জীবনের বাঁকে বাঁকেরামাযান ও ছিয়াম

রামাদানে অত্যাচার!

দৃশ্য ১ঃ

স্বামী স্ত্রী দু জনে বিকেলে অফিস থেকে ফিরেছেন। স্বামী প্রবর বাসায় এসে মাত্র কাপড় বদলে টিভির সামনে রিমোট হাতে বসে গেলেন। স্ত্রী দৌড়ে ঢুকলেন রান্না ঘরে, ইফতারি বানাতে হবে। দু দন্ড জিরোবারও সময় পেলেন না।

ওদিকে টিভির সামনে থেকে কর্তাবাবু অনুরোধ করলেন, “ওগো তোমার হাতের আলুর চপটা দারুন হয়, একটু বানাওতো দেখি!” আরেক রুম থেকে শাশুড়ী বললেন, “বৌমা তোমার শশুড়ের জন্য পায়েসটা রাঁধতে ভুলো না কিন্তু!”

ইফতারের পর স্বামী বিশ্রাম নিয়ে যান তারাবীতে আর স্ত্রী আবার ঢোকেন হেঁশেলে, সেহেরী রান্না করা যে এখনো বাকি রয়ে গেছে!

দৃশ্য ২ঃ

কলেজ থেকে মেয়ে বাসায় এসেই বসে গেল ল্যাপ্টপ নিয়ে, মা দিবসে প্রোফাইল পিকচার চেঞ্জ করতে করতে বলল, “মা আমার কিন্তু ইফতারিতে হালিম চাই ই চাই। আর এখন আমাকে বিরক্ত করো না আমি ক্লান্ত!” ওদিকে মাও কিন্তু সারাদিন ঘরের কাজ সামলে ক্লান্ত! যদিও মায়েদের ক্লান্ত হওয়া বোধহয় ধর্তব্যরে বিষয় না!! তাই না?

দৃশ্য ৩ঃ

গৃহকর্তী সারাদিন বসে বসে কুরআন পড়ছেন, রাতেও অনেক নামাজ পড়ছেন, সারাদিন প্রচুর ইবাদত করছেন। ওদিকে রান্নাঘরে কাজের মেয়েটি সকাল থেকে কাজের পর কাজ করে যাচ্ছে।

ঘর মোছা, কাপড় ধোয়া, রান্না করা ইত্যাদি ইত্যাদি। বিকেল থেকেই সে বাসার সবার জন্য ইফতার বানাচ্ছে, ইফতারের পর এক রাশ থালা বাসন ধুচ্ছে আর মধ্যরাতে ঘরের অনেকেরই আগে উঠে যাচ্ছে সে। তাকে তখন ভাত রাঁধতে হবে, তরকারি গরম করতে হবে, কত কাজ! সেও কিন্তু রোজা রাখছে, তারপরও সবার মত এত বিশ্রাম কি তার ভাগ্যে আছে!!

উপরের দৃশ্যগুলো কিছুটা কাল্পনিক হলেও কি খুব একটা অপরিচিত ঠেকছে? চাইলে এমন আরো অনেক দৃশ্যপট এর কথা লেখা যায়! কিন্তু কী দরকার! আমাদের নিজের বাসার দিকে তাকালেই হয়, প্রতি রোজায় এসব কাহিনী তো চিরায়ত বাংলার ঐতিহ্য হয়ে গেছে, যা আমরা পরম যতনে লালন করছি!

যাই হোক আজকে আর কথা বাড়াবো না, শুধু অনুরোধ করব একবার সততার সাথে খোলা মনে ভেবে দেখতে, নির্যাতিত এই ঘরের মানুষগুলোর যায়গায় নিজেকে বসিয়ে দেখতে। আমাদের স্ত্রী, মা, কাজের মানুষ, ছেলের বউ এরাও যে মানুষ তা অনুভব করতে এত কষ্ট হয় কেন আমাদের? কেন আমরা পারি না তাদের একটু হলেও সহযোগিতা করতে?

