সাম্প্রতিক প্রসঙ্গ

মূর্তি অপসারণ ও পুনঃস্থাপন

সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের ঈমান-আক্বীদার প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলী দেখিয়ে দেশের সর্বোচ্চ আদালতের সামনে তলোয়ারধারী ও শাড়ি পরিহিতা গ্রীক পুরাণে বর্ণিত বিচারের দেবী থেমিসের ভাষ্কর্য বা মূর্তি উঠানো হয়েছিল ২০১৬ সালের ১৮ই ডিসেম্বর রবিবার গভীর রাতে। ইসলামী জনতার তীব্র প্রতিবাদের মুখে সেটা নামানো হয় ৫ মাস ৬ দিন পর ২৫শে মে ২০১৭ বৃহস্পতিবার দিবাগত রাতে। ফের সেটি উঠানো হয় ৪৮ ঘণ্টা পর সুপ্রীম কোর্টের বর্ধিত (অ্যানেক্স) ভবনের সামনে ২৭শে মে শনিবার দিবাগত রাতে ১লা রামাযানের তারাবীহর সময়ে কড়া পুলিশী নিরাপত্তার মধ্যে। ভাষ্কর মৃণাল হক-এর ধর্ম পরিচয় জানি না। তবে তিনি তার স্ত্রী-সন্তান সহ আমেরিকার নাগরিক। ইতিপূর্বে ২০০৮ সালে তিনি ঢাকা বিমান বন্দরে হাজী ক্যাম্পের সামনে নাস্তিক ‘লালন’ ফকীরের ভাষ্কর্য বানিয়েছিলেন। তখনও ইসলামী জনতার প্রতিবাদের মুখে সরকার সেটি ভেঙ্গে ফেলতে বাধ্য হয়। বাংলাদেশ চারুশিল্প সংসদের সেক্রেটারী প্রফেসর মনীরুযযামান বলেন, ‘মৃণাল হক ঢাকা শহরের যেখানেই ভাষ্কর্য নির্মাণ করেছেন, সেখানেই বিতর্ক হয়েছে’। বাম চেতনায় বিশ্বাসী প্রফেসর সলীমুল্লাহ খান বলেন, ‘সুপ্রীম কোর্ট বিল্ডিং নিজেই একটি অনন্য ভাষ্কর্য। তার সম্মুখে গ্রীক মূর্তি বসিয়ে সুপ্রীম কোর্ট বিল্ডিং-এর সৌন্দর্য বিনষ্ট করা হয়েছে। যারা ঐ ভাষ্কর্য সরানোর বিরুদ্ধে আন্দোলন করছে, তাদের সঙ্গে এদেশের জনগণ থাকবে না’।

