কুর’আন কি আল্লাহ্ রাসুল (সা)’র লেখা কোনো গ্রন্থ?
বিরাট আলিশান একটি বাড়ি। মোঘল আমলের সম্রাটেরা যেরকম বাড়ি বানাতো, অনেকটাই সেরকম। বাড়ির সামনে দৃষ্টিনন্দন একটি ফুলের বাগান। ফুলের বাগানের মাঝে ছোট ছোট কৃত্রিম ঝর্ণা আছে। এই বাড়ির মালিকের রুচিবোধের প্রশংসা করতেই হয়। ঝঞ্চাট ঢাকা শহরের মধ্যে এটি যেন এক টুকরো স্বর্গখন্ড।
কিন্তু অবাক করা ব্যাপার হলো, বাগানের কোথাও লাল রঙের কোন ফুল নেই।এতবড় বাগানবাড়ি, অথচ, কোথাও একটি গোলাপের চারা পর্যন্ত নেই। বিস্ময়ের ব্যাপার তো বটেই।
–
আমরা এসেছি সাজিদের এক দূর সম্পর্কের খালুর বাসায়। ঢাকা শহরে বড় বড় ব্যবসা আছে।বিদেশেও নিজের ব্যবসা-বাণিজ্যের শাখা-প্রশাখা ছড়িয়েছেন। ছেলে-মেয়েদের কেউ লন্ডন, কেউ কানাডা আর কেউ সুইজারল্যান্ড থাকে। ভদ্রলোক উনার স্ত্রীকে নিয়ে ঢাকাতেই রয়ে গেছেন কেবল শিকড়ের টানে।
তবে, ঢাকায় নিজের বাড়িখানাকে যেভাবে তৈরি করেছেন, বোঝার উপায় নেই যে এটি ঢাকার কোন বাড়ি নাকি মস্কোর কোন ভি আই পি ভবন।
আমাকে এদিক-সেদিক তাকাতে দেখে সাজিদ প্রশ্ন করলো,- ‘এভাবে চোরের মতো এদিক-ওদিক তাকাচ্ছিস কেনো?’
আমি ভ্যাবাচেকা খাওয়ার মতো করে বললাম,- ‘না, আসলে তোর খালুকে নিয়ে ভাবছি।’
– ‘উনাকে নিয়ে ভাবার কি আছে?’
আমি বললাম,- ‘অসুস্থ মানুষদের নিয়ে ভাবতে হয়।এটাও একপ্রকার মানবতা, বুঝলি?’
সাজিদ আমার দিকে বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে বললো,- ‘অসুস্থ মানে? কে অসুস্থ?’
– ‘তোর খালু।’
– ‘তোকে কে বললো উনি অসুস্থ?’
আমি দাঁড়ালাম। বললাম,- ‘তুই এতকিছু খেয়াল করিস, এটা করিস নি?’
– ‘কোনটা?
– ‘তোর খালুর বাগানের কোথাও কিন্তু লাল রঙের কোন ফুলগাছ নেই। প্রায় সব রঙের ফুলগাছ আছে, লাল ছাড়া।এমনকি, গোলাপের একটি চারাও নেই।’
– ‘তো?’
