চড়ুইদম্পতি!
একটা দরস (ক্লাস) শেষ করেই হুজুরকে দেখতাম টুক করে ঘরে চলে গেছেন। ছেলেরা কিছু না বলে মুখ টিপে হাসছে। নতুন গিয়েছি, এখনো মাদরাসার হাল-হাকিকত ভাল করে বোঝা হয়নি। হুজুরের চুলে পাক ধরেছে, কিন্তু মনে পাক ধরেনি। মাদরাসার পেছনে বড় এক পুকুর। তার পাড়ে বিশাল বাঁশঝাড়! ওটা পেরিয়ে গেলেই হুজুরের বাড়ি! আমরা ভাঙা বেড়ার ফাঁক দিয়ে দেখতাম, হুজুর কী ভীষণ আগ্রহ নিয়ে ঘরের পানে ছুটছেন! হুজুরকে আসতে দেখে, বুড়িমাও দরজা খুলে এগিয়ে আসতেন! দূর থেকে আবছা দেখা যেত। বুড়িমা পুকুর পাড় ধরে বেশ কিছুটা এগিয়ে আসতেন! তারপর দু’জনে একসাথে ঘর পর্যন্ত যেতেন। কখনো হাত ধরাধরি করে! কখনো দেখা হওয়ার স্থানেই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ কথা বলতেন! এত কথা কোথায় যে পেতেন! মাত্র ঘণ্টাখানেক আগে হুজুর ঘর থেকে এসেছেন আমাদেরকে পড়াতে! এই খানিকের মধ্যেই এত কথা জমে গেছে! এত ভাব, এত আবেগ? এই বুড়ো হাড়েও? আমাদের কচিমনে বেশ দোলা দিয়ে যেত দু’জনের নিষ্পাপ ভালবাসার দৃশ্যগুলো! এই বুড়ো বয়েসেও দু’জনের খুনসুটিগুলো বেশ লাগত! তখন হয়তো এগুলোকে সঠিক অর্থে বুঝতাম না! কিন্তু দু’জন মানুষের একে অপরের প্রতি গভীর অনুরাগ, আশপাশকে আপ্লুত করে ফেলত!
.
আমাদের বুড়ো হুজুর আমাদেরকে গল্প শোনাতেন। আমরা হুজুরের বাড়িতে ধান কাটতে যেতাম। পুকুরের মাটি কাটতে যেতাম! বৃহস্পতিবার জোহরের পর ছুটি হলে মাদরাসায় থেকে যেতাম। কাছেই তো! একটু জিরিয়ে সোজা ক্ষেতে চলে যেতাম। শুরু হত ধান দা-নো (কাটা)। ফাঁকে ফাঁকে পানচিনি চলতো। বুড়িমা পাঠাতেন। অন্য হুজুরদের বাড়িতে কাজ করতে গেলে ঘণ্টায় যদি একবার নাস্তা আসতো, বুড়িমার কাছ থেকে আসত দু’বার! অন্যদিন পান খাওয়া নিষিদ্ধ থাকলেও, কাজ করতে এলে, সিদ্ধ হয়ে যেত। বাড়ি থেকে আস্ত পানের বাটাই পাঠিয়ে দিতেন! বুড়াহুজুর আমাদেরকে কাজ বুঝিয়ে দিয়ে কিছুক্ষণ থেকে আবার চলে যেতেন। আবার সেই ঠোঁটটেপা হাসি! দরজা বন্ধ ভালোবাসা!
.
এখন হুজুর আর বুড়িমার মধ্যে কুসুম কুসুম ভালবাসা চুইয়ে চুইয়ে পড়লেও, একটা সময় ছিল ঢিসুম ঢিসুম! বুড়িমার জামাই পছন্দ হয়নি। কেন যে হয়নি সে এক রহস্য। অথচ বিয়ের আগে তিনিই এখানে সম্বন্ধ পাতানোর জন্যে উঠেপড়ে লেগেছিলেন। হুজুর গরীব জেনেই বিয়েতে অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন। ঘটনার শুরু আরও বহু আগে। বুড়িমার কাছে তাদের জীবনের গল্প শুনেছি! বহুবার! হুজুরের কাছ থেকে শোনা গল্পটাই তুলে ধরা যাক:
-আমার আব্বু ছিলেন অত্যন্ত কড়া ধাঁচের মানুষ! পান থেকে চুন খসতে পারতো না। কড়া শাসনে রাখতেন আমাদেরকে। আদরও করতেন বেশুমার। অন্যায় করলে পেটাতেনও বেদম! আব্বুর একটা সাইকেল ছিল। স্কুলে যাওয়া-আসা করতেন। স্কুল ছিল অনেক দূরে! ভোরে চারটা খেয়ে দু’চাকায় চড়ে বসতেন। ফিরতে ফিরতে সেই রাত!
আমার বেজায় শখ ছিল সাইকেল চালানোর! কিন্তু সুযোগ কই! একমাত্র রাতের বেলাটাই সাইকেল ঘরে থাকে! এক বৃহস্পতিবারে, চাচাত ভাইসহ সাইকেলটা বের করে আনলাম! আমি কোনও রকমে চড়ে বসলাম! সে পেছন থেকে ধরে রাখছে। মনের আনন্দে প্যাডেল ঘোরাচ্ছি! সে ধাক্কা দিয়ে গতি বাড়িয়ে দিচ্ছে! সমস্যা দেখা দিল থামানো নিয়ে! ব্রেক কষলে উল্টে পড়ার সম্ভাবনা। লাফ দিয়ে নামবো সে উপায়ও নেই। সামনেই আমাদের বাড়ির পুকুর! এতকিছু ভাবার সময় পাওয়া গেল না। ঝপাৎ করে পুকুরে গিয়ে পড়লাম! হাবুডুবু খেতে খেতে হাঁচড়ে পাঁচড়ে তীরে ভীড়লাম! কিন্তু সাইকেল? ডুব দিয়ে চেষ্টা করলাম! পেলাম না। গভীর রাত, পুকুরের দিকে তাকাতেই ভয়ে গা সিঁটিয়ে ওঠে! সাহস করে নেমে পড়েছিলাম! ঝোঁকের বশে নামলেও ভয়ের কথা মনে পড়ে যাওয়াতে আর নামতে হিম্মত হল না। এখন উপায়? আব্বু সকালে উঠে বাজারে যাবেন! সাইকেল না পেলে বুঝে ফেলবেন সব!
