আরাকানে পুনরায় বিপন্ন মানবতা
রোহিঙ্গা সমস্যা দক্ষিণ এশিয়ার একটি ধারাবাহিক জাতিগত সন্ত্রাসের প্রকৃষ্ট উদাহরণ। কল্পনাতীত পশুত্ব ও অসভ্যতার এমন জয়জয়কার আধুনিক সভ্যতাগর্বী বিশ্বের ইতিহাসে এক ঘৃণ্যতম কলংকিত অধ্যায়। প্রতিনিয়ত যে সীমাহীন পাশবিকতায় বর্বর মগ বৌদ্ধরা নিরীহ রোহিঙ্গা মুসলমানদের কচুকাটা করছে, তা নিমিষেই আদিম জংলী সমাজের কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে। ১৭৯৯ সালে সর্বপ্রথম বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী মগদের অত্যাচারে শরণার্থী হয়ে দলে দলে আরাকান থেকে চট্টগ্রামে পালিয়ে আসে রোহিঙ্গারা। তারপর আরাকান বার্মা রাজ্যভুক্ত হ’লে অন্ততঃ শতবর্ষের জন্য তারা বর্মী অত্যাচার থেকে রক্ষা পায়। কিন্তু ১৯৪২ সালে মিয়ানমার বৃটিশ শাসন থেকে স্বাধীন হ’লে আবারও রোহিঙ্গা নিধনে মেতে ওঠে বর্মীরা। সেই থেকে অদ্যাবধি দফায় দফায় নিধনযজ্ঞ অব্যাহত আছে। ২০১৭ সালের সর্বশেষ ঘটনায় সমগ্র আরাকান থেকে রোহিঙ্গারা সম্পূর্ণভাবে নির্মূলের পথে। কক্সবাজারের আকাশ-বাতাস এখন লক্ষ লক্ষ স্বামী-সন্তান, পরিবারহারা, সম্ভ্রমহারা রোহিঙ্গা নারী, শিশু, বৃদ্ধ শরণার্থীর রোনাজারিতে ভারি হয়ে উঠেছে। পিছনে তারা রেখে এসেছে আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশীর রাইফেলের গুলিতে, চাপাতির আঘাতে, আগুনে পুড়ে কিংবা ধর্ষিতা হয়ে বেঘোরে মারা পড়া শত-সহস্র লাশের বিভৎস সারি। যারা কোনমতে প্রাণ নিয়ে জঙ্গল, পাহাড়, নদীর দুর্লংঘ্য পথ পাড়ি দিয়ে পালিয়ে আসতে পেরেছে, তাদের অবস্থাও অত্যন্ত করুণ ও মানবেতর। জীবনযুদ্ধে লড়াইয়ের সর্বশেষ শক্তিও যেন হারিয়ে ফেলেছে তারা। অনাহারে, অর্ধাহারে অসহায় সর্বহারা শরণার্থীরা ভুলে গেছে শোকের ভাষাও। সাম্প্রতিক বিশ্ব সিরিয়া, ইয়েমেন ও ইরাকী শরণার্থীদের দেখেছে, কিন্তু রোহিঙ্গাদের মত এমন সর্বস্বান্ত ও বিধ্বস্ত শরণার্থী কেউ দেখেনি। মানবিক বিপর্যয়ের এমন করুণ দৃশ্য ভুলিয়ে দিচ্ছে অতীতের সব নিষ্ঠুরতার ইতিহাস। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ‘হিউম্যান রাইটস ওয়াচে’র দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক জ্যেষ্ঠ গবেষক তেজশ্রী থাপা মন্তব্য করেছেন, যেসব রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আসছেন, তাঁদের কারোরই মিয়ানমারে ফিরে যাওয়ার আশা নেই। তিনি বলেন, ‘বাস্তব অবস্থা খুব খুব খারাপ। কোন ছবি দিয়ে সেটি বর্ণনা করা সম্ভব নয়। আমি অনেক শরণার্থীদের সঙ্গে কাজ করেছি। কিন্তু কোন শরণার্থীদের এতটা বিধ্বস্ত অবস্থায় পাইনি’। জাতিসংঘ এই সমস্যাকে ‘সবচেয়ে স্বল্প সময়ে সবচেয়ে বড় মানবিক বিপর্যয়গুলোর অন্যতম’ বলে বর্ণনা করেছে।
রোহিঙ্গা কারা?
