন অনুষ্ঠানও দেখতে যাই না, কোনো বই পুস্তকও পড়তে চাই না।” (জাকির নায়েকের আসল চেহারা, পৃষ্ঠা নং ১৮)

“জাকির নায়েক নিয়ে আপনার পর্যবেক্ষণ বা মন্তব্যের কথা কখনো কি তার সঙ্গে শেয়ার করেছেন? কখনো যোগাযোগ করার ভাবনা আছে?” এমন এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছেন, “তিনি একজন আলেম, একথা আমার কাছে প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত ইসলাম ধর্ম অথবা ইসলামী শিক্ষা সম্পর্কে আলাপ-আলোচনা বা মতবিনিময়ের জন্য তার সঙ্গে আমার যোগাযোগের কোনো প্রশ্নই আসে না।” (জাকির নায়েকের আসল চেহারা, পৃষ্ঠা নং ১৯)

একই বইয়ের ২৩ পৃষ্ঠায় তিনি এটাও স্বীকার করেছেন যে, কেবলমাত্র তৃতীয় পক্ষের থেকে ‘শোনা’ কথার উপর ভিত্তি করেই তিনি সমালোচনা করেছেন। তিনি বলেছেন, “আমি যেহেতু তার বইও পড়িনা, প্রোগ্রামও দেখিনা, তাই এগুলো যারা পড়েন বা দেখেন তাদের বাচনিকের ভিত্তিতেই আমার মন্তব্য করতে হবে।”

এই যদি হয় একজন শীর্ষ আলেমের পক্ষ থেকে কারো ব্যাপারে সমালোচনার ভিত্তি, তাহলে কি অবস্থা আমাদের, ভাবতে খুবই কষ্ট লাগে।

এছাড়াও ড. জাকির নায়েকের ব্যাপারে আমাদের দেশের যারা সমালোচনা করেছেন তারা যে সকল বিষয়ে সমালোচনা করেছেন তার অধিকাংশই জাকির নায়েক কখন কোথায় বলেছেন তার কোন উদ্ধৃতি নেই। অনেক ক্ষেত্রে জাকির নায়েকের ব্যাপারে এমন কথা বলা হয়েছে যা আসলে জাকির নায়েক বলেন নি। আবার অনেক ক্ষেত্রে জাকির নায়েকের একটি দীর্ঘ একটি আলোচনার মাঝখান থেকে বিচ্ছিন্নভাবে অস্পষ্ট করে উদ্ধৃতি দেয়া হয়েছে যার মাধ্যমে আসলে জাকির নায়েকের মুল বক্তব্যকে বিকৃত করা হয়েছে। অনেক সমালোচনা করা হয়েছে অযৌক্তিকভাবে কেবলমাত্র ধারণার উপর ভিত্তি করে। আর বাকি অধিকাংশ ইখতিলাফ তথা মতবিরোধপূর্ণ মাসআলার ক্ষেত্রে ক্ষেত্রেই ড. জাকির নায়েক কর্তৃক কুরআন ও হাদীসের রেফারেন্স দিয়ে বিভিন্ন মত উল্লেখ শেষে তার মধ্যে একটিকে প্রাধান্য দেয়ার বিষয়টিকে বলা হয়েছে মনগড়া ব্যখ্যা বা কুরআন-হাদীসের অপব্যখ্যা। এসম্পর্কে এখন সমালোচকদের কিছু সমালোচনা ও আমার স্বল্প জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার আলোকে তার বিপরীত বাস্তবতা বা তুলে ধরা হচ্ছে। অনেক পাঠকই হয়তো আমার দেয়া জবাবের চেয়েও ভালো জবাব দিতে পারবেন। তাদের জন্য শেয়ার করার সুযোগ রইলো।

১. “জাকির নায়েক আলেম নন।” (মাওলানা নূরুল ইসলাম ওলীপুরী লিখিত, জাকির নায়েকের আসল চেহারা, পৃষ্ঠা নং ৫)

– ‘ড. জাকির নায়েক আলেম নন’ -এই কথাটি কতটুকু সত্য? যারা বলছেন যে, তিনি আলেম নয়, তাদের কাছে আলেম হওয়ার মানদন্ড ও মাপকাঠি কি? আলেম হওয়ার জন্য কোন কওমী মাদ্রাসায় পড়াই কি একমাত্র পথ?

আমরা জানি আরবদেশসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের স্কুল-কলেজ আমাদের দেশের স্কুল-কলেজের মতো নয়। সেখানকার স্কুল-কলেজের সিলেবাস থেকে আমাদের দেশের স্কুল-কলেজের সিলেবাস রাতদিন ব্যবধান। আমার জানামতে সউদী আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশের সরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহে মাদরাসাহ বলা হয়। আর সেই সকল প্রতিষ্ঠানের পড়াশোনা আমাদের অনেক কওমী মাদ্রাসার চেয়েও যে শ্রেষ্ঠতর, তা না মেনে উপায় নেই। সুতরাং কুরআন-সুন্নাহর উপর দীর্ঘ পড়াশোনার মাধ্যমে যে কেউ আলেম হতে পারেন।

ড. জাকিরও এই হিসেবে আলেম বলে গণ্য হতে পারেন। উপরন্তু তার গবেষণা প্রতিষ্ঠানে আরব-আজমের এক ঝাঁক নবীন ও প্রবীণ মুহাক্কিক আলেমের স্বরব উপস্থিতি বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দেয়ার মতো। ড. জাকির নায়েকের প্রতিষ্ঠান ইসলামিক রিসার্চ ফাউন্ডেশন বা আইআরএফ এর গবেষক প্যানেলে যে সকল আলেম আছেন তার কয়েকজন হলেন, আল্লামা সিরাজ ওয়াহহাজ, হুসাইন ইয়ে, ইয়াসির কাজী, সালীম আল আমরী, আসীম আল হাকিম, শেখ জাফর ইদ্রিস, রিয়াজ আনসারী, মুহাম্মাদ আল জিবালী, ওয়াজদি গাজ্জায়ি, ওয়ালিদ বাসইউনি প্রমুখ বিশ্ববরেণ্য আলেম। যাদের অনেকেই মধ্যপ্রাচ্যের শীর্ষ ইসলামী ব্যক্তিত্ব।

ড. জাকির নায়েকের গবেষণা ও আলোচনা প্রস্তুত করার অনেক ক্ষেত্রেই এই সকল বিজ্ঞ আলেমের ভূমিকাও থাকে। এছাড়াও দীনী গবেষণা ও পর্যালোচনার জন্য রয়েছে বিচক্ষণ আলেমদের তত্ত্বাবধানে আলাদা টীম।

ড. জাকির নায়েকের সমালোচকগণ একটু কষ্ট করলেই এই সকল তথ্য জানতে পারতেন। কিন্তু তারা তা না করেই সম্পূর্ণ কল্পনা প্রসূত বলে দিয়েছেন যে, জাকির নায়েক আলেম নন, তার সাথে আলেমদের সম্পর্ক নেই। যা নি:সন্দেহে দু:খজন।

আমাদের দেশের অনেক আলেমের মধ্যকার এ ধরণের একটি সংকীর্ণ মানসিকতা প্রায় সময় কাজ করে থাকে। কারো মতের সাথে পুরোপুরি না মিললেই তাকে আলেমদের কাতার হতে আলাদা করে ফেলা হয় তার গবেষণায় আরবের অনেক বড় বড় আলেমের সম্পৃক্ততা থাকলেও তাদেরকে ধর্তব্যের বাইরে রাখা হয়। আল্লাহ আমাদের এই সংকীর্ণ মানসিকতা পরিহার করার তাওফীক দিন।

আর যদি ড. জাকির নায়েক যদি বিজ্ঞ আলেম নাও হয়ে থাকেন তদুপরি পবিত্র কুরআনের সূরায়ে তাওবার ১২২ নং আয়াতের মাধ্যমে আমরা জানি যে, দীনের উপর তাফাক্কুহ বা গভীর জ্ঞান অর্জন করা প্রত্যেক মুসলমানের উপর ফরজে আইন নয়, বরং ফরজে কিফায়া। কিন্তু সূরায়ে ইউসূফের ১০৮ নং আয়াত, সূরায়ে নাহল এর ১২৫ নং আয়াতসহ আরো অনেক আয়াতের দ্বারা এটা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত যে প্রতিটি মুসলিমের জন্য দীনের দাওয়াত দেয়া ফরজ। অন্যের কাছে দীনের কথা পৌঁছে দেয়ার নির্দেশ রাসূল সা. তার হাদীসেও দিয়ে গেছেন।

সুতরাং ড. জাকির নায়েক যদি আলেম নাও হন, তিনি তো একজন মুসলিম, আর মুসলিম হিসেবে কুরআন ও হাদীসের নির্দেশনার আলোকে তিনি তার জানা অধ্যায় প্রমাণ সহকারে অন্যদের কাছে পৌঁছে দেয়ার চেষ্টা করছেন। (আর ড. জাকির নায়েকও তার বিভিন্ন আলোচনায় নিজেকে সব সময় বিভিন্ন ধর্মের একজন ছাত্র বলে পরিচয় দেন, ফকীহ বা বিরাট মুহাদ্দিস হিসেবে নন।) এটা কি করে নিন্দনীয় ও সমালোচনার বিষয় হতে পারে ?

২. “তিনি পড়াশোনা করেছেন খৃষ্টান মিশনারী ও হিন্দুদের স্কুল-কলেজে।” এরপর তিনি ইসলাম নিয়ে পড়াশোনা করেছেন এবং কুরআন হাদীস দিয়ে বক্তব্য দিচ্ছেন। (মুফতী মীযানুর রহমান কাসেমী লিখিত বই, ডা. জাকির নায়েকের ভ্রান্ত মতবাদ, পৃষ্ঠা ০৬)

– উলামায়ে কিরামগণ এ ব্যাপারে সকলেই একমত যে, শরীয়তের কোন বিধান লংঘন না হলে স্বাভাবিকভাবে ও সাধারণত: স্কুল-কলেজে পড়াশোনা হারাম কিংবা অন্যায় কোন কাজ নয়। প্রয়োজনীয় দীনী ইলম অর্জনের পর একজন মানুষ যে কোন বিষয়ের ইলম অর্জন করতে পারেন। যে কোন বৈষয়িক বিষয়ে পান্ডিত্য লাভ করতে পারেন।

সাহাবায়ে কিরাম রা. মুশরিক, ইহুদী ও অন্যান্য ধর্ম ছেড়ে মুসলিম হয়ে কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে নিজেকে পরিবর্তন করেছেন। এরপর দীনের দাওয়াত দিয়েছেন কুরআন ও সুন্নাহর মাধ্যমে। -এটা যদি অন্যায় বা নিন্দনীয় না হয়ে প্রশংসার বিষয় হয়, তাহলে স্কুল-কলেজে পড়াশোনা করার পর কুরআন-হাদীস নিয়ে অধ্যয়ন ও গবেষণা এবং তার পর দীনের দাওয়াতের কাজে নিজেকে নিয়োজিত করাও নি:সন্দেহে প্রশংসার দাবীদার।

৩. কুরআন হাদীস নিয়ে অধ্যয়ন করার জন্য একজন অভিজ্ঞ শিক্ষকের তত্ত্বাবধানে থাকা প্রয়োজন কিন্তু এ ব্যাপারে তার কোন শিক্ষক নেই। (মাওলানা নূরুল ইসলাম ওলীপুরী লিখিত, জাকির নায়েকের আসল চেহারা, পৃষ্ঠা নং ৬, ৯)

ড. জাকির নায়েকের ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক কোন শিক্ষক নেই বলে যারা মন্তব্য করছেন, নি:সন্দেহে তারা না জেনে অজ্ঞতার পরিচয় দিয়েছেন। আরব দেশগুলো শেখ আহমাদ দীদাতকে একজন শ্রেষ্ঠ ইসলামিক পন্ডিত বলে বিবেচিত। ড. জাকির নায়েক নিজে তার অধীনে ইসলামের উপর পড়াশোনা করেছেন। শেখ আহমাদ দীদাতও ড. জাকিরকে তার শ্রেষ্ঠ ছাত্র বলে স্বীকৃতি দিয়েছেন। শেখ আহমাদ দীদাত সম্পর্কে জাকির নায়েকের সমালোচকগণও নিজ বইতে স্বীকার করেছেন যে, তিনি একজন শ্রদ্ধেয় এবং ‘হক পন্থী’ দীনের দায়ী।

ড. জাকির নায়েক আলেমদের সম্পর্কহীন কথাটিও পুরোপুরি ভুল এবং সীমাহীন মুর্খতার পরিচায়ক। বরং ড. জাকির নায়েক যে পরিমাণ আলেম আর আন্তর্জাতিক শীর্ষ ইসলামী ব্যক্তিদের সমন্বয়ে দীনের কাজ করেন, বর্তমান বিশ্বে তার দ্বিতীয়টি খুঁজে পাওয়া দুষ্কর হবে। ড. জাকির নায়েকের যে কোন গবেষণা ও বক্তব্যে তার এই উলামা টীমের অবদান নি:সন্দেহে অনস্বীকার্য। তার আলোচনায় ইলমী এবং ইজতিহাদী বিষয়াবলীর সুক্ষ্মাতিসুক্ষ্ম উপস্থাপনই বলে দেয় যে, এগুলো রচনা ও গ্রন্থনার পেছনে কত মেধাবান আর বিজ্ঞ আলেমদের অবদান ছিলো।

