পাওয়া না পাওয়ার গল্প
আজ সুপ্তির বিয়ের সাত বছর পূর্ণ হলো। ওদের দু’জনেরই দিনটির কথা মনে আছে, কিন্তু কেউই এ ব্যাপারে সকাল থেকে কোন উচ্চবাচ্য করছে না। হাসান সকালে উঠেই গম্ভীর মুখে পেপার পড়তে পড়তে নাস্তা খেয়ে অফিসে চলে গেলো। সুপ্তিও ওর পাশে বসে নিঃশব্দে খেয়ে নিলো।
ও অফিসে যাবার পর, আরো একটি একাকী দিন শুরু হলো। তাদের শান্ত নিস্তব্ধ বিশাল বাড়িটি যেন আরো ঝিমিয়ে পড়লো। সুপ্তি জানে, আজো রাত করে বাড়ি ফিরবে হাসান, অন্য দিনের মতোই অনাদরে কেটে যাবে দিনটি। যদিও তারা আজকাল বিবাহ বার্ষিকী পালন করে না। তবুও দিনটির কথা ভুলে থাকাও সম্ভব নয়।
কারন এই দিনের আরো একটি অর্থ আছে তাদের কাছে। বছর ঘুরে এ তারিখটি এলে, আরো তীব্র ভাবে মনে পড়ে যায় যে ব্যার্থতার আরো একটি বছর পূর্ণ হলো!! সবাই যখন জিজ্ঞেস করে, তোমাদের বিয়ের কতো গুলো বছর গেলো, কিন্তু এখনো তোমাদের………..
থাক..আর ভাবতে ইচ্ছে হয় না সুপ্তির। দু’হাত দিয়ে মাথা চেপে বসে পড়ে।
আজকাল মাঝে মাঝে মনে হয়, বোধহয় পাগল হয়ে যাচ্ছে সে। পৃথিবীর সব কিছুই অসহ্য লাগে। কারো কোন আনন্দ তাকে স্পর্শ করে না। তার পুরো পৃথিবী জুড়ে যেন নীল বেদনার ছায়া।
অথচ কয়েক বছর আগেও সব অন্যরকম ছিলো। নিজেদের প্রথম বিবাহ বার্ষিকীর কথা মনে পড়লো ওর। প্রথম দু এক বছর বেশ ঘটা করে দিনটি পালন করতো তারা। সেবার অফিসের কাজে এক সপ্তাহের জন্য বিদেশ গিয়েছিলো হাসান। সুপ্তি ওকে সারপ্রাইজ দেবার জন্য দীর্ঘ প্লেন জার্নি করে পৌঁছে গিয়েছিলো ভূমধ্যসাগর তীরের সেই ছোট্ট শহরটিতে।
ইটালিয়ান এক রেস্টুরেন্টে প্রচুর চীযের টপিং দেয়া বিশাল এক পিতযা মারগারিটা খেয়েছিলো ডিনারে। অত:পর ভরা পূর্নিমায় অর্ধরাত্রি পর্যন্ত হেঁটেছিলো সাগরের বালুকাবেলায়। বিচের পাশের বিশাল পাথুরে চাঁই এর ওপর বসে, হাতে হাতে রেখে বিস্তীর্ণ আকাশের নিচে হাজারো তারার মেলায় যেন হারিয়ে গিয়েছিলো দু’জনে।
সে রাতে হ্যাট পড়া বুড়ো ফুল ওয়ালার কাছ থেকে টকটকে লাল গোলাপ কিনে দিয়েছিলো হাসান। ডায়েরির ভাঁজে এখনো গোলাপটি রেখে দিয়েছে সুপ্তি। শুকিয়ে ম্লান হয়ে যাওয়া গোলাপের পাপড়ির দিকে তাকালে মনে হয়, তাদের ভালোবাসাও কি দিনে দিনে এমনি করে শুকিয়ে বিদীর্ণ হয়ে যাচ্ছে! হাসান কি তাকে এখনো আগের মতো ভালবাসে, নাকি সব কিছুর জন্য তাকে দায়ী মনে করে!
