স্রষ্টা ও সৃষ্টি

আল্লাহর সতর্কবাণী

রফীক আহমাদ

আল্লাহ এক, অদ্বিতীয় ও অসীম সত্তার অধিকারী। আর মানুষ হ’ল তাঁর সর্বাধিক প্রিয় সৃষ্টি। তিনি মানুষকে শয়তান হ’তে সাবধান থাকার পুনঃ পুনঃ নির্দেশ প্রদান করেছেন। কুরআন এলাহী গ্রন্থ। এ গ্রন্থে আল্লাহ ইহকাল ও পরকাল সম্পর্কে মানুষকে সতর্ক-সাবধান করেছেন।
পবিত্র কুরআনের বাণী সমূহের প্রতি আস্থাশীল ও অকৃত্রিম বিশ্বাসী থাকার আহবান জানান হয়েছে। এতদসত্ত্বেও কেউ কল্পনাপ্রসূতভাবে নিত্যনতুন কর্মকান্ডে প্রবৃত্ত হ’লে তার পরিণাম হবে ভয়াবহ। এখানে এই ভয়াবহ পরিণতি সম্পর্কে সতর্কবাণীর অবতারণা করা হ’ল। মহান আল্লাহ রাসূল (ছাঃ)-কে সতর্ককারীরূপে পৃথিবীতে প্রেরণ করেছেন। তাঁর মাধ্যমেই মানুষকে হুঁশিয়ার করেছেন। আল্লাহ বলেন, إِنْ أَنْتَ إِلَّا نَذِيرٌ، إِنَّا أَرْسَلْنَاكَ بِالْحَقِّ بَشِيْراً وَنَذِيْراً وَإِن مِّنْ أُمَّةٍ إِلَّا خَلَا فِيْهَا نَذِيْرٌ- ‘আপনি তো কেবল একজন সতর্ককারী। আমি আপনাকে সত্য ধর্মসহ পাঠিয়েছি সংবাদদাতা ও সতর্ককারীরূপে। এমন কোন সম্প্রদায় নেই যাতে সতর্ককারী আসেনি’ (ফাতির ২৩-২৪)
একই মর্মার্থে অন্য আয়াতে মহান আল্লাহ বলেন,
قُلْ مَا كُنْتُ بِدْعاً مِّنَ الرُّسُلِ وَمَا أَدْرِيْ مَا يُفْعَلُ بِيْ وَلَا بِكُمْ إِنْ أَتَّبِعُ إِلَّا مَا يُوْحَى إِلَيَّ وَمَا أَنَا إِلَّا نَذِيْرٌ مُّبِيْنٌ-
‘বলুন, আমি তো কোন নতুন রাসূল নই। আমি জানি না আমার ও তোমাদের সাথে কি ব্যবহার করা হবে। আমি কেবল তারই অনুসরণ করি, যা আমার প্রতি অহি করা হয়। আমি স্পষ্ট সতর্ককারী বৈ নই’ (আহক্বাফ ৯)
অন্যত্র তিনি বলেন,
يَا أَيُّهَا النَّبِيُّ إِنَّا أَرْسَلْنَاكَ شَاهِداً وََّمُبَشِّراً وَنَذِيْراً، وَدَاعِياً إِلَى اللهِ بِإِذْنِهِ وَسِرَاجاً مُّنِيْراً، وَبَشِّرِ الْمُؤْمِنِيْنَ بِأَنَّ لَهُم مِّنَ اللهِ فَضْلاً كَبِيْراً، وَلَا تُطِعِ الْكَافِرِيْنَ وَالْمُنَافِقِيْنَ وَدَعْ أَذَاهُمْ وَتَوَكَّلْ عَلَى اللهِ وَكَفَى بِاللهِ وَكِيْلاً-
‘হে নবী! আমি আপনাকে সাক্ষী, সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারী রূপে প্রেরণ করেছি এবং আল্লাহর আদেশক্রমে তাঁর দিকে আহবায়ক রূপে এবং উজ্জ্বল প্রদীপরূপে। আপনি মুসলমানদের সুসংবাদ দিন যে, তাদের জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে বিরাট অনুগ্রহ রয়েছে। আপনি কাফের ও মুনাফিকদের আনুগত্য করবেন না এবং তাদের উৎপীড়ন উপেক্ষা করুন ও আল্লাহর উপর ভরসা করুন। আল্লাহ কার্যনির্বাহী রূপে যথেষ্ট’ (আহযাব ৪৫-৪৮)
একই বিষয়ে অন্যত্র বর্ণিত হয়েছে,
