পবিত্রতা

মোযা, পাগড়ী ও ব্যান্ডেজের উপর মাসাহ সম্পর্কিত মাসআলা

মুহাম্মাদ শরীফুল ইসলাম

মোযার উপর মাসাহ করার হুকুম :

মোযা দুই প্রকার। যথা- ১- اَلْخُفُّ অর্থাৎ চামড়ার তৈরী মোযা। ২- اَلْجَوْرَبُ অর্থাৎ কাপড়ের তৈরী মোযা। এই উভয় প্রকার মোযার উপর মাসাহ করা জায়েয।

ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল (রহঃ) বলেন, ليس في قلبي من المسح شيء، فيه أربعون حديثا عن النبي صلى الله عليه وسلم. অর্থাৎ মোযার উপরে মাসাহ করা জায়েয, এতে আমার অন্তরে সামান্যতম সন্দেহ নেই। এ সম্পর্কে নবী করীম (ছাঃ) হ’তে ৪০টি হাদীছ বর্ণিত হয়েছে।[1]

মুগীরাহ ইবনু শু‘বাহ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন,

أَنَّهُ خَرَجَ لِحَاجَتِهِ فَاتَّبَعَهُ الْمُغِيْرَةُ بِإِدَاوَةٍ فِيْهَا مَاءٌ فَصَبَّ عَلَيْهِ حِيْنَ فَرَغَ مِنْ حَاجَتِهِ فَتَوَضَّأَ وَمَسَحَ عَلَى الْخُفَّيْنِ.

একদা আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) প্রাকৃতিক প্রয়োজনে বাইরে গেলে তিনি (মুগীরাহ) পানি সহ একটা পাত্র নিয়ে তাঁর অনুসরণ করলেন। অতঃপর আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) প্রাকৃতিক প্রয়োজন শেষ করে এলে তিনি তাঁকে পানি ঢেলে দিলেন। আর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ওযূ করলেন এবং উভয় মোযার উপর মাসাহ করলেন।[2]

মোযার উপর মাসাহ ছহীহ হওয়ার পূর্বশর্ত সমূহ :

(ক) পবিত্র অবস্থায় অর্থাৎ ওযূ অবস্থায় মোযা পরিধান করা। অতএব ওযূ বিহীন অবস্থায় মোযা পরিধান করলে তার উপর মাসাহ করা জায়েয নয়।

উরওয়া ইবনে মুগীরাহ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন,

كُنْتُ مَعَ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم فِيْ سَفَرٍ فَأَهْوَيْتُ لأَنْزِعَ خُفَّيْهِ فَقَالَ دَعْهُمَا فَإِنِّيْ أَدْخَلْتُهُمَا طَاهِرَتَيْنِ فَمَسَحَ عَلَيْهِمَا.

আমি নবী করীম (ছাঃ)-এর সঙ্গে কোন এক সফরে ছিলাম। (ওযূ করার সময়) আমি তাঁর মোযা দু’টি খুলতে চাইলে তিনি বললেন, ও দু’টি থাক, আমি পবিত্র অবস্থায় ওদু’টি পরেছিলাম। (এই বলে) তিনি তার উপর মাসাহ করলেন।[3]

(খ) মোযা বৈধ হওয়া। অর্থাৎ যদি কেউ অন্য কারো মোযা জোরপূর্বক অন্যায়ভাবে ছিনিয়ে নিয়ে পরিধান করে অথবা চুরিকৃত মোযা পরিধান করে অথবা রেশমী কাপড়ের তৈরী মোযা পরিধান করে। তাহ’লে তার উপর মাসাহ করা জায়েয নয়।

(গ) মোযা পবিত্র হওয়া। অর্থাৎ অপবিত্র মোযার উপর মাসাহ করা জায়েয নয়। যেমন কুকুর অথবা গাধার চামড়া দ্বারা তৈরীকৃত মোযার উপর মাসাহ করা জায়েয নয়।

(ঘ) শারঈ দলীল দ্বারা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে মাসাহ করা। আর তা হ’ল, মুক্বীমের জন্য এক দিন, এক রাত এবং মুসাফিরের জন্য তিন দিন, তিন রাত।

