সাম্প্রতিক প্রসঙ্গ

রাজনীতি করুন, ইসলামের অপব্যাখ্যা করবেন না

মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব

গত ৫ই ফেব্রুয়ারী’১২-তে ঢাকার একটি দৈনিকে প্রকাশিত এদেশের একটি পরিচিত ইসলামী রাজনৈতিক দলের কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদের একজন প্রভাবশালী ব্যারিষ্টার সদস্যের লিখিত প্রবন্ধটি অনেক পরে ইন্টারনেটে পড়লাম। লেখাটিতে তিনি তাঁর দলের নেতা-কর্মীদের আরব বসন্তের ঢেউয়ে উজ্জীবিত হওয়ার আহবান জানিয়েছেন এবং তিনি লেখাটি শেষ করেছেন নিম্নোক্ত বাক্যের মাধ্যমে-
‘প্রশ্ন হচ্ছে, দক্ষিণ এশিয়ার ১৬ কোটি মানুষের বাংলাদেশের গায়ে এই আরব বসন্তের বাতাস কখন লাগবে?’ এ আহবান তাঁর নিজের, না দলের, না তাঁর মক্কেল কারাবন্দী নেতাদের, না নেপথ্য মোড়লদের, ভবিষ্যতই সেটা বলে দেবে।
‘আরব বসন্ত’ বলতে লেখক যেটি বুঝাতে চেয়েছেন, সেটি হ’ল তাঁর মতে ইসলামী নেতাদেরকে ইসলামী শরী‘আত বাস্তবায়নের লক্ষ্য পরিবর্তন করে বর্তমানে সেক্যুলার নীতি অবলম্বন করতে হবে। যেমনটি পরিদৃষ্ট হয়েছে আরব বসন্তের ইসলামী নেতাদের মাঝে। তাঁর দেওয়া তথ্য মতে, তিউনিসিয়ার ইসলামী দল আন-নাহযাহ পার্টি ২১৭ সদস্যের পার্লামেন্টে ৮৯টি আসন পেয়েছে। বাকীগুলি পেয়েছে সেক্যুলার দু’টি দল। মরক্কোতে ৩৯৫ আসনের পার্লামেন্টে ১০৭টি আসন পেয়েছে সেদেশের মধ্যপন্থী ইসলামী দল জাস্টিস এন্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি এবং মিসরের ইখওয়ানের রাজনৈতিক শাখা ফ্রিডম এন্ড জাস্টিস পার্টি সেদেশের ৫০৮ আসনের পার্লামেন্টে ২৩৫টি আসন পেয়েছে। ১২৩টি আসন পেয়েছে সালাফীপন্থী আন-নূর পার্টি।
এক্ষণে নির্বাচনে জয়লাভের পর এই পার্টিগুলির ভূমিকা কী ছিল? নিম্নে চিত্রটি সংক্ষেপে দেয়া হল।-
(১) আরব বসন্ত শুরু হয় যে তিউনিসিয়ায়, সেখানকার ইসলামী দল আন-নাহযার চেয়ারম্যান রশীদ ঘানুসী (৭০) দীর্ঘ ২০ বছর লন্ডনে নির্বাসিত জীবন কাটিয়ে স্বদেশে ফিরে ঘোষণা করেছেন যে, ‘ক্ষমতায় গেলে তার দল শরীয়া আইন বাস্তবায়ন করবে না’। নাহযাহ পার্টির এক মুখপাত্র বলেন, তারা তিউনিসিয়াকে মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে উদার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিণত করবেন। সেখানে মাদক নিষিদ্ধ করা হবে না বা বিদেশীদেরকে সী বীচে বিকিনি পরিধান নিষিদ্ধ করা হবে না। ইসলামী ব্যাংকিংকে বাধ্যতামূলক করা হবে না। কেননা তাঁর মতে তিউনিসিয়া সবার দেশ। রশিদ ঘানুসির ভাষায়- ‘..in which the rights of God, the Prophet, women, men, the religious and the non-religious are assured, because Tunisia is for everyone’ অর্থাৎ ‘এ দেশে গড, নবী, নারী, পুরুষ, ধার্মিক, অধার্মিক নির্বিশেষে সকলের অধিকার নিশ্চিত করা হবে। কেননা তিউনিসিয়া সকলের’ (বিবিসি নিউজ, ২৭ অক্টোবর’১১)
পাঠক খেয়াল করুন, এত বড় একজন ইসলামী নেতা ‘আল্লাহ’ না বলে ‘গড’ বলছেন। ২০ বছর লন্ডনে থেকে ব্রেন ওয়াশ হয়ে গেছে বলেই তো মনে হয়। জানা আবশ্যক যে, ‘আল্লাহ’ নামের কোন প্রতিশব্দ নেই। এর পরিবর্তে গড, ঈশ্বর, ভগবান, সৃষ্টিকর্তা, উপরওয়ালা ইত্যাদি বলা নিষিদ্ধ।
(২) মরক্কোর বিজয়ী ইসলামী দল পিজেডি ঘোষণা করেছে, তারা জনগণের উপর ইসলামের কোনো বিধান চাপিয়ে দেবে না। বরং তারা ইসলামী অর্থনীতি অনুসরণ করে দেশকে উন্নয়ন, অধিকতর সমবণ্টন এবং দারিদ্র্য বিমোচনের চেষ্টা করবে। তবে মাদক এবং মহিলাদের পর্দার মত বিষয়গুলোতে তারা কোন মতামত দেবে না। কেননা মরক্কো পর্যটকদের জন্য একটি আকর্ষণীয় স্থান (বিবিসি নিউজ, ২৭ নভেম্বর’১১)
(৩) বহুল প্রসিদ্ধ ইখওয়ানুল মুসলেমীনের রাজনৈতিক শাখা ফ্রিডম এন্ড জাস্টিস পার্টি ঘোষণা করেছিল যে, একজন ক্যাথলিক খ্রিষ্টানকেও মিসরের রাষ্ট্রপ্রধান হিসাবে মেনে নিতে তাদের কোন আপত্তি থাকবে না। যার ধারাবাহিকতায় বর্তমান প্রেসিডেন্ট মুরসী তাঁর ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসাবে গ্রহণ করেছেন একজন কপটিক খ্রিষ্টানকে এবং একজন নারীকে।
