ইসলাম ও রাসুল সাঃ এর বিরুদ্ধে প্রপাগান্ডাঃ সেকাল ও একাল
আবু উসাইদ
রাসুলুল্লাহ সাঃ এর যে সকল অনন্য গুনাবলী আল্লাহ্ দিয়েছিলেন, তার একটি হলো তাঁর ভাষা। অল্প কথায় এতো সুন্দর ভাব প্রকাশ করতে তাঁর মতো সমসাময়িক পৃথিবীতে আর কেউ পারেনি। নবুয়্যত লাভ করার পর সারা জীবনে একটি অপ্রয়োজনীয় কথাও তিনি বলেননি। সামান্য দু-একটি উদাহরণ দেয়া যাক।
“যে ব্যক্তি তার দুই চোয়াল এবং দুই উরুর মধ্যবর্তি অঙ্গের হিফাজত করবে, আমি তার জন্য জান্নাতের জামিন হবো”। (বুখারী)
“যে ব্যক্তি আল্লাহ্ ও আখিরাতের উপর বিশ্বাস রাখে তার উচিৎ উত্তম কথা বলা অথবা চুপ থাকা”। (বুখারী)
“তোমাদের ভেতর সেই লোক উত্তম, যে নিজে কুরআন শিখে ও অপরকে শেখায়”। (বুখারী)
“হে আল্লাহ্, হে অন্তর সমূহের পরিবর্তনকারী, তুমি আমার অন্তরকে তোমার আনুগত্যের দিকে ফিরিয়ে দাও”। (আবু দাউদ)
“আল্লাহ্, তুমি আমাকে ক্ষমা করো, আমার উপর রহম করো, আমাকে হিদায়াত দান করো, আমার অভাব পূরণ করো, আমার ভয় দূর করো, আমাকে রিজিক দান করো, আমার অপূর্ণতাকে পূর্ণ করো” (নামাজে দুই সিজদাহর মাঝখানে তিনি এই দুয়া পড়তেন। লক্ষ্য করে দেখুন আপনার এক জীবনের জন্য আর কিছু বাকী আছে কিনা)। (মুসলিম)
রাসুলুল্লাহ সাঃ যখন থেকে মানুষকে প্রকাশ্যে ইসলামের দিকে ডাকতে লাগলেন তখন কুফফার গোষ্ঠীর অন্যতম সমস্যা হয়ে দাঁড়ালো তাঁর এমন ভাষার মোকাবেলা করা। ঘটনা এমন ঘটতে লাগলো যে, কেউ একজন কোন কারণে মক্কায় এলো। সে যেন ইসলামের দিকে আকৃষ্ট না হতে পারে সে জন্য কাফিররা আগে থেকেই তার কানে এমন এক মন্ত্র দিয়ে দিলো যে, “এখানে মুহাম্মাদ নামে এক পাগল কবি আছে- যে মানুষকে বিভ্রান্ত করছে, নিজেদের দ্বীন থেকে বের করে ফেলছে। তোমরা সবাই সাবধান থেকো”। কথাটা শুনে অনেকেই ভড়কে যায়, তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা গেলো তারা কথাগুলো শোনার জন্য আগ্রহী হয়ে উঠে, যেনো “দেখিতো কি বলে”-এমন। আর কেউ যখন উৎসাহী হয়ে তাঁর (সাঃ) সাথে দেখা করে তাঁর কথা শুনে, তাহলে সে অবাক হয়। এ লোক কিভাবে পাগল আর কবি হতে পারে? তারা আরো বিমোহিত হয় কুরআনের ততোধিক শ্রেষ্ঠ ভাষা ও শব্দচয়ন শুনে। এক সময় দেখা গেলো সে লোকগুলোই ইসলামে প্রবেশের জন্য অগ্রগামী হয়ে যাচ্ছে।