শুরাইহ ইবনে হানী বলেন, سَأَلْتُ عَلِيَّ ابْنِ أَبِى طَالِبٍ عَنِ الْمَسْحِ عَلَى الْخُفَّيْنِ فَقَالَ جَعَلَ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم ثَلاَثَةَ أَيَّامٍ وَلَيَالِيَهُنَّ لِلْمُسَافِرِ وَيَوْمًا وَلَيْلَةً لِلْمُقِيْمِ.  অর্থাৎ আমি আলী ইবনু আবি তালেব (রাঃ)-কে মোযার উপর মাসাহ করা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলাম (মাসাহ কতদিন যাবৎ করা যায়?) উত্তরে তিনি বললেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তা মুসাফিরের জন্য তিন দিন, তিনি রাত এবং মুক্বীমের জন্য এক দিন, এক রাত নির্ধারণ করে দিয়েছেন’।[4]

অতএব মুক্বীমের জন্য এক দিন, এক রাত এবং মুসাফিরের জন্য তিন দিন, তিন রাত অতিক্রম হ’লে তার উপর মাসাহ করা জায়েয নয়।

মোযার উপর মাসাহ করার নিয়ম :

মোযার উপর মাসাহ করার সময় তার উপরিভাগ মাসাহ করতে হবে। অর্থাৎ পায়ের পাতার উপর মাসাহ করতে হবে।

মুগীরাহ ইবনে শু‘বাহ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, رَأَيْتُ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَمْسَحُ عَلَى الخُفَّيْنِ عَلَى ظَاهِرِهِمَا.  অর্থাৎ আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে মোযাদ্বয়ের উপরিভাগ মাসাহ করতে দেখেছি।[5]

অতএব মোযার নিম্নভাগ ও পেছনের দিকে মাসাহ করা বৈধ নয়। আলী (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন,

لَوْ كَانَ الدِّيْنُ بِالرَّأْىِ لَكَانَ أَسْفَلُ الْخُفِّ أَوْلَى بِالْمَسْحِ مِنْ أَعْلاَهُ وَقَدْ رَأَيْتُ رَسُوْلَ اللهِ صلى الله عليه وسلم يَمْسَحُ عَلَى ظَاهِرِ خُفَّيْهِ.

অর্থাৎ দ্বীন যদি বিবেক-বুদ্ধি অনুসারেই হ’ত, তাহ’লে মোযার উপরিভাগ অপেক্ষা নিম্নভাগ মাসাহ করাই উত্তম হ’ত। অথচ আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে দেখেছি, তিনি তাঁর মোযাদ্বয়ের উপর দিকেই মাসাহ করতেন।[6]

মোযার উপর মাসাহ ভঙ্গের কারণ সমূহ :

(ক) গোসল ফরয হ’লে : অর্থাৎ মোযার উপরে মাসাহ করার পরে স্ত্রী মিলন করলে অথবা স্বপ্নদোষ হ’লে তা ভঙ্গ হয়ে যাবে। ছফওয়ান ইবনু আস্সাল (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, كَانَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَأْمُرُنَا إِذَا كُنَّا فِيْ سَفَرٍ أَلاَّ نَنْزِعَ خِفَافَنَا إِلاَّ ثَلاَثَةَ أَيَّامٍ، إِلاَّ مِنْ جَنَابَةٍ… অর্থাৎ আমরা যখন সফরে থাকতাম তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আমাদেরকে নির্দেশ দিতেন, আমরা যেন আমাদের মোযা না খুলি তিন দিন অতিবাহিত হওয়ার পূর্বে। তবে জানাবাতের অবস্থা ব্যতীত।[7]

(খ) মোযা খুলে ফেললে মাসাহ ভঙ্গ হয়ে যাবে। অর্থাৎ পবিত্র অবস্থায় মোযা পরিধান করার পরে তা খুলে পুনরায় পরিধান করলে উক্ত মোযার উপরে মাসাহ করা বৈধ নয়।

