বোধোদয় হোক আমাদের
সম্প্রতিই শেষ হ’ল বাংলাদেশের একাদশ জাতীয় নির্বাচন। একটি দল সেখানে নিরংকুশ বিজয় লাভ করল, আর হেরে গেল অপর দলগুলি। একদলের মতে, এতে জিতেছে জনগণ, উন্নয়ন এবং স্থিতিশীলতা। অপর দলের মতে, এতে জয় হয়েছে যুলুম-অন্যায়, অসততা আর প্রহসনের। কোন ভাষ্যটি নৈতিক দিক দিয়ে সঠিক বা বেঠিক সে প্রসঙ্গে আমরা যাব না। বিষয়টি সকলেরই কম-বেশী বোধগম্য। আমরা কেবল সেই দিকটি অবলোকন করতে চাই যে, নির্বাচন এবং নির্বাচন-পরবর্তী সময়ে দেশের ইসলামী ঘরানায় গণতন্ত্রকেন্দ্রিক ধ্যান-ধারণার স্বরূপটি কী দেখা গেল এবং এর আলোকে আমাদের ভবিষ্যৎ সিদ্ধান্ত ও গন্তব্য কী হওয়া উচিৎ।
আমরা আগেই জানি গণতন্ত্রের ধারণা বিস্তৃতিলাভের পর থেকে সকল দেশেই ইসলামী ঘরানার মধ্যে গণতন্ত্র নিয়ে একটা টানাপোড়েন আছে, যেমনটি ছিল সমাজতন্ত্রের বিকাশকালে। একসময় ‘ইসলামী সমাজতন্ত্র’ নিয়ে ব্যাপক চিন্তা-গবেষণা শুরু হ’লেও সমাজতন্ত্রের অস্তিত্ব হারানোর সাথে সাথে তার বিদায় ঘটেছে। তারপর থেকে শুরু হয়েছে ‘ইসলামী গণতন্ত্র’ নিয়ে একইরূপ আলোচনা। একদল বিষয়টি চিন্তা ও দর্শনগত দিক থেকে দেখা শুরু করলেন তো অপরদল সেটিকে ব্যবহারিক দিক থেকে একনায়কতন্ত্র বিরোধী ব্যবস্থা হিসাবে দেখতে লাগলেন। এভাবেই ইসলামপন্থীদের মধ্যে সুস্পষ্ট দু’টি ধারা তৈরী হ’ল। যাদের একদল গণতন্ত্রের ঘোর বিরোধী, অপরদল ঘোরতর না হ’লেও জোরালো সমর্থক।
যারা গণতন্ত্র বিরোধী তারা সুস্পষ্টভাবে গণতন্ত্রকে ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক ব্যবস্থা হিসাবে দেখেন। কেননা গণতন্ত্রের নৈতিক ভিত্তি হ’ল ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ, যা সুনির্দিষ্ট কোন ধর্ম বা আদর্শের সাবভৌমত্বকে স্বীকৃতি দেয় না। জনগণের স্বাধীন ইচ্ছাই সেখানে সবকিছু। অপরদিকে ইসলাম নিরংকুশ তাওহীদবাদী ধর্ম হিসাবে এক আল্লাহর সার্বভৌমত্বকামী। ফলে উভয়ের মধ্যে সংঘর্ষ অবশ্যম্ভাবী। আবার যারা গণতন্ত্রকে সমর্থন করেন, তারা মূলতঃ গণতন্ত্রকে আদর্শবাদী জায়গা থেকে না দেখে একনায়কতন্ত্রবিরোধী ব্যবস্থা হিসাবে দেখেন। এদের কেউবা ‘ইসলামী গণতন্ত্র’ নামে একটি নয়া প্রকল্প উপস্থাপন করেন। তারা মনে করেন একক রাজার শাসনের বিপরীতে জনগণের মতামতভিত্তিক শাসনব্যবস্থাই হ’ল গণতন্ত্র, যা ভোট বা নির্বাচনের মাধ্যমে অনূদিত হয়। এই দৃষ্টিভঙ্গিগত পার্থক্য থেকেই প্রধানতঃ গণতন্ত্র সম্পর্কে ইসলামপন্থীদের দ্বিধাবিভক্তির জন্ম।