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার প্রসিদ্ধ দেশ বার্মা, যার প্রাচীন নাম ছিল ব্রহ্মদেশ। ১৯৮৯ সালে তা হয়ে যায় মিয়ানমার। মিয়ানমারের মূল ভূখন্ড তথা মধ্যাঞ্চল ৭টি ডিভিশনে বিভক্ত। এর বাইরে রয়েছে আরও ৭টি রাজ্য চিন, কাচিন, কারেন, কায়াহ, মন, শান এবং রাখাইন। রাখাইন রাজ্যটির পূর্বনাম ছিল আরাকান। ইতিহাসে এই নামেই তা পরিচিত। মিয়ানমারের পশ্চিমাঞ্চলে বঙ্গোপসাগর তীরবর্তী এই সমভূমি অঞ্চলের আয়তন ২২ হাযার বর্গমাইল। প্রাকৃতিকভাবে এটি মায়ানমারের মূল ভূখন্ড থেকে সুউচ্চ আরাকান পর্বতশ্রেণী দ্বারা বিভক্ত। মধ্যযুগে আরাকানের রাজধানীর নাম ছিল ম্রোহাং। সেটারই অপভ্রংশ হ’ল রোহাং বা রোসাঙ্গ। সেখানকার অধিবাসীরা হ’ল রোহিঙ্গা। প্রাথমিক যুগেই তাদের মাঝে ইসলামের দাওয়াত ছড়িয়ে পড়ে আরবদের মাধ্যমে। ফলে তারা অধিকাংশই মুসলমান হয়ে যায়। বহু পূর্ব থেকে আরাকানের আকিয়াব সমুদ্রবন্দরটি সুপ্রসিদ্ধ ছিল। ফলে শুধু আরবরা নয়, আরও বিভিন্ন দেশ থেকে নাবিকরা এখানে ভিড় জমাতো এবং স্থানীয় নারীদের সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হ’ত। সেই সূত্রে বহুজাতির সংমিশ্রণ ঘটেছে রোহিঙ্গাদের মাঝে। ১৪৩০ সাল থেকে ১৭৮৫ সাল পর্যন্ত আরাকান ছিল একটি স্বাধীন রাষ্ট্র, যার মধ্যে ২১১ বছর ছিল মুসলিম শাসনাধীন। চট্টগ্রাম তখন ছিল এই রাষ্ট্রেরই অংশ। এই আরাকানী রোহিঙ্গাদের মধ্যে প্রায় ৯২ শতাংশই মুসলমান। বাকীরা হিন্দু ধর্মাবলম্বী। তাদের মোট জনসংখ্যা ছিল অনধিক ২০ লাখ। তবে বিভিন্ন সময়ে বর্মীদের নির্যাতনে বিদেশে শরণার্থী হয়েছে প্রায় ১০ লক্ষাধিক। যাদের মধ্যে বাংলাদেশে ৪ লক্ষ, পাকিস্তানে ২ লক্ষ, সঊদী আরবে ২ লক্ষ ও থাইল্যান্ডে ২ লক্ষ আশ্রয় নিয়েছে। এছাড়া ইন্ডিয়া, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়াসহ ইউরোপ, আমেরিকার বিভিন্ন দেশে আশ্রয় নিয়েছে আরও লক্ষাধিক। বর্তমান সংকট শুরু হওয়ার পর ২৪ আগস্ট’১৭ থেকে এ পর্যন্ত বাংলাদেশে আগতদের নিয়ে রোহিঙ্গা শরণার্থীর সংখ্যা ১০ লক্ষ ছাড়িয়েছে।
রোহিঙ্গাদের উপর নির্যাতনের ধারাবাহিক চিত্র :
বহু জাতি-উপজাতির আবাসস্থল বর্তমান মায়ানমারের ১৩৫টি মতান্তরে ১৩৯টি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর একটি হ’ল রোহিঙ্গা। রাখাইনে তারা ছাড়াও বাস করে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী বর্মী রাখাইন জাতি, যারা আরাকানে বসবাস শুরু করে ৯ম শতকের পরে। ১৫শ’ শতকের প্রথমার্ধে বর্মীরা আরাকান পাহাড় অতিক্রম করে আরাকান রাজ্যে আক্রমণ করে। তারপর থেকে ধীরে ধীরে বর্মীরা আরাকানে বসতি স্থাপন করতে থাকে। সুতরাং এ কথা নিঃসন্দেহে প্রমাণিত যে, রোহিঙ্গারাই আরাকানের প্রাচীন বাসিন্দা। রাখাইনরা বহু পরে উড়ে এসে জুড়ে বসেছে।
১৭৮৫ সালে সর্বপ্রথম আরাকান বার্মীজদের দখলীভুক্ত হয়। বর্মী রাজা বোদাওপায়া (১৭৮২-১৮১৯) ক্ষমতায় আসার পর মুসলমানদের উপর নির্যাতন শুরু করেন। ১৭৯৯ সালে নির্যাতনের মাত্রা এত বেড়ে যায় যে, হাযার হাযার রোহিঙ্গা মুসলমান প্রথমবারের মত চট্টগ্রামে শরণার্থী হয়। যদিও রাজা পরবর্তীতে অনুতপ্ত হন এবং তার অবস্থান পরিবর্তন করেন। ১৮২১ সালে সেখানে প্রায় ৫ লক্ষ মুসলমানের বসবাস ছিল। ১৯২৪ সালে আরাকানে বৃটিশ শাসন শুরু হ’লে আবার মুসলমানদের অবস্থার উন্নতি হয়। বৃটিশরা বহু সংখ্যক ইন্ডিয়ানকে আরাকানে নিয়ে আসে কাজের উদ্দেশ্যে, যাদের মধ্যে মুসলিমও ছিল, হিন্দুও ছিল। কিন্তু বার্মার বৌদ্ধরা ইন্ডিয়ান মুসলমানদের সাথে মিলিয়ে স্থানীয় রোহিঙ্গা তথা বার্মিজ মুসলমানদেরকেও তখন থেকে কালা বা বিদেশী সম্বোধন করা শুরু করে। একই সময়ে তাদের মাঝে ইন্ডিয়াবিরোধী মনোভাব জাগ্রত হ’তে শুরু করে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর তা আরও যোরদার হয়। অবশেষে ১৯৩৮ সালে ইন্ডিয়ান অভিবাসীসহ সকল নৃগোষ্ঠীর মুসলমানদের বিরুদ্ধে বৌদ্ধরা দাঙ্গা শুরু করে। ‘বার্মা কেবল বার্মীজদের জন্য’ এই জাতীয়তাবাদী শ্লোগান তুলে তারা গোটা বার্মায় রক্তক্ষয়ী সহিংসতা চালায়। এতে সরকারী হিসাবে তাদের হাতে ২০৪ জন মুসলমান নিহত, অপর ১০০০ জন আহত এবং ১১৩টি মসজিদ ধ্বংস হয়। এভাবে বার্মায় মুসলিম বিদ্বেষ চূড়ান্ত রূপ লাভ করে।