তাদের সমমনা ভারতের ‘জামায়াতে ইসলামী’ গত বছরের এপ্রিল মাসে ‘ওয়েলফেয়ার পার্টি অফ ইন্ডিয়া’ নামে নতুন একটি রাজনৈতিক দল গঠন করেছে। পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামী তাদের আদর্শিক কার্যক্রম চালিয়ে যাবে। ১৬ সদস্যের উক্ত ওয়েলফেয়ার পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটিতে প্রেসিডেন্ট ও সেক্রেটারী জামায়াতে ইসলামীর লোক হলেও তাতে পাঁচজন অমুসলিম রয়েছে। ভাইস চেয়ারম্যান দু’জনের একজন খ্রিষ্টান ও অন্যজন অন্যধর্মী অমুসলিম। তারা তাদের ইসলামী শ্লোগান বাদ দিয়ে এখন করেছে কেবল ‘ন্যায় বিচার, স্বাধীনতা ও সমতা’।
উপরোক্ত ইসলামী দলগুলির এই আদর্শচ্যুতিকেই লেখক উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছেন। আর এটাই তাঁর বহু কাংখিত ‘আরব বসন্ত’-এর শিক্ষা।
তিনি তুরস্কের ইসলামপন্থী সাবেক প্রধানমন্ত্রী নাজমুদ্দীন আরবাকানের পতন ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী এরদোগানের সেক্যুলার নীতি তুলে ধরে এরদোগানের প্রশংসা করেছেন। কারণ তিনি ইসলামের নাম নেন না এবং পাশ্চাত্যের সমালোচনা করেন না। নিজ দেশে ইসলামবিরোধী আইনসমূহও বাতিল করেননি। অমনিভাবে তিনি মালয়েশিয়ার ইসলামী দল পিএএস যারা এখন ইসলামের কথা বাদ দিয়ে কেবল ন্যায়বিচারের কথা বলছে, তাদের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন এবং বলেছেন, নেতৃত্বের কাজ হ’ল একটি পথ রুদ্ধ হলে আরো তিনটি পথ বের করা’।
অতঃপর তিনি তাঁর উদ্দেশ্য হাছিলের জন্য কুরআনের একাধিক আয়াতের অপব্যাখ্যা করেছেন। আমরা তাঁর দলের রাজনীতির মধ্যে প্রবেশ না করে স্রেফ কুরআনের অপব্যাখ্যাগুলি তুলে ধরব ও তার জবাব দেব ইনশাআল্লাহ।-
কুরআনের অপবাখ্যা :
(১) ইসলামী নেতাদের আদর্শচ্যুতির পক্ষে তিনি সূরা হজ্জ-এর শেষ আয়াতটিকে ব্যবহার করেছেন। যেখানে আল্লাহ বলেছেন,وَمَا جَعَلَ عَلَيْكُمْ فِي الدِّينِ مِنْ حَرَجٍ ‘আর আল্লাহ দ্বীনের ব্যাপারে তোমাদের উপর কোনরূপ সংকীর্ণতা আরোপ করেননি’। এর ব্যাখ্যায় রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন যে, নিশ্চয়ই দ্বীন সহজ। যে ব্যক্তি এতে কড়াকড়ি আরোপ করে, দ্বীন তাকে পরাভূত করে। কাজেই তোমরা মধ্যম পন্থা অবলম্বন কর… এবং সকালে, বিকালে ও রাতের কিছু অংশে ইবাদতের মাধ্যমে আল্লাহর সাহায্য প্রার্থনা কর’ (বুখারী হা/৩৯)। এ আয়াতের মধ্যে ইবাদতের ক্ষেত্রে মধ্যপন্থা অবলম্বন করতে বলা হয়েছে। কিন্তু কাউকে ইসলামী আদর্শ ছেড়ে কুফরী সেক্যুলার মতাদর্শ গ্রহণ করার অনুমতি দেওয়া হয়নি।
(২) একই উদ্দেশ্যে সূরা আনকাবূতের ২৯ আয়াতটি ব্যবহার করেছেন। যেখানে আল্লাহ বলছেন,وَالَّذِيْنَ جَاهَدُوْا فِيْنَا لَنَهْدِيَنَّهُمْ سُبُلَنَا وَإِنَّ اللهَ لَمَعَ الْمُحْسِنِيْنَ ‘যারা আমাদের পথে সংগ্রাম করে, আমরা তাদেরকে আমাদের রাস্তা সমূহে পরিচালিত করব। আর আল্লাহ অবশ্যই সৎকর্মশীলদের সঙ্গে থাকেন’ (আনকাবূত ২৯/৬৯)
উক্ত আয়াতে আল্লাহ বলেছেন, তিনি কেবল আল্লাহর পথে সংগ্রামকারী সৎকর্মশীলদের সাথে থাকেন। পথভ্রষ্ট লোকদের সাথে নয়। অথচ এখানে আল্লাহবিরোধী সেক্যুলার রাস্তায় আহবানের পক্ষে আয়াতটিকে ব্যবহার করেছেন মাননীয় লেখক।
ইহুদী-নাছারা ও সেক্যুলারদের পাতানো দলতন্ত্রের ফাঁদে পা দিয়ে কথিত ইসলামী দলগুলি নতুন হিসাবে প্রথমবারে কিছু বেশী ভোট পাওয়ায় লেখক খুশীতে হুঁশ হারিয়ে ফেলেছেন। তারা কি ভুলে গেছেন যে, শতকরা ১০০ ভাগ ভোট পেয়েও শেখ মুজিব বা সাদ্দাম হোসেন টিকতে পারেননি? অতএব ভোট পাওয়া না পাওয়ার সাথে সত্য-মিথ্যার কোন সম্পর্ক নেই। মূল বিষয়টি হ’ল ইসলামী দলগুলি জনগণকে ইসলামের পথে পরিচালিত করতে চায়, না কি শয়তানী পথে পরিচালিত করতে চায়-সে ব্যাপারে আগে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। ইসলামের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কল্যাণকারিতা তারা কতটুকু জনগণকে বুঝাতে পেরেছেন? কিংবা তারা নিজেরা বা তাদের কর্মীরা কতটুকু বুঝেন ও আমল করেন?