ভাষ্কর্য সরানোর সময় মৃণাল হক নাকি হু হু করে কেঁদেছেন। তার অনুসারী দেশের বিশিষ্ট নাগরিক বলে খ্যাত কয়েকজন চিহ্নিত ব্যক্তি কেঁদে-কেটে বিবৃতি দিয়েছেন। স্বাধীনতার চেতনা গেল, সাম্প্রদায়িকতার জয় হ’ল ইত্যাদি বলে চিৎকার করেছেন। ৭২-এর সংবিধানের দোহাই দাতা ও চেতনার ফেরিওয়ালা এইসব গণবিচ্ছিন্ন বিশিষ্ট (?) নাগরিকেরা নিজেদেরকে অসাম্প্রদায়িক ও ধর্মনিরপেক্ষ বলেন। সেটা যদি সঠিক হয়, তাহ’লে গ্রীক দেবী থেমিস হ’ল সেদেশের মূর্তি সংস্কৃতির কথিত ঐশ্বরিক আইন (ডিভাইন ল’)-এর প্রতীক। যে মূর্তিপূজা ও তারকাপূজার বিরোধিতা করায় সেদেশের সর্বোচ্চ আদালতের ৫২৫ জনের জুরি বোর্ডের অধিকাংশের রায়ের ভিত্তিতে সক্রেটিসের মত বিশ্বখ্যাত একজন দার্শনিক ও জ্ঞানী ব্যক্তিকে নিজ হাতে হেমলক বিষ পানে আত্মাহুতি দিতে বাধ্য করা হয়। সেই গ্রীকদের রচিত রোমান ল’-এর অনুসারী যারা সেক্যুলার বলে পরিচয় দিয়ে নিজেদের কৌলিন্য যাহির করেন, তারা কিভাবে গ্রীক ঐশ্বরিক আইনের প্রতীককে নিজেদের বলে ধারণা করতে পারেন? তাছাড়া গ্রীক পুরাণ মতে থেমিস দেবী শুধু ন্যায়বিচারই করেন না, সোশ্যাল অর্ডার তথা সামাজিক শৃংখলাও রক্ষা করেন। থেমিসের হাতে তরবারি সেই শক্তি প্রয়োগের প্রতীক। অথচ আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থা সামাজিক শৃংখলার দায়িত্ব বিচার বিভাগকে দেয় না। তা থাকে নির্বাহী বিভাগ তথা সরকারের হাতে। তাহ’লে কোন যুক্তিতে প্রগতিশীল হওয়ার দাবীদাররা থেমিস দেবীর পূজারী হ’লেন? তাহ’লে কি এই দেবী একই সঙ্গে বিচার বিভাগ ও প্রশাসন উভয়েরই দেবী? মৃণাল হক বলছেন, যথাযথ কর্তৃপক্ষের নির্দেশেই তিনি এটা করেছেন ও পুনঃস্থাপন করেছেন। এজন্য তিনি ১৫ লক্ষ টাকাও পেয়েছেন। তাহ’লে কে এই মৃণাল হক? কারা এর মদদ দাতা? কি তাদের উদ্দেশ্য?

সরকারী দল বলছে, এটি সুপ্রীম কোর্টের ব্যাপার। এখানে আমাদের কিছুই করার নেই। অথচ সুপ্রীম কোর্ট কেবল প্রধান বিচারপতি দিয়েই চলে না। সেখানে রয়েছে সরকারী ও বিরোধী দলের জাঁদরেল সব আইনজীবীরা। যারা প্রায় সবাই মুসলমান। অথচ তাদের কোন ভূমিকা এযাবৎ দেখা যায়নি। এই ধরনের শৈথিল্যবাদী লোকদের কারণেই দেশে সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদ বিস্তার লাভ করছে। কে না জানে যে, তাওহীদ ও শিরকের সম্পর্ক পরস্পরে সাংঘর্ষিক? মূর্তি হ’ল শিরকের প্রতীক। ছবি-মূর্তি-ভাষ্কর্য-প্রতিকৃতি সবই তাওহীদ বিরোধী। নূহ (আঃ)-এর যুগ থেকেই মূর্তিপূজার বিরুদ্ধে নবী-রাসূলগণ তাওহীদের প্রচার করেছেন। দু’টি বিশ্বাসের ভিত্তিতে দু’টি সংস্কৃতি পৃথিবীতে চালু রয়েছে। দু’টির মধ্যে আপোষ করার কোন সুযোগ নেই।

অনেকে বলেন, মূর্তিকে পূজা করা শিরক হ’লেও শিল্প হিসাবে তা লালন করায় কোন দোষ নেই। এ যুক্তিতে তারা ভাষ্কর্য নামে এগুলিকে সিদ্ধ করার অপচেষ্টা চালান। তারা যদি পূজাই না করবেন, তাহ’লে নিষ্প্রাণ একটি মূর্তির জন্য তাদের এত আহাযারী কেন? আবার থেমিস মূর্তিটিকে দেবী বলার কারণ কি? দেবী তো তাকেই বলা হয়, যাকে দেবতা জ্ঞানে পূজা করা হয়।