ভয়ের চোটে হাত-পা পেটে সেঁধিয়ে গেল! কী যে করি! এখন দুুপুররাত! আম্মু জেগে থাকলে যা হোক একটা বন্দোবস্ত করা যেত! চাচাত ভাই সাইদকে বললাম:
-সাইদ, আমি আজ বাড়িতে যাব না। তুমি গিয়ে ঘুমিয়ে পড়! সকালে চুপি চুপি আম্মুকে বলবি, সাইকেল কোথায় ডুবেছে!
-আপনি এতরাতে কোথায় যাবেন?
-আপাতত কাছারি ঘরে ঘুমিয়ে থাকব! সকালে দূর থেকে লক্ষ্য রাখব! আব্বুর মতিগতি যদি সুবিধের মনে না ঠেকে, কিছুদিনের জন্যে গা ঢাকা দেব!
.
আব্বু ফজর পড়ে এসে সাইকেল না পেয়েই যা বোঝার বুঝে গেলেন। হাঁকডাক করতে করতে বাজারের থলে নিয়ে হাটের দিকে রওয়ানা দিলেন। বুঝতে বাকি রইল না, সামনে পেলে আমাকে আস্ত চিবিয়ে খেয়ে ফেলবেন। মানে মানে সরে পড়াই নিরাপদ!
.
আম্মুকে লুকিয়ে ঘরে এলাম। হাতড়ে হাতড়ে লুঙ্গি-জামা নিয়ে সন্তর্পনে বেরিয়ে এলাম। হাটের রাস্তা এড়িয়ে পুবমুখি কোনাকুনি আইলের পথ ধরলাম! গন্তব্য নিরুদ্দেশ! হুট করে বের হয়ে পড়া। মাথায় এল চরের দিকে চলে গেলে কেমন হয়! এক বন্ধুর বাড়ি ওদিকে! ধানকাটার মৌসুম চলছে! অনেক খুঁজেও বন্ধুর বাড়ি বের করতে পারলাম না। রাতে ধান কাটতে আসা একদল কামলার ঝুপড়িতে আশ্রয় নিলাম। তাদেরকে সব কথা বললাম না। শুধু বললাম, আমার বাড়িঘরে ঠাঁই নেই! আপাতত কোনও আশ্রয় নেই! তারা দয়াপরবশ হয়ে থাকতে দিল। খেতে দিল। সকালে তাদের সাথে ক্ষেতেও নিয়ে গেল। আমি বেশ ভাল ধান কাটতে পারতাম! ছোটবেলা থেকেই কাজ করে আসছি! তারা হল মৌসুমি কামলা! আমরা গ্রামের মানুষজন স্থায়ী কামলা! আমার ধান কাটা দেখে তারা অবাক! জমির মালিকও মুগ্ধ! তিনি কিছু বললেন না। দিনশেষে আমার জন্যে মজুরির ব্যবস্থা হল। অবশ্য কামলারা ধান কাটে ঠিকা হিশেবে! গেরস্থের সব জমির ধান কেটে দিলে এত এত টাকা পাওয়া যাবে। থাকা-খাওয়া মালিকের।
.
টিকে গেলাম দিনমজুর হয়ে। ততদিনে আমার থাকার ব্যবস্থা কামলাদের ঝুপড়ি থেকে গেরস্থের কাছারি ঘরে স্থানান্তরিত হয়েছে। বাড়ির জন্যে মনে কেমন করলেও পিটুনির ভয়ে যেতে মন সরছিল না। এখানে থাকতে থাকতে পরিবেশ পছন্দ হয়ে গেল। লেখাপড়া নেই। প্রথম দিকে এটা বেশ ভাল লাগছিল। চারদিকে ধু ধূ চর! দিগন্ত-বিস্তৃত মাঠ! মহিষ চরছে, গরু চরছে মাইল কে মাইল খোলা আকাশ! এক নেশা ধরানো প্রকৃতি! তখনো মুহুরি প্রজেক্ট কারো কল্পনাতেও ছিল না। সাগর ছিল উদ্দাম উন্মুখ উন্মাতাল!
এখন তো মুহুরি প্রজেক্টের কারণে পানি বাধাপ্রাপ্ত হয়ে পড়েছে। সেই ষাটের দশকে, উত্তাল পানির সে কি তোড়জোড়! পানি নেমে গেলে গোটা চরাঞ্চল কী সবুজ হয়ে উঠতো! শুধু মাটি? মানুষের মনও যে তখন সবজে রঙ ধারন করত! মুহুরির পাড়ের বিকেলগুলো এখনো যে তীব্রভাবে টেনে ধরে রাখে, তখন কেমন ছিল কল্পনাও করা যাবে না। বিশেষ করে গোধূলি বেলার মন কেমন করা গা-জুড়ানো বাতাসে সে এক নাড়িছেঁড়া টান থাকে। উঠেই আসতে ইচ্ছা করে না। মনে হয় বসেই থাকি, বসেই থাকি! অনন্তকাল! রাত-দিন!
.
আমার মনিবের বাড়ি ছিল বর্তমান প্রজেক্টের অদূরে! ধানকাটার জমিও এর আশেপাশেই। কামলারা দিনে কাজ করতো, রাতে করুণ সুরে গীত গাইত। একা একা, কোরাস করে করে!
হেইয়ারে মাঝি ভাই!
কইও আমার মায়ের ঠাই!
মোরে যেন নিতে আহে
নাইওরেরও লাইইইইইই!!
