ছোটগল্প/উপন্যাস

তালহা’র সাওম রাখা

আজকে তালহা প্রথমবারের মত সাওম রাখছে। কারণ তালহা এখন যথেষ্ট বড় হয়েছে। বড় হওয়া মানে কী আসলে? লম্বা হওয়া? নাকি দাঁড়ি গোঁফ হওয়া? আসিফ তো লম্বা না,দাঁড়ি-গোঁফও হয় নি,তবু ও গতবার সবকটা সাওম রেখেছে।তাই তালহাও এবার সবকটা সাওম রাখবে।
আসিফ ভয় লাগায় তালহাকে, সাওম রাখা এত সহজ না।পানি খেতে পারবি না,কফ-থুথু গিলতে পারবি না,চিপস অথবা বিস্কুট খাওয়ার কথাতো বাদই দিলাম।বলে আসিফ তালহার দিকে তাকায়,ভয় পেয়েছে মনে হয়। কিরে তালহা, ভয় পেলি নাকি? আসিফ বুঝিয়ে দিতে চায় ও তালহার চেয়ে বড়,বয়সেও অভিজ্ঞতায়ও।
তালহা পেটুক না।খাওয়া দাওয়া জিনিসটা অতটা আকর্ষণীয় মনে হয় না ওর কাছে। আম্মা তো বেশ জোর করেই ওকে খেতে বসায়।ওর একমাত্র প্রিয় খাবার পুডিং,খুব প্রিয়। রমাদান মাসে সেটা না হয় একটু কমই খেল,ইফতারের পর তো খেতে সমস্যা নেই। কিন্তু কফ-থুথু! এটা কিভাবে আটকাবে ও! একটু নার্ভাসই হল তালহা।
থুথু খেলেও কি সাওম ভেঙ্গে যাবে?
ভ্রু কুঁচকে দেখলো আসিফ।নাআআ।সুর করে বলল আসিফ।তিন বার খেতে পারবি, এর বেশী হলেই ভেঙ্গে যাবে।দুপুরের দিকে বেশী তৃষ্ণা লাগে,তখনের জন্য জমা করে রাখবি।সকাল সকালই বেশী খেয়ে ফেলিস না।আমি একবার সকালেই তিনবার খেয়ে ফেলছিলাম। তারপর বাকিটা দিন কি যে কষ্টে পার হল! তালহা ভয়ে ঢোক গিলতে গিয়ে আরেকটু হলেই থুথু গিলে ফেলত।আসিফকে তো আর বলা যায় না যে এর মধ্যেই ও দুইবার থুথু খেয়ে ফেলেছে। একবার ফজর সালাতের পর,আরেকবার সকালে ঘুম থেকে ওঠে কুলি করার পর। আর এখন তো খেতে খেতেই বাঁচল! আলহামদুলিল্লাহ! আসিফ ছিল বলে! ছেলেটা অতটা খারাপ না। তালহা ভাবে।
আমি গেলাম, আসিফ বলে। দেখিস চুরি করে কিছু খেয়ে টেয়ে ফেলিস না আবার।তোর তো আবার ঘন ঘন ক্ষুধা লাগে।
আসিফের কথা শুনে তালহার শরীর যেন জ্বলে গেল। বিশেষ করে ওর হাসার ভঙ্গীটা। উফফ। তালহার খুব রাগ হচ্ছিল আসিফের ওপর।
“আনা সাঈমুন!আনা সাঈমুন!”
আমি রোজাদার! আমি রোজাদার!
মা শিখিয়েছেন কথাটা।এটা বলে ও নিজের রাগটা কমানোর চেষ্টা করল।সাওম পালন মানে শুধু তো খাবার পানি থেকে বিরত থাকা নয় বরং ঝগড়া-রাগারাগি থেকেও বিরত থাকতে হবে।
তবে তালহা তার আগের একটা সিদ্ধান্ত পাল্টালো।আসিফ ছেলেটা অতটা ভাল না! নয়তো রমাদান মাসে কেউ কারো ব্যাপারে এরকম কিছু বলে!
কিঞ্চিৎ ক্ষুধা পেল তালহার। প্রতিদিন স্কুলে যাবার আগেই ও নাস্তা সারে। হেরফের কখনো হয় না। আজকে দেহঘড়ি জানান দিচ্ছে,খাবার সময় পার হয়ে যাচ্ছে। তালহা অন্যদিকে মন দেবার চেষ্টা করল।
ক্লাস থ্রিতে পড়ে তালহা। আসিফ ওর দু বছরের বড়। পড়ে ক্লাস ফাইভে।আর নিজের সিনিয়র ভাবটুকু আসিফ সবক্ষেত্রে তালহার ওপর জাহির করার চেষ্টা করে। গত রমাদানে তালহা অসুস্থতার কারণে সাওম রাখতে পারে নি। সেবার আসিফ তালহাকে এ নিয়ে অনেকবার নাজেহাল করেছিল।
তাই তালহা এবার সবকটা সাওম রাখবে,কষ্ট হলেও।