আরবের প্রায় সকল শীর্ষ ইসলামী পন্ডিতদের সাথে ড. জাকির নায়েকের সম্পর্ক অত্যন্ত দৃঢ়। গত রমজানে ড. জাকির নায়েকের প্রোগ্রামে অংশগ্রহণ করার জন্য কাবা শরীফের সম্মানিত ইমাম, শায়খ সুদাইসী প্রাইভেট বিমান নিয়ে ছুটে আসেন এবং অনুষ্ঠান শেষ করে আবার মক্কায় ফিরে যান।

এছাড়াও বর্তমান আধুনিক যুগে আরব-আজমের বড় বড় শায়খ ও আলেমদের সাথে ড. জাকির নায়েকের যে কি পরিমাণ যোগাযোগ, বিজ্ঞ আলেমদের কত বড় টিম নিয়ে জাকির নায়েক গবেষণা করেন, তার কোনরূপ ধারণা না নিয়ে কেবলমাত্র কল্পনাপ্রসূতভাবে ‘ড. জাকির নায়েকের কোন শিক্ষক ও নির্দেশক নেই’ বলে মন্তব্য করা অপবাদ বৈকি।

কোন ব্যক্তিকে ইসলামের জন্য উপকারী না ক্ষতিকর তা মূল্যায়ন করার একমাত্র গ্রহণযোগ্য পদ্ধতি হচ্ছে কুরআন এবং হাদীস। কেবলমাত্র কোন মাদ্রাসার থেকে আলেম হওয়ার ‘সনদ’ না থাকা কিংবা প্রচলিত আলেমদের মতো বেশ-ভুষা না থাকাই একজন ব্যক্তিকে ‘পথভ্রষ্ঠ’ কিংবা গোমরাহ বলার জন্য যথেষ্ট নয়। কারো কোন সুনির্দিষ্ট বক্তব্য বা লেখনীর ব্যাপারে কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে সুনিশ্চিত বৈপরিত্বের প্রমাণ ব্যতীত কেবলমাত্র ‘’অনেক আলেম তার বিপক্ষে’ বক্তব্য দিয়েছেন’ বলা গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। যতক্ষণ না সেই সকল আলেমদের বিরোধীতার কারণ গুলো (ইখতেলাফ পূর্ণ মাসআলার বাইরে) সুনিশ্চিতভাবেই কুরআন সুন্নাহ বিরোধী বুঝা যাবে। না হলে বর্তমান বিশ্বে ইহুদী এবং খৃষ্টানদের মধ্যেও কুরআন-হাদীসের উপর অভিজ্ঞ লক্ষ লক্ষ পাওয়া যাবে। তাদের সুন্নাতী লেবাস পোষাকও আছে। ইসলামী পন্ডিতদের অধীনে ছাত্র হিসেবে তারা পড়াশোনাও করেছে। তাই বলে তারা ইসলামের কল্যাণকামী বা মিত্রপক্ষ নয়। কারণ তাদের কর্মকান্ড এবং বক্তব্য গুলোকে কুরআন-সুন্নাহর কষ্টিপাথরে যাচাই করলে তাদের গোমর ফাঁস হয়ে যাবে।

নবী আ. গণ যেহেতু নিষ্পাপ এবং স্বয়ং মহান আল্লাহর পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত ছিলেন, সাহাবীগণ যেহেতু স্বয়ং প্রিয়নবী সা. এর প্রশিক্ষণে ও তত্ত্বাধানে ছিলেন। তাদের ব্যাপারে স্বয়ং আল্লাহ পরীক্ষা নিয়েছেন বলে ঘোষণা এসেছে, ইরশাদ হয়েছে;

أُولَئِكَ الَّذِينَ امْتَحَنَ اللَّهُ قُلُوبَهُمْ لِلتَّقْوَى لَهُمْ مَغْفِرَةٌ وَأَجْرٌ عَظِيمٌ

অর্থ: “(রাসূলের প্রিয় সাহাবীগণ-) তারা হলেন সেই সকল মহান ব্যক্তি, স্বয়ং মহান আল্লাহ যাদের অন্তরের তাকওয়ার পরীক্ষা নিয়েছেন। তাদের জন্য রয়েছে ক্ষমা ও মহাপ্রতিদান।” (সূরা হুজুরাত, আয়াত: ০৩)

তাই এখন যারা বলবে যে আমরা কুরআন এবং হাদীস মানি, কিন্তু সাহাবীদেরকে মানি না, তারা আসলে হাদীসও মানে না, কুরআনও মানে না। কারণ সাহাবায়ে কিরাম রা. ছিলেন সরাসরি প্রিয়নবী সা. এর প্রত্যক্ষ তত্ত্বাধানে। রাসূল সা. ছিলেন তাদের শিক্ষক। আর সাহাবীদের ঈমান ও তাকওয়ার পরীক্ষা নিয়েছেন স্বয়ং মহান আল্লাহ। এরপর স্বয়ং আল্লাহ সাহাবীদের ব্যাপারে সার্টিফিকেট দিয়েছেন। যেমন উপরোক্ত আয়াতে বলা হয়েছে।

এছাড়া মহানবী সা. তার অসংখ্য হাদীসে সাহাবীদের সমালোচনা ও নিন্দাবাদ করতে কঠোরভাবে নিষেধ করেছেন। এরপরও যারা সাহাবীদের সমালোচনা করবে, মহান আল্লাহর পরীক্ষায় সন্তুষ্ট না হয়ে নিজেরাও তাদের পরীক্ষা নিতে চাইবে, তারা নি:সন্দে কুরআন এবং হাদীসের উপর পূর্ণাঙ্গ আস্থাশীল নয়। তবে অনেকের হয়তো প্রশ্ন আছে যে, তাহলে সাহাবীদের কারো জীবনে যদি কোন গুনাহ হয়েছে বলে প্রমাণ পাওয়া যায় তাহলে সেটিও কি আমরা মেনে নেবো?

এর জবাব হলো, সাহাবীগণ যেহেতু রাসূলের পর্যবেক্ষণে ছিলেন, রাসূল যেহেতু তাদের শিক্ষক ছিলেন, তাই ছাত্রের সাময়িক দূর্বলতার সমাধান তাদের শিক্ষক এবং আমাদের সকলের প্রিয় নবী সা. কি দিয়েছিলেন? তিনি যেই সমাধান দিয়েছিলেন সেটিই আমাদের গ্রহণ করতে হবে। আর বুঝতে হবে যে, এই সমাধানটি সারা বিশ্বের অনাগত সকল মানুষকে জানিয়ে দেয়ার জন্যই মহান আল্লাহ এমনটির অবতারণা করেছিলেন। । ভুলের উপর আমাদের আমল করা যেমন ভুল তেমনি সেই ভুল নিয়ে আমাদের বিশাল গবেষণায় মত্ত্ব হওয়াও অনুচিত যেহেতু এ ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞার সুস্পষ্ট হাদীস আছে। – আর এমন সামান্য ব্যতিক্রম খুব কম ক্ষেত্রেই পাওয়া যাবে । তারা অবশ্যই আমাদের চেয়ে অনেক অনেক শ্রেষ্ঠ ও মহান। তাই সাহাবীগণ অবশ্যই সমালোচনার উর্ধ্বে। আর সাহাবীদের সমালোচনা না করা কিংবা তাদেরকে গালমন্দ না করার জন্য রাসূলের অনেক হাদীসও বর্ণিত হয়েছে (কলেবর না বাড়ানোর জন্য যার বিস্তারিত উদ্ধৃতি হতে বিরত রইলাম)।

নবী এবং সাহাবী ব্যতীত পৃথিবীর আর কোন মানুষই সমালোচনা ও পর্যালোচনার উর্ধ্বে নয়। আর এই সমালোচনা ও পর্যালোচনার মানদন্ড বা মাপকাঠিও নির্ধারিত, তা হচ্ছে কুরআন এবং হাদীস।

একইভাবে কোন ব্যক্তির কাছ থেকে (ইখতেলাফপূর্ণ মাসআলা ব্যতীত) কুরআন এবং হাদীসের সাথে সাংঘর্ষিক কোন বক্তব্য পাওয়া গেলে অবশ্যই তার সেই বক্তব্যকে বর্জন করতে হবে। তাকে সংশোধনের চেষ্টা করতে হবে। তবে সাথে সাথে এটাও স্মরণ রাখতে হবে যে, একজন ব্যক্তির একটি ভুলের কারণে তার সকল কাজকেই বাতিল করে দেয়া যাবে না। একজন মানুষের একটি পদস্খলন যেমন গ্রহণযোগ্য নয়, তেমনি একটি পদস্খলনের কারণে তার বাকী সকল ভালো কাজও পরিত্যাজ্য হতে পারে না। এক্ষেত্রে সকলকেই বাড়াবাড়ি এবং ছাড়াছাড়ি পরিহার করে মধ্যম পন্থা অবলম্বন করতে হবে।

৪. “ড. জাকির নায়েকের কুরআন তিলাওয়াত শুদ্ধ নয়।” (মাওলানা নূরুল ইসলাম ওলীপুরী লিখিত, জাকির নায়েকের আসল চেহারা, পৃষ্ঠা নং ৯)

– নি:সন্দেহে প্রতিটি মুসলমানের জন্য পবিত্র কুরআন শুদ্ধভাবে তিলাওয়াত করা দরকার। ইমাম সাহেবের তিলাওয়াত যদি লাহনে যলী হয় তাহলে তার ইমামতি শুদ্ধ হয় না এব্যাপারেও কারো দ্বিমত নেই।

এটা ঠিক যে ড. জাকির নায়েকের আরবী উচ্চারণ খানিকটা আটকে যায়। শুধু আরবী উচ্চারণই নয় বরং যারা ড. জাকির নায়েকের আলোচনা শুনেছেন তারা দেখেছেন যে, ড. জাকির নায়েকের ইংরেজি ভাষা ও বক্তব্যও অতোটা শ্র“তিমধুর নয়। তার ইংরেজি শব্দ উচ্চারণও আটকে যায় এবং শব্দগুলো খানিকটা ভেঙ্গে ভেঙ্গে আসে। জন্মগতভাবে কিংবা কারণবশত: যদি কারো মুখে জড়তা থাকে তাহলে এমনটি হতে পারে। তার তিলাওয়াত শুনে আমার যা মনে হয়েছে তা হলো, শারীরিক কোন ত্র“টি থাকার কারণেই সম্ভবত: তার শব্দের উচ্চারণ অতটা শ্র“তিমধুর নয়।

যারা আগ্রহ করে তার আলোচনা শুনতে যান বা শুনেন তারা তার কথা এজন্য শুনেন না যে তাতে সূর, তাল, লয় কিংবা উচ্চাঙ্গের সাহিত্য-লালিত্যপূর্ণ ভাষা ও শৈল্পিক ব্যাকরণ আছে। বরং তারা তার থেকে বিভিন্ন বিষয়ের উপর তথ্য-তত্ত্ব এবং যৌক্তিক ও প্রামাণ্য আলোচনা শোনার জন্য।

তবে এটা যদি শারীরিক কারণে হয়ে থাকে তাহলে অবশ্যই কিছু করার নেই। কিন্তু যদি তিলাওয়াত ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে এটা দূর করার কোন ব্যবস্থা থাকে তাহলে তা করা দরকার। আর যদি এটি শারীরিক সমস্যা নাও হয়ে থাকে তাহলেও এটি এমন কোন বিষয় নয়, যার ফলে তার জন্য দীনের দাওয়াত দেয়া বন্ধ রাখতে হবে। উচ্চারণ সমস্যার কারণে যেমনিভাবে একজন মুসলিমের উপর নামাজ পড়া, রোজা রাখার বিধান রহিত হয় না, একইভাবে উচ্চারণ সমস্যার কারণে ড. জাকির নায়েককে ‘দীনের দাওয়াত ও তাবলীগ’ বন্ধ করে দিতে হবে এমনটিও আবশ্যক নয়। বরং এটা তো আরো প্রশংসনীয় যে, হযরত বিলাল রা. কিংবা হযরত মূসা আ. এর মতো মহান ব্যক্তিরা যেমন নিজেদের উচ্চারণ সমস্যা থাকা সত্ত্বেও দীনের দাওয়াত নিয়ে এগিয়ে গেছেন তেমনি জাকির নায়েকও কষ্ট করে হলেও দীনের দাওয়াত দিয়ে যাচ্ছেন।

সর্বোপরি ড. জাকির নায়েক যেহেতু ইমাম কিংবা কিরাআতের প্রশিক্ষক নন, তাই এই বিষয়টি দিয়ে তাকে অভিযুক্ত করা কোনভাবেই যুক্তিসঙ্গত নয়।

৫. “ড. জাকির নায়েকের অপব্যখ্যা : প্যান্ট-শার্ট-টাই পড়া জায়েয।” (মুফতী মীযানুর রহমান কাসেমী লিখিত বই, ডা. জাকির নায়েকের ভ্রান্ত মতবাদ, শেষ পৃষ্ঠা)

– পোষাকের ব্যাপারে এই অভিযোগ অনেকের। আমাদের সমাজে প্রচলিত ও স্বাভাবিক শার্ট-প্যান্ট অবশ্যই তাকওয়ার পোষাক নয় -এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু তাই বলে এটি যে হারাম, আজ পর্যন্ত কাউকে তা বলতে শোনা যায়নি। কারণ পোশাকের ব্যাপারে ইসলামের ৭ টি মূলনীতি রয়েছে।

যেমন: ১. সতর ঢাকতে হবে। ২. শরীরের কাঠামো বোঝা যেতে পারবে না। ৩. এমন স্বচ্ছ হতে পারবে না, যার দ্বারা ভেতরের অবয়ব দেখা যায়। ৪. বিপরীত লিঙ্গের পোষাক হতে পারবে না। ৫. বিপরীত লিঙ্গকে আকৃষ্টকারী পোষাক হতে পারবে না। ৬. অমুসলিমদের ধর্মীয় পোষাক হতে পারবে না। ৭. অহংকার প্রকাশ করে এমন পোষাক হতে পারবে না। (অনেক হাদীসের দ্বারা এই মূলনীতি গুলো বের করা হয়েছে। লেখা সংক্ষিপ্ত করার জন্য বিস্তাতির উদ্ধৃতি দেয়া হতে বিরত থাকতে হবে।)