প্রায় প্রতি রাতেই ঘুরেফিরে এই একটা গানই গাইত! প্রতিটি লাইন আলাদা জোর দিয়ে। ভিন্ন জোশ দিয়ে। বিশেষ করে ‘হেইয়ারে’ বলার সময় সবার সম্মিলিত কোরাস যেন চরাঞ্চলের নিঝুম রাতের স্তব্ধতাকে ভেঙে খান খান করে দিত। একজন গাইত, বাকিরা সঙত দিত। গান গওয়ার এক পর্যায়ে, কয়েকজনের মধ্যে ‘জলজলা’ চলে আসত! মাতালের মত হয়ে অপার্থিব এক শক্তিতে লাফাতে শুরু করত। ভীষণ জোরে জোরে ফোঁস ফোঁসসস করে নাক দিয়ে নিঃশ^াস বেরোতে থাকত! কিছুক্ষণ এমন করার পর, আস্তে নেতিয়ে পড়ত! কখনো কখনো তাকে বাঁশের কঞ্চি দিয়ে পিটিয়ে শান্ত করতে হত! জলজলা থামার সময় মুখের কষ বেয়ে ফেনা ভাঙতেও দেখেছি! আবার কয়েকজন ‘মোরে যেন নিতে আহে’ বলে ভেউ ভেউ করে কেঁদে উঠত! যে সে কান্না নয়, অনেক গভীর থেকে উঠে আসা কান্না! তাদের সামনে হয়তো ফুটে উঠতো, একটি অসহায় মেয়ের করুণ মুখচ্ছবি! স্বামীর বাড়িতে কষ্টের দিনগুলো কেটে যাচ্ছে! বিয়ের পর স্বামীর বাড়ি আসার পর আর বাপের বাড়ি যাওয়া হয়ে ওঠেনি! কেউ নিতে আসে নি। গরীব বাবা ভয়ে এদিকে আসার সাহস পায় না। আসা-যাওয়ার খরচা-পাতি যোগাড় নেই যে! মেয়েকে নাইওর নিতে হলে আলাদা নৌকায় চড়িয়ে নিতে হবে। আসার সময় নানা ‘তত্ব’ নিয়ে আসতে হবে! ফসল উঠলে বিক্রি করে যদি হাতে অতিরিক্ত কিছু থাকে, তাহলেই মেয়েকে আনার চিন্তা করা যাবে! কিন্তু ফসল উঠতে এখনো বহু দেরী! ততদিনে মেয়েটা আমার, বেঁচে থাকবে তো!
এদিকে মেয়েটা মায়ের বিরহে, বাবার বিরহে, ভাইবোনের বিরহে, উঠোনের বাতালি লেবু গাছটির বিরহে, গুমরে গুমরে মরে! স্বামীর বাড়ি পাশ দিয়েই বয়ে গেছে নদী! পাল তুলে সার সার নৌকা যায়! আসে! বিয়ের পরও এমনি এক নৌকায় করেই রাঙা বৌ হয়ে এসেছিল! নদীর দিকে তাকালে মনটা হু হু করে ওঠে! এই নদীরই উজানে আমার বাড়ি! আমাদের হাঁসগুলো নদীতে চরে! একটা হাস পথ ভুলে ভেসে আসতে পারে না!
কামলাদের স্বরটা ক্রমশ বেদনাবিধুর হয়ে উঠত! গাঁয়ের বধূটির সমস্ত কষ্ট যেন তাদের কণ্ঠ দিয়ে! গানের মাঝামাঝিতে একজন দু’জন কাঁদত, গান শেষ হলে একসাথে সবাই ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করত! তাদের কান্নার তোড়ে বাড়িঘরের মহিলারাও কাঁদত! তাদের গান শোনার জন্যে সন্ধ্যার পর থেকেই আমার মনিব বাড়িতে কুটুম ও পড়শিবাড়ির মহিলারা ভীড় জমাতো! এই ওই গানকে সামনে রেখেই বোধ হয় পরবর্তীতে প্রায় বিশ বছর পরে ১৯৭০ সালে রচিত হয়েছে:
কে যাস রে ভাটি গাঙ বাইয়া
আমার ভাইধন রে কইয়ো নাইওর নিতো বইলা!
.
আমি কাছারি ঘরে চলে আসার পর আর গান শুনতে পারিনি। কিভাবে যেন বাড়ির লোকজন টের পেয়ে গেছে, আমি পালিয়ে এসেছি। আমি পড়ালেখা করা ছাত্র। ব্যস আমার মেঠো কাজ বন্ধ হয়ে গেল। প্রস্তাব এল, বাড়ির ছেলেমেয়েদেরকে পড়ানোর! কাছেপিঠে কোনও ইশকুল-মাদরাসা নেই। বাড়িতেই লোজিং মাস্টার রেখে পড়ানোর নিয়ম। বেশিরভাগ ছেলেমেয়েই নিরক্ষর থেকে যায়! যাদের বাড়ির কেউ শহরে থাকে, পড়াশোনা করা কেউ থাকে, তারাই ঘরের ছেলেপিলেদের লেখাপড়ার কিছুটা উদ্যোগ গ্রহণ করে। শুরু হল নতুন জীবন। মাস্টারি করা। ছাত্রসংখ্যা এক দু’জন নয়! পুরো এক পল্টন। মনিব বাড়ি, পাশের বাড়ি, তার পাশের বাড়ি! পুরো গ্রাম! মসজিদের ইমামতিও জুটল! খাওয়া-দাওয়ার কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। অন্য বাড়িতে খাওয়া মনিব পছন্দ করতেন না! মনিবগিন্নি তো শুনতেই পারতেন! আমাদের হুজুরকে আমরা খাওয়াব! তোমাদের ছেলেপিলেদেরকে পড়ার সুযোগ করে দিয়েছি, এই ঢের! তারপরও কি মহিলাদের কোমল আবেগ ‘দাবায়া’ রাখা যায়? হুজুরের জন্যে কিছু একটা করতে না পারলে, ইহজনম বৃথা! এ বাড়ি থেকে পিঠা পাঠাচ্ছে, ও বাড়ি থেকে শিন্নি পাঠাচ্ছে! কিছু না কিছু আসার বহর লেগেই আছে! মধুর উৎপাতে জীবন চিৎপাত! কোন ছাত্রের মা আমার কাছে বেশি প্রিয় হবে, এ নিয়েও চাপা দ্বন্দ্ব শুরু হলো।
.