قُلْ إِنَّمَا أَنَا مُنْذِرٌ وَمَا مِنْ إِلَهٍ إِلاَّ اللهُ الْوَاحِدُ الْقَهَّارُ، رَبُّ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَمَا بَيْنَهُمَا الْعَزِيْزُ الْغَفَّارُ-
‘বলুন, আমি তো একজন সতর্ককারী মাত্র এবং পরাক্রমশালী আল্লাহ ব্যতীত কোন উপাস্য নেই। তিনি আসমান-যমীন ও এতদুভয়ের মধ্যবর্তী সবকিছুর পালনকর্তা, পরাক্রমশালী, মার্জনাকারী। বলুন, এটি এক মহাসংবাদ’ (ছোয়াদ ৬৫-৬৭)
মানুষকে শয়তানের ব্যাপক প্রভাব ও আধিপত্যের বেড়াজাল হ’তে রক্ষার জন্য তাদেরকে সতর্ক করে পরম করুণাময় আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَقُل لِّعِبَادِي يَقُولُواْ الَّتِي هِيَ أَحْسَنُ إِنَّ الشَّيْطَانَ يَنْزَغُ بَيْنَهُمْ إِنَّ الشَّيْطَانَ كَانَ لِلإِنْسَانِ عَدُوّاً مُّبِيْناً- ‘আমার বান্দাদেরকে বলে দিন, তারা যেন যা উত্তম এমন কথাই বলে। শয়তান তাদের মধ্যে সংঘর্ষ বাঁধায়। নিশ্চয়ই শয়তান মানুষের প্রকাশ্য শত্রু’ (বানী ইসরাঈল ৫৩)
মহান আল্লাহ আরও বলেন, وَإِمَّا يَنْزَغَنَّكَ مِنَ الشَّيْطَانِ نَزْغٌ فَاسْتَعِذْ بِاللهِ إِنَّهُ هُوَ السَّمِيْعُ الْعَلِيْمُ ‘যদি শয়তানের পক্ষ থেকে আপনি কিছু কুমন্ত্রণা অনুভব করেন, তবে আল্লাহর শরণাপন্ন হোন। নিশ্চয়ই তিনি সর্বশ্রোতা সর্বজ্ঞ’ (হা-মীম সাজদাহ ৩৬)
মানুষ ও জিন জাতিকে আল্লাহ তা‘আলার ইবাদত করার জন্যই সৃষ্টি করা হয়েছে। অতঃপর নবী-রাসূলগণের মাধ্যমে জানিয়ে দেয়া হয়েছে তাদের জীবন-যাপন পদ্ধতি ও ধর্মীয় বিধানাবলী। স্বয়ং আল্লাহ প্রদত্ত এই বিধানাবলীর বিপরীত কাজ করার কোন অবকাশ নেই মানব সম্প্রদায়ের। তজ্জন্য আল্লাহ তা‘আলা বহু সতর্কবাণী দ্বারা মানব জাতিকে বারংবার সাবধান করেছেন এবং তাদের পথপ্রদর্শক মহানবী (ছাঃ)-কেও সতর্ক করা হয়েছে তাঁর উম্মতের স্বপক্ষে। উপরের আয়াতগুলো তার সুস্পষ্ট প্রমাণ। মহানবী (ছাঃ)-এর প্রতি অর্পিত অপরিসীম গুরুদায়িত্বের প্রেক্ষাপটে তাঁকে পুনঃ পুনঃ প্রত্যাদেশ দ্বারা প্রত্যক্ষ সতর্ককারী হিসাবে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। কুরআনে এক ও অদ্বিতীয় আল্লাহর অস্তিত্বের বিকল্প যে কোন প্রকারের ধারণা হ’তে বিরত থাকতে বলা হয়েছে। এই সতর্কবাণীর সঠিক মূল্যায়নকারী মুসলমানদের জন্য আল্লাহর পক্ষ হ’তে সুসংবাদ এবং অবমূল্যায়নকারী কাফির ও মুনাফিকদের বর্জন করার সংবাদও দেওয়া হয়েছে। অতঃপর সকল অপকর্মের হোতা শয়তান হ’তে সাবধান থাকার সবিশেষ প্রত্যাদেশ এসেছে। শয়তান যে কোন পরিস্থিতিতে দুর্বল বান্দাকে পথভ্রষ্ট করতে পারে এবং শক্তিশালী বান্দাকেও আক্রমণের চেষ্টা করতে পারে। এমতাবস্থায় আল্লাহর শরণাপন্ন হওয়া বা আল্লাহর সমীপে আত্মসমর্পণ করতে হবে।
