অর্থনীতি/ব্যবসা-বাণিজ্য

অর্থনীতিতে মুসলমানদের অবদানঃ একটি সংক্ষিপ্ত মূল্যায়ন

মানব সমাজের শুরু থেমেই অর্থনীতির প্রয়োগ ছিল অপরিহার্য । অর্থনীতির তাত্ত্বিক  উন্নয়নের আগেই এই বিষয়ের প্রয়োগ ছিল মানবসমাজে। পরবর্তীতে বিভিন্ন সভ্যতা এবং মনিষী এই শাস্ত্রের উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখেন।মুসলিমরা তাদের স্বর্নযুগে জ্ঞান বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখার মত এই শাখাতেও অনেক অবদান রাখেন। পাশ্চাত্যের দার্শনিকরা সব সময় জ্ঞান বিজ্ঞানে মুসলিমদের অবদান স্বীকার না করার চেষ্টা করেন। অর্থনীতি শাস্ত্রের  ক্ষেত্রে পাশ্চাত্যের এই প্রচারনা  একেবারেই অযৌক্তিক এবং মুসলমানদের ছোট করার প্রয়াস ছাড়া আর কিছু নয়।

পাশ্চাত্যের অর্থনীতিবিদরা অর্থনীতি শাস্ত্রের উন্নয়নের সময় ধরেন গ্রীস এবং রোমানদের সময় থেকে। তাদের মতে গ্রীস দার্শনিক এবং রোমান মনিষীরাই অর্থনীতির বিভিন্ন তত্ত্ব উদ্ভাবন শুরু করেন এবং পরবরতীতে ‘ইউরোপ’ তাকে ভিত্তি ধরে এই শাস্ত্রের উন্নয়ন সামনে এগিয়ে যায় । তবে গ্রীস ও রোমানদের সাথে ইউরোপ অর্থনীতি শাস্ত্রের এই যে যোগাযোগ তার মাঝামাঝি যে সময়টা তার  ব্যাপারে ইউরোপীয়রা কিছু বলতে চান না । অথচ এই সময়টা হচ্ছে মুসলিম মনিষীদের অর্থনীতি শাস্ত্রের উন্নয়নের সময় । মুসলিম মনিষীরা গ্রীস ও রোমানদের অর্থনৈতিক তত্ত্ব সংরক্ষণ,   বিশ্লেষণ ও উন্নয়ন করেন , যা পরবর্তীতে লাভ করেন ইউরোপিয়ানরা । অথচ পাশ্চাত্য বিশ্ব মুসলমানদের অর্থনীতি শাস্ত্রের উপর যে অবদান তার ব্যাপারে খুব বেশি কিছু বলতে চান না ।পাশ্চাত্য অর্থনীতিবিদ জোসেফ সুমপিটার ১৯৫৪ সালে প্রকাশিত History of Economic Analysis বইতে মুসলমানদের অর্থনীতিতে অবদানের সময়টাকে বলেছেন  The Great Gap  যা একটা নির্জলা মিথ্যা । বর্তমান বিশ্বের মুসলিমরা যদি এই কারনে হীনমন্যতায় ভোগেন তাহলে তা হবে তাদের জ্ঞানের স্বল্পতার কারনে। বক্ষ্যমান প্রবন্ধে অর্থনীতি শাস্ত্রে মুসলিম মনিষীদের অল্প িকছু অবদান নি্যে পর্যালোচনা করা হল। কারন এ বিষয়ে বিস্তািরত আলোচনা করতে একটি কিংবা দুটি কি্তাব নয় , বরংঅসংখ্য কি্তাব রচনা করতে হবে।

হানাফি মাযহাবের প্রতিষ্ঠাতা ইমাম আবু হানিফার শিষ্য ‘কাজী আবু ইউসুফ’ ছিলেন বাগদাদের প্রধান কাজী । তৎকালীন খলীফার অনুরোধে তিনি রচনা করেন ‘কি্তাব আল খারাজ’ যাতে তি্নি রাজস্ব সংগ্রহ , আয়ের ব্যবস্থাপনা এবং সরকারী ব্যয় নিয়ে আলোচনা করেন । আবু ইউসুফ ‘এডাম স্মিথ’ এর অনেক পূর্বে ‘ রাজস্ব আরোপের নীতি্মালা আলোচনা করেন । দেশের অর্থনৈতিক কি কি দায়িত্ব রয়েছে তা নিয়ে ও আলোচনা করেন ।

