সাম্প্রতিক প্রসঙ্গ

ভূমিকম্প : কতটা প্রস্তুত বাংলাদেশ?

সকল  প্রশংসা আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের জন্য এবং আমরা শুধুমাত্র তারই কাছে সাহায্য কামনা করি এবং দরুদ অ সালাম নাজিল হোক প্রিয় নবী প্রিয় ইমাম মুহাম্মাদ (صلى الله عليه وسلم) এর উপর তার পরিবারবর্গের উপর, সাহাবাকেরামদের উপর, তাবেঈগনের উপর,তাবে তাবেঈ গনের উপর এবং কিয়ামাত পর্যন্ত  যারা তার অনুশরন করবে তাদের উপর।  আল্লাহর সতকীকরণ ধরন-ধারণে, আকার-প্রকৃতিতে, বিভিন্ন সময় বিভিন্নরূপে আপতিত হয়। কখনো ব্যাপক বিধংসী ঘূর্ণিঝড়ের আকৃতিতে, কখনো নির্বাধ-দুর্দমনীয় বন্যার আকারে, কখনো বা যুদ্ধের আকারে, কখনো প্রচণ্ড ভূমিকম্পের আকারে, আল্লাহ তাঁর বান্দাদেরকে সতর্ক করে থাকেন। কারণ তিনি চান না যে মানুষ অবাধ্য  হয়ে, তার বিধি-বিধানের প্রতি পৃষ্ঠপ্রদর্শন করে, প্রবৃত্তি চালিত হয়ে জীবনযাপন করুক, যার ভয়াবহ পরিণতি হবে পরকালের দুঃসহ যন্ত্রণাদায়ক জীবন, জাহান্নাম।

দুর্যোগের দেশ বাংলাদেশ ভয়াবহ একটি দুর্ঘটনার জন্যে  কতটুকু প্রস্তুত? বন্যা ও জলোচ্ছ্বাসে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চল ভেসে গেলে, হাজারো মানুষের প্রাণহানি ও সর্বস্ব হারিয়ে গেলে সরকার কিছুদিন মাতামাতিতে মাতে। সংবাদপত্রগুলো হিউম্যান স্টোরি ‘বেচে’ খায়! কিন্তু পরে এ ধরনের দুর্যোগ মোকাবিলার কোনো প্রস্তুতি নেওয়ার প্রস্তুতি লক্ষ করা যায় না।ইদানীংকালে বাংলাদেশে প্রায় ভূমিকম্পের ‘উপদ্রব’ দেখা যাচ্ছে।

বাংলাদেশ সচরাচর এসব ভূমিকম্পের উৎস না-হলেও প্রতিবেশী অঞ্চলগুলোর বিভিন্ন উৎসে উৎসারিত ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ায় (আফটার শক) বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল ভয়ে-বিস্মরণে বারবার কেঁপে উঠছে। দুলছে বহুতল দালান। ফাটল সৃষ্টি হচ্ছে জনপথে। বস্তি বা কাঁচা ঘরবাড়ি কিংবা ভূমিধসের মাত্রাহীন আশঙ্কার কথা পাশে তুলে রাখি।নগরায়নের হুজুগে বাংলাদেশ জুড়ে গড়ে উঠেছে পাকা, সেমি-পাকা আর বহুতল অপরিকল্পিত (বহুলাংশে অননুমোদিতও) বাড়ি-ঘর। ২০০০ সালের আগে সিমেন্টে বাংলাদেশ স্বয়ংসম্পূর্ণ ছিল না। বাংলাদেশের নির্মাণশিল্প নির্ভরশীল ছিল আমদানিকৃত চীনা সিমেন্টের ওপর। অধিক মুনাফার লোভে চীনের রাস্তা আর নর্দমা বানানোর উপযোগী ৪২৫ মানের সিমেন্টে গড়ে উঠেছে ঢাকা-চাটগাঁসহ বিভিন্ন শহরাঞ্চল। আমাদের আন্তঃনগর ও আন্তঃজেলার সংযোগ সড়কগুলো কেবলমাত্র তৃতীয় শ্রেণীর মানের নয় বরং একমাত্র যাতায়াত ও যোগাযোগ মাধ্যম। রাজধানীর সঙ্গে দেশের অন্যান্য অঞ্চলগুলোর যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতার জন্যে চাই সামান্য কোনও অঘটন।