চোখ ফেটে কান্না আসে সুপ্তির। আজকাল প্রায়ই এমন হয়। সারাদিন ঘর অন্ধকার করে দরজা বন্ধ করে কাঁদে ও। রান্নাবান্না ঘরের কাজ কিছুই করতে ইচ্ছে করে না। এমনো দিন যায়, হাসান অফিস থেকে এসে দেখে ঘরে কোন রান্না হয় নি। কিন্তু সে কখনোই কোন কিছুতে রাগ করে না। নির্বিবাদে বাইরে থেকে খাবার নিয়ে আসে।
ওর এই নির্বিকার ভাব দেখে আরো রাগ ওঠে সুপ্তির। হাসানের কি কিছুতেই কিছু যায় আসে না, না কি ওর প্রতি অবহেলা আর করুনা বশত এই ভাবলেশহীন ব্যবহার করে!!
দরজা বন্ধ করে শোবার ঘরে খাটের এক কোনায় বসে পড়ে ও, পর্দা টেনে দেয়, সূর্যের আলো সহ্য হচ্ছে না। এরপর হাঁটু গেড়ে বসে কান্নায় ভেংগে পড়ে।
****************
জরুরী মিটিং না থাকলে হাসান আজ অফিসে আসতো না। আজ সারাদিন তার সুপ্তিকে নিয়ে ঘুরতে ইচ্ছে হচ্ছে, বিয়ের পরের সেই প্রথম দিনগুলোর মতো করে। কি হাশিখুশি মেয়ে ছিলো ওর বউটি। সারাদিন কথার ফুলঝুরিতে চারদিক মাতিয়ে রাখতো।
ছোট বাচ্চাদের সাথে খুব জমতো ওর। বাচ্চা খুব ভালোবাসতো। কিন্তু এই একটি জিনিস এর অভাব, তাদের প্রচণ্ড সুখী জীবনে, উচ্ছল বউটির সকল উচ্ছলতায় যেন কালো মেঘে ঢেকে দিলো।
হাসানের ইচ্ছে করে পৃথিবীর সকল সুখ এনে প্রিয়তমার পায়ের কাছে রেখে দিতে। আগে বিবাহবার্ষিকী ভুলে গেলে, অভিমানে তুলকালাম কাণ্ড করতো সুপ্তি। আর এখন এই দিন সমাগত হলেই হাসানের আতংক বাড়তে থাকে। কারন এ সময় অন্য দিনের চেয়েও যেন বেশি ডিপ্রেসড হয়ে পড়ে সুপ্তি।
একেকটা বছর যায়, আর সুপ্তির মনে হতে থাকে, না পাওয়ার আরো একটি বছর শেষ হলো। সন্তানহীন আরো বারোটা মাস গেলো! দিনে দিনে কেমন ডিপ্রেশনে চলে যাচ্ছে সে।
সাইকলজিস্ট ইকবাল আংকেলের সাথে কথা বলেছে হাসান। উনি বলেছেন সুপ্তিকে আনন্দে রাখতে। একা কম রাখতে।
হাসান তার পিএস কে দিয়ে আজ বিকেল চারটার কক্সবাজারের দুটো প্লেনের টিকেট করতে বলে। সুপ্তি সাগর ভালোবাসে, সাগর দেখলে ছেলেমানুষের মতো উচ্ছসিত হয়ে ওঠে। হাসান মিটিং শেষে সকাল সকাল বাসায় চলে আসে, সাথে নিয়ে আসে টকটকে রক্ত লাল সাতটি গোলাপ।
************
বেলা এগারটায় কলিং বেলের শব্দে চমকে ওঠে সুপ্তি। সকাল থেকে কাঁদতে কাঁদতে চোখ মুখ ফুলিয়ে ফেলেছে। মুখ ধুয়ে, গায়ে ওড়না পেঁচিয়ে দৌড়ে যায় দরজা খুলতে।
হাসান এক গুচ্ছ লাল গোলাপ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, গোলাপ গুলো ওর হাতে দিয়ে কানের কাছে ফিসফিস করে বললো,
“আমি কি আমার বউকে ফেরত পেতে পারি? আমার সেই কাজল পড়া লাজরাংগা সদা হাস্যময়ী বউটিকে?
আমার বেগম কি জানেন, তাকে এই অধম কতটা ভালোবাসে, আর বেগমের সহচর্যে এই ছন্নছাড়ার জীবন কতটা পূর্ন হয়েছে!”