(৩) মাননীয় লেখক তুরষ্ক, তিউনিসিয়া, মালয়েশিয়া, মিসর ও ভারতে ইসলামী আন্দোলনের কৌশলগত অবস্থান পরিবর্তনের প্রশংসা করার পর বলেছেন, এর আসল লক্ষ্য হ’ল ‘দ্বীনের বাস্তবায়ন’! এখানে তিনি সূরা ছফ ৯ আয়াতটির অপব্যাখ্যা করেছেন। পূর্ণ আয়াতটি হ’ল,هُوَ الَّذِيْ أَرْسَلَ رَسُوْلَهُ بِالْهُدَى وَدِيْنِ الْحَقِّ لِيُظْهِرَهُ عَلَى الدِّيْنِ كُلِّهِ وَلَوْ كَرِهَ الْمُشْرِكُوْنَ ‘তিনি সেই সত্তা, যিনি স্বীয় রাসূলকে হেদায়াত ও সত্যদ্বীন সহ প্রেরণ করেছেন সকল দ্বীনের উপর তাকে বিজয়ী করার জন্য। যদিও মুশরিকরা তা অপসন্দ করে’ (ছফ ৬২/৯)। অর্থাৎ তাঁর মতে ঐসব দেশে দ্বীনের বিজয় হয়েছে ইসলামকে বাদ দিয়ে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের সাথে আপোষ করার কারণে। অতএব আমাদেরও সেটা করা উচিৎ।
প্রশ্ন হ’ল, উক্ত আয়াতে দ্বীনকে বিজয়ী করার অর্থ কি রাজনৈতিক বিজয়? সকল দ্বীনের উপর বিজয় অর্থ কি সকল রাষ্ট্রের উপর বিজয়? আফসোস! এই তথাকথিত বিজয় যে কত ভঙ্গুর তার নিদর্শন বারবার প্রকাশিত হওয়ার পরেও এসব ইসলামী রাজনীতিকদের হুঁশ ফেরে না। যেমন অনেক টালবাহানার পর গত ২৪শে জুন’১২ ঘোষিত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ফলাফলে দেখা গেল যে, ১ কোটি ৩২ লাখ ভোট পেয়ে ইখওয়ানের প্রার্থী মুহাম্মাদ মুরসী মিসরের প্রেসিডেন্ট হয়েছেন। মোবারকপন্থী প্রার্থী আহমাদ শফিক তাঁর চেয়ে মাত্র ৯ লাখ ভোট কম পেয়েছেন। অথচ তার আদৌ ভোট পাওয়ার কথা নয়। তাই আগামী নির্বাচনে এটুকু উৎরে যেতে সেক্যুলারদের কোন সমস্যা হবে বলে মনে হয় না। পত্রিকায় এসেছে যে, পাশ্চাত্যের সাথে সমঝোতার মাধ্যমেই মুরসীকে নির্বাচিত ঘোষণা করা হয়েছে। অর্থাৎ সেক্যুলারদের চাইতে তিনি হবেন আরও এক কাটা বাড়া। যেমন তুরস্কের অবস্থা হয়েছে।
উল্লেখ্য যে, আমাদের নবী (ছাঃ) মৃত্যুর তিন বছর পূর্বে মক্কা জয় করেন। তার অর্থ তৎকালীন বিশ্বের সকল রাষ্ট্রের উপর বিজয় নয়। তিনি তো সে সময়ের পরাশক্তি রোম ও পারস্য জয় করেননি। জয় করেননি ভারত-বাংলাদেশ কিংবা ইউরোপ-আমেরিকা। তার অর্থ কি তিনি সকল দ্বীনের উপর বিজয় লাভ করেননি? অবশ্যই করেছেন। তবে সেটা আদর্শিক বিজয়। কথিত রাজনৈতিক বিজয় নয়।
ব্যারিষ্টার ছাহেবদের মত রাজনৈতিক মুফাসসিরদের মাথায় কেবলই রাজনৈতিক ক্ষমতার চিন্তা ঘুরপাক খায়। তাই রাজনৈতিক বিজয়কেই তারা আসল বিজয় মনে করেন। অথচ আল্লাহ এখানে বলেছেন لِيُظْهِرَهُ عَلَى الدِّيْنِ كُلِّهِ ‘সকল দ্বীনের উপর বিজয়’। সকল রাষ্ট্রের উপর বিজয় নয়। একটু পরেই বলা হয়েছে وَلَوْ كَرِهَ الْمُشْرِكُوْنَ ‘যদিও এটা মুশরিকরা অপসন্দ করে’।
