ওযূ সম্পর্কিত মাসআলা – ২
মুহাম্মাদ শরীফুল ইসলাম
পবিত্রতা অর্জনের অন্যতম মাধ্যম ওযূ। এর অনেক ফযীলত রয়েছে। নিম্নে এ সম্পর্কে আলোচনা পেশ করা হ’ল।-
(ক) ওযূ ঈমানের অর্ধেক :
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, اَلطُّهُوْرُ شَطْرُ الإِيْمَانِ ‘পবিত্রতা ঈমানের অর্ধেক’।[1]
(খ) ওযূ ছোট পাপের কাফ্ফারা :
এ মর্মে হাদীছে এসেছে, আবু হুরায়রাহ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,
إِذَا تَوَضَّأَ الْعَبْدُ الْمُسْلِمُ أَوِ الْمُؤْمِنُ فَغَسَلَ وَجْهَهُ خَرَجَ مِنْ وَجْهِهِ كُلُّ خَطِيْئَةٍ نَظَرَ إِلَيْهَا بِعَيْنَيْهِ مَعَ الْمَاءِ أَوْ مَعَ آخِرِ قَطْرِ الْمَاءِ، فَإِذَا غَسَلَ يَدَيْهِ خَرَجَ مِنْ يَدَيْهِ كُلُّ خَطِيْئَةٍ كَانَ بَطَشَتْهَا يَدَاهُ مَعَ الْمَاءِ، أَوْ مَعَ آخِرِ قَطْرِ الْمَاءِ، فَإِذَا غَسَلَ رِجْلَيْهِ خَرَجَتْ كُلُّ خَطِيْئَةٍ مَشَتْهَا رِجْلاَهُ مَعَ الْمَاءِ، أَوْ مَعَ آخِرِ قَطْرِ الْمَاءِ، حَتَّى يَخْرُجَ نَقِيًّا مِنَ الذُّنُوْبِ.
‘কোন মুসলিম অথবা মুমিন বান্দা ওযূ করার সময় যখন মুখমন্ডল ধুয়ে ফেলে তখন তার চোখ দিয়ে অর্জিত পাপ পানির সাথে অথবা (তিনি বলেছেন,) পানির শেষ বিন্দুর সাথে বের হয়ে যায়। যখন সে উভয় হাত ধৌত করে তখন তার দু’হাতের স্পর্শের মাধ্যমে অর্জিত পাপ পানির সাথে অথবা পানির শেষ বিন্দুর সাথে ঝরে যায়। অতঃপর যখন সে উভয় পা ধৌত করে তখন তার দু’পা দিয়ে হাঁটার মাধ্যমে অর্জিত পাপ পানির সাথে অথবা পানির শেষ বিন্দুর সাথে ঝরে যায়। এইভাবে সে যাবতীয় পাপ থেকে মুক্ত ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হয়ে যায়’।[2]
অন্য একটি হাদীছে এসেছে, ওছমান (রাঃ)-এর আযাদকৃত দাস হুমরান থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি ওছমান ইবনু আফ্ফান (রাঃ)-এর জন্য ওযূর পানি নিয়ে আসলে তিনি ওযূ করে বললেন, লোকেরা রাসূল (ছাঃ) থেকে বেশ কিছু হাদীছ বর্ণনা করে থাকে। ঐ হাদীছগুলো কি তা আমার জানা নেই। তবে আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে আমার এই ওযূর ন্যায় ওযূ করতে দেখেছি। তারপর তিনি বলেছেন, مَنْ تَوَضَّأَ هَكَذَا غُفِرَ لَهُ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِهِ وَكَانَتْ صَلاَتُهُ وَمَشْيُهُ إِلَى الْمَسْجِدِ نَافِلَةً. ‘যে ব্যক্তি এভাবে ওযূ করে তার পূর্বের সকল গুনাহ মাফ করে দেওয়া হয়। ফলে তার ছালাত ও মসজিদে যাওয়া অতিরিক্ত আমল হিসাবে গণ্য হয়’।[3]
(গ) ওযূ বান্দার মর্যাদা বৃদ্ধি করে :
আবু হুরায়রাহ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,
أَلاَ أَدُلُّكُمْ عَلَى مَا يَمْحُو اللهُ بِهِ الْخَطَايَا وَيَرْفَعُ بِهِ الدَّرَجَاتِ. قَالُوْا بَلَى يَا رَسُوْلَ اللهِ قَالَ إِسْبَاغُ الْوُضُوْءِ عَلَى الْمَكَارِهِ وَكَثْرَةُ الْخُطَا إِلَى الْمَسَاجِدِ وَانْتِظَارُ الصَّلاَةِ بَعْدَ الصَّلاَةِ فَذَلِكُمُ الرِّبَاطُ.
‘আমি কি তোমাদেরকে (এমন কাজ) জানাবো না, যা করলে আল্লাহ বান্দার গুনাসমূহ ক্ষমা করেন এবং মর্যাদা বৃদ্ধি করেন? লোকেরা বলল, হে আল্লাহর রাসূল! আপনি বলুন। তিনি বললেন, কষ্টকর অবস্থায় থেকেও পুর্ণাঙ্গরূপে ওযূ করা, ছালাতের জন্য মসজিদে বার বার যাওয়া এবং এক ছালাতের পর আর এক ছালাতের জন্য অপেক্ষা করা। আর এই কাজগুলোই হ’ল সীমান্ত প্রহরা’।[4]
(ঘ) ওযূ জান্নাত লাভের মাধ্যম :
আবু হুরায়রাহ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) একদা ফজরের ছালাতের সময় বেলাল (রাঃ)-কে জিজ্ঞেস করলেন,
يَا بِلاَلُ حَدِّثْنِيْ بِأَرْجَى عَمَلٍ عَمِلْتَهُ فِيْ الإِسْلاَمِ فَإِنِّيْ سَمِعْتُ دَفَّ نَعْلَيْكَ بَيْنَ يَدَيَّ فِيْ الْجَنَّةِ قَالَ مَا عَمِلْتُ عَمَلاً أَرْجَى عِنْدِيْ أَنِّيْ لَمْ أَتَطَهَّرْ طُهُوْرًا فِيْ سَاعَةِ لَيْلٍ أَوْ نَهَارٍ إِلاَّ صَلَّيْتُ بِذَلِكَ الطُّهُوْرِ مَا كُتِبَ لِيْ أَنْ أُصَلِّيَ.