ইমাম গাজ্জালি্র সাধারন পরিচয় তি্নি একজন সুফি দাশনিক । কিন্তু অর্থনী্তি্ শাস্ত্রে  ইমাম গাজ্জালি্র অবদানের কথা হয়ত অনেকে জানেনা এমনকি মুসলমানরাও । গাজ্জালী্র লেখায় ইসলামি দেশের কল্যাণজনক আর্থিক ভূমিকা পরিষ্কার ভাবে বোঝা যায় । গাজ্জালী তার ‘এহইয়া উলুমুদ্দীন’ বইতে ক্লাসি্কাল অর্থনী্তিবি্দদের বহু পূর্বে ‘দেশের আর্থিকনি্রাপওা’ নী্তিমালা নিয়ে আলোচনা করেছেন ।  ইমাম গাজ্জালি্র মতে দেশের মানুষের জীবন, বুদ্দিমওা , সম্পত্তি ও সম্পদের নি্রাপত্তা দেবে সরকার ।

ইবনে খালদুন মুসলিম জাহানের একজন খ্যাতিমান সমাজ বিজ্ঞানি ,এবং অর্থনীতবিদ । তিনি তার বিভিন্ন লেখায় শ্রম বন্টন, মূল্য ,চাহিদা এবং  যোগান, ভোগ, সরকারের অর্থ সংস্থান এবং বানিজ্য চক্র নিয়ে আলোচনা করেন। ইবনে খালদুনের মতে অতিরিক্ত অপব্যয়ের কারনে একটি বিরাট সাম্রাজ্য ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। তিনি দেশের অর্থনীতিতে সরকারের হস্তক্ষেপ নিরুতসাহিত করেন এবং বাজারকে সুষম বণ্টনের উপায় হিসাবে উল্লেখ করেন। স্মিথ এর বহু পূর্বে তিনি শ্রমের বন্টনের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে আলোচনা করেন। AMERCAN  President Ronlad Regan  এর উপদেষ্টা এবং অর্থনীতিবিদ Arthur Lafferতার laffer curve ‘এর জন্য বিখ্যাত । কিন্তু মজার ব্যাপার হল ইবনে খালদুন কয়েক শত বছর পূর্বে এই CURVE এর ধারনা দিয়েছিলেন । এমনকি ArtherLafferও কোন সময় বলেননি যে তিনি Laffer Curve এর আবিষ্কর্তা   । বরং  Laffer নিজেই এর খ্যাতি দিয়েছেন ‘ইবনে খালাদুন কে’ ।

মুসলিম অর্থনীতিবিদরা পাশ্চাত্যের বহু পূর্বেই এক শিল্পের সাথে আরেক শিল্পের যোগসূত্র এবং পারস্পরিক নির্ভরশীলতা নিয়ে আলোচনা করেছিলেন । মুসলিম মনীষী ‘ আল শায়বাণী’ সর্বপ্রথম এ বিষয়ে নিয়ে আলোচনা করেন। পরবর্তীতে ‘ইমাম গাজ্জালী’ তা নিয়ে আর বিস্তারিত আলোচনা করেন।  গাজ্জালী লিখেছেন ‘চাষিরা শস্য উৎপাদন    করে , জাঁতাকলের মালিক শস্য পিষে ময়দা করা হয়, রুটি প্রস্তুতকারক সেই ময়দা দিয়ে রুটি তৈরি করেন। ‘ইমাম গাজ্জালী’ আর লিখেছিলেন ‘কামার চাষির চাষাবাদের যন্ত্রপাতী বানিয়ে দেয় , আবার ছুতোর কামারের যন্ত্রপাতী বানিয়ে দেয়। মুসলীম অর্থনীতিবিদদের এই সব কথায় পরিষ্কার ভাবে এক শিল্পের সাথে আরেক শিল্পের উপর পারস্পারিক নির্ভরশীলতা পরিষ্কার ভাবে বুঝা যায়।

শিল্পের পারস্পারীক  নির্ভরশীলতা পাশাপাশি অর্থনীতিতে সহযোগীতা এবং শ্রম বণ্টনের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে ও মুসলিম অর্থনীতিবিদরা অনেক আগেই আলোচনা করেছিলেণ। ‘ ইমাম গাজজালী’ বলেছেন “একটি সামান্য সূই ক্রেতার কাছে আসার আগে পঁচিশ জনের অবদান থাকে” । ইমাম গাজ্জালীর অন্তত সাতশত বছর পরে পাশ্চাত্যের অর্থনীতিবিদ Adam Smith একই রকম যুক্তি প্রদানের সময় ‘সুই কারখানার উদাহরন দিতেন’।