জানা আবশ্যক যে, মুশরিকরা ইসলামী আদর্শকে অপসন্দ করে এবং নানারকম দোহাই দিয়ে নিজেদের বাতিল দ্বীনকে অাঁকড়ে থাকে। কিন্তু তারা কখনোই ইসলামী শাসনকে অপসন্দ করে না। বরং নিজেদের জাতভাই রোম সম্রাটের শাসন থেকে বাঁচার জন্য সিরিয়ার তৎকালীন খ্রিষ্টানরা মুসলিম বিজেতা সেনাপতি আবু ওবায়দাহ ইবনুল জাররাহ-এর কাছে অনুনয়-বিনয় করেছিল ইসলামী খেলাফতের অধীনস্ত থাকার জন্য। সিন্ধুর হিন্দু প্রজারা তাদের হিন্দু রাজাকে ছেড়ে মুসলিম বিজেতা সেনাপতি মুহাম্মাদ বিন কাসিমের শাসনকে স্বাগত জানিয়েছিল। এমনকি তাঁর মৃত্যুর খবর শুনে রাস্তায় কেঁদে গড়াগড়ি দিয়েছিল ও তাঁর মূর্তি গড়ে পূজা শুরু করেছিল। ভারতবর্ষের অমুসলিম প্রজাসাধারণ দিল্লীর মুসলিম শাসকদের ‘দিল্লীশ্বর’ ‘জগদীশ্বর’ বলে শ্রদ্ধা জানাতো। কারণ মুশরিকরা একথা ভালভাবেই জানে যে, ইসলামী শাসনেই কেবল ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল প্রজাসাধারণের জান-মাল ও ইযযতের নিরাপত্তা রয়েছে। অন্য কোন শাসনে যার কল্পনাই করা যায় না।
অতএব সেক্যুলারিজমের কাছে সিজদা করে দু’চারটে এম.পি পদ দখল করার নাম ইসলামের বিজয় নয়। ইসলাম নিঃসন্দেহে বিশ্ববিজয়ী আদর্শ। নেতাদের কর্তব্য হ’ল ইসলামের বিজয়ী আদর্শ সেক্যুলার নেতাদের কাছে তুলে ধরা এবং এর কল্যাণকারিতার প্রতি বিশ্বকে আকৃষ্ট করা। যে দেশের জনগণ যত দ্রুত এটা বুঝতে পারবে, সেদেশে তত দ্রুত ইসলাম তার আদর্শিক ও রাজনৈতিক বিজয় লাভ করবে।
(৪) সূরা আহযাব ২১ আয়াতে আল্লাহ বলেন, لَقَدْ كَانَ لَكُمْ فِي رَسُولِ اللهِ أُسْوَةٌ حَسَنَةٌ لِّمَنْ كَانَ يَرْجُوْ اللهَ وَالْيَوْمَ الْآخِرَ وَذَكَرَ اللهَ كَثِيْرًا- ‘নিশ্চয়ই তোমাদের মধ্যে যারা আল্লাহ ও আখেরাতকে কামনা করে এবং আল্লাহকে বেশী বেশী স্মরণ করে, তাদের জন্য আল্লাহর রাসূলের মধ্যে উত্তম আদর্শ নিহিত রয়েছে’।
অথচ এই আয়াতের অপব্যাখ্যা করে তিনি রাসূল (ছাঃ)-কে স্রেফ একজন বিজয়ী সেনাপতি হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছেন। অতঃপর উক্ত আয়াতটির অনুবাদ করে বলেছেন যে, রাসূলের জীবনে তোমাদের জন্য নিহিত আছে উত্তম আদর্শ (আহযাব ৩৩/২১)। নিঃসন্দেহে তিনি বিজয়ী সেনাপতি ছিলেন। কিন্তু একমাত্র সে উদ্দেশ্যেই তিনি নবী হয়ে দুনিয়াতে আসেননি। বরং তিনি মানবজীবনের সকল ক্ষেত্রেই উত্তম নমুনা ছিলেন।
লেখক রাসূল (ছাঃ)-কে একজন সুদক্ষ সেনানায়ক বানাতে গিয়ে ইতিহাস বিকৃত করেছেন। তিনি লিখেছেন, ওহোদের বিপর্যয় কাটিয়ে উঠে মুসলমানদের মনে সাহস সঞ্চয়ের জন্য পরদিনই তিনি আহত ছাহাবীদের নিয়ে শত্রুসৈন্যের পিছনে ধাওয়া করেছিলেন’। অথচ এটা ছিল আবু সুফিয়ানের পুনরায় মদীনা আক্রমণের খবর শুনে তার পাল্টা ব্যবস্থা মাত্র। যেকোন নেতাই এটা করতে বাধ্য।
তিনি লিখেছেন, ‘হিজরতের পর মক্কায় কাফেররা অনেকটা হাফ ছেড়ে বলেছিল, আপদ চলে গেছে। বাঁচা গেল। কিন্তু মদীনা পৌঁছেই তিনি মক্কা থেকে সিরিয়াগামী বাণিজ্য কাফেলার উপর চাপ সৃষ্টি করেন। তাঁর গৃহীত এ কৌশলই ছিল দ্বিতীয় হিজরীতে সংঘটিত বদর যুদ্ধের পর্যভূমি। … বদর যুদ্ধ না হলে ওহোদ, খন্দক, হোদায়বিয়া ও মক্কা বিজয় হতো না’।