‘হে বেলাল! ইসলাম গ্রহণের পর সর্বাধিক সন্তোষজনক যে আমল তুমি করেছ, তা আমাকে বল। কেননা জান্নাতে (মি‘রাজের রাতে) আমি আমার সামনে তোমার পাদুকার আওয়াজ শুনতে পেয়েছি। বেলাল (রাঃ) বললেন, আমার নিকট এর চেয়ে (অধিক) সন্তোষজনক কিছু আমি করিনি যে, দিন-রাত যখনই যে কোন প্রহরে আমি পবিত্রতা অর্জন করেছি, তখনই সে তাহারাত দ্বারা ছালাত আদায় করেছি, যে পরিমাণ ছালাত আদায় করা আমার তাক্বদীরে লেখা ছিল’।[5]
(ঙ) ওযূ অন্যান্য উম্মাতের সাথে উম্মাতে মুহাম্মাদীর পার্থক্যকারী :
একটি হাদীছে এসেছে, ছাহাবীগণ বললেন,
كَيْفَ تَعْرِفُ مَنْ لَمْ يَأْتِ بَعْدُ مِنْ أُمَّتِكَ يَا رَسُوْلَ اللهِ فَقَالَ أَرَأَيْتَ لَوْ أَنَّ رَجُلاً لَهُ خَيْلٌ غُرٌّ مُحَجَّلَةٌ بَيْنَ ظَهْرَىْ خَيْلٍ دُهْمٍ بُهْمٍ أَلاَ يَعْرِفُ خَيْلَهُ. قَالُوْا بَلَى يَا رَسُوْلَ اللهِ. قَالَ فَإِنَّهُمْ يَأْتُوْنَ غُرًّا مُحَجَّلِيْنَ مِنَ الْوُضُوْءِ وَأَنَا فَرَطُهُمْ عَلَى الْحَوْضِ.
অর্থাৎ হে আল্লাহর রাসূল! আপনি আপনার উম্মাতের এমন লোকদের কিভাবে চিনবেন যারা এখনও দুনিয়াতেই আসেনি? উত্তরে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, বল দেখি, যদি কোন ব্যক্তির নিকট কাল এক রঙ্গা বহু ঘোড়ার মধ্যে একদল ধবধবে সাদা কপাল ও সাদা হাত-পা বিশিষ্ট ঘোড়া থাকে, সে কি তার ঘোড়া সমূহ চিনতে পারবে না? তারা বললেন, হ্যঁা, হে আল্লাহর রাসূল! তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, আমার উম্মতের লোকেরও ওযূর কারণে (ক্বিয়ামতের দিন) সেইরূপ ধবধবে সাদা কপাল ও সাদা হাত-পা অবস্থায় উপস্থিত হবে আর আমি হাউযে কাওছারের নিকট তাদের অগ্রগামী হিসাবে উপস্থিত থাকব’।[6]
(চ) ওযূ শয়তানের গিঁট খোলার অন্যতম মাধ্যম :
আবু হুরায়রাহ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,
يَعْقِدُ الشَّيْطَانُ عَلَى قَافِيْةِ رَأْسِ أَحَدِكُمْ إِذَا هُوَ نَامَ ثَلاَثَ عُقَدٍ يَضْرِبُ كُلَّ عُقْدَةٍ عَلَيْكَ لَيْلٌ طَوِيْلٌ فَارْقُدْ فَإِنِ اسْتَيْقَظَ فَذَكَرَ اللهَ انْحَلَّتْ عُقْدَةٌ فَإِنْ تَوَضَّأَ انْحَلَّتْ عُقْدَةٌ فَإِنْ صَلَّى انْحَلَّتْ عُقْدَةٌ فَأَصْبَحَ نَشِيْطًا طَيِّبَ النَّفْسِ وَإِلاَّ أَصْبَحَ خَبِيْثَ النَّفْسِ كَسْلاَنَ.
‘তোমাদের কেউ যখন ঘুমিয়ে পড়ে তখন শয়তান তার ঘাড়ের পশ্চাদাংশে তিনটি গিঁট দেয়। প্রতি গিঁটে সে এ বলে চাপড়ায়, তোমার সামনে রয়েছে দীর্ঘ রাত, অতএব তুমি শুয়ে থাক। অতঃপর সে যদি জাগ্রত হয়ে আল্লাহকে স্মরণ করে তাহ’লে একটি গিঁট খুলে যায়। পরে ওযূ করলে আরেকটি গিঁট খুলে যায়। অতঃপর ছালাত আদায় করলে আরেকটি গিঁট খুলে যায়। তখন তার প্রভাত হয় উৎফুল্ল মনে ও অনাবিল চিত্তে। অন্যথা সে সকালে উঠে কলুষ কালিমা ও আলস্য সহকারে’।[7]
ওযূ ভঙ্গের কারণ সমূহ
ওযূ ভঙ্গের কারণ মোট ৫টি। যথা :
১- পেশাব ও পায়খানার রাস্তা দিয়ে কিছু বের হওয়া :
পেশাব-পায়খানার রাস্তা দিয়ে মল-মূত্র, বীর্য, মযী[8], হায়েয ও নিফাসের রক্ত এবং বায়ূ বের হ’লে ওযূ ভঙ্গ হয়ে যায়।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন, أَوْ جَاءَ أَحَدٌ مِّنْكُمْ مِنَ الْغَائِطِ أَوْ لاَمَسْتُمُ النِّسَاءَ فَلَمْ تَجِدُوْا مَاءً فَتَيَمَّمُوْا صَعِيْدًا طَيِّبًا– ‘অথবা তোমাদের কেউ পেশাব-পায়খানা থেকে আসে কিংবা তোমরা স্ত্রী সম্ভোগ কর, তবে যদি পানি না পাও তাহ’লে পবিত্র মাটি দ্বারা তায়াম্মুম কর’ (নিসা ৪৩)।
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, لاَ تُقْبَلُ صَلاَةُ مَنْ أَحْدَثَ حَتَّى يَتَوَضَّأَ. ‘যে ব্যক্তির ওযূ ভঙ্গ হয়েছে তার ছালাত হবে না যতক্ষণ পর্যন্ত সে ওযূ না করে’।[9]
অন্য হাদীছে এসেছে, ছাফওয়ান ইবনে আস্সাল (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, كَانَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَأْمُرُنَا أَنْ لاَ نَنْزِعَ خِفَافَنَا، ثَلاَثَةَ أَيَّامٍ إِلاَّ مِنْ جَنَابَةٍ، لَكِنْ مِنْ غَائِطٍ وَبَوْلٍ وَنَوْمٍ. অর্থাৎ রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আমাদেরকে নির্দেশ দিতেন, আমরা যেন (সফর অবস্থায়) তিন দিন যাবৎ পেশাব-পায়খানা এবং ঘুমের কারণে আমাদের মোযা না খুলি। তবে জানাবাতের অবস্থা ব্যতীত।[10]
অন্য হাদীছে এসেছে, আববাদ ইবনু তামীম (রহঃ)-এর চাচা হ’তে বর্ণিত, একদা আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)-এর নিকট এক ব্যক্তি সম্পর্কে বলা হ’ল যে, তার মনে হয়েছিল যেন ছালাতের মধ্যে কিছু হয়ে গিয়েছিল। তিনি বললেন, لاََ يَنْفَتِلْ أَوْ لاَ يَنْصَرِفْ حَتَّى يَسْمَعَ صَوْتًا أَوْ يَجِدَ رِيحًا. ‘সে যেন ফিরে না যায়, যতক্ষণ না শব্দ শুনে বা দুর্গন্ধ পায়’।[11]
অন্য বর্ণনায় এসেছে,
عَنْ فَاطِمَةَ بِنْتِ أَبِىْ حُبَيْشٍ أَنَّهَا كَانَتْ تُسْتَحَاضُ فَقَالَ لَهَا النَّبِىُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إِذَا كَانَ دَمُ الْحَيْضَةِ فَإِنَّهُ دَمٌ أَسْوَدُ يُعْرَفُ فَإِذَا كَانَ ذَلِكَ فَأَمْسِكِىْ عَنِ الصَّلاَةِ فَإِذَا كَانَ الآخَرُ فَتَوَضَّئِىْ وَصَلِّى فَإِنَّمَا هُوَ عِرْقٌ.