এই ৬ টি বিষয়ের মধ্যে সাধারণ প্যান্ট-শার্ট পড়ে না। তবে স্কীন টাইট অনেক প্যান্টের দ্বারা যেহেতু শরীরের নিম্নাংশের অবয়ব ফুটে উঠে তাই এমন প্যান্টও পরা যাবে না। (ইসলামে পোষাক কেমন হতে হবে? আলোচনায় জাকির নায়েকও এটি বলেছেন।) টাইয়ের ব্যাপারে বিভিন্ন জনের বিভিন্ন মত আছে। কেউ বলছেন এটি খৃষ্টানদের বিশেষ আলামত হিসেবে এসেছে আবার কেউ বলছেন এটি পাশ্চাত্যের শীত প্রধান দেশে প্রয়োজনীয় একটি পোষাক হিসেবে বিবেচিত হয়। কিন্তু টাইকে কোন খৃষ্টানও নিজেদের ধর্মীয় চিহ্ণ বলে দাবী করেছে এমন প্রমাণ কেউ দিতে পারেন নি। তারপরও যেহেতু এটা নিয়ে মতভেদ তাই আমার মতে মুসলমানদের জন্য বিশেষভাবে দীনের দায়ীদের জন্য এটি না পরাই সর্বোত্তম। (অনেক অনুষ্ঠানে ড. জাকির নায়েকও টাই ছাড়া বক্তব্য দিয়েছেন)।

মুফতী মীযানুর রহমান ছাড়াও জাকির নায়েকের সমালোচকগণের প্রায় সকলেই জাকির নায়েকের প্যান্ট-শার্ট-টাই পড়ার কঠোর সমালোচনা করেছেন এবং বলতে চেয়েছেন যে এটি ইসলামী পোষাক নয়। কিন্তু কিভাবে এটি ইসলামী পোষাক নয়? এ ব্যাপারে তারা কোন সুস্পষ্ট বক্তব্য তুলে ধরতে পারেন নি। অন্যান্য বিষয়ের মতো এক্ষেত্রেও কোন কুরআন সুন্নাহর আলোকে কোন প্রামাণ্য আলোচনা করেন নি।

তবে কেউ কেউ রাসূলের একটি হাদীসের দ্বারা দূর্বলভাবে তাদের মন্তব্য প্রমাণ করতে চেয়েছেন। মুসনাদে আহমাদ ও আবূ দাউদ শরীফের উদ্ধৃতি দিয়ে মিশকাত শরীফের ৪৩৪৭ নং সেই হাদীসটি হলো:

عن ابن عمر قال : قال رسول الله صلى الله عليه وسلم. مَنْ تَشَبَّهَ بِقَوْمٍ فَهُوَ مِنْهُمْ.

অর্থ: “হযরত ইবনে উমর রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, মহানবী সা. ইরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি (আকীদা-বিশ্বাস ও বিধর্মীদের ধর্মীয় রীতি-নীতি গ্রহণের ক্ষেত্রে) যেই সম্প্রদায়ের সাথে সামঞ্জস্যশীল হবে, সে তাদেরই অন্তর্ভুক্ত হবে।” (মিশকাত শরীফ : ৪৩৪৭ নং হাদীস)

এই হাদীস বর্ণিত হয়েছে মুসলিমদের জন্য অন্য ধর্মের ও অন্য মতাদর্শের লোকদেরকে আকীদা-বিশ্বাস এবং সেই বিশ্বাস থেকে উৎসারিত ধর্মীয় চিহ্ণ সমূহ বর্জন করার নির্দেশ হিসেবে। আর যে কোন পোষাকের ক্ষেত্রেও যদি সেটি ভিন্ন ধর্মের ধর্মীয় চিহ্ণ হিসেবে সেই ধর্মের লোকদের কাছে নিশ্চিত হয়ে থাকে তাহলে তা যে মুসলমানদের জন্য ব্যবহার হারাম এ ব্যাপারেও কোন দ্বিমত নেই। কিন্তু দু:খজনক বিষয় হলো এই হাদীসের দ্বারা স্বাভাবিক শার্ট-প্যান্টকে হারাম বলাটা কোনভাবেই মেনে নেয়া যায় না। কেননা এগুলো খৃষ্টান কিংবা বিধর্মীদের ধর্মীয় চিহ্ণ নয়। শুধুমাত্র ইহুদী-খৃষ্টানদের জন্যই এগুলো নির্দিষ্ট নয়। বরং সাধারণ পোষাক হিসেবে ইহুদী-খৃষ্টানদের মতো কোটি কোটি মুসলমান আজ এগুলো পড়ছে। আর বিধর্মীদের ধর্মীয় চিহ্ণের বাইরে যে কোন পোষাক যেহেতু মুসলমানরাও পরতে পারে এবং জায়েজ তাই স্বাভাবিক শার্ট-প্যান্টও যে জায়েজ সে ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই।

যেহেতু এই ব্যাপারে মত-পার্থক্য বা সন্দেহ আছে তাই এটি পরিহার করাই উত্তম। বিশেষত: দীনের দায়ীদের জন্য শার্ট-প্যান্টের পরিবর্তে তাকওয়ার পোষাক লম্বা জামা-পাজামা বা জুব্বা পড়াই অধিক ভালো। একইভাবে সুস্পষ্ট হারাম নয় এমন পোষাকের ব্যবধানের কারণে কাউকে ভিন্নধর্মের এজেন্ট কিংবা সে ইসলামের ক্ষতি করছে বলে প্রচার করাও নি:সন্দেহে অগ্রহণযোগ্য।

৬. পর্দার ব্যাপারে ড. জাকির নায়েকের শিথীলতা। তার অনুষ্ঠানে পুরুষ-মহিলাদের অংশগ্রহণ।

– মহিলাদের মুখমন্ডল পর্দার অন্তর্ভুক্ত হবে কি না তা নিয়ে স্বয়ং ইমামদের মধ্যেই ইখতেলাফ রয়েছে। মহান আল্লাহ মহিলাদের পর্দার ব্যাপারে বলেছেন,

وَقُلْ لِلْمُؤْمِنَاتِ يَغْضُضْنَ مِنْ أَبْصَارِهِنَّ وَيَحْفَظْنَ فُرُوجَهُنَّ وَلا يُبْدِينَ زِينَتَهُنَّ إِلا مَا ظَهَرَ مِنْهَا.

অর্থ: “আর মুমিন নারীদেরকে বল, তারা তাদের দৃষ্টিকে সংযত রাখবে এবং তাদের লজ্জাস্থানের হিফাযত করবে। আর ‘যা সাধারণত প্রকাশ পায়’ তা ছাড়া তাদের সৌন্দর্য তারা প্রকাশ করবে না।” (সূরা নূর, আয়াত ৩১)

এই আয়াতে ‘যা সাধারণত প্রকাশ পায়’ বাক্যের ব্যাখ্যায় হাত, পায়ের পাতার সাথে মুখকেও খোলা রাখা যাবে বলে হযরত ইবনে আব্বাস, মুজাহিদ ও আতা (রহিমা.) মত দিয়েছেন। সুতরাং মহিলারা এটা খোলা রাখতে পারবে। যদিও আহনাফের মতে বর্তমান সময়ে মহিলাদের মুখমন্ডল খোলা রাখার দ্বারা ফিতনা সৃষ্টির সম্ভাবনা থাকায় এটিও ঢাকতে হবে। ড. জাকির নায়েকও তার If Label Shows Your Intent Wear It বা “মুসলিমদের পোষাক কেমন হওয়া উচিত?” শীর্ষক আলোচনার আলোচনায় মহিলাদের পর্দার ব্যাপারে ইমামদের বিভিন্ন মতের কথা সমানভাবে তুলে ধরেছেন।

এক্ষেত্রে আমাদের মতের সাথে তার দলীল নির্ভর দ্বিমত থাকতে পারে। কিন্তু তাই বলে তার প্রামাণ্য বক্তব্যের বিপক্ষে তার সম্পর্কে কটু মন্তব্য করা শোভা পায় না।

৭. “ডা. জাকির নায়েক চতুর্থ খলীফা হযরত আলী রা. কে উম্মতের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ বলে দাবী করেছেন- যা মূলত: ভ্রান্ত শিয়া ফিরকার আকীদাবিশ্বাস। -নাউযুবিল্লাহ।

এক্ষেত্রে ডা. জাকির নায়েক বলেছেন যে, আবূ বকর সিদ্দীক রা. যে উম্মতের মধ্যে শ্রেষ্ঠ -এর কোন দলীল-প্রমাণ পাওয়া যায় না।” (গবেষণা প্রতিবেদন, মাসিক আদর্শ নারী, মে ২০১১, পৃষ্ঠা নং ১৩)

গবেষণা প্রতিবেদন বলা হলেও উপরোক্ত কথা দুটি ড. জাকির নায়েক তার কোন আলোচনায় বলেছেন তার কোন সূত্র বা উদ্ধৃতি দেয়া হয়নি। পত্রিকা কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করা হলে তারা বলে এ বিষয়টি তারা খোঁজ নিয়ে পরে জানাবেন। অর্থাৎ ‘অনুসন্ধানী প্রতিবেদন’ আগে প্রকাশ হয়ে গেছে অনুসন্ধান ছাড়া, পরে অনুসন্ধান করে সূত্র জানানো হবে। কিন্তু পরের মাস জুনের পত্রিকাতেও জবাব পাওয়া যায় নি। উল্টো জাকির নায়েক সম্পর্কে নতুন নতুন পরস্পর সাংঘর্ষিক কথা বলা হয়েছে। জুন মাসের আদর্শ নারী পত্রিকায় জাকির নায়েক সম্পর্কে আরো মিথ্যা অপবাদ দেয়া হয়েছে।

৮. “তিনি গায়রে মুকাল্লিদ (আহলে হাদীস) সম্প্রদায়ের লোক হিসেবে এ সম্প্রদায়ের মতাদর্শের প্রচার-প্রসারকে নিজের মেনুফেক্ট নির্বাচন করেন। দ্রষ্টব্য: http:/Is the Logic of Zakir Naik Reliable?” (গবেষণা প্রতিবেদন, মাসিক আদর্শ নারী, জুন ২০১১, পৃষ্ঠা নং ৫)

গত মে মাসের আদর্শনারী পত্রিকায় জাকির নায়েকের বিরুদ্ধে আরোপিত অভিযোগের ক্ষেত্রে জাকির নায়েকের কথা গুলো কখন কোথায় বলেছেন, তার সূত্র ও রেফারেন্স না পেয়ে আমরা ‘পাক্ষিক মুক্ত আওয়াজ’ নামক একটি ইসলামিক পত্রিকার পক্ষ থেকে মাসিক আদর্শ নারী পত্রিকার সম্পাদক জনাব মুফতী আবুল হাসান শামসাবাদী সাহেবের কাছে ফোন করেছিলাম। তার কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিলো যে, তিনি তার পত্রিকায় জাকির নায়েকর কথার যেই উদ্ধৃতি দিয়েছেন সেগুলো জাকির নায়েক কখন, কোথায়, কোন আলোচনায় বলেছেন?

তিনি বলেছিলেন, আমরা বিশ্বস্ত সূত্রে জানতে পেরেছি। আমরা তখন তার কাছে এর প্রমাণ চাইলাম এবং সূত্র দিতে বললাম। তখন তিনি আমাদের এই বলে আশ্বস্ত করলেন যে, এ ব্যাপারে আরো গবেষণা হচ্ছে, আগামী মাসে সূত্র জানানো হবে।

এরপর এলো জুন মাস। এ মাসের আদর্শ নারী পত্রিকায়ও পূর্বের মতোই জাকির নায়েকের বিরুদ্ধে “জাকির নায়েক সম্পর্কে উত্থাপিত প্রশ্নাবলীর জবাব” শিরোনামে আরেকটি গবেষণা প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে স্বয়ং সম্পাদক আবুল হাসান শামসাবাদী সাহেবের নিজ নামে। ভালো কথা। আশা করলাম এখন হয়তো জাকির নায়েকের কোন ভুলের প্রমাণ পাওয়া যাবে। জাকির নায়েক প্রতিবেদনের প্রথম পাতাতে জাকির নায়েকের পরিচয় উল্লেখ করে উইকি পিডিয়ার সূত্র দেয়া হযেছে। মেনে নিলাম। কারণ বিশ্বের যে কোন বরেণ্য ব্যক্তির জীবন বৃত্তান্তই উইকিপিডিয়াতে পাওয়া যাবে। একটি উদ্ধৃতি পেয়ে খানিকটা খুশিই হয়েছিলাম। যে যাক এবার হয়তো আরো কিছু যৌক্তিক কোন পয়েন্ট পাওয়া যাবে। কিন্তু উইকিপিডিয়া ও অন্যান্য সূত্রের ইংরেজি লিংক দেখে খানিকটা দ্বিধান্বিত হয়েছি। কারণ যারা ইন্টারনেট ব্যবহার করেন তারা সকলেই জানেন যে ইন্টারনেটে যে কোনো ওয়েব সাইট বা লিঙ্কের ইরেজি অক্ষর গুলো সব ছোট হাতের হয় এবং সেখানে মাঝখানে কোন স্পেস থাকে না।