অথচ প্রকৃত ঘটনা এর সম্পূর্ণ বিপরীত। আবু সুফিয়ান-আবু জাহলরা হাফ ছেড়ে বাঁচেনি। বরং রাসূল (ছাঃ)-কে রাতের অন্ধকারে গৃহ অবরোধ করে হত্যা করতে ব্যর্থ হয়ে তাঁর মাথা অথবা তাঁকে জীবিত ধরে আনার বিনিময়ে তারা ১০০ উটের পুরস্কার ঘোষণা করেছিল। তারা বিরাট বাণিজ্য সম্ভার নিয়ে সিরিয়া গমন করেছিল। উদ্দেশ্য ছিল, ঐ বাণিজ্যলব্ধ অর্থে কেনা যুদ্ধ-সরঞ্জাম তারা মদীনায় হামলায় ব্যবহার করবে এবং রাসূল (ছাঃ)-কে সেখান থেকে উৎখাত করবে। সেজন্যেই তাদের বাণিজ্য কাফেলা আটকানোর উদ্দেশ্যে মুষ্টিমেয় শ’তিনেক সাথী নিয়ে রাসূল (ছাঃ) আবু সুফিয়ানের পিছু ধাওয়া করেছিলেন। কিন্তু তাকে আটকাতে পারেননি। এরই মধ্যে আবু সুফিয়ানকে আটকানোর ভুল খবর শুনে তাকে উদ্ধারের জন্য আবু জাহল এক হাযার সৈন্যের বিশাল বাহিনী নিয়ে রাসূল (ছাঃ)-এর বিরুদ্ধে বদর অভিমুখে অভিযান চালায়। এই যুদ্ধের জন্য রাসূল (ছাঃ)-এর কোন পূর্ব পরিকল্পনা বা প্রস্ত্ততি ছিল না। এমনকি যুদ্ধ করবেন, না মদীনায় ফিরে যাবেন, এ বিষয়েও ছিল পরামর্শ সভায় মতভেদ। পরে আল্লাহর নির্দেশে এ যুদ্ধ সংঘটিত হয় ও তাঁর বিশেষ অনুগ্রহে এ যুদ্ধে বিজয় লাভ হয়। কারণ ঐদিন মুসলমানরা ছিলেন নিতান্তই দুর্বল ও কাফেররা ছিল সবল (আলে ইমরান ৩/১২৩)। আল্লাহ বলেন, ‘যদি পূর্ব হতেই তোমাদের ও তাদের মধ্যে যুদ্ধ সম্পর্কে তোমরা কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে চাইতে, তবে প্রতিশ্রুত সময়ের ব্যাপারে তোমাদের মধ্যে মতভেদ হ’ত। কিন্তু যা ঘটাবার ছিল, তা ঘটাবার জন্য আল্লাহ উভয় দলকে যুদ্ধ ক্ষেত্রে সমবেত করলেন। যাতে যে ধ্বংস হবে, সে যেন সত্য প্রকাশিত হওয়ার পর ধ্বংস হয়। আর যে জীবিত থাকবে, সে যেন সত্য সুস্পষ্টরূপে প্রকাশিত হওয়ার পর জীবিত থাকে। আল্লাহ সর্বশ্রোতা ও সর্বজ্ঞ’ (আনফাল ৮/৪২)
উক্ত আয়াতে পরিষ্কার হয়ে গেছে যে, বদরের যুদ্ধ আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)-এর কোন পরিকল্পিত বিজয়াভিযান ছিল না। বস্ত্ততঃ সূরা আনফাল ১-৪৮ পর্যন্ত আয়াতগুলি বদর যুদ্ধ সম্পর্কেই নাযিল হয়েছে।
জানা আবশ্যক যে, আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)-এর জীবনে প্রায় সকল যুদ্ধই ছিল আত্মরক্ষামূলক কিংবা প্রতিরোধমূলক। কাফির-মুশরিক ও মুনাফিকদের অবিরাম ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত ও হামলা মুকাবিলা করতে গিয়েই তাঁকে যুদ্ধে লিপ্ত হতে হয়েছিল।
(৫) সূরা আলে ইমরান ১১০ আয়াতে আল্লাহ বলেন, كُنتُمْ خَيْرَ أُمَّةٍ أُخْرِجَتْ لِلنَّاسِ تَأْمُرُوْنَ بِالْمَعْرُوْفِ وَتَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنكَرِ وَتُؤْمِنُوْنَ بِاللهِ ‘তোমরাই শ্রেষ্ঠ জাতি, যাদের আবির্ভাব ঘটানো হয়েছে মানুষের কল্যাণের জন্য। তোমরা মানুষকে ভাল কাজের আদেশ দিবে ও মন্দ কাজে নিষেধ করবে এবং আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস রাখবে…’।
অথচ আয়াতের অপব্যাখ্যা করে তিনি লিখেছেন, মুসলিম জাতিকে আল্লাহ তা‘আলা পাঠিয়েছেন গোটা মানবতার কল্যাণের উদ্দেশ্যে নেতৃত্বদানের জন্য (আলে ইমরান ৩/১১০)। অন্ধকার থেকে আলোর পথে নিয়ে আসার জন্য (ইবরাহীম ১৪/১)।’
এখানে মাননীয় লেখক আল্লাহর কেতাব ছেড়ে ধর্মনিরপেক্ষতার অন্ধকারের দিকে যাওয়ার পক্ষে কুরআনের অত্র আয়াতকে ব্যবহার করেছেন। অতএব সারা বিশ্বে নেতৃত্ব দেবার জন্য তিনি দেশের ইসলামী নেতৃবৃন্দকে তাঁর ভাষায় ‘সব সংকীর্ণতা ও আত্মম্ভরিতার ঊর্ধ্বে উঠতে হবে এবং বাস্তবধর্মী ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে’। সেকারণ তুরষ্ক, মিসর, তিউনিসিয়া ও ভারতের জামায়াতে ইসলামী থেকে তিনি শিক্ষা নিতে বলেছেন।