ফাতেমা বিনতে আবু হুবাইশ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি ইস্তিহাযাগ্রস্ত মহিলা ছিলেন। নবী করীম (ছাঃ) তাকে বললেন, হায়েযের রক্তের পরিচিতি এই যে, তা কাল রং-এর হবে। যখন এই ধরনের রক্ত প্রবাহিত হবে তখন ছালাত ত্যাগ করবে এবং যখন অন্যরূপ রং দেখবে তখন ওযূ করে ছালাত আদায় করবে। নিশ্চয়ই এটা হচ্ছে রগের রক্ত।[12]
২- পেশাব-পায়খানার রাস্তা ব্যতীত শরীরের অন্য কোন জায়গা দিয়ে মল-মূত্র অথবা বায়ূ নির্গত হওয়া :
কারো অসুস্থতার কারণে অপারেশনের মাধ্যমে যদি পেশাব-পায়খানার রাস্তা ব্যতীত অন্য কোন রাস্তা দিয়ে পেশাব-পায়খানা বের করে তবুও তার ওযূ ভঙ্গ হয়ে যাবে।
পক্ষান্তরে শরীরের যেকোন স্থান দিয়ে রক্ত, পুঁজ এবং বমন হ’লে ওযূ ভঙ্গ হবে কি-না? এ ব্যাপারে ওলামায়ে কেরামের মধ্যে মতভেদ পরিলক্ষিত হয়। তবে ছহীহ মত হ’ল উল্লিখিত কারণে ওযূ ভঙ্গ হবে না। তবে রক্ত, পুঁজ এবং বমনের পরিমাণ খুব বেশী হ’লে মতভেদের গন্ডি হ’তে নিজেকে দূরে রাখার জন্য পুনরায় ওযূ করাই ভাল।[13]
৩- ওযূ অবস্থায় জ্ঞান হারিয়ে ফেলা :
এখানে জ্ঞান হারানোর দু’টি মাধ্যম লক্ষণীয়।
(ক) অস্থায়ী জ্ঞান হারানো যা ঘুম, অসুস্থতা এবং নেশাগ্রস্তের কারণে হয়ে থাকে। যেমন- রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) নির্দেশ দিতেন, أَنْ لاَ نَنْزِعَ خِفَافَنَا ثَلاَثَةَ أَيَّامٍ إِلاَّ مِنْ جَنَابَةٍ لَكِنْ مِنْ غَائِطٍ وَبَوْلٍ وَنَوْمٍ. ‘আমরা যেন (সফর অবস্থায়) তিন দিন যাবৎ পেশাব-পায়খানা এবং ঘুমের কারণে আমাদের মোযা না খুলি। তবে জানাবাতের অবস্থা ব্যতীত’।[14]
অন্য হাদীছে এসেছে, আলী ইবনু আবু তালেব (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, أَنَّ رَسُوْلَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ : الْعَيْنُ وِكَاءُ السَّهِ، فَمَنْ نَامَ فَلْيَتَوَضَّأْ. ‘চক্ষু হ’ল গুহ্যদ্বারের ঢাকনা। অতএব যে ব্যক্তি ঘুমাবে সে যেন ওযূ করে’।[15]
এ হাদীছ দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, ওযূ অবস্থায় ঘুমিয়ে গেলে ওযূ ভঙ্গ হয়ে যায়। তবে তা এমন ঘুম যে, ঘুমের মধ্যে বায়ু নিঃসরণ হ’লে তা উপলব্ধি করা যায় না। পক্ষান্তরে যদি এমন ঘুম হয় যে ঘুমে বায়ু নিঃসরণ উপলব্ধি করা যায় সে ঘুমের কারণে ওযূ ভঙ্গ হবে না।[16] এ প্রসঙ্গে আনাস (রাঃ) বলেন,
كَانَ أَصْحَابُ رَسُوْلِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَنْتَظِرُوْنَ الْعِشَاءَ الآخِرَةَ حَتَّى تَخْفِقَ رُءُوْسُهُمْ ثُمَّ يُصَلُّوْنَ وَلاَ يَتَوَضَّئُوْنَ.