এলাকায় একজন বড় আলিমের বাড়ি ছিল। তিনি বড় এক মাদরাসায় শিক্ষকতা করতেন। ছুটিতে বাড়ি এসে আমাকে দেখলেন। সবকিছু জানার পর পরামর্শ দিলেন, তুমি কেন এখানে পড়ে আছ! সুন্দর ভবিষ্যত নষ্ট করছ? চলো আমার সাথে, আমাদের মাদরাসায় ভর্তি করিয়ে দেব! আমি এককথায় রাজি হয়ে গেলাম! জায়গীর বাড়িতে আমার সিদ্ধান্তের কথা জানালাম! তারা বেঁকে বসল! কিছুতেই আমাকে ছাড়বে না। হুজুরের শরনাপন্ন হলাম! তিনি সবার সাথে কথা বললেন! রাজি করাতে পারলেন না। আমি ঠিক করলাম, আবার পালাব! মতিগতি দেখে জায়গীর (লোজিং) বাড়ির কর্তা পাল্টা একটা প্রস্তাব দিলেন। তারা আমাকে সাইকেল কিনে দেবেন। আমি আসা যাওয়া করে পড়ব। এতে তাদের এই প্রত্যন্ত অঞ্চলের ছেলেমেয়েগুলো শিক্ষার আলো পাবে! কুরআন পড়া শিখতে পারবে! নইলে সব আগের মত মূর্খ থেকে যাবে!
হুজুর দেখলেন প্রস্তাবটা মন্দ নয়। সম্মতি দিলেন। তখনকার যুগে মাদরাসার তালিবে ইলমরা অনেকেই জায়গীরে থেকে লেখাপড়া করত। আশেপাশের ছোট ছোট বাচ্চাদেরকে লেখাপড়া শেখাত! এভাবেই আলিমগন গ্রামবাঙলায় শিক্ষাবিস্তারে কার্যকর ভূমিকা রেখে এসেছেন।
শুরু হল আবার পড়াশোনা। সাথে চলতে লাগলো শিক্ষকতা। এলাকায় গ্রহনযোগ্যতা আগের তুলনায় শতগুণ বেড়ে গেল। আব্বাজান কিভাবে কিভাবে খোঁজ পেয়ে আমার মাদরাসায় হাজির। তিনি কিছুতেই আমাকে ছাড়বেন না। সাথে করেই নিয়ে যাবেন। আমার যেতে ইচ্ছে হল না। সেটা সরাসরি আব্বাকে বলার হিম্মত হল না। তাকে আমার হুজুরের কাছে নিয়ে গেলাম। হুজুর আব্বাকে অনেক করে বোঝালেন! আব্বাজান যে শক্ত মানুষ! তাকে বুঝিয়ে নিজের মত থেকে টলাবে, এমন মানুষ পাওয়া ভার! আমি শেষে মরিয়া হয়ে বললাম, আপনি তাহলে আজ আমার সাথে চলুন! বিদায় নিয়ে আসি! তাতেও তিনি রাজি নয়! পরে কী ভেবে রাজি হলেন! নিয়ে গেলাম! জায়গীরদারকে সব খুলে বললাম! এককান দু’কান হতে হতে চারদিকে ছড়িয়ে গেল আমার চলে যাওয়ার কথা! চারদিক থেকে মানুষ এসে জড়ো হল। সবাই মিলে পারলে আব্বাজানের পায়ের উপর পড়ে, এমন অবস্থা! আব্বাজান শিক্ষিত মানুষ! তিনি বোধ হয় উপলব্ধি করলেন, এই অজপাড়াগাঁয়, আমার কারনে অনেকগুলো ছেলেমেয়ে কুরআন শরীফ পড়া শিখছে! অক্ষরজ্ঞান অর্জন করছে, কাজটা তুচ্ছ করার মত নয়! তিনি শিক্ষক! শিক্ষার গুরুত্ব বোঝেন! সে রাতে থাকলেন। সবাই তাকে মাথায় তুলে রাখল। আব্বা আমার পড়ানো দেখলেন। আশেপাশের মানুষের কাছ থেকে আমার সম্পর্কে রিপোর্ট নিলেন। ছাত্র-ছাত্রীদের পরীক্ষা নিলেন। আমার আসার আগে অবস্থা আর পরের অবস্থা সম্পর্কে খুঁটে খুঁটে প্রশ্ন করলেন। সকালে উঠে বললেন:
-তুই এখানেই থাক! তোর দ্বারা আল্লাহ তা‘আলা এলাকায় কুরআন কারীম শিক্ষা চালু করেছেন! এটা বহুত বড় সৌভাগ্যের বিষয়। তোর মা তোর জন্যে চিন্তা করতে করতে অসুস্থ হয়ে পড়েছে! তাকে সান্ত¡না দেয়ার জন্যে হলেও তোর একবার বাড়ি যাওয়া দরকার!
বাড়ি গেলাম। মাদরাসা খোলা, তাই দেরি না করে চলে এলাম। সামনে শুক্রবার দেখে বেড়াতে আসব! আম্মাকে আশ^স্ত করলাম! মনে আর কোনও গ্লানি রইল না। অপরাধবোধ রইল না। একমনে পড়াশোনা করতে লাগলাম। জায়গীর বাড়িতেও পড়ানোর কাজ চলতে লাগল। পাঞ্জেগানা থেকে মসজিদটা জামে মসজিদে রূপান্তরিত হল। সাথে সাথে আমারও উত্তরণ ঘটতে লাগল! এভাবেই দাওরা শেষ হল। হুজুরগন হুকুম করলেন মাদরাসার শিক্ষকতায় যোগ দিতে! যেখানে এতদিন পড়াশোনা করেছি সেখানেই শিক্ষকতার সুযোগ পাওয়া, আমার জন্যে অনেক আনন্দের! আব্বাজানও ভীষণ খুশী, ছেলে এমন বুযর্গানে কেরামের মাদরাসায় শিক্ষকতার সুযোগ পেয়েছে!
.