এ কথা সুবিদিত যে, আধুনিক পৃথিবীতে মোটাদাগে মূলতঃ দুই ধারার রাষ্ট্রপরিচালনা নীতি দেখা যায়। একটি একনায়কতন্ত্র, অপরটি গণতন্ত্র। পৃথিবীর শুরুকাল থেকেই একনায়কতন্ত্র তথা রাজতন্ত্র বা স্বৈরতন্ত্রই রাষ্ট্র পরিচালনা করে এসেছে। আর গণতন্ত্র তথা জনগণের মতামতভিত্তিক রাষ্ট্র পরিচালনা ব্যবস্থা আধুনিক যুগের আবিষ্কার। এখন উক্ত দু’টি রাষ্ট্রপরিচালনা ব্যবস্থাকে সামনে রেখে যদি ইসলামের আলোকে বিশ্লেষণ করতে চাই তবে প্রথমতঃ আমরা লক্ষ্য করব যে, একটি রাষ্ট্রে শাসক কেমন চরিত্রের হবেন এবং কিভাবে ও কোন নীতিতে রাষ্ট্র পরিচালনা করবেন, সে বিষয়ে ইসলাম বিস্তারিত দিক-নির্দেশনা দিয়েছে। যেমন ইসলাম বলেছে নেতৃত্ব চেয়ে নেয়া যাবে না এবং নেতৃত্বের লোভ করা যাবে না। বলেছে আদল ও ইনছাফের কথা, শান্তি ও ন্যায়বিচারের কথা। বলেছে যুলুম ও অবিচার হ’তে বিরত থাকার কথা। সর্বোপরি একটি সমাজকে ইসলামের আলোকে কিভাবে পূর্ণাঙ্গভাবে ঢেলে সাজাতে হবে সে বিষয়ে সুস্পষ্ট দিক-নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
কিন্তু একজন শাসক ঠিক কোন পদ্ধতিতে নির্বাচিত হবে এমন সুনির্দিষ্ট রূপরেখা ইসলাম নির্ধারণ করে দেয় নি। যেমন রাসূল (ছাঃ) যখন মারা গেলেন, তখন তিনি কাউকে পরবর্তী শাসক হিসাবে নির্ধারণ করে যাননি, যদিও ইঙ্গিত প্রদান করেছিলেন। আবূ বকর (রাঃ) সরাসরি তাঁর পরবর্তী উত্তরসূরীর নাম ঘোষণা করে গিয়েছেন। আবার উমার (রাঃ) নেতৃত্ব নির্বাচনের জন্য একটি কমিটি গঠন করেছিলেন। পরবর্তী দুই খলীফা ওছমান (রাঃ) ও আলী (রাঃ) তো আকস্মিকভাবে নিহত হওয়ার কারণে এ বিষয়ে কোন নির্দেশনা দেওয়ারই সুযোগ পাননি। পরবর্তীকালে উমাইয়া শাসকরাও বিভিন্ন উপায়ে নেতৃত্ব নির্বাচন করেন। সুতরাং এ কথা বলা যায় যে, ইসলাম শাসক নির্বাচনের বিষয়টিকে মুসলিম উম্মাহর ইজতিহাদের উপর ছেড়ে দিয়েছে। এর ভিত্তিতে পরবর্তী মুসলিম বিদ্বানগণ যেমন ইমাম মাওয়ার্দী (৪৫০হি.), ইমাম আল-জুওয়াইনী (মৃ. ৪৭৮হি.), ইমাম নববী (মৃ. ৬৭৬হি.) প্রমুখ ‘আহলুল হাল্লি ওয়াল আক্বদ’ তথা পরামর্শ পরিষদ (আধুনিক পরিভাষায় নির্বাচন কমিশন) গঠনের কথা বলেছেন, যে পরিষদ উপস্থিত জনগণের মধ্য থেকে দ্বীনদারী ও সক্ষমতার ভিত্তিতে সর্বাধিক যোগ্য ব্যক্তিকে নেতৃত্বের জন্য বেছে নেবেন। আর নিঃসন্দেহে এটিই সর্বোত্তম নির্বাচন ব্যবস্থা। তবে মোদ্দাকথা হ’ল, যে কোন ন্যায়ানুগ উপায়ে শাসক নির্বাচিত হোক না কেন, ইসলামের