এম.এল.এম (মাল্টি-লেভেল মার্কেটিং)
ডায়াগ্রামটি দেখুন, জন প্রতি ১০ জন করে আর এভাবে বাড়তে বাড়তে তা একসময় ধরলাম ১০ বিলিয়ন(১০০০কোটি) হয়ে গেল বা ধরলাম পৃথিবীর সবাই এতে অংশগ্রহণ করলো। আরেকটু পরিস্কার করে বলি, যদি সমগ্র পৃথিবীর জনসংখ্যা ৫ বিলিয়ন (৫০০কোটি) হয় আর সবাই এই পিরামিড স্কিমে অংশগ্রহণ করে তখন একদম নীচের স্তরে লোক সংখ্যা থাকবে মোট জনসংখ্যার ৯০% অর্থাৎ ৪.৫বিলিয়ন (৪৫০কোটি)। বাকী থাকে ৫০ কোটি। এই ৪৫০ কোটি মানুষ আর কোন মানুষকে পাবে না তাদের নীচে অন্য কাউকে যোগ করার জন্যে। যার ফলশ্রুতিতে ৫০০ কোটি মানুষের মধ্যে মাত্র ৫০ কোটি মানুষ লাভবান হবে আর বাকী ৪৫০ কোটি মানুষ কোন লাভ পাবে না, LOSERS. অর্থাৎ এরা সবাই ক্ষতিগ্রস্থ হবে। স্পষ্ট জুয়া খেলা।
এখন চলুন, দেখি ইসলামী শরীয়াহ কি বলে।
প্রথমত, ইসলামী শরীয়াতে এই ধরণের (MULTI-LEVEL MARKETING)MLM হারাম। এই ধরণের স্কীমে জুয়া খেলার প্রক্রিয়া রয়েছে এই প্রক্রিয়াতে প্রতারণা করে মানুষকে অংশগ্রহণ করানো হয় (কারণ তাদেরকে বলা হয় না একটা বিরাট অংশ লাভ থেকে বঞ্চিত হবে) এবং তাদের লোভ দেখানো হয় যে তারা অল্প সময়ের মধ্যে অনেক লাভবান হবে, এক কথায় = জুয়া খেলা।
হে মুমিনগণ, এই যে মদ. জুয়া, প্রতিমা এবং ভাগ্য-নির্ধারক শরসমূহ এসব শয়তানের অপবিত্র কার্য বৈ তো নয়। অতএব, এগুলো থেকে বেঁচে থাক – যাতে তোমরা কল্যাণপ্রাপ্ত হও। (সূরা মায়িদা: ৯০)
এই প্রক্রিয়াতে এমন কোন পণ্য বিক্রি করা হয় না যেটা ক্রয় করতে বাজারে চাহিদা রয়েছে যেমন: চাল, ডাল, তেল, চিনি ইত্যাদি কিংবা এমন কোন পণ্যও বিক্রি করা হয় না যে জিনিসটি আপনি সত্যিই কিনতে চান বা আপনার কেনার চাহিদা রয়েছে। বরং পণ্যটি নিয়ে ক্রেতাকে চৌকসপূর্ণ কথা বলে ক্রয় করতে প্রলুব্ধ করা হয় আর সেই সাথে তাদের MLM সিস্টেম এ যোগদান করার জন্য বিশেষভাবে প্ররোচিত করা হয়। এই MULTI-LEVEL MARKETING এ যোগদান করলে তারা কিভাবে লাভবান হবে, কিভাবে অধিক অর্থ পাওয়া যাবে সেই বিষয়ে বিশেষ চাতুর্যপূর্ণ লেকচার প্রদান করা হয়। পণ্য বিক্রয় করাটা এখানে মুখ্য উদ্দেশ্য নয় মুখ্য উদ্দেশ্য হচ্ছে তাদের প্রক্রিয়াতে আপনাকে যোগদান করানো। এভাবে কোন পণ্য বিক্রয় করার মধ্যে প্রতারণা করার প্রক্রিয়া বলবৎ থাকে যার কারণে এই ধরণের পণ্য ক্রয়-বিক্রয় করাটা হারাম।