আম্মা অসুস্থ হয়ে পড়লেন। বাড়িতে তার সেবাযতœ করার কেউ নেই। বোনের বিয়ে হয়ে গেছে। আব্বাও বৃদ্ধ! চাকুরি থেকে রিটায়ার্ড করেছেন আরো আগে। আমাকে একটা সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আমি দেরি করলাম না। এতদিনের সমস্ত সম্পর্ক বন্ধনের মায়া ত্যাগ করে বাড়িয়ে চলে এলাম। মায়ের সেবার জন্যে মাদরাসা থেকেও সাময়িক অব্যাহতি নিলাম। আম্মু রোগশয্যায় থেকেই অন্যকিছুর কলকাঠি নাড়ছিলেন। বুঝেও না বোঝার ভান করলাম! বোন বেড়াতে এল। আব্বুও দুর্বল শরীরে, এখানে ওখানে যাচ্ছেন। অবস্থা যা দেখছি, আর বেশি দেরি নেই! আব্বু কী মনে করে একদিন আমাকে না জানিয়ে, আমার মাদরাসায় গেলেন। আমার ‘খাস’ উস্তাজের সাথে কথা বলে জানতে পারলেন, জায়গীর বাড়ি থেকে আমার উস্তাজকে একটা প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল। তিনি সময় সুযোগের অভাবে প্রস্তাবটা আব্বার কাছে পৌঁছাতে পারেন নি। আব্বাজান দেরি না করে হুজুরকে নিয়ে জায়গীর বাড়িতে গেলেন। ফিরে এসে আমার মতামত চাইলেন। আমার অমত করার কী আছে! পাত্রীকে সেই ছোটবেলা থেকে চিনি। আমার জীবনের প্রথম ছাত্রী। খেলার সাথীও বলা চলে। বাড়ির সবার ছোট! সবার আদরের! আদরে কিছুটা বাঁদরও হয়ে গিয়েছিল! প্রথম প্রথম তার বাঁদরামির কারনে আমার জীবনও অতিষ্ঠ হয়ে ওঠার যোগাড় হয়েছিল! আস্তে আস্তে তাকে পোষ মানাতে হয়েছিল! আমি নতুন করে মাদরাসায় পড়াশোনা করার পর, হুজুরদের হুকুমে পর্দা করতে শুরু করেছিলাম। সেও বড় হয়ে গিয়েছিল। তার বড় ভাইয়া থাকত ঢাকায়। তাকে সেখানে নিয়ে রেখেছিল। শহরে থেকে যেন কিছু আদব-সহবৎ শিখতে পারে! ভবিষ্যতে বিয়েশাদি দিতে সুবিধা হবে! আগের বোনদের বিয়েও এভাবে হয়েছে। শহরে নিয়ে যাওয়ার পর, ভাল ভাল সম্বন্ধ এসেছে। ছোট মেয়েরও এমনি হওয়ার কথা ছিল! ঈদে-চাঁদে বড়ভাই-ভাবীর সাথে গ্রামের বাড়িতে আসত! পর্দার আড়াল থেকে একবার কুশল বিনিময় করে যেত! ব্যস আর কোনও যোগাযোগ থাকত না! সে থাকত ভেতর বড়িতে! আমি থাকতাম সারাদিন মাদরাসায়! তারপর মসজিদে! শুধু খাবারের সময় টের পেতাম, বাড়তি যতেœর ছাপ! বুঝে নিতাম এটা গুরুর প্রতি শিষ্যার শ্রদ্ধার বহিঃপ্রকাশ!
.
আমরা ছিলাম নিম্ন মধ্যবিত্ত! বাবা সাধারণ একজন শিক্ষক। আমার স্ত্রীরা ছিল বনেদি বড়লোক! গ্রামে জন্ম হলেও সে শহরেও থেকে এসেছে! আমার মনে একটু খটকা ছিল, সে আমাদের গরীব পরিবারে মানিয়ে গুনিয়ে নিতে পারবে তো! আমি জায়গীর ছেড়ে চলে আসার পর, আম্মাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম! ওদিকের সাথে যোগযোগ রাখার সুযোগ পাইনি! আমার জন্যে পাত্রী দেখার হচ্ছে, এ-সংবাদ কিভাবে যেন জায়গীর বাড়িতে পৌঁছে গিয়েছিল! সে তখন বাড়িতে! ধানকাটা উপলক্ষ্যে শহর থেকে বেড়াতে এসেছে! সবকথা জানার পর, সে-ই আগে বেড়ে ভাবীকে বলেছে! আব্বু-আাম্মুর অমত না থাকলে, কারো মারফতে ‘ওনাদের’ বাড়িতে একটা প্রস্তাব পাঠানো যেতে পারে! ব্যস এটুকুই!
.
বিয়ের পর প্রথম দিকে আমার মনে হত, সে এ-বিয়েতে খুব খুশি! আম্মার অসুস্থতার খবর শুনে সে নাকি খুবই বিচলিত হয়ে পড়েছিল। আমার সাথে সরাসরি যোগাযোগ না থাকলেও, সে এদিকের খবরাখবর নিয়মিতই রাখত! মায়ের সেবার জন্যে সব ছেড়ে বাড়িতে এসে থিতু হয়েছি, এতে সে খুবই খুশি হয়েছে। আমার বিয়ের কথা ওঠার আগেও সে ভেবেছে, আমার একজন সঙ্গী দরকার! একটা ছেলের পক্ষে একা একা অসুস্থ মায়ের সেবা করা কঠিন!
আমার কাছেই সে তার অর্জিত শিক্ষার অনেকটা অর্জন করেছে! শহরে গেলেও সে কোনও প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হয়নি! বাসায় থেকেই বইপত্র পড়ত! ভাবীর কাজে সাহায্য করত! সেলাইফোঁড় শিখত! আমার প্রতি একটা কৃতজ্ঞতাবোধ থেকেই সে পাশে দাঁড়াতে চেয়েছে! আলহামদুলিল্লাহ! সে খুব ভালভাবেই আমার পাশে দাঁড়িয়েছে! তার অক্লান্ত সেবাশ্রমেই আম্মা শেষ ক’টা দিন আরামে কাটিয়েছেন। আব্বাও পুত্রবধূর প্রতি ভীষণ কৃতজ্ঞ ছিলেন!
.
