সাম্প্রতিক প্রসঙ্গ

প্রশ্ন ফাঁস

পরীক্ষায় প্রশ্ন ফাঁস মানেই জাতির গলায় ফাঁস। এখন যার মহোৎসব চলছে। শিশু শ্রেণী থেকে শুরু করে বিসিএস পরীক্ষার প্রশ্নপত্র পর্যন্ত ফাঁস হয়ে যাচ্ছে। আগামী দিনের বংশধরগণের জন্যই বর্তমানের যত প্রচেষ্টা। অথচ যদি তাদেরকেই পঙ্গু করে ফেলা হয়, তাহ’লে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ কি হবে, তা সহজেই অনুমেয়। অভিজ্ঞজনেরা বলছেন, ২০১২ সালের পর থেকে বাংলাদেশের কোন পাবলিক পরীক্ষা প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগ ছাড়া অনুষ্ঠিত হয়নি। এতদসত্ত্বেও দায়িত্বশীল কর্তা ব্যক্তিদের দায়মুক্তি দেওয়া হয়েছে এই অজুহাতে যে পূর্বেও তো প্রশ্ন ফাঁস হয়েছে। অতএব তখন যদি দোষ না হয়ে থাকে, তাহ’লে এখন এমন দোষের কি? ভাবখানা এই যে, কেউ পাপ করলে আমাকে তা আরো জোরে শোরে করতে হবে। আদম পুত্র ক্বাবিল তার ভাই হাবীলকে খুন করেছিল। তাই আমাদেরকে আমাদের ভাইদের সমানে খুন করে যেতে হবে। বেশ তাহ’লে প্রশাসন ও আদালত উঠিয়ে দিন। জেলখানা খুলে দিন ও তাতে ভূমিহীনদের আবাদ করার সুযোগ দিন। সেই সাথে নিজেরা দায়িত্ব ছেড়ে যার যার ঘরে গিয়ে ঘুমান! শিক্ষা সচিব বলেছেন, প্রশ্ন ফাঁস যেহেতু ঠেকানো যাবে না, সেহেতু বই খুলে পরীক্ষা দেওয়ার বিধান করার চিন্তাভাবনা হচ্ছে’। এটা কেমন কথা? সেজন্য কেউ কেউ মন্তব্য করেছেন, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে প্রশ্ন ফাঁস বিষয়ক একটা পৃথক অধিদফতর খোলা উচিত। যেমন বহু পূর্বে প্রবীণ রাজনীতিবিদ খান এ. সবুর (১৯০৮-১৯৮২ খৃ.) প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের নিকট একটি ‘ঘুষ মন্ত্রণালয়’ ও সেই সঙ্গে একজন দক্ষ ‘ঘুষ মন্ত্রী’ নিয়োগের দাবী জানিয়েছিলেন। যাতে সরকারী কোন কাজে ঘুষের রেইট কত, তা জনগণ জানতে পারে। সেই সাথে সরকারী কর্মকর্তারা তাদের দায়িত্বের অনুপাতে কোন প্রকল্প থেকে কত পার্সেন্ট নিবেন, সেটা তারা জানতে পারেন।

প্রশ্ন ফাঁসের এই অপকর্মকে অনেকে ‘সংস্কৃতি’ বলছেন। যেমন তারা ধর্ষণ ও বিচারহীনতাকে ‘সংস্কৃতি’ বলছেন। অথচ কুকীর্তি কখনও সংস্কৃতি হ’তে পারেনা। ‘সংস্কৃতি’ শব্দটি কেবল সুন্দর ও পরিশীলিত সৎকর্মের রীতির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। সবচেয়ে লজ্জার বিষয়, এখন এই অপকর্মে খোদ শিক্ষক ও অভিভাবকরাই জড়িয়ে পড়েছেন। অভিভাবকরা নিজেরা চাঁদা তুলে প্রশ্ন ফাঁসের ব্যয় নির্বাহের জন্য বড় ধরনের তহবিল খুলেছেন। সেখানে সদা প্রস্ত্তত শিক্ষকেরা ফাঁসকৃত আসল প্রশ্নপত্র উত্তরসহ শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দিচ্ছেন। ঢাকাতে সম্প্রতি এমন একটি বড় চক্রের সন্ধান পাওয়া গেছে। যারা গত চার বছর ধরে এই অপকর্ম করে যাচ্ছে। ভবিষ্যতে প্রযুক্তির আরো উন্নতি হ’লে হয়তবা উত্তরপত্রে লেখার শ্রম থেকেও পরীক্ষার্থীদের মুক্তি দেওয়া হবে।

এবারে এস.এস.সি পরীক্ষার সময় ফাঁসকৃত প্রশ্নপত্র বাস ভর্তি করে সরাসরি পরীক্ষা কেন্দ্রে ঢুকে পড়েছে। ধরা পড়েছে কোমলমতি পরীক্ষার্থীরা। ভীত-সন্ত্রস্ত ক্রন্দনরত এগারজন পরীক্ষার্থীকে আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয়েছে। অথচ মূল প্রশ্ন ফাঁসকারীরা ধরাছোঁয়ার বাইরে আছে। দেশের ইতিহাসে এটাই প্রথম এরূপ লজ্জাকর ঘটনা। যারা তাদের নিরপরাধ সন্তানদের আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে দিয়ে স্বস্তি লাভ করে, তারা কোন মানুষের স্তরেই পড়ে কি না সন্দেহ। ঐ নাবালক আসামীরা আদৌ কোন আসামী নয়। আসামী হ’ল দেশের গোটা অভিভাবক সম্প্রদায়। ঐ সন্তানদের চোখের পানি গোটা দেশের লজ্জার বহিঃপ্রকাশ। দুর্ভাগ্য এই, যাদের লজ্জা পাওয়া উচিত ছিল, সেই দায়িত্বশীলদেরই লজ্জা নেই।

এজন্য দায়ী হ’ল (১) দুর্বল ব্যবস্থাপনা। (২) রাজনৈতিক অদূরদর্শিতা। (৩) শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের চরম খাম খেয়ালীপনা। প্রথমটির বিষয়ে বলা চলে যে, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের গুরুত্বপূর্ণ পদসমূহে দলীয়, কিন্তু অযোগ্য, অদক্ষ ও দুর্নীতিবাজদের পদায়ন করা হয়েছে। ফলে তারা নিজেদেরকে কৈফিয়তের ঊর্ধ্বে মনে করে। দ্বিতীয়টির বিষয়ে বলা চলে যে, শতভাগ স্বাক্ষরতা সম্পন্ন করে দেশকে দ্রুত জাতিসংঘের পুরস্কার প্রাপ্ত দেশে উন্নীত করার লক্ষ্যে কাজ করা। সেজন্য চিরাচরিত পরীক্ষা পদ্ধতি বাদ দিয়ে বিদেশী গ্রেডিং পদ্ধতি চালু করা। যেখানে ৮০ পাওয়া ও ১০০ পাওয়া ছাত্রের গ্রেড সমান। এতে মেধাবী ছাত্ররা নিরুৎসাহিত হচ্ছে। তৃতীয়তঃ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের খামখেয়ালীর অন্যতম হ’ল এই যে, (ক) শতভাগ পাস করিয়ে দেওয়ার জন্য মন্ত্রণালয় থেকে বিজ্ঞপ্তি জারি করা এই মর্মে যে, কেউ যেন ফেল না করে। যেখানে ন্যূনতম পাস মার্ক ১০০তে ৩৩, সেখানে ২৪ পেলে পাস করানোর নির্দেশ দেওয়া হয়। যদি কেউ ফেল করে, তাহ’লে সরকারের প্রজ্ঞাপন অনুসারে এজন্য পরীক্ষককেই লিখিতভাবে জবাবদিহি করতে হবে। ফলে বিবেকের তাড়নায় বহু শিক্ষিক-শিক্ষিকা পরীক্ষকের দায়িত্ব ছেড়ে দিয়েছেন। অথচ এতে পরীক্ষকদের কোনই দোষ নেই।  অল্প সময়ে অধিক খাতা দেখার অনৈতিক চাপ সৃষ্টি করা। ফলে খাতা না দেখেই অথবা কেবল চোখ বুলিয়েই কিংবা অনেক সময় নিজে ও নিকটজনেরা মিলে নম্বর শীট ভরে খাতা দেখার দায়িত্ব শেষ করেছেন। ফল দাঁড়িয়েছে এই যে, সর্বত্র জিপিএ-৫ এর ছড়াছড়ি। অথচ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় অকৃতকার্য। (খ) সৃজনশীল পরীক্ষা পদ্ধতি। যা ছাত্রদের মেধা বিকাশের উদ্দেশ্যে করা হয়েছে। কিন্তু সেটা তখনই সম্ভব, যখন তার মেধার বিকাশ ঘটে। অথচ ছোট্ট শিশু, যার মেধা এখনও সুপ্ত, তাকেই বলা হচ্ছে অজানা একটি প্যারা পড়ে বুদ্ধি খাটিয়ে তার জবাব লিখতে। যেখানে শিক্ষকরাই জবাব দিতে পারেন না। এমনকি এরূপ প্রশ্ন তৈরী করতেই তারা হিমশিম খাচ্ছেন। সেখানে কোমলমতি ছাত্রদেরকে সৃজনশীল পরীক্ষায় বাধ্য করা হচ্ছে। ফলে এটাই তাদের মধ্যে চালু হয়ে গেছে যে, হিজিবিজি কিছু লিখলেই জিপিএ-৫ পাব। সৃজনশীল পদ্ধতির উদ্ভাবক বেঞ্জামিন স্যামুয়েল ব্লুম শিক্ষার্থীদেরকে অসীম সৃজনশীল শিশু হিসাবে কল্পনা করেছিলেন এবং তাদের মেধার দ্রুত বিকাশের জন্য এই পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছিলেন। কিন্তু এজন্য প্রয়োজন ছিল সৃজনশীল পাঠ্য বই রচনার এবং সৃজনশীল পাঠ দানে দক্ষ শিক্ষকের। অথচ সেগুলি কিছুই না করে সৃজনশীল পরীক্ষা গ্রহণের উদ্ভট চিন্তা বাস্তবায়নের চেষ্টা করা হচ্ছে। যা উল্টো ফল বয়ে এনেছে। (গ) ব্যবহারিক পরীক্ষা। বাস্তবে কোন স্কুল-কলেজ-মাদরাসাতেই এখন ব্যবহারিক ক্লাস করানো হয় না। কিন্তু সব পরীক্ষার্থীকেই ব্যবহারিকে শতভাগ নম্বর দেওয়ার রীতি গড়ে উঠেছে। যা স্রেফ দুর্নীতি। যে ব্যাপারে শিক্ষার্থীদেরকে ছোট থেকেই অভ্যস্ত করানো হচ্ছে। (ঘ) এমসিকিউ বা বহু নির্বাচনী প্রশ্নপত্র। যার শতভাগ মুখস্থ নির্ভর। অথচ সবসময় বলা হচ্ছে ‘মুখস্থকে না বল’। এই পদ্ধতি বাতিল যোগ্য। (ঙ) ৫ম শ্রেণীতে পাবলিক পরীক্ষা চালু করা। যা এযাবৎকালের সবচেয়ে বড় ভুল। ফলে কচি বাচ্চাদের অপরিপক্ক মস্তিষ্কে জিপিএ-৫ পাওয়ার দুর্বহ চিন্তার বোঝা চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। সেই সাথে তাদের খেলা-ধুলা ও তাদের অভিভাকদের ঘুম হারাম করা হয়েছে। তারা এখন দিনরাত বাচ্চা নিয়ে ছুটছেন কোচিং সেন্টারগুলিতে। ২০১৮ সালে প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষার শতভাগ প্রশ্নপত্র সৃজনশীল পদ্ধতিতে হবে বলে ঘোষণা করা হয়েছে। যা একটি আত্মঘাতি সিদ্ধান্ত। (চ) সরকারী ভাবে বই লেখা ও ছাপানো। যাতে অযোগ্য লেখকদের ভুলে ভরা লেখা এবং জনগণের আক্বীদা-আমলের বিরোধী মতবাদ ও বস্ত্তবাদী চিন্তা-চেতনা প্রসারের অপচেষ্টা চলছে। উপরোক্ত কর্মকান্ডের ফলে পুরা শিক্ষাব্যবস্থাটাই এখন কোচিং নির্ভর ও গাইড বই সর্বস্ব হয়ে উঠেছে। অপরদিকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলি সনদ বিতরণী কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে।