এহেন পরিস্থিতে কুফফার গোষ্ঠী খাবি খাচ্ছিলো। এক সময় তারা সিদ্ধান্ত নিলো যে, তারা রাসুলুল্লাহ সাঃ এর সাথে সারাক্ষণ আঠার মতো লেগে থাকবে আর তিনি যেনো মানুষের সাথে কোন কথা না বলতে পারেন সেজন্য মানুষকে দূরে সরিয়ে রাখবে। এই কাজে সবচেয়ে অগ্রগামী হয়ে এগিয়ে এলো এমন এক ব্যক্তি, যিনি ইসলাম আসার আসার আগে ছিলেন রাসুলুল্লাহ সাঃ এর সবচেয়ে প্রিয়তম ব্যক্তিদের একজন, যার নাম আবু লাহাব। এই ব্যক্তি সারাদিন রাসুলুল্লাহ সাঃ এর সাথে সেঁটে থাকতো। তিনি কারো সাথে কথা বলতে গেলে ওই লোককে বলতো, “কার সাথে কথা বলতে যাচ্ছো তুমি? এ তো পাগল আর যাদুকর। তোমাকে তোমার দ্বীন থেকে বের করাই হলো এর বদ মতলব। সরে যাও, সরে যাও”। আবু লাহাবের কথা শুনে আর রাসুলের মুখের দিকে তাকিয়ে অনেকেরই মনে সন্দেহ হতো-এ লোকটা কি আসলেই এমন? অনেকে আবু লাহাবের বাধা উপেক্ষা করেও কথা শুনতো আর আশ্চর্য হতো, “না এ তো এমন হতেই পারে না”। এক সময় মাঠে নেমে গেলো কুফফারদের সেরা কবির দল। তারা কেউ কুরআনকে কটাক্ষ করে লিখতে লাগলো, কেউ আবার রাসুলকে ব্যাঙ্গ করে লিখতে লাগলো কবিতা, আর কেউ কেউ ভয়ংকর সব অশ্লীল সাহিত্য আর কবিতা প্রচার করতে লাগলো রাসুলুল্লাহ সাঃ এর পবিত্র চরিত্রের নামে। মোটামুটি একা এই মানুষটির বিরুদ্ধে সবাই একসাথে মাঠে নেমে গেলো, কিন্তু সমস্যা হলো একটাই। আল্লাহ্ ছিলেন তাঁর সাথে। “তারাও ষড়যন্ত্র করে, আর আল্লাহও পরিকল্পনা করেন। আর আল্লাহ্ হলেন শ্রেষ্ঠ পরিকল্পনাকারী” কুরআনের এ আয়াত পরে নাজিল হলেও আল্লাহ্ এর ব্যতিক্রম আগেও করেননি। এক সময় আল্লাহ্ তাঁকে এদের উপর প্রতিশ্রুত বিজয় দিলেন। ইসলাম হয়ে দাঁড়ালো পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ শক্তি।
তবে সেই যে শুরু হয়েছিলো ইসলাম আর রাসুলুল্লাহ সাঃ এর বিরুদ্ধে অপপ্রচার, তা আজ পর্যন্ত চলছে এবং কিয়ামাত পর্যন্ত চলবে। কালের পরিক্রমায় কেউ ইসলামকে বাতিল বলেছে, কেউ রাসুল সাঃকে সন্ত্রাসী আখ্যা দিয়েছে, কেউ চালিয়েছে অশ্লীল আক্রমণ। কেউ আবার রাসুলুল্লাহ সাঃ কে অনেক বড় মাপের মানুষ দেখিয়ে বিরাট বই লিখেছে, তবে তার সাথে সূক্ষ্মভাবে লিখে দিয়েছে, “মুহাম্মাদ সত্যিই ছিলেন অসম্ভব জ্ঞানী ও প্রতিভাবান, তাই তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়েছিলো কুরআনের মতো এমন একটি উন্নত বই রচনা করা (আল্লাহ্ ক্ষমা করুন আমাদের)”।
ইসলামের পুরো ইতিহাস বাদ দেয়া যাক। আমাদের সামান্য সময়ে আমরা দেখেছি সালমান রুশদীর স্যাটানিক ভার্সেস, তসলিমা নাসরিনের মানহীন অনেক সাহিত্যে আল্লাহ্ ও রাসুলের বিরোধিতা, রাসুলুল্লাহ সাঃ কে নিয়ে কার্টুন আঁকার প্রতিযোগিতা, শামসুর রাহমান-শওকত ওসমান-হুমায়ূন আযাদ-আহমদ শরীফের মতো ইসলাম ও রাসুলের সুকৌশলী কুৎসাকারীকে। অতি সাম্প্রতিক সময়ে শুরু হয়েছে ইসলাম আর রাসুলুল্লাহ সাঃএর বিরুদ্ধে ফিল্ম বানিয়ে ছড়িয়ে দেয়া। আগ্রাসী ইন্টারনেট আর ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার বদৌলতে তা ছড়িয়ে পড়ছে সারা বিশ্বে।