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর ছাহাবীগণ এশার ছালাতের শেষ পর্যন্ত অপেক্ষা করছিলেন। এমনকি (ঘুমের কারণে) তাদের মাথা আন্দোলিত হচ্ছিল। অতঃপর তারা ছালাত আদায় করলেন। কিন্তু ওযূ করলেন না।[17]
(খ) স্থায়ীভাবে জ্ঞান হারানো, যা পাগল হয়ে গেলে হয়ে থাকে। অস্থায়ীভাবে জ্ঞান হারালে যদি ওযূ ভঙ্গ হয়ে যায় তাহ’লে স্থায়ীভাবে জ্ঞান হারালেও ওযূ ভঙ্গ হয়ে যাবে।
৪- ওযূ অবস্থায় উটের গোশত খাওয়া :
জাবের ইবনু সামুরা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে জিজ্ঞেস করলেন, يَا رَسُوْلَ اللهِ أَتَوَضَّأُ مِنْ لُحُوْمِ الْغَنَمِ؟ قَالَ : إِنْ شِئْتَ فَتَوَضَّأْ، وَإِنْ شِئْتَ فَلاَ تَتَوَضَّأْ، قَالَ : أَتَوَضَّأُ مِنْ لُحُوْمِ الْإِبِلِ؟ قَالَ : نَعَمْ، تَوَضَّأْ مِنْ لُحُوْمِ الْإِبِلِ. অর্থাৎ হে আল্লাহর রাসূল! আমি কি ছাগলের গোশত খেয়ে ওযূ করব? তিনি বললেন, ‘তুমি চাইলে ওযূ কর। আর না চাইলে ওযূ কর না’। অতঃপর জিজ্ঞেস করলেন, আমি কি উটের গোশত খেয়ে ওযূ করব? তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ, উটের গোশত খেয়ে ওযূ করবে’।[18]
৫- ইসলাম ত্যাগ করা :
আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَمَنْ يَكْفُرْ بِالْإِيْمَانِ فَقَدْ حَبِطَ عَمَلُهُ وَهُوَ فِيْ الْآخِرَةِ مِنَ الْخَاسِرِيْنَ ‘আর যে ঈমান প্রত্যাখ্যান করল, অবশ্যই তার আমল বরবাদ হবে এবং সে আখেরাতে ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হবে’ (মায়েদা ৫)।
এছাড়া যে সকল কারণে গোসল ফরয হয়, সে সকল কারণে ওযূ ফরয হয়।
লজ্জাস্থান স্পর্শ করলে ওযূ ভঙ্গ হবে কি?
এখানে লজ্জাস্থান বলতে পেশাব-পায়খানা উভয় দ্বারকে বুঝানো হয়েছে। অর্থাৎ যদি কেউ ওযূ অবস্থায় পেশাব-পায়খানার রাস্তা সরাসরি স্পর্শ করে তাহ’লে তার ওযূ ভঙ্গ হবে কি-না? এ ব্যাপারে ওলামায়ে কেরামের মধ্যে মতভেদ পরিলক্ষিত হয়। তবে ছহীহ মত হ’ল উত্তেজনা ব্যতীত স্বাভাবিকভাবে লজ্জাস্থান স্পর্শ করলে ওযূ ভঙ্গ হবে না। কিন্তু উত্তেজনা বশত স্পর্শ করলে এবং লজ্জাস্থান দিয়ে কিছু নির্গত হ’লে ওযূ ভঙ্গ হবে।[19]
ক্বায়েস ইবনে ত্বলক তার পিতা হ’তে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, একদা আমরা আল্লাহর নবী (ছাঃ)-এর নিকট গমন করি। এমন সময় একজন গ্রাম্য লোক এসে জিজ্ঞেস করল, يَا نَبِىَّ اللهِ مَا تَرَى فِى مَسِّ الرَّجُلِ ذَكَرَهُ بَعْدَ مَا يَتَوَضَّأُ فَقَالَ هَلْ هُوَ إِلاَّ مُضْغَةٌ مِنْهُ أَوْ قَالَ بَضْعَةٌ مِنْهُ. অর্থাৎ হে আল্লাহর রাসূল! ওযূ করার পরে যদি কোন ব্যক্তি তার পুরুষাঙ্গ স্পর্শ করে তবে এ ব্যাপারে আপনার মতামত কি? রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, ‘পুরুষাঙ্গ তো একটি গোশতের টুকরা অথবা তিনি বললেন, গোশতের খন্ড মাত্র’।[20]
অত্র হাদীছ দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, লজ্জাস্থান স্পর্শ করলে ওযূ ভঙ্গ হবে না। লজ্জাস্থান শরীরের অন্যান্য অঙ্গের মতই। শরীরের অন্যান্য অঙ্গ স্পর্শ করলে যেমন ওযূ ভঙ্গ হবে না, তেমনি লজ্জাস্থান স্পর্শ করলেও ওযূ ভঙ্গ হবে না।
পক্ষান্তরে অন্য হাদীছে এসেছে, বুসরা বিনতে ছাফওয়ান হ’তে বর্ণিত, তিনি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে বলতে শুনেছেন, مَنْ مَسَّ ذَكَرَهُ فَلْيَتَوَضَّأْ. ‘যে তার পুরুষাঙ্গ স্পর্শ করল সে যেন ওযূ করে।[21] অন্যত্র রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, مَنْ مَسَّ ذَكَرَهُ فَلْيَتَوَضَّأْ وَأيُّمَا امْرَأَةٍ مَسَّتْ فَرْجَهَا فَلْتَتَوَضَّأْ. ‘যে লোক তার পুরুষাঙ্গ স্পর্শ করল সে যেন ওযূ করে, আর যে মহিলা তার লজ্জাস্থান স্পর্শ করল সে যেন ওযূ করে’।[22]
উল্লিখিত হাদীছদ্বয় দ্বারা লজ্জাস্থান স্পর্শ করলে ওযূ করা মুস্তাহাব বুঝানো হয়েছে; ওয়াজিব বুঝানো হয়নি। উপরোক্ত প্রথম হাদীছ যার প্রমাণ বহন করে। কেননা উক্ত হাদীছে রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, ‘পুরুষাঙ্গ তো একটি গোশতের টুকরা অথবা তিনি বললেন, গোশতের খন্ড মাত্র’।[23]
শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনে তায়মিয়া (রহঃ) বলেছেন, লজ্জাস্থান স্পর্শ করলে ওযূ করা মুস্তাহাব, ওয়াজিব নয়।[24]
তাছাড়া আলী ইবনু আবি তালেব (রাঃ), আম্মার ইবনু ইয়াসার (রাঃ), ইবনে মাস‘ঊদ (রাঃ), ইবনে আববাস (রাঃ), হুযাইফা ইবনুল ইয়ামান (রাঃ), ইমরান ইবনে হুসাইন (রাঃ), আবু দারদা (রাঃ), ক্বায়েস ইবনু তালক (রাঃ), ইবনে জুবাইর (রাঃ), নাখঈ এবং তাউস (রহঃ) সকলেই লজ্জাস্থান স্পর্শ করলে ওযূ ভঙ্গ হবে না বলে উল্লেখ করেছেন।[25]
নারীদের স্পর্শ করলে ওযূ ভঙ্গ হবে কি?
