রূপপুর পারমাণবিক প্রকল্পের জন্য চেরনোবিল দুর্ঘটনার বার্তা
১৯৮৬ সালের ২৬শে এপ্রিল যখন চেরনোবিল পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে বিস্ফোরণ ঘটে, তার দুই যুগেরও বেশী আগে মানুষ পৌঁছে গিয়েছিল মহাশূন্যে। বিজ্ঞানচর্চার মাধ্যমে পৃথিবী এগিয়েছে, এগিয়ে যাবে। কিন্তু বিজ্ঞান যখন চর্চার বদলে অন্ধ বিশ্বাসে পরিণত হয়, তখনই ঘটে যত বিপদ। সত্তর আর আশির দশকে বিজ্ঞানে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের অহমিকায় অন্ধ হয়ে যাওয়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া কেউই এই বিপদ থেকে রেহাই পায়নি। ১৯৭৯ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে থ্রি মাইল আইল্যান্ড পারমাণবিক দুর্ঘটনার মাধ্যমে বেজেছিল সাবধান হয়ে যাওয়ার ঘণ্টা। কিন্তু সে সময়ে নীতিনির্ধারকেরা তা কানে তোলেননি। যার মূল্য গুনতে হয়েছে ১৯৮৬ সালের ২৬শে এপ্রিল ইউক্রেনে চেরনোবিল পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে বিস্ফোরণের ঘটনার মাধ্যমে। ৩২ বছর পেরিয়ে গেলেও চেরনোবিল শহর এখনো বসবাসের অনুপযুক্ত। বিকলাঙ্গ শিশুর জন্ম আর ক্যানসারে মৃত্যু এখনো সেখানে নিয়মিত ঘটনা। তেজস্ক্রিয় বিকিরণ ছড়িয়ে পড়া রাশিয়া, বেলারুশ আর ইউক্রেনের কয়েক লাখ হেক্টর জমি আজও ফলনের জন্য অনুপযুক্ত।
চেরনোবিল দুর্ঘটনার পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের বিশাল কর্মযজ্ঞ স্তিমিত হয়ে পড়ে। আর ২০১১ সালে জাপানে ফুকুশিমা দুর্ঘটনার পর জার্মানী ২০২২ সালের মধ্যেই চালু থাকা সব পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ করে দেওয়ার ঘোষণা দেয়। পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় ইউরেনিয়ামের সবচেয়ে বেশী পরিমাণ মজুদের মালিক অস্ট্রেলিয়া কোন পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ না করার নীতি গ্রহণ করেছে। অতিরিক্ত খরচ আর নিরাপত্তাহীনতার কারণে উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহারে দক্ষ দেশগুলো যখন পারমাণবিক বিদ্যুৎকে বিদায় জানাচ্ছে, তখন ঠিক কি কারণে বাংলাদেশ রূপপুরে ২ হাযার ৪০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণকাজ শুরু করল, তা পরিষ্কার নয়।
রূপপুর প্রকল্পের কাজ শুরুর আগেই নির্মাণ ব্যয় ৩২ হাযার কোটি টাকা থেকে বেড়ে ১ লাখ কোটি টাকায় পৌঁছে গেছে। লাগামছাড়া খরচ আর নির্মাণের দীর্ঘসূত্রিতায় শেষ পর্যন্ত এই প্রকল্পের মোট ব্যয় কোথায় গিয়ে ঠেকবে, তা কেউ জানে না। রূপপুর প্রকল্পের নিরাপত্তার ব্যাপারে যদি এতটাই নিশ্চিত হওয়া যায়, তবে ঠিক কি কারণে ভবিষ্যৎ যেকোন দুর্ঘটনার জন্য প্রকল্প-সংশ্লিষ্ট সবাইকে দায়মুক্তি দিয়ে আইন পাস করে রাখা হয়েছে, সেটাও একটা যরূরী প্রশ্ন। অন্যদিকে এই বিদ্যুৎ উৎপাদনের সময় যে তেজস্ক্রিয় বর্জ্য তৈরি হয়, বলা হচ্ছে রাশিয়া নাকি এই বর্জ্য ফেরত নেবে। অথচ রাশিয়ার আইন অনুসারে অন্য দেশের তেজস্ক্রিয় বর্জ্য সেখানে স্থায়ীভাবে সংরক্ষণ অসম্ভব।
প্রযুক্তির আধুনিকায়নে অন্যান্য বিদ্যুৎ উৎপাদনী ব্যবস্থায় খরচ কমে। যেমন ২০১০ সালের তুলনায় প্রতি ইউনিট সৌর বিদ্যুতের দাম সাত বছরের ব্যবধানে কমে গেছে শতকরা ৭২ ভাগ। অথচ পারমাণবিক বিদ্যুতের ক্ষেত্রে প্রতিনিয়ত নিত্যনতুন নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা যুক্ত হ’তে থাকায় খরচ কেবলই বাড়ে। এ কারণেই ২০০৭ সালে নির্মাণকাজ শুরু হওয়া ১ হাযার ৬০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার ফ্রান্সের ফ্লামেনভিলে বিদ্যুৎকেন্দ্রের নির্মাণ খরচ ফুকুশিমা দুর্ঘটনার পর তিন গুণ বেড়েছে, কিন্তু নির্মাণকাজ এখনো শেষ হয়নি। কাজেই চেরনোবিলসহ প্রতিটি পারমাণবিক দুর্ঘটনা সবার জন্য সতর্কবার্তা।
[আমরা আগেও বলেছি, আজও সরকারকে দেশের জন্য এই মরণফাঁদ তৈরীর প্রকল্প বন্ধ করার আহবান জানাচ্ছি (স.স. – আত-তাহরীক)]