ভাইয়ের বউ অভিজান (১ম পর্ব)
চারপাশটা এমন থম মেরে আছে, যেমনটা হয় বড়সড় ডাকাতির পর। সাবধানী আমি দরজা থেকে কাঠবিড়ালির মতো মাথা বের করে দেখি- ওমা! সেকি ঘো ঘো আওয়াজ! বাজ পড়ছে যেন।পড়ন্ত বিকেলে রোদ না যত তাড়াতাড়ি পড়ে, বাবার চোখের পাতা তার থেকেও দ্রুত পড়ে যায় বোধহয়। ঘুম…আর সাথে শুরু হয় কামান আর গোলা বর্ষণ এর মতো আওয়াজ। আর আমার প্রিয় মাসুম মা! তার কথা আর বলতে। আজ তিনিও একটু সহমত প্রকাশ করতে মাঝে মাঝে মেঘের মত ঘো-ঘা করছেন এই আরকি!
বাবার বাড়ি বেড়াতে এসেছি। বাড়িশুদ্ধ পুচকো-পুচকি সবাই ঘুম। বাড়িতে গল্প করবার কেউ ছিল না বলে ছাদে আসলাম। এসে দেখি, ওমা! আমার বিজ্ঞ ভাই মহাশয় আমারও আগে ছাদে এসে হাজিরা দিয়েছেন। ভাবুক সাদাতকে যে এই সময় ছাদে পাব, সত্যি আশা করিনি। সাদাতের ছাদে আসা, আর দিনের বেলা বাদুড় উড়তে দেখা সমান কথা!
ভারি লেন্স এর উপর দিয়ে চোখ তুলে দেখলে কেবল আমাদেরই দেখে, তারপর হারিয়ে যায় আবার ইয়া মোটা মোটা বইয়ে, আজ পর্যন্ত এই খালি দেখেছি! কিন্তু চারচোখা মানুষটা আজ ছাদে!
যাই হোক, ছাদে বাবা শখ করে ছাদ বাগান করেছেন। সেই বাগানে কুমড়ো ফুলটা বেশ বড়ই ধরেছে দেখছি, চাঙি পাতানো শিম গাছ, তারই এক পাশে আরেক গাছে ছোট ছোট করলা ঝুলে আছে, লাউ তো রীতিমতো আয়তনে লম্বা বেলুন হয়েছে যেন! কচি ধনে পাতাও আছে দেখছি। মা বলেছিলেন লাগিয়েছে। এসে দেখা হয়নি; বেশ লাগছে দেখতে!
এবার নাকি মরিচের কী এক নতুন জাত বেরিয়েছে, আমার মা তাই কোত্থ থেকে জোগাড় যত্ন করে এনে লাগিয়েছেন। কিছুতেই নামটা মনে না পড়াতে সাদাতকে “এই বলতো” বলে কুনুই দিয়ে খোচাতেই বলল-
“উহু আপু…. বিজলি প্লাস!”
মোনাজাতের ভঙ্গিতে মুখের উপর হাত চেপে রয়েছি খুব কষ্টে, শরীর রীতিমতো কাপছে। আমার আর হাসি থামে না। কিন্তু বিজ্ঞ মানুষের সামনে হাসলে কি না কি হয়! নামটা না যতটা হাস্যকর, তার চেয়েও হাস্যকর,গুতো খেয়ে সাদাতের পেচামুখো মুখটা!
জ্ঞানী মানুষের রাগ ভাঙাতে বললাম,
- সাদাত, এই নামটার একটু মূল উদঘাটন কর তো!
- কিই আবার! মরিচের জাত… নতুন বেরিয়েছে!!
এই ছেলের দেখছি খুব ঝাঝ! আমি বললাম আবার,
- তাই বলে এই নাম? বিজলি প্লাস?এই মরিচ খেয়ে বিজলির এর মতো পিল্লি চমকাবে নাকি? হ্যা?
বলে আমি সাদাত দুজনেই সম্বসরে হেসে উঠলাম।
২.
আমি ছাদ বিশ্লেষণ করছি, আর বকবক করছি। ওমা দেখি ভাই আমার উদাস মনে মেঘ উড়ে যাওয়া দেখছে। শুনবে কী কথা! সুরু চোখে সন্ধিৎসু মনে তার দিকে তাকিয়ে দেখি ভবঘুরে অগোছালো ভাইটা আমার, এমন ভাবে আকাশের দিক তাকিয়ে যেন কত যে হাহাকার বুকে! লক্ষ্যণ তো ভাল না! সাদাত এর চোখ আজকাল বইয়ের পাতা ছাড়া আকাশের মেঘ দেখছে দেখি, পুকুরে হাসের সাতার দেখছে, পাখিদের উড়োউড়ি দেখছে, এক দৃষ্টিতে উদাসভাবে নিচের বেসমেন্টের বাচ্চাদের খেলা দেখছে। ব্যাপার তো “ভাল্লাগেনা” রোগের দিকে…
আমি বললাম,
- কী রে জিনিয়াস! এখন আইনস্টাইন থেকে শেক্সপিয়ার কিছুই বাদ দিচ্ছিস না দেখছি?