দুপুর দুটা।যোহরের সালাত পড়ে এসে তালহা কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিল।ক্লান্ত লাগছিল ওর।তারপর হোমওয়ার্ক নিয়ে বসল।এরাবিক আর গণিত।রমাদান উপলক্ষে স্কুলে খুব অল্পই হোমওয়ার্ক দিয়েছিল।
ত্রিশ মিনিটেই শেষ করা সম্ভব। এরাবিক শেষ করতে করতে ওর ক্লান্তি যেন আরও বেড়ে গেল।ঘড়ি দেখল তালহা।ইফতার এর আরও প্রায় তিন ঘন্টার মত বাকি। একটু বিরক্তই যেন হল তালহা। ধুর! এতক্ষণ!
গণিত হোমওয়ার্কটা ইফতারের পর করবে ভেবে তালহা বারান্দার দিকে গেল। পাশের বারান্দাতেই আসিফদের বাসা। আসিফ থাকতে পারে ভেবে তালহা একটু পিছিয়ে এল জানালা থেকে।দেখতে পেলে ও কিছু না কিছু বলে ক্ষ্যাপানোর চেষ্টা করবে তালহাকে।
একটু পর ঠিকই আসিফ ওদের বাসার বারান্দায় এসে দাঁড়াল। অন্যমনস্ক ছিল বলে দেখতে পায় নি তালহা।
কিরে,এখানে কী করিস! লুকিয়ে লুকিয়ে কিছু খাচ্ছিস নাকি!দেখি হাত দেখা তো!
হঠাৎ আসিফের কণ্ঠ শুনে তালহা ভীষণ চমকে উঠল। এতটা চমকে গেল যে ভয়ে ও ঢোক গিলে ফেলল আর সাথে থুথুও…
আজ সারাদিনে কম করে হলেও দশ বারের মত থুথু ফেলেছে ও। একটাবারের জন্যেও তালহা থুথু জমতে দেয় নি।আর এখন শুধু আসিফের কারণে…
রাগান্বিত হবার বদলে কান্না পেল তালহার। আসিফের সামনে যাতে না পড়ে যায় তাই বারান্দা থেকে রুমের ভেতর চলে এল ও।ওদিকে আসিফ বলে চলেছে, হা হা!ধরা খাইছে!হি হি!
তালহার ইচ্ছে হচ্ছে আসিফের ওপর রাগ দেখাতে। ওকে বলতে যে,ওর কারণেই তালহার সাওম ভেঙ্গেছে। আর আল্লাহ ওকে শাস্তি দেবেন এই কারণে। শেষ পর্যন্ত নিজেকে আটকাল তালহা।
ও সিদ্ধান্ত নিল যে বাসায় ওর সাওম ভেঙ্গে যাবার ব্যাপারে কাউকে কিছু বলবে না।ইফতার না হওয়া পর্যন্ত তাই ও আর কিছু খাবে না।
গতদিন যখন ও ভাবছিল যে, আজকে ও জীবনে প্রথমবারের মত সাওম রাখবে তখন নিজেকে হঠাৎ খুব বড় বড় মনে হচ্ছিল।জীবনে স্যাক্রিফাইসের পরিমাণ যত বেশী হবে তত বেশী আনন্দ।আর যে স্যাক্রিফাইসগুলো শুধু আল্লাহর জন্য করা হয় সেগুলো তো আসলে বিনিয়োগ, ফলে আমরা পৃথিবীতেও তার সুফল পাব আর আখিরাতেও। শেষের কথাগুলো তালহা তেমন বুঝে নি কিন্তু তবুও বাড়ির বড়দের মত সেও না খেয়ে থাকবে এই চিন্তাটাই তালহাকে বেশ অনুপ্রাণিত করেছিল। তাছাড়া ওর ইচ্ছা ছিল শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য কিছু করা। এই ভাবনাটার পরে ছিল আসিফকে দেখিয়ে দেওয়া যে ও এখন বড় হয়ে গিয়েছে।
না,সেটা আর হল না। হয়তবা বাকি সব সাওম ও রাখবে কিন্তু আসিফ তো একটার জন্য ওর চেয়ে এগিয়ে থাকবে। তাছাড়া একটা সাওম ভেঙ্গে গেল, আল্লাহ কি এর সাওয়াব দেবেন!
রমাদান মাস শুরু হবার আগে তালহার ক্লাসে পড়ানো হয়েছিল আল্লাহর নাম এবং গুণাবলী সম্পর্কে। ওদের পড়ানো হয়েছিল আল্লাহ হচ্ছেন আর-রহমান, আর-রহীম, আল-গাফুর।
তাহলে সামান্য এই ভুলের জন্য কেন তার সাওম ভেঙ্গে যাবে! তার চেষ্টার কি কোন মূল্যই নেই! আর সে তো ইচ্ছে করে করে নি! সব তো আসিফের দোষ!
দুঃখ ভরা মন নিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল তালহা।