অথচ তারা এখন কক্ষচ্যুত নক্ষত্রের মত আলোহীন। তাদের কাছ থেকে প্রকৃত ঈমানদারগণের শেখার মত কিছুই নেই। যা আছে তা কেবলই পথভ্রষ্টতার শিক্ষা ও আদর্শচ্যুতির দুঃসংবাদ। আর সেকারণেই পশ্চিমা বিশ্ব খুশী হয়ে এটাকে ‘আরব বসন্ত’ (Arab Spring) বলে অভিনন্দিত করেছে। কারণ এটি তাদের কাছে একটি বড় সুসংবাদ। সম্প্রতি সিরিয়ার বিদ্রোহীদের প্রতি ইসরাঈলের প্রকাশ্যে সমর্থন ঘোষণায় বিদ্রোহীদের হাস্যোজ্জ্বল মিছিলের চেহারা পত্রিকায় এসেছে। হায়রে মুসলমান! নিজেদের ধ্বংস কামনায় তোমরা কতই না দুঃসাহসী!!
(৬) আলোচনার শেষে তিনি সুচতুরভাবে মানুষের সুবিধাবাদী চেতনাকে উসকে দেবার পক্ষে কুরআনের আয়াতকে ব্যবহার করেছেন। যেমন তিনি বলেছেন, ‘মানুষের দুঃখ-কষ্ট ও বিপদ-মুসিবত বাড়ানোর জন্য আল্লাহ পবিত্র কুরআন নাযিল করেননি’ (সূরা তাহা ২০/১)। অথচ আয়াতটির দ্বিতীয় অংশ তিনি গোপন করেছেন এবং নিজের মতলব হাছিলের জন্য কেবল প্রথমাংশটুকু কাজে লাগিয়েছেন। আয়াতগুলি নিম্নরূপ:
আল্লাহ বলেন, طه، مَا أَنزَلْنَا عَلَيْكَ الْقُرْآنَ لِتَشْقَى،إِلَّا تَذْكِرَةً لِّمَن يَخْشَى- (১) ত্বোয়াহা (২) আপনাকে কষ্ট দেয়ার জন্য আমরা আপনার উপর কুরআন নাযিল করিনি (৩) কেবল উপদেশ দেবার জন্য তাদের, যারা আল্লাহকে ভয় করে’। অর্থাৎ আল্লাহভীরু মানুষকে উপদেশ দেওয়ার জন্যই আল্লাহ কুরআন নাযিল করেছেন (তাফসীর কুরতুবী)। যাহহাক বলেন, কুরআন নাযিলের পর আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) ও ছাহাবীগণ দীর্ঘ ইবাদতে রাত্রি জাগরণ করতেন। এটা দেখে মুশরিক নেতারা বলতে লাগল, মুহাম্মাদের উপর কুরআন নাযিল হয়েছে কেবল তাকে কষ্ট দেওয়ার জন্য। তখন এ আয়াতগুলি নাযিল হয়। যাতে বুঝিয়ে দেয়া হয় যে, বাতিলপন্থীরা যেটা ভেবেছে সেটা নয়, বরং আল্লাহ তাঁর উপরে ইলম নাযিল করেছেন। যাতে রয়েছে প্রভূত কল্যাণ’ (তাফসীর ইবনু কাছীর)
অথচ ব্যারিষ্টার ছাহেব কত সুন্দরভাবে আয়াতটিকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করেছেন। যদি বলি তাওহীদ ছেড়ে শিরককে বরণ করে নিলে কি তাঁর দলের লোকেরা সুখে থাকবে? বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর বিগত ৪১ বছরে তাঁর দলের ছাত্রসংগঠন মিলে দু’শো লোকও এখনো ইসলামের জন্য শহীদ হয়নি। অথচ ধর্মনিরপেক্ষ নেতাদের বক্তব্য মতে তাদের বড় দলের অন্ততঃ ৩০ হাযার নেতা-কর্মী নিহত হয়েছে, ৬০ হাযারের মত পঙ্গু হয়েছে এবং গৃহহারা হয়েছে অসংখ্য। জাতীয়তাবাদী দলটির বক্তব্যও প্রায় একই রূপ। তাহলে সেখানে গিয়ে ব্যারিষ্টার ছাহেবরা কষ্ট থেকে বাঁচতে পারবেন কি? কুরআনের জন্য কষ্ট পেলে তাতে জান্নাত আছে। কিন্তু সেখান থেকে কষ্টের ভয়ে পালালে স্রেফ জাহান্নাম আছে। যেখানে আমরা কেউই যেতে চাই না। ইবনে উবাই কষ্টের ভয়ে ওহোদ যুদ্ধ থেকে পিছিয়ে এসেছিল। কিন্তু মৃত্যু থেকে বাঁচতে পেরেছিল কি?