অপরদিকে মহানবী (ছাঃ)-এর বাণী ও জীবনাদর্শ সমগ্র বিশ্ববাসীর জন্য একইভাবে অনুসরণযোগ্য। অর্থাৎ আল্লাহর আদেশ, নির্দেশ ও সতর্কবাণীর পাশাপাশি মহানবী (ছাঃ)-এর আদেশ, নির্দেশ ও সতর্কবাণীরও যথাযথ মূল্যায়ন করতে হবে। নইলে আমাদের জীবনের সকল সৎকর্ম সমূহ নিষ্ফল হয়ে যাবে। আল্লাহ বলেন, إِنَّا أَرْسَلْنَاكَ شَاهِداً وَمُبَشِّراً وَنَذِيْراً، لِتُؤْمِنُوْا بِاللهِ وَرَسُوْلِهِ وَتُعَزِّرُوْهُ وَتُوَقِّرُوْهُ وَتُسَبِّحُوْهُ بُكْرَةً وَأَصِيْلاً- ‘আমি আপনাকে (রাসূল) প্রেরণ করেছি অবস্থা ব্যক্তকারী রূপে, সুসংবাদদাতা ও ভয় প্রদর্শনকারী রূপে। যাতে তোমরা আল্লাহ ও রাসূলের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন কর এবং তাঁকে সম্মান ও সাহায্য কর এবং সকাল-সন্ধ্যায় আল্লাহর পবিত্রতা ঘোষণা কর’ (ফাতাহ ৭-৯)
আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান না আনার পরিণতি ভয়াবহ। যারা কাফের তাদেরকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। আল্লাহ বলেন, وَمَن لَّمْ يُؤْمِن بِاللهِ وَرَسُوْلِهِ فَإِنَّا أَعْتَدْنَا لِلْكَافِرِيْنَ سَعِيْراً، وَلِلَّهِ مُلْكُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ يَغْفِرُ لِمَنْ يَشَاءُ وَيُعَذِّبُ مَن يَشَاءُ وَكَانَ اللَّهُ غَفُوراً رَّحِيماً- ‘যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলে বিশ্বাস করে না, আমি সেসব কাফেরের জন্য জ্বলন্ত অগ্নি প্রস্ত্তত করে রেখেছি। নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলের রাজত্ব আল্লাহরই। তিনি যাকে ইচ্ছা ক্ষমা করেন এবং যাকে ইচ্ছা শাস্তি দেন। তিনি ক্ষমাশীল, পরম মেহেরবান’ (ফাতাহ ১৩-১৪)
আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের অবাধ্যতার পরিণাম ভাল নয়; তাদেরকে আল্লাহ পথভ্রষ্টতায় নিপতিত বলেছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَمَا كَانَ لِمُؤْمِنٍ وَلاَ مُؤْمِنَةٍ إِذَا قَضَى اللهُ وَرَسُولُهُ أَمْراً أَن يَكُوْنَ لَهُمُ الْخِيَرَةُ مِنْ أَمْرِهِمْ وَمَن يَعْصِ اللهَ وَرَسُولَهُ فَقَدْ ضَلَّ ضَلَالاً مُّبِيْناً- ‘আল্লাহ ও তাঁর রাসূল কোন কাজের আদেশ করলে কোন ঈমানদার পুরুষ ও ঈমানদার নারীর সে বিষয়ে ভিন্ন   সিদ্ধান্তের ক্ষমতা নেই। যে ব্যক্তি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আদেশ অমান্য করে, সে প্রকাশ্য পথভ্রষ্টতায় পতিত হয়’ (আহযাব ৩৬)