বৃহত্তম সমুদ্র বন্দর চাটগাঁর সঙ্গে রাজধানী ঢাকার সড়ক যোগাযোগের পথ মাত্র একটি। বিকল্প একটি রাস্তা আছে প্রায় সিলেট স্পর্শ করে ব্রাক্ষণবাড়িয়া হয়ে। আরেকটি বন্দর মংলার সঙ্গে যোগাযোগের ব্যবস্থাও বেশ নাজুক।রেল যোগাযোগ এমনিতেই বিভিন্ন কারিগরি ও সিগন্যাল সমস্যায় ভোগে। দুই জেলার মাঝখানে কোথাও কোনও রেললাইন বিচ্ছিন্ন কিংবা নষ্ট হলে তাৎক্ষণিক সারানোর মতো কারিগরি সামর্থ্য বাংলাদেশের নেই। নদী পথগুলো এখনো নির্ভরযোগ্য চলাচল মাধ্যম হয়ে ওঠেনি। বিমানবন্দরগুলো তো আদি-যুগের।৭ মাত্রার একটা ভূ-কম্পনে বিপুল পরিমাণ দালান ধূলিস্মাৎ হবে। কাঁচা বাড়ি-ঘর মিশে যাবে মাটির সঙ্গে। বাসের চাকা সুষ্ঠুভাবে চলাচলের অনুপযোগী রাস্তার কী দুর্দশা হবে সেটা ভাবতেও ভয় লাগে! অকাতরে প্রাণহানি ঘটবে এই সর্বনাশী আশঙ্কা থাকবেই।

প্রশ্ন হচ্ছে, আহত ও দুর্গতদের উদ্ধারের কী ব্যবস্থা নেওয়া হবে? সেই প্রস্তুতি বা সামর্থ্য কি বাংলাদেশের আছে? বড় ধরনের ভূ-কম্পনে বিদ্যুৎ-পানি-গ্যাসসহ সকল ইউটিলিটি ব্যবস্থা ভেঙে পড়া স্বাভাবিকএকসঙ্গে ১০ হাজার আহত মানুষকে সামান্য প্রাথমিক সাধারণ চিকিৎসা দেওয়ার ইনফ্রাস্ট্রাকচারের বিষয়ে কি কোনও সরকারি কার্যকর পরিকল্পনা আছে? ধ্বংসস্তূপের ভেতর বেঁচে থাকা মানুষগুলোকে উদ্ধারের সরঞ্জামাদির কোনও ব্যবস্থা বা আয়োজন কি বিবেচনায় আছে? দুর্গত মানুষগুলো খোলা আকাশের নিচে পানি-খাদ্য-কম্বলের অভাবে ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যেতে পারে আশঙ্কার বিপরীতে সরকারি ভাবনাটা কী?