কিন্তু আদর্শ নারী পত্রিকায় দেয়া সূত্রে দেখা যাচ্ছে ইংরেজি বানানে মাঝে মাঝে বড় অক্ষর এবং একটু পর পর স্পেস। এর চেয়েও বড় অসঙ্গতি মনে হলো অধিকাংশ লিংকেই কোন ওয়েব পেজ এর নাম নেই দেখে। দ্বিতীয় লিঙ্কটি হলো http:/Is the Logic of Zakir Naik Reliable? দ্বিতীয় এই লিঙ্কটি একটু যাচাই করে দেখার জন্য লিঙ্কটি হুবহু কপি করে আমার ইন্টারনেট এক্সপ্লোরার এ পেষ্ট করলাম। এন্টার দিলাম। কিন্তু স্বাভাবিকভাবে কিছু আসলো না। উইকিপিডিয়াতে দিলাম সেখানেও নো রেসাল্ট শো করলো। শেষ পর্যন্ত গুগল এ সার্চ এর ঘরে এটা পেষ্ট করে এন্টার দিলাম। তারা কয়েকটা ওয়েবের নাম দেখালো যেখানে নাকি এই লেখাটি আছে। সেটি হলো: http:/www.unchangingword.com/aboutus.php তো এই ওয়েব পেজে এসে দেখলাম জাকির নায়েকের বিরুদ্ধে অনেক কথাই এখানে লেখা হয়েছে।

ওয়েব পেজটির প্রথম পাতা কুরআনের ছবি দিয়ে খুব সুন্দর করে সাজানো হয়েছে। আরবীতে কালিমাতুল্লাহ শব্দটিও লেখা হয়েছে। তার মধ্যে খৃষ্টানদের বিরোধীতা করে তিনি যে সব কথা বলেছেন তাও খন্ডন করার চেষ্টা করা হয়েছে। এটা দেখে একটু থমকে গেলাম। এবার আগের চেয়ে ভালো করে দেখার চেষ্টা করতে লাগলাম এই ওয়েব পেজটা কাদের? কারা জাকির নায়েকের বিরোধীতা করছে? একটু খুঁজতেই দেখলাম খুবই গুরুত্বপূর্ণ কলেবরে একটি লিঙ্ক দেয়া, লিঙ্কটির নাম The Titles of Hazrat Isa Masih In the Qur’n এটা দেখে আমি এমন শক খেয়েছি! খোদার কসম করে বলতে পারি, আমার সামনে সিংহ দেখলেও আমি এতোটা আঁতকে উঠতাম না। পাঠক হয়তো এর মধ্যেই বুঝে গেছেন। এটা হচ্ছে খৃষ্টানদের একটি ওয়েব সাইট। যেখানে কুরআনের বিভিন্ন আয়াতের বিকৃত ব্যখ্যা করে হযরত ঈসা আ. কে আল্লাহর পূত্র সাব্যস্ত করার চেষ্টা করা হয়েছে এবং কুরআনে হযরত ঈসা আ. এর নাম আছে দেখিয়ে মুসলমানদের বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করা হয়েছে। এছাড়াও এই ওয়েবের বিভিন্ন লেখায় বাইবেলের পক্ষে প্রচারণা চালানো হয়েছে খুব সুক্ষ্মভাবে। যা অভিজ্ঞ কেউ ছাড়া সাধারণ কোন মুসলমানের জন্য বুঝা ও উপলব্ধি করা খুবই কঠিন। প্রায় অসম্ভব।

খৃষ্টানদের গোমর ফাঁক করে দেয়ার কারণে তারা যে জাকির নায়েকের উপর ক্ষুব্ধ এটা আমি আগেই শুনেছি। কিন্তু মাওলানা আবুল হাসান শামসাবাদী সাহেবের মতো এমন বিচক্ষণ একজন আলেম এবং আদর্শনারী পত্রিকার মতো এমন গুরুত্বপূর্ণ একটি মাসিক পত্রিকা তাদের মত প্রমাণের জন্য খৃষ্টানদের ওয়েবের সাহায্য নিয়েছে! এটা আমি কি করে মেনে নেই? আমার মনে হচ্ছে আমি মাটির নিচে চলে যাই। আল্লাহ তাদেরকে হেদায়াত দিন। আগ্রহী পাঠকরা চাইলে আমার কথার সত্যতা যাচাইয়ের জন্য এই লিঙ্কে গিয়ে দেখে আসতে পারেন। http:/www.unchangingword.com/aboutus.php তবে খৃষ্টানদের এই চতুর ওয়েব দেখে বিভ্রান্ত হবেন না যেনো!

এ ছাড়া আদর্শ নারী পত্রিকায় আর যেসকল লিঙ্ক দেয়া হয়েছে তার অধিকাংশই হলো ভারত পাকিস্তানের কবর-মাজার ও পীর-ফকীর পুজারী ভন্ড বিদআতীদের ওয়েব সাইট। কিছু ব্লগের লিঙ্কও দেয়া হয়েছে। যারা তাদের পার্থিব স্বার্থে জাকির নায়েক ব্যাঘাত ঘটানোয় সাংঘাতিক ক্ষুব্ধ হয়ে অনলাইনে জাকির নায়েকের সমালোচনার ঝর তুলেছেন।

এছাড়া দেওবন্দ মাদ্রাসাসহ পাকিস্তানের কিছু মাদ্রাসা থেকেও ইখতিলাফী ও মতবিরোধপূর্ণ মাসআলায় জাকির নায়েকের সমালোচনা করা হয়েছে এবং এ ক্ষেত্রে হানাফী মাযহাবের লোকদেরকে ইখতেলাফী মাসআলায় জাকির নায়েকের মত অনুসরণ করতে নিষেধ করা হয়েছে। এটা হতেই পারে। সুন্নাত-নফল মাসআলা গত ক্ষেত্রে জাকির নায়েকের উদ্ধৃত প্রমাণ্য আলোচনার চেয়েও বেশি প্রামাণ্য কোন বক্তব্য থাকলে সে বিষয়ে আমল করা যেতে পারে। কিন্তু তাই বলে কুরআন-হাদীসের দলীল নির্ভর বক্তব্য প্রদানকারী কাউকে গোমরাহ বলাটা তো অবশ্যই অনুচিত ও হারাম কাজ।

এছাড়াও আদর্শ নারী পত্রিকার এই রিপোর্টের শেষে বলা হয়েছে “এ বিষয়ে আরো বিস্তারিত জানতে চাইলে fatwa against dr zakir naik অথবা fatwa about dr zakir naik লিখে সার্চ দিলে অনেক তথ্য পাওয়া যাবে।” আমার বলতে হচ্ছে যে, ইন্টারনেটে fatwa against islam/quran/muhammad অথবা fatwa about islam/quran/muhammad লিখে সার্চ দিলে আরো অনেক অনেক বেশি তথ্য পাওয়া যাবে। তাহলে এখন এগুলোও কি বাতিল ও অগ্রহণযোগ্য হবে -নাউযুবিল্লাহ।

আসলে আমাদের দুর্ভাগ্য, যে আমরা এমন কিছু ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক নেতৃবৃন্দের অনুসরণ করছি, যারা না বুঝে ইখলাসের সাথে জাতিকে গোমরাহ করছেন। এই আদর্শ নারী পত্রিকা বাংলাদেশের ইসলামপ্রিয় জনগণের মাঝে প্রায় ৫০/৬০ হাজার কপি বিক্রি হয়। এখন একজন আবুল হাসান শামসাবাদী সাহেবের অন্ধ আক্রোশের কারণে আজ এই পত্রিকার এক বিশাল পাঠক শ্রেণী বিভ্রান্ত হচ্ছে। তারা যদি খৃষ্টানদের সেই ওয়েব সাইট দেখে বিভ্রান্ত হয় তাহলে এর দায়ভার কে নেবে? একজন মুসলমানকে বাতিল ও ভ্রান্ত বলার জন্য কি আমাদের এখন খৃষ্টানদের সহযোগিতা নিতে হবে?

অথচ তারা যদি একটু চিন্তা করতেন তাহলে নিজেরাই বুঝতেন যে, যেই ব্যক্তির বিরুদ্ধে খৃষ্টানরা সমালোচনা করেছে, বিদআতী ভন্ড মাজার পুজারীরা যার বিরুক্ষে লিখেছে, বৃটেন যাকে যেতে দিচ্ছে না, ভারতের মত কুফর দেশের সরকার ও তার আদালত যার বিরুদ্ধে একটি মামলায় ওয়ারেন্ট জারী করেছে সেই ব্যক্তি ড. জাকির নায়েক যে সত্যের উপর আছে এর জন্য তো এগুলোই প্রমাণ হিসেবে যথেষ্ট। আল্লাহ এদেরকে কবে সঠিক বুঝ দিবেন?

বিভ্রান্তি গুলো যেভাবে ছড়ায়:

ড. জাকির নায়েকের বিরুদ্ধে আরো অনেক গুলো অভিযোগ করা হয়েছে। বাস্তবতা বোঝার জন্য সেগুলো উল্লেখ করার আগে একটি উপমা দেয়া খুবই প্রাসঙ্গিক ও প্রয়োজন মনে করছি।

একটি উদাহরণ: সউদী আরবের একজন বিখ্যাত ইসলামী পন্ডিত ও দার্শনিকের নাম হচ্ছে শায়খ মারুফ আহমেদ। যিনি মিডিয়ার মাধ্যমে সুন্দর ও সাবলীলভাবে অত্যন্ত ইখলাসের সাথে মানুষকে ইসলামের দিকে দাওয়াত দেয়ার জন্য খুবই প্রসিদ্ধ ও বিখ্যাত। তার দাওয়াতের কারণে অনেক মানুষ ভিন্ন ধর্ম ছেড়ে ইসলাম গ্রহণ করছে। তার মাধ্যমে প্রতিনিয়ত ইসলামের অনেক খেদমত হচ্ছে। তার অনেক ভক্ত ও শুভানুধ্যায়ী আছেন। অপরদিকে বাংলাদেশের সিলেট অঞ্চলে মাওলানা রায়হান উদ্দীন খান নামক আরেকজন মুহাক্কিক আলেম আছেন যিনি দেশ জুড়ে এমনকি দেশের বাইরেও প্রতিনিয়ত ইসলামের সুমহান বাণী ছড়িয়ে দেয়ার জন্য রাত-দিন একাকার করে ওয়াজ ও বয়ান করে যাচ্ছেন। মানুষদেরকে ইসলামের সহীহ কথা-বার্তা শোনাচ্ছেন। তার মাধ্যমে হাজার হাজার মানুষের অনেক ভুল ধারণা ভেঙ্গে যাচ্ছে। শিরক-বিদআত ছেড়ে তারা সুন্নাতের দিকে ফিরে আসছেন। তারও অনেক ভক্ত ও শুভানুধ্যায়ী আছেন। তবে এই দুই শায়খ ও হযরতের নিজেদের মধ্যে কোন দিন যোগাযোগ হয় নি। উভয়ে উভয়ের কাজ নিয়ে ব্যস্ত আছেন।

এখন ইসলাম বিদ্বেষীরা দেখলো যে, এই দুই মহান ব্যক্তির দ্বারা খুব অল্প সময়েই ইসলাম দূর দূরান্তে ছড়িয়ে পড়ছে। মুসলমানরা তো ইসলামের উপর পূর্ণাঙ্গ আমল করা শুরু করেছেই, এমনকি অমুসলিমরা পর্যন্ত ইসলাম গ্রহণ করছে। এই অবস্থা যদি চলতে থাকে তাহলে অচিরেই ইসলাম বিজয়ের কাছাকাছি পৌঁছে যাবে। তাই তারা দীনী দাওয়াতের এই গতি থামানোর জন্য অনেক চিন্তা-ভাবনা করতে লাগলো। কিন্তু তাদের উভয়েই যেহেতু ইখলাসের সাথে দীনের কাজ করছেন তাই তাদেরকে সরাসরি দীনের কাজ থেকে বিরত রাখা সম্ভব নয়। তাদেরকে বিরত করতে হলে এবং ইসলামের উপকারের বদলে তাদের দ্বারা ইসলামের ক্ষতি করতে হলে তা কৌশলে করতে হবে। নেক সূরতে ধোঁকায় ফেলতে হবে তাদেরকে। এজন্য তারা আশ্রয় নিলো খুবই নিন্দনীয় এক কূট-ষড়যন্ত্রের। (মুসলিমদের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ আর মারাত্মক ভ্রাতৃঘাতি লড়াই জঙ্গে জামাল আর জঙ্গে সিফফিনের ঘটনার মূল প্রেক্ষাপটের আলোকে)

ইসলাম বিদ্বেষীরা দশ জন দশ জন করে দুই দলে ভাগ হয়ে দুই শায়খের মুরীদ হলো। এবার নতুন মুরীদ ও ভক্তরা তাদের শায়খ ও উস্তাদের জান প্রাণ খিদমতে নিজেদেরকে আত্মনিয়োগ করলো। শায়খ ও উস্তাদের যে কোন প্রয়োজনে নিজেরা সর্বাত্মক চেষ্টা করে। অর্থ, সময় ও শ্রম দিতে কখনো কার্পন্য করে না। ফলে অল্প দিনের মধ্যেই উভয় শায়খের কাছে এই নতুন মুরীদরা প্রিয় পাত্রে পরিণত হলেন। অনেকদিন এভাবে যাওয়ার পর এবার ইসলাম বিদ্বেষীরা তাদের মূল কাজ আরম্ভ করলো। প্রথমে শায়খ মারুফ আহমেদ দা. বা. এর কাছে তার সেই নতুন মুরীদরা গিয়ে বললো, শায়খ! আলহামদুলিল্লাহ আপনি তো দীনের অনেক খেদমত করছেন। কিন্তু ইসলামের শত্র“রাও বসে নেই। তারা মুসলিমদের ছদ্মাবরণে এমন এমন লোক তৈরী করছে যারা দীনের দিকে মানুষকে আহ্বান করে কিন্তু আসলে তারা লোকদেরকে পথভ্রষ্ঠ ও গোমরাহ করছে।

একথা শুনে শায়খ মারুফ আহমেদ আশ্চর্য হয়ে বললেন, তাই নাকি? এটা কি করে সম্ভব? তোমরা কিভাবে জানলে এই কথা? কোথায় শুনেছো।

তখন তারা বললো, এরকম তো আগেও হয়েছে। বর্তমানেও হচ্ছে। বিশেষত: বাংলাদেশে একজন খুব বড় মাপের আলেম বলে নিজেকে প্রচার করছে আর ইসলামের অপব্যখ্যার মাধ্যমে লোকদেরকে বিভ্রান্ত করছে।

এবার শায়খ মারুফ বললেন, লা হাওলা ওয়ালা কুওয়াতা ইল্লাবিল্লাহ। কি বলো তোমরা। এটাও কি সম্ভব? আমি তো তার ব্যাপারে খারাপ কিছু শুনি নি। তোমরা যদি কিছু শুনে থাকো তাহলে আমাকে যাচাই করে জানাও। আমি তো ব্যস্ততার কারণে নিজে খোঁজ নিতে পারছি না। এবার সেই মুরীদরা কয়েকদিন পর জানালো যে, শায়খ, আমরা অনেক অনুসন্ধান করেছি এবং সেই মাওলানার ব্যাপারে বেশ গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পেয়েছি।

শায়খ মারুফ বললেন, কি সেই তথ্য? আমাকে তাড়াতাড়ি বলো!