ওযূ অবস্থায় নারীদের স্পর্শ করলে ওযূ ভঙ্গ হবে কি-না এ ব্যাপারে ওলামায়ে কেরামের মধ্যে মতভেদ পরিলক্ষিত হয়। তবে বিশুদ্ধ মত হ’ল ওযূ অবস্থায় নারীদের স্পর্শ করলে ওযূ ভঙ্গ হবে না।[26] আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
يَا أَيُّهَا الَّذِيْنَ آمَنُوْا إِذَا قُمْتُمْ إِلَى الصَّلاَةِ فَاغْسِلُوْا وُجُوْهَكُمْ
وَأَيْدِيَكُمْ إِلَى الْمَرَافِقِ وَامْسَحُوْا بِرُءُوْسِكُمْ وَأَرْجُلَكُمْ إِلَى الْكَعْبَيْنِ وَإِنْ كُنْتُمْ جُنُبًا فَاطَّهَّرُوْا وَإِنْ كُنْتُمْ مَرْضَى أَوْ عَلَى سَفَرٍ أَوْ جَاءَ أَحَدٌ مِنْكُمْ مِنَ الْغَائِطِ أَوْ لاَمَسْتُمُ النِّسَاءَ فَلَمْ تَجِدُوْا مَاءً فَتَيَمَّمُوْا صَعِيْدًا طَيِّبًا فَامْسَحُوْا بِوُجُوْهِكُمْ وَأَيْدِيْكُمْ مِنْهُ.
‘হে মুমিনগণ! যখন তোমরা ছালাতে দন্ডায়মান হ’তে চাও, তখন তোমাদের মুখ ও কনুই পর্যন্ত হাত ধৌত কর, মাথা মাসেহ কর এবং টাখনু পর্যন্ত পা (ধৌত কর) এবং যদি তোমরা অপবিত্র থাক, তবে ভালভাবে পবিত্র হও। আর যদি অসুস্থ হও কিংবা সফরে থাক অথবা যদি তোমাদের কেউ পায়খানা থেকে আসে অথবা তোমরা যদি স্ত্রীদের সাথে সহবাস কর অতঃপর পানি না পাও, তবে পবিত্র মাটি দ্বারা তায়াম্মুম কর। সুতরাং তা দ্বারা তোমাদের মুখ ও হাত মাসাহ কর’ (মায়েদা ৬)। এই আয়াতে উল্লেখিত أَوْ لاَمَسْتُمُ النِّسَاءَ বলতে স্ত্রী সহবাসের কথা বুঝানো হয়েছে। শুধুমাত্র হাত দ্বারা স্পর্শ করা বুঝানো হয়নি।[27]
হাদীছে এসেছে, রাসূল (ছাঃ) তার কোন স্ত্রীকে চুম্বন করে ছালাত আদায় করেছেন। কিন্তু ওযূ করেননি। আয়েশা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, أَنَّ رَسُوْلَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَبَّلَ بَعْضَ نِسَائِهِ، ثُمَّ خَرَجَ إِلَى الصَّلاَةِ، وَلَمْ يَتَوَضَّأْ فَقُلْتُ : مَا هِيَ إِلاَّ أَنْتِ فَضَحِكَتْ. রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাঁর কতিপয় স্ত্রীকে চুম্বন করলেন। অতঃপর ছালাতের জন্য বের হয়ে গেলেন কিন্তু ওযূ করলেন না। আমি বললাম (উরওয়া ইবনে জুবাইর), সেটা আপনি ছাড়া আর কে? তখন তিনি (আয়েশা) হাসতে লাগলেন।[28] অতএব ওযূ অবস্থায় নারী স্পর্শ করলে বা চুম্বন করলে ওযূ ভঙ্গ হবে না।
শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনে তায়মিয়া (রহঃ) বলেন, কোন মহিলাকে স্পর্শ করলে অথবা কোন অপবিত্র বস্ত্ত স্পর্শ করলে ওযূ ভঙ্গ হবে না।[29]
মৃত ব্যক্তিকে গোসল করালে ওযূ ভঙ্গ হবে কি?
ওযূ অবস্থায় মৃত ব্যক্তিকে গোসল করালে ওযূ ভঙ্গ হবে না। কারণ মৃত ব্যক্তিকে গোসল করালে ওযূ ভঙ্গ হওয়ার বিষয়টি কুরআন ও হাদীছ দ্বারা সাব্যস্ত নয়। পক্ষান্তরে ইবনু ওমর (রাঃ), আবু হুরায়রাহ (রাঃ) এবং ইবনু আববাস (রাঃ) থেকে একটি আছার বর্ণিত হয়েছে যেখানে তাঁরা মৃত ব্যক্তিকে গোসল করানোর পরে ওযূ করার নির্দেশ দিয়েছেন।[30] অত্র আছার দ্বারা ওযূ ভঙ্গ হওয়ার কথা বুঝানো হয়নি। বরং মৃত ব্যক্তিকে গোসল করানোর পরে ওযূ করা মুস্তাহাব বুঝানো হয়েছে।[31]
যে সকল ইবাদতের জন্য ওযূ করা ওয়াজিব
ছালাত আদায় করার জন্য ওযূ করা :
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, لاَ تُقْبَلُ صَلاَةٌ بِغَيْرِ طُهُوْرٍ وَلاَ صَدَقَةٌ مِنْ غُلُوْلٍ. ‘পবিত্রতা ব্যতীত ছালাত এবং হারাম মালের দান কবুল হয় না’।[32] অতএব ছালাত ছহীহ হওয়ার পূর্বশর্ত হ’ল ওযূ ছহীহ হওয়া।
কুরআন স্পর্শ করার জন্য ওযূ করা ওয়াজিব কি?
