ছোটগল্প/উপন্যাস

এক টুকরো সুখের খোঁজে-০৩

সানজিদার ইচ্ছে ছিল না অনার্স শেষ করার আগে বিয়ে করার কিন্তু পরিবারের এত চাপের মুখে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেনি সে। ইচ্ছা ছিল এমএ শেষ করে জব করার, নিজের পায়ে দাঁড়ানোর তারপর বিয়ে। কিন্তু হঠাৎই নাকি ভাল ছেলে পাওয়া গেছে এজন্য দেরি করতে চাচ্ছেনা সানজিদার পরিবার। ছেলে ভাল চাকুরী করে, দেখতে হ্যান্ডসাম। সানজিদার সাথে নাকি বেশ মানাবে তানভীর কে। তানভীর কে দেখে পছন্দও হল সানজিদার। বিয়েও হয়ে গেল।
দেখতে দেখতে বছর খানেক ও হয়ে গেল বিয়ের। এই এক বছরে সানজিদার জীবনযাত্রায় আমূল পরিবর্তন ও হয়েছে।
সানজিদা স্কুলে পড়ার সময় থেকেই বোরকা পরত, নিকাব ও করত। কিন্তু তানভীর বোরকা পরা মোটেও পছন্দ করেনা। সে চায়না সানজিদা বোরকা পরে বাইরে যাক। স্বামী কে খুশি করতে সানজিদা বোরকা পুরোপুরিই ছেড়ে দিয়েছে। পার্টিতে সেজেগুজে গেলে তানভীর খুব খুশি হয়। কলিগরা যখন সানজিদার রূপের তারিফ করে, তানভীর তখন ঠোঁটে একটা অহংকারী হাসি এনে গর্বে বুক ফুলায়। সুন্দরী বউ পেয়েছে সে। অন্যদের নিশ্চয় হিংসে হয় তানভীরের বউকে কে দেখে!
:
বিয়ের পর আর ভার্সিটিতে তেমন যায়নি সানজিদা। সত্যি বলতে সময়ই হয়নি। নতুন সংসারে কত কাজ থাকে। সামনে পরীক্ষা বলে আজ ভার্সিটি আসল সানজিদা। ক্লাসে গিয়ে নিজের আসনে বসতেই চোখ গেল পাশে বসা মেয়েটার দিকে। মেয়েটাও তাকিয়ে আছে সানজিদার দিকে। চোখ ছাড়া কিচ্ছু দেখা যাচ্ছেনা। চোখ দুটো খুব পরিচিত লাগছে। কে হতে পারে? এমন পোশাকে তো আগে কাউকে ক্লাসে দেখেনি! সানজিদার মনের অবস্থা হয়ত মেয়েটা বুঝতে পেরেছে। নিজেই এগিয়ে এসে বলল, চিনতে পারছিস না, এই তো? আমি নুসরাত।
– নুসরাত!! তোর এই অবস্থা কেন?
– আমারও তো একই প্রশ্ন। তোর এই অবস্থা কেন?
হঠাৎ সানজিদার খেয়াল হল নিজের প্রতি। আগে বোরকা,নিকাব পরতো,আর এখন সালোয়ার-কামিজ পরে ভার্সিটিতে এসেছে। মাথায় ছোট্ট একটা ঘোমটাও দেয়নি সে। কপালে টিপ ও দিয়েছে, তানভীরের পছন্দ বলে।
– জামাই পছন্দ করেনা বোরকা পরা, কোনভাবেই রাজি করাতে না পেরে হাল ছাড়তে হয়েছে। তোর কথা বল…
– বিয়ের দিনই আমাকে সে বুঝিয়েছে পর্দা কেন করছি, কোরআনে পর্দার হুকুম কেমন, আর পূর্ণ পর্দা কিভাবে করা উচিৎ। আমার জন্য উত্তম টাই আমি গ্রহন করেছি।
লজ্জায় সানজিদা মাথা নিচু করে ফেলল। নুসরাত আগে বোরকাই পরত না। ধীরে ধীরে বোরকা পরল, নামায ধরল। এমন কি ক্লাস থেকে বের হয়ে গিয়েও কত নামায আদায় করেছে। এখন দ্বীনদার ছেলে বিয়ে করে পূর্ণ পর্দাশীল হয়ে গেছে। আর সানজিদা?
ছোট থেকেই বোরকা/নিকাব পরত, নামায ও পরত ৩/৪ ওয়াক্ত। অথচ আজ তার একি দশা!
যদিও সে বুঝতে পারছে তার এই অধঃপতন কিন্তু কি করবে সে! তানভীর পছন্দ করেনা।
– সানজু, জামাই পছন্দ করেনা বলে পর্দা ছেড়ে দিলি? কাজ টা কি ভাল করলি?
– আমি কি করব বল? তানভীরের মতে বোরকা পরেই এই যুগে খারাপ কাজ বেশী করে, এজন্যই সে পছন্দ করেনা।
– তোরও কি তাই ধারনা?
