সাম্প্রতিক প্রসঙ্গ

রাষ্ট্রহীন করা হচ্ছে ৪০ লাখ মানুষকে

ভারতের আসাম রাজ্যে ৪০ লাখ অধিবাসীর ঘাড়ে প্রত্যাশিত আতঙ্কের পাহাড় চেপে বসেছে। সম্প্রতি রাজ্য সরকারের তৈরী করা চূড়ান্ত জাতীয় নাগরিক তালিকায় (এনআরসি) তাঁদের নাম ওঠেনি। জনস্বার্থসংশ্লি­ষ্ট একটি মামলার প্রেক্ষাপটে ভারতের সুপ্রিম কোর্টের দেওয়া আদেশে এই এনআরসি হালনাগাদ করা হয়েছে। যাঁরা অনিবন্ধিত রয়ে গেছেন, এই তালিকা শুধু তাঁদের নিয়েই অনিশ্চয়তা তৈরী করেনি; এনআরসি নিয়ে কেন্দ্র ও কয়েকটি রাজ্যের নেতৃস্থানীয় বিরোধী দলও বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে। সংশি­ষ্ট কর্তৃপক্ষ বারবার বলেছে, একজন প্রকৃত ভারতীয় নাগরিকও যাতে তাঁর নাগরিকত্ব নিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত না হন, গৃহীত ট্রাইব্যুনাল ও আইনি প্রক্রিয়ায় সে নিশ্চয়তা রয়েছে। কিন্তু এই বক্তব্য-বিবৃতি আতঙ্ক তেমন একটা কমাতে পারেনি। আসামের পর ইতিমধ্যে ওডিশা আর ঝাড়খন্ড থেকেও এনআরসি করার ঘোষণা এসেছে।

প্রাথমিক পর্যায়ে কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন বিজেপি সরকার এ নিয়ে তেমন উদ্বেগ দেখায়নি। তারা তাদের উদ্বিগ্ন প্রতিবেশীসহ অন্যদের বিশ্বাস করাতে চেয়েছে, এনআরসি প্রক্রিয়া সর্বোচ্চ আদালত ও আসাম রাজ্যের বিষয়। গত ৩০শে জুলাই কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিং সংসদকে আশ্বস্ত করেন, এ খসড়া তালিকা প্রস্তুত করার ক্ষেত্রে কেন্দ্র কোন ভূমিকা রাখেনি। এর এক দিন পরই বিজেপির সভাপতি অমিত শাহ সদর্পে বললেন, ‘এটি বাস্তবায়নের সাহস আপনাদের নেই, আমাদের আছে।’ বিরোধী কংগ্রেসকে উদ্দেশ্য করে তিনি আরও বলেন, ‘বাংলাদেশী অভিবাসীদের তাড়িয়ে দেওয়ার সাহস আপনাদের নেই’।

এনআরসির চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশের পর প্রতারণার ছদ্মাবরণ আরও খুলে যেতে শুরু করে। ১০ই সেপ্টেম্বর বিজেপির প্রভাবশালী সাধারণ সম্পাদক রাম মাধব জোর গলায় বলেন, অবৈধ অভিবাসীদের ‘শনাক্ত করা, বাদ দেওয়া ও দেশে ফেরত পাঠানোর’ (ডিটেক্ট, ডিলিট অ্যান্ড ডিপোর্টেশন) নীতি অ্যাজেন্ডায় রয়েছে। তিনি গুরুত্ব দিয়ে বলেন, এটি তাঁর দলের ‘বিবেচনায় নেওয়া এক সিদ্ধান্ত’। ১১ই সেপ্টেম্বর জয়পুরে দলটির এক সমাবেশে অমিত শাহ দাবী করেন, ৪০ লাখ ‘বাংলাদেশী অনুপ্রবেশকারীর’ তালিকা তৈরি করা হয়েছে। তিনি ঘোষণা করেন, ‘বিজেপি একজন বাংলাদেশী অনুপ্রবেশকারীকেও ছাড় না দেওয়ার অঙ্গীকার করেছে। আমরা তাদের সবাইকে বের করে দেব’। অমিত শাহ তাঁর এই অন্যায্য অ্যাজেন্ডার পক্ষে সমর্থন বাড়ানোর লক্ষ্যে জাতীয় নিরাপত্তাজনিত উদ্বেগ তুলে ধরেন এবং দিল্লি, আহমেদাবাদ ও মুম্বাইয়ে সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের জন্য ‘অনুপ্রবেশকারীদের’ দায়ী করেন। ‘অবৈধ অনুপ্রবেশকারীদের পক্ষে দাঁড়ানোর’ জন্য বিরোধীদের অভিযুক্তও করেন। বিজেপির দলীয় প্রধানের বক্তব্যেরই প্রতিধ্বনি তুলে তেলেঙ্গানার এমএলএ রাজা সিং বলেন, ‘রোহিঙ্গা ও বাংলাদেশী অবৈধ অভিবাসীরা সসম্মানে দেশ না ছাড়লে তাঁদের গুলি করে নির্মূল করা হবে’। সহিংসতায় উসকানি দেওয়ার জন্য তাঁর বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