তার মধ্যে প্রথম পরিবর্তন দেখি এক ঈদে বাপের বাড়ি যাওয়ার পর! তার বোনেরা সবাই বড়লোক! ভগ্নিপতিরা অর্থবিত্তের অধিকারী। তাদের তুলনায় আমি কিছুই না। একদম না। কোনও বোন হয়তো তাকে কানপড়া দিয়েছে! তার মধ্যে অর্থের মোহ ঢুকিয়ে দিয়েছে! বেড়ানো শেষে তাকে নিয়ে এলাম। লক্ষ্য করলাম, সে সারাদিন কেমন যেন গোমড়া গোমড়া হয়ে থাকে! আস্তে আস্তে সে নানা অভাবের কথা বলতে শুরু করল! এটা নেই, ওটা নেই! দিনদিন বেড়েই চলল তার নাই নাই ভাব! আমি মাদরাসায় পড়াই! তার এতকিছুর চাহিদা পূরণ কিভাবে করি! আর এতদিন তো সে অভাব-অনটনের মধ্যেই সুখী হয়ে ছিল! হঠাৎ কেন তার এই পরিবর্তন! নতুন এক উপসর্গ দেখা দিল, তার মধ্যে আমাকে ছেড়ে বাপের বাড়ি থাকার প্রবণতা আশংকাজনক হারে বেড়ে গেল। বাধ্য হয়ে রেখে এলাম! দিনের পর দিন আমি ঘরে একা একা থেকেছি! তাকে আনতে গেলে, সে আমার সাথে দেখা করেনি! খালি হাতে ফিরে এসেছি!
.
দিনরাত আল্লাহর কাছে দু‘আ করেছি। কিছুদিন পর আমার শাশুড়ি মারা গেলেন। তারপর শ্বশুর আবার বিয়ে করেছেন। ও তখনো বাপের বাড়িতে! একদিন ভোর রাতে উঠে আমার আচানক মনে হল, সৎ মায়ের সাথে থাকতে তার হয়ত ভাল লাগছে না! দেখি না চেষ্টা করে! দেরী না করে তাকে আনতে গেলাম! এবার আর দ্বিমত করল না। আল্লাহ তা‘আলা তাকে সুমতি দিয়েছেন। বাড়িতে এসেই, গত দু’বছর সে আমার সাথে যে আচরণ করেছে, তা পুষিয়ে দেয়ার জন্যে উঠেপড়ে লাগল। তার এতসব অবহেলা অনাদর সত্বেও আমি তার সাথে কোনও খারাপ আচরণ করিনি, রাগ দেখাইনি! আবার বিয়ে করে ফেলিনি, লজ্জা শরমের মাথা খেয়ে বারবার তাকে বুঝিয়ে শুনিয়ে ফিরিয়ে আনতে গিয়ে ব্যর্থ হয়েও হাল ছাড়িনি! এ-বিষয়টা তার মনে গভীর রেখাপাত করেছে! এতদিন তার উপেক্ষামূলক আচরণের কারণে জীবনের প্রতি বিতৃষ্ণ হয়ে উঠেছিলাম! এবার তার অতি আদর-যত্নের ধাক্কায় জীবন অতিষ্ঠ (!) হয়ে উঠল! হারিয়ে যাওয়া দু’বছরের সেবাযত্ন একসাথে করে ফেলতে চাইছিল! তার দেখাদেখি আমার মধ্যেও কেমন যেন বোধ তৈরি হল। আমিও তাকে আগের চেয়ে বেশি ভালবাসতে শুরু করলাম!
.
.
.
আমাদের একটা চোখ সব সময় হুজুরের দিকে পড়ে থাকত! হুজুর কখন বাড়ি যাবেন! বুড়া হুজুর বাড়িতে যাওয়ার পর বুড়িমা যেখানেই থাকতেন, চিলের মত ছুটে চলে আসতেন। ঘরে প্রবেশ করেই দরজা বন্ধ করে দিতেন। একটু পর হুজুর আবার ফিরে আসতেন! মাদরাসার বড় ভাইয়েরা দুষ্টুমি করে তাদের নাম দিয়েছিলেন: ‘চাঁইয়াঁ’। মানে চড়ুই দম্পতি। শুধু তাই নয়, আসরের নামাজের পর, মাতবাখ থেকে ভাত উঠিয়েই আমরা সবাই দৌড় দিতাম মাদরাসার পুরনো মসজিদের দিকে। সেখানে অনেক চড়ুই পাখির বাসা। প্রতিদিন না পারলেও প্রায়ই চড়ুই ধরে নিয়ে আসতাম। বুড়ো হুজুরকে দিলে কী যে খুশি হতেন, বলে বোঝানোর মত নয়! সবার মধ্যে একটা কথা প্রচলিত ছিল:
-হুজুর নিয়মিত চড়ুই পাখির গোশত খান বলেই, বুড়ো বয়েসেও
এত……!!!
.
দীর্ঘদিন এমন ধারনাই ভেতরে বেশ পোক্ত ছিল, চড়ুই পাখির গোশতে বিশেষ ‘শক্তি’ আছে। খেলে ‘মুর্দা’ যিন্দা হয়ে ওঠে! কারণ পুরুষ চড়ুইকে দেখা যায়, একটু পরপরই চড়ুইনির উপর চড়াও হচ্ছে! অফুরন্ত ‘শক্তি’ না থাকলে এতবার কী করে সম্ভব?
অনেক দিন পর, এই কিছুদিন আগে জানতে পেরেছি, এটা চরম একটা ভুল ধারনা! চড়ুইয়ের গোশতে বাড়তি কোনও ‘শক্তি’ নিহিত নেই!
মি. চড়ুই বারবার তার মিসেসের উপর চড়াও হওয়ার কারণ আর কিছুই না,
= ‘অদক্ষতা’।
বেচারা সুবিধা করতে পারে না! আসলে বেচারাকে দোষ দিয়েইবা কী হবে! চড়ুইনি ছোট্ট পাখি! তার সবকিছুই তো ছোট্ট! চড়ুই সারাক্ষণ যা তিড়িং বিড়িং করে, সুবিধা করে ওঠা মুশকিল! এটাকেই সাধারন মানুষ ভুল অর্থে গ্রহণ করে!
.