১৯৪২ থেকে থেকে ২০১৭ খ্রিষ্টাব্দ : ১৯৪২ সালে ২য় বিশ্বযুদ্ধের সময় বৃটিশরা সরে গেলে আবারও স্থানীয় রাখাইন বৌদ্ধদের সাথে রোহিঙ্গাদের দাঙ্গা বেঁধে যায় এবং জাপানী বাহিনী ও বার্মীজ বাহিনী সম্মিলিতভাবে রোহিঙ্গাদের উপর হামলা চালায়। ফলে ৪০ হাযারের বেশী রোহিঙ্গা মুসলমান চট্টগ্রামে পালিয়ে আসে। সেসময় বর্তমান প্রধানমন্ত্রী অং সান সুকীর পিতা অং সান বৃটিশ বিরোধী আন্দোলন শুরু করেন। এ আন্দোলনে তাঁকে সক্রিয়ভাবে সমর্থন করেন রোহিঙ্গাসহ বার্মার মুসলমান নেতারা।
১৯৪০ সালে পাকিস্তান আন্দোলন শুরু হ’লে রোহিঙ্গারা পাকিস্তানের সাথে একত্রিত হওয়ার মনোবাসনায় সংগঠিত হ’তে থাকেন। ১৯৪৮ সালে বার্মা স্বাধীন হওয়ার প্রাক্কালে তারা পাকিস্তান আন্দোলনের নেতা মুহাম্মাদ আলী জিন্নাহর সাথে যোগাযোগ করেন এবং আরাকানের রাজধানী আকিয়াবে নর্থ আরাকান মুসলিম লীগ গঠনও করেন। কিন্তু মি. জিন্নাহ সম্ভবতঃ এ বিষয়ে বার্মার সাথে কোন দ্বন্দ্বে যেতে চাননি। ফলে তাদের দাবী নাকচ করে দেন। সেদিন যদি তিনি বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে নিতেন, তাহ’লে হয়ত আরাকান রাজ্যের একটি অংশ আজ বাংলাদেশেরই অংশ হ’তে পারত।
মি. জিন্নাহর প্রত্যাখ্যানের পর রোহিঙ্গারা ‘মুজাহিদ পার্টি’ নামে উত্তর আরাকানে একটি সংগঠন গড়ে তোলে। এর উদ্দেশ্যে ছিল আরাকানে একটি স্বায়ত্তশাসিত মুসলিম রাজ্য গঠন করা।
১৯৪৭ সালে বার্মার পার্লামেন্টে মেম্বার নির্বাচিত হন দুই জন রোহিঙ্গা মুসলমান এমএ গাফফার এবং সুলতান আহমাদ। ১৯৫১ সালের নির্বাচনে বিজয়ী হন ৫ জন রোহিঙ্গা। ১৯৫৬ সালেও নির্বাচিত হন অনুরূপ ৬ জন রোহিঙ্গা এবং সুলতান আহমাদ কেন্দ্রীয় সরকারের স্বাস্থ্যমন্ত্রী হিসাবে নিয়োজিত হন।
১৯৬২ সালে জেনারেল নে উইন একটি সেনা ক্যুর মাধ্যমে ক্ষমতায় আসেন এবং মুসলমানদের অধিকারসমূহ একে একে হরণ করতে শুরু করেন। উদাহরণস্বরূপ সেনাবাহিনী থেকে সকল মুসলমানকে অপসারণ করা হয়। তাদের ধর্মীয় স্বাধীনতা রুদ্ধ করে নানা উৎপীড়নমূলক পদক্ষেপ নেয়া হয়। মুসলিম রাজনৈতিক সংগঠনগুলোকে পর্যন্ত সন্ত্রাসী আখ্যায়িত করে নিষিদ্ধ করা হয়।
১৯৭১ থেকে ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে রাখাইন বৌদ্ধ ভিক্ষুরা আকিয়াবে আমরণ অনশন করে সরকারকে চাপ দিতে থাকে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য। তারা অভিযোগ তোলে যে আরাকানে মুসলমানরা দিন দিন সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়ে যাচ্ছে এবং অচিরেই তারা সমগ্র আরাকান দখল করে ফেলবে। তারা অভিযোগ তোলে যে, এর পিছনে দায়ী হ’ল বাংলাদেশ থেকে আগত অবৈধ অভিবাসীরা। এর ভিত্তিতে ১৯৭৮ সালে বার্মা সরকার রোহিঙ্গাদের উপর ‘অপারেশন কিং ড্রাগন’ নামে ভয়াবহ আর্মী অভিযান চালায়। ফলে ২ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসতে বাধ্য হয়। পরে জাতিসংঘের সহযোগিতায় তারা বছরখানেক পর পুনরায় আরাকানে ফিরে যেতে সক্ষম হয়। কিন্তু তার আগেই শরণার্থী শিবিরে অপুষ্টির শিকার হয়ে প্রায় ১২ হাযার মানুষের মৃত্যু ঘটে। যার অধিকাংশই ছিল শিশু।
কিছুকাল পরই ১৯৮২ সালে তাদের নাগরিকত্ব কেড়ে নেয়া হয় এবং তাদেরকে অবৈধ অভিবাসী বাঙালী বলে অভিহিত করা হয়। ফলে তারা নিজ দেশে পরবাসী হয়ে পড়ে। তাদের চলাফেরা সীমিত করে দেয়া হয়। লেখাপড়া, চাকুরি সবকিছু থেকে বঞ্চিত করা হয়। তাদের জমিজমা জোরপূর্বক কেড়ে নিয়ে বৌদ্ধ বসতিস্থাপনকারীদের দেয়া হয়। যেন তারা ক্ষুধার্ত বিড়ালের সম্মুখে খাঁচায় বন্দী ইঁদুর।
১৯৮৯ সালে আরাকানের নাম পরিবর্তন করে রাখাইন রাখা হয়, যেন মধ্যযুগের মুসলিম ঐতিহ্যকে ইতিহাসের পাতা থেকে বিলুপ্ত করে রোহিঙ্গাদের নাম-নিশানা মুছে ফেলা যায়।
১৯৯২ সালে পুনরায় ব্যাপকভাবে মিলিটারী অপারেশন শুরু হ’লে আড়াই লক্ষাধিক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসে। সেসময় চরম মানবিক বিপর্যয়ের শিকার হয় রোহিঙ্গারা।
১৯৯৪ সাল থেকে নতুন জন্ম নেয়া রোহিঙ্গা শিশুদের জন্মসনদ দেয়া বন্ধ করে দেয় বর্মী সরকার।
২০১২ সালে আবারও রোহিঙ্গা ও রাখাইন দাঙ্গায় শতাধিক মুসলমান নিহত হয় এবং গৃহহীন হয় প্রায় দেড় লক্ষ। এ দাঙ্গায় নারী ধর্ষণ, ঘরবাড়ী ও ফসল পোড়ানো, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও মসজিদ ধ্বংসসহ বহু মানবতাবিরোধী অপরাধে লিপ্ত হয় বর্মী সেনা এবং তাদের মদদপুষ্ট বৌদ্ধ জঙ্গীরা। এসময় বহু রোহিঙ্গা বাংলাদেশসহ পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে আশ্রয় নেয়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। অসহায়, পাশবিক নির্যাতনের শিকার বনু আদমদেরকে সীমান্তরক্ষীদের পুশব্যাক করার নির্মম দৃশ্য সেসময় সারাবিশ্বের মানুষের হৃদয়কে নাড়া দেয়। পরে এদের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ সাগরে ডুবে মারা যায় অথবা সীমান্তরক্ষীদের গুলিতে বেঘোরে প্রাণ হারায়। তবুও থেমে থাকেনি তাদের বিপদ সংকুল যাত্রা। বিভিন্ন দেশে তারা আশ্রয়প্রার্থী হয়। বাংলাদেশেও প্রায় ৭০ হাযার রোহিঙ্গা আশ্রয় নেয় এ দফায়। যদিও শরণার্থীর মর্যাদা না পাওয়ায় তাদেরকে অত্যন্ত মানবেতর জীবন যাপন করতে হচ্ছে।
২০১৪ সালের আদমশুমারী থেকে বাদ দেয়া হয় রোহিঙ্গাদেরকে।
২০১২ থেকে ২০১৫ পর্যন্ত থেমে থেমে রোহিঙ্গাদের উপর অমানুষিক নির্যাতন ও আক্রমণ অব্যাহতভাবে চলছিলই। ২০১৬ সালের অক্টোবরে তথাকথিত ‘হারাকাতুল ইয়াক্বীন’ নামক একটি রোহিঙ্গা সশস্ত্র গ্রুপের পাল্টা আক্রমণে ৯জন পুলিশ নিহত হওয়ার ছুতো ধরে আবারও বর্মী সেনারা ভয়াবহ হামলা চালায়। তারা গ্রামের পর গ্রাম পুড়িয়ে নিশ্চিহ্ন করে দেয়। নৃশংসভাবে দা, ছুরি, কিরিচ, গুলির আঘাতে মারা যায় হাযার হাযার রোহিঙ্গা। গণধর্ষণের শিকার হয় হাযারও নারী। আগুনে পুড়িয়ে মারা হয় বহু শিশুকে। রোহিঙ্গাদের শস্যক্ষেত, মার্কেট, মসজিদ, স্কুল সবকিছু পুড়িয়ে দেয় তারা। মর্মান্তিক গণহত্যার সেসব দৃশ্য বিশ্বমিডিয়ায় প্রকাশ পেলে তীব্র নিন্দার ঝড় ওঠে। কিন্তু তাতেও নিরস্ত হয়নি বর্মী সরকার এবং বর্বর বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদীরা। এ দফায়ও লক্ষাধিক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়।
২০১৭ সালের ২৪শে আগস্ট কফি আনান কমিশন রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব প্রদানের সুফারিশ উত্থাপন করে মায়ানমার সরকারের কাছে। ঠিক তার পরদিনই ২৫শে আগস্ট রহস্যজনকভাবে ‘আরাকান স্যালভ্যাশন আর্মী’ নামে একটি গ্রুপ দেশীয় অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে রাতের অাঁধারে ৩০টি পুলিশ স্টেশনে একযোগে হামলা চালিয়েছে বলে বর্মী সরকার জানায়। এই হামলার পূর্বাপর প্রেক্ষাপট পর্যালোচনা করলে এটাই পরিষ্কার ধারণা হয় যে, এটি বর্মী সেনাবাহিনীর সাজানো পূর্বপরিকল্পনা। কেননা নাগরিকত্ব প্রস্তাব বাস্তবায়িত হবার সম্ভবনা যখন তৈরী হ’ল, ঠিক সেই সময় এমন হামলার কোন যৌক্তিকতা ছিল না। যাইহোক সেই সূত্রকে ভিত্তিভূমি ধরে বর্মী সেনাবাহিনী নতুনভাবে জাতিগত সন্ত্রাসের বর্বরতম নযীর স্থাপন করে আরাকান থেকে রোহিঙ্গাদের চূড়ান্তভাবে নির্মূলের মিশনে নামে। সে অপারেশন আজও অব্যাহত রয়েছে। এ পর্যন্ত পুড়িয়ে নিশ্চিহ্ন করে দেয়া হয়েছে ২১০টি গ্রাম। বরাবরের মত মানবতাবিরোধী হেন কোন জঘণ্য অপরাধ নেই যা তারা করেনি। প্রায় ১০ হাযার রোহিঙ্গা ইতিমধ্যে তাদের হাতে নিহত হয়েছে। আর কত নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছে, কত শিশু পরিবার ছাড়া হয়েছে, কত নারী স্বামীহারা হয়েছে, তার কোন ইয়ত্তা নেই। গত কয়েক সপ্তাহে বাংলাদেশে আশ্রয় গ্রহণ করেছে প্রায় ৬ লাখ শরণার্থী। প্রতিদিন বিপদসংকুল পথ অতিক্রম করে রেকর্ডসংখ্যক প্রায় ২০ হাযার মানুষ সীমান্ত অতিক্রম করছে, যার প্রায় ৮০ ভাগই নারী ও শিশু। এছাড়া অপেক্ষায় রয়েছে আরও কয়েক লক্ষ রোহিঙ্গা। জাতিসংঘ আশংকা করছে, এ দফায় শরণার্থীর সংখ্যা ১০ লক্ষ ছাড়িয়ে যেতে পারে, অর্থাৎ রোহিঙ্গা জাতি মিয়ানমার থেকে সবংশে নির্মূলের পথে। ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহে রাজেঊন।
রোহিঙ্গাদের উপর নির্যাতনের মূল কারণ :
(১) মুসলিম বিদ্বেষ : মায়ানমারের বর্তমান জনসংখ্যার প্রায় ৮৫ ভাগ বৌদ্ধ। তারা বহুদিন ধরে মুসলমানদেরকে তাদের জাতিস্বত্তার জন্য হুমকি মনে করে আসছে। ফলে প্রায়ই বিচ্ছিন্নভাবে মুসলমানদের উপর আক্রমণ ঘটে। যেমন ১৯৯৭ সালে মান্দালয়ে প্রায় দেড় হাযার বৌদ্ধ ভিক্ষু একত্রিত হয়ে মুসলমানদের মসজিদ, বাড়িঘর, গাড়ি, সহায়-সম্পদ আগুনে পুড়িয়ে দেয়। যা রাজধানী ইয়াঙ্গুনসহ পার্শ্ববর্তী যেলাসমূহেও ছড়িয়ে পড়ে। এতে কেবল মান্দালয়ে পোড়ানো হয় ১৮টি মসজিদ। পোড়ানো হয় বহু কুরআনের কপি। ২০০১ সালে আফগানিস্তানের বামিয়ানে বুদ্ধ মূর্তি ধ্বংসের প্রতিক্রিয়ায় টাউঙ্গু শহরে বৌদ্ধরা দুই শতাধিক মুসলমান হত্যা করে। পুড়িয়ে দেয় ১১টি মসজিদ এবং ৪০০ বাড়ি-ঘর। মসজিদে ছালাতরত অবস্থায় হত্যা করা হয় ২০জন মুছল্লীকে। ২০১৩ সালে মায়ানমারের কেন্দ্রীয় শহরগুলোতে ৯৬৯ নামে মুসলিমবিদ্বেষী একটি বৌদ্ধ চরমপন্থী জাতীয়তাবাদী আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। তারা সারা মিয়ানমারে মুসলিমভীতি ছড়িয়ে দেয় এবং মুসলমানদের উপর আক্রমণের জন্য বৌদ্ধ সমাজকে উস্কানী দেয়। যার নেতৃত্বে ছিল আশিন ভিরাথু নামের এক ভিক্ষু। এর প্রেক্ষিতে দেশটির মুসলমানদেরকে সামাজিকভাবে আরও কোনঠাসা করে ফেলা হয়। ২০১৬ তে বৌদ্ধরা রাজধানী ইয়াঙ্গুনের নিকটবর্তী বাগো অঞ্চলে একটি মসজিদ পুড়িয়ে দেয়। তার পরপরই কাচিন রাজ্য এবং মধ্য মায়ানমারের একটি মসজিদে আগুন ধরানো হয়। এছাড়া বিচ্ছিন্ন নানা ঘটনা তো রয়েছেই। মানবাধিকারকর্মী ও বার্মিজ রোহিঙ্গা অর্গানাইজেশন ইউকের প্রেসিডেন্ট তুন খিন বলেন, ‘রোহিঙ্গারা অনেক বছর ধরেই গণহত্যার সম্মুখীন হচ্ছে। মিয়ানমারের উগ্র জাতীয়তাবাদীদের সহজ লক্ষ্য তারা। রোহিঙ্গারা একটি ভিন্ন নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠী এবং তাদের চেহারা ও ধর্ম- দুই-ই ভিন্ন। সুতরাং রোহিঙ্গাদের চিহ্নিত করা সহজ।’
(২) বার্মীজ জাতীয়তাবাদ : ‘বার্মা কেবল বার্মিজদের জন্য’ এই শ্লোগান তুলে বার্মিজদের জাতীয়তাবাদী আন্দোলন শুরু হয়েছিল শত বছর পূর্বেই। সেই সর্বগ্রাসী জাতীয়বাদের কোপে কাটা পড়তে হচ্ছে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গাদের, যাদেরকে তারা বাঙ্গালী বলে দেশ থেকে তাড়িয়ে দিতে চাচ্ছে। তাদের এই জাতীয়তাবাদী সন্ত্রাসের শিকার সেখানকার কারেন, কাচিন, কোকাং প্রভৃতি স্বাধীনতাকামী আরও কয়েকটি নৃগোষ্ঠীও, যদিও তাদের অধিকাংশই বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। অঞ্চল ও জাতিগত বিভেদ ঘিরে কেন্দ্রের সাথে সব প্রদেশের কমবেশী সহিংসতা বিরাজ করছে মিয়ানমারে। তবে সেসব স্বাধীনতাকামীদের মত সহিংস আরাকানের রোহিঙ্গারা কখনই ছিল না। হয়ত দুর্বলতা এবং ধর্মীয় সংখ্যালঘুতা বিবেচনায় রোহিঙ্গা মুসলিমরা দীর্ঘদিন ধরে নযীরবিহীন নৃশংসতায় নিশ্চিহ্ন হবার পথে। বিশেষ করে আরাকানের বৌদ্ধরা সংখ্যালঘুতার ভয়ে আক্রান্ত। কেননা যদি শরণার্থী হয়ে পড়া ১০-১৫ লক্ষ রোহিঙ্গাকে দেশে ফেরানো হয়, তবে আরাকানের ৬৫ ভাগ জনসংখ্যা হবে রোহিঙ্গা মুসলমান। যা তাদের জন্য চরম শিরঃপীড়ার কারণ। এজন্য তারা বর্তমানে আরাকানে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদেরও জন্মহার নিয়ন্ত্রণের জন্য ২টির বেশী সন্তান গ্রহণ করা নিষিদ্ধ করেছে।
(৩) নাগরিকত্ব আইন : ১৯৮২ সালে মিয়ানমারের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর তালিকা থেকে রোহিঙ্গা মুসলমানদের উচ্ছেদ করতে নতুন ষড়যন্ত্র আঁটে মিয়ানমারের সামরিক জান্তা। তাদের প্রণীত ১৯৮২ সালের নাগরিকত্ব আইন মোতাবেক মিয়ানমারের পূর্ণ নাগরিক হিসাবে কেবল তারাই স্বীকৃতি পাবে যাদের পূর্বপুরুষগণ ১৮২৩ সাল তথা বৃটিশ শাসনের পূর্ব থেকে বার্মায় বসবাস করছে। এই আইনের ভিত্তিতে তারা রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব বাতিল করে তাদেরকে অবৈধ অভিবাসী আখ্যা দেয়। তাদের দাবী রোহিঙ্গারা বৃটিশ আমলে বাংলাদেশ থেকে আসা অভিবাসী। তারা মিয়ানমারের আদিবাসী নয়।
(৪) বর্ণবাদ : ২০০৯ সালে হংকঙে মিয়ানমারের প্রতিনিধি ইয়ে মিন্ট অং রোহিঙ্গাদের প্রতি সমবেদনা প্রকাশ না করার আহবান জানিয়ে বলেন যে, তারা হ’ল ‘as ugly as ogres’ অর্থাৎ ‘রাক্ষসের মত কুৎসিৎ’ এবং তারা অন্যান্য বার্মিজ নৃগোষ্ঠীর মত সুন্দর ও নরম চামড়ার অধিকারী নয়। এছাড়া এক আর্মী জেনারেল রোহিঙ্গা নারী ধর্ষণের অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করতে গিয়ে এই ভাষা ব্যবহার করে যে, ‘তারা কুৎসিৎ ও নোংরা। তাদেরকে কোন সেনা ধর্ষণ করবে না’।
(৫) অর্থনৈতিক স্বার্থ : খনিজ সম্পদ, সমুদ্রসীমা ও বিখ্যাত আকিয়াব বন্দর সুবিধার বিবেচনায় রাখাইন প্রদেশের গুরুত্ব অন্য রকম। এর দখল ঘিরে নানা শক্তির আশা-আকাঙ্খা এতকাল ধরে জিইয়ে থাকা সংঘাতের অন্যতম কারণ।
কেন মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের ‘বাঙ্গালী’ বলছে?
ভারতবর্ষ থেকে বিদায়ের পূর্বে ইংরেজরা বার্মার ১৩৯টি জাতিগোষ্ঠীর একটি তালিকা তৈরী করে। কিন্তু রোহিঙ্গার নাম সেখানে তারা অন্তর্ভুক্ত করেনি। এটি ছিল বার্মায় অশান্তি ও অস্থিতিশীলতা বিদ্যমান রাখার লক্ষ্যে ব্রিটিশদের একটি রাজনৈতিক চাল (বাংলাদেশ প্রতিদিন, ২২শে সেপ্টেম্বর’১৭)। আর এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গা নামক কোন জাতিগোষ্ঠী কখনই রাখাইনে ছিল না বলে দাবী করে বসে। তাদের মতে, রোহিঙ্গারা মূলত বাঙালী। তারা অবৈধভাবে বাংলাদেশ থেকে এসে রাখাইনে বসবাস করছে। কেননা তাদের ভাষা চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষার সাথে মেলে। গত ১৭ই সেপ্টেম্বর’১৭ মিয়ানমারের সেনাপ্রধান মিন অং হ্লাইয়াং আবারও জোর দিয়ে বলেছেন, তারা রোহিঙ্গা হিসাবে স্বীকৃতি দাবী করছে অথচ তারা কখনো মিয়ানমারের নৃগোষ্ঠী ছিল না। এটি ‘বাঙালী’ ইস্যু। আর এই সত্য প্রতিষ্ঠায় আমাদের একতাবদ্ধ হওয়া প্রয়োজন (প্রথম আলো, ১৮ই সেপ্টেম্বর’১৭)।
অথচ আরাকানে রোহিঙ্গাদের রয়েছে সুদীর্ঘ ইতিহাস। তারাই হ’ল আরাকানের ভূমিপুত্র, যা ঐতিহাসিকভাবে প্রমাণিত। এমনকি যে নাগরিকত্ব আইনে বৃটিশ শাসনের পূর্বকালকে নাগরিকত্ব পাবার শর্ত হিসাবে ধরা হয়েছে তার পূর্বেই ১৭৯৯ সালে স্কটিশ লেখক ফ্রান্সিস বুকানন হ্যামিল্টন আরাকানের স্থানীয় অধিবাসীদের কথা লিখতে গিয়ে বলেন, “Mohammedans, who have long settled in Arakan, and who call themselves Rooinga, or natives of Arakan” অর্থাৎ ‘আরাকানে বহুদিন ধরে বসবাস করে আসছে মুসলমানরা এবং তারা নিজেদেরকে রোহিঙ্গা বা আরাকানের অধিকাসী হিসাবে আখ্যায়িত করে থাকেন।’ অনুরূপভাবে ১৮১১ সালে ক্লাসিকাল জার্নালে এবং ১৮১৫ সালে জার্মান লেখক জোহান সেভেরিন ভাটের এক জার্মান পত্রিকায় বার্মায় রোহিঙ্গা নামক সম্প্রদায়ের অস্তিত্বের কথা লিখেছেন (Azeem Ibrahim. The Rohingyas: Inside Myanmar’s Hidden Genocide. Oxford University Press. pp. 24–25).
