সাম্প্রতিক প্রসঙ্গ

ক্ষমা আর ঘৃণা নিয়ে অনেক কথা চলছে, ব্যাপারটাকে একটু অন্য দৃষ্টিকোণ থেকে দেখি?

 

আচ্ছা যে লোকটা ৫০ জন মুসল্লীকে মেরে ফেলল তাকে কী আল্লাহ মাফ করবেন?

করতে পারেন। নজির আছে বানু ইসরাইলের এক লোক ৯৯টা খুন করেছিল। খেয়াল করুন – খুন কিন্তু – বান্দার হকের সাথে জড়িত।

এরপরে সেই খুনী গেল এক হুজুর টাইপের লোকের কাছে – সেই লোক হয়ত ইবাদাত করত কিন্তু দ্বীন জানত না। সে বলল, মাফ নাই। উত্তরদাতাকে খুন করে লোকটা সেঞ্চুরি করে ফেলল।

এরপরে সে গেল একজন আলিমের কাছে। আলিম বললেন, সব পাপেরই মাফ আছে যদি অনুতপ্ত হয়ে তাওবাহ করে আল্লাহর কাছে বান্দা ফিরে আসে। এরপরে আলিম সাহেব লোকটাকে উপদেশ দিলেন, তুমি যে এলাকায় থাক সেটা খারাপ। তুমি ওই গ্রামে ভালো মানুষদের কাছে যাও, তাদের সাথে থাক।
লোকটা অনুতপ্ত ছিল। রওনা দিল সে ওই গ্রামের দিকে। পথেই তার মৃত্যু হলো।
পাপী লোক – ভালো কাজ করেনি। আযাবের ফেরেশতারা আসলেন রুহ নিয়ে যাবে বলে।

রহমতের ফেরেশতারাও আসলেন – ওই যে তাওবাহ করেছে।
দেখা গেল সে মাঝ পথেই মারা গেছে। শেষে আল্লাহ জমীনকে বললেন তুমি লাশটাকে ওই ভালো গ্রামের দিকে একটু ঠেলে দাও। রহমতের ফেরেশতারাই নিয়ে গেল তার লাশ – আল্লাহই তাকে ক্ষমা করে দিলেন।

নিউজিল্যান্ডের এই খুনি যদি ইসলাম গ্রহণ করে, আল্লাহ তার অতীত সমস্ত গুণাহ মাফ করে দেবেন। সে হয়ত জেল থেকে মুক্তি পাবে না, কিন্তু সে জাহান্নাম থেকে বেঁচে যাবে।

এবং আমরা, এই মুসলিমরা তাকে ভাই হিসেবে গ্রহণ করে নেব।
ঘৃণা করব না।
ভালোবাসব।
যদিও সে আমাদেরই ৫০ জন ভাইবোনকে, শিশু সন্তানকে মাসজিদের মধ্যে খুন করেছে।

এই ভালোবাসাটা আসলে কী?

এটার নাম আল্লাহর জন্য ভালোবাসা। এই ভালোবাসার ভিত্তি ব্যক্তিগত কোনো কিছু নয়, শুধুমাত্র ইসলাম।

এই ভালোবাসাটা বোঝা জরুরি কারণ এই ভালোবাসার বিপরীতে আছে ঘৃণা। আমরা যেমন আল্লাহর জন্য ভালোবাসি, ঠিক তেমন আমাদের ঘৃণাটাও হতে হবে আল্লাহর ওয়াস্তে।

আমাদের ভালোবাসার মতো ঘৃণারও দুটো দিক আছে।

১/ যাদের প্রতি শুধুই ঘৃণা – কাফির, মুশরিক, নাস্তিক।
২/ যাদের প্রতি আপেক্ষিক ঘৃণা – যারা মুসলিম তারা আল্লাহর প্রতি ঈমানের কারণে ভালোবাসার দাবীদার। কিন্তু বিভিন্ন পাপে নিমজ্জিত থাকার কারণে পাপ অনুযায়ী তাদের প্রতি ঘৃণা।

ইসলামের স্কলাররা এই ভালোবাসা এবং ঘৃণাকে নাম দিয়েছেন “আল-ওয়ালা আল বারা”, অথবা “আল হুব্বু ফিল্লাহ ওয়াল বু’উদু ফিল্লাহ”।

এই ঘৃণার মৌলিক ভিত্তিটা কী?

এই ঘৃণার মূল কথা হচ্ছে পৃথিবীতে সবচেয়ে বড় অন্যায় ১০০টা খুন করা নয়, পৃথিবীতে সবচেয়ে বড় অন্যায় আল্লাহর সাথে শির্ক করা। এটা সবচেয়ে বড় যুলম। খুন করা নিঃসন্দেহে ভয়ংকর পাপ – কিন্তু এই সব পাপেরই শেষ আছে – কিন্তু আল্লাহর সাথে শির্ক করলে, কুফরি করলে – সেই পাপটার শেষ নেই। এই পাপ যে করবে তাকে কোনো মুসলিম ভালোবাসতে পারবে না।

এটাই ঈমানের দাবী। এবং এই জিনিসটা মানুষের কমন সেন্সে ঢুকবে না বলেই এই কথাগুলো আসমান থেকে ওয়াহি পাঠিয়ে বলা হয়েছে। নবী-রসূলদের এই কথাগুলো বলার জন্য আল্লাহ আযযা ওয়া জাল্লা মানুষের কাছে পাঠিয়েছেন।

