ক্যালেন্ডার উল্টানোর আগে একটু ভাবুন
এক. একটি বছর অতিবাহিত হওয়া মানে মূল্যবান জীবনের একটি অংশ খসে পড়া। কবরমুখী যাত্রার এই টার্নিং পয়েন্টে এসে ফুর্তি করা কোনো বিবেকবান মানুষের কাজ হতে পারে না। জীবনের প্রতিটি স্টপেজে দাঁড়িয়ে একজন বুদ্ধিমান লোক নিজের আয়-ব্যয়ের হিসাব মেলায়।
মুসনাদে আহমদের বর্ণনামতে হজরত উমর রা: বলেন, তোমরা হিসাব গ্রহণ করার আগেই নিজের হিসাব নিজেই নিয়ে রাখো। সূরা হাশরে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তোমরা তাদের মতো হয়ো না, যারা আল্লাহকে ভুলে গেছে, তাই আল্লাহও তাদের আত্মভোলা করে দিয়েছেন’ (আয়াত ১৯)।
তিরমিজির বর্ণিত হাদিসে এসেছে, সেই (প্রকৃত) বুদ্ধিমান, যে নিজেই নিজের হিসাব গ্রহণ করে এবং পরকালের জন্য কাজ করে। সূরা মু’মিনূনে আল্লাহ তায়ালা তাঁর অনুগত বান্দাদের আলোচনা করতে গিয়ে বলেন, যারা তাঁদের প্রতিপালকের ভয়ে সন্ত্রস্ত থাকে তারাই ভালো কাজে প্রতিযোগিতা করে এবং তাতে বিজয়ী হয়।
নতুন বছর এলেই কি ফুর্তি করতে হবে? সব নতুনত্বে উৎসব আর উন্মাদনা উন্মাদেরই কাজ হতে পারে। একজন মৃত্যুদণ্ড ঘোষিত আসামির জন্য নতুন বছরের আগমন কখনোই ফুর্তির কারণ হতে পারে না। বরং প্রতিটি নতুন দিনই তার নিঃশ্বাসকে দীর্ঘায়িত করার কথা। আমরা সবাই তো মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামির মতোই জন্মের সাথে সাথেই মৃত্যুর ঘোষণা মাথায় নিয়ে এসেছি। যেকোনো সময় সমন আসতে পারে! ইরশাদ হয়েছে, ‘প্রত্যেক প্রাণীকেই মৃত্যুর স্বাদ আস্বাদন করতে হবে’ (সূরা আলে ইমরান, আয়াত ১৮৫)।
দুই. নতুন বছরের প্রথম দিনকে উৎসবের মাধ্যমে উদযাপনের ইতিহাস বেশ পুরনো। ইরানের অগ্নিপূজকরা এর সূচনা করেন। নতুন বছরের প্রথম দিনকে তারা ‘নওরোজ’ বলে থাকে। নওরোজ অর্থ নতুন দিন। এ দিনে তারা উপাসনা ও উৎসবে মেতে ওঠে। হাজারো বছর ধরে এ সংস্কৃতি তারা পালন করে আসছে। গত কয়েক শতাব্দী আগে খ্রিষ্টানরাও ইংরেজি (খ্রিষ্টীয়) নববর্ষ উদযাপন করে আসছে।
বুখারি-মুসলিমে বর্ণিত হাদিসে রাসূলুল্লাহ সা: ইরশাদ করেছেন, তোমরা অবশ্যই তোমাদের পূর্ববর্তীদের (অর্থাৎ ইহুদি ও খ্রিষ্টানদের) নিয়ম-নীতির অন্ধ অনুকরণ করবে। এমনকি তারা কোনো গর্তে প্রবেশ করলে তোমরাও তাতে প্রবেশ করবে। সুনানে আবু দাউদে বর্ণিত হাদিসে রাসূলুল্লাহ সা: ইরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি কোনো সম্প্রদায়ের সাদৃশ্য গ্রহণ করবে সে তাদের অন্তর্ভুক্ত বিবেচিত হবে।
তিন. ইংরেজি নববর্ষ বরণ উপলক্ষে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশও কোটি কোটি টাকা অপব্যয় করে আতশবাজি করা হয়। ফুর্তির নামে পশুদেরও হার মানানো নির্লজ্জতায় ডুবে যায় সমাজের বড় একটি অংশ। কথায় আছে, লজ্জা উঠে গেলে কোনো কিছু করতেই বাঁধ ও বাধা থাকে না। অর্থনৈকি চরম দুরবস্থা ও দারিদ্র্যের কশাঘাতে আহত সাধারণ জনগণকে যারা রক্ষা করার নসিহত করেন, ভদ্রতার ভেকধারী সমাজের সেসব লোক এবং রক্তচোষা বণিকরা মেতে ওঠেন থার্টিফার্স্ট নাইটের নগ্নতা ও উন্মাদনায়। নারীর অধিকার আদায়ের নামে ইসলামের একহাত নেয়া নারীবাদী সুশীলরা থার্টিফার্স্ট নাইটে নারীকে পণ্য হিসেবে উপস্থাপন করেন। বাংলা সংস্কৃতির ধ্বজাধারীরাও এ উপলক্ষে পশ্চিমা এই সংস্কৃতিতে ডুবে যান।
এ দেশে কনকনে শীতে একটুখানি উষ্ণতার পরশ পাওয়ার মতো কাপড়ের অভাবে প্রতি বছর চরম কষ্টে নিপতিত হন বহু বনি আদম। অথচ প্রতি বছর থার্টিফার্স্ট নাইট মাতাতে আসেন ভারত, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, ফিলিপাইন ও কেনিয়ার ডিজেরা। রেডিসন, শেরাটন, রিজেন্সিতে পারফর্ম করেন তারা। তাদের নাচ ও গানের সাথে থাকে এ দেশীয় আইটেম গার্ল ও ডিজেদের নোংরামি। থাকে ফ্যাশন শো, আইটেম ড্যান্স ও লাইভ মিউজিক কনসার্ট।
চার. আমরা মুখে ব্যক্তিস্বাধীনতার কথা বললেও আদতে কর্পোরেট ব্যবসায়ীদের ক্রীড়নকে পরিণত। করপোরেট ব্যবসায়ীদের ব্যবসায়িক স্বার্থ রক্ষার জন্য তারা আমাদের জন্য ডিজাইন করে বিভিন্ন দিবস ও সংস্কৃতির। ব্যবসার প্রয়োজনে তারা আমাদের কাঁদায় আবার একই প্রয়োজনে হাসায়।
প্রকৃত স্বাধীনতা অর্জনের জন্য মহান আল্লাহ ছাড়া অন্য সবার; এমনকি নিজ প্রবৃত্তির দাসত্বও ছাড়তে হবে আমাদের। অন্যথায় আজীবন স্বাধীনতার খোলসেই পরাধীন হয়ে থাকব আমরা। মহান আল্লাহ আমাদের শুদ্ধ চিন্তা ও সঠিক কাজ করার তাওফিক দান করুন। আমীন।
লেখক : শায়খ আহমাদুল্লাহ, চেয়ারম্যান, আস-সুন্নাহ ফাউন্ডেশন।
অনেক মূল্যবান কথা। ধন্যবাদ