- মানেএএএ?
- এই যা চেহারার হালত বানিয়েছিস, ঘরকুনো থেকে পুরোদস্তুর উদ্বাস্তুর মতো ছাদে ঘুরছিস, আবার আকাশে মেঘও দেখছিস, দার্শনিক দার্শনিক ভাব, এসব তো…
- হইছে চুপ কর তো, আপু। ভাল্লাগছিল না তাই এসেছি ছাদে।
আমি ইউরেকা বলার মত চিৎকার করে উঠলাম। পেয়েছি…পেয়েছি হ্যা এটাই!
চোখ বড় করে সাদাত ভয় পেয়ে গেল আমার এভাবে উচ্ছাস দেখে।
আমি যে ওর বড় বোন দেখলে কেউ বলে না। এমন রাশভারী মুখ আর মুড নিয়ে থাকে যেন ও মুরুব্বি! যাই হোক পেয়ে গেছি। রোগ- “ভাল্লাগে না”। ঔষধ জানা আছে। আমি হেসে বলি,
- বাছাধন! তোমারো সময় এসে গিয়েছে তবে। শীগগির প্রস্তুতি নেয়া শুরু কর। তোমার এ শূন্যতা পূর্নতা পাবার ব্যবস্থা করছি, দাড়াও!
মাথা চুলকিয়ে সাদাত বলল,
- ইয়ে মানে…কীসের প্রস্তুতি??
- ইয়ে না গো…ইয়ে না!!বিয়ে …বিয়েএএ। হুম, তোমার এই ভাল্লাগেনা অসুখের ঔষধ। তোমার চিরকুমার লাইব্রেরির একজন লাইব্রেরীয়ান দরকার যে! সারাজীবন তো বই পড়ে যে চারচোখা হয়েছো। এবার দুই হাত থেকে চার হাত করো।বয়স উপযুক্ত সময়!
ভাবলাম সে হাসবে লাজুক বরের হাসি। বোন বিয়ের কথা বলেছে বলে কথা। ওমা সে কী! চ্যালেঞ্জের সুরে বলল আমার মতো মানুষকে কোনো মেয়েই সহ্য করতে পারবে না, নো ওয়ে! দেখাবার সাথে সাথে বিদায় দিবে। আর যদি না দেয় তবে বিয়ের শর্ত একটাই তাকে আমার থেকে বেশি জ্ঞানী তবে তোর থেকে কম জ্ঞানী হতে হবে। বলে সে নির্লিপ্ত অনুভূতিহীন হয়ে চলে গেল ছাদ থেকে।
কি বররে!
হ্যালির ধুমকেতু দেখার মত আমি চমকে গিয়ে স্থির হয়ে দাড়িয়েই আছি। ও যে আমার থেকে কয়েক’শ গুণে জ্ঞানী এটা পাড়াশুদ্ধ সবাই জানে। স্বল্পভাষী সাদাতের ক্রেস্টের সারি সারি তাক তারই সাক্ষী। কিন্তু সাদাত কি এক অদ্ভুদ স্ট্যান্ডার্ড ঠিক করে দিল!! আমার থেকেও, অ্যা?
হঠাৎ মনে হল ওর এত্ত বড় সাহস আমাকে (বড় বোনকে) অপমান! বিয়ে করবে আবার গুগলি দিয়েছে। দাঁড়া…আমি!!
আমার সংকল্প এখন যেন একটাই হয়ে গেল সাদাতের বিয়ে! মেয়ের খোজ শুরু হলো। মা তো রাজি। মায়ের কথা গুণবতী বউ নিবেন, বাবা নিবেন কোমল মনের। বাবারে বাবা! খাসা বিপদ তো! এত শর্ত, যে করেই হোক সব শর্ত মিলিয়ে গুনবতী জ্ঞানবতী… পৃথিবীতে হাজার মেয়ে আছে। সাদাতের থেকে বেশি জ্ঞানী! আমার জ্ঞানের সাথে পরে মিলালেও চলবে।
৩.
