সাম্প্রতিক প্রসঙ্গ

আমি মুসলিম, তাই কী এই নজরদারি?

আমি নিউইয়র্ক সিটি মসজিদে ইসলামের উপর লেকচার শুরু করার কয়েক সপ্তাহের মধ্যে কিছু অদ্ভূত ঘটনা ঘটতে থাকে। আমার বক্তৃতা শুনতে আসা শিক্ষানবিস ও ধর্মানুরাগীরা আমাকে বলেন, আইন শৃঙ্খলা বাহিনী তাদেরকে আমি ও আমার বক্তব্য নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে।

এর কিছুদিনের মধ্যেই শ্রোতাদের মধ্যে সন্দেহজনক লোকদের দেখতে পাই। একজন ভদ্র লোককে আমি চিহ্নিত করি- যিনি নিয়মিত বক্তব্য শুনতে আসেন কিন্তু প্রায়ই বক্তব্যের মাঝখানে ঘুমিয়ে পড়েন।

২০০৩ সালে আমি ব্রুকলিন কলেজে ইংরেজি সাহিত্যে পড়তাম। আমি নিউইয়র্কে বেড়ে উঠি এবং শহরটিকে ভালোবাসি। কিন্তু ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বরের হামলার পর নিউইয়র্কের মুসলিমরা মারাত্মক বৈষম্যের শিকার হতে থাকেন।

হামলার পরেই মুসলিমরা বিভিন্ন বিদ্বেষমূলক আক্রমণের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হন। এসব হামলার শিকার মুসলিমদের আমি সাহস যোগানোর চেষ্টা করতাম। তারা যেন বিশ্বাস হারিয়ে না ফেলেন- সে ব্যাপারে তাদের উৎসাহ দিতাম। আমি ধর্ম নিয়ে কথা বলতাম, আহতদের দেখতে যেতাম, ইসলাম বিরোধীদের অন্যায়ের বিরুদ্ধে আল্লাহর বিশালতার কথা ব্যাখ্যা করতাম।

আমি অন্যায় কিছু করতাম না। আমার বক্তৃতায় সবসময় সংঘাত ও সন্ত্রাসবাদকে নিরুৎসাহিত করেছি। গত এক দশক যাবৎ আমি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজরদারিতে আছি বলে আমার মনে হয়। ছদ্মবেশধারী পুলিশ আমার দ্বারা সংঘটিত যে কোনো অপরাধের তথ্য উদঘাটনের জন্য সবসময় আমাকে অনুসরণ করতো বলে আমার ধারণা।

২০১৩ সালে আমার আশঙ্কাই সত্যি হয়। এপি নিউজ এজেন্সি মারফত জানতে পারি, মুসলিমদের বিরুদ্ধে নিউইয়র্ক পুলিশ পরিচালিত আক্রমণাত্মক নজরদারির তালিকায় আমিও ছিলাম।

এপি জানায়, ৯/১১ হামলার পর মুসলিমদের উপর কড়া নজরদারি শুরু করে নিউইয়র্ক পুলিশ। পুলিশ কর্মকর্তারা মসজিদ গুলোকে গোপনে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে চিহ্নিত করতে থাকেন। রেকর্ডকৃত খুৎবা ও ইমামদের উপর গোয়েন্দাগিরি করা শুরু করেন তারা।

সুনির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ ছাড়া শুধুমাত্র সন্দেহের ভিত্তিতে ২০০১ সালের পরে নিউইয়র্ক পুলিশ ইসলামী সংগঠনগুলোর বিপক্ষে কমপক্ষে এক ডজন ‘সন্ত্রাসবাদ বিরোধী অনুসন্ধান’ চালায়। এখনো পর্যন্ত তারা কোনো অভিযোগ গঠন করতে সক্ষম হয়নি।

এসোসিয়েট প্রেস জানিয়েছে, বছরের পর বছর ধরে চলা নজরদারিতে এফবিআই নিশ্চিত হয়েছে আমি কোনো হুমকি ছিলাম না।

পুরো জমায়েতকে টার্গেট করা হয়। পুরো মুসলিম সম্প্রদায়- বইয়ের দোকান থেকে রেস্তোরাঁর ওপর নজরদারি চলে। এ সময় নির্দোষ মানুষকেও সন্দেহের চোখে দেখা হয়। এতে আমরা বিচ্ছিন্নতাবোধে আক্রান্ত হই আর পুলিশভীতি আমাদের পেয়ে বসে। নিউইয়র্ক পুলিশ বিপুল সংখ্যক অনুচর নিয়োগ দেয়ায় আমরা প্রতিবেশীদেরও অবিশ্বাস করতে শুরু করি।

আমি আশঙ্কা করেছিলাম স্থানীয় পুলিশ সদস্যরা নিরপরাধ মুসলিমদের ওপর নজরদারি করছে, তবে তাদের নজরদারির মাত্রা ছিল আমার আশঙ্কার চেয়েও ব্যাপকভিত্তিক। পুলিশ প্রতিমুহূর্তে আমাকে অনুসরণ করতে লাগল। এমনকি আমার বিয়ের অনুষ্ঠানে কারা উপস্থিত হয়েছিলেন তাও ভিডিও করা হয়। আমি ও আমার স্ত্রী বিয়ের আংটি কিনতে দোকানে গেলে সেখানেও নজরদারি চলে।