সুতরাং একথা নিঃসন্দেহে প্রমাণিত রোহিঙ্গারা আরাকানেরই আদিবাসী। বরং বৌদ্ধরা পরবর্তীতে বসতি স্থাপন করেছে। তারা নিজেদেরকে খৃষ্টপূর্ব ৩০০০ সালে আগমনকারী হিসাবে দাবী করলেও এর কোনই ঐতিহাসিক এবং প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ নেই। বরং এটাই প্রমাণিত যে ১৫ শতকে স্বল্প সংখ্যায় আরাকানে প্রবেশ করলেও মূলতঃ অষ্টাদশ শতাব্দীতে বার্মীজ শাসন প্রতিষ্ঠার পর তারা ব্যাপক সংখ্যায় বসতি স্থাপন করে। এজন্য নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অর্মত্য সেন যথার্থই বলেছেন, ‘রোহিঙ্গারা বার্মাতে যায়নি বরং বর্মীরা আরাকান দখল করেছে’।
মায়ানমারের বৌদ্ধ বংশদ্ভূত রোহিঙ্গা গবেষক ১৯৮৮ সালে মায়ানমার ত্যাগ করা ড. মঙ জার্নির বিশ্বব্যাপী অগণিত উপস্থাপনা অনুযায়ী, নিকটবর্তী চট্টগ্রাম এলাকার বাংলাভাষীদের সঙ্গে ভাষাগত মিলের সূত্র ধরে রোহিঙ্গাদের বাঙালী বলে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচারণা আসলে গোয়েবলসের পুনঃপুনঃ মিথ্যা উচ্চারণের মাধ্যমে তাকে সত্য হিসাবে প্রতিষ্ঠার সফল এক মায়ানমার সরকারী অপচেষ্টা।
তাছাড়া ভাষা বাংলা হ’লেই যদি বাংলাদেশী হয়, তাহ’লে আসাম, ত্রিপুরা আর পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে সব বাঙালী বাংলাদেশী হ’ত! অনুরূপভাবে তারা যদি বাংলাদেশীই হ’ত তাহ’লে শত বছর ধরে নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়েও তারা কেন আরাকানে অভিবাসী হয়ে পড়ে থাকবে?
মায়ানমারের অন্যান্য স্থানে মুসলমানদের কি অবস্থা?
মায়ানমারে রোহিঙ্গা ছাড়াও ইন্ডিয়ান বংশদ্ভূত মুসলমান রয়েছে যারা ইয়াঙ্গুনে বসবাস করে আসছে। এছাড়া রয়েছে চায়না এবং মালয়ী বংশদ্ভূত মুসলমান। রয়েছে বার্মীজ নারীদের সাথে বিবাহসূত্রে স্থায়ী হওয়া এশিয়ার বিভিন্ন দেশের মুসলমানরাও। এদের সংখ্যা চার লাখের বেশী নয় (২০১৫ সালে মিয়ানমার সরকারের পরিসংখ্যান অনুযায়ী) এবং বৌদ্ধদের সাথে একত্রিতভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। ফলে সাধারণতঃ তারা আক্রমণের লক্ষ্যবস্ত্ত হয় না। যদিও বিভিন্ন সময়ে বিচ্ছিন্ন আক্রমণে তাদেরকেও কোনঠাসা করে রাখা হয়। এছাড়া একমাত্র রাখাইনের ‘কেমান’ মুসলমানরা মিয়ানমারের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী হিসাবে স্বীকৃতি পেয়েছে। এর কারণ সম্ভবত এই যে, তারা বৃটিশপূর্ব কাল থেকেই জাতিগতভাবে রোহিঙ্গাদের প্রতি বিদ্বেষী এবং আরাকানে রোহিঙ্গাদের আধিপত্য বিস্তারকে বিরূপ চোখে দেখে। তাদের সংখ্যাও মাত্র ৩ হাযারের মত। এ কারণে মুসলমান হওয়া সত্ত্বেও তারা স্বীকৃতি পেয়েছে বলে ধারণা করা যায়।
কেন হচ্ছে না সমাধান?
রোহিঙ্গারা গত অর্ধশত বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে জাতিগত সন্ত্রাসের শিকার। তাদের ব্যাপারে মিয়ানমার সরকার মানবাধিকার লংঘনের সর্বোচ্চ রেকর্ড স্থাপন করেছে। এতদস্বত্ত্বেও গোটা বিশ্ব কেন নিশ্চুপ কিংবা যতটা জোরালো ভূমিকা নেয়া দরকার, তা নিচ্ছে না কেন? এর প্রাথমিক উত্তর রোহিঙ্গারা মুসলমান। ফলে স্বাভাবিক মানবাধিকার যেন তাদের জন্য প্রযোজ্য নয়, এটা প্রায় স্বতঃসিদ্ধ ব্যাপার আজকের বিশ্বে। অপরদিকে নতজানু মুসলিম সরকারগুলোও আপন আপন স্বার্থ নিয়ে ব্যস্ত। ফলে তারাও রোহিঙ্গাদের অধিকারের প্রশ্নে সরব নয়। দ্বিতীয়তঃ অমেরিকা, ইংল্যান্ড আর জাতিসংঘের ভূমিকা একসূত্রে গাঁথা; যার স্বার্থ ইঙ্গ-মাকিন পরাশক্তির অর্থনৈতিক ঔপনিবেশবাদ। চীন, রাশিয়া ও ভারতের ভূমিকাও এখানে ঘৃণ্য বাণিজ্যিক আধিপত্যবাদকে ঘিরেই। ফলে কেউই রোহিঙ্গাদের জন্য মানবিক সাহায্য ঘোষণার বাইরে কোন পদক্ষেপ নেবে না। রাজনৈতিক ও বাণিজ্যিক স্বার্থকে পাশ কাটিয়ে মানবতার স্বার্থ বিবেচনার মত সত্য অবস্থানে আসার সৎসাহস নেই তাদের। বাংলাদেশ সরকারেরও সাধ্য নেই যে উপরোক্ত পরাশক্তিদের রাগিয়ে কোন কথা বলে। ফলে মায়ানমারের গণহত্যার বিরুদ্ধে নিন্দা প্রস্তাব তোলার দুঃসাহস তাদের হয়নি। সুতরাং রোহিঙ্গা সমস্যার আশু সমাধান যে সুদূর পরাহত, তা বলাই বাহুল্য। পোপ ফ্রান্সিস যথার্থই বলেছিলেন, ‘এই বিশ্বের মুসলিম দুই প্রকার যুদ্ধ করছে- প্রথম যুদ্ধ নিজেদের পীড়িত প্রমাণ করার, দ্বিতীয় যুদ্ধ বিচার পাওয়ার। প্রথম যুদ্ধে তারা কিছু হ’লেও এগিয়েছে, কিন্তু দ্বিতীয় যুদ্ধে আজ পর্যন্ত তারা সাফল্য লাভ করতে পারেনি।’ ফিলিস্তীন, কাশ্মীর, সিরিয়া, মিয়ানমার, ইরাকে লক্ষ লক্ষ মুসলমান হত্যা করা হচ্ছে, অথচ উল্টো মুসলমানদেরকেই বলা হচ্ছে সন্ত্রাসী!