এই ঘৃণা এবং এই ভালোবাসাটাকে অনেক মুসলিমরা বোঝে না।

যারা ছাড়াছাড়ির দিকে গেছে তারা বলে, “সবার ওপর মানুষ সত্য তাহার ওপর নাই” অথবা “মানব ধর্মই বড় ধর্ম” অথবা “যে কোনো একটা ধর্ম মানলেই চলবে – সব ধর্মই স্রষ্টার কাছে মানুষকে নেয়।”

এই তথাকথিত উদারপন্থা অনেককে ইসলামের বাইরে বের করে দেয়।
সব ধর্ম ঠিক হলে ইসলাম মিথ্যা কারণ ইসলামের মূল কথাই হচ্ছে “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ” – সমস্ত মাবুদ মিথ্যা, একমাত্র ইবাদাত পাওয়ার যোগ্য আল্লাহ।
যে আল্লাহর প্রতি ঈমান আনবে না, তার রসুলের উপরে আসা শরীয়াত অস্বীকার করবে – সে অনন্তকালের জন্য জাহান্নামী। সে আপাত দৃষ্টিতে দুনিয়াতে যত ভালো কাজই করুক না কেন।

আবার অন্যদিকে কিছু মানুষ বাড়াবাড়ির দিকে গেছে। যে ঘৃণা বা ভালোবাসা অন্তরে থাকার কথা সেটা তারা বাহ্যিক এমন কিছু কাজে নিয়ে এসেছে যা করার অনুমতি ইসলাম আমাদের দেয়নি। যেমন কোনো অমুসলিমের সম্পত্তি দখল করা, তাকে অত্যাচার করা, বোমা হামলা বা অন্যান্য সন্ত্রাসী হামলার মাধ্যমে যুদ্ধরত নয় এমন অমুসলিমদের নিহত করা।

ইসলামী আইন যেমন একজন মুসলিমকে নিরাপত্তা দেয় তেমন একজন অমুসলিমকেও দেয়। যদিও সেই অমুসলিম পৃথিবীর সবচেয়ে জঘন্য অপরাধ – শির্ক বা কুফরি করছে তাও তার বিরুদ্ধে আমরা খেয়াল-খুশি মতো ঘৃণার বহির্প্রকাশ দেখাতে পারব না।

আমাদের ঘৃণাটা তার শির্ক-কুফরির বিরুদ্ধে, সেই মানুষটা যখনই এই শির্ক-কুফরি ছেড়ে দেবে সাথে সাথে সে আমাদের ভাই হয়ে যাবে, তাকে আমরা ভালোবাসব। এই আমলটা অন্তরের আমল।

একজন অমুসলিমের প্রতি ঘৃণাটা যে আসলে আল্লাহর ওয়াস্তে তার প্রমাণ কী? তার প্রমাণ আমরা তাকে আমাদের প্রতিষ্ঠানে চাকরি দিই, তার কাছে আমরা পণ্য বিক্রি করি। তাকে আমরা বিভিন্ন কাজে সাহায্য করি, তার বিপদে এগিয়ে আসি। সে ক্ষুধার্ত থাকলে আমরা খাবার দিই, সে অসুস্থ হলে চিকিৎসা করি। শীতে তার কাপড় না থাকলে আমরা তাকে কম্বল দিই, বন্যায় তার ঘর পড়ে গেলে আমরা ঘর তৈরি করে দিই।

আমাদের ঘৃণাটার ধরণ এমন যে আমরা তার সর্বাঙ্গীন কল্যাণ চাই এবং তাই তাকে প্রতিনিয়ত ইসলামের দিকে ডাকি। কারণ, আল্লাহর দাসত্বে না এলে আখিরাতের অনন্ত জীবনে তাকে অনন্ত কালের জন্য আগুনে পুড়তে হবেই।

সেক্যুলার ঘৃণা কিন্তু এমন না। যারে দেখতে নারি তার সব কিছুই ভালো লাগে। সেখানে যাকে ঘৃণা করা হয় তার ক্ষতি চাওয়া হয়। কিন্তু আল্লাহর ওয়াস্তে ঘৃণাতে জড়িয়ে আছে কল্যাণকামনা।

যে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদের শিখিয়েছেন কাফিরদের ঘৃণা করার ব্যাপারে সেই তাকেই আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা কুরআনের আয়াতে কাফিরদের সত্য প্রত্যাখ্যানে কষ্ট পেতে বার বার নিষেধ করেছেন।

রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে শির্ক-কুফর এতই কষ্টের ব্যাপার ছিল যে মনে হতো তিনি কষ্ট পেতে পেতে নিঃশেষ হয়ে যাবেন। এই কষ্টটার উৎপত্তি দরদে। মানুষের প্রতি মানুষের সহমর্মিতায়। একজন অস্বীকারকারীর অবধারিতে পরিণতি জানার পরে চুপচাপ বসে থাকা কঠিন।

প্রতিটি মানুষ কাউকে না কাউকে ভালোবাসে। কাউকে না কাউকে ঘৃণা করে। ইসলাম দাবী করে এই ভালোবাসা এবং ঘৃণা ব্যক্তিস্বার্থ থেকে উঠিয়ে আল্লাহর জন্য করতে হবে।

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা যেন আমাদের তাঁর ওয়াস্তে ঘৃণা এবং তার জন্য ভালোবাসার তাওফিক আমাদের দেন।

-শরীফ আবু হায়াত অপু

মন্তব্য করুন

Back to top button