– ‘তো আর কি? তিনি হয়তো কালার ব্লাইন্ড। স্পেশেফিকলি, রেড কালার ব্লাইন্ড।’
সাজিদ কিছু বললো না। হয়তো সে এটা নিয়ে আর কোন কথা বলতে চাচ্ছে না, অথবা, আমার যুক্তিতে সে হার মেনেছে।
–
সাজিদ কলিংবেল বাজালো।
ঘরের দরজা খুলে দিলো একটি তের-চৌদ্দ বছর বয়েসী ছেলে। সম্ভবত কাজের ছেলে।
আমরা ভেতরে ঢুকলাম। ছেলেটি বললো,- ‘আপনারা এখানে বসুন।আমি কাকাকে ডেকে দিচ্ছি।’
ছেলেটা একদম শুদ্ধ বাংলায় কথা বলছে। বাড়ির মালিককে স্যার বা মালিক না বলে কাকা বলছে।সম্ভবত, উনার কোন গরীব আত্মীয়ের ছেলে হবে হয়তো। যাদের খুব বেশি টাকা-পয়সা হয়, তারা গ্রাম থেকে গরিব আত্মীয়দের বাসার কাজের চাকরি দিয়ে দয়া করে।
ছেলেটা ভদ্রলোককে ডাকার জন্য সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে গেলো।ঘরের ভেতরটা আরো চমৎকার। নানান ধরনের দামি দামি মার্বেল পাথর দিয়ে দেওয়াল সাজানো।
দু’তলার কোন এক রুম থেকে রবীন্দ্রনাথের গানের সুর ভেসে আসছে,- ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে, তবে একলা চলো রে……’
আমি সাজিদকে বললাম,- ‘কি রে, তোর এরকম মোঘলাই ষ্টাইলের একটা খালু আছে, কোনদিন বললি না যে?’
সাজিদ রসকষহীন চেহারায় বললো,- ‘মোঘলাই ষ্টাইলের খালু তো, তাই বলা হয়নি।’
– ‘তোর খালুর নাম কি?’
– ‘এম.এম. আলি।’
ভদ্রলোকের নামটাও উনার বাড়ির মতোই গাম্ভীর্যপূর্ণ। আমি জিজ্ঞেস করলাম,- ‘এম. এম. আলি মানে কি?’
সাজিদ আমার দিকে তাকালো। বললো,- ‘মোহাম্মদ মহব্বত আলি।’
ভদ্রলোকের বাড়ি আর ঐশ্বর্যের সাথে নামটা একদম যাচ্ছে না। এইজন্যে হয়তো মোহাম্মদ মহব্বত আলি নামটাকে শর্টকাট করে এম.এম. আলি করে নিয়েছেন।
–
ভদ্রলোক আমাদের সামনের সোপায় পায়ের উপর পা তুলে বসলেন। মধ্যবয়স্ক। চেহারায় বার্ধক্যের কোন ছাপ নেই। চুল পেকেছে, তবে কলপ করায় তা ভালোমতো বোঝা যাচ্ছে না।
তিনি বললেন,- ‘তোমাদের মধ্যে সাজিদ কে?’
আমি লোকটার প্রশ্ন শুনে অবাক হলাম খুব। সাজিদের খালু, অথচ সাজিদকে চিনে না। এটা কি রকম কথা?
সাজিদ বললো,- ‘জ্বি, আমি।’
– ‘হুম, I guessed that’- লোকটা বললো। আরো বললো,- ‘তোমার কথা বেশ শুনেছি, তাই তোমার সাথে আলাপ করার ইচ্ছে জাগলো।’
আমাদের কেউ কিছু বললাম না। চুপ করে আছি।