সমাধানের পথ:
আজও পর্যন্ত রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান হিসাবে রোহিঙ্গাদের আত্মপরিচয়ের অধিকার নিশ্চিত করার পরিবর্তে বৈশ্বিক সংস্থাগুলো কেবল মানবিক বিপর্যয় ঠেকানোতে আগ্রহ দেখায়। ফলে মূল সমস্যাগুলো অবহেলিতই থেকে যায়। এতে করে বর্মী সরকার বারবার নৃশংস নিপীড়ন চালানো সত্ত্বেও এবং গণহত্যার সমস্ত উপাদানের প্রমাণ পাওয়া সত্ত্বেও জাতিসংঘের সুনির্দিষ্ট কোন পদক্ষেপ লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। এক্ষণে এর সমাধান বাংলাদেশের হাতেই রয়েছে বলে আমরা মনে করি। কেননা বেশী দিন এত শরণার্থীর বোঝা বহন করা তার জন্য দুরূহ হবে। সেজন্য রোহিঙ্গাদের পক্ষে বাংলাদেশের কূটনৈতিক উদ্যোগ ও প্রচেষ্টাই হবে সবচেয়ে ফলপ্রসূ এবং সম্ভবত খোদ রোহিঙ্গাদের চেয়েও তা অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে সক্ষম। ইতিমধ্যে বাংলাদেশ সরকারের মানবিক অবস্থান সকলের কাছে প্রশংসিত হয়েছে। একে পুঁজি করে সরকারের সামনে সুযোগ এসেছে আন্তর্জাতিক ফোরামে জোরালো কূটনৈতিক পদক্ষেপ গ্রহণের, যাতে করে মিয়ানমার সরকার কফি আনান কমিশনের সুফারিশ বাস্তবায়ন করতে বাধ্য হয় এবং রোহিঙ্গাদের নাগরিক অধিকার নিশ্চিত করে সসম্মানে তাদেরকে দেশে ফিরিয়ে নেয়। এছাড়াও সরকার মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নারকীয় গণহত্যার বিচার দাবী করে আন্তর্জাতিক আদালতে (ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল কোর্ট) অভিযোগ উত্থাপনের জন্য প্রচেষ্টা চালাতে পারে। আর শেষ পর্যন্ত কোন পদক্ষেপই যদি ফলপ্রসূ না হয়, সেক্ষেত্রে রোহিঙ্গাদেরকে শরণার্থী ক্যাম্পের মানবেতর জীবনে বন্দী না রেখে পার্বত্য চট্টগ্রামের জনবিরল এলাকায় পুনর্বাসিত করা যেতে পারে। এতে করে তারা একদিকে যেমন দেশীয় অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখার সুযোগ পাবে, অন্যদিকে পার্বত্য চট্টগ্রামের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের বিরুদ্ধে একটি প্রতিরোধশক্তি হিসাবেও কাজ করতে পারবে। যেমনটি প্রস্তাব করেছিলেন মাসিক আত-তাহরীক-এর সম্পাদক মন্ডলীর সভাপতি প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব (সম্পাদকীয়, মাসিক আত-তাহরীক, জুলাই ২০১২)।
মোটকথা রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সবচেয়ে বড় আশ্রয়দাতা দেশ এবং প্রতিবেশী হিসাবে বাংলাদেশের জন্য বর্তমান প্রেক্ষাপটে একটি ঐতিহাসিক ভূমিকা রাখার সুযোগ এসেছে। যা কিনা মানবতার পক্ষে এবং বিশ্ব শান্তি ও সমৃদ্ধির পক্ষে অত্যন্ত প্রশংসনীয় ভূমিকা হিসাবে বিবেচিত হ’তে পারে।
পরিশেষে মহান আল্লাহর নিকটে আকুল প্রার্থনা তিনি যেন এই মযলুম ভাইবোনদের রক্ষা করেন এবং যালিমদেরকে দুনিয়ার বুক থেকে উৎখাত করেন। সেই সাথে যে সকল শরণার্থী মুহাজির বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে, তাদের প্রতি সরকার মানবতার দৃষ্টি আরও প্রসারিত করুক এবং সর্বস্তরের সাধারণ মানুষ সাধ্যমত অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে তাদের প্রতি এগিয়ে আসুক, এটাই আমাদের কাম্য।
– আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব