বিভ্রান্তির সমাধান

যদি সবকিছু পূর্ব নির্ধারিত হয়ে থাকে তাহলে সেগুলো সম্পাদনের জন্যে মানুষকে জবাবদিহি করতে হবে কেন?

যেকোন পাপকার্য সম্পাদনের ঘটনা কি তাকদিরে লিখিত এবং আল্লাহ কর্তৃক পূর্ব নির্ধারিত? যদি উত্তর হ্যাঁ হয়, তাহলে কেন আল্লাহ তাঁর কিছু বান্দার জন্যে পাপ কার্য সম্পাদনের নিয়তি নির্ধারন করলেন এবং কিছু বান্দার জন্যে ভালো কাজ সম্পাদন নির্ধারণ করলেন, আমরা কি সকলেই সমান মানুষ নই ?

উত্তর দিচ্ছেন: শাইখ সালিহ আল মুনাজ্জিদ

আলহামদুলিল্লাহ, একজন ব্যক্তি অবশ্যই দুটি বিষয়ে বিশ্বাস করবেন:
(১) যে আল্লাহ, তাঁর মর্যাদা সর্বাধিক, তিনি সকল কিছুর সৃষ্টিকর্তা এবং এই সৃষ্টিজগতে কোন কিছুই তাঁর ইচ্ছা ব্যতীরেকে সংঘটিত হয় না। তিনি জানেন অনাগত বিষয় সম্পর্কে , জানেন সামনে কি ঘটতে চলেছে এবং তিনি তাকদীরে সবকিছু নির্ধারিত করেছেন এবং কিতাবে লিপিবদ্ধ করে রেখেছেন আসমান ও জমীন সৃষ্টির পঞ্চাশ হাজার বছর পূর্বে। একথাটি সহীহ হাদীসে রাসুলুল্লাহ সাল্লল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণিত হয়েছে। তিনি ন্যায়বিচারক এবং কারো প্রতি বিন্দুমাত্র যুলুম করেন না। কেননা তিনি তাঁর সৃষ্টি থেকে অমুখাপেক্ষী এবং তাদের কাছে তাঁর কোন কিছুর প্রয়োজন নেই। তিনি পরম দয়ালু এবং চিরন্তনভাবে তাদের প্রতি মহান দাতা, কাজেই কিভাবে তিনি তাঁর সৃষ্টির প্রতি অবিচার যুলুম করতে পারেন ?

কুর’আন ও সুন্নাহর বহু স্থানে তাকদীরের এই নীতিটি বর্ণিত হয়েছে। যেমন এই আয়াতসমূহে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা বলছেন:

إِنَّا كُلَّ شَيْءٍ خَلَقْنَاهُ بِقَدَرٍ

আমি প্রত্যেক বস্তুকে পরিমিতরূপে (ক্বাদর সহকারে) সৃষ্টি করেছি। [সূরা কামার ৫৪;৪৯]

“পৃথিবীতে এবং ব্যক্তিগতভাবে তোমাদের উপর কোন বিপদ আসে না; কিন্তু তা জগত সৃষ্টির পূর্বেই কিতাবে লিপিবদ্ধ আছে। নিশ্চয় এটা আল্লাহর পক্ষে সহজ”। [সূরা হাদীদ ২২]

রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেনঃ “আল্লাহ সবকিছু সৃষ্টির পঞ্চাশ  হাজার বছর পূর্বে সৃষ্টি সংক্রান্ত যাবতীয় নিয়তি (তাকদীর)  লাওহে-মাহফূযে লিপিবদ্ধ করে রেখেছেন।”(মুসলিমঃ ২৬৫৩)

(২) মানুষের স্বাধীন ইচ্ছা ও ক্ষমতা রয়েছে যার দ্বারা সে কোন কাজ যেমন করতে পারে তেমনিভাবে কোন কাজ না করে তা থেকে বিরতও থাকতে পারে। সে বিশ্বাস যেমন করতে পারে তেমনি অবিশ্বাসও করতে পারে, সে মান্য করতে পারে কিংবা অমান্য করতে পারে। আর এ স্বাধীনতার কারণেই তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে, দায়ী করা হবে এবং কর্মানুসারে পুরষ্কৃত কিংবা শাস্তি প্রদান করা হবে। যদিও এসব কিছুই আল্লাহ জানেন যে সে কি ধরণের কাজ সম্পাদন করবে, সে মানুষ নিজের জন্য কি নির্বাচন করবে এবং তার শেষ পরিণতি ও গন্তব্যস্থল কি হবে। কিন্তু আল্লাহ তাকে কোন মন্দ কাজ করাতে বাধ্য করেন না, কিংবা কাউকে কুফর নির্বাচন করতে বাধ্য করেন না, বরং তিনি সুস্পষ্টভাবে মানুষকে হেদায়তের পথ দেখিয়ে থাকেন। আর এ কারণে  তিনি নবী-রাসূল (তাদের সকলের উপর শান্তি বর্ষিত হোক) প্রেরণ করেছেন এবং আসমানী কিতাব নাযিল করেছেন এবং সঠিক পথ দেখিয়ে দিয়েছেন। যে কেউ ভ্রান্ত পথের অনুসরণ করে সে তা করে নিজের ক্ষতির জন্যেই।