এক্ষেত্রে একটি মৌলিক সত্যের কাছে আমাদের মাথা নত করতেই হবে যে, আমরা কেউই সত্য-মিথ্যার মানদন্ড নই। আর সেজন্যেই আমাদের সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ যুগে যুগে নবী-রাসূলগণের মাধ্যমে তাঁর অভ্রান্ত সত্যবাণী সমূহ পাঠিয়ে মানুষকে সঠিক পথের নির্দেশনা দিয়েছেন। পবিত্র রামাযান মাসের ক্বদর রজনীতে আল্লাহ তাঁর সর্বশেষ গ্রন্থ আল-কুরআন প্রেরণ করেছেন। যা ‘মানব জাতির জন্য পথ প্রদর্শক, সঠিক পথের স্পষ্ট ব্যাখ্যা এবং সত্য ও মিথ্যার পার্থক্যকারী’ (বাক্বারাহ ১৮৫)। সেখানে তিনি হযরত ইবরাহীম (আঃ)-এর সাথে তাঁর মূর্তিপূজারী ও তারকাপূজারী পিতা ও সম্প্রদায়ের মধ্যেকার বিতর্ক পরিবেশন করেছেন। যেমন তিনি স্বীয় রাসূলকে বলেন, ‘আর তুমি তাদেরকে ইবরাহীমের বৃত্তান্ত শুনিয়ে দাও’ (৬৯)। ‘যখন সে তার পিতা ও সম্প্রদায়কে ডেকে বলল, তোমরা কিসের পূজা কর?’ (৭০)। তারা বলল, আমরা মূর্তি সমূহের পূজা করি এবং সর্বদা এদেরকেই নিষ্ঠার সাথে আঁকড়ে থাকি’ (৭১)। ‘সে বলল, তোমরা যখন আহবান কর, তখন কি তারা শুনতে পায়’? (৭২)। ‘অথবা তারা কি তোমাদের কোন উপকার বা ক্ষতি করতে পারে’? (৭৩)। ‘তারা বলল, না। তবে আমরা আমাদের বাপ-দাদাদের পেয়েছি, তারা এরূপই করত’ (৭৪)। ইবরাহীম বলল, তোমরা কি তাদের সম্পর্কে ভেবে দেখেছ, যাদের তোমরা পূজা করে আসছ’? (৭৫)। ‘তোমরা এবং তোমাদের পূর্ববর্তী বাপ-দাদারা?’ (৭৬)। ‘তারা সবাই আমার শত্রু, বিশ্ব চরাচরের পালনকর্তা ব্যতীত’ (৭৭)। ‘যিনি আমাকে সৃষ্টি করেছেন, অতঃপর তিনিই আমাকে পথ প্রদর্শন করেছেন’ (৭৮)। ‘যিনি আমাকে আহার দেন ও পান করান’ (৭৯)। ‘যখন আমি পীড়িত হই, তখন  তিনিই আমাকে  আরোগ্য দান করেন’ (৮০)। ‘আর যিনি আমাকে মৃত্যু দান করবেন। অতঃপর পুনরায় জীবিত করবেন’ (শো‘আরা ৬৯-৮১)

এবারে দেখা যাক, পূজা হৌক বা শিল্প হৌক, ছবি-মূর্তি সম্পর্কে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) কি বলেছেন? তিনি বলেন, ‘এই সমস্ত ছবি যারা তৈরী করেছে, ক্বিয়ামতের দিন তাদের শাস্তি দেওয়া হবে ও তাদেরকে বলা হবে, যা তোমরা সৃষ্টি করেছ, তাতে জীবন দাও। অতঃপর তিনি বলেন, যে গৃহে (প্রাণীর) ছবিসমূহ থাকে, সে গৃহে (রহমতের) ফেরেশতা প্রবেশ করে না’ (বুঃ মুঃ)। হযরত আয়েশা (রাঃ) বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) স্বীয় গৃহে (ক্রুশের বা প্রাণীর) ছবিযুক্ত কোন বস্ত্তই রাখতেন না। দেখলেই তা ভেঙ্গে চূর্ণ করে দিতেন’ (বুখারী)। এক্ষণে কুরআনের সিদ্ধান্ত হ’ল, ‘আল্লাহ ও তাঁর রাসূল কোন বিষয়ে ফায়ছালা দিলে কোন মুমিন পুরুষ বা নারীর সে বিষয়ে নিজস্ব কোন ফায়ছালা দেওয়ার এখতিয়ার নেই। যে ব্যক্তি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের অবাধ্যতা করবে, সে ব্যক্তি স্পষ্ট ভ্রান্তিতে পতিত হবে’ (আহযাব ৩৬)। অতএব তাওহীদের এই দেশে আল্লাহর গযব ডেকে আনবেন না। দায়িত্বশীলরা সাবধান হৌন!

মন্তব্য করুন

Back to top button