ওযূ অবস্থায় কুরআন স্পর্শ করাই উত্তম। তবে ওযূ বিহীন কুরআন স্পর্শ করা জায়েয। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, لاَ يَمَسُّهُ إِلاَّ الْمُطَهَّرُوْنَ ‘কেউ তা (কুরআন) স্পর্শ করে না পবিত্রগণ ছাড়া’ (ওয়াক্বিয়া ৭৯)। এখানে ‘পবিত্রগণ’ বলতে ফেরেশতাগণকে বুঝানো হয়েছে। বিনা ওযূ উদ্দেশ্য নয়।
সুলায়মান ইবনে মূসা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী করীম (ছাঃ) বলেছেন, لاَ يَمَسُّ الْقُرْآنَ إِلاَّ طَاهِرٌ. ‘কুরআন স্পর্শ করে না পবিত্র ব্যক্তি ছাড়া’।[33] এখানে পবিত্র ব্যক্তি বলতে এমন অপবিত্রতা থেকে পবিত্রতা অর্জনকে বুঝানো হয়েছে, যে অপবিত্রতার কারণে গোসল করা ওয়াজিব হয়। অতএব কুরআন স্পর্শ করতে হ’লে ওযূ করা উত্তম, ওয়াজিব নয়। অর্থাৎ বিনা ওযূতে কুরআন স্পর্শ করে তেলাওয়াত করা জায়েয।
তিলাওয়াত ও শুকরিয়া সিজদাহ করার জন্য ওযূ শর্ত কি?
তিলাওয়াতে সিজদাহের অর্থাৎ কুরআনের যে সকল আয়াত তেলাওয়াত করলে সিজদাহ করতে হয় এবং শুকরিয়ার সিজদাহ, যা ভাল কোন খবর শুনলে করতে হয় তা ওযূ করে আদায় করা উত্তম। কিন্তু ওযূ করা ওয়াজিব নয়। অর্থাৎ বিনা ওযূতে এই সিজদাহ করা জায়েয।
এ প্রসঙ্গে হাদীছে এসেছে,
عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ رضـ نَّ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ سَجَدَ بِالنَّجْمِ وَسَجَدَ مَعَهُ الْمُسْلِمُوْنَ وَالْمُشْرِكُوْنَ وَالْجِنُّ وَالإِنْسُ.
ইবনু আববাস (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, নবী করীম (ছাঃ) সূরা নাজ্ম তিলাওয়াতের পর সিজদাহ করেন এবং তাঁর সাথে সমস্ত মুসলিম, মুশরিক, জ্বিন ও ইনসান সবাই সিজদাহ করেছিল’।[34]
অতএব তিলাওয়াত ও শুকরিয়ার সিজদাহর ক্ষেত্রে ওযূ পূর্বশর্ত হ’লে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মুশরিকদেরকে সিজদাহ করতে নিষেধ করতেন। কেননা তাদের ওযূ ও ছালাত ছহীহ নয়। শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনে তায়মিয়াহ এবং মুহাম্মাদ ইবনে ছালেহ আল-উছায়মীন (রহঃ) অনুরূপ ফৎওয়া প্রদান করেছেন।[35]
যে সকল কাজের জন্য ওযূ করা সুন্নাত?
(ক) আল্লাহ তা‘আলার যিকির এবং কুরআন তেলাওয়াতের সময় ওযূ করা। (খ) প্রত্যেক ছালাতের সময় ওযূ করা সুন্নাত। যদিও সে ওযূ অবস্থায় থাকে। কারণ রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) প্রত্যেক ছালাতের সময় ওযূ করতেন। আনাস (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, كَانَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَتَوَضَّأُ عِنْدَ كُلِّ صَلاَةٍ قُلْتُ كَيْفَ كُنْتُمْ تَصْنَعُوْنَ قَالَ يُجْزِئُ أَحَدَنَا الْوُضُوْءُ مَا لَمْ يُحْدِثْ. অর্থাৎ নবী করীম (ছাঃ) প্রত্যেক ছালাতের সময় ওযূ করতেন। আমি বললাম, আপনারা কি করতেন? তিনি বললেন, ওযূ ভঙ্গের কারণ না হওয়া পর্যন্ত আমাদের পূর্বের ওযূ যথেষ্ট হ’ত।[36]
(গ) সহবাসের পরে পুনরায় স্ত্রী মিলন, ঘুমাতে বা পানাহার করতে চাইলে ওযূ করা সুন্নাত। আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, إِذَا أَتَى أَحَدُكُمْ أَهْلَهُ ثُمَّ أَرَادَ أَنْ يَعُوْدَ فَلْيَتَوَضَّأْ. ‘তোমাদের কেউ একবার স্ত্রী সহবাস করার পরে পুনরায় সহবাসের ইচ্ছা করলে সে যেন ওযূ করে’।[37]
অন্য হাদীছে এসেছে, আয়েশা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, أَنَّ رَسُوْلَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ كَانَ إِذَا أَرَادَ أَنْ يَنَامَ وَهُوَ جُنُبٌ تَوَضَّأَ وُضُوْءَهُ لِلصَّلاَةِ قَبْلَ أَنْ يَنَامَ. অর্থাৎ রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) জুনুবী বা নাপাক অবস্থায় ঘুমাতে চাইলে ছালাতের ওযূর ন্যায় ওযূ করে ঘুমাতেন।[38]
আয়েশা (রাঃ) আরো বলেন, كَانَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إِذَا كَانَ جُنُبًا فَأَرَادَ أَنْ يَأْكُلَ أَوْ يَنَامَ تَوَضَّأَ وُضُوْءَهُ لِلصَّلاَةِ. অর্থাৎ রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) জুনুবী বা নাপাক অবস্থায় খেতে অথবা ঘুমাতে চাইলে ছালাতের ওযূর ন্যায় ওযূ করে নিতেন।[39]
(ঘ) গোসল করার পূর্বে ওযূ করা সুন্নাত
আয়েশা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত,
أَنَّ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ كَانَ إِذَا اغْتَسَلَ مِنَ الْجَنَابَةِ بَدَأَ فَغَسَلَ يَدَيْهِ ثُمَّ يَتَوَضَّأُ كَمَا يَتَوَضَّأُ لِلصَّلاَةِ ثُمَّ يُدْخِلُ أَصَابِعَهُ فِيْ الْمَاءِ فَيُخَلِّلُ بِهَا أُصُوْلَ شَعَرِهِ ثُمَّ يَصُبُّ عَلَى رَأْسِهِ ثَلاَثَ غُرَفٍ بِيَدَيْهِ ثُمَّ يُفِيْضُ الْمَاءَ عَلَى جِلْدِهِ كُلِّهِ.