তারা বললো, বাংলাদেশের সেই মাওলানার নাম হচ্ছে মাওলানা রায়হান উদ্দীন খান। তার বাড়ী সেই দেশের সিলেটে। আমরা তার অনেক আলোচনা শুনেছি। দেখেছি তিনি সব ক্ষেত্রে ভুল ব্যাখ্যা দেন। আমরা এখানে তার একটি কথা উল্লেখ করছি যার দ্বারাই আপনি বুঝতে পারবেন যে সে ইসলামের কত বড় ক্ষতি করছে।

প্রসঙ্গত: এক ওয়াজে মাওলানা রায়হান উদ্দীন খান বলেছিলেন, “আমার দেশের বাড়ি সিলেটে। শাহ জালাল মাজার সংলগ্ন মাজার রোড এলাকায়। আমার বাসাও মাজারের পাশেই। সেই মাজারের সাথে একটি মাদ্রাসা আছে। যার দ্বারা ইসলামের খেদমত হচ্ছে।” এবার সেই ইসলাম বিদ্বেষীরা শায়খ মারুফকে মাওলানা রায়হান উদ্দীন খানের এই ওয়াজ বিকৃত করে শোনালো। আর বললো দেখেছেন শায়খ, এই ওয়াজে রায়হান নামের সেই লোক বলেছে যে, সে মাজারে থাকে। তার কাছে মাজার ভালো লাগে এবং মাজারের দ্বারা নাকি ইসলামের উপকার হচ্ছে।

যেহেতু শায়খ মারুফ সাহেব আরবের লোক। তাই তিনি বাংলা অতো ভালো বুঝেন না। কেবল মাজার আর ইসলাম শব্দটি বুঝতে পেরেছেন। বাকি বিষয় তিনি তার ‘বিশ্বস্ত’ মুরীদদের বক্তব্য থেকে সত্যি মনে করে নিলেন। তিনি চিন্তায় পড়ে গেলেন! কি অবস্থা এমন একজন বড় মাপের প্রসিদ্ধ মানুষের! যে মাজারে থাকে এবং মাজারকে ভালো বলে।

এবার সেই মুরীদরা শায়খ মারুফকে খুব শক্ত করে ধরলো যে, শায়খ একমাত্র আপনিই মুসলিম জাতিকে এই লোকের বিভ্রান্ত মতবাদ থেকে রক্ষা করতে পারেন। আপনি যদি তার ‘আসল চেহারা’ জাতিকে খুলে না দেখান তাহলে পুরো জাতি গোমরাহ হয়ে যাবে। আপনি এখনি বই লিখুন, মিডিয়ায় বক্তব্য দিন, প্রয়োজনে টাকা ও ব্যয় যা লাগে দীনের জন্য আমরাই তার ব্যবস্থা করে দিবো। দীনের নুসরাতের জন্য নিজেদের সকল কিছু আপনার কাছে অর্পন করবো।

এবার শায়খ মারুফ আহমেদ মুসলিমদের উপকারের জন্যই ইখলাসের সাথে মাওলানা রায়হান উদ্দীন খানের বিরোধীতা করাকে ফরজ মনে করলেন। দীনের অন্যান্য কাজ বাদ দিয়ে তিনি রায়হান উদ্দীনের সমালোচনা করে বই লিখলেন, “মাওলানা রায়হান উদ্দীনের আসল চেহারা।” “মাওলানা রায়হান উদ্দীনের ভ্রান্ত মতবাদ।” ইত্যাদি ইত্যাদি। এরপর সারা দেশে এটা নিয়ে শুরু হলো ব্যাপক আলোচনা সমালোচনা। এখন অপর পক্ষ যদি এই সকল অভিযোগের কারণে পাল্টা অভিযোগ করা শুরু করে তাহলেই ইসলাম বিদ্বেষীদের চাহিদা শতভাগ সফল।

প্রিয় পাঠক!

এখনই কোন বিরূপ মন্তব্য না করে, এই সম্পূর্ণ কাল্পনিক ঘটনাটি ড. জাকির নায়েকের বিরুদ্ধে উত্থাপিত আমাদের দেশের কয়েকজন নন্দিত আলেমের নিম্নোক্ত কয়েকটি উদ্ধৃতির সাথে একটু মিলিয়ে দেখুন। তারপর ভাবুন।

ড. জাকির নায়েকের বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হয়েছে তিনি বলেছেন: (কিন্তু কোন আলোচনায় বা কোথায় বলেছেন তা অভিযোগকারীদের কেউই উল্লেখ করেন নি বা উদ্ধৃতি দেন নি।)

৯. “যারা হিন্দুস্থানে বাস করে তারা সকলেই হিন্দু, কাজেই আমাকেও (ধর্মীয় দিক থেকে) হিন্দু বলতে পারেন।” (মুফতী মীযানুর রহমান কাসেমী লিখিত বই, ডা. জাকির নায়েকের ভ্রান্ত মতবাদ, শেষ পৃষ্ঠা)

ড. জাকির নায়েক তার “হিন্দু ইজম এন্ড ইসলাম” শীর্ষক আলোচনার শুরুতেই বলেছেন, “হিন্দু শব্দটির একটি ভৌগলিক বিশেষত্ব রয়েছে। হিন্দু শব্দটি এসেছে সিন্ধু থেকে। সিন্ধু শব্দটি উচ্চারণে কঠিন হওয়ার কারণে লোকেরা একে সহজ করে ‘হিন্দু’ বলে উচ্চারণ করা শুরু করে। এরপর এক সময় সিন্ধুনদের পাশে বসবাসকারী ভারতীয়দেরকে বোঝানোর জন্য হিন্দু শব্দ ব্যবহার শুরু হয়।” (এনসাইক্লোপিডিয়া অফ রিলিজিওন অফ এথিক্স ৬ নং খন্ডের ৬৯৯ অধ্যায় দ্রষ্টব্য।)

‘হিন্দু ইজম এন্ড ইসলামে’র এই আলোচনার পুরোটা আমি কয়েকবার শুনেছি, কিন্তু কোথাও ড. জাকির নায়েকের “কাজেই আমাকেও হিন্দু বলতে পারেন” এই কথা শুনিনি। সমালোচকও তার বক্তব্যে কোন রেফারেন্স দেন নি। সম্ভবত: তিনি তার উর্বর মস্তিস্ক দিয়ে ড. জাকির নায়েকের কথা, ‘অভিধানে হিন্দু শব্দের অর্থ লেখা হয়েছে সিন্ধুনদের অববাহিকায় বসবাসকারী ভারতীয়দেরকে’ -এ থেকেই পরের অংশ “কাজেই আমাকেও হিন্দু বলতে পারেন” নিজ থেকেই সংযুক্ত করে দিয়েছেন অথবা পরিস্কার ভৌগলিকভাবে ব্যবহৃত একটি শব্দের দ্বারা ইচ্ছাকৃতভাবে একজন মুসলমানকে ইসলাম থেকে বের করে দিতে চেয়েছেন। (আমাকে হিন্দু বলতে পারেন -এই কথা জাকির নায়েকের মুখে যদি কেউ কোন আলোচনায় শুনে থাকেন হালে লিঙ্ক দিবেন আশা করি অথবা আলোচনার নাম বলবেন।)

প্রিয় পাঠক! উপরের সেই কাল্পনিক ঘটনার সাথে এবার মিলিয়ে দেখুন, একজন মুসলিমের বিরোধীতা করার জন্য কোথাকার পানি কোথায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে।

১০. “ড. জাকির নায়েক কাজা নামায অস্বীকার করেছেন এবং বলেছেন যে, কাজা নামায পড়ার দরকার নেই। তাওবা করে নিলেই চলবে।” (গবেষণা প্রতিবেদন, মাসিক আদর্শ নারী, মে ২০১১, পৃষ্ঠা নং ১৩)

অথচ এটি ড. জাকির নায়েকের বিপক্ষে একটি সম্পূর্ণ ভুল ও অসত্য তথ্য। ‘কাজা নামাজ’ আর ‘উমরী কাজা নামাজ’ দু’টি আলাদা আলাদা বিষয়। জাকির নায়েক তার কোন আলোচনাতেই ‘কাজা নামাজ’ এর বিপক্ষে বলেন নি। তবে ‘উমরী কাজা নামাজের’ ব্যাপারে শুধু জাকির নায়েক নন, আরবের আরো অনেকেরই ভিন্ন মত আছে। তাদের মতের স্বপক্ষে দলীলও আছে, বিপক্ষেও কথা আছে। (দীর্ঘ সূত্রতা পরিহার করার জন্য উভয় পক্ষের দলীল দেয়া থেকে বিরত থাকতে হচ্ছে)

তাই এক্ষেত্রেও তার সাথে আমাদের দ্বিমত হতে পারে। কিন্তু তাই বলে ‘উমরী কাজা’ নামাজকে শুধুমাত্র ‘কাজা নামাজ’ বলে চালিয়ে দেয়া তো প্রকাশ্য অন্যায়।

১১. “রাসূল সা. এর একাধিক বিবাহ ছিলো রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের জন্য।” (মুফতী মীযানুর রহমান কাসেমী লিখিত বই, ডা. জাকির নায়েকের ভ্রান্ত মতবাদ, শেষ পৃষ্ঠা)

এখানেও ড. জাকির নায়েকের বক্তব্যকে বিকৃত করা হয়েছে। জাকির নায়েক তার “ইসলামে নারীর অধিকার” শীর্ষক আলোচনায় এক প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, “প্রিয়নবী সা. এর একাধিক বিয়ের অনেকগুলো কারণ ও যৌক্তিক পয়েন্ট ছিলো। তার মধ্যে একটি ছিলো জনকল্যাণ ও সমাজ সেবা। যেমন হযরত খাদিজা রা. এর সাথে বিবাহ। প্রিয়নবী সা. এর দু’টি বিবাহ ছিলো স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে। একজন হযরত খাদিজা রা. ও অপরজন হযরত আয়শা রা.। এছাড়া মহানবী সা. এর বাকি বিবাহ গুলো প্রত্যেকটিই ছিলো বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে। হয়তো সমাজের কোন সংস্কার, বিভিন্ন গোত্রের সাথে ভ্রাতৃত্বপূর্ণ সম্পর্ক সৃষ্টি কিংবা রাজনৈতিক ও ভৌগলিক কারণ।”

এই পুরো বক্তব্যের মাঝখান থেকে “রাজনৈতিক ফায়দা হাসিল” বলে বিকৃত উদ্ধৃতি প্রদান নি:সন্দেহে অনুচিত।

আর মহানবী সা. একাধিক বিয়ের কোনটির ক্ষেত্রে যদি রাজনৈতিক বিচক্ষণতার কারণ থেকে থাকে তাহলে তা অস্বীকার করাটা এতো বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে গেলো কেন, তা বোধগম্য নয়। এটা কি কেবল বিরোধীতার জন্য বিরোধীতা?