পবিত্র কুরআন করীমের ব্যাখ্যা ও মর্মানুযায়ী একথা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত যে, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে উম্মতের প্রত্যেকের উপর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর হক সব চাইতে বেশী। স্বয়ং মহান আল্লাহ তা‘আলা নিজ কালামে তাঁর আদেশ মান্য করার সাথে সাথে রাসূলের আদেশও মান্য করার হুকুম দিয়েছেন। অতঃপর যারা তাঁর ও রাসূলের আদেশ অমান্য করবে বা তাঁদেরকে অবিশ্বাস করবে, তাদের ভয়াবহ পরিণতির বিষয়টিও উপরের আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে। তবে কোন ঈমানদার পুরুষ বা ঈমানদার নারী আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আদেশ পালনে ভিন্নমত পোষণ করে না। একমাত্র অবিশ্বাসীরাই ভ্রষ্টতায় পতিত হয়। এ বিষয়ে হাদীছে এসেছে,
عَنْ أَبِىْ هُرَيْرَةَ أَنَّ رَسُوْلَ اللهِ صلى الله عليه وسلم قَالَ كُلُّ أُمَّتِىْ يَدْخُلُوْنَ الْجَنَّةَ، إِلاَّ مَنْ أَبَى قَالُوْا يَا رَسُوْلَ اللهِ وَمَنْ يَأْبَى قَالَ مَنْ أَطَاعَنِىْ دَخَلَ الْجَنَّةَ، وَمَنْ عَصَانِىْ فَقَدْ أَبَى-
আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘আমার উম্মতের সকলেই জান্নাতে প্রবেশ করবে, তবে যারা অস্বীকার করেছে তারা ব্যতীত। ছাহাবীগণ জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! কে অস্বীকার করে? তিনি বললেন, যে ব্যক্তি আমার দ্বীনের আনুগত্য করবে, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে, আর যে ব্যক্তি আমাকে অমান্য করবে সেই অস্বীকার করে’ (বুখারী হা/৭২৮০)
অন্য হাদীছে এসেছে, আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, বাক্য একটি, আর আমি বলেছি দ্বিতীয়টি। তিনি বলেছেন, যে ব্যক্তি আল্লাহর সমকক্ষ আছে বিশ্বাস রেখে মৃত্যুবরণ করে সে আগুনে (জাহান্নামে) প্রবেশ করবে। আর আমি বলেছি, যে ব্যক্তি আল্লাহর সমকক্ষ অস্বীকার করে মৃত্যুবরণ করে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে’ (বুখারী)
পবিত্র কুরআন হচ্ছে সর্বশেষ আসমানী কিতাব, যা মহান আল্লাহর তরফ থেকে মহানবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর উপর অবতীর্ণ হয়েছিল। আর হাদীছ হ’ল মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর কার্যাবলীর বিবরণ ও তাঁর বক্তব্যের অথবা আল-কুরআনের বাস্তব রূপ। ছহীহ বুখারীর উপরোল্লিখিত হাদীছ দু’টি মহানবী (ছাঃ)-এর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সতর্কবাণীর প্রমাণ। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, মহানবী (ছাঃ)-এর যাবতীয় হাদীছ সংরক্ষিত হয়েছে। সুতরাং পবিত্র কুরআন ও হাদীছ উভয় সতর্কবাণীর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য এক ও অভিন্ন। এসব হাদীছের সমর্থনপুষ্ট আরও বহু আয়াত রয়েছে।
আখিরাতকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করলে সকল কর্ম বাতিল হয়ে যায়। এ ব্যাপারে আল্লাহ মানুষকে সতর্ক করে বলেন, وَالَّذِيْنَ كَذَّبُوْا بِآيَاتِنَا وَلِقَاء الآخِرَةِ حَبِطَتْ أَعْمَالُهُمْ هَلْ يُجْزَوْنَ إِلاَّ مَا كَانُوْا يَعْمَلُوْنَ- ‘বস্ত্ততঃ যারা মিথ্যা জেনেছে আমার আয়াত সমূকে এবং আখেরাতের সাক্ষাৎকে, তাদের যাবতীয় কাজকর্ম ধ্বংস হয়ে গেছে। তেমন বদলাই সে পাবে যেমন আমল সে করত’ (আ‘রাফ ১৪৭)
অন্যত্র মহান আল্লাহ বলেন, فَمَنْ أَظْلَمُ مِمَّنِ افْتَرَى عَلَى اللهِ كَذِباً أَوْ كَذَّبَ بِآيَاتِهِ إِنَّهُ لاَ يُفْلِحُ الْمُجْرِمُوْنَ ‘অতঃপর তার চেয়ে বড় যালেম কে আছে, যে আল্লাহর প্রতি অপবাদ আরোপ করেছে কিংবা তাঁর আয়াত সমূহকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছে? কস্মিনকালেও পাপীদের কোন কল্যাণ হয় না’ (ইউনুস ১৭)
আল্লাহ তাঁর প্রিয় হাবীব (ছাঃ)-কে লক্ষ্য করে বলেন, نَبِّئْ عِبَادِيْ أَنِّيْ أَنَا الْغَفُوْرُ الرَّحِيْمُ، وَ أَنَّ عَذَابِيْ هُوَ الْعَذَابُ الأَلِيْمَ- ‘আপনি আমার বান্দাদেরকে জানিয়ে দিন যে, আমি অত্যন্ত ক্ষমাশীল ও দয়ালু এবং এটাও জানিয়ে দিন যে, আমার শাস্তিই যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি’ (হিজর ৪৯-৫০)। এ সকল আয়াতে আল্লাহর সতর্কবাণী বিদ্যমান।
আল্লাহর স্মরণ থেকে উদাসীন থাকলে শয়তান তাকে পথভ্রষ্ট করতে চেষ্টা করে। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ বলেন, وَمَنْ يَعْشُ عَنْ ذِكْرِ الرَّحْمَنِ نُقَيِّضْ لَهُ شَيْطَاناً فَهُوَ لَهُ قَرِيْنٌ- ‘যে ব্যক্তি দয়াময় আল্লাহর স্মরণ থেকে চোখ ফিরিয়ে নেয় (ভুলে থাকে), আমি তার জন্য এক শয়তান নিয়োজিত করে দেই, অতঃপর সেই হয় তার সঙ্গী’ (যুখরুফ ৩৬)
পবিত্র কুরআনের এই অভাবনীয় বাণী একদিকে মানবতাকে আল্লাহর স্মরণে ডুবে থাকার আহবান জানিয়েছে, অপরদিকে সতর্কতা অবলম্বনের ঐকান্তিক দীক্ষাও প্রদান করেছে। সুতরাং শ্রেষ্ঠ ধর্ম ইসলাম সুরক্ষায় আল্লাহর স্মরণ যেমন অপরিহার্য, অনুরূপভাবে আল্লাহর সতর্কবাণীর অনুসরণও একইভাবে প্রয়োজন। ইহকালীন জীবনের পরিসমাপ্তির পর পরকালীন জীবনে প্রবেশ মুহূর্তেই আল্লাহর সতর্কবাণীর প্রভাব প্রতিফলিত হবে। আর বিশ্বস্ত বান্দাদের পক্ষেই এতদসংক্রান্ত বিষয়ে কিছুটা স্পষ্ট ধারণা অর্জন করা সম্ভব। অতঃপর এদেরকে কল্যাণের পথে ফিরানোর লক্ষ্যেই পবিত্র কুরআনে এই সতর্কবাণী সম্বলিত আয়াতগুলো সংযোজন করা হয়েছে।
বস্ত্তত সকল সতর্কবাণীর মূল উদ্দেশ্যই হচ্ছে মানুষকে সংশোধনের মাধ্যমে তাদের মুক্তির পথে পরিচালিত করা। মহান আল্লাহ বলেন,
