মহাকাব্য
বরষাকে দেখলে মহাকাব্যের নায়িকা মনে হতাে। ওর একটা প্রেম ছিল। ছেলেটা আচমকা মারা যাবার পর ওর নায়িকাসুলভ চেহারায় বিষন্নতার ছাপ মেঘনাদপ্রিয়ার কথাই মনে করিয়ে দিত। সে কারাে সাথে খুব একটা কথা বলত না, কলেজেও আসত কদাচিৎ।
রাহির সাথে বরষার কথাবার্তা ‘কেমন আছ, ভালাে আছি’র গণ্ডী পেরােয় কলেজে মার্কশিট আনতে গিয়ে। অনার্সে দুজন দুই জায়গায় ভর্তি হয়েছে। এই নিয়ে কথা বলতে বলতে অনেক কথা হয়ে গেল। বরষা রাহির ফোন নম্বর চাইলে ও মনে মনে ভাবল, তােমার দুই বছরে কারাে সাথে কথা বলার সময় হয়নি, আর তুমি করবে আমাকে ফোন’! কিন্তু নম্বর দিয়ে দিল।
রাহিকে অবাক করে দিয়ে সেদিন বিকেলেই বরষা ওকে ফোন করল। তারপর থেকে প্রতিদিনই সে ফোন করত। রাহি বুঝতে পারল, বহুদিন পর বিষন্নতা কাটিয়ে উঠে বরষা যখন হঠাৎ আবিষ্কার করল ওর আশেপাশে আর কেউ অবশিষ্ট নেই, তখন সে বন্ধুত্বের জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে। রাহির তাতে সমস্যা নেই। কীভাবে কীভাবে যেন সব সমস্যাগুলাে খুঁজে পেতে ওর কাছে চলে আসে! সে এতে এত অভ্যস্ত যে, ওর কাছে এখন এটা স্বাভাবিক ব্যাপার বলেই মনে হয়।
অতিরিক্ত সুন্দরী মেয়েদের বেলা যা হয়, ছাত্রীত্ব বজায় রাখার জন্য যতটুকু ক্লাস না করলেই নয় তার বাইরে বরষা কোথাও যেতে পারত না। রাহি মাঝেমধ্যে বরষার বাসায় যেত বটে। কিন্তু বিশাল বন্ধুগােষ্ঠীর সবাইকে সবসময় খুশি করা সম্ভব হতাে না। তাই ওদের দুজনের বন্ধুত মূলত ফোনে ফোনেই অগ্রসর হতে থাকে। এভাবেই ওরা জেনে যায় পরস্পরের সমস্ত খবর , আদান-প্রদান হয় সকল সংবাদ।
প্রায় একবছর পর, একদিন বরষা রাহিকে ফোন করে জানায়, আজ আমাকে দেখতে আসবে।
এটা কোনাে নতুন ব্যাপার নয়। ওর জন্য প্রায় প্রতিদিনই নিদেনপক্ষে একহালি প্রস্তাব আসত। তার মধ্যে অনেক বেছে-বুছেও ওকে প্রায়ই জনসমক্ষে প্রদর্শনী দিতে হতাে। তবে এবার ওকে বেশ উফুল্ল মনে হচ্ছিল। রাহি খুব খুশি হলাে বান্ধবীকে আনন্দিত দেখে।
হঠাৎ বরষা বলে বসল, জানাে? তােমার বিবেচনার ওপর আমার ভীষণ আস্থা। তুমি রাজি হলেই কেবল আমি এই বিয়েতে মত দেব, নতুবা নয়।’
বরষার শিশুসুলভ সরলতায় রাহি হেসে ফেলল, শােন, সংসার আমি করব না। করবে তুমি। পছন্দ করার অধিকার এবং দায়িত্ব তােমার আর তােমার পরিবারের। তারপর যেখানে যা সাহায্য সহযােগিতা প্রয়ােজন হয়, আমি আছি ইনশাআল্লাহ।
বরপক্ষ চলে যাওয়া মাত্র রাহিকে ফোন করল বরষা। ওর গলা শুনেই রাহি বেশ বুঝতে পারছিল এই বিয়ের ব্যাপারে বরষার কোনাে প্রকার দ্বিধা নেই। ওকে দেখার জন্য ওর হবু শ্বশুরবাড়ির সবাই এসেছিল। সে তাদের আচরণে মুগ্ধ আর হবু শাশুড়িকে সে তখন থেকেই মা ডাকতে শুরু করে দিয়েছে! ওর গলায় উচ্ছ্বাস শুনে রাহির মনে হলাে, বহুদিন পর বরষা স্বাভাবিক তরুণীসুলভ উচ্ছলতায় জেগে উঠেছে। যে বিষন্নতা ওকে সবসময় আচ্ছন্ন করে রাখত তার লেশমাত্র নেই। এ এক নতুন বরষা! মন থেকে বান্ধবীর হবু শ্বশুরবাড়ির সবাইকে পছন্দ করে ফেলল রাহি।।
সাতদিন পর হঠাৎ বরষার গলার সেই উচ্ছ্বাস কেমন যেন স্তিমিত মনে হলাে।
কী হয়েছে বরষা? উদ্বিগ্ন হয়ে জিজ্ঞেস করল রাহি।
‘এমন লজ্জার কথা কী করে বলি, রাহি? কীভাবে আব্বা আম্মাকে বুঝাই?
‘আগে তাে বল কী হয়েছে? ‘আমার আপা এই বিয়ে ভেঙ্গে দিতে চায়।
যাহ’!
‘তুমিও যদি আমার কথা বিশ্বাস না কর তাহলে কে করবে, বল? হতাশ হয়ে যায় বরষা। “আচ্ছা, আমি বিশ্বাস করলাম। কিন্তু তােমার কেন এমন মনে হলাে আমাকে বুঝিয়ে বল তাে। আমার তাে মনে হয় বড় আপা তােমাকে অত্যন্ত স্নেহ করেন। তা তাে করেই, এই ব্যাপারে কোনাে সন্দেহ নেই। কিন্তু ও কিছুতেই হিংসা দমন করতে পারছে না।
হিংসা!
‘তােমাকে তাে বলেছি, ও পালিয়ে বিয়ে করেছে। সেজন্য ও আজ পর্যন্ত শ্বশুরবাড়িতে বউয়ের মর্যাদা পায়নি। আব্বা-আম্মাও ওর সাথে বহুবছর যােগাযােগ রাখেননি। মাত্র গতবছর থেকে ওর অসহায়ত্বের কথা বিবেচনা করে, ওরা ওকে বাসায় আসতে দিচ্ছেন। আমাকে দেখানাের সময় ওকে ডাকা হয়নি। ওর বিয়েতে কেউ যায়নি। আর আমার বিয়েতে শুধু দেখার জন্যই সম্পূর্ণ শ্বশুরকুল এসেছিল। আব্বা-আম্মা আমার বিয়েতে এমন ধুমধাম করছেন যা মানুষ সচরাচর বড় মেয়ের বিয়েতে করে। ও কিছুতেই এসব হজম করতে পারছে না। আমাকে দেখে যাবার চারদিন পর, যেদিন ওরা আংটি পরাতে এলাে, আপা দুপুর থেকেই বাসায় এসে বসে রইল। আম্মা মানা করার পরও সে অনুষ্ঠানে সবার সামনে এসে বসল। তখন ওকে পরিচয় করিয়ে দিতে হলাে। পরদিন ও এসে আম্মাকে বলে, ‘এই বিয়ে ভেঙ্গে দাও।’
‘আম্মা অবাক হয়ে বলল, “কেন?”
‘ও বলল, “ছেলের ফিগার ভালাে না।
‘আম্মা বলল, এতে যদি বরষার সমস্যা না হয়, তাে তাের সমস্যা কী? ওর শাশুড়ি তাে প্রতিদিন ফোন করে ওর সাথে কথা বলেন। ও যেখানে খুশি, সেখানে ফিগার দিয়ে কী হবে?
কিন্তু আপাকে তাে আমি চিনি। ও যা ঠিক করে, তা করেই ছাড়ে। আমার কেন যেন মনে হচ্ছে ও এই বিয়ে হতে দেবে না।
রাহি বলল, তােমার এই প্রস্তাবটি কতটা পছন্দের তা তুমি তােমার আব্বা-আম্মাকে জানিয়ে রাখ। শান্ত থাক। সব ঠিক হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ।
কিন্তু কিছুই ঠিক হলাে না। সাতদিন ধরে প্রতিদিনই বরষা রাহিকে বড় আপার নানান কার্যক্রমের বিবরণ শােনাতে লাগল। মহিলার ধৈর্য এবং অধ্যাবসায়ে রাহি মুগ্ধ! অষ্টম দিন বরষা ফোন করে বলল, ‘রাহি, আমি আংটি ফেরত পাঠিয়ে দিয়েছি। বড় আপা বিশ্বস্তসূত্রে খবর এনেছে ছেলের চারিত্রিক সমস্যা আছে।
রাহি একটু অবাক হলাে। আর যাই হােক, চারিত্রিক বিষয়ে মানুষ সহজে মিথ্যা বলে না। সুতরাং বড় আপা হয়তাে এ ব্যাপারে মিথ্যা বলেননি। তবু সে বরষাকে জিজ্ঞেস করল, বিশ্বস্ত সূত্রটা কে, তুমি চেন?
সে বলল, ‘মলি আপা, যিনি আমাদের বিয়ের ঘটকালি করেছেন।
ব্যাপারটা রাহির কাছে বেখাপ্পা মনে হলাে। কোনাে মহিলা কি জেনেশুনে আরেকজন মহিলার ক্ষতি করতে পারে? ছেলের চারিত্রিক সমস্যা থাকলে তিনি বরষার জন্য প্রস্তাব দেবেনই বা কেন?
রাহি বলল, ‘বরষা, তুমি একবার মলি আপাকে ফোন করে জিজ্ঞেস কর। বল, বড় আপাকে উনি কী বলেছেন তুমি নিজে শুনতে চাও।
কী লাভ রাহি? আমি এই বিয়ের চিন্তা বাদ দিয়েছি।
তারপরও তুমি একটা ফোন কর। আচ্ছা, তুমি যখন বলছ, আমি ফোন করে কথা বলছি। একঘণ্টা পর বরষা ফোন করে কাঁদতে কাঁদতে অস্থির, রাহি, আমি কল্পনাও করতে পারিনি, আমার আপা আমার এত বড় ক্ষতি করবে! মলি আপার সাথে ওর দেখাই হয়নি! উনি বলছেন, তােমার আংটি পেয়েছি। কিন্তু তুমি কী করে ধারণা করলে আমি তােমার এমন সর্বনাশ করতে পারি? এমন ছেলে তুমি আরেকটা পাবে না। কিন্তু আমি তাে নিজের হাতে সব শেষ করে দিলাম! এখন আমি কী করব রাহি? রাহি সান্ত্বনা দেয়ার ভাষা খুঁজে পেল না।
দুদিন পর বরষা ফোন করে জানাল ছেলে ওকে আংটি ফেরত পাঠিয়েছে। সাথে সাথে ওর আব্বাকে ফোন করে অনুমতি নিয়ে ওর সাথে কথা বলেছে। জীবনে প্রথম আলাপ। অথচ সে কী বকা ! ‘আপনাকে আংটি কি মলি আপা পরিয়েছিল? আপনি কী বুঝে উনাকে আংটি ফেরত পাঠালেন? ভাগ্য ভালাে যে, উনি আমার মাকে জানানাের আগে আমাকে খবর দিয়েছিলেন! আপনি জানেন, আমার মা এই খবর পেলে কী পরিমাণ কষ্ট পেতেন? নিন, আমার ফোন নম্বর রাখুন। ভবিষ্যতে আমার চরিত্র নিয়ে কোনাে প্রকার সন্দেহ হলে সরাসরি আমাকে ফোন করে জেনে নেবেন। তারপর সন্তুষ্ট না হলে আমি নিজে এসে আংটি ফেরত নিয়ে যাব। আর শুনুন, আপনার এই কাণ্ডকীর্তির ব্যাপারে আমার মাকে জানানাের প্রয়ােজন নেই। আরেকটা কথা, আপনি কি সারাজীবন এভাবে মানুষের কথা শুনে সিদ্ধান্ত নেবেন? না নিজেও কিছু বুদ্ধি খরচ করবেন? বকা খেয়েও বরষা খুশি হলাে। ওর ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করা গেল এবং হবু শাশুড়িকে কষ্ট দেয়া হলাে না। ওর গল্প শুনে রাহিও বান্ধবীর খুশিতে আপুত হলাে ।
বড় আপার চেষ্টা অব্যাহত রইল। আব্বা-আম্মা সাবধান হয়ে যাওয়াতে ডান সুবিধা করতে পারছিলেন না। সাতদিন পর উনি অস্থির হয়ে চরম সিদ্ধান্ত নিলেন। বরষা বুঝতে পারছিল উনার উদ্দেশ্য সুবিধার নয়। কিন্তু পুরােপুরি বুঝে উঠার আগেই উনি ওর আব্বা-আম্মার রুমে ঢুকে ভেতর থেকে দরজা আটকে দিলেন। ভেতর থেকে ফোন করার শব্দ পেয়ে সে দৌড়ে ড্রয়িং রুমের ফোন তুলতেই ওপাশ থেকে ওর হবু বরের গলা শুনতে পেল, ‘হ্যালাে’!
বড় আপা নিজের পরিচয় দিলেন। তারপর রষার চরিত্র নিয়ে যে বানােয়াট ফিরিস্তি শুরু করলেন তাতে বরষার দুচোখে প্লাবন নেমে এলাে।
অনেকক্ষণ পর হবু বর জিজ্ঞেস করলেন, আপনি এসব কথা আমাকে কেন বলছেন? বড় আপা মােহনীয় কণ্ঠে বললেন, আমি আপনার শুভাকাঙ্ক্ষী, আপনার উপকার করতে চাই।’
হবু বর বললেন, সরি , যিনি নিজের বােনের ক্ষতি করেন, তার উপকার আমি গ্রহণ করতে ইচ্ছুক নই।’
বরষার হৃদয় দুলে উঠলাে। কিন্তু ততক্ষণে বড় আপা প্রচণ্ড কর্কশ স্বরে এমন সব গালিগালাজ শুরু করেছে যা শুনে বরষার গা রি রি করতে লাগল। ভদ্রলােক কেন যে ফোন রেখে দিচ্ছেন না সে বুঝতে পারল না। কিন্তু উনি কোনাে জবাবও দিচ্ছেন না। প্রায় পনেরাে মিনিট পর আপা নিজেই ক্লান্ত হয়ে গেলেন। বললেন, আপনি আছেন, না রণে ভঙ্গ দিয়েছেন?
হবু বর বললেন, ‘আছি।’
বড় আপা আশ্চর্য হয়ে বললেন, তাহলে কিছু বলছেন না যে?
ভদ্রলােক জবাব দিলেন, আপনি তাে পাগল, পাগলের কথায় কোনাে জবাব দিতে হয় না।
বড় আপা ফোন ছুঁড়ে মেরে তার স্বরে কান্নাকাটি করতে লাগলেন। বরষা ফোন রেখে দিতে যাচ্ছিল, কিন্তু ওপাশ থেকে শােনা গেল, ‘ফোন রাখবেন না, প্লিজ। আমি জানি আপনি শুরু থেকেই শুনছেন।
মা অপ্রস্তুত হয়ে বলল, বড় আপার আচরণের জন্য আমি ভীষণ চিন্তিত। বিশ্বাস করুন, আমি ওকে থামাতে চেয়েছিলাম। কিন্তু ও রুমের ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করে দিয়েছে।’
হবু বর বললেন, কোনাে সমস্যা নেই। উনি যেকোনাে কারণেই চান না আমাদের বিয়েটা হােক। আপনি যে কাজটা করবেন তা হলাে, এই ব্যাপারে আপনি কাউকে জানাবেন না। আপার সাথে স্বাভাবিক আচরণ করবেন। উনাকে সফল হতে দেয়া যাবে না। সুতরাং খেয়াল রাখবেন, উনার কারণে যেন বিয়েটা না ভাঙ্গে।
বরষা অবাক হয়ে বলল, “এইমাত্র ও যা যা বলল, যা করল, তারপরও আপনি আমাকে বিয়ে করবেন?