কয়েক বছর আগে হাইতিতে ভূ-কম্পে নিহত মানুষের সংখ্যার চেয়ে ভূ-কম্প পরবর্তী মৃতের সংখ্যাই বেশি দেখা গেছে অব্যবস্থাপনায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সর্বাত্মক শক্তি-সামর্থ্যে সাহায্যে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল তাঁবু-পানি-শিশু ও মৌলিক খাদ্য সরবরাহ নিয়ে। কিন্তু বিদেশি সাহায্য নিয়ে সুবিশাল হারকিউলিস বিমানগুলো নামার এবং রিলিফ সামগ্রী বিলি বণ্টনের মতো ‘রিসোর্স’ ও ইনফ্রাস্ট্রাকচার ছিল না হাইতির। বাংলাদেশে একসঙ্গে কয়টা হারকিউলিস বিমান নামতে পারবে বিদেশি সাহায্য নিয়ে? আর সেই সাহায্য সরঞ্জামাদি স্টোরেজের অবকাঠমো ও ব্যবস্থা কী আছে? যদি রাজধানী ঢাকা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় আক্রান্ত অঞ্চল থেকে তাহলে সেই জেলায় আকাশযোগে রিলিফ পৌঁছানো কি যাবে? ভূমিকম্পের মতো জাতীয় দুর্যোগে একসঙ্গে অনেকগুলো অ্যাম্বুলেন্স আর হাসপাতাল শয্যার অবশ্যম্ভাবী প্রয়োজন দেখা দেয়। আমাদের সার্বিক চালচিত্র কী? একসঙ্গে দু’তিনটি জেলা আক্রান্ত হলে কী হবে বাংলাদেশের? দেশি-বিদেশি সাহায্য-সহায়তা কি সময়মতো পৌঁছনো সম্ভব হবে? ল্যান্ড লাইন বিকল হলে আর মোবাইল ফোনের টাওয়ারগুলো ভেঙে পড়লে বিকল্প কোনো মাধ্যম বা ব্যবস্থা কী আছে অব্যাহত যোগাযোগের? ব্যবস্থা কী আছে বিদেশি ডাক্তার ও সাহায্যকর্মীদের অস্থায়ী আবাসনের?

সবচেয়ে বড় আশঙ্কা হচ্ছে তথ্য হারিয়ে যাওয়ার। বাংলাদেশের কোনও ইনফরমেশনের ব্যাকআপ নেই। ব্যাংকগুলোর লেনদেনের তথ্যগুলোর কী কোনও ব্যাকআপ থাকে আঞ্চলিক কিংবা হেড অফিসে? কার একাউন্টে কত ছিল কিংবা ঋণখেলাপিদের তালিকাটা ভূমিকম্প-উত্তর বাংলাদেশে খুঁজে পাওয়া যাবে? ভেঙে পড়া কারাগারের কয়েদিদের তালিকাটা কি ধ্বংসস্তূপের নিচ থেকে উদ্ধার সম্ভব হবে? চিহ্নিত সন্ত্রাসীদের তালিকাটা? ফ্ল্যাটগুলোর দলিল, জমির মালিকানার রেকর্ডের কোনো ব্যাকআপের ব্যবস্থা কী আছে? উল্লেখ্য, ’৬৫-এর পাক-ভারত যুদ্ধের সময় কসবা সাব-রেজিস্ট্রি অফিস সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়েছিল। তখনও এক জেলার সম্পত্তি অন্য জেলায় রেজিস্ট্রির নিয়ম ছিল। এখনও জমির দালালেরা পুড়ে যাওয়া কসবা সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে রেজিস্ট্রি দেখিয়ে নিরীহ মানুষের সম্পদ লুটে। ভূমিকম্প-উত্তর বাংলাদেশে অকাতরে প্রাণ ও সম্পদের হানি ঘটবে নিঃসন্দেহে কিন্তু তথ্যের অভাবে একজনের ব্যাংক হিসাব অন্যের নামে, সাধুকে সন্ত্রাসী আর খুনি বেকসুর খালাস এবং একজনের জমি অন্যের নামে দেখানোর ব্যবসাটা বেশ জমে উঠবে।ভাগ্য সহায়তা করলে দুর্গত মানুষগুলোকে উদ্ধার ও বাঁচানো যাবে হয়ত। বিধ্বস্ত নগরীগুলো গড়ে তোলা যাবে ধীর লয়ে হলেও। সভ্যতার অগ্রযাত্রা কখনও থেমে থাকে না। কিন্তু হারিয়ে যাওয়া তথ্যগুলো?

কোনও কোনও মানুষ ভূমিকম্পের আগাম ক্ষয়ক্ষতির বিনিময়ের মুনাফার অংকটা ভেবে নিশ্চয় গোঁফে তেল মাখছেন। অবশ্য কেউ কেউ আছেন কুম্ভকর্ণ নিদ্রায়।

আল্লাহ্‌ আমাদের সবাইকে এই দুর্যোগের থেকে হেফাজাত করুক। আমিন

মূল প্রবন্ধঃ সংগৃহীত 

মন্তব্য করুন

Back to top button