এপির তথ্য ফাঁসের পর আমি শুধু অস্বস্তিই বোধ করিনি, আমি ছিলাম আতঙ্কিত। আমার মনে হলো আমি এমন একটি বাড়িতে বাস করছি যেখানে কোনো দেয়াল নেই। ফলে পুলিশ সর্বদা নজরদারি করতে পারছে।

আমি কী বলছি, কাকে বলছি তা নিয়ে শঙ্কিত হয়ে পড়েছিলাম। আমি আমার জীবন নিয়ে শঙ্কায় পড়ে গেলাম। আশেপাশের কাউকেই আমি বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। বন্ধু ও স্বজনদেরও মনে হতো যে তারাও হয়তো ছদ্মবেশী গুপ্তচর।

২০১৩ সালের পর আমি ভাষণের ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে শুরু করি। ইসলামের মূল্যবোধ এবং সাহস সম্পর্কেও আমি কথা বলতাম না এই আশঙ্কায় যে তা সহিসংতাকে উসকে দিচ্ছে বলে ভুলভাবে উপস্থাপন করা হতে পারে। মুসলিম বিশ্বের নিরপরাধ বেসামরিক লোকজন যে বিধ্বস্ত অবস্থায় রয়েছে তা নিয়েও কথা বলা বন্ধ করে দিলাম- কারণ তা আমেরিকা বিরোধী বলে বিবেচিত হতে পারে।

নিম্ন আয়ের কিছু শিশু ও কিশোরদের আমি সংগঠিত করলে নিউইয়র্ক পুলিশ দাবি করে যে আমি তাদের সামরিক প্রশিক্ষণ দিতে জড়ো করেছি। অথচ তাদেরকে জড়ো করেছিলাম সপ্তাহান্তে বাস্কেটবল খেলা, সাঁতার প্রতিযোগিতা ও প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে দৌড় প্রতিযোগিতার জন্য।

খুতবার প্রস্তুতির জন্য আমি ভিডিও শুনলে পুলিশ অভিযোগ করে যে আমি উগ্রপন্থী আলেমদের বক্তব্য ডাউনলোড করছি। আমার বারার বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হয় যে তিনি ওয়াল ট্রেড সেন্টারে বোমা হামলায় জড়িত ওমর আবদেল রহমানের সহযোগী। অথচ পুলিশ কোনো মামলা দায়ের করতে পারেনি।

আমি আশাবাদী এজন্য যে সেসব কঠিন বছরগুলো শেষ হয়েছে। নিউইর্য়কে নতুন বসবাসরত মুসলিমদের ওপর পুলিশের নজরদারি বাড়ানোয় নিউইয়র্ক পুলিশের বিরুদ্ধে ২০১৩ সালের আগস্ট মাসে আমি একটি মামলায় শরিক হই।

গত মাসে নিউইয়র্ক পুলিশ আমার এবং এ মামলার আরো ৫ জন বাদির সাথে সমঝোতা করেছে। পুলিশ বিভাগ পুলিশদের আচরণের ব্যাপারে কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরির্বতন এনেছে। তার মধ্যে বিভিন্ন ধর্ম, বর্ণ ও গোত্রের ওপর গোয়েন্দাগিরি চালানোকে বাতিল করার বিষয়টিও রয়েছে।

আদালত কর্তৃক চূড়ান্ত অনুমোদন সাপেক্ষে সমঝোতাটিতে যে প্রস্তাব করা হয়েছে তা হলো বছরজুড়ে আরো যেসব গোয়েন্দা নজরদারি চলছে সেসব কর্মকাণ্ডও বন্ধ করতে হবে। এবং ধর্মীয় ও রাজনৈতিক বিষয়ে কোনো অনুসন্ধানে একটি বেসামরিক পর্যবেক্ষণ কমিটি গঠন করা।

আমি আশা করছি না যে আমার অন্য মুসলিম ভাইয়েরা আমার সকল দৃষ্টিভঙ্গির সাথে একমত হবেন। যেমন আমি দৃঢ়ভাবে মনে করি ইসলাম হচ্ছে আল্লাহ প্রদত্ত একটি স্বর্গীয় সত্য এবং সকল মুসলমানকেই অবিরতভাবে কুরাআনকে অনুসরণ করতে হবে। কিন্তু এদেশ সব আমেরিকানদের জন্যই বাকস্বাধীনতা ও ধর্মীয় সমতা রক্ষা করে।

যখন কোনো মুসলিমকে শুধুমাত্র তার বিশ্বাসের ভিত্তিতে লক্ষ্যবস্তু বানানো হয়, তা হবে এদেশের নিয়ম নীতির প্রতি অশ্রদ্ধা প্রদর্শন।

মোহাম্মদ এলশিনাবি

(ওয়াশিংটন পোস্টে প্রকাশিত নিবন্ধ)

ইসলামিক ইমেইল নিউজলেটার
নতুন পোস্ট প্রকাশিত হলে সরাসরি আপনার ই-মেইল ইনবক্সে পেতে সাবস্ক্রাইব করুন।
icon

মন্তব্য করুন

Back to top button