অর্থাৎ নবী (ছাঃ) যখন জানাবাতের গোসল করতেন, তখন প্রথমে তাঁর হাত দু’টো ধুয়ে নিতেন। অতঃপর ছালাতের ওযূর মত ওযূ করতেন। অতঃপর তাঁর আঙ্গুলগুলো পানিতে ডুবিয়ে নিয়ে চুলের গোড়া খিলাল করতেন। অতঃপর তাঁর উভয় হাতের তিন অাঁজলা পানি মাথায় ঢালতেন। তারপর তাঁর সারা দেহের উপর পানি ঢেলে দিতেন।[40]
(ঙ) ঘুমের পূর্বে ওযূ করা :
বারা ইবনু আযেব (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী (ছাঃ) বলেছেন, إِذَا أَتَيْتَ مَضْجَعَكَ فَتَوَضَّأْ وُضُوْءَكَ لِلصَّلاَةِ ثُمَّ اضْطَجِعْ عَلَى شِقِّكَ الأَيْمَنِ…) অর্থাৎ যখন তুমি বিছানায় যাবে তখন ছালাতের ওযূর মত ওযূ করে নিবে। তারপর ডান কাতে শয়ন করবে…।[41]
ওযূর নিয়ম : (১) প্রথমে মনে মনে ওযূর নিয়ত করবে।[42] অতঃপর (২) ‘বিসমিল্লাহ’ বলবে।[43] এরপর (৩) ডান হাতে পানি নিয়ে দুই হাত কব্জি সমেত ধুবে[44] এবং আঙ্গুল সমূহ খিলাল করবে।[45] আঙ্গুলে আংটি থাকলে নাড়াচাড়া করে সেখানে পানি প্রবেশ করাবে।[46] এরপর (৪) ডান হাতে পানি নিয়ে ভালভাবে কুলি করবে ও প্রয়োজনে নতুন পানি নিয়ে নাকে দিয়ে বাম হাত দ্বারা ভালভাবে নাক ঝাড়বে।[47] তারপর (৫) কপালের গোড়া থেকে দুই কানের লতী হয়ে থুৎনির নীচ পর্যন্ত পুরা মুখমন্ডল ধৌত করবে[48] ও দাড়ি খিলাল করবে।[49] তারপর (৬) প্রথমে ডান ও পরে বাম হাত কনুই সহ ধুবে।[50] এরপর (৭) পানি নিয়ে দু’হাতের ভিজা আঙ্গুলগুলি মাথার সম্মুখ হ’তে পিছনে ও পিছন হ’তে সম্মুখে বুলিয়ে একবার পুরা মাথা মাসাহ করবে।[51] একই সাথে ভিজা শাহাদত আঙ্গুল দ্বারা কানের ভিতর অংশে ও বুড়ো আঙ্গুল দ্বারা পিছন অংশে মাসাহ করবে।[52] অতঃপর ডান ও বাম পায়ের টাখনুসহ ভালভাবে ধুবে[53] ও বাম হাতের আঙ্গুল দ্বারা পায়ের আঙ্গুল সমূহ খিলাল করবে।[54] (৯) এভাবে ওযূ শেষে বাম হাতে কিছু পানি নিয়ে লজ্জাস্থান বরাবর ছিটিয়ে দিবে[55]ও নিম্নোক্ত দো‘আ পাঠ করবে-
أَشْهَدُ أَنْ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللهُ وَحْدَهُ لاَ شَرِيْكَ لَهُ وَأَشْهَدُ أَنَّ مُحَمَّدًا عَبْدُهُ وَرَسُوْلُهُ، اللَّهُمَّ اجْعَلْنِيْ مِنَ التَّوَّابِيْنَ وَاجْعَلْنِيْ مِنَ الْمُتَطَهِّرِيْنَ–
‘আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ব্যতীত কোন উপাস্য নেই। তিনি একক, তাঁর কোন শরীক নেই। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মাদ (ছাঃ) তাঁর বান্দা ও রাসূল। হে আল্লাহ! আপনি আমাকে তওবাকারীদের ও পবিত্রতা অর্জনকারীদের অন্তর্ভুক্ত করুন’ (তিরমিযী)।
ওমর ফারূক (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, উক্ত হাদীছে রাসূল (ছাঃ) এরশাদ করেন, যে ব্যক্তি পূর্ণভাবে ওযূ করবে ও কালেমায়ে শাহাদত পাঠ করবে, তার জন্য জান্নাতের আটটি দরজাই খুলে দেওয়া হবে। যে দরজা দিয়ে ইচ্ছা সে প্রবেশ করবে।[56] উল্লেখ্য যে, এই দো‘আ পাঠের সময় আসমানের দিকে তাকানোর হাদীছটি ‘মুনকার’ বা যঈফ।[57]
[2]. ঐ, ‘ওযূর পানির সাথে পাপ সমূহ বের হয়ে যায়’ অনুচ্ছেদ, হা/৫৭৬, ৩/১২৬ পৃঃ।
[3]. ঐ, হা/৫৪৩, ৩/১০৮ পৃঃ।
[4]. ঐ, হা/৫৮৬, ৩/১৩৪ পৃঃ।
[5]. বুখারী, ‘রাতে ও দিনে পবিত্রতা অর্জনের মর্যাদা’ অনুচ্ছেদ, হা/১১৪৯, বঙ্গানুবাদ, তাওহীদ পাবলিকেশন্স ১/৫৫৭ পৃঃ।
[6]. মুসলিম, হা/২৩৪, মিশকাত, হা/২৭৮, ‘ওযূর মাহাত্ম্য’ অনুচ্ছেদ; বঙ্গানুবাদ (এমদাদিয়া) ২/৪৫ পৃঃ।
[7]. বুখারী, হা/১১৪২, বঙ্গানুবাদ তাওহীদ পাবলিকেশন্স ১/৫৫৪ পৃঃ।
[8]. বীর্যপাতের পূর্বে নিঃসৃত অপেক্ষাকৃত তরল শুক্ররস।
[9]. বুখারী, ‘পবিত্রতা ব্যতীত ছালাত কবুল হবে না’ অধ্যায়, হা/১৩৫, বঙ্গানুবাদ, তাওহীদ পাবলিকেশন্স, ১/৮৫ পৃঃ, মুসলিম, হা/২২৫। মিশকাত, হা/২৮০, বঙ্গানুবাদ (এমদাদিয়া) ২/৪৮ পৃঃ।