(গ) নির্দিষ্ট সময় শেষ হয়ে গেলে : ইসলামী শরী‘আত কর্তৃক নির্দিষ্ট সময় শেষ হওয়ার পরে মোযার উপর মাসাহ করা জায়েয নয়। আর তা হ’ল, মুক্বীমের জন্য এক দিন ও এক রাত এবং মুসাফিরের জন্য তিন দিন ও তিন রাত।[8]

সফর অবস্থায় মোযার উপর মাসাহ করে নির্দিষ্ট সময় অতিক্রম হওয়ার পূর্বেই মুক্বীম হ’লে তার হুকুম :

সফর অবস্থায় মোযার উপর তিন দিন, তিন রাত মাসাহ করা বৈধ। কিন্তু সফরকারী এক দিন অথবা দুই দিন পরে নিজ বাড়ীতে ফিরে আসলে সে মুক্বীম হয়ে গেল। এ অবস্থায় তার জন্য এক দিন, এক রাতের বেশী মাসাহ করা বৈধ নয়। এমতাবস্থায় তার করণীয় হ’ল, সে মুক্বীমের হুকুম পালন করবে। অর্থাৎ যদি এক দিন, এক রাত অতিক্রম হয়ে থাকে তাহ’লে মাসাহ ত্যাগ করবে। আর যদি এক দিন, এক রাতের কিছু অংশ বাকী থাকে তাহ’লে তা পূর্ণ করবে।[9]

মুক্বীম অবস্থায় মোযার উপর মাসাহ করে নির্দিষ্ট সময় অতিক্রম হওয়ার পূর্বেই সফরে বের হ’লে তার হুকুম :

কেউ মুক্বীম অবস্থায় মোযার উপর মাসাহ করে এক দিন অতিক্রম হ’লে এবং এক রাত বাকী থাকতেই সফরে বের হ’ল। এখন যেহেতু সে মুসাফির সেহেতু তার জন্য তিন দিন, তিন রাত মাসাহ করা বৈধ। এমতাবস্থায় তার করণীয় হ’ল, সে মুক্বীমের হুকুম বাস্তবায়ন করবে। অর্থাৎ সে তার মুক্বীম অবস্থার বাকী এক রাত মাসাহ করে মাসাহ ত্যাগ করবে। কেননা এক্ষেত্রে মুসাফিরের হুকুম পালন করলে মাসাহ ছহীহ হবে কি-না এ ব্যাপারে সন্দেহ রয়েছে। অতএব যে বিষয়ে সন্দেহ রয়েছে তা থেকে দূরে থাকাই উচিত।[10] কেননা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, دَعْ مَا يَرِيْبُكَ إِلَى مَا لاَ يَرِيْبُكَ. ‘যা তোমার কাছে সন্দেহযুক্ত মনে হয়, তা পরিত্যাগ করে সন্দেহমুক্ত কাজ কর’।[11]

পাগড়ীর উপর মাসাহ করার হুকুম

পাগড়ীর উপর মাসাহ করা জায়েয। তবে পাগড়ীর বেশী অংশ মাসাহ করতে হবে। সামান্য কিছু অংশ মাসাহ করলে ছহীহ হবে না।[12] জা‘ফর ইবনে আমর (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, رَأَيْتُ النَّبِيَّ صلى الله عليه وسلم يَمْسَحُ عَلَى عِمَامَتِهِ وَخُفَّيْهِ.  অর্থাৎ আমি নবী করীম (ছাঃ)-কে তাঁর পাগড়ীর উপর এবং উভয় মোযার উপর মাসাহ করতে দেখেছি।[13]

অতএব পাগড়ীর উপর মাসাহ করা জায়েয। কিন্তু এর উপর ভিত্তি করে টুপির উপর মাসাহ করা বৈধ নয়। কেননা হাদীছে টুপির উপর মাসাহ করার কথা বর্ণিত হয়নি। তাছাড়াও পাগড়ী খুলে পুনরায় বাঁধতে যে কষ্ট অনুভূত হয়, টুপিতে তা হয় না।[14]