তালহা!তালহা!
উঠে যাও,ইফতারের সময় হয়েছে!
তালহা প্রায় দু ঘণ্টা ধরে ঘুমিয়েছে! মার হাত বুলানিতে আরাম লাগছিল বলে আবার ঘুমিয়ে পড়তে চাইল তালহা। মা আবার বললেন, ইফতার করবে না,তালহা? সাওম রেখেছ মনে নেই!
সাওমের কথা বলাতে তালহার ঘুম হঠাৎ করেই ভেঙ্গে গেল আর সাথে সাথে একটু দুঃখও পেল ও। আহ! আজকে আমার প্রথম সাওমটা হত!
যাও তালহা, টেবিলে বসো।
তালহা ভাবছিল মাকে বলবে কিনা সাওম ভাঙ্গার কথা,বললে মা কাউকে বলবে না, কিন্তু তাও কেন যেন তালহা লজ্জা পেল।
টেবিলে গিয়ে দেখতে পেল ইতোমধ্যে ছোটচাচা,বাবা আর আসিফ টেবিলে বসে আছে। আসিফকে মা ইফতারের দাওয়াত দিয়েছিলেন। আসিফকে দেখেই তালহার দুঃখটা যেন আরও বেড়ে গেল। তালহা গিয়ে আসিফের পাশের চেয়ারটাতে গিয়ে বসল। বাবা আর ছোট চাচাকে মুনাজাত করতে দেখে তালহাও হাত তুলল।
আল্লাহ,আপনি তো অনেক ক্ষমাশীল,অনেক দয়ালু। প্লিজ,আমার সাওমটা কবুল করে নিয়েন।
আযান হল। টেবিলে প্রথম দিন উপলক্ষে অনেক ধরনের খাবার। সবাই খেজুর দিয়ে ইফতার শুরু করল।তালহাও নিল। পেটে ক্ষুধা থাকা সত্বেও তালহার আর কিছু খেতে মন চাইছে না।
ছোটচাচার সামনে পুডিং এর প্লেট ছিল। তিনি বললেন,তালহা নাও তোমার প্রিয় খাবার।আজকে না তোমার প্রথম সাওম ছিল?
জ্বি,ছোটচাচা। আমতা আমতা করে বলল তালহা।
তাহলে এত অল্প অল্প খাচ্ছে যে?
কিছু না,এমনি।
তালহা,তুমি বোধহয় জান না যে সাওম অবস্থায় থুথু ইচ্ছাকৃ্ত বা অনিচ্ছাকৃ্তভাবে খেয়ে ফেললেও কিছু হয় না। তোমাকে অনেকবার থুথু ফেলতে দেখেছি আজকে। এটার কোন দরকার নেই,বাবাও সায় দিলেন।
তালহা এবার খুশীতে এমন চমকাল যে বেশ কয়েকবার একসাথে সব থুথু গিলে ফেলল।আল্লাহর প্রতি কৃ্তজ্ঞতায় তালহার মন ভরে গেল।আলহামদুলিল্লাহ!
ধন্যবাদ! ছোটচাচা, কেউ একজন আমাকে ভুল শিখিয়েছিল।বলে তালহা আসিফের দিকে তাকাল। আসিফ মনের সুখে খেয়েই চলেছিল। ইচ্ছা করছিল সবাইকে বলে দিতে ওর কথা।কিন্তু নিজেকে সংযত করল ও। সাওম শেষ হলে কি হবে! রমাদান তো কেবল শুরু!
তালহা মনে মনে বলল, “আনা সাঈমুন,আনা সাঈমুন!”

“তালহার সাওম রাখা”
ইফাত মান্নান
.
#ঘুড়ি_Ghuri

ইসলামিক ইমেইল নিউজলেটার
নতুন পোস্ট প্রকাশিত হলে সরাসরি আপনার ই-মেইল ইনবক্সে পেতে সাবস্ক্রাইব করুন।
icon

মন্তব্য করুন

Back to top button