মূল বিবেচ্য বিষয় হ’ল শাসক কেমন হবে এবং কিভাবে রাষ্ট্র চালাবে। আর এজন্য নির্ধারণ করে দিয়েছে রাষ্ট্র পরিচালনার সুনির্দিষ্ট মূলনীতিসমূহ। ফলে কোন মুসলিম শাসক যেভাবেই নির্বাচিত হোক না কেন, তাকে অবশ্যই ইসলামী আইনের প্রতি বিশ্বাসী হ’তে হবে এবং ইসলামী বিধি-বিধান মোতাবেক সমাজ ও রাষ্ট্র পরিচালনা করতে হবে- এটাই ইসলামের দাবী।
এখন প্রশ্ন হ’ল, প্রচলিত এই দুই ধারার নেতৃত্ব নির্বাচন ব্যবস্থার মধ্যে একনায়কতন্ত্রের ব্যাপারে মুসলিম বিদ্বানগণ তেমন আপত্তি না তুললেও তাঁদের অধিকাংশই কেন প্রায় একবাক্যে গণতন্ত্রকে নাকচ করেন? এর কারণ হ’ল, গণতন্ত্র নিছক একটি নেতৃত্ব নির্বাচন ব্যবস্থা নয়, বরং এটি একটি মতবাদ বা আদর্শের নাম। শুধু তাই নয়, গণতন্ত্র আল্লাহর সার্বভৌমত্বের পরিবর্তে মানবীয় সার্বভৌমত্বকে যেভাবে সর্বেসর্বা ঘোষণা করে এবং যেভাবে মানবীয় স্বেচ্ছাচারিতাকে নিরংকুশ প্রাধান্য দেয়, তা নিঃসন্দেহে কুফরীর পর্যায়ভুক্ত। কেননা তাতে আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসের কোন স্থান নেই। স্থান নেই কোন শাশ্বত বিধানের। ধর্ম সেখানে কেবলমাত্র মানুষের ব্যক্তিগত বিষয়। ফলে গণতন্ত্র ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীদের কাছে এক পরম পুজনীয় ধর্ম। এ কারণেই কথায় কথায় তারা ডেমোক্র্যাটিক ভ্যালুজের কথা বলে। আর এর বিপরীতে একনায়কতন্ত্র কেবলই একটি একচ্ছত্র কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থা। এটি কোন আদর্শ বা মতবাদের নাম নয়। এজন্য গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের কথা জোরেশোরে প্রচারিত হ’লেও কোথাও একনায়কতান্ত্রিক মূল্যবোধ বলে কিছু দেখা যায় না। আবার গণতন্ত্রে অধিকাংশের রায় চূড়ান্ত হওয়ায় এতে ব্যক্তিবিশেষের মত গুরুত্ব পায় না, তা যতই সত্য ও মূল্যবান হোক না কেন। কিন্তু একনায়কতন্ত্র বা রাজতন্ত্রে শাসকের হাতে এই ক্ষমতা থাকে এবং তিনি চাইলে নিজস্ব ক্ষমতাবলে ইসলামী আইন বাস্তবায়ন করতেও পারেন। ফলে শাসক আল্লাহভিরু হ’লে তার মাধ্যমে পুরোপুরি ইসলামী শাসনব্যবস্থা কায়েম হ’তে পারে। কিন্তু গণতন্ত্রের মাধ্যমে তা কখনই সম্ভব নয়। এমনকি শাসক ও জনগণ চাইলেও না। কেননা আদর্শ ও চরিত্রগতভাবে গণতন্ত্র সম্পূর্ণ ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী এবং বস্ত্তবাদী। ফলে জনগণের এমন কিছু চাওয়ারই অধিকার নেই যা গণতান্ত্রিক আদর্শের সাথে খাপ খায় না।