ইবনে খালাদুন ওঁ শ্রম বন্টনের সুবিধার কথা বহু পূর্বেই আলোচনা করেছিলেন । পাশ্চাত্যের অর্থনীতিবিদ ‘Spengler’ শ্রম বন্টনের ব্যাপারে ইবনে খালদুনের চিন্তা-ভাবনা সংক্ষেপে উপস্থাপন করেন ১৯৬৪ সালে। পাশ্চাত্যের পুঁজিবাদী অর্থনীতি যেখানে বিভিন্ন কূটকৌশল প্রয়োগের মাধ্যমে ক্রেতার কাছ থেকে যে কোন উপায় যত পারা যায় মুনাফা নিয়ে নেওয়ার চেষ্টা চালায় সেখানে মুসলিম অর্থনীতিবিদরা মুনাফা গ্রহনের ক্ষেত্রে ন্যায়পরায়ণ থাকতে আহ্বান জানান। ইবনে তাইমিয়া তার বিভিন্ন লেখায় অতিরিক্ত মুনাফা নেওয়ার সমালোচনা করেন।  যে ক্রেতা পণ্যের মূল্য সম্পর্কে ধারনা রাখে না  তার কাছ থেকে বেশী মুনাফা নেওয়া তিনি ইসলামের রীতিবিরুদ্ধ বলে মত দেন। বর্তমানে ‘Theory of rent’ এর জনক হিসেবে আমরা সবাই David Ricardo  কে জানি । অর্থাৎDavid Ricardo কয়েক শতক বছর পূর্বে ইবনে খালদুন স্পেনের উদাহরন টেনে ‘Theory of rent’ এর  অন্তর্নিহিত তত্ত্বের     ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন ।

‘কুদামা বীন জাফর’ খলীফা আল- মুতাসিম বিল্লাহর  সময় বাগদাদের অর্থসচিব ছিলেন । অর্থনীতিতে তার বেশ উল্লেখযোগ্য অবধান ছিল । আধুনিক অর্থনীতিবিদরা পণ্যের বিনিময়ে পণ্য ( Barter exchange এর যে সকল সমস্যার কথা বলেন তা তিনি সেই সময় ব্যাখ্যা করেছিলেন। ‘আল-গাজ্জালী – আল দীমাস্কী’ ও Barter trade এর সমস্যা ও টাকার মুদ্রার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে আলোচনা করেন।

অর্থনীতি শাস্ত্রের সাথে যারা পরিচিত তারা প্রায় সবাই Thomas Gresham এর দেওয়া Gresham’s law নিয়ে জানেন । Gresham’s law তে বলা হয় খারাপ টাকা ভাল টাকাকে কে বাজার থেকে বের করে দেয় । কিন্তু ইমাম ইবনে তাইমিয়া এবং আল মাকরিজী কয়েক শতাব্দী পূর্বেই মামলূক সুলতানদের সময়ে এই তত্ত্বের বিস্তারিত ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন ।

দুনিয়ার সকল ধর্মই এবং দর্শনে সুদের সমালোচনা করা হয়েছে। অধুনা পাশ্চাত্য অর্থনীতি গড়ে উঠেছে এই সুদের উপর ভিত্তি করে । ইসলাম ধর্মে সুদকে কঠোর ভাবে নিষেধ করা হয়। সুদ পুঁজিপতিদের শোষণ এবং অবিচারের একটি অন্যতম হাতিয়ার। মুসলিম অর্থনীতিবিদরা অনেক আগেই সমাজে সুদের খারাপ প্রভাব নিয়ে আলোচনা করেছেন  ।এদের মধ্যে ইবনে তাইমিয়া এবং আল-রাজীর নাম বিশেষ ভাবে উল্লেখ করার মত। সুদকে যৌক্তিক করার জন্য ‘ Time value of money’ র যে যুক্তি পুঁজিবাদী অর্থনীতিবিদরা দেন তা ইসলামে অগ্রহণযোগ্য। শুধু টাকার বিনিময়ে টাকা নয়, বেশ কিছু পণ্যের বিনিময়ে পণ্য গ্রহণেও ইসলাম বাধা দেয় এবং সুদ বলে অভিহিত করেন। মুসলিম অর্থনীতিবিদরা এ ধরনের বিনিময় নিষেধ হওয়ার কারন সেই মধ্যযুগেই বর্ণনা করেন।

