সাম্প্রতিক প্রসঙ্গ

শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দিন!

করোনা ভাইরাস সত্বর চলে যাবে, এর পর অন্য কোন ভাইরাস বাংলাদেশে আসবে না, এমন কোন গ্যারাণ্টি কেউ দিতে পারবেন কি? তাহ’লে বড় বড় ব্যবসা-বাণিজ্য সবই চলছে, কেবল ক্ষুদ্র ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সমূহ বন্ধ থাকবে কেন? ‘বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা’ ইতিমধ্যে সকলকে হুঁশিয়ার করেছে যে, করোনা ভাইরাসের সাথে খাপ খাইয়ে যথাযথ প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নিয়েই সবাইকে চলতে হবে। কবে পৃথিবী এই ভাইরাস থেকে পরিত্রাণ পাবে, সেটার সুচিন্তিত টাইমলাইন কারু জানা নেই। এইসব হুঁশিয়ারী এমনই ইঙ্গিত দেয় যে, আমাদের বেঁচে থাকার তাকীদে যাবতীয় মৌলিক বিষয় মহামারির ভিতরেই বিকল্প বেছে নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। তা না হ’লে মানব সভ্যতা যে নিশ্চিত হুমকির মুখে পড়বে, সেটা সহজে অনুমেয়। তাই নীতি নির্ধারকদের করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ শূন্যের কোঠায় নেমে আসার পরেই কেবল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সমূহ খুলে দেওয়া হবে, এরূপ সাধু চিন্তা পুরোপুরি যৌক্তিক নয়।

আমরা মনে করি, অফিসে, কল-কারখানায়, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ও মসজিদ-ঈদগাহে পরস্পরে ৩ ফুট দূরতব বজায় রাখা এবং মাস্ক পরিধান অব্যাহত রাখা সম্ভব। একইভাবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রতি বেঞ্চে দুই মাথায় দু’জন শিক্ষার্থী বসা এবং এভাবে সব শিক্ষার্থীদের সশরীরে ক্লাস নেওয়া খুবই সম্ভব ও সঙ্গত। মোবাইলে বা অনলাইনে ক্লাস নেওয়া স্রেফ পন্ডশ্রম মাত্র। এতে শিক্ষার্থীদের কোন মনোযোগ আসে না। শিক্ষকদের কোন প্রভাবও তাদের উপর পড়ে না। তাই অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম কোনভাবেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সশরীরে পাঠদানের বিকল্প হ’তে পারেনা।

ইউনেস্কোর সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী পুরোপুরি ও আংশিকভাবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সমূহ বন্ধ থাকায় বিশ্বব্যাপী ৮৮ কোটি ৮০ লাখের বেশী শিশুর পড়াশোনা অব্যাহতভাবে বাধার মুখে পড়েছে। তনমধ্যে গত বছর মার্চ থেকে বন্ধ রাখা বিশ্বের ১৪টি দেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশী সময় ধরে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রেখেছে পানামা, এল সালভাদর, বাংলাদেশ ও বলিভিয়া। ফলে গত ১২ই জুলাই ইউনিসেফ ও ইউনেস্কো যৌথ বিবৃতিতে বিশ্বের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছে।

এটি সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত যে, সংক্রমণের প্রধান কারণগুলির মধ্যে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলি নেই। তাছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বয়স্ক ও সচেতন। তারা নিজেরাই সাবধান থাকবে। সেই সাথে শিক্ষক ও বিভাগীয় কর্মচারীগণ নিজেরা শ্রেণীকক্ষে বা দরজায় শিক্ষার্থীদের হুঁশিয়ার করবেন। সাথে মাস্ক ও হ্যান্ড স্যানিটাইজার রাখবেন। প্রয়োজনে সেগুলি দরদের সাথে শিক্ষার্থীদের সরবরাহ করবেন। এভাবে বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে উপযুক্ত প্রশমন কৌশল অবলম্বনের মাধ্যমে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি সামাল দেওয়া সম্ভব। সাথে সাথে শিক্ষার্থী সহ সকল নাগরিকের জন্য ব্যাপকভাবে টিকা প্রদান কর্মসূচীকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে। অনেক কিছু ছাড় দিয়ে হ’লেও সরকারকে গুরুত্বের সাথে সর্বাগ্রে এটি বাস্তবায়ন করতে হবে। ২০১৬ সালের হিসাবে ১৪৪ কোটির অধিক জনসংখ্যার বিশাল দেশ চীন যদি ২০২০ সালের এপ্রিল থেকে বিগত ১৫ মাস ধরে সে দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সমূহ খোলা রাখতে পারে, তাহ’লে আমরা কেন পারিনা? করোনায় আক্রান্ত প্রথম দেশ হওয়া সত্ত্বেও তারা ও উত্তর কোরিয়া সহ পৃথিবীর ১২টি দেশ যদি ইতিমধ্যে করোনমুক্ত হ’তে পারে, তাহ’লে আমরা কেন পারিনা?