[10]. সুনানু ইবনে মাজাহ, হা/৪৭৮।
[11]. বুখারী, ‘নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত সন্দেহের কারণে ওযূ করতে হয় না’ অনুচ্ছেদ, হা/১৩৭, বঙ্গানুবাদ, তাওহীদ পাবলিকেশন্স ১/৮৬ পৃঃ।
[12]. আবু দাউদ হা/২৮৬, নাসাঈ, হা/৩৬০।
[13]. মুহাম্মাদ বিন ছালেহ আল-উছায়মীন, শারহুল মুমতে আলা যাদিল মুসতাকনি ১/২৭৪ পৃঃ, মুহাম্মাদ বিন ছালেহ আল-ফাওযান, আল-মুলাক্ষাছুল ফিক্বহী ১/৬১ পৃঃ।
[14]. সুনানু ইবনে মাজাহ, হা/৪৭৮।
[15]. সুনানু আবু দাউদ, হা/২০৩, সুনানু ইবনু মাজাহ, হা/৪৭৭, হাদীছ হাসান। দ্রঃ ইরওয়াউল গালীল ১/১৪৮ পৃঃ।
[16]. মাজমূ‘ ফাতাওয়া, ২১/২৩০ পৃঃ।
[17]. মুসলিম, হা/৩৭৬, আবূদাঊদ, হা/২০০।
[18]. মুসলিম, হা/৩৬০।
[19]. শারহুল মুমতে আলা যাদিল মুসতাকনি ১/২৮৪ পৃঃ; মুহাম্মাদ ইবনে ওমর ইবনে সালেম বাযেমূল, আত-তারজীহু ফী মাসায়েলিত ত্বাহারাহ ওয়াছ ছালাত, ৬০ পৃঃ।
[20]. সুনানু আবী দাঊদ হা/১৮২, হাদীছ ছহীহ।
[21]. মুওয়াত্ত্বা মালেক হা/৯১, তিরমিযী হা/৮২, নাসাঈ হা/১৬৩। হাদীছ ছহীহ।
[22]. মুসনাদে আহমাদ, ১/১৩২ পৃঃ। হাদীছটি হাসান লিগাইরিহি।
[23]. সুনানু আবী দাঊদ হা/১৮২, হাদীছ ছহীহ।
[24]. মাজমূ‘ ফাতাওয়া, ২১/২৪১ পৃঃ।
[25]. মুছান্নাফ আব্দুর রায্যাক, ১/১১৭-১২১ পৃঃ; মুছান্নাফ ইবনে আবী শায়বা, ১/১৬৪-১৬৫ পৃঃ।
[26]. শারহুল মুমতে, ১/২৯১ পৃঃ; আত-তারজীহু ফী মাসায়েলিত ত্বাহারাহ ওয়াছ ছালাত, ৬১-৬৭ পৃঃ।
[27]. তাফসীরুত ত্ববারী, (দারুল ফিকর), ৫/১০৫ পৃঃ।
[28]. সুনানু ইবনে মাজাহ, হা/৫০২, হাদীছটি ছহীহ।
[29]. ইমাম ইবনে তাইমিয়া, হাক্বীকাতুছ ছিয়াম, ৪৪ পৃঃ।
[30]. মুছান্নাফ আব্দুর রায্যাক, হা/৬১০১।
[31]. শারহুল মুমতে, ১/২৯৬ পৃঃ।
[32]. মুসরিম, হা/২২৫, মিশকাত, হা/২৮১, বঙ্গানুবাদ (এমদাদিয়া) ২/৪৮ পৃঃ।
[33]. মুয়াত্তা মালেক, ১/১৯৯ পৃঃ, দারাকুতনী, ১/১২১ পৃঃ; হাদীছ ছহীহ। দ্র: ইরওয়াউল গালীল, হা/১২২।
[34]. বুখারী, ‘মুশরিকদের সাথে মুসলিমগণের সাজদাহ করা আর মুশরিকরা অপবিত্র, তাদের ওযূ হয় না’ অনুচ্ছেদ, হা/১০৭১। বঙ্গানুবাদ তাওহীদ পাবলিকেশন্স ১/৫২৪ পৃঃ।
[35]. মাজমূ‘ ফাতাওয়া ২১/২৭৯,২৯৩ পৃঃ; শারহুল মুমতে ১/৩২৫-৩২৭ পৃঃ।
[36]. বুখারী, ‘হাদাছ ব্যতীত ওযূ করা’ অনুচ্ছেদ, হা/২১৪, বঙ্গানুবাদ তাওহীদ পাবলিকেশন্স ১/১১৮ পৃঃ।
[37]. মুসলিম, হা/৩০৮।
[38]. মুসলিম, হা/৩০৫।
[39]. মুসলিম, হা/৩০৬।
[40]. বুখারী, ‘গোসলের পূর্বে অযূ করা’ অনুচ্ছেদ, হা/২৪৮, বঙ্গানুবাদ তাওহীদ পাবলিকেশন্স ১/১৩৪ পৃঃ।
[41]. বুখারী, ‘গোসলের পূর্বে অযূ করা’ অনুচ্ছেদ, হা/২৪৭, বঙ্গানুবাদ তাওহীদ পাবলিকেশন্স ১/১৩১ পৃঃ।
[42]. মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/১।
[43]. মিরমিযী, ইবনু মাজাহ, মিশকাত হা/৪০২।
[44]. মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, নায়লুল আওতার ১/২০৬ ও ২১০ পৃঃ।
[45]. নাসাঈ, আবূদাঊদ, তিরমিযী, ইবনু মাজাহ, মিশকাত হা/৪০৫।
[46]. বুখারী, নায়লুল আওতার ১/২৩১ পৃঃ; ‘আংটি নাড়াচাড়া ও আঙ্গুল সমূহ খিলাল করা’ অনুচ্ছেদ।
[47]. মুত্তাফাক আলাইহ, মিশকাত হা/৩৯৪।
[48]. মুত্তাফাক আলাইহ, নায়লুল আওতার ১/২১০ পৃঃ।
[49]. তিরমিযী, নায়লুল আওতার ১/২২৪ পৃঃ।
[50]. বুখারী, নায়লুল আওতার ১/২২৩ পৃঃ।
[51]. মুত্তাফাক আলাইহ, মিশকাত হা/৩৯৪।
[52]. নাসাঈ, ইবনু মাজাহ, মিশকাত হা/৪১৪।
[53]. মুত্তাফাক আলাইহ, মিশকাত হা/৩৯৪।
[54]. আবূদাঊদ, তিরমিযী, মিশকাত হা/৪০৬-০৭।
[55]. আবূদাঊদ, নাসাঈ, মিশকাত হা/৩৬১।
[56]. তিরমিযী, মিশকাত হা/২৮৯।
[57]. নাছিরুদ্দীন আলবানী, ইরওয়াউল গালীল ১/১৩৫ পৃঃ।