লোকটা আবার বললো,- ‘প্রথমে আমার সম্পর্কে দরকারি কিছু কথা বলে নিই। আমার পরিচয় তো তুমি জানোই,সাজিদ। যেটা জানো না, সেটা হলো,- বিশ্ববিদ্যালয় জীবন থেকে আমি একজন অবিশ্বাসী। খাঁটি বাংলায় নাস্তিক। হুমায়ুন আজাদকে তো চেনো, তাই না? আমরা একই ব্যাচের ছিলাম। আমি নাস্তিক হলেও আমার ছেলেমেয়েরা কেউই নাস্তিক নয়।সে যাহোক, এটা নিয়ে আমার মাথাব্যথা নেই।আমি ব্যক্তিস্বাধীনতায় বিশ্বাসী।’
সাজিদ বললো,- ‘খালু, আমি এসব জানি।’
লোকটা অবাক হবার ভান করে বললো,- ‘জানো? ভেরি গুড। ক্লেভার বয়।’
– ‘খালু, আমাকে ডেকে পাঠিয়েছেন কেনো তা বলুন।’
– ‘ওয়েট! তাড়াহুড়ো কিসের?’- লোকটা বললো।
এরমধ্যেই কাজের ছেলেটা ট্রে তে করে চা নিয়ে এলো।
আমরা চায়ের কাপে চুমুক দিলাম। লোকটাকে একটি আলাদা কাপে করে চা দেওয়া হলো। সেটা চা নাকি কফি, ঠিক বোঝা যাচ্ছে না।
লোকটি বললো,- ‘সাজিদ, আমি মনে করি, তোমাদের ধর্মগ্রন্থ, আই মিন আল কোরান, সেটা কোন ঐশী গ্রন্থ নয়। এটা মুহাম্মদের নিজের লেখা একটি বই।মুহাম্মদ করেছে কি, এটাকে জাষ্ট স্রষ্টার বাণী বলে চালিয়ে দিয়েছে।’
এইটুকু বলে লোকটা আমাদের দু’জনের দিকে তাকালো। হয়তো বোঝার চেষ্টা করলো আমাদের রিএ্যাকশান কি হয়।
আমরা কিছু বলার আগেই লোকটি আবার বললো, – ‘হয়তো বলবে, মুহাম্মদ লিখতে-পড়তে জানতো না। সে কিভাবে এরকম একটি গ্রন্থ লিখবে? ওয়েল! এটি খুবই লেইম লজিক। মুহাম্মদ লিখতে পড়তে না জানলে কি হবে, তার ফলোয়ারদের অনেকে লিখতে-পড়তে পারতো।উচ্চ শিক্ষিত ছিলো। তারা করেছে কাজটা।মুহাম্মদের ইশারায়।’
সাজিদ তার কাপে শেষ চুমুক দিলো। তখনও সে চুপচাপ।
লোকটা বললো,- ‘কিছু মনে না করলে আমি একটি সিগারেট ধরাতে পারি? অবশ্য, কাজটি ঠিক হবে না জানি।’
আমি বললাম,- ‘শিওর!’
এতক্ষণ পরে লোকটি আমার দিকে ভালোমতো তাকালো। একটি মুচকি হাসি দিয়ে বললো,- ‘Thank You…’
–
সাজিদ বললো,- ‘খালু, আপনি খুবই লজিক্যাল কথা বলেছেন। কোরান মুহাম্মদ সাঃ এর নিজের বানানো হতেও পারে। কারন, কোরান যে ফেরেস্তা নিয়ে আসতো বলে দাবি করা হয়, সেই জিব্রাঈল আঃ কে মুহাম্মদ সাঃ ছাড়া কেউই কোনদিন দেখেনি।’
লোকটা বলে উঠলো,- ‘এক্সাক্টলি, মাই সান।’
– ‘তাহলে, কোরানকে আমরা টেষ্ট করতে পারি, কি বলেন খালু?’
– ‘হ্যাঁ হ্যাঁ, করা যায়…….’
সাজিদ বললো,- ‘কোরান মুহাম্মদ সাঃ এর বানানো কি না, তা বুঝতে হলে আমাদের ধরে নিতে হবে যে, মুহাম্মদ সাঃ স্রষ্টার কোন দূত নন। তিনি খুবই সাধারন, অশিক্ষিত একজন প্রাচীন মানুষ।’
লোকটা বললো,- ‘সত্যিকার অর্থেই মুহাম্মদ অসাধারণ কোন লোক ছিলো না। স্রষ্টার দূত তো পুরোটাই ভূয়া।’
সাজিদ মুচকি হাসলো। বললো,- ‘তাহলে এটাই ধরে নিই?’