ছোট বেলায় মা কে কত কষ্ট করতে দেখতাম! কত দিন দেখেছি সেহেরির সময় আম্মু অনেক আগে উঠে গিয়ে ভাত, তরকারি রান্না করে আমাদের ডেকে তুলে খাইয়েছে। সব সময় এসব taken for granted হিসেবেই নিতাম। এখন নিজের সংসার হবার পর বুঝি আমার মা কত কত কাজ করত এবং তখন কত অবিচার করেছি মা এর উপর!

আমরা কি ইন শা আল্লাহ্‌ এই রামাদানে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে পারি না আমাদের ভালবাসার মানুষগুলোর প্রতি কিংবা পশুর মত খাটতে থাকা গৃহকর্মীটির প্রতি?

*মা কে ইফতারি বানানোর সময় হাত লাগালে মা কতটা খুশি হবে জানেন?

*যে ঘরে স্বামী স্ত্রী দুজনেই চাকুরিজীবি সেখানে অফিস থেকে ফিরে স্ত্রী কে কিছুটা সাহায্য করলে কিন্তু পুরুষটির সম্মান কমবে না, বরং বাড়বে।

*স্ত্রীকে একান্তই যদি সাহায্য করতে না পারেন, অন্তত প্রতি নিয়ত বাহারী ইফতারি খাবার আবদার করা বন্ধ করুন। রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এর সময়ে সাহাবীরা অনেকেই শুধু খেজুর আর পানি দিয়ে ইফতার করতেন। দিনের পর দিন তাঁদের বাসায় চুলা জ্বলত না। উনার উম্মত হয়ে আমাদের কেন এত নবাবী চালে চলতেই হবে?

* অন্যকে ইবাদত করতে না দিয়ে, জুলুম করে শুধু নিজে ইবাদত করলে হবে? তাই বাসার কাজের মানুষটির প্রতিও যত্নবান হোন, তাকে কাজে সাহায্য করুন, রোজার দিনে ভারী কাজ দেওয়া থেকে বিরত থাকুন ও সর্বোপরি তাকেও ইবাদতের সুযোগ দিন।

গৃহস্থালি কাজে সাহায্য করা আমাদের রাসুল পাক (সাঃ) এর একটি সুন্দর সুন্নত, যা বিশেষত আমাদের পুরুষরা ভুলতে বসেছেন। রামাদানের এই পবিত্র দিনে চলুন এই সুন্নতটি পনুরুজ্জীবিত করার চেষ্টা করি।

আর আমাদের মাঝে যারা অন্যকে জুলুম করে তাদের বলছি, কিয়ামতের দিন কিন্তু জুলুমকারীর সওয়াব, নিপীড়িতের আমল নামায় যোগ করে দেয়া হবে! যদি সব সওয়াব দিয়ে দেবার পরও জুলুমের হিসাব নেয়া শেষ না হয়, তাহলে যার উপর জুলুম করা হয়েছে তার গুনাহসমূহ নিয়ে, জুলুমকারীর কাঁধে ফেলা হবে! তাই অন্যকে জুলুম করে যদি সারাদিন জুড়েও ইবাদত করা হয়, তবুও কিন্তু আমলনামায় পূন্যের ঘর শূন্য হয়ে যেতে পারে।

সুতরাং সাধু সাবধান!

আল্লাহ্‌ যেন আমাদের অন্তরে অন্যের প্রতি সহমর্মিতা ও ভালবাসাবোধ জাগ্রত করেন। আমিন।

————————
রামাদানে অত্যাচার!

রৌদ্রময়ী এডমিন

ইসলামিক ইমেইল নিউজলেটার
নতুন পোস্ট প্রকাশিত হলে সরাসরি আপনার ই-মেইল ইনবক্সে পেতে সাবস্ক্রাইব করুন।
icon

মন্তব্য করুন

Back to top button