ইমাম মালিক রহিমাহুল্লাহ কর্তৃক লিখিত তার মুয়াত্তায় এই বিষয়ে বিস্তারিত একটি হাদীস বর্ণিত রয়েছে। হাদীসটির ভাষ্য নিম্নরুপ:
আল্লাহর রাসূল ﷺ ‘মুযাবানা’ কে হারাম ঘোষণা করেছেন। ‘মুযাবানা’ বলতে বুঝায় এমন প্রক্রিয়ার লেনদেন যেখানে কোন পণ্যের যেমন: চাল, গম, ইত্যাদি যার পরিমাণ জানা নেই, এখন একজন ক্রেতা চালের মালিকের কাছে এসে তাকে বলল, আমি এই চালের গোলাটি কিনতে চাই। সে অনুমান নির্ভর একটি পরিমাণ নির্ধারণ করে চালের মালিককে টাকা পরিশোধ করল এবং টাকা পরিশোধ করার আগে চালের মালিককে বলে নিল, টাকা পরিশোধ করার পর আমি চালগুলো পরিমাপ করে দেখব, যদি চালের পরিমাপ করে দেখা যায় তার পরিমাণ যা অনুমান করা হয়েছিল তার চেয়ে কম হয় তাহলে সেটা আমার ক্ষতি আর যদি দেখা যায় অনুমানের চেয়ে বেশী তাহলে সেটা আমার লাভ। উভয় পক্ষের সম্মতিতে এই ধরণের লেনদেন জুয়া খেলার নামান্তর। উভয় পক্ষই এখানে বড় ধরণের লাভের আশায় ঝুকি নিয়ে লেনদেন করছে। কোন পক্ষই প্রকৃতপক্ষে জানে না তার সত্যিই লাভ হবে না ক্ষতি হবে। রাসূল ﷺ এই ধরণের লেনদেনকে হারাম ঘোষণা করেছেন।
সূত্র: Business Transactions: Malik :: Book 31 : Hadith 31.13.25
একইভাবে MLM প্রক্রিয়াতে সম্ভাব্য লাভের আশায় মানুষ পণ্য ক্রয় করে MLM প্রক্রিয়াতে যোগদান করে থাকে। বাস্তবপক্ষে লাভের বিষয়টি এখানে নিশ্চিত নয়, ক্ষতির বিষয়টিও নিশ্চিত নয়। আর আমরা উপরের ডায়াগ্রামটিতে দেখেছি, MLM প্রক্রিয়াতে অধিকাংশ লোক কোন লাভ পাবে না বরং ক্ষতির সম্মুখিন হবে। যা স্পষ্টতই প্রতরণা।
দ্বিতীয়ত, একটি বিরাট জনগোষ্ঠী ক্ষতির সম্মুখীন হবে(অর্থাৎ এরা কোন লাভ পাবে না) যা অন্যায়ভাবে অন্যের সম্পদ ভোগ করার শামিল।
তোমরা অন্যায়ভাবে একে অপরের সম্পদ ভোগ করো না। (সূরা বাকারা: ১৮৮)
তৃতীয়ত, রাসূল ﷺ বলেছেনঃ তোমরা কি জান এটি কোন মাস? তারা বললেন, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলই ভাল জানেন। তিনি বললেনঃ এটি সম্মানিত মাস। নবী ﷺ বললেনঃ এ মাস, এ শহর, এ দিনটি তোমাদের নিকট যেমন সম্মানিত, তেমনিভাবে আল্লাহ তাআলা তোমাদের জান, তোমাদের সম্পদ ও তোমাদের ইযযত-আবরুকে তোমাদের পরস্পরের জন্যে সম্মানিত করে দিয়েছেন। ( সহীহ বুখারী, সহীহ মুসলিমেও প্রায় একই ধরণের হাদীস রয়েছে)।