– না না। আমি এটা বিশ্বাস করিনা। কিন্তু ওর সাথে লাগতেও যাই না। শর্ট টেম্পারের লোক।
– দ্বীনের প্রতি এই ছোট ছোট ছাড়ই একদিন দ্বীন থেকে বের করে দেয়। নিজে যা বিশ্বাস করিস না তাহলে তা কেন চুপচাপ মেনে নিয়ে আমল করছিস?
– সত্যি বলতে আমারও খারাপ লাগে এভাবে চলতে। কিন্তু কি করব? ঝগড়া করব এসব নিয়ে?
– না না। ঝগড়া কেন করবি! বরং যখন মুড ভাল থাকবে তখন বুঝিয়ে বলবি।
:
সেদিন রাতে সানজিদা তানভীর কে বলল সে আবার বোরকা/নিকাব পরতে চায়, তানভীর শুনেই মুখ বিকৃত করল। বলল, এসবের কোন দরকার নেই। তানভীরের এমন আচরনে সানজিদার একটু জেদ ই হল। কি এমন করতে চেয়েছে সে যে এমন করতে হবে? সানজিদা একটু দৃঢ় কন্ঠেই বলল, তুমি এমন মুখ বিকৃত করলেও লাভ নেই, আমি যা বলেছি তাই করব, দেখি তুমি কি করতে পারো।
পরদিন ক্লাসে গিয়ে নুসরাতের সাথে দেখা করল সানজিদা। গতরাতের ঘটনা খুলে বলল। কিন্তু নুসরাত বলল ভিন্ন কথা!
বলল, তোর এই জেদ করে বোরকা পরার কোনই মূ্ল্য নেই আল্লাহর কাছে। পর্দা করতে হবে আল্লাহর ভয়ে, পর্দা করতে হবে আল্লাহর হুকুম মানার জন্য। জামাইয়ের সাথে জেদ করে বোরকা পরবি তাহলে তোর নিয়াত তো সহিহ হল না। আগে তোকে জানতে হবে পর্দা কেন করতে হবে। তোর জন্য আমি একটা বই এনেছি। বই টা আজকেই পুরোটা শেষ করবি। এটা পড়লে তুই বুঝতে পারবি কেন পর্দা করতে হবে।
:
বাসায় ফিরেই নুসরাতের দেয়া বইটা খুলে বসল সানজিদা। একটানে পড়ে নিল শুরু থেকে শেষ। বই টা পড়ার পর সানজিদা নিজেকে নিয়ে ভাবতে বসল। পর্দার উদ্দেশ্য না জেনেই এতদিন বোরকা পরেছে সে। আবার ছেড়েও দিয়েছে তানভীরের কথায়। এতগুলো দিন সে বেপর্দায় ঘুরে বেরিয়েছে। কত শত পুরুষের মনরঞ্জনের সামগ্রী হয়েছে সে। পার্টি গুলোতে তানভীরের কলিগরা কত বাজে ভাবে তার প্রশংসা করত! তখন এক ধরনের ভাল লাগা কাজ করলেও এখন বুঝতে পারছে কি বিকৃত রুচির পরিচয় এসব। স্বামীর কথা মানতে গিয়ে দ্বীন থেকে কত দূরে সরে এসেছে সানজিদা একটু সুখের আশায়,একটি সুখের সংসারের আশায়। সেই সুখ কি পেয়েছে সে? মাসে মাসে তানভীরের হাত ধরে পার্টিতে যাওয়া, হাসিমুখে দুজনের সেলফি আপলোড করা, শপিংয়ে গিয়ে চেক-ইন দেয়া, দামী রেস্টুরেন্টে সেজেগুজে খেতে যাওয়া এসব দেখে মানুষ হয়ত ভাবে কত সুখি দম্পতি! আসলেই কি তাই?
শুধু সানজিদা ই জানে কতটা অবহেলিত সে, কতটা একা, কতটা নিঃস্ব! সংসার নামের এই জায়গা টাতে সে শুধুই একজন মেয়ে, একজন রাঁধুনী। অথচ প্রতিটা মেয়েরই স্বপ্ন থাকে একজন স্ত্রী হওয়ার,অর্ধাঙ্গী হওয়ার, স্বামীর বন্ধু হওয়ার। এই সংসারে কখনোই সানজিদার ইচ্ছে গুলো পূর্ণতা পায়না। একটা মেয়ে কি এমন চায় তার স্বামীর কাছে? একটু ভালবাসা, একটু খোঁজ, একটু কেয়ার, একটু গুরুত্ব, একটু সস্তা সারপ্রাইজ, দিন শেষে একটু স্বীকরোক্তি সেও মিস করেছে। এটুকুই তো চায় সানজিদা। যে সুখের জন্য সে নিজেকে পরিবর্তন করেছে সে সুখ অধরাই থেকে গেল।
:
তানভীর বাসায় ফেরার পর সানজিদা আজ খুব যত্ন নিল ওর। বুঝিয়ে শুনিয়ে তানভীর কে আজ রাজি করাতেই হবে। প্রতি নামাযের পর সে দোয়া ও করছে এজন্য। কিন্তু তানভীর কে তার উদ্দেশ্য বলার পর কোনই লাভ হল না। উল্টো বলে দিল এই বাসায় থেকে সানজিদা এসব করতে পারবেনা। কোনভাবেই স্বামী কে রাজি করাতে না পেরে সানজিদা সিদ্ধান্ত নিল তানভীর রাজি না হলেও সে পর্দা করবে। কারন এখন সে বুঝেছে পর্দা টা আল্লাহর হুকুম। আর বাবা-মা,স্বামী-সন্তান, ভাই-বোন কারও কথাতেই আল্লাহর হুকুমের বাইরে যাওয়া যাবেনা।
প্রথম প্রথম সানজিদা যখন পর্দা শুরু করে তানভীর বুঝতে পারেনি। কারন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত তানভীরের অফিস। কিন্তু বিভিন্ন অজুহাতে যখন তানভীরের সাথে পার্টিতে যেতে,বাইরে যেতে চাইতোনা তখন তানভীরের আর বুঝার বাকি রইল না সানজিদা কেন যেতে চাচ্ছেনা। বাসায় তানভীরের ছোট ভাই, বন্ধুরা, কলিগ আসলেও সানজিদা কে সামনে নেয়া যায়না। তানভীরের কথা কে অগ্রাহ্য করে সানজিদা নিজের খেয়াল খুশি মত চলছে এটা তানভীর কিছুতেই সহ্য করতে পারলোনা। দৃঢ় কন্ঠে জানিয়ে দিল সানজিদা যদি তার কথা না শুনে তবে তার সাথে থাকা সম্ভব নয়। এভাবে সে তানভীর কে অপমান করছে। বন্ধুদের সামনে, কলিগদের সামনে লজ্জায় এখন মুখ দেখাতে পারেনা তানভীর।
সানজিদা কোন ভাবেই তানভীর কে বুঝাতে পারলোনা অপমান নয় বরং আল্লাহর হুকুম মানতেই সে এসব করছে। ব্যর্থ হয়ে সে অনবরত আল্লাহর কাছে চাইতে লাগল। এ এক করুন আকুতি। নিজের সম্মান রক্ষার আকুতি। আল্লাহর হুকুমের উপর অবিচল থাকার আকুতি।
স্বামীর হেদায়াতের জন্য তাহাজ্জুদে রাতের পর রাতে কাঁদতে লাগল সানজিদা। এত প্রার্থনায় তানভীরের কোনই পরিবর্তন হলনা ঠিকই কিন্তু সানজিদার ক্রমেই দ্বীনের উপর শক্ত অবস্থান হয়ে গেল। আল্লাহর অনুগ্রহের উপর অন্ধ বিশ্বাস জন্ম নিল। আল্লাহর জন্য নিজের পরম আকাঙ্ক্ষিত কিছুকেও ত্যাগ করার মানসিকতা তৈরি হল। এখন তানভীর যতই চাপ দেয়,যতই সম্পর্ক রাখবেনা বলে হুমকি দেয় সানজিদার এতে কোনই ভাবান্তর হয়না।
তানভীর একদিন পরিবারের সবাইকে নিয়ে আলোচনায় বসে। সানজিদার আচরন গুলো, সানজিদা ওকে কতটা যন্তনায় রেখেছে তা তুলে ধরে সবার সামনে। এভাবে আর সংসার করতে পারবেনা বলেও জানিয়ে দেয়। তানভীরের পরিবার ও তানভীর কে সাপোর্ট দেয়। এমন মানসিক রোগী কে নিয়ে সত্যিই সংসার করা যায়না।
:
পাশের ঘর থেকে সবব শুনছে সানজিদা। কিছুই বলার নেই তার। আজ সেও অনেক ক্লান্ত। বিন্দু মাত্র দ্বীনের বুঝ নেই এমন লোকের সাথে সংসার করা যায়না। আল্লাহর উপর ছেড়ে দিয়েছে তার দুনিয়ার জীবন। দুনিয়ায় আজ আর তার কিছুই হারানোর বাকি নেই। তবে সানজিদা জানে দুনিয়ায় হারানো জিনিস গুলো প্রকৃতপক্ষে সে জমা করছে আখিরাতের ব্যাংকে। আল্লাহর কাছে থেকে অজানা সেই প্রতিদানের আশায় সুখে পূর্ণ হয়ে উঠে সানজিদার বহুদিনের অতৃপ্ত মন।

লিখেছেন→ (MarJaana IsRaa)

ইসলামিক ইমেইল নিউজলেটার
নতুন পোস্ট প্রকাশিত হলে সরাসরি আপনার ই-মেইল ইনবক্সে পেতে সাবস্ক্রাইব করুন।
icon

মন্তব্য করুন

Back to top button