ছোটগল্প/উপন্যাস

খাইরু মাতা‘-গুণাইবিবি!

গতকাল ফেনিতে ওলামা বাজার হযরতের জানাযায় গেলাম। রীতিমতো অসাধ্য সাধন করেই ঢাকা থেকে সোজা ওলামাবাজার পৌঁছেছি। অপেক্ষা করছি। কোথাও বসার জায়গা নেই। তাই দাঁড়িয়ে আছি। রাস্তার ওপর। তখন আরেকজন হযুরের কথা মনে পড়লো। তিনি গতবছর মারা গেছেন। এই মুহূর্তে তার নামটা মনে আসছে না। না আসুক। নাম নয় কামটাই জরুরী। সে-হুযুরের কিছু কথা বলা যাক।

ওয়াজ শুনতে বসেছি। গ্রাম-বাঙলার ঐতিহ্যবাহী শীতকালীন ওয়াজ। নিচে শুকনো খড় বিছানো। মাথায় ওপর শামিয়ানা। বাঁশের খুঁটিতে ছোট্ট বোর্ডে লেখা:

  • মনোযোগ সহকারে ওয়াজ শ্রবন করুন।
  • মাহফিলের পবিত্রতা রক্ষা করুন।
  • মুকাব্বির।
  • হালাল রিযিক ভক্ষণ করুন।
  • পর্দা মেনে চলুন…

এমনি আরো নানা বক্তব্য। আমার একটা শখ হলো, ওয়াজ শুনতে গিয়ে এসব বক্তব্যগুলো আগে পড়া। হাতের কাজগুলো লক্ষ্য করা। কোনটার আর্ট কেমন হয়েছে সেটা তুলনা করা। এবার কোন বোর্ডটা নতুন করে লেখা হয়েছে, সেই মান্ধাতা আমলে লেখা হয়েছে কোনটা, সেটা বের করা। এটা না করলে, মনে হয় ওয়াজ শুনতে আসাটা পূর্ণতা পেল না। চালতা-জলপাই-আলুসেদ্ধ-এর কথা বলতে গেলে রাত পোহাবে। সেটা আরেক দিনের জন্যে তোলা থাক!

ওয়াজ শুরু হলো। এর মধ্যে দুইটা অধিবেশন হয়ে গেছে। এখন ইশার পর। গুরুত্বপূর্ণ কোনও হুজুর এখন বসবেন। আমরা অধীর হয়ে অপেক্ষা করছি। এরই মধ্যে উপরের শামিয়ানা ভিজে চুইয়ে চুইয়ে টুপটুপ শিশির ঝরতে শুরু করেছে। অবসান ঘটলো প্রতীক্ষার। একজন সৌম্যদর্শন বৃদ্ধ এলেন। আগে তাকে কখনো দেখিনি। তার কথা শোনার সৌভাগ্যও হয়নি। তাই আগে থেকে ধারনা করতে পারছিলাম না, তিনি কেমন কথা বলবেন।

আমাদের গ্রামের ওয়াজ মাহফিলগুলোতে,  এধরনের হুযুরগন সাধারণত আখেরাত, আত্মশুদ্ধি, পীর-মুরিদী ইত্যাদি বিষয় নিয়েই কথা বলেন। এবং মানুষের ওপর বেশ ভাল প্রভাবও পড়ে। ওয়াজ শুরু করলেন। হাদীস পড়লেন:
= দুনিয়ার সেরা সম্পদ হলো উত্তম স্ত্রী।

হুযুর হাদীসের সামান্য ব্যাখ্যা করেই, ব্যক্তিগত স্মৃতিতে চলে গেলেন। ওয়াজ করলেন অল্পসময়। এরমধ্যে তার কিছু জীবনদর্শনও জানা হয়ে গেলো। বাড়ি এসে হুযুরের ওয়াজের কথা বললাম।

-ওমা তাই নাকি! এমন মানুষের সাথে তো একবার দেখা করা জরুরী! তাহলে আমিও শিখতে পারতাম অনেক কিছু! নিয়ে যাবেন?
-সুযোগ থাকলে অবশ্যই নিয়ে যেতাম। তুমি হুযুরনীর কাছ থেকে শিখতে। আমি হুযুরের কাছ থেকে!