বিগত শতাব্দীর শুরুতে আরব জাতীয়তাবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের সুঁড়সুড়ি দিয়ে কামাল পাশা ও তার সাথীদের মাধ্যমে ওছমানীয় খেলাফত ধ্বংস করে বিশ্বশক্তি তুরষ্ককে যারা ‘ইউরোপের রুগ্ন ব্যক্তি’ বানিয়েছিল এবং ঐক্যবদ্ধ ইসলামী খেলাফতকে ভেঙ্গে টুকরা টুকরা করে যারা নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নিয়েছিল। যদিও বাহ্যিক ভাবে এগুলি স্বাধীন রাষ্ট্র ছিল এবং আছে। তারাই এখন পুনরায় গণতন্ত্রের ও ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের সুঁড়সুড়ি দিয়ে বাকী মুসলিম বিশ্বকে গ্রাস করার জন্য ধাপে ধাপে এগিয়ে আসছে। ইতিমধ্যেই তারা ইন্দোনেশিয়া ও সূদানকে বিভক্ত করেছে। অতঃপর লিবিয়াকে কুক্ষিগত করেছে ও সেখান থেকে তৈল লুট করছে। এখন বাকীগুলিকে একে একে গ্রাস করতে চলেছে। হাতিয়ার হ’ল কথিত গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ ও জাতীয়তাবাদ। তাদের চালান করা এইসব শয়তানী মতবাদের অস্ত্র প্রয়োগ করে তারা নামধারী মুসলিম নেতাদের দিয়েই বিশ্বব্যাপী মুসলিম নিধনে মেতে উঠেছে ও একে একে মুসলিম দেশগুলিতে আগ্রাসন চালাচ্ছে। সেক্যুলার নেতারা তো তাদের দাবার ঘুঁটি আছেনই। বাকী ইসলামী নেতাদেরকে যদি আদর্শচ্যুত করা যায়, তাহ’লে তাদের সামনে আর কোন বাধা থাকে না।
বস্ত্ততঃ ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের মাধ্যমে তারা প্রথমে মুসলমানকে ধর্মের গন্ডীমুক্ত করে। অতঃপর জাতীয়তাবাদের বিষ ছড়িয়ে তাদের ঐক্য ছিন্নভিন্ন করে। অতঃপর গণতন্ত্রের মাধ্যমে তাদেরকে মানুষের গোলাম বানায়। ফলে মানুষ এখন মানুষের দাসত্বের অধীনে চরমভাবে পিষ্ট হচ্ছে। বিশ্বব্যাপী চলছে এই শয়তানী হানাহানির বহ্ন্যুৎসব। ইসলামী নেতাদের উচিত ছিল সর্বাগ্রে মানুষকে তাওহীদের শিক্ষা দানের মাধ্যমে আল্লাহর দাসত্বে ফিরিয়ে আনা। তার পরেই মানুষ সত্যিকার অর্থে স্বাধীনতার স্বাদ পেত। মানবতা মুক্তি পেত।
মনে রাখা উচিত যে, এ দুনিয়ার কেউ চিরকাল বেঁচে থাকবে না। অতএব ইসলামী নেতারা যদি দুনিয়াবী বিপদের ভয়ে পথভ্রষ্ট হন এবং নিজেদের জান বাঁচানোর জন্য হিকমতের নামে বা পরিস্থিতির দোহাই দিয়ে বাতিলের সঙ্গে আপোষ করেন, তবে তাদের জন্যেও জাহান্নাম অবধারিত। আল্লাহ বলেন, إِنَّ اللهَ جَامِعُ الْمُنَافِقِيْنَ وَالْكَافِرِيْنَ فِيْ جَهَنَّمَ جَمِيْعاً ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ মুনাফিক ও কাফিরদেরকে জাহান্নামে একত্রিত করবেন’ (নিসা ৪/১৪০)
মুসলমান সবকিছু ত্যাগ করতে পারে। কিন্তু তার ঈমান ত্যাগ করতে পারে না। রাজনৈতিক ও বৈষয়িক ক্ষেত্রে শরী‘আত বর্জন করে কেবল ছালাত-ছিয়াম ও হজ্জ-ওমরাহ পালনের মাধ্যমে ঈমান রক্ষা করা যায় না। এরূপ ধারণা স্রেফ শয়তানী ধোঁকা ব্যতীত কিছুই নয়। আল্লাহ বলেন, فَلْيَحْذَرِ الَّذِيْنَ يُخَالِفُوْنَ عَنْ أَمْرِهِ أَنْ تُصِيْبَهُمْ فِتْنَةٌ أَوْ يُصِيْبَهُمْ عَذَابٌ أَلِيْمٌ ‘যারা রাসূলের আদেশের বিরোধিতা করে, তারা এ ব্যাপারে সতর্ক হৌক যে, (দুনিয়ায়) তাদের গ্রেফতার করবে কঠিন ফিৎনা এবং (আখেরাতে) তাদের গ্রেফতার করবে মর্মন্তুদ শাস্তি’ (নূর ২৪/৬৩)
ব্যারিষ্টার ছাহেবদের ইসলামী দলটির বিগত ৭১ বছরের ইতিহাসে বহু আদর্শিক ও রাজনৈতিক ডিগবাজি এবং নরম ও চরমপন্থী ভূমিকা আমরা দেখেছি। ১৯৪১ সালে সংগঠনের প্রতিষ্ঠালগ্নে তারা বলেছিলেন, ২৫/৫০ লক্ষ লোকের ভিড় অপেক্ষা ১০ জন মাত্র বিপ্লবী কর্মী ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য যথেষ্ট’। তখন এটাকে পাকিস্তান বিরোধিতা হিসাবে গণ্য করা হয়েছিল। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর তারা অধিকাংশের পূজারী হলেন এবং ১৯৫৬ সালে যখন ইসলামী শাসনতন্ত্রের পক্ষে গণজোয়ার সৃষ্টি হয়েছিল, তখন তাঁরা বললেন। পাকিস্তানে হানাফী ফিক্বহ অনুযায়ী ইসলামী রাষ্ট্র পরিচালিত হবে’। ১৯৮৬ সালে এই দলটির বাংলাদেশী আমীর একই কথা বললেন, ১৯৬৪ সালে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে এই দলটি ইসলামী নীতির বাইরে গিয়ে ধর্মনিরপেক্ষ ও বাম দলগুলির সাথে মিলে মহিলা প্রার্থীকে সমর্থন দেয়। বাংলাদেশেও তারা নারী নেতৃত্ব হারাম বলে বারবার ঘোষণা করলেও সবসময় দুই নেত্রীর যেকোন একজনের লেজুড় হিসাবে রাজনীতি করেছেন। মন্ত্রীও হয়েছেন। আর দু’দিন হাতে ক্ষমতা পেয়েই আহলেহাদীছ নেতৃবৃন্দের উপর হামলে পড়েছেন ও তাদের উপর মিথ্যা অপবাদ ও মিথ্যা মামলা দিয়ে কারা নির্যাতন চালিয়েছেন। আর সবকিছুতেই তারা সর্বদা ইসলামের অপব্যাখ্যা করে তাদের কর্মীদের শান্ত করেছেন।
এভাবে তাদের যেনতেন প্রকারেণ ক্ষমতা দখলের রাজনীতি এবং সেজন্যে কুরআন-হাদীছের অপব্যাখ্যা অভিজ্ঞ মহলে সুপরিচিত। ১৯৯৬-তে ধর্মনিরপেক্ষ বড় দলটির সহযোগী হওয়া, অতঃপর ২০০০ সালে ঢাকায় আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের কাছ থেকে ‘মডারেট’ লকব পাওয়ার কথা কেউ ভুলেনি। ২০০১ সালে কথিত জাতীয়তাবাদী দলটির সহযোগী হবার সময় তারা হোদায়বিয়ার সন্ধির অপব্যাখ্যা করেছিলেন এবং এভাবে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)-কে তাদের অপকর্মের পক্ষে সাফাই হিসাবে পেশ করেছিলেন। বাংলাদেশের সেক্যুলাররা যেটা করতে সাহস পায়নি, কথিত এইসব ইসলামী চিন্তাবিদরা নির্দ্বিধায় সেটা করেন এবং তাদের তৃণমূল পর্যায়ের পুরুষ ও নারী কর্মীরা সেটা মাঠে-ময়দানে প্রচার করে থাকেন। এভাবে এইসব ইসলামী নেতারা নিজেরা পথভ্রষ্ট হন, অন্যকেও পথভ্রষ্ট করেন।
জানা আবশ্যক যে, ইসলামী খেলাফত ইসলামী তরীকায় প্রতিষ্ঠিত হবে। কুফরী তরীকায় নয়। তাই সবকিছুর পূর্বে ইসলামের পক্ষে জনসচেতনতা সৃষ্টি করা আবশ্যক। অতঃপর জনগণ ইসলামী খেলাফত চায় না মানুষের মনগড়া বিধান চায়, তার উপর জনমত যাচাই হবে। এরপর কে খলীফা হবেন, দল ও প্রার্থীবিহীনভাবে সে নির্বাচন হবে। সেই নির্বাচনের পথ ও পদ্ধতি ইসলামী নীতিমালার আলোকে নির্বাচন কমিশন নির্ধারণ করবে। গণতন্ত্রের নামে প্রচলিত দলতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষ শাসন স্রেফ একটা কুফরী ও জংলী শাসন ছাড়া কিছুই নয়। শান্তিপ্রিয় স্বাধীন মানুষ কখনোই এই প্রতারণাপূর্ণ নিষ্ঠুর ও নির্যাতনকারী শাসন চায় না। বিকল্প কিছু সামনে না থাকাতেই মানুষ এই নির্বাচনী যাঁতাকলে নিষ্পিষ্ট হচ্ছে।
অতএব সকল ইসলামী দলের নেতাদের বলব, আল্লাহকে ভয় করুন। ইসলামকে ছেড়ে বাতিলের মধ্যে সমাধান খোঁজার চেষ্টা করবেন না। কুফরের সাথে আপোষকামী পথ ছেড়ে তাওহীদের জান্নাতী পথে ফিরে আসুন। দেশে তাওহীদ প্রতিষ্ঠার একক লক্ষ্যে সকল দল ঐক্যবদ্ধ হৌন। এতেই আল্লাহর সন্তুষ্টি নিহিত রয়েছে। আর প্রকৃত মুমিনের জন্য আল্লাহর সন্তষ্টি ভিন্ন আর কোন কিছুই লক্ষ্য থাকতে পারে না। আল্লাহ আমাদেরকে হক-এর উপর দৃঢ় থাকার তাওফীক দান করুন- আমীন!

মন্তব্য করুন

Back to top button