সুপ্তি আস্তে করে দরজা ছেড়ে দিয়ে ঘরে ঢুকে পড়ে, হাসান পেছন পেছন এসে ওর হাত ধরে বলে, “সুপ্তি প্লিয বসো, তোমার সাথে জরুরী কথা ছিলো।”
ক্লান্ত স্বরে সুপ্তি জবাব দেয়, “আমার কিছু শুনতে ইচ্ছে হচ্ছে না, তাড়াতাড়ি বাসায় এসেছো কেন? কিছু ফেলে গেছো?
“সুপ্তি আজ তোমাকে শুনতেই হবে, তোমার কোন অধিকার নেই আমার জীবন…… আমাদের জীবন এভাবে ধ্বংস করে দেবার!”
এবার সুপ্তি থমকে দাঁড়ায়। কঠিন স্বরে বলে, “শেষ পর্যন্ত স্বীকার করলে তাহলে, যে আমি তোমার জীবন ধ্বংস করে দিচ্ছি, আমি একজন ব্যার্থ নারী!”
হাসান অধৈর্য হয়ে বলে উঠলো, “উফ, তুমি কেন বোঝ না, তোমাকে নিয়ে আমি কতো সুখী! পৃথিবীতে সবার সব কিছু থাকে না, আর কোন নির্দিষ্ট বস্তু না পাওয়ার অর্থ এই নয় যে, জীবন ওর জন্য থেমে যাবে। কিংবা কখনোই তোমার দোয়া কবুল হবে না!! আর তোমার তো কোন দোষ নেই, আমাদের ভাগ্য তো আমরা লিখি নি!! যা হচ্ছে, এর মাঝেও নিশ্চয় কোন কল্যান নিহিত আছে, যা আমরা এখন বুঝতে পারছি না। ”
সুপ্তির চোখ দিয়ে বড় বড় ফোঁটায় পানি পড়তে লাগলো, তবু চুপচাপ শুনতে লাগলো হাসানের কথা –
“এই দুনিয়াতে যতক্ষণ বেঁচে থাকবো সবাইকেই কিছু পরীক্ষা দিতে হবে। কোন না কোন না পাওয়া থাকবে। আবার না পাওয়ার ভীড়ে অনেক প্রাপ্তিও থাকবে।
যেমন আমরা দু’জন একসাথে আছি, একে অপরকে সম্মান করি, ভালোবাসি, এসব কি অনেক বড় পাওয়া নয়! কত জনের জীবনে তো এগুলোও নেই। আমাদের কি উচিত নয়, যা আছে তার জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা!
এমন যদি হয় আমি বা তুমি কোন একজন, অপরের জীবন থেকে হারিয়ে গেলাম, তখন কি মনে হবে না, এই সময়গুলো অনেক ভালো ছিল! ”
এবার সুপ্তি লাফ দিয়ে উঠে হাসানের মুখ চেপে ধরলো, “ছি: কি বলো এসব!”
“শোন, যে কৃতজ্ঞ হয় আল্লাহ্ তাকে আরো বাড়িয়ে দেন। আমি চাই এখন থেকে আমরা যা পেয়েছি, তা নিয়ে কৃতজ্ঞ থাকবো। আমাদের সম্পর্কের হেফাযতের জন্য দোয়া করবো আর অপেক্ষা করবো, আমাদের ভাগ্যেও আল্লাহ্ নিশ্চয় উত্তম কিছু দেবেন, সুন্দরতম ধৈর্যের বিনিময়ে। ”
সুপ্তি আস্তে করে বললো, “সবই বুঝি, কিন্তু মন যে মানে না!”
“মন কে মানাতে হবে, এটাই আমাদের পরীক্ষা। যাও, উঠে পড়ো, মুখ হাত ধোও আর রেডি হয়ে এসো। আজ থেকে আমি আমার পুরোনো বউটিকে ফিরে পেতে চাই ও পুরোনো বউ এর সাথে নতুন করে জীবন শুরু করতে চাই।”
********
আধা ঘণ্টা পর…..
ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে আছে সুপ্তি। পরনে হালকা আকাশী নীল জামদানী। অনেক দিন পর চোখ ভরে কাজল দিলো ও। আজ কেন যেন ওর খুব ইচ্ছে হচ্ছে ঝুম বৃষ্টির মাঝে সাগর পাড়ে হাঁটতে। ইশ! হাসান কি জানে, তার বউ সাগরের কাছে যেতে ভীষণ ভালোবাসে??