১২. ড. জাকির নায়েক বলেছেন, “ইসলামে দাঁড়ির তেমন একটা গুরুত্ব নেই।” (মাওলানা নূরুল ইসলাম ওলীপুরী লিখিত, জাকির নায়েকের আসল চেহারা, পৃষ্ঠা নং ২৭)

কিন্তু জাকির নায়েক কোথায় বলেছেন যে ইসলামে দাঁড়ির তেমন একটা গুরুত্ব নেই তার কোন উল্লেখ নেই। এটি সম্পূর্ণ মিথ্যা একটি অপবাদ ছাড়া আর কিছুই নয়। উল্টো জাকির নায়েকের আলোচনায় এর উল্টো চিত্র ভেসে উঠেছে। If Label Shows Your Intent Wear It বা “মুসলিমদের পোষাক কেমন হওয়া উচিত?” শীর্ষক আলোচনার পুরোটা যারা শুনেছেন তারা নি:সন্দেহে দেখেছেন এবং শুনেছেন যে ড. জাকির নায়েক দাঁড়িকে কিভাবে ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ একটি আমল বলে উল্লেখ করেছেন এবং সব মুসলমানদের জন্য এটি রাখার প্রতি জোর দিয়েছেন। এছাড়াও তিনি পরিস্কারভাবে বলেছেন, “অনেকে হালকা বা পাতলা দাঁড়ি হলে কেটে ফেলে অসুন্দর দেখা যায় এই কারণে। কিন্তু যারা তাদের হালকা ও পাতলা দাঁড়ি অসুন্দর দেখা যাওয়ার পরেও কেবলমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য রাখবে, নি:সন্দেহে তারা অন্যদের থেকে অনেক বেশি প্রতিদান পাবে। আর এজন্যই আমার দাঁড়ি হালকা-পাতলা হওয়া সত্ত্বেও আমি আল্লাহর রহমত লাভের আশায় তা না কেটে রেখে দিয়েছি।”

এই আলোচনায় ড. জাকির নায়েক শুধু দাঁড়ি রাখার কথাই বলেন নি, বরং এর পাশাপাশি মাথায় টুপি পড়ার কথাও বলেছেন জোর গলায়। পোষাকের আলোচনায় স্কিন টাইট জিন্স প্যান্ট পরার কারণে পুরুষদের সতর প্রকাশ হয়ে যাওয়ার সমালোচনা করে তিনি পুরুষদের জন্য স্কিন টাইট প্যান্ট পরারও নিন্দা করেছেন। অথচ তার বিরুদ্ধেই লেখা হয়েছে, তিনি নাকি দাঁড়ির কোন গুরুত্ব দেন না। জাকির নায়েক নিজেই সুন্নতী লম্বা দাড়ি রেখেছেন। সব সময় টুপি পরিধান করে থাকেন। অন্তত: তার চেহারা দেখেছেন এমন কেউ তাকে দাঁড়ি-টুপির বিরোধী বলে ধারণা করাটা এমনিও কঠিন।

১৩. “ড. জাকির নায়েক হায়াতুন নাবী সা. অস্বীকার করেছেন।”

ড. জাকির নায়েকের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বেশি আলোচিত একটি অভিযোগ হচ্ছে তিনি নাকি ‘হায়াতুন নাবী’ সা. অস্বীকার করেছেন। কিন্তু দু:খজনক হলো, যারা তার বিরুদ্ধে এই অভিযোগ এনেছেন উপরের অভিযোগ গুলোর মতো তারা তাদের বইতে এর সূত্র হিসেবে ড. জাকির নায়েকের কোন আলোচনা বা বক্তব্যের উদ্ধৃতি দেন নি, যে তিনি কোন আলোচনায় এটি বলেছেন। সমালোচকদের একজন এক্ষেত্রে উদ্ধৃতি দিয়েছেন ভারতের খালিক সাজিদ বোখারী সাহেবের ‘হাকীকতে জাকির নায়েক’ কিতাবের। কিন্তু উচিত ছিলো জাকির নায়েকের নির্দিষ্ট বক্তব্যের উদ্ধৃতি। যাই হোক আমরা এখন পর্যন্ত এ ব্যাপারে জাকির নায়েকের কোন আলোচনায় এটি পাই নি। তবে হায়াতুন নাবী সা. এর এই বিষয়টি ভারত-বাংলাদেশের আলেম সমাজে খুবই আলোচিত একটি বিষয়। ব্যাপারটি নিয়ে খানিকটা বিভ্রান্তিও আছে। এসম্পর্কে কয়েকজন মুহাক্কিক আলেমের সাথে আলোচনা করে অর্জিত ইলম ও কিছু তথ্য নিম্নে তুলে ধরা হলো।

হাদীসের মাঝে বলা হয়েছে যে, মহানবী সা. তার কবরে ‘জীবিত।’ এর দ্বারা বলা হয় যে, আমাদের নবীর বিশেষ মর্যাদা ও সম্মান হলো তিনি ‘হায়াতুন নাবী’ সা.। বা নিজ কবরে জীবিত। তবে দুনিয়ার জীবনের ‘হায়াত’ আর আখেরাতের জীবনের ‘হায়াতে’র মাঝে পার্থক্য আছে। এই পার্থক্য নিয়েই ইখতেলাফ। কেননা, আরবীতে হায়াত এর বিপরীত শব্দ মওত। আরবী শব্দ ‘হায়াত’ বলতে আমরা বাংলায় ‘জীবিত’ বুঝে থাকি। একইভাবে আরবীতে ব্যবহৃত ‘মওত’ শব্দটির অর্থ আমরা বাংলায় ‘মৃত’ বলি। এখন আমাদের হায়াত এবং মওত শব্দের স্বাভাবিক অর্থ অনুযায়ী যদি আমরা ‘হায়াতুন নাবী’ সা. এর অর্থ ‘জীবিত নবী’ করা হয় তাহলে অবশ্যই এর বিপরীত শব্দ তথা ‘মওতুন নাবী’ বলাটা নিষিদ্ধ হতে হবে। কারণ দুটো পরস্পর বিরোধী শব্দ একই ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা যায় না। অথচ আমরা পবিত্র কুরআনে প্রিয় নবী সা. এর নামের সাথে দুটি গুরুত্বপূর্ণ স্থানে মওত বা মৃত শব্দের ব্যবহার দেখতে পাই। যেমন সূরায়ে আলে ইমরানের বলা হয়েছে,

وَمَا مُحَمَّدٌ إِلا رَسُولٌ قَدْ خَلَتْ مِنْ قَبْلِهِ الرُّسُلُ أَفَإِنْ مَاتَ أَوْ قُتِلَ انْقَلَبْتُمْ عَلَى أَعْقَابِكُمْ وَمَنْ يَنْقَلِبْ عَلَى عَقِبَيْهِ فَلَنْ يَضُرَّ اللَّهَ شَيْئًا وَسَيَجْزِي اللَّهُ الشَّاكِرِينَ.

অর্থ: “মুহাম্মাদ সা. তো একজন রাসূল। যদি তিনি মৃত্যুবরণ করেন অথবা নিহত হন তাহলে কি তোমরা তোমাদের পূর্বেকার ভ্রান্ত জীবনে ফিরে যাবে?” (সূরা আলে ইমরান : ১৪৪)

অন্যত্র বলা হয়েছে, إِنَّكَ مَيِّتٌ وَإِنَّهُمْ مَيِّتُونَ.

অর্থ “নিশ্চয়ই আপনি মৃত্যুবরণ করবেন এবং তারাও মারা যাবে।” (সূরা জুমার : ৩০)

এখন মহানবী সা. কে যদি ‘হায়াত’ শব্দের দ্বারা স্বাভাবিকভাবে জীবিত বলতে যা বুঝায় অর্থাৎ ‘দুনিয়াবী জীবন’ সেই রকম জীবিত বলা হয় তাহলে পবিত্র কুরআনের এই দু’টি আয়াতের উপর নি:সন্দেহে প্রশ্ন আসবে যে তাহলে সেখানে রাসূলের জন্য মওত বা মৃত শব্দটি ব্যবহার করা হলো কেন? আর যদি রাসূল ‘দুনিয়াবী হায়াতে’র অধিকারীই হবেন তাহলে কবরে কেন?

এই সকল বিষয়ের সহজ সমাধান হচ্ছে হাদীসে বর্ণিত ‘হায়াত শব্দের’ অর্থটিকে ‘শান’ বা বিশেষ মর্যাদা বলে ধরে নেয়া। অর্থাৎ মহানবী সা. তার কবরে বিশেষ মর্যাদা বা শান হলো তিনি সেখানে জীবিত। এটা হলো তার পরকালীন হায়াত বা জীবন। দুনিয়াবী জীবন নয়। ‘হায়াত’ শব্দের দ্বারা যে, শান বা বিশেষ মর্যাদা বোঝানো হয় তার প্রমাণ আমরা পেতে পারি কুরআনের নিম্নোক্ত আয়াত হতে। শহীদদের জন্য মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনের সূরায় বাকারায় ইরশাদ করেছেন,

وَلا تَقُولُوا لِمَنْ يُقْتَلُ فِي سَبِيلِ اللَّهِ أَمْوَاتٌ بَلْ أَحْيَاءٌ وَلَكِنْ لا تَشْعُرُونَ.

অর্থ: “যারা আল্লাহর পথে শহীদ হয়, তোমরা তাদেরকে মৃত বলো না। তারা জীবিত কিন্তু তোমরা তা অনুধাবন করতে পারো না।” (সূরা বাকারা : ১৫৪) এই আয়াতে এবং একইভাবে সূরায়ে আলে ইমরানের ১৬৯ নং আয়াতে শহীদদেরকে মৃত বলে ধারণা করতেও নিষেধ করা হয়েছে।

গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো নবী রাসূলদের ক্ষেত্রে কুরআনের কোথাও এমনটি বলা হয় নি যে, তাদেরকে মৃত বলা যাবে না, যা শহীদদের ব্যাপারে বলা হয়েছে। কিন্তু তারপরও আমরা কেউই কিন্তু শহীদদের ক্ষেত্রে ‘হায়াতুশ শুহাদা’ বলি না। এটা এজন্য যে, শহীদদের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত ‘হায়াত’ বা জীবিত শব্দের অর্থ যে, ‘শান’ বা বিশেষ মর্যাদা সে ব্যাপারে সকলেই একমত। একইভাবে প্রিয়নবী সা.ও ইন্তিকালের পর সকল মানুষের চেয়ে সবচেয়ে বেশী মর্যাদার স্তরে আছেন। একথাই বিভিন্ন হাদীসে ‘হায়াত’ শব্দ বলে বোঝানো হয়েছে।

এটি বোঝার সহজের জন্য আমরা মানুষ ও তার রূহের অবস্থা সমূহের একটি সংক্ষিপ্ত আলোচনা করতে পারি। মানুষ প্রথমে আলমে আরওয়াহ বা রূহের জগতে ছিলো। এই রূহের জগতে সকলে জীবিত ছিলো। এরপর দুনিয়ার জীবন। এই জীবনেও সকল মানুষ জীবিত। এরপর আসে মৃত্যু। মৃত্যুর মাধ্যমে মানুষ আলমে বারযাখ এ স্থানান্তরিত হয়। এই অবস্থায় উপনীত হওয়া সকলকে স্বাভাবিকভাবে মৃত বলা হয়। (ক্ষেত্র বিশেষে একেকজনের মর্যাদা অনুযায়ী শান কম বেশি হয়) এরপর আখেরাতে আবার সকলে জীবিত হবে। এই তিনটি বিষয়ে কারো কোন দ্বিমত নেই।

এখন আসুন আমরা দেখি যে, প্রিয়নবী সা. আলমে বারযাখ বা মৃত্যবরণ করার পরের অবস্থানে কিরূপ আছেন। এই অবস্থায় আমরা হাদীস দ্বারা রাসূল সম্পর্কে হায়াতের কথা জানতে পারি। যে তিনি তার কবরে জীবিত। এই জীবিত শব্দের অর্থ আমাদের মতো জীবিত নয়। অর্থাৎ এখানে জীবিত শব্দটি রাসূলের শান। সুতরাং হায়াতুন নাবী সা. এর পরিবর্তে ‘শানুন নাবী সা.’ শব্দটি অধিক উপযুক্ত। হায়াতুন নাবী সা. বলা হলেও আসলে তার দ্বারা উদ্দেশ্য হবে ‘শানুন নাবী’ সা. যা আমরা উপরোক্ত আলোচনার দ্বারা বুঝতে পেরেছি।

ড. জাকির নায়েক রাসূলের আলমে বারযাখ অবস্থার বিশেষ মর্যাদাকে অস্বীকার করেন নি কখনো। যা তার সাথে যোগাযোগের মাধ্যমে নিশ্চিত হয়েছি। সুতুরাং এখন ড. জাকির নায়েক যদি হায়াত শব্দের আমাদের বোধগম্য শাব্দিক অর্থের সাথে দ্বিমত করে থাকেন তাহলে এজন্য তাকে পথভ্রষ্ঠ বা গোমরাহ বলাটা ঠিক হবে না।

উপরে উল্লেখিত বিষয়াবলী ছাড়াও ডা. জাকির নায়েকের বিপক্ষে তারাবির নামাজ ৮ রাকাত হবে না বিশ রাকাত, জুমার খুতবা আরবীতে হওয়া জরুরী কি না, মহিলাদের মসজিদে যাওয়া ইত্যাদিসহ বিভিন্ন মাসআলা ও মাযহাবগত ভিন্নমতের কারণে অভিযোগ উত্থাপন করা হয়েছে। অথচ এ সকল ক্ষেত্রে পক্ষে বিপক্ষে উভয়েরই দলীল ও প্রমাণ রয়েছে। তাই এ সকল মতবিরোধপূর্ণ মাসআলার সূত্র ধরে একজনকে ‘ভ্রান্ত মতবাদী’ বলাটা কোন মতেই উচিত নয়। কারণ এখন যারা ড. জাকির নায়েকের বিপক্ষে একটি ভিন্ন মতের কারণে কঠিন থেকে কঠিন অভিযোগ আনছেন, তাদের বিপক্ষে এখন জাকির নায়েক যদি পাল্টা আক্রমণ ও অভিযোগ আনা শুরু করেন এবং তার মিডিয়ার মাধ্যমে বক্তব্য দেন তাহলে তখন মুসলিমদের আভ্যন্তরীন বিভেদ আর মতপার্থক্য আরো বাড়বে এবং এটা উম্মাহর বৃহত্তর ঐক্যে বিরাট ফাটল ধরানো ছাড়া আর কোন উপকারেই আসবে না।