ফলে যারা নিজেদের তাওহীদবাদী মুসলিম বলে দাবী করেন এবং ইসলামী জীবন-বিধান অনুযায়ী নিজের সমগ্র জীবনকে ঢেলে সাজাতে চান, যারা ইহকালীন ও পরকালীন জীবনে সার্বিক কল্যাণের প্রত্যাশী; তাদের জন্য গণতন্ত্র নিছক আল্লাহদ্রোহী, আত্মপুজারী ও প্রতারণাপূর্ণ জীবনব্যবস্থা। সূদভিত্তিক পুঁজিবাদী অর্থনীতির মত তার বহিরাঙ্গ যতই সুশোভিত হোক না কেন, ইসলামের সাথে তা কখনই একীভূত করা যায় না। আর এজন্যই গণতন্ত্রকে আদর্শিকভাবে সমর্থনের তো প্রশ্নই আসে না, এমনকি যদি সাদা চোখে নেতৃত্ব নির্বাচন ব্যবস্থা হিসাবেও ধরা হয়, তবুও তা গ্রহণযোগ্য মনে করার সুযোগ নেই। কেননা তাতে রয়েছে বাতিল ও জাহেলিয়াতের সাথে নিরেট আপোষকামিতা। রয়েছে ইসলামবিরোধী আদর্শ ও সংস্কৃতির কাছে বেশরম আত্মসমার্পণ। কোন আল্লাহভীরু ও সৎ মানুষের পক্ষে এই নির্বাচনের পথে হাঁটা সম্ভব নয়। আর যেহেতু ইসলামে নেতৃত্ব চেয়ে নেয়ার সুযোগ নেই, সেহেতু এ পথ ইসলামের পথই নয়। অতএব এই গোটা ব্যবস্থাপনার সাথে কোন নিষ্ঠাবান ঈমানদার ব্যক্তি সম্পর্ক রাখতে পারে না।
বাংলাদেশের সাম্প্রতিক নির্বাচন আমাদেরকে আবারও এই রূঢ় বাস্তবতাকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছে। সচেতন সমাজে কিছুটা হ’লেও বোধোদয় হয়েছে যে, গণতন্ত্র সাধারণ জনগণকে ক্ষমতার মোহে ভুলানো এক পুজিবাদী প্রতারণা বৈ কিছুই নয়, যাতে রয়েছে শুভংকরের ফাঁকি। এই পথ ধরে কখনই ইসলামের রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠাদান সম্ভব নয়। আহলেহাদীছ ওলামায়ে কেরাম এ বিষয়ে জাতিকে বহু আগে থেকেই সতর্ক করে আসছেন। অনেক ইসলামপন্থী ‘মন্দের ভালো’ নামে এক আপোষকামী নীতি প্রচারের চেষ্টা করেছিলেন, যার অসারতা ইতিমধ্যেই প্রমাণিত হয়েছে। নীতি-আদর্শের প্রশ্নে হক্ব ও বাতিলের সাথে কখনও আপোষ হয় না, আপোষ করা যায় না। সুতরাং আমরা আশা রাখি, যুবসমাজের একটা বিরাট অংশ যারা এ বছর ভোটার হয়েছিলেন তারা বিষয়টি গভীরভাবে চিন্তা করবেন। সর্বোপরি নবী-রাসূলদের দেখানো পদ্ধতি তথা সর্বাত্মক সমাজ সংস্কারের আন্দোলন ব্যতিরিকে ইসলামী খেলাফত প্রতিষ্ঠার ভিন্ন কোন পন্থা নেই এবং ভাড়াটে বা আমদানীকৃত কোন তন্ত্র-মন্ত্র ইসলামের কোনই উপকারে আসতে পারে না- এই জ্বলন্ত সত্যটি অনুধাবনের সময় আমাদের এখনই। আল্লাহ আমাদের তাওফীক দান করুন। আমীন।
– আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব
(সম্পাদকীয়, তাওহীদের ডাক)