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা বলেন:

“বলুনঃ সত্য তোমাদের পালনকর্তার পক্ষ থেকে আগত। অতএব, যার ইচ্ছা, বিশ্বাস স্থাপন করুক এবং যার ইচ্ছা অমান্য করুক”। [সূরা কাহাফ ১৮;২৯]

“আমি তাকে পথ দেখিয়ে দিয়েছি। এখন সে হয় কৃতজ্ঞ হয়, না হয় অকৃতজ্ঞ হয়”। [সূরা ইনসান ৩]

“অতঃপর কেউ অণু পরিমাণ সৎকর্ম করলে তা দেখতে পাবে এবং কেউ অণু পরিমাণ অসৎকর্ম করলে তাও দেখতে পাবে। [সূরা যিলযাল ৭-৮]

“আওয়াজ আসবেঃ এটি জান্নাত। তোমরা এর উত্তরাধিকারী হলে তোমাদের কর্মের প্রতিদানে।” [সূরা আরাফ ৪৩]

“তোমরা তোমাদের কৃতকর্মের কারণে স্থায়ী আযাব ভোগ কর।” [সুরা সাজদা ৩২;১৪]

আল্লাহ সুবহানহু ওয়া তায়ালা বলছেন, মানুষের মধ্যে যারা বিশ্বাস করে ঈমান আনে এবং সৎ কর্ম করে তা করে নিজের ইচ্ছায় এবং স্বাধীনভাবে তা নির্বাচন করে, এরপর সে জান্নাতে প্রবেশ করে অথবা সে অবিশ্বাস করে, মন্দ কাজ করে নিজের ইচ্ছায় এবং স্বাধীনভাবে তা নির্বাচন করে, এরপর সে জাহান্নামে প্রবেশ করে।

প্রত্যেক ব্যক্তি নিজের অন্তর-বিবেক বুদ্ধি প্রয়োগ করে কিংবা আশেপাশের মানুষদের দেখে জানে যে  আমাদের কোন কাজটি ভাল কিংবা মন্দ, কোনটি আনুগত্য কিংবা অবাধ্যতা পাপ-এগুলো করা কিংবা না করা আমাদের নিজেদের ইচ্ছা, এবং আমরা এমন কোন শক্তিও অনুভব করি না যা জোর করে আমাদের এগুলো করতে বাধ্য করে।
আপনি যেমন অভিশাপ দিতে পারেন, শপথ করতে পারেন, মিথ্যা-গীবত করতে পারেন ঠিক তেমনিভাবে পারেন আল্লাহর প্রশংসা করতে, তার মর্যাদার কথা ঘোষণা করতে, ক্ষমার জন্যে প্রার্থনা করতে, সত্য কথা বলতে এবং ভালো উপদেশ দিতে। আপনি পারেন অলস বিনোদনের স্থানের দিকে অগ্রসর হতে, মন্দ ও মিথ্যার দিকে হেঁটে যেতে আবার আপনি মসজিদ কিংবা আনুগত্য ও ভালো কাজের দিকেও স্বাধীনভাবে অগ্রসর হতে পারেন।

একজন মানুষ তার হাত দিয়ে আঘাত করতে পারে, চুরি করতে পারে, মিথ্যা বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারে কিংবা সে পারে অভাবী লোকের সাহায্য করতে, ভালো কাজ অনুগ্রহ করতে। প্রত্যেকেই এই কাজগুলোর মধ্যে থেকে কিছু না কিছু করে থাকে এবং কেউ বলতে পারবে না, তাকে তার নিজের স্বাধীন ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোন একটি অদৃশ্য শক্তি তাকে বাধ্য করিয়েছে কিংবা জোর খাটিয়ে এগুলো করিয়েছে বরং সে নিজের স্বাধীন ইচ্ছায় পছন্দানুসারে ভালো কিংবা মন্দ কাজ করে এবং এর কারণে এই কাজগুলোর জন্য তাকে জবাবদিহি করতে হবে; যদি তার আমল ভালো হয় তাহলে সে এর উত্তম প্রতিদান পাবে আর যদি খারাপ আমল হয় তাহলে সে অনুরুপ মন্দ ফলাফল লাভ করবে।

