ছোটগল্প/উপন্যাস

গুড ফর হার থিং

১.
আমরা সবাই হোমো সেপিয়েন্স প্রজাতির হলেও, একেকজন আমরা একেকরকম। যদি আমি তারিকের কথা বলি ও হাসাতে হাসাতে মানুষও খুন করতে পারে আবার মুনীর কিন্তু একেবারে ভিন্ন। এমনকি তারিকও ওকে হাসাতে পারে না অন্যদের সে আর কী হাসাবে! তবু মুনীরের রাজনৈতিক বিশ্লেষণ এত চমৎকার যে এমনকি তারিকও তখন হাসির কথা ভুলে মন দিয়ে ওর কথা শোনে। এই যে মানুষে মানুষে আমাদের এত ভিন্নতা এর পেছনেও বহু কারণ আছে। একেকজনের ভিন্ন ভিন্ন পরিবেশে বড় হওয়া, পিয়ার প্রেশার আর বাবা মার ব্যাক্তিত্বের প্রভাবও থাকে সন্তানদের ওপর। এতসব ভিন্নতা মানে অনেক অনেক ভিন্ন চিন্তা আর মতামত। তবুও আমরা মিলেমিশে থাকি। মানুষ তো সামাজিক প্রাণি।
.
নিজের কথা বললে গুণ তেমন খুঁজে পাই না, কিন্তু মানুষের অন্তর্নিহিত শক্তিগুলো ভালোই ধরতে পারি। এটাকে গুণ বলা যায় না বোধহয়, তবু এইখানেই আমি নবীজীর কোন একটা স্বভাবের অনুসারী হবার সুখানুভূতিটা পাই।
.
প্রতি বছরই তারিকরা ছোটখাট ঘরোয়া পিকনিকের আয়োজন করে, আর আমার ডাক পড়ে পিকনিকের কালচারাল আয়োজনটা পরিচালনা করতে। আমি সবসময়ই থাকি। কারণ ঐ প্রোগ্রামে এত এত ভিন্ন ভিন্ন বয়েসী ছেলেমেয়েরা অংশগ্রহণ করে যা মোটামুটি একটা ট্যালেন্টদের মিলনমেলা!
.
সকাল ৯ টা। তারিক আমাকে নিয়ে গেলো ওদের বাড়ির ওপর তলায়, যেখানে আমরা যারা যারা প্রোগ্রাম করবে তাদের প্রস্তুত করাব। তারিক সবাইকে নিয়ে এল আর একে একে সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিল। ওরা মোটামুটি ১০ জনের মত। সবার চেয়ে বয়সে যে বড় সে ক্লাস সেভেনে পড়ে, বেশ চটপটে ছেলে। আর সবার ছোট ক্লাস ওয়ানে পড়ে। পরিচিতি শেষ হলে তারিক বলে যেতে লাগলো কে কোন কাজে পারদর্শী। আর তারিকের বলার ভংগীতে আমি সহ পিচ্চিরা হেসে এক জন আরেকজনের ওপর গড়িয়ে পড়ছিল।
.
-এই যে, এই দাদার নাম হল সাকিব। দেখলে মনে হয় যে ভাজা মাছ ও বোধ হয় উল্টে খেতে জানে না; এই ছেলে গত বছর সাংবাদিক চরিত্রে অভিনয় করেছিল। নাটকের আগে কোন দাড়ি-গোঁফ ছিল না, নাটক শুরু হবার পর দেখি স্টেজে দাড়ি-গোঁফ লাগিয়ে এই বান্দা দাঁড়িয়ে আছেন।
.
এভাবে একের পর এক সবাইকে নিয়ে বেশ মজা করে কথা বলছিল তারিক। এত হাসির মাঝে আমি একজনকে খুঁজে পেলাম মুনীরের মত। পিচ্চি মেয়েটা পড়ে ক্লাস থ্রি তে। একদম চুপচাপ এক কোণে দাঁড়িয়ে আছে, মাঝে মাঝে একটু একটু হাসছে।
.
-আর এই আপাটি হলেন মিস চুপচাপ। মানে কথা বলে টুকটাক। ইনি খুব ইমোশনালও। তাই ইনাকে ঘাটাবি না। বলে তারিক অন্য কাজগুলো দেখতে চলে গেলো।