ব্যান্ডেজের উপর মাসাহ করার হুকুম :

শরীরের কোন অঙ্গ ভেঙ্গে গেলে বা কেটে গেলে সেই অঙ্গে ব্যান্ডেজ করা হয়। ওযূ করার সময় সেই ব্যান্ডেজের উপর মাসাহ করা জায়েয। এক্ষেত্রে কোন সময় সীমা নির্ধারিত নয়। অর্থাৎ যতদিন পর্যন্ত ব্যান্ডেজ থাকবে ততদিন পর্যন্ত মাসাহ করা জায়েয।[15]


[1]. ইবনে কুদামা (রহঃ), মুগনী, ১/৩৬০ পৃঃ।

[2]. বুখারী, ‘মোযার উপর মাসাহ করা’ অনুচ্ছেদ, হা/২০৩, বঙ্গানুবাদ, তাওহীদ পাবলিকেশন্স ১/১১৫ পৃঃ।

[3]. বুখারী, ‘পবিত্র অবস্থায় উভয় পা মোযায় প্রবেশ করানো’ অনুচ্ছেদ, হা/২০৬, বঙ্গানুবাদ, তাওহীদ পাবলিকেশন্স ১/১১৬ পৃঃ।

[4]. মুসলিম, হা/৬৬১। মিশকাত, ‘মোযার উপর মাসাহ করা’ অনুচ্ছেদ, হা/৪৮২। বঙ্গানুবাদ, এমদাদিয়া ২/১২৯ পৃঃ।

[5]. ছহীহ তিরমিযী, তাহক্বীক: নাছিরুদ্দীন আলবানী, হা/৮৫। তিনি হাদীছটিকে হাসান ছহীহ বলে উল্লেখ করেছেন। মিশকাত, হা/৪৮৭, বঙ্গানুবাদ, এমদাদিয়া, ২/১৩২ পৃঃ।

[6]. আবু দাউদ, হা/১৬২, মিশকাত, হা/৪৯০, বঙ্গানুবাদ, এমদাদিয়া, ২/১৩৩ পৃঃ; হাফেয ইবনে হাজার হাদীছটিকে ছহীহ বলেছেন। দ্র. তালখীছুল হাবীর ১/১৬০।

[7]. তিরমিযী, হা/৯৬, নাছিরুদ্দীন আলবানী হাদীছটিকে হাসান বলেছেন। দ্র. ইরওয়াউল গালীল, হা/১০৪।

[8]. মুসলিম, হা/৬৬১; মিশকাত, ‘মোযার উপর মাসাহ করা’ অনুচ্ছেদ, হা/৪৮২; বঙ্গানুবাদ, এমদাদিয়া ২/১২৯।

[9]. মুহাম্মাদ বিন ছালেহ আল-উছায়মীন, শারহুল মুমতে আলা যাদিল মুসতাকনি ১/২৫১।

[10]. মুহাম্মাদ বিন ছালেহ আল-উছায়মীন, শারহুল মুমতে আলা যাদিল মুসতাকনি ১/২৫২।

[11]. তিরমিযী, তাহক্বীক: নাছিরুদ্দীন আলবানী, হা/২৫১৮, তিনি হাদীছটিকে ছহীহ বলে উল্লেখ করেছেন।

[12]. মুহাম্মাদ বিন ছালেহ আল-উছায়মীন, শারহুল মুমতে আলা যাদিল মুসতাকনি ১/২৫৯।

[13]. বুখারী, ‘মোযার উপর মাসাহ করা’ অনুচ্ছেদ, হা/২০৫, বঙ্গানুবাদ, তাওহীদ পাবলিকেশন্স ১/১১৫।

[14]. মুহাম্মাদ বিন ছালেহ আল-উছাইমীন, শারহুল মুমতে আলা যাদিল মুসতাকনি ১/২৫৩-২৫৪।

[15]. ফিকহুল মুয়াস্সার, মুজাম্মা মালিক ফাহ্দ, পৃঃ ২৭।

মন্তব্য করুন

আরও দেখুন
Close
Back to top button