إِنَّ عَلَيْنَا لَلْهُدَى، وَإِنَّ لَنَا لَلْآخِرَةَ وَالْأُولَى، فَأَنْذَرْتُكُمْ نَاراً تَلَظَّى، لَا يَصْلَاهَا إِلَّا الْأَشْقَى، الَّذِيْ كَذَّبَ وَتَوَلَّى، وَسَيُجَنَّبُهَا الْأَتْقَى، الَّذِي يُؤْتِي مَالَهُ يَتَزَكَّى، وَمَا لِأَحَدٍ عِندَهُ مِن نِّعْمَةٍ تُجْزَى، إِلَّا ابْتِغَاء وَجْهِ رَبِّهِ الْأَعْلَى، وَلَسَوْفَ يَرْضَى-
‘আমার দায়িত্ব পথপ্রর্দশন করা। আর আমি মালিক ইহকালের ও পরকালের। অতএব আমি তোমাদেরকে প্রজ্জ্বলিত অগ্নি সম্পর্কে সতর্ক করে দিয়েছি। এতে নিতান্ত হতভাগ্য ব্যক্তিই প্রবেশ করবে, যে মিথ্যারোপ করে ও মুখ ফিরিয়ে নেয়। এ থেকে দূরে রাখা হবে আল্লাহভীরু ব্যক্তিকে। যে আত্মশুদ্ধির জন্য তার ধন-সম্পদ ব্যয় করে এবং তার উপর কারও কোন প্রতিদানযোগ্য অনুগ্রহ থাকে না, তার মহান পালনকর্তার সন্তুষ্টি অন্বেষণ ব্যতিত, সে সত্বরই সন্তুষ্টি লাভ করবে’ (আল-লায়ল ১২-২১)
উপরের আয়াতগুলোতে অপরাধীদের লক্ষ্য করে প্রজ্জ্বলিত অগ্নিকুন্ডের অর্থাৎ জাহান্নামের ভীতি প্রদর্শন করা হয়েছে। অপরদিকে আল্লাহভীরু ও আল্লাহর সন্তুষ্টি অন্বেষণকারীদের পুরোপুরি অভয় দেওয়া হয়েছে।
মহানবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর অমূল্যবাণী তথা হাদীছ পৃথকভাবে সংরক্ষিত হয়েছে হাদীছ গ্রন্থে। পবিত্র কুরআনের সতর্ক বাণীর ন্যায়, হাদীছ গ্রন্থেও বহু সতর্কবাণী রয়েছে। উদাহরণ স্বরূপ একটি হাদীছ পেশ করা হ’ল,
عَنْ حُذَيْفَةَ بْنِ الْيَمَانِ يَقُوْلُ كَانَ النَّاسُ يَسْأَلُوْنَ رَسُوْلَ اللهِ صلى الله عليه وسلم عَنِ الْخَيْرِ وَكُنْتُ أَسْأَلُهُ عَنِ الشَّرِّ، مَخَافَةَ أَنْ يُدْرِكَنِىْ فَقُلْتُ يَا رَسُوْلَ اللهِ إِنَّا كُنَّا فِىْ جَاهِلِيَّةٍ وَشَرٍّ فَجَاءَنَا اللهُ بِهَذَا الْخَيْرِ، فَهَلْ بَعْدَ هَذَا الْخَيْرِ مِنْ شَرٍّ قَالَ نَعَمْ. قُلْتُ وَهَلْ بَعْدَ ذَلِكَ الشَّرِّ مِنْ خَيْرٍ قَالَ نَعَمْ، وَفِيْهِ دَخَنٌ. قُلْتُ وَمَا دَخَنُهُ قَالَ قَوْمٌ يَهْدُوْنَ بِغَيْرِ هَدْىٍ، تَعْرِفُ مِنْهُمْ وَتُنْكِرُ. قُلْتُ فَهَلْ بَعْدَ ذَلِكَ الْخَيْرِ مِنْ شَرٍّ قَالَ نَعَمْ، دُعَاةٌ عَلَى أَبْوَابِ جَهَنَّمَ، مَنْ أَجَابَهُمْ إِلَيْهَا قَذَفُوهُ فِيهَا. قُلْتُ يَا رَسُوْلَ اللهِ صِفْهُمْ لَنَا. قَالَ هُمْ مِنْ جِلْدَتِنَا، وَيَتَكَلَّمُونَ بِأَلْسِنَتِنَا. قُلْتُ فَمَا تَأْمُرُنِىْ إِنْ أَدْرَكَنِىْ ذَلِكَ قَالَ تَلْزَمُ جَمَاعَةَ الْمُسْلِمِيْنَ وَإِمَامَهُمْ. قُلْتُ فَإِنْ لَمْ يَكُنْ لَهُمْ جَمَاعَةٌ وَلاَ إِمَامٌ قَالَ فَاعْتَزِلْ تِلْكَ الْفِرَقَ كُلَّهَا، وَلَوْ أَنْ تَعُضَّ بِأَصْلِ شَجَرَةٍ، حَتَّى يُدْرِكَكَ الْمَوْتُ، وَأَنْتَ عَلَى ذَلِكَ-