খাদ্য-বস্ত্র, বাসস্থান-শিক্ষা ও চিকিৎসা মানুষের মৌলিক চাহিদা সমূহের অন্তর্ভুক্ত। অথচ অন্য সবগুলি সীমিত বা অসীমিত আকারে চললেও কেবল শিক্ষার অধিকার থেকে আমাদের সন্তানদের বঞ্চিত রাখা হচ্ছে। সেই সাথে সামাজিকভাবে শিশুদের গড়ে ওঠার কল্যাণ থেকে তারা মাহরূম হচ্ছে। ফলে তারা ক্রমেই অস্বাভাবিক জীবনের দিকে ঝুঁকে পড়ছে। ‘কিশোর গ্যাং’ শব্দটি ইতিমধ্যেই পত্রিকার শিরোনাম হচ্ছে। যাদের ঠেকানোর ক্ষমতা প্রশাসনের নেই। সেই সাথে বিষণ্ণতা, আত্মহত্যা ও আত্মহত্যা-প্রবণতার মত জটিল মানসিক ব্যাধিও ক্রমেই আমাদের তরুণদের গ্রাস করছে। তাদের মধ্যে ইন্টারনেট আসক্তি বেড়ে যাচ্ছে। ফলে আগামী দিনের জাতির মেরুদন্ড ভঙ্গুর হয়ে যাচ্ছে। তাই সর্বাগ্রে তাদের মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া আবশ্যক। তাছাড়া গবেষণায় দেখা গেছে যে, সৌহার্দ্যপূর্ণ পারিবারিক ও সামাজিক পরিবেশ এবং পারিবারিক কাজ ও কায়িক পরিশ্রম করলে মানসিক স্বাস্থ্যের উপর করোনার ক্ষতিকর প্রভাব অনেকাংশে হ্রাস পায়। অতএব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিয়ে শিক্ষার্থীদের যদি কেবল খেলাধূলায় ব্যস্ত রাখা যায়, তাতেও তাদের অনেক কল্যাণ আছে। বর্তমানে এটাই বাস্তব যে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সমূহ যদি এখনই খুলে দেওয়া হয়, তথাপি প্রায় অর্ধেক শিক্ষার্থী আর প্রতিষ্ঠানমুখো হবেনা। তারা অনেকেই বিভিন্ন শ্রমে জড়িয়ে পড়েছে। অথবা গরীব বাপ-মায়ের পরিবারে সহযোগিতা করছে। গত ৮ই জুলাই রাতে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে হাশেম ফুডস লিমিটেডের অগ্নিদগ্ধ ও মৃত শ্রমিকদের অধিকাংশই ছিল শিশু শ্রমিক। এতে বুঝা যায়, শিশু শিক্ষার্থীদের অবস্থা কি?

প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে বিশেষজ্ঞদের হিসাব মতে, করোনাকালে দেশে ২ কোটি ৪৫ লাখের উপর মানুষ নতুনভাবে গরীব হয়েছে। সেই সাথে যোগ হয়েছে খুলনা ও সাতক্ষীরা অঞ্চলে গত ২৬শে মে আঘাত হানা ভয়ঙ্কর ঘুর্ণিঝড় ‘ইয়াসে’র ধ্বংসযজ্ঞ। চলছে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে নদী ভাঙ্গনে ভিটে-মাটি সহ সর্বস্বহারা মানুষের হাহাকার। এদের এবং এদের সন্তানদের উপায় কি হবে? এছাড়া অনেক শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রীর ফল লাভের অপেক্ষায় ছিল। আশা ছিল সার্টিফিকেট হাতে পেয়ে তারা কোন প্রতিষ্ঠানে চাকরী পাবে। কিন্তু তারা এখন চোখে অন্ধকার দেখছে। সেকারণ আমরা দাবী করেছি, এমপিও বিহীন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির শিক্ষক-কর্মচারীদের জন্য মাসিক কমপক্ষে ১৫ হাযার ও ১০ হাযার টাকা এবং গরীব পরিবারগুলির জন্য কমপক্ষে ১২ হাযার টাকা করোনাকালীন ভাতা বরাদ্দ করুন! সেই সাথে সরকারী সাহায্য বঞ্চিত দুস্থ ও ইয়াতীমখানা সহ মাদ্রাসা, স্কুল, কলেজ ও অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিকে ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য প্রতিষ্ঠানের তারতম্য অনুযায়ী অর্থ বরাদ্দ করুন। অতঃপর তা স্ব স্ব প্রতিষ্ঠানের একাউন্টে পৌঁছে দিন। সর্বোপরি অশুভ চামড়া সিন্ডিকেটের হাত থেকে কুরবানীর চামড়াকে রক্ষা করুন। নদীভাঙ্গন এলাকায় ও ইয়াস কবলিত এলাকায় স্থায়ী বন্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধ নির্মাণ করুন। বিশেষ করে ইয়াসে ক্ষতিগ্রস্ত দক্ষিণের লবণাক্ত অঞ্চলে সুপেয় পানির জন্য ব্যাপকভাবে গভীর নলকূপ বসান। আর বেড়ায় যেন কাঁকুড় না খায়, সে ব্যাপারে সরকারকে অবশ্যই কঠোরভাবে নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করতে হবে।

সবশেষে আমাদের একান্ত আবেদন, অনতিবিলম্বে দেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দিন এবং বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা দিয়ে শিক্ষার্থীদের পুনরায় তাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা নিন। সেই সাথে যেসব শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার ফল আটকিয়ে আছে, তাদের ফলগুলি কোনরূপ ফিস ছাড়াই তাদের ঠিকানায় পৌঁছে দিন। আল্লাহ আমাদের সহায় হৌন -আমীন!

প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
মাসিক আত-তাহরীক

ইসলামিক ইমেইল নিউজলেটার
নতুন পোস্ট প্রকাশিত হলে সরাসরি আপনার ই-মেইল ইনবক্সে পেতে সাবস্ক্রাইব করুন।
icon

১টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

Back to top button