আমাদের হাতে কখনো একাধিক চড়ুইও ধরা পড়ত। বুড়িমা তখন আমাদেরকে চড়ুইভাতিতে দাওয়াত দিতেন। সাধারন সালুন দিয়ে কব্জি ডুবিয়ে পেটপুরে চেটেপুটে সব ভাত খেয়ে ফেলতাম। চড়ুইয়ের গোশত পাতে দিতে গেলে আমরা ফনা তোলা ‘পানখ সাপ’ দেখার মত চমকে উঠতাম! ভীষণ জোরে মাথা নেড়ে অনীহা প্রকাশ করতাম! এ-বিপদজনক গোশত এখন খাওয়া কি নিরাপদ! পরে ‘অনাকাঙ্খিত’ পরিস্থিতি সামাল দেব কী করে? এমনি আরো কত ‘চিন্তা’ আর অমূলক ‘আশংকা’, এখন ভাবলেও হাসি পায়! ওসব চড়ুই-ফড়ুই কিছু না, মনে রঙ থাকলে, বেশি বেশি ‘ভালবাসতে’ সমস্যা হয় না। বয়েসও কোনও ব্যাপার না!
.
তারা ছিলেন ‘মেড ফর ইচ আদার’। বুড়া হুজুর সপ্তাহে একদিন শহরে যেতেন। তাবলীগের মারকাজে শবগুজারি করতে যেতেন। প্রায়ই এমন হয়েছে, হুজুর রাতের বেলা সবাই ঘুমিয়ে পড়লে, প্রায় দশ কিলোমিটার হেঁটে বাড়ি চলে এসেছেন। থাকতে পারেন নি। শবগুজারিতে গেলে, হুজুর আমাদের ছোটদের তিনজনকে ঘরে রেখে যেতেন। জামাত করে নামায পড়তে সুবিধা হবে, তাই তিনজন। সে এক অবিশ^াস্য আনন্দজনক স্মৃতি। প্রতি বৃহস্পতিবারে কোনও তিনজন থাকবে, সেটা নিয়েও পুরো সপ্তাহ জুড়ে চাপা উত্তেজনা বিরাজ করত। গোপনে প্রতিযোগিতা চলত, কে বেশি চড়ুই ধরতে পারে! তাহলে বুড়িমার কাছে প্রিয় হওয়া যাবে। পরবর্তী তিন ক্যান্ডিডেট’ নির্বাচন হতো হুজুরদের নৈশ ‘সংসদ’-এর গোপন ‘ব্যালটে’! নিজের অবস্থান টিকিয়ে রাখতে সপ্তাহ জুড়ে চড়ুইসংযোগে জনসংযোগ চালাতে হত! আহা বেচারা চড়ুই!!
বৃহস্পতিবার আসরের আগে করে হুজুর বের হতেন। পরদিন ফজর পড়ে চলে আসবেন! এই সামান্য সময়ের বিরহেও দু’জন কী যে অসম্ভব কাতর হয়ে পড়তেন! বলে বোঝানোর মত নয়। বুড়িমা নয়ন জলে ভাসতেন, বুড়া হুজুরও রুমালে চোখের কোন মুছতে মুছতে বগলে ছাতা নিয়ে কোনাকুনি পথ ধরতেন। সে এক দেখার মত দৃশ্য। আমরা হুজুরকে বড় রাস্তা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আসতাম। মাগরিব পড়ে ঘরে ফিরতাম! এর মধ্যে বুড়িমা আমাদের জন্যে নাস্তা তৈয়ার করে ফেলেছেন। পুত্রবধূ এসব কাজে অংশ নিত না। আলাদা ঘরে থাকত! ওটা ছিল এক অদ্ভুত ‘চরিত্র’। হুজুর যাওয়ার সময় পই পই করে বলে যেতেন:
-গল্পগুজবে সময় নষ্ট না করে পড়বে! খোশখত (সুন্দর লিপি) লিখবে।
হুজুর সুন্দর কলম বানাতে পারতেন। বুড়িমারহাতে বানানো কলম ছিল আরো লা-জবাব! বুড়িমা নিজেই বাঁশঝাড়ে চলে যেতেন। বেছে বেছে ‘বাতি’ দেখে বাঁশের ছিপ এনে কলম বানিয়ে দিতেন। কয়লা গুড়ো পানিতে গুলে কিভাবে যেন ঘন করে কালি বানিয়ে দিতেন। আমরা লিখতে বসলে তিনি পাশে থেকে দেখতেন। গুটুর গুটুর পান চিবুতেন আর গুজুর গুজুর গল্প বলতেন। রাতে ঈশার পরপরই আমাদেরকে খাইয়ে-দাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিতেন। তারপর তিনি উঠোনে মাদুর পেতে বসে থাকতেন। আমাদের বুঝতে বেগ পেতে হতো না, তিনি হুজুরের অভাব বোধ করছেন। রাতে একা একা তার ঘুম আসবে না। এভাবে সারা রাত জেগে বসে থাকবেন। তাসবীহ পড়বেন। নামাজ পড়বেন। সারা উঠানময় হেঁটে বেড়াবেন! কোনও কোনও এক অপ্রত্যাশিত রাতে, বুড়া হুজুর চলে আসেন। চাঁদের আলোয় দু’জনে একজন আরেকজনের হাত ধরে, একে অপরের দিকে চেয়ে আছেন! দীর্ঘ সময় ধরে! এমন দৃশ্য নিজ চোখে দেখার দুর্লভ সৌভাগ্য হয়েছে! হুজুর ঘরে এসেই কল চেপে হাত-পা ধুতেন। সে রাতেও তাই করলেন। আমাদের ঘুম ভেঙে গেল। তারপর ঘটল সেই অপার্থিব দৃশ্য! আচ্ছা, তারা দু’জনে অপরের মুখের বলিরেখার মধ্যে কী খুঁজে বেড়াত এত দীর্ঘ সময় ধরে! চাদের মায়াবী আবছা আলোয়? আমরা বেড়ার এপাশে! তারা ওপাশে!
.
দু’জনের অকৃত্রিম ভালোবাসার মধ্যে সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুর ঘটনাও নিয়ত ঘটে চলেছিল। হুজুরের ছেলে আর বউয়ের মাঝে বনিবনা হচ্ছিল না। পুত্রবধূটাকে হিংসুটে মনে হত আমাদের কাছে। আমরা ঘরে গেলে, বুড়িমা কত আদর করতেন! কিন্তু বৌটি এসবের ধার ধারত না। উল্টো শাশুড়ির আচরণকে আদিখ্যেত বলে নাক সিঁটকাত!