হবু বর বললেন, ‘উনি যা বলেছেন সব মিথ্যা আপনিও জানেন, আমিও জানি। উনি তাে এমন বাজে কথা আমার ব্যাপারেও বলেছিলেন। তারপরও তাে আপনি আমাকে বিশ্বাস করেছেন, তাহলে আমি কেন আপনাকে অবিশ্বাস করব? কিন্তু …’
কিন্তু কী?
বিয়ের পর এর জন্য আপনি আমাকে কথা শােনাবেন না তাে?
‘শুনুন, আপনার বােন পাগল, আমি সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষ। আপনার কোনাে সমস্যা থাকলে আমাকে এখনই বলতে পারেন।
বরষা হাসতে হাসতে ফোন রেখে দিল। পরে রাহি আর বরষা কথা বলতে বলতে হাসি থামাতেই পারছিল না!
বিয়ের আর সাতদিন বাকি। বরষা রাহিকে ফোন করে ক্লান্ত গলায় বলল, ‘আমি আর পারি না রে’!
আবার কী হলাে?
‘বড় আপা আম্মাকে আল্টিমেটাম দিয়েছে, এই বিয়ে হতে পারবে না। হলে সে আর কোনােদিন এই বাসায় আসবে না। আব্বা বাড়ি গেছিলেন তা তাে জানেনা। উনি বাড়ি থেকে রওয়ানা দিয়েছেন। আব্বা এলেই আব্বা আম্মা ওদের বাসায় গিয়ে বিয়ে ভেঙ্গে দিয়ে আসবে।’
রাহি কী করবে বুঝে পেলাে না। এতদিন পর মেয়েটা স্বাভাবিক হতে শুরু করেছিল। কিন্তু ওর বােন নিজের হিংসা চরিতার্থ করতে গিয়ে ওকে নিজ হাতে ধ্বংসের পথে ঠেলে দিচ্ছেন। বাসায় আবার সান্ধ্য আইন। মাগরিবের পর বের হওয়া যাবে না। কিছু না ভেবে সে বরষাকে বলল, “আমি আসছি।
তখন মাগরিব পার হয়ে প্রায় এশার সময় হয়ে এসেছে। বহু কষ্টে আম্মুকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে একজন Escort জোগাড় করে রাহি যখন বরষার বাসায় এসে পৌঁছুল, তখন এশার আযান হচ্ছে। সে কখনাে আম্বু আম্মুকে ছাড়া রাতে বের হয়নি। ওর নিজেরই কেমন যেন অস্বস্তি লাগছিল। তবুও বান্ধবীকে সাহায্য করার তাগিদে সে যখন বরষাদের বাসায় ঢুকল তখন শুধু ড্রইংরুম ছাড়া সর্বত্র অন্ধকার। বরষার ভাইরা বিমর্ষ হয়ে বসে আছে। আন্টি বেডরুমে শােয়া। বরষা আন্টির দরজায় দাঁড়িয়ে কাঁদছে। বড় আপা বিজয় সেলেব্রেট করার জন্য নিজের বাসায় চলে গিয়েছেন।
রাহির আওয়াজ পেতেই আন্টি এসে ওকে বেডরুমে নিয়ে বসালেন। বেচারিকে পুরাে পাগলের মতাে দেখাচ্ছে।
উনি রাহিকে সামনে বসিয়ে বললেন, মাগাে, আমার দুই মেয়ের মাঝে পড়ে আমি শেষ! ছােট মেয়ে বলে এখানে বিয়ে না হলে ও আর বিয়েই করবে না। বড়টা বলে এখানে বিয়ে হলে সে আর বাসায় আসবে না। এখন আমি কী করি বল তাে?