২.
নবীজী ﷺ প্রতিটা মানুষের ভেতরকার দক্ষতাগুলো খুব সহজে চিহ্নিত করতে পারতেন। তিনি সবার নামই শুধু জানতেন না তাদের গুণ-দোষ সহ চিনতেন এবং তাদের সঙ্গে যখন কথা বলতেন তখন এই জ্ঞান ব্যাবহার করতেন। তাই তিনি আবু যার (রদিয়াল্লাহু আনহু) কে রাগান্বিত না হবার উপদেশ দিয়েছিলেন আর হাসান (রদিয়াল্লাহু আনহু) কে বলেছিলেন পদ্য বানাতে। অর্থাৎ তিনি সবার পজিটিভ এবং নেগেটিভ বিষয়গুলো জানতেন এবং সেভাবেই তাদের সাথে মিশতেন।
এই বিষয়গুলোই আমি তারিকের বাড়ির পিচ্চিগুলোর ক্ষেত্রে ভাবছিলাম। ওদের আমি ভালোভাবে চিনি না, ওদের ভেতরকার স্বভাবগুলোও আমি জানি না। কিভাবে এগুবো আমি?
.
আমি সবাইকে আলাদা আলাদাভাবে ডাকলাম, তাদের সাথে তাদের মত হয়েই মেশার চেষ্টা করলাম। শুধু এটা জানতে যে এদের ভেতরে কেমন মানুষ বাস করে।
যা দেখলাম, তা হল আমার যা একটা গুণ ছিল তাও হুমকির মুখে পড়ে গেল।
.
তবু কারো কারো সাথে কথা বলে বুঝেছি, ওরা খুব কনফিডেন্ট। যেকোন কিছুই করতে দেওয়া হোক না কেন, নাটক, কবিতা আবৃত্তি, উপস্থাপনা তারা খুব ভালোই পারবে। ঝামেলায় পড়লাম মিস চুপচাপকে নিয়ে। তাকে যখন বললাম তোমাকে মুসলিমদের সাথে মুসলিমদের সম্পর্ক নিয়ে কিছুক্ষণ কথা বলতে হবে, ও খুব খুশী খুশী রাজি হয়ে গেল। কারণ আমি ওকে নাটকে অংশগ্রহণ করতে বলি নি। আর নাটক সে মরে গেলেও করবে না। অথচ নাটকে ওকে বেশ মানাত। সবাই নিজের মত করে প্রস্তুতি নিচ্ছিল। মিস চুপচাপ বারান্দায় দাঁড়িয়ে রিহার্স করছিল ওর বক্তব্য। আমি বেশ আগ্রহ নিয়ে শুনছিলাম, পরিষ্কার ও স্পষ্ট শব্দে ও বলছিল, “মুসলিম হিসেবে আরেক জন মুসলিম আমাদের কাছে অনেকগুলি অধিকার রাখে। যেমন, সালাম দেওয়া, দাওয়াত গ্রহণ করা…”
.
বুঝলাম স্কুলে অনেক কিছুই শিখেছেন ছোট আপা। কিন্তু বিপত্তি বাঁধে যখন ও সবার সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলতে যায়। বাচ্চাদের কমন শত্রু, নার্ভাসনেস। এখন অল্প ক’দিনে ওর এই সমস্যা দূর করা আমার জন্য দুঃসাধ্য ছিল। দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলাম। কী করা যায় ভাবতে লাগলাম। ওদিকে আরেকজন পিচ্চি ছিলেন যিনি হেভি লেভেলের নাটক তো করতে পারেন কিন্তু বেশ কদিন ধরে তার গলা বসা। সেই যে গলা বসল এখনও উঠে দাঁড়ানোর নাম নেই। এমতাবস্থায় মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেল। মিস চুপচাপকে আমি এমন কাজে দিলাম যা আমাদের নিরস নাটককে প্রাণবন্ত করে দিয়েছিল।