ভারতের রাজনৈতিক নেতাদের বাংলাদেশের বিপক্ষে এই অবস্থান বোধগম্য নয়। দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে চমৎকার সম্পর্ক গড়ে তোলার ক্ষেত্রে ভারতীয় নেতারা বারবারই বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের অবদান জোর গলায় বলে এসেছেন। এ নিয়ে বিতর্কের কোন সুযোগ নেই যে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল নিয়ে দেশটির কেন্দ্রীয় সরকারের বড় ধরনের নিরাপত্তা উদ্বেগ কমানো, ঐ অঞ্চলের উন্নয়ন এবং সেখানে কেন্দ্রের কর্তৃত্ব বাড়ানোর পেছনে বাংলাদেশের সক্রিয় তৎপরতা সহায়তা করেছে। মাত্র কিছুদিন আগেও বাংলাদেশ ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সাতটি রাজ্যে পণ্যপরিবহনে দিল্লিকে চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দর ব্যবহার করার অনুমতি দিয়েছে। এ ইঙ্গিত করা অযথার্থ হবে না যে এমন শুভেচ্ছার যথাযথ জবাব বাংলাদেশ পায়নি। বরং বলা যায়, তিস্তা নদীর পানিবণ্টন সমস্যার এখনো সুরাহা হয়নি, বাংলাদেশী পণ্যের রপ্তানীতে অন্যায্য বাধাগুলো রয়ে গেছে, সীমান্তেও হত্যা চলছে। আর কয়েক মাসের মধ্যে যখন বাংলাদেশে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হ’তে যাচ্ছে, ঠিক তখনই কী কারণে ভারত সরকার এমন একটি স্পর্শকাতর বিষয়ে উৎসাহী হয়ে উঠল, তা ভেবে বিস্মিত হ’তে হয়।

এ রকম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে বাংলাদেশের নীরবতায় দেশের মানুষ বিরক্ত। ভারতের কর্মকান্ডে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ অত্যন্ত নীরব। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তার ব্যাখ্যায় বলেছে, এনআরসি তাদের রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও যেন সে ব্যাখ্যাই মেনে নিয়েছে। বড় প্রতিবেশী দেশের এমন দাবীর বিরুদ্ধে মানুষ সুনির্দিষ্ট অবস্থান দেখতে চায়। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় যদি এ নিশ্চয়তা দেয় যে, আসামের নির্বাসিত বাসিন্দাদের বাংলাদেশে পাঠানো হবে না, তাহ’লে আপামর জনসাধারণের কাছে তাদের সে বার্তা পৌঁছে দেওয়ার দায় রয়েছে। কয়েক দশক ধরে আরাকানের ভীতিকর ঘটনা নিয়ে পররাষ্ট্র বিভাগের দীর্ঘদিন ধরে বালুতে মাথা গোঁজা উটপাখির মতো আচরণের কারণে এ মুহূর্তে জাতিকে বড় খেসারত দিতে হচ্ছে। আসাম বিষয়ে একই ভুলের পুনরাবৃত্তি হঠকারী হবে।

ভারতের শীর্ষ রাজনৈতিক নেতৃত্ব থেকে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় যেভাবে বাংলাদেশবিরোধী বিবৃতি দেওয়া হচ্ছে এবং এনআরসিকে কেন্দ্র করে ঘটনাপ্রবাহ যে গতিতে এগিয়ে চলেছে, তাতে বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন দলের শীর্ষস্থানীয় নেতা ও বিরোধী দলের কাছ থেকে ভারতের সাম্প্রতিকতম কর্মকান্ডের ব্যাপারে দৃঢ় অবস্থান নেওয়ার সময় এসেছে। ভারতের রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এ নীতির বিরুদ্ধে দ্বিপক্ষীয় জোরালো কূটনৈতিক প্রচেষ্টা চালানোরও এখন সময়। এই নীতি সীমান্তের উভয় পাশের সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলতে পারে।

এ ব্যাপারে সন্দেহের অবকাশ খুবই কম যে, এনআরসি বিষয়টি বাঙালী জনগোষ্ঠীর ওপর হিন্দু জাতীয়তাবাদী ও কট্টরপন্থী আসামবাসীদের এক দ্বিমুখী আক্রমণ, যেখানে মুসলমানদের সংখ্যা বেশ উল্লেখযোগ্য। আসামে মুসলমানেরা তৃতীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ। ভারতশাসিত কাশ্মীরের পর তা একে দ্বিতীয় জনবহুল মুসলিম রাজ্যে পরিণত করেছে।

এনআরসি প্রকল্পের বাস্তবায়নে বিতর্ক জড়িয়ে আছে। এনআরসি বাস্তবায়নের কর্তৃত্ব নিয়ে নিরপেক্ষতা ও গ্রহণযোগ্যতার প্রশ্ন উঠেছে। কারণ নিবন্ধন প্রক্রিয়ার মাঝামাঝি নতুন নতুন আইন যুক্ত করে প্রক্রিয়াটিকে করে তোলা হয়েছে আরও জটিল। এতে আবেদনকারীদের দাবী প্রতিষ্ঠায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়েছে। পর্যবেক্ষকেরা বলছেন, আপিল প্রক্রিয়া নিষ্পত্তিতে কয়েক দশক না হ’লেও বছরের পর বছর লেগে যেতে পারে।

এই আচরণের প্রবক্তারা তাঁদের সাম্প্রদায়িক মনোভাব পরিষ্কার করেছেন। কেন্দ্রীয় বিজেপি সরকার আশ্বস্ত করেছে, যাঁরা হিন্দুধর্মীয় বিশ্বাসের অনুসারী, এনআরসিতে নাম না থাকলেও তাঁদের চিন্তার কারণ নেই। অমিত শাহ স্পষ্টভাবে বলেছেন, ‘নাগরিকত্ব (সংশোধন) বিল ২০১৬’ আফগানিস্তান, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ থেকে আসা হিন্দু, শিখ, জৈন, বৌদ্ধ এবং অন্যদের নাগরিকত্ব (ভারতের) নিশ্চিত করবে। তাই এনআরসি প্রয়োগের প্রধান নিশানা যে মুসলমানেরা তা নিয়ে সন্দেহ নেই।

ভারতের এনআরসি আর পাকিস্তানের নতুন প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের ঘোষণা পাশাপাশি রাখলে বিষয়টি বেশ মজার দেখায়। পাকিস্তানের ইমরান খান ঘোষণা করেছেন, পাকিস্তানে বসবাসকারী আড়াই লাখ অনিবন্ধিত বাংলাদেশী ও ১৪ লাখ আফগানকে পাকিস্তানের নাগরিকত্ব দেওয়ার বিষয়টি বিবেচনা করা হবে। বিশ্ব যখন রাষ্ট্রহীনতার পরিস্থিতি দূর করতে মিলিতভাবে কাজ করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, তখন আসামে এনআরসি প্রয়োগ এ শতাব্দীর সবচেয়ে বড় রাষ্ট্রহীন জনগোষ্ঠীর জন্ম দিতে পারে। কোন যুক্তি বা আইনে বাংলাদেশ আসাম থেকে পাঠানো মানুষদের গ্রহণ করতে বাধ্য নয়। কেননা তাঁদের মর্যাদা নির্ধারণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ কোন পক্ষ নয়। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দায়িত্বশীল সদস্য দেশ হিসাবে ভারত নিশ্চিতভাবে জানে, আন্তর্জাতিক আইনের বেশ কিছু বিধিবিধানে গণ-বহিষ্কার নিষিদ্ধ।

ইসলামিক ইমেইল নিউজলেটার
নতুন পোস্ট প্রকাশিত হলে সরাসরি আপনার ই-মেইল ইনবক্সে পেতে সাবস্ক্রাইব করুন।
icon

মন্তব্য করুন

আরও দেখুন
Close
Back to top button