রাহি ঢােক গিলে বলল, আন্টি আমি অনেক ছােট। কিন্তু, আপনি অনুমতি দিলে আমি কটা কথা বলতাম।
বল মা’!
আপনার বা আংকেলের কি ছেলে বা ছেলের পরিবারের ব্যাপারে কোনাে সন্দেহ বা আপত্তি আছে?
না রে মা, আমাদের তাে ঐ বাড়ির সবাইকে খুব পছন্দ। আর আমার মেয়ে তাে যেদিন ওকে দেখতে এলাে সেদিন থেকেই শাশুড়িকে মা ডাকতে শুরু করেছে! ভদ্র মহিলা জানাে ওকে প্রতিদিন ফোন করেন?
তার মানে এখানে আপত্তি শুধু বড় আপার, তাই তাে?
জ্বী। ‘বিয়েটা কি বড় আপার না বরষার? ‘বিয়ে তাে বরষার। বড় আপা তাে বিয়ে করে ফেলেছেন, তাই না আন্টি? উনি বিয়ে করার সময় কার কার পরামর্শ নিয়েছিলেন? কারাের না! কাউকে তাে জানায়নি’! তাহলে আপনারা বরষার বিয়েতে উনার কথাকে এত গুরুত্ব দিচ্ছেন কেন? ‘ও যে নাছােড়বান্দা, মা! বলছে এই বিয়ে হলে ও আর আসবে না। আপনারা তাে স্বেচ্ছায় উনাকে বহুবছর এই বাসায় আসতে দেননি। আরও কিছুদিন না আসুক। বরষার বিয়েটা হয়ে গেলেই উনি আবার আসা শুরু করবেন। কিন্তু উনার একটা অহেতুক আব্দারের জন্য আপনারা বরষার জীবনটা কেন নষ্ট করবেন? সে তাে আপনাদের সবাইকে নিয়ে, সবার মানসম্মানের প্রতি খেয়াল রেখেই সুখী হতে চায়। সে যখন আপনাদের এত খেয়াল রাখে, আপনি কি চান না আপনার এই মেয়েটি সুখী হােক?
আন্টি দুহাতে মাথার চুল আঁকড়ে ধরে বললেন, “আমার মাথা আর কাজ করে না মা। তুমি বল আমি কী করব। তুমি যা বলবে তাই করব।’
‘ঠিক তাে আন্টি? ওয়াদা? হ্যাঁ মা, ওয়াদা।’
‘আপনি বিসমিল্লাহ বলে বরষার বিয়েটা দিয়ে দেন। বড় আপা আসতে চাইলে আসবে, না এলে এলাে। উনার বিয়ের পর সব ঠিক হয়ে গিয়েছে না? বরষার বিয়ের পরেও সব ঠিক হয়ে যাবে।
রাহির কথাটা আন্টির খুব পছন্দ হলাে। কিছুক্ষণ পর আঙ্কেল এসে পৌঁছুলে সে তাঁকেও একই কথা বলল। আঙ্কেল ওকে বসিয়ে রেখেই বরষার হবু শ্বশুরবাড়িতে ফোন করলেন, বাড়ি থেকে এসেছি তাে, অনেক ক্লান্ত লাগছে। আজকে আর না আসি। না না, তেমন জরুরি কিছু না। এমনেই দেখা-সাক্ষাতের জন্য আসতে চাচ্ছিলাম। এখন ইনশাআল্লাহ বিয়ের আসরেই দেখা হবে বেয়াই। আসসালামু আলাইকুম।
সাতদিন পর বরষার বিয়ে হয়ে গেল।
– রেহনুমা বিনতে আনিস