প্রশ্নফাঁসের বিষয়টি মূলতঃ সরকার পরিচালিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতেই হচ্ছে। যেখানে দেশের অধিকাংশ সাধারণ শিক্ষার্থী পড়াশুনা করে। অথচ বাংলাদেশে আরও প্রায় ১১ ধরনের শিক্ষা ব্যবস্থা চলছে। সেসব স্থানে প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়না। বিশেষ করে শত শত ইংরেজী মাধ্যম স্কুলে প্রশ্ন ফাঁসের কথা কেউ কল্পনাও করেনা। উচ্চবিত্ত পরিবারের ছেলে-মেয়েরা সেসব প্রতিষ্ঠানে পড়াশুনা করে। ফলে ভবিষ্যৎ কর্ম জীবনে তারাই যে নেতৃত্ব দিবে এবং আম জনতার সন্তানেরা তাদের গোলামী করবে, সেই অশুভ পরিকল্পনার অবাধ বাস্তবায়ন চলছে কথিত গণতান্ত্রিক সরকারের মাধ্যমে। অতএব সরকারের উচিত হবে সহায়ক ভূমিকা পালন করা, সরাসরি ভূমিকা নয়। আল্লাহ আমাদের হেফাযত করুন- আমীন!

মন্তব্য করুন

Back to top button