বুড়োবুড়ির এমন রুদ্ধদ্বার দাম্পত্যসুখ যোয়ান-যোয়ানির সহ্য হচ্ছিল না। তাদের মনে হয়তো খেদ ছিল, তাদের কী হলো? তারা কেন তাগড়া শরীরেও ঠিকমত বাগড়া দিতে পারছে না? ছেলে যতই দুষ্ট হোক, মা-বাবাকে অশ্রদ্ধা করতে পারে না। কিন্তু হুজুরের পুত্রবধূটা যে দজ্জাল ধরনের। শ্বশুর-শাশুড়ির যখন-তখন রুদ্ধদ্বার প্রণয় তার হজম হলো না। নানাভাবে মনের কেনা উদ্ধার করতে লাগল। ছেলেও তার চণ্ডালমার্কা বিবিকে খোঁটা দেয়,
-দেখ, আম্মু এত বয়েস হয়ে যাওয়ার পরও, কিভাবে আব্বুকে ভালবাসে! তোমার কী যে হল! ভরা যৌবনেও তোমার কোনও কিছুতে আগ্রহ খুঁজে পাই না। কেমন শীতল, নিস্পৃহ তুমি! মাঝে মধ্যে মনে হয়, তুমি বোধ হয় নারী নও, আস্ত একটা মরদ!
-বিয়ের সময় তো আমাকে নারী মনে করেই আকদ করার জন্যে উঠেপড়ে লেগেছিলে!
-তখন কি আর বুঝতে পেরেছিলাম, আমি এক নিরুত্তাপ শীতলা বুড়িকে বিয়ে করতে যাচ্ছি!
এসব ঝগড়া মাঝেমধ্যে আমাদের সামনেই লেগে যেত। বুড়িমা দেখেও না দেখার ভান করতেন। বউ তার বুড়ি শাশুড়িকে মনের মতো করে জব্দ করতে না পেরে ভেতরে ফুলতে ফুলতে থাকত! স্বামীকে বেশি কিছু বলতে পারত না! শাশুড়ির উপর তার ঝাল ঝাড়ত! বুড়িমা ধৈর্যের প্রতিমূর্তি! অচঞ্চল! তিনি কারো কাছে অভিযোগ করেন না। শুধু বড় মেয়েটা নাইওর এলে, তাকে মনের কথা খুলে বলেন।
.
বুড়িমা তার জীবন নিয়ে খুবই সুখী! শুধু বৌমার আচরণটা মাঝেমধ্যে অসহ্য হয়ে যায়! কী আর করা, একজন মানুষ সব দিক থেকে সুখী হতে পারে না! বুড়িমা এক বৃহস্পতিবার রাতে আমাদেরকে ভাত বেড়ে দিতে দিতে বলেছিলেন!
-আমার বৌমাটা আল্লাহ কেন এমন করেছেন তোরা জানিস?
-জি¦ না! কেন এমন করেছেন?
-আমার পাপের প্রায়শ্চিতত্ত করার জন্যে!
-আপনি এত ভাল মানুষ, আপনার আবার কিসের পাপ!
-ঐ যে বিয়ের পর তোদের হুজুরের সাথে দু’বছর দুর্ব্যবহার করেছিলাম! সে পাপ! মৃত্যু পর্যন্ত আমাকে এ-পাপের প্রায়শ্চিত্ত করে যেতে হবে! আমি ‘তার’ কাছে, আমার সেই অন্যায় আচরণের জন্যে হাজারবারেরও বেশি ক্ষমা চেয়েছি! তারপরও এমন ফিরিশতাতুল্য মানুষকে কষ্ট দেয়া আল্লাহর বোধ হয় পছন্দ হয়নি! দুনিয়াতেই তার ফল ভোগ করাচ্ছেন!
.
সপ্তাহের শেষ দিন। হুজুর মারকাযে যাবেন। শবগুজারিতে। বুড়িমা রাতের জন্যে শুকনো খাবার তৈরী করে দেবেন। তার যোগাড় যন্ত্র করছেন। একটু আগে বাজার থেকে মিঠাই এনে হুজুরকে দিয়েছি! হুজুর আমাদেরকে পড়া দিয়ে মিঠাই নিয়ে ঘরে গেলেন। বুড়িমা যথারীতি এগিয়ে এসে স্বামীকে বরণ করে নিলেন। হাত ধরে ঘরে নিয়ে গেলেন! দরজাটা ভেজিয়ে দিলেন…….!
হুজুর কিছুক্ষণ পর মাদরাসায় ফিরে এসে আমাকে পাঠালেন। গরুটা মাঠে বাঁধা আছে। নিয়ে আসতে হবে। আজকের দুধটা দোহানো হয়নি। নাতির জন্যে সেমাই রান্না করতে দুধ লাগবে! এক দৌড়ে গিয়ে গরু নিয়ে এলাম। বাছুরটা বাঁধা ছিল। রশি ছুটিয়ে তার মায়ের কাছে নিয়ে এলাম! ওলানে মুখ লাগিয়ে পানিয়ে বাছুরটাকে আবার বেঁধে রাখলাম! বুড়িমা ছোট্ট একটা বালতি নিয়ে এসে পিঁড়িতে বসলেন। দুধ দোহানো শুরু করবেন, এমন সময় তার পুত্রবধূ এসে হাজির! বলা-কওয়া ছাড়াই হ্যাঁচকা টানে বুড়িমার হাত থেকে বালতিটা একপ্রকার ছিনিয়ে নিলেন! দাঁত কিড়মিড় করে হিসহিসিয়ে বললেন:
-এ-অবস্থায় দুধ দোহাতে এসেছেন? এতক্ষণ দরজা বন্ধ করে কী করেছেন না করেছেন, আল্লাহই জানেন! আপনার ঘিন-পিত না থাকতে পারে, আমাদের আছে! এ-দুধ দিয়ে মা‘সুম বাচ্চার সেমাই রান্না করব? যান যান,আগে গোসল করে আসুন!