রাসুলুল্লাহ সাঃ এর বিরুদ্ধে পাগল অপবাদ আর অশ্লীল কবিতা যখন চরমে, তখন মক্কায় এসেছিলো আরব উপদ্বীপের বিখ্যাত একজন চিকিৎসক। মানুষের কাছ থেকে রাসুলের নামে এমন আক্রমণাত্মক কথা শুনে তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন সেই লোকটির সাথে দেখা করবেন। একদিন দেখা করলেন তিনি তাঁর (সাঃ) সাথে। তাঁকে (সাঃ) তিনি বললেন, “ভাই, তোমার কি সত্যিই কোন মানসিক অসুবিধা হচ্ছে? আমার কাছে এর ভালো ঔষধ আছে, তুমি চাইলে আমি তা তোমাকে তা দিতে পারি। আশা করি কাজে দেবে তোমার”। রাসুলুল্লাহ সাঃ মৃদু হেসে বললেন, “আপনি আগে আমার কিছু কথা শুনুন, তারপর আপনি ভাবুন কি করা যায়”। তিনি (সাঃ) তাঁকে ইসলাম ও আল্লাহর কথা শুনালেন। কুরআনের আয়াত শুনালেন। সেই চিকিৎসক সব শুনে আবেগাক্রান্ত হয়ে পড়লেন। হিদায়াতের দ্বার আল্লাহ্ তার জন্য খুলে দিয়েছিলেন। গোপনে তিনি তখনই ইসলাম গ্রহণ করলেন। রাসুলের কাছে তিনি এসেছিলেন এক উদ্দেশ্য নিয়ে, ফিরে গেলেন আলোক উদ্ভাসিত অন্তর নিয়ে।
আজ মুসলিমদের ভগ্ন দশা। তারা আজ কুফফারদের দিকে চাতক পাখির মতো তাকিয়ে থাকে অনুদান আর অনুকম্পার জন্য। সারা পৃথিবীতে যতো পাখি আর পশু প্রতি বছর গুলি করে মারা হয়, তার চেয়ে হয়তো অনেক বেশী মুসলিম মারা হয় গুলি করে আর বোমা মেরে। পাখি কিংবা বন্য প্রাণী শিকারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার শক্ত আইন আছে, মুসলিম মারার কোন বিচার নেই। বিশ্ব মিডিয়া আর পাপেট শাসকদল আজ কুফফারদের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে। আজ তাই পৃথিবীর সকল সময়ের চেয়ে বেড়ে গেছে এদের এই আক্রমণ আর অশ্লীল অপবাদ। ইসলামের সামান্য জ্ঞান লাভকারী যে কোন মানুষেরই এমন অপবাদ শুনে অন্তর ছিন্ন ভিন্ন হয়। তবে এমন প্রপাগান্ডা যতোবার হয়েছে তা ইসলামের পক্ষেই গেছে, মানুষ আগ্রহী হয়েছে ইসলামকে জানার জন্য। হু হু করে বেড়েছে ইসলামে কনভার্শনের হার। মুসলিম জাতি আজ আঘাতে আঘাতে জর্জরিত কিন্তু তারা জানে শ্রেষ্ঠ সান্ত্বনা ও আশ্রয়ের স্থানটি তাদের অধিকারে সব সময়ই আছে, এবং তা কখনো তাদের ছেড়ে যাবে না। আর সেটা হলো আল্লাহর সেই বাণী- “তারাও ষড়যন্ত্র করে, আর আল্লাহও পরিকল্পনা করেন। আর আল্লাহ্ হলেন শ্রেষ্ঠ পরিকল্পনাকারী”।