হুযায়ফা ইবনুল ইয়ামান (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, লোকেরা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিকট কল্যাণকর বিষয় সম্পর্কে প্রশ্ন করত। আর আমি অকল্যাণকর বিষয় সম্পর্কে জিজ্ঞেস করতাম, এতে আমার পতিত হওয়ার ভয়ে। তাই আমি জিজ্ঞেস করলাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমরা মূর্খতা ও অকল্যাণের মধ্যে ছিলাম। অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা আমাদের এ কল্যাণ (ঈমান) দান করেছেন, তবে কি এ কল্যাণের পর পুনরায় অকল্যাণ (সংঘটিত) হবে? তিনি বললেন, হ্যাঁ হবে। আমি বললাম, সেই অকল্যাণের পরেও কি পুনরায় কল্যাণ আসবে? তিনি বললেন, হ্যাঁ আসবে। তবে তা ধূয়াযুক্ত (নির্ভেজাল) হবে। জিজ্ঞেস করলাম, দুখান (ধূ‘য়া) অর্থ কি? তিনি বললেন, লোকেরা আমার পথ ব্যতীত অন্য পথ অবলম্বন করবে। তাদের পক্ষ হ’তে ভাল ও মন্দ উভয়ই তুমি প্রত্যক্ষ করবে। আমি বললাম, অতঃপর এ কল্যাণের পর কি পুনরায় অকল্যাণ আসবে? তিনি বললেন, হ্যাঁ আসবে। তা এই যে, জাহান্নামের দিকে কতক আহবানকারী হবে, যারা তাদের আহবানে সাড়া দিবে, তাদেরকে তারা জাহান্নামে নিক্ষেপ করবে। আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! আমাদেরকে তাদের পরিচয় জানিয়ে দিন। তিনি বললেন, তারা আমাদের মতই হবে এবং আমাদের কথার ন্যায়ই কথা বলবে। আমি বললাম, আমি সে অবস্থায় উপনীত হ’লে আমাকে কি নির্দেশ দেন? (আমার করণীয় কি হবে)? তিনি বললেন, তখন অবশ্যই মুসলমানদের জামা‘আত (সংগঠন) ও মুসলমানদের ইমামকে অাঁকড়ে ধরে থাকবে। আমি বললাম, সে সময় যদি কোন মুসলিম সংগঠন ও মুসলিম ইমাম না থাকে (তখন আমাদের করণীয় কি)? তিনি বললেন, বৃক্ষমূলকে ধারণ করে হ’লেও সেসব (কুফরী) দলকে পরিত্যাগ করে চলবে। এমনকি এ অবস্থায় তোমাদের মৃত্যু উপস্থিত হয়ে যাবে, অথচ তুমি ঐ অবস্থায়ই থাকবে (অর্থাৎ বাতিল ফিরকা থেকে বিরত থেকে দৃঢ়ভাবে হক ধারণ করে থাকবে) (মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/৫৩৮২)
বান্দার প্রতি আল্লাহর সতর্কবাণীর ন্যায় মহানবী (ছাঃ)-এর সতর্কবাণীরও যে প্রয়োজনীয়তা রয়েছে, উপরের আলোচনায় তা সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে। আল্লাহর সতর্কবাণীকে প্রত্যক্ষ ঘোষণা এবং মহানবী (ছাঃ)-এর সতর্কবাণীকে পরোক্ষ ঘোষণা বলা যেতে পারে। তবে উভয় সতর্কবাণীর লক্ষ্য-উদ্দেশ্য এক ও অভিন্ন। অতএব আমরা সর্বান্তকরণে এক আল্লাহর আদেশ ও তার বাস্তবায়নকারী মহানবী (ছাঃ)-এর বাণীর সমন্বয়ে আমাদের ভবিষ্যত কর্মপন্থা সুস্থির করব। আল্লাহ আমাদের তাওফীক্ব দান করুন-আমীন!

মন্তব্য করুন

Back to top button