ইখতেলাফপূর্ণ মাসআলার কারণে যদি একজন আরেকজনকে বাতিল ও গোমরাহ বলে মন্তব্য করা শুরু করেন তাহলে আরব আজমের শীর্ষ সব আলেম এমনকি চার মাযহাবের চার ইমামসহ সকল উলামায়ে কিরামের বিরুদ্ধেই গোমরাহ আর বাতিলের ফতোয়া দিতে হবে। কারণ আমরা যারা ইমাম আবূ হানিফা রহ. এর মাযহাব হিসেবে প্রসিদ্ধ হানাফী মাযহাবের অনুসারী, তারা নিজেরাও সকল মাসআলায় ইমাম আবূ হানীফা রহ. এর মত অনুযায়ী চলি না। অনেক ক্ষেত্রে বিভিন্ন মাসআলায় ইমাম আবূ হানীফা রহ. এর মতের বিপরীত মতকে আমরা গ্রহণ করেছি। যেমন: চাঁদ দেখা ও রোযা-ঈদের মাসআলায় ইমাম আবূ হানীফা রহ. এর মতে, পৃথিবীর এক প্রান্তে যদি রমজান কিংবা ঈদের চাঁদ দেখা যায় তাহলে এর দ্বারা পৃথিবীর অপর প্রান্ত পর্যন্ত সকল মুসলমানের উপর এক সাথে রোজা ফরজ হয় এবং একই দিনে ঈদ করা আবশ্যক। কিন্তু উলামায়ে আহনাফ এটা অনুসরণ করেন না। (দ্রষ্টব্য: দুররে মুখতার, আজহারুর রেওয়াতে, ফতোয়ায়ে আলমগীরী, ফাতহুল মুলহিম, রোযা এবং ঈদ অধ্যায়)

বর্গা চাষের ব্যাপারে ইমাম আবূ হানীফা রা. এর মত হলো কাউকে বর্গা চাষ দেয়া জায়েজ নেই। এটা হারাম। যার জমি আছে সে সম্ভব হলে নিজে তাতে চাষ করবে, না হলে অন্য যে চাষ করতে পারে তাকে এমনিই দিয়ে দিবে। তবে ইমাম মুহাম্মাদ ও আবূ ইউসূফ রহ. সময়ের প্রেক্ষিতে বর্গাচাষকে বৈধ বলেছেন। আমরা হানাফীরা সারা দেশে বর্গাচাষ বৈধ হিসেবেই আমল করে যাচ্ছি। (দ্রষ্টব্য হেদায়া, কিতাব)

নামাজে সূরায়ে ফাতেহা আরবী ভাষার পরিবর্তে ফারসীতে পড়া জায়েজ আছে বলে ইমাম আবূ হানীফা রহ. এর মতে। কিন্তু আমরা হানাফীরা কেউই এটাকে সমর্থন করি না। (দ্রষ্টব্য নূরুল আনওয়ার)

কুরআন পড়িয়ে, ইমামতি করে, কিংবা মাদ্রাসায় দীন শিক্ষাদানের বিনিময়ে অর্থ ও বিনিময় গ্রহণ কোন মতেই জায়েজ নেই ইমাম আবূ হানীফা রহ. এর মতে। সূরা বাকারার ৪১ নং আয়াত অনুসারে তিনি এটাকে পুরো হারাম বলে মত দিয়েছেন। (তাফসীরে মা’আরিফুল কুরআন, ৩৫ পৃষ্ঠা দ্রষ্টব্য) তবে ইমাম শাফেয়ী, ইমাম মালেক, ইমাম আহমাদ রহ. সহ জমহুর উলামায়ে কিরামের মত হচ্ছে, “যদি বায়তুল মালের পক্ষ থেকে দীনের শিক্ষক ও ধর্মপ্রচারকদের জন্য প্রয়োজনীয় ভাতার ব্যবস্থা করা না যায় এবং সেই সকল ব্যক্তিগণ দীনের কাজে ব্যস্ত হওয়ার কারণে অন্য কোন কাজ করতেও অপারগ হন, তাহলে তাদের জন্য বেতন নির্ধারণ করা বৈধ।” (তাফসীরে ইবনে কাসীর, ২৪৫ পৃষ্ঠা) বর্তমানে আমরা এই শেষোক্ত মতের উপরই আমল করে থাকি।

আজকে আমরা সকলেই ইমাম বুখারী রহ. অত্যন্ত সম্মান ও শ্রদ্ধা করি। তার লিখিত বোখারী শরীফকে সহীহ বলে মত পোষণ করি। কিন্তু এই ইমাম বুখারী রহ. এরও নিজস্ব একটি মাযহাব বা মত ছিলো। তার মতে মাতৃদুগ্ধ পানের মতো ছাগলের দুধ পান করার দ্বারাও ‘হুরমতে রিযাআত’ বা ‘দুধ সম্পর্ক’ সাবেত হবে এবং একই ছাগলের দুধ পানকারী নারী-পুরুষের মধ্যে আপন ভাই-বোনের মতো সম্পর্ক বিধায় তারা একে অপরকে বিয়ে করতে পারবে না। কিন্তু আমরা এটি অনুসরণ করি না।

বিখ্যাত সাহাবী হযরত আবূ হুরায়রা রা. এর একটি ঐতিহাসিক মত ছিলো, গরম কিছু স্পর্শ করলে উযূ ভেঙ্গে যাবে। এমনকি যদি কেউ গরম পানি স্পর্শ করে তাহলেও তার উযু ভেঙ্গে যাবে। কিন্তু আমরা বর্তমানে কেউই হযরত আবূ হুরায়রা রা. এর এই মত অনুযায়ী আমল করি না।

এধরণের আরো শত-সহস্র উদাহরণ দেয়া যাবে বিভিন্ন ইখতেলাফী মাসআলায় ইমামদের ও উলামায়ে কিরামের আভ্যন্তরীন মতপার্থক্যের। কিন্তু এর কারণে কখনই আমরা একে অপরকে বাতিল ও গোমরাহ বলি না। বরং যদি কেউ ইখতিলাফী মাসআলার কারণে কাউকে বাতিল বলে তাহলে তাকেই মুর্খ ও অবুঝ বলি। তাহলে কেন আমরা ডা. জাকির নায়েকের মতো ইসলামের এমন নিবেদিত প্রাণ দায়ীকে ইখতেলাফী মাসআলায় মত দেয়ার কারণেই বাতিল ও গোমরাহ বলবো? -এটা অবশ্যই অনুচিত কাজ। যা আমাদের পরিহার করা উচিত।

তবে ডা. জাকির নায়েক যেহেতু ‘তুলনামূলক ধর্ম পর্যালোচনার’ উপর বেশি অভিজ্ঞ, তাই একদিকে ড. জাকির নায়েকেরও যেমন উচিত মতবিরোধপূর্ণ মাসআলায় নিজেকে না জড়ানো। অপরদিকে অন্যান্য উলামায়ে কিরামদের জন্যও আবশ্যক যে, ইখতেলাফপূর্ণ মাসআলায় কারো ব্যাপারে মন্তব্য করতে যাচাই-বাছাই করা উচিত। বিশেষত: নিজ নিজ পরামর্শক ও ভক্ত-মুরীদদের অতি উৎসাহ ও বক্তব্যে প্রভাবিত না হয়ে বাস্তবিক সত্য অনুসন্ধান করা উচিত। না হলে এই উম্মাহ আবারও সেই জঙ্গে জামাল আর জঙ্গে সিফফীনের ভ্রাতৃঘাতি সঙ্ঘাতের কবলে পরবে। মহান আল্লাহ আমাদেরকে ভবিষ্যতের সেই অবাঞ্ছিত অবস্থা থেকে হেফাজত করুন।

আমরা সেই পরিস্থিতি আর চাই না। আজ আরব বিশ্বে যেখানে শিয়া-সুন্নী পর্যন্ত জালিম আমেরিকা ও তার আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়ে লড়াই করছে, মিশরে মুসলিমদের সাথে খৃষ্টানরাও জালিম হোসনি মোবারকের বিরুদ্ধে সফল আন্দোলনের মাধ্যমে আমেরিকার ক্রীড়নককে হটিয়েছে, সেখানে আমরা যদি এখনও নিজেদের মধ্যকার মুস্তাহাব আর নফল বিষয় নিয়ে একে অপরের বিরুদ্ধে পাল্টা-পাল্টি ফতোয়া আর বিবৃতি দিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ি, তাহলে এই উম্মাহ সামনে এগোবে কি করে?

তাই জাতির কর্ণধার, মহানবী সা. এর উত্তরসূরী উলামায়ে কিরামকে যুগ চাহিদার প্রেক্ষিতে এসকল বিষয় আজ গভীরভাবে ভেবে দেখতে হবে। বিশ্বজুড়ে মুসলিম উম্মাহর আর্তনাদ, অসহায় মানবতার হাহাকার আর অজুত প্রাণের আত্মত্যাগের কথা আমাদের ভুলে গেলে চলবে না।

উম্মাহ্কে ঐক্যবদ্ধ একটি প্লাটফর্মে এনে আবারও পূর্ণাঙ্গ ইসলামি জীবন ব্যবস্থা কায়েম ও মুসলিম উম্মাহ্র জন্য একমাত্র বৈধ শাসন ব্যবস্থা খিলাফত পুন:প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সকলকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে, সুনির্দিষ্ট কর্মপদ্ধতির মাধ্যমে নেতৃত্বের জন্য আজ আলেমদেরই এগিয়ে আসতে হবে। আল্লাহ তাআলা আমাদের সকলকে এ ব্যাপারে সঠিক বুঝ দিন, আমীন।

– মুহাম্মাদ ইসহাক খান

ইসলামিক ইমেইল নিউজলেটার
নতুন পোস্ট প্রকাশিত হলে সরাসরি আপনার ই-মেইল ইনবক্সে পেতে সাবস্ক্রাইব করুন।
icon

৩৪টি মন্তব্য

  1. মন্তব্য…আমরা সবাই মুসলমান, সবার উদ্দেশ্য সতূের পথে ঈমান টিকিয়ে রাখা, জাকির নায়েক তো আমাদের ভাই, তিনিও মুসলিম, ইসলামের ব্যপারে যদি কেহ সঠিক কথা, বলে থাকে তা গুহণ করে নিতে হবে, যদিও সে রাস্তার -মেথট ও হয়, আলেম হতে হবেনা, জাকির- নায়েক – ওলিপুরি – সাইদি যে হোক তাদের হক কথা গুলো গুহন করতে আপত্তি কোথায়, আর ভুল গুলো গুহন না করেন, প্রয়োজনে তাদের শুদরানোর চেষ্টা করেন! কারণ ইসলামের ব্যপারে আপনারাই তো অনেক কিছু জানেন।

  2. মন্তব্য…আপনার লেখা আমার জীবনের পড়া শ্রেষ্ঠ কয়েকটা লেখার মধ্যে একটা। এত ভাল আর এত সুন্দর করে লিখেছেন। রেফারেন্সসহ লিখেছেন তাই লেখাটার মর্যাদা অনেক বেশি। আল্লাহ (সুব:) আপনাকে আরো বেশি জ্ঞান দান করুন এবং ইসলামের খেদমতে কাজ করার সুযোগ দান করুন এই দোয়া করি। আমি আপনার আরো লেখা পড়তে চাই সেটা কিভাবে সম্ভার একটু জানাবেন। জাযাকাল্লাহু খাইরান।

  3. মন্তব্য… সাদৃশ্য
    ******
    ব্রাহ্মণ ও আলেম সমাজ
    ******************
    ডাঃ জাকির নায়েক এবং আমাদের অবস্থানঃ
    *******************************