যাক সব মিলে দুই এ দুই এ চার! মেয়ে পাওয়া গেল। বিয়ের দিন তারিখ সব ঠিক। অবশেষে বিয়ে করিয়ে গাড়িতে করে নতুন বউ নিয়ে ফিরছি আমরা সবাই, কাঁদছে নতুন বউ। রসকসহীন সাদাত তার বউয়ের দিক তাকিয়ে দেখল খালি। তারপর ফ্যানটা তার দিকে ঘুরিয়ে দিতেই আমার ছেলে বলল “মামা গলমে মামণি কান্না করে নাই তো,ফ্যান অদিকে দিসো কেন? গলম আমাতে লাগসে, বাতাস দেও” শুনে হোহো রোল পড়ে গেল গাড়িতে। ভাই আমার লজ্জায় চুপসে গেল। বিবাহিত জ্ঞানী মানুষজনদের রোমান্টিক হওয়া যে ভারী বিপদ দেখছি!
আজ বিয়ের প্রথম রাত সাদাতের। আর বড় বোন হিসেবে কিছু পরামর্শ দিলাম। বললাম মাথায় হাত রেখে দুয়া পড়বি, একসাথে দু’রাকাত নফল নামাজ পড়বি , বৈবাহিক জীবনের কমিটমেন্টগুলা ঠিক করে নিবি। সবশেষে বললাম,
- সাদাত, বিড়াল কিন্তু প্রথম রাতেই মারতে হয়।
-“বিড়াল??”সাদাত অবাক বিস্ময়ে জিজ্ঞেস করতেই বললাম,
-”শাদীর পহেলা রাতে মারিবে বিড়াল/না হলে বরবাদ সব তাবত পয়মাল।”
সাদাত বলল-“আহ! আপু এইটার মানে কী আবার?”
-এই যাহ! এত জ্ঞানী তুই এটার মানে জানিস না! এই তোর জ্ঞান সাদাত? ছেঃ ছেঃ..যা এখন তোর বউ তোর জ্ঞান বাড়াবে! তবে…
সাদাতকে রুমে ঠেলে দিয়ে বলি, “বিড়ালটা কিন্তু তোর বউয়ের কাছে! মারতে হবে তোকে” বলে কিছু কাজ মিটিয়ে মিটিমিটি হাসি হেসে আমি মায়ের বাড়ি থেকে বিদায় হলাম। সাদাত ‘এ্যা’ করল খালি।
৩.
পরেরদিন সকাল। বিপুল খোশমেজাজে নববিবাহিত ভাইকে ফোন দিতেই এমন ভাবে সালাম দিল আর বলল, আপুউউ…
যেন ও কৃষ্ণগহ্বরের মাঝে আমাকে খুজে পেল। বললাম,
- কীরে, বিড়াল মেরেছিস?
- ধুর!! শুন আপু তোকে খুব সিরিয়াস কথা বলব, হাসবি না একদম।
- না হাসব না বল এবার!(হাসতে হাসতে)
- উহু…আপু তুই তো আমাকে সেই ধাধা দিয়ে চলে গেলি। তারপর যা হল না! আমাকে বললি বিড়াল মারতে যেটা নাকি বউয়ের কাছে! কিছু বুঝি তো না-ইই! উল্টো টেনশন হতে শুরু করল। আমি রুমে ঢুকার আগে পণ করলাম যা হবে এই কোয়েশ্চেন এর সমাধান তো করেই ছাড়ব। বললাম মনু! ঘুঘু দেখেছো তোমরা…ঘুঘুর ফাদ দেখোনি! আমি সুপুরুষ ভাব নিয়ে রুমে ঢুকি। এদিক আমার ঘাম ছুটে যাচ্ছে হাত কাপছে। তো সালাম দিয়ে বউয়ের কপালে হাত রেখে দুয়া পড়ছি। আল্লা-হুম্মা ইন্নি আসআলুকা খাইরাহা ওয়া খাইরা মা জাবালতাহা ‘আলাইহি, ওয়া আ‘ঊযু বিকা মিন শাররিহা ওয়া শাররি….. এইটুক গিয়ে ভয়ে আমার কিছুতেই বাকিটুকু মনে পড়ে না তো পড়েই না, ওয়া শাররি ওয়া শাররি করেই যাচ্ছি…। বউ আমার এমন ভয় পাওয়া দেখে এমন হাসি দিল মুখ চেপে যে লজ্জায় আমি আর নাই! তারপর ওই আমাকে বাকিটুকু হাসতে হাসতে বলে দিল। পড়লাম। তো তারপর যাই করি গড়মিল হচ্ছিলই। কখনো আমি তোতলাচ্ছি কখনো হাটতে গিয়ে হোচট খাচ্ছি। এমন অবস্থায় দেখে বেচারি বউ বলে কী হয়েছে আপনার? এমন করছেন কেন? না পেরে হাউকাউ করে খুলে বললাম শুনো- আপু বলেছে “শাদীর পহেলা রাতে মারিবে বিড়াল/না হলে বরবাদ সব তাবত পয়মাল”-এটার মানে না বের করা পর্যন্ত শান্তি হচ্ছে না? জানো….
-আনান বিনতে আলম