এই হাদীসটির মাধ্যমে MLM প্রক্রিয়াটিকে আরো জোড়ালোভাবে নিষেধ করে দেয়। কারণ, এক মুসলিমের সম্পদ অন্য মুসলিমের নিকট ঠিক তেমনি সম্মানিত যেমনটি সম্মানিত জিলহজ্জ্ব মাস, মক্কা নগরী, আরফার দিন। কাজেই অন্য মুসলিমের সম্পদ প্রতারণা করে, ঠকিয়ে নেওয়া হারাম। আর MLM প্রক্রিয়াতে তাই হয়ে থাকে, অন্যের সম্পদ প্রতারণা করে, ঠকিয়ে নেওয়া হয়।
চতুর্থত, এই ধরণের লেনদেন এ হারাম বিষয়টাকে অন্য নাম দিয়ে আকর্ষণীয় করে চালানো হয় যদিও আসল জুয়া খেলার সিস্টেমটাই বলবৎ থাকে। এভাবে স্পষ্ট হারাম কাজকে পরিবর্তন করে অন্য নামে চালিয়ে দেওয়া আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সাথে প্রতারণা করার শামিল।
পঞ্চমত, প্রত্যেক মুসলমানের উচিত সত্য জানা মাত্রই হারাম কাজ থেকে বিরত হওয়া বাস্তবে সেটা তার জন্যে ক্ষতির কারণ হোক না কেন।
“যে কেউ শুধুমাত্র আল্লাহ তাআলার জন্যে কোন কিছু পরিত্যাগ করবে, আল্লাহ তাআলা তার চেয়েও উত্তম কিছু দিয়ে তাকে ক্ষতি পুষিয়ে দিবেন।” (আহমদ, সহীহ)
ষষ্ঠত, আরো বিস্তারিত জানতে এখানে ক্লিক করুন।
মহান আল্লাহ তাআলা আমাদের MLM নামক ফিতনা থেকে হিফাজত করুন। আমীন।
এই লেখাটি পূর্বে ০৪ ঠা মার্চ, ২০১০ সকাল ১১:০৯ এ সামুতে প্রকাশিত হয়েছিল। বর্তমান সময়ে MLM ফিতনা রুপে আবির্ভূত হয়েছে এবং অনেকেই বিস্তারিত না জেনে এটাকে বৈধরুপে মেনে নিয়ে MLM প্রক্রিয়াতে যোগদান করছেন। তাই কিছুটা বর্ধিত আকারে এখানে প্রকাশ করা হল, যেন বিশ্বাসী মুসলিমগণ MLM এর ফাঁদে পতিত না হন।
ইসলাম সবসময়ই আধুনিক, এটা অতীত, বর্তমান এবং অনাগত ভবিষ্যত এর জীবন বিধান। যার মৌলিক বিষয়াবলী সুনির্ষ্ট। অতএব যুগপরিক্রমায় আধুনিক বিষয়াবলি কিভাবে মানুষের জন্য মংগলময় হতে পারে, ইসলামিক স্কলারগনতো সেটাই বলবেন। কিন্তু দেখি উল্টো।
বাস্তবে এখন পর্যন্ত আমাদের দেশে যেসব এমএলএম কোম্পানীর আবির্ভাব হয়েছে, তারা জনগণের ক্ষতিই করেছে।
ফকিহ/মুফতিগন কোন বিষয়ের উপর ফতুয়া দিয়েই দায়িত্ব পালন শেষ হয়েছে মনে করলে হবে না, তাদেরকে আধুনিক ও সমসাময়িক বিষয়ের উপর পরিপুর্ণ দক্ষতা আয়ত্ব করতে হবে ইসলামি শরিয়ার বৈধ পদ্ধতি বাতলে দিতে হবে।