    আপনি কোন মাদ্রাসায় পড়েছেন???
    আমাদের দেশের এক শ্রেনির আলেম এবং তাদের অনুশারিদের একটা কমন প্রশ্ন? এদের মধ্যে এমন অনেক আলেম আছে যাদের কে প্রশ্ন করা হলে কুর-আন সুন্নাহ মুতাবেক উত্তর দিতে বুকটা ফেটে যায় অথচ মুখ ফুটেনা অন্যদিকে ডাঃ জাকির নায়েক কে কোন প্রশ্ন করা হলে সেকেন্ড এর মধ্যে কুর-আন হাদিসের রেফারেন্স সহ উত্তর দিয়ে দেন, তবুও এই লোক গুলো মনে করে ডাঃ নায়েক এর শিক্ষা কোন শিক্ষাই নয় কারন উনি মাদ্রাসায় পড়েননি!! ডাঃ সাব সাদা কে সাদা-ই বলছেন আর কালো কে কালো কিন্ত দেশের আলেম দের কথা হলো এই সাদা কালো পার্থক্যকারী জ্ঞান টুকু মাদ্রাসা থেকে নেননি তাই তার কথা মানা যাবেনা!!! কি আজব প্রানির মত মনোভাব!!!? তাহলে বলা যায়না কি শুধু যারা মাদ্রাসায় লেখা পড়া করেছেন তারাই কেবল ধর্ম কর্ম করুক!!!! কারন এদের মতে তারা ছারা বাকি সবার শিক্ষায় গলত সুতরাং আমলেও গলত!!! এই আলেম এর সুযোগ্য এবং সুশিক্ষিত পিতার জ্ঞান এবং আমল ও বাতিল কারন তিনি মাদ্রাসায় পড়েননি!!! পুত্র আলেম এর কথা শুনে বা বই পড়ে ও কোন ফায়দা নেই।
    অথচ সুযোগ্য আলেম (পুত্র) শত শত ইসলামিক “কেতাব ” লিখে তা ঘরে ঘরে রাখার, পড়ার ও আমল করার মাধ্যমে জান্নাতি হওয়ার আহবান জানিয়ে আসছেন? আর তাইত বেহেস্তি জেওর, নেয়ামুল কুর-আন, মকসুদুল মুমিনিন,ফাজায়েলে আমল, বার চান্দের ফজিলত, ভেদে মারেফাত ইয়াদে খুদা,আশেকে মাশুক, খাব নামা পড়ে লাখো মানুষ তাদের ভাষায় জান্নাতি হচ্ছে!!! (না কি জাহান্নামি হচ্ছে???)।
    মিয়া আলেম আপনার কাছে আমার প্রশ্ন এখন যদি আপনার সুযোগ্য সুশিক্ষিত পিতা,ডাঃ জাকির নায়েক এবং আমরা সাধারণ শিক্ষিত গন আপনাদের লিখিত বই পড়ে হুবুহু শতভাগ তাই মানুষের সামনে বয়ান করি ও আমল করি তাহলে কি মানুষকে এই বলে শতর্ক করবেন যে “তাদের কথা মানা যাবেনা ” তাদের আমল মানা যাবেনা কারন তারা “””মাদ্রাসায়”” পড়েনি!!!? হ্যা শতর্ক করবেন যদি চরম হিংসুক আর বেওকুফ হয়ে থাকেন। আপনার লিখিত সত্য কথাগুলুই মিথ্যা হয়ে গেল অন্য কেউ বলার কারনে, কি আজিব না?
    বই গুলু ত আপনারা মাদ্রাসা পড়ুয়া আলেম গনই লিখেছেন!!! না কি ইংলিশ মিডিয়াম এর কেউ লিখেছে?
    আপনি (আলেম) অথবা আপনার মান্যবর উস্তাদ ও পীরগন মাদ্রাসার সিলেবাসের বাইরে যে হাজার হাজার বই লিখেছেন তা কেন লিখেছেন এবং কার জন্য লিখেছেন??? এর জবাব কি?? না কি সবই ভুল লিখেছেন? যা অন্য কেউ পড়ে আমল করলে ভুল হবে?? তাহলে কেন কোনদিন দেখলাম না যে মসজিদে বা কোন মজলিশে যখন অতি সাধারণ একজন লোক ফাজায়েলে আমল বা ভেদে মারেফাত ইয়াদে খুদা পড়ে কান্নাকাটির রোল ফেলে দেয়, মানুষেরা মাওলার প্রেমে! হাবুডুবু খায়,চিক মারে,লাফ দিয়ে গাছে উঠে যায় তখন বললেন সাধারণ মানুষের জন্য শুধু বই পড়ে বয়ান করা ও আমল করা যায়েয নয়??? এই ফতুয়া কোন দিনও কেন দিলেন না যে মাদ্রাসায় না পড়ে শুধু শুধু নেয়ামুল কুর-আন, মকসুদুল মুমিনিন, বার চান্দের ফজিলত, রাসুল এর নামাজ পড়ে আমল করা যাবেনা, জান্নাতি ও হওয়া যাবেনা???

    আপনাদের তরিকার বা মতের বা পছন্দের সকল “কেতাব ” যে কেউ পড়ছে, বয়ান করছে, আমল করছে আপনাদের কোন সমস্যা নেই, আপনার সুযোগ্য সুশিক্ষিত পিতা, ডাঃ জাকির নায়েক এবং অন্যান্য সুশিক্ষিত ব্যাক্তিগন যখন কুর-আন থেকে হুবুহু কথা বলে, প্রমানিত সহি হাদিস থেকে উদ্ধৃতি দেয়, সে অনুযায়ী আমল করে ও আমলের দাওয়াত দেয় তখন আপনার তালা লাগানো বুক ও মুখ দুটো ই খুলে এই ফতুয়া বের হয় যে “সে কোন মাদ্রাসায় পড়েছে “? শুধু কুর-আন হাদিস পড়েই বয়ান করা ও আমল করা ঠিক হবেনা!!! কি দ্বিমুখী নীতি? কি হাস্যকর ফতুয়া? বিভেক খাটালেই বুঝে আসে।

    ব্রাহ্মণ সমাজে কিন্তু সাধারণ লোকের ধর্ম কর্ম শেখা ও চর্চা করা অপরাধ। এক সময় ছিল তখন সাধারণ কোন হিন্দু ধর্মীয় বই পড়লে শাস্তি সরুপ গলন্ত সিসা তার কানের মধ্যে ঢেলে দেওয়া হত।
    আমাদের দেশের মাদ্রাসায় পড়ুয়া কিছু লোকের মনোভাব ঠিক ব্রাহ্মণ দের মতই ।
    তারা ভাবে ধর্ম শুধু তারাই শিখেছে তারাই শুধু ধর্ম নিয়ে কথা বলবে, ঠিক বলুক বা বেঠিক বলুক সামনে দাঁড়ানো উচ্চশিক্ষিত, বিভেক সম্পন্ন সুস্থ্য মানুষটিকে তাই মেনে নিতে হবে বোবার মত। হিন্দু ধর্মে যেমন ব্রাহ্মণ দের একচেটিয়া ব্যাবসা চালু আছে তেমনি আমাদের মাদ্রাসা পড়ুয়া কিছু লোকের অভিলাষ ছিল ইসলামের নামে একচেটিয়া ব্যাবসা শুধু তারাই করে যাবে, সেটা হউক তাবিজ বিক্রি করে, ভাড়ায় দুয়া ইউনুছ বা কুর-আন খতম করে, মিলাদের নাম করে জিলাপি মিস্টির সাথে কিছু হাদিয়া পকেটে ভরার মাধ্যমে, পীর মুরিদির নামে বিনা পুজির লাভজনক ব্যাবসার মাধ্যমে অথবা ওয়াজের নামে মানুষকে সত্য মিথ্যা স্বপ্ন ও ভেজালে ভরা কেচ্ছা কাহিনী বলার মাধ্যমে।
    কিন্ত আল্লাহতালার অশেষ রহমত যে আজ সাধারণ মানুষ, বিভেক সম্পন্ন শিক্ষিত মানুষ গুলু সহি শুদ্ধ ইসলামিক বই পড়ে সত্য জানতে পেড়েছে এবং তা প্রচার ও আমল করে যাচ্ছে, যার দরুন ঐ সুবিধাবাদী ধর্ম ব্যাবসায়ি দের স্বার্থেওওসওওস ব্যাপক ভাবে আঘাত হানে ও ক্ষতি সাধন হয়, ফলে তারা শুধু ঐ সমস্ত লোকদের বিরুদ্ধেই ফতুয়া দিয়ে থাকে “” তারা কোন মাদ্রাসায় পড়েছে””??
    অথচ তাদের মতের পক্ষে লেখা ভ্রান্ত কেচ্ছা কাহিনী, বানোয়াট গল্প ও স্বপ্ন যখন কোন মাদ্রাসা পড়ুয়া অথবা মাদ্রাসা না পড়ুয়া সাধারণ ধর্ম জ্ঞান হীন লোক পড়ে, বয়ান করে ও আমল করে জান্নাতি অথবা জাহান্নামি হচ্ছে সেদিকে তাদের দৃস্টি নেই কোন ফতুয়া নেই। এরা কতই না সুবিধাবাদী ফতুয়া বাজ!!!!

    অথচ দুনিয়াতে মাদ্রাসা থাক বা না থাক দ্বীন শিক্ষা ও আমল করা সবার জন্যই ফরজ, সে কোথা থেকে শিখল সেটা বিষয় নয় আসলে সে সঠিক শিখল কিনা সেটা হচ্ছে মুল বিষয়।
    ইসলামি জ্ঞান কোন মাদ্রাসায় সীমাবদ্ধ নয়, জ্ঞান মুলত রক্ষিত প্রথমত আল্লাহর কাছে,তার পর আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের মাঝে এবং বান্দার ভুলে যাওয়ার প্রবণতার কারনে তা কিতাবেও সংরক্ষণ করা হয়েছে। আমরা অনেক মনিষীর ইতিহাস জানি যারা কোন মাদ্রাসায় যাননি বরং তাদের পিতা বা কোন শিক্ষাগুরুর কাছ থেকে ইসলাম শিখেছেন এবং নিজের অধ্যয়ন বলে আল্লাহর রহমত এ উস্তাদের চাইতেও অনেক বেশি স্মরণীয় বরণীয় হয়ে আছেন উজ্জ্বল তারকার ন্যায়। সুতরাং শুধু মাদ্রাসাকেই কেবল ইসলামি জ্ঞান শিক্ষার কেন্দ্র ভাবা চরম বোকামি ছারা আর কি?? তাহলে ডাঃ জাকির নায়েক কোন মাদ্রাসায় পড়েছে এই প্রশ্ন কেন????

  4. আমি আল্লাহর দরবারে শুকরীয়া জ্ঞাপন করছি, আল হামদুলিল্লাহ।মহান আল্লাহ যুগে যুগে এই পৃথিবীতে নবী ও রাসুলগনকে পাঠিয়েছেন পথহারা আত্নভুলা মানুষকে পথ দেখানোর জন্য।আর ড:জাকির নায়েকেও পাঠিয়েছেন একজন মানুষ হিসেবে।একজন ইসলামের দায়ী হিসেবে।আমি তার দিকে আকৃষ্ঠ হয়ে বলছি না।আমি তার লেকচার অনেক শুনেছি। সব লেকচারের উপর বিবেচনা করে বলছি,আমি খুদার কসম করে বলছি, তার লেকচারে যত সত্যতা,স্পষ্ঠতা পেয়েছি বর্তমান জগতের এমন কোনো বক্তার মধ্যে আমি ততটা পাইনি।অলি পুরি সাহেব ড:জাকির নায়েকের যে অপব্যাখ্যা করেছেন সেটা খুবই দুঃখ জনক।অলি পুরি সাহেব কুর-আন ও হাদিসের বর্ননা ভুলেগেছেন নতুবা তার স্বার্থ হাসিলের জন্য এমনটা করেছেন।অলি পুরি সাব নিজেই বলেছেন ড:জাকির নায়েকের লেকচার শুনেন নি। প্রত্যেক্ষভাবে না শুনে কারো ব্যাপারে মন্তব্য করা কি? তিনি ভুলে গেছেন।আমি আলেম সমাজের প্রতি আহবান করব, দয়াকরে আপনারা অন্ধ অনুকরণ করবেন না।আপনারা যদি অন্ধ অনুকরণ করেন তাহলে শান্তির ধর্ম ইসলাম কে অপমানিত করবেন।কারো বেপারে কিছু বলতে হলে তার কথার অর্থ বুঝে বলার চেষ্ঠা করোন।আল্লাহ আমরা সবাইকে সঠিক দিক বুঝার শক্তি দান করুক।আমিন

  5. উলামায়ে কেরাম ততক্ষণ পর্যন্ত জাকির নায়েকের সাথে ছিলেন যতক্ষণ পর্যন্ত সে সঠিক ছিল। যখন সে কুরান ও সুন্নাহর বিরুদ্দে চলে গেল তখন তারা তার বিরুদ্দে কলম ধরলেন।আপনি তো অনেক কিছু বাদ দিয়ে দিলেন। ইয়াজিদ, কুরানে ভুল,আল্লাহ কে হিন্দুদের দেবতাদের নামে ডাকা যাবে।এসব কি ভুলে গেছেন।ভাই এক বালতি দুধ নষ্ট হওয়ার জন্য এক ফোটা গরুর ছেনা যথেষ্ট। সত্যকে বুঝতে চেষ্টা করুন।

    1. আহারে মামুন মিয়া, তোমরা বাংলাদেশে নেংটিদের সিদুর পরছ, হারাম, মদ, জুয়া, যেনা-বেভিচার, খুন, গুম, ধর্ষণ ইত্যাদি অনায়াসেই সহ্য করে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছো। আর কুটি ইন্দুর হইয়া বরেণ্য ইসলাম প্রচারক ডা. জাকির নায়েকের সমালোচনা করছ। আহ কি পন্ডিত রে……….. আচ্ছা বলতো, পরম দয়ালূ কোন ভাষার শব্দ? সৃষ্টিকর্তা কোন শব্দ? সর্বশক্তিমান কোন শব্দ? তুমি আল্লাহকে যদি বাংলা, ফার্সি, আরবি, ইত্যাদি ভাষায় ডাকতে পার তাহলে অন্য ভাষায় কেন নয়? আরে ছাগলের দল………. যে নামেই ডাকুক না কেন স্বয়ং আল্লাহকেই তো ডাকা হচ্ছে। তোমাদের মত পীর বাবাকে দয়াল বাবা, তারপর মুর্শিদ ইত্যাদি ইত্যাদি নামে তো ডেকে শিরক করছে না। আর হিন্দুদের বেদ, গীতায় ঈশ্বরকে উদ্দেশ্য করে যে নামগুলো ব্যবহার করা হয়েছে সেগুলো মূলত আল্লাহকেই উদ্দেশ্য করে ব্যবহার করা, কিন্তু হিন্তু পন্ডিতেরা সেগুলোকে মূর্তিতে রূপ দিয়ে শিরক করে চলেছে। এখানে কি ঐ শব্দগুলো ভূল??? না-কি শব্দগুলোকে ভুল ব্যবহার করা হচ্ছে সেটা ভুল???

  6. Dear i-onlinemedia,
    Assalamualaikum…..
    Ami dr.zakir naik er ai kicu vranto bissaser virodita kore apnader ai likha gulo copy kore ekta android application creat korte cai .. ate kore ai likha gulo aro vhalovhabe choriye deya jabe asa korchi.tai apnader ai likha gulo copy korar permission ceye ai message ti dicci.. asa kori apnara apotti rakhben na..tottosurte apnader website er link diya hobe Insaallah.tai as fast as possible apnader comment amake jabadben asa kori.. apnader reply er opekhay thakbo.Khuda hafez. ..

মন্তব্য করুন

Back to top button