হুযুরের কথায় ফিরে আসা যাক। হুযুর অবশ্য খাঁটি চোস্ত ফেনির ভাষাতেই ওয়াজ করেন। কথা বলেন। কোনও রকমের মিশেল দেয়া ছাড়াই। তার পুরো কথায়, একটাও ফেনির আঞ্চলিক ভাষার বাইরের শব্দ উচ্চারণ করতে দেখিনি। একেবারে গ্রামীন। মাটির মানুষ। যাবতীয় আধুনিকতার ছোঁয়ামুক্ত।

(এক)

শীতকাল এলে বিভিন্ন মাদরাসায় ওয়াজে যেতে হয়। দূর-দূরান্তে। অনেক সময় ফিরতে ফিরতে রাত গভীর হয়ে যায়। যিকির করতে করতে চলে আসি। এসেই দেখি হাতমুখ ধোয়ার জন্যে প্রস্তুত! আমি অবাক!
-এতক্ষণ তো চুলা গরম থাকার কথা নয়?
-হিয়ান আন্নে বুইজতেন্ন! মন গরম থাইকলে, হানিও গরম রাখন যায়!
-কেন্নে গরম রাইখ্স এক্কান ক-না!
-আপনি বলেছিলেন রাত গভীর হয়ে যাবে। তাই পানিটা গরম করে, ন্যাকড়া পেঁচিয়ে, কুঁড়ার বস্তার মধ্যে ঢুকিয়ে রেখেছি। তারপর কাঁথা দিয়ে ভাল করে ঢেকে দিয়েছি। আমি নানুর কাছে শিখেছি এটা। নানুকেও দেখেছি নানার জন্যে এভাবে পানি গরম রাখতেন। নানা মাদরাসা থেকে হেঁটে হেঁটে ফিরতে অনেক রাত হয়ে যেতো!

(দুই)

মাদরাসার ধান তুলতে গিয়েছি। প্রায় দশ কিলোমিটার দূরের চর এলাকায়। সারাদিনের ক্লান্তিতে শরীর ভেঙে আসছিল। ঘরে এসে বসতে না বসতেই জগে করে ঠান্ডা ডাবের পানি নিয়ে উনি হাজির। বিস্ময়ভরা প্রশ্ন মুখ দিয়ে অজান্তেই বেরিয়ে গেলো:
-এত ঠান্ডা ডাব কোথায় পেলে?
-পুকুরের কাঁদার মধ্যে পুঁতে ইট চাপা দিয়ে রেখেছিলাম।

(তিন)

মাদরাসার কাজে যতদূরেই যেতাম! পইপই করে বলে দিতেন, যেন ফিরে আসি। এমনো হয়েছে, ঢাকা গিয়েছি। কাজ শেষ হয়নি। আরেকদিনের কাজ বাকী থেকে গেছে। ‘উনার’ কতামতো চলে এসেছি। পরদিন ভোরে ভোরে আবার ঢাকা গিয়ে কাজ সেরে এসেছি।

(চার)

তার ওয়াজ শোনার শখ। কাছেপিঠে কোথাও ওয়াজ হলে, রিকশায় করে নিয়ে যেতাম। সেই মাদরাসার পাশের কোনও বাড়িতে নিয়ে রাখতাম। ওয়াজ শেষ হলে দু’জনে আবার রিকশায় চড়ে ফিরতাম। উনি অন্য কারো ওয়াজ শুনতে পছন্দ করেননা। শুধু আমার ওয়াজই শুনেন। এজন্য প্রায় প্রতিটি ওয়াজই আমি তাকে উদ্দেশ্য করেই করতাম। কারন এই একজন মানুষের জন্যে আমি অনেক কিছুই করতে পারি। দূরে কোথাও ওয়াজ হলে, তাকে নিয়ে যেতে পারতাম না। তখন শ্রোতাদের অবস্থা বুঝে ওয়াজ করতাম। না না, আমরা নিজের খরচেই ওয়াজে যেতাম, আসতামও নিজের খরচে। আর ওয়াজ করে টাকা নেয়ার তো প্রশ্নই আসে না।

(পাঁচ)

গ্রামের মাদরাসা। বাবুর্চির সংকট লেগেই থাকে। উনি নিজেই তালিবে ইলমদের জন্যে রান্না-বান্না করে দিতেন। তারা বিকেলে খাওয়ার জন্যে আমাদের জমির ধান দিয়ে মুড়ি ভেঙে দিতেন। ছোট ছোট ছাত্রদেরকে ঘরে ডেকে এনে নিজে বেড়ে খাওয়াতেন। নিজের সন্তানদের মতো করে।

(ছয়)

আমি মাদরাসা থেকে কোনও বেতন নিই না। এটা তিনি খুবই পছন্দ করতেন। তাই তিনি চেষ্টা করতেন, সংসারে দুটো পয়সা কিভাবে রোজগার করা যায়। তিনি চাটাই বানাতেন। নারকেল বিক্রি করতেন। লাউ বিক্রি করতেন। আরও কতো কিছু যে তিনি করতেন। শুধু আমার জন্যে ও মাদরাসার জন্যে। মাদরাসার কোনও ছোট তালিবে ইলম অসুস্থ হলে, তিনি তাকে ঘরে আনিয়ে নিতেন। রাতদিন নিজের সন্তানের মতো সেবা-শুশ্রুষা করে সারিয়ে তুলতেন। তার কাছে নিজের সন্তান যেমন আদর পেতো, মাদরাসার প্রতিটি তালিবে ইলমও তেমন আদর পেতো।

(সাত)

সবাই বাপের বাড়িতে গেলে, নিজের স্বামী-সন্তানের জন্যে এটা-সেটা নিয়ে আসে। আর উনি স্বামী-সন্তানের পাশাপাশি মাদরাসার তালিবে ইলমদের জন্যেও কিছু না কিছু নিয়ে আসতেন।

(আট)

মাদরাসা ছুটি হলে, সাধারণত ছাত্ররা বাড়িতে চলে যায়। কিন্তু আমাদের এখানে ব্যতিক্রম চিত্র দেখা যেতো। ছাত্ররা বাড়ি যেতে চাইত না। তারা তাদের আম্মাজির কাছে থেকে যেতে চাইতো। অনেক সময় জোর করে পাঠাতে হতো। গেলেও ছাত্ররা পড়ার কথা বলে দুয়েকদিন আগে চলে আসতো। আম্মাজির কাছে দুটোদিন থাকবে বলে।

(নয়)

আমি অসুস্থ হয়েছি, তিনি রাতটা ঘুমিয়ে কাটিয়েছেন, এমনটা কখনো হয়নি। তাকে যতই ঘুমুতে বলি, তিনি সেই একই উত্তর দিতেন:
-ঘুম না আসলে শুধু শুধু শুয়ে থেকে কী লাভ!

বসে বসে কখনো আমার মাথা টিপে দিতেন। কখনো হাতের মটকা ফুটিয়ে দিতেন। কখনো পা টিপে দিতেন। এমনটা অবশ্য প্রতি রাতেই করতেন। নিষেধ করলেও শুনতেন না। বলতেন:
-সারাদিন মাদরাসার কাজে কত দৌড়াদৌড়ি করেন। হাত-পা ব্যথা হয়ে যাবার কথা নয়? শরীরে ব্যথা থাকলে ঘুম আসবে? আরাম করে না ঘুমুতে পারলে আগামীকাল মাদরাসায় সবক পড়াবেন কী করে? এরপর আর কথা চলে না।

(দশ)

বছরের শেষ দিকে মাদরাসার ভীষণ টানাটানি পড়ে যায়। হুযুরদের বেতন তো দূরের কথা, তালিবে ইলমদের দৈনিক খাবারের চাল কেনার টাকাও থাকে না। তখন উনি কোত্থেকে যেন একথোক টাকা বের করে আমার হাতে দিতেন। বলতেন:
-এগুলো খরচ করুন। ইনশাআল্লাহ আল্লাহ বরকত দিবেন!
-তুমি এতটাকা কোথায় পেলে?
একবছর একরকম উত্তর হতো। কোনও বছর বলতেন: কানের দুলটা বিক্রি করে দিয়েছি। কোনওবার বলতেন: সারা বছর লাই-পেপে-নারকেল-মোস্তাকপাতা বিক্রি করে জমিয়েছি। বছরের শেষের দিকে কথা ভেবে।

(এগার)

সকালে রান্না করার তরকারী না থাকলে, পুকুরে জাল মারতে হতো। তাহাজ্জুদের ওজু করতে গেলে, উনি ‘নুই’ দিয়ে আসতেন। আমি আমি জাল মারতাম, কিন্তু আমাকে জাল টেনে তুলতে দিতেন না। ঠান্ডা পানিতে আমার কষ্ট হবে তাই। তিনিই আস্তে আস্তে জাল তুলতেন। বেশ দক্ষতার সাথেই তিনি কাজটা করতে পারতেন। তার কথা ছিল:
-আপনি বাইরের কাজে সারাদিন কষ্ট করেন! ঘরে আপনার তেমন কোনও খায়-খেদমত করতে পারি না! বাইরের কষ্ট কমানোর সাধ্য আমার নেই, কিন্তু ঘরের কষ্ট কমানোর সাধ্য তো আমার আছে! আমার জাল যদি আপনারটার মতো সুন্দর করে গোল হয়ে পড়তো, তাহলে আপনাকে জাল মারার কষ্টটুকুও দিতাম না।

কথা বলতে বলতে হুযুরের গলাটা ধরে এলো। পরম কৃতজ্ঞতায় আপ্লুত স্বরে বললেন:
-আমাদের নবীজি ঠিক কথাই বলে গেছেন। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সম্পদ হলো; নেককার বিবি।

এমন ভর মজলিসেই তিনি বাকরুদ্ধ কণ্ঠে বললেন:
-আল্লাহর বান্দী আল্লাহর কাছে চলে গেছেন। আমাকে একা রেখে। আমি বুড়া মানুষ! সারাজীবন তার সাথে থেকে, এখন একা একা কিভাবে থাকি! আপনার সবাই তার জন্যে দু‘আ করবেন।


-শাইখ আতিক উল্লাহ

ইসলামিক ইমেইল নিউজলেটার
নতুন পোস্ট প্রকাশিত হলে সরাসরি আপনার ই-মেইল ইনবক্সে পেতে সাবস্ক্রাইব করুন।
icon

১টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

Back to top button