৩.
দর্শকদের মধ্যে ছিল পিকনিকে অংশ নেওয়া পরিবারগুলো, আমি আর তারিক। নাটক এর পর্দা ফেলা হল। বিশিষ্ট অভিনেত্রী যার অভিনয়ের কথা একটু আগেই বলেছিলাম তিনি আর আমাদের সাকিব স্টেজে। ওরা দুজন ভাই-বোনের চরিত্রে অভিনয় করবে।
.
সাকিব ছোট বোনকে ঈদের দিন বেড়াতে নিয়ে যাচ্ছে না। ওদিকে ছোট বোন বায়না ধরেছে। কিন্তু সাকিব ওরফে বড় ভাই কোনভাবেই রাজি হচ্ছে না। ঠিক সেসময় ছোট বোন তার এ-কে-৪৭ বের করল। মানে সত্যি সত্যি না কথার এ-কে-৪৭। “মুসলিম হিসেবে আরেক জন মুসলিম আমাদের কাছে অনেকগুলি অধিকার রাখে। যেমন, সালাম দেওয়া, দাওয়াত গ্রহণ করা…” নেপথ্য কণ্ঠে চমৎকার কাজ করছে মিস চুপচাপ। ও কথা বলছে আর সাকিবের ছোট বোন চমৎকারভাবে ঠোঁট নাড়িয়ে যাচ্ছে। মিস চুপচাপ বলে চলল, “আমি একজন মুসলিম। সুতরাং এটা আমার অধিকার যে তুমি আমাকে বেড়াতে নিয়ে যাবে…”। এই যুক্তি শুনে দর্শকদের কেউ কেউ হেসে দিল। পর্দার পেছনে ও কতটা সাবলীলভাবে কথা বলছে দেখে অবাক হচ্ছিলাম। মিস চুপচাপের অনুরোধে পর্দার পেছনেও আমরা কেউ ছিলাম না। একজন থাকেলও ও নার্ভাস হয়ে যায়। তবু আমি লক্ষ্য রাখছিলাম।
.
শেষমেশ সুন্দরভাবে নাটক শেষ হল। সবাই শুধু নাটকেরই প্রশংসা করল না বরং নেপথ্যে কণ্ঠের চমৎকার উপস্থাপনারও প্রশংসাও করল। আর এসব আইডিয়ার জন্য আমিও কিছুটা বাহবা পেলাম। সমস্যা ছিল, আমরা কেউ গুড ফর নাথিং না। আমরা সবাই গুড ফর সে জিনিসটার জন্য যেটা আমরা ভালো পারি। যেমন মিস চুপচাপ পারে সুন্দর করে বক্তব্য দিতে তবে পর্দার পেছন থেকে।
.
এই সাহসটা আমি কিভাবে করেছিলাম! যদি নবীজী ১৭ বছর বয়েসী একজন যুবকের হাতে সেনাপতির দায়িত্ব দিতে পারেন, কারণ তিনি তার ভেতরের দক্ষতাটাকে চিনতেন, তবে আমি কেন তাঁর মত চৌকস হব না! সবাই চলে যাওয়ার পর মিস চুপচাপ চুপিচুপি এসে আমাকে জড়িয়ে ধরল, অনেকদিন পর কারও এমন মমতা পেয়ে মনে হল আমিও একেবারে গুড ফর নাথিং না!
“গুড ফর হার থিং”
– ইফাত মান্নান
#ঘুড়ি_Ghuri

১টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

Back to top button