ইসলামের ইতিহাসে আমরা দেখতে পাই আল-হিসবা নামক বিশেষ দপ্তরের ভূমিকা। সংক্ষেপে আল-হিসবা ছিল একটি অফিস যার মাধ্যমে অর্থনৈতিক কার্যকলাপ এবং নীতি নৈতিকতা পর্যবেক্ষণ করা হয়। অনেক মুসলিম অর্থনীতিবিদরাই আল-হিসবার দায়িত্ব এবং কর্তব্য নিয়ে বলেছেন। আল-হিসবার দায়িত্বে থাকা ‘মুহতাসিবের’ কি কি কাজ তা নিয়ে তারা দিক-নির্দেশনা দিয়েছিলেন।এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য মনীষীরা হলেন আল-শায়বানি, ইবনে বাসাম, ইমাম ইবনে তাইমিয়া, আল-উকবানী, ইবনে আব্দুন, ইবনে আবদ আল রউফ এবং আল- সাকাতি। আল হিসবার কার্যকলাপে এবং মুসলিম অর্থনীতিবিদদের দেওয়া এই দিক নির্দেশনা থেকে এখনকার সময়েও অনেক কিছু অনুসরণ করা হয়।

গ্রীস এবং রোমান সমাজেও ‘বাজার দেখা-শুনার’ জন্য বিশেষ অফিসার নিয়োগ দেওয়া হত। এই সকল অফিসগুলোকে বলা হত agoronomos. অনেক ইউরপীয়ান পণ্ডিত দাবি করেন যে এই agoronomos থেকেই মুসলমানরা ‘আল-হিসবার’ ধারনা নিয়েছিল। কিন্তু এই দাবি একেবারেই ভুল।‘আল- মাওয়ারদি’ পবিত্র কুরআনেই ‘আল- হিসবার’ যে ধারনা তার অস্তিত্ব দেখিয়েছেন।

“এবং তোমাদের মধ্যে এরূপ এক সম্প্রদায় থাকা দরকার যারা কল্যাণেরদিকে আহবান করে এবং সৎ কাজে আদেশ করে ও অসৎ  কাজে নিষেধ করে, আর তারাই সুফল প্রাপ্ত হবে। (সূরা আলে-ইমরান, আয়াত-১০৪)।

‘আল-মাওয়ারদি বলেন পবিত্র কুরানের এই আয়াতেই ‘আল-হিসবার’ ধারনা পাওয়া যায়। ইবনে তাইমিয়াও বলেন যে রাসুলুল্লাহ (সঃ) এবং খুলাফায়ে রাশিদিনের আমলে ও ‘বাজার পর্যবেক্ষন ও তদন্তের’ প্রমান পাওয়া যায়।

বক্ষ্যমান প্রবন্ধে মুসলিম অর্থনীতি বিদ দের কিছু অবদান অতি সংক্ষেপে তুলে ধরা হল। বর্তমান পৃথিবী পাশ্চাত্যের পুজিবাদী অর্থনীতির নির্যাতনে আজ জর্জরিত  । ভোগবাদী এই অর্থনৈতিক দর্শন অনেক রাষ্ট্রকে এবং তার সাথে তার জনসাধারণকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে ঠেলে দিচ্ছে। এই অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় ধনী তার ধনসম্পদ বাড়িয়ে চলেছে আর দরিদ্রের অবস্থা অপরিবর্তিত থাকছে, এমনকি অনেক জায়গায় দরিদ্র আরও দরিদ্র হচ্ছে। দুনিয়ার মানুষ পুঁজিবাদী অর্থনীতি থেকে বাচতে আশ্রয় খুঁজেছিল সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতিতে । কিন্তু সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি একটি জেলখানা ছাড়া আর কিছু নয়। এই অর্থনীতি মানুষের স্বাভাবিক প্রকৃতি বিরুদ্ধ আর তাই তা আজ বিলুপ্ত হওয়ার পথে। মানুষের কল্যান নিশ্চিত করতে হলে এখন ইসলামি অর্থনীতির বাস্তবায়ন ছাড়া আর দ্বিতীয় কোন উপায় নেই।

 

লেখক: মাহামুদুল হাসান
বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ও গবেষক
[email protected]

ইসলামিক ইমেইল নিউজলেটার
নতুন পোস্ট প্রকাশিত হলে সরাসরি আপনার ই-মেইল ইনবক্সে পেতে সাবস্ক্রাইব করুন।
icon

মন্তব্য করুন

Back to top button