`আর আল্লাহ যা কিছু নির্ধারিত করেছেন সেগুলো হচ্ছে এমন কিছু বিষয় যা সম্পর্কে মানুষ সেই কাজটি করার আগে জানতে পারে না এবং সে তার উপর ভিত্তি করে তার কাজ করতে পারে না কিংবা এটাকে কোন অজুহাত হিসেবেও ব্যবহার করতে পারে না। মানুষের জন্যে এটা মানানসই নয় যে সে তার প্রতিপালকের কাছে প্রশ্ন আবেদন করে জানতে চাইবে কেন তিনি কাউকে অভিশপ্ত করেছেন কিংবা কাউকে ভালো কিছু দান করেছেন। আল্লাহ যাকে অভিশপ্ত করেছেন তার প্রতি অবিচার যুলুম করেননি, বরং তিনি তাকে সময়, স্বাধীন ইচ্ছা ও স্বাধীনভাবে কাজ করার ক্ষমতা দান করেছেন, উপরন্তু তিনি মানুষের কাছে বার্তাবাহক রাসূল পাঠিয়েছেন, তাদের সাথে তিনি কিতাব নাযিল করেছেন, তিনি মানুষকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন সতর্ক করেছেন সব ধরনের সতর্কতা দিয়ে যেমন বিপর্যয় ও পরীক্ষা দিয়ে, যাতে মানুষ তাঁর নিকট তাওবা করে এবং আল্লাহর দিকে ফিরে আসে। যদি সে মানুষ ভ্রান্তি ও গোমরাহীর পথ বেছে নেয় এবং অপরাধী পাপীদের পথ অনুসরণ করে  তাহলে সে কেবল নিজের ক্ষতি করলো এবং সে নিজেই নিজেকে অভিশাপ দিলো, অভিশপ্ত করলো, আর একথাই আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা ঘোষণা করছেন,

“যে নিজেকে শুদ্ধ করে, সেই সফলকাম হয়। এবং যে নিজেকে কলুষিত করে, সে ব্যর্থ মনোরথ হয়”। [সূরা শামস ৯-১০]

“বস্তুতঃ আল্লাহ তাদের উপর কোন অন্যায় করেননি, কিন্তু তারা নিজেরাই নিজেদের উপর অত্যাচার করছিল।” [আলে ইমরান ১১৭]

“তাদের সংবাদ কি এদের কানে এসে পৌঁছায়নি, যারা ছিল তাদের পূর্বে; নূহের আ’দের ও সামুদের সম্প্রদায় এবং ইব্রাহীমের সম্প্রদায়ের এবং মাদইয়ানবাসীদের? এবং সেসব জনপদের যেগুলোকে উল্টে দেয়া হয়েছিল? তাদের কাছে এসেছিলেন তাদের নবী পরিষ্কার নির্দেশ নিয়ে। বস্তুতঃ আল্লাহ তো এমন ছিলেন না যে, তাদের উপর জুলুম করতেন, কিন্তু তারা নিজেরাই নিজেদের উপর জুলুম করতো”। [সূরা তাওবা ৭০]

পরিশেষে এ কথা বলা যায়, আল্লাহ হলেন ভালো মন্দ সবকিছুর সৃষ্টিকর্তা এবং তিনি সবকিছু পূর্ব নির্ধারিত করেছেন, অভিশপ্ত ও করুণাপ্রাপ্তদের মধ্যে পার্থক্য করেছেন  এই বিশ্বাস পোষণ করার মানে এই নয় যে আল্লাহ তাঁর বান্দাদের উপর জোর খাটিয়ে কাউকে আনুগত্য করান কিংবা কাউকে অবাধ্যতা করান। বরং তিনি তাঁর বান্দাদের স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি প্রদান করেছেন এবং ভালো মন্দ বাছাইয়ের ক্ষমতা প্রদান করেছেন, আর এর উপরেই বান্দারা ইচ্ছানুসারে আমল করে, যার ফলে তাদের আমলের জন্যে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। আল্লাহ তাঁর বান্দাদের প্রতি যুলুম করেন না।

আরও পড়ুন এই প্রশ্নটির জবাব, প্রশ্ন নম্বর 96989.

আল্লাহ সবচেয়ে ভালো জানেন।

মূলঃ শাইখ সালিহ আল মুনাজ্জিদ

Islam Q&A

মন্তব্য করুন

Back to top button