– ‘হুম’- লোকটার সম্মতি।
সাজিদ বলতে লাগলো,- ‘খালু, ইতিহাস থেকে আমরা জানতে পারি, হজরত ঈউসুফ আঃ এর জন্ম হয়েছিলো বর্তমান ফিলিস্তিনে। ঈউসুফ আঃ ছিলেন হজরত ঈয়াকুব আঃ এর কনিষ্ঠতম পুত্র। ঈয়াকুব আঃ এর কাছে ঈউসুফ আঃ ছিলেন প্রাণাধিক প্রিয়।কিন্তু, ঈয়াকুব আঃ এর এই ভালোবাসা ঈউসুফ আঃ এর জন্য কাল হলো। তার ভাইয়েরা ষড়যন্ত্র করে ঈউসুফ আঃ কে কূপে নিক্ষেপ করে দেয়। এরপর, কিছু বণিকদল কূপ থেকে ঈউসুফ আঃ কে উদ্ধার করে তাকে মিশরে নিয়ে আসে। তিনি মিশরের রাজ পরিবারে বড় হন।ইতিহাস মতে, এটি ঘটে- খ্রিষ্টপূর্ব চতুর্দশ শতকের আমেনহোটেপের রাজত্বকালের আরো তিন’শ বছর পূর্বে। খালু, এই বিষয়ে আপনার কোন দ্বিমত আছে?’
লোকটা বললো,- ‘নাহ। কিন্তু, এগুলো দিয়ে তুমি কি বোঝাতে চাও?’
সাজিদ বললো,- ‘খালু, ইতিহাস থেকে আমরা আরো জানতে পারি, খ্রিষ্টপূর্ব চতুর্দশ শতকে চতুর্থ আমেনহোটেপের আগে যেসকল শাসকেরা মিশরকে শাসন করেছে, তাদের সবাইকেই ‘রাজা’ বলে ডাকা হতো। কিন্তু, খ্রিষ্টপূর্ব চতুর্থ শতকে চতুর্থ আমেনহোটেপের পরে যেসকল শাসকেরা মিশরকে শাসন করেছিলো, তাদের সবাইকে ‘ফেরাঊন’ বলে ডাকা হতো। ঈউসুফ আঃ মিশরকে শাসন করেছিলেন খ্রিষ্টপূর্ব চতুর্দশ শতকের চতুর্থ আমেনহোটেপের আগে।আর, মূসা আঃ মিশরে জন্মলাভ করেছিলেন চতুর্থ আমেনহোটেপের কমপক্ষে আরো দু’শো বছর পরে।অর্থাৎ, মূসা আঃ যখন মিশরে জন্মগ্রহন করেন, তখন মিশরের শাসকদের আর ‘রাজা’ বলা হতো না, ‘ফেরাঊন’ বলা হতো।’
– ‘হুম, তো?’
– ‘কিন্তু খালু, কোরানে ঈউসুফ আঃ এবং মূসা আঃ দুইজনের কথাই আছে। অবাক করা ব্যাপার হচ্ছে, কোরান ঈউসুফ আঃ এর বেলায় শাসকদের ক্ষেত্রে ‘রাজা’ শব্দ ব্যবহার করলেও, একই দেশের, মূসা আঃ এর সময়কার শাসকদের বেলায় ব্যবহার করেছে ‘ফিরাঊন’ শব্দটি। বলুন তো খালু, মরুভূমির বালুতে উট চরানো বালক মুহাম্মদ সাঃ ইতিহাসের এই পাঠ কোথায় পেলেন? তিনি কিভাবে জানতেন যে, ঈউসুফ আঃ এর সময়ের শাসকদের ‘রাজা’ বলা হতো, মূসা আঃ সময়কার শাসকদের ‘ফেরাঊন’? এবং, ঠিক সেই মতো শব্দ ব্যবহার করে তাদের পরিচয় দেওয়া হলো?’
মহব্বত আলি নামের ভদ্রলোকটি হো হো হো করে হাসতে লাগলো। বললো,- ‘মূসা আর ঈউসুফের কাহিনী তো বাইবেলেও ছিলো। মুহাম্মদ সেখান থেকে কপি করেছে, সিম্পল।’
সাজিদ মুচকি হেসে বললো,- ‘খালু, ম্যাটার অফ সরো দ্যাট, বাইবেল এই জায়গায় চরম একটি ভুল করেছে। বাইবেল ঈউসুফ আঃ এবং মূসা আঃ দুজনের সময়কার শাসকদের জন্যই ‘ফেরাঊন’ শব্দ ব্যবহার করেছে, যা ঐতিহাসিক ভুল। আপনি চাইলে আমি আপনাকে বাইবেলের ওল্ড টেষ্টামেণ্ট থেকে প্রমান দেখাতে পারি।’
লোকটা কিছুই বললো না। চুপ করে আছে। সম্ভবত, উনার প্রমান দরকার হচ্ছে না।
সাজিদ বললো,- ‘যে ভুল বাইবেল করেছে, সে ভুল অশিক্ষিত আরবের বালক মুহাম্মদ সাঃ এসে ঠিক করে দিলো, তা কিভাবে সম্ভব, যদি না তিনি কোন প্রেরিত দূত না হোন, আর, কোরান কোন ঐশি গ্রন্থ না হয়?’
লোকটি চুপ করে আছে। এরমধ্যেই তিনটি সিগারেট খেয়ে শেষ করেছে। নতুন আরেকটি ধরাতে ধরাতে বললো,- ‘হুম, কিছুটা যৌক্তিক।’
সাজিদ আবার বলতে লাগলো,- ‘খালু, কোরানে একটি সূরা আছে, সূরা আল ফাজর নামে। এই সূরার ৬ নম্বর আয়াতটি এরকম,- ‘তোমরা কি লক্ষ্য করো নি, তোমাদের পালনকর্তা ইরাম গোত্রের সাথে কিরূপ ব্যবহার করেছেন?’
এই সূরা ফাজরে মূলত আদ জাতি সম্পর্কে বলা হয়েছে। আদ জাতির আলাপের মধ্যে হঠাৎ করে ‘ইরাম’ নামে একটি শব্দ চলে এলো, যা কেউই জানতো না এটা আসলে কি। কেউ কেউ বললো, এটা আদ জাতির কোন বীর পালোয়ানের নাম, কেউ কেউ বললো, এই ইরাম হতে পারে আদ জাতির শারীরিক কোন বিশেষ বৈশিষ্ট্য, কারন, এই সূরায় আদ জাতির শক্তিমত্তা নিয়েও আয়াত আছে। মোদ্দাকথা, এই ‘ইরাম’ আসলে কি, সেটার সুস্পষ্ট কোন ব্যাখ্যা কেউই দিতে পারেনি তখন। এমনকি, গোটা পৃথিবীর কোন ইতিহাসে ‘ইরাম’ নিয়ে কিছুই বলা ছিলো না।
কিন্তু, ১৯৭৩ সালে, ন্যাশনাল জিওগ্রাফি সিরিয়ায় মাটির নিচে একটি শহরের সন্ধান পায়।এই শহরটি ছিলো আদ জাতিদের শহর। সেই শহরে পাওয়া যায়, সুপ্রাচীন উঁচু উঁচু দালান। এমনকি, এই শহরে আবিষ্কার হয় তখনকার একটি লাইব্রেরি। এই লাইব্রেরিতে একটি তালিকা পাওয়া যায়। এই তালিকায় তারা যেসকল শহরের সাথে বাণিজ্য করতো, সেসব শহরের নাম উল্লেখ ছিলো।আশ্চর্যজনক হলেও সত্য এই- সেই তালিকায় ‘ইরাম’ নামের একটি শহরের নামও পাওয়া যায়, যেটা আদ জাতিদেরই একটি শহর ছিলো। শহরটি ছিলো একটি পাহাড়ের মধ্যে। এতেও ছিলো সুউচ্চ দালান।
চিন্তা করুন, যে ‘ইরাম’ শব্দের সঠিক ব্যাখ্যা এর পূর্বে তাফসিরকারকরাও করতে পারেনি। কেউ এটাকে বীরের নাম, কেউ এটাকে আদ জাতির শারিরীক বৈশিষ্ট্যের নাম বলে ব্যাখ্যা করেছে,
১৯৭৩ সালের আগে যে ‘ইরাম’ শহরের সন্ধান পৃথিবীর তাবৎ ইতিহাসে ছিলো না, কোন ভূগোলবিদ, ইতিহাসবিদই এই শহর সম্পর্কে কিছুই জানতো না, প্রায় ৪৩ শত বছর আগের আদ জাতিদের সেই শহরের নাম কিভাবে কোরান উল্লেখ করলো? যেটা আমরা জেনেছি ১৯৭৩ সালে, সেটা মুহাম্মদ সাঃ কিভাবে আরবের মরুভূমিতে বসে ১৪০০ বছর আগে জানলো? হাউ পসিবল? তিনি তো অশিক্ষিত ছিলেন।কোনদিন ইতিহাস বা ভূগোল পড়েন নি। কিভাবে জানলেন, খালু?’
আমি খেয়াল করলাম, লোকটার চেহারা থেকে মোঘলাই ভাবটা সরে যেতে শুরু করেছে। পুত্রতুল্য ছেলের কাছ থেকে তিনি এতোটা শক খাবেন, হয়তো আশা করেন নি।
সাজিদ আবার বলতে লাগলো,-
‘খালু, আর রহমান নামে কোরানে একটি সূরা আছে। এই সূরার ৩৩ নম্বর আয়াতে বলা হচ্ছে,-
‘হে জ্বীন ও মানুষ! তোমরা যদি আসমান ও জমিনের সীমানায় প্রবেশ করতে পারো, তবে করো। যদিও তোমরা তা পারবেনা প্রবল শক্তি ছাড়া’
মজার ব্যাপার হলো, এই আয়াতটি মহাকাশ ভ্রমণ নিয়ে। চিন্তা করুন, আজ থেকে ১৪০০ বছর আগের আরবের লোক, যাদের কাছে যানবাহন বলতে কেবল ছিলো উট আর গাধা, ঠিক সেই সময়ে বসে মুহাম্মদ সাঃ মহাকাশ ভ্রমণ নিয়ে কথা বলছে, ভাবা যায়?
সে যাহোক, আয়াতটিতে বলা হলো,- ‘যদি পারো আসমান ও জমিনের সীমানায় প্রবেশ করতে, তবে করো’ ,
এটি একটি কন্ডিশনাল (শর্তবাচক) বাক্য। এই বাক্যে শর্ত দেওয়ার জন্য If (যদি) ব্যবহার করা হয়েছে।
খালু, আপনি যদি এ্যারাবিক ডিকশনারি দেখেন, তাহলে দেখবেন, আরবিতে ‘যদি’ শব্দের জন্য দুটি শব্দ আছে। একটি হলো ‘লাও’, অন্যটি হলো ‘ইন’। দুটোর অর্থই ‘যদি।’ কিন্তু, এই দুটোর মধ্যে একটি সুক্ষ্ম পার্থক্য আছে। পার্থক্যটি হলো- আরবিতে শর্তবাচক বাক্যে ‘লাও’ তখনই ব্যবহার করা হয়, যখন সেই শর্ত কোনভাবেই পূরণ সম্ভব হবে না। কিন্তু, শর্তবাচক বাক্যে ‘যদি’ শব্দের জন্য যখন ‘ইন’ ব্যবহার করা হয়, তখন নিশ্চয় এই শর্তটা পূরণ সম্ভব।
আশ্চর্যজনক ব্যাপার, কোরানে সূরা আর রহমানের ৩৩ নম্বর আয়াতটিতে ‘লাও’ ব্যবহার না করে ‘ইন’ ব্যবহার করা হয়েছে। মানে, কোন একদিন জ্বীন এবং মানুষেরা মহাকাশ ভ্রমণে সফল হবেই।আজকে কি মানুষ মহাকাশ জয় করেনি? মানুষ চাঁদে যায়নি? মঙ্গলে যাচ্ছে না?
দেখুন, ১৪০০ বছর আগে যখন মানুষের ধারনা ছিলো একটি ষাঁড় তার দুই শিংয়ের মধ্যে পৃথিবীকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, ঠিক তখন কোরান ঘোষণা করছে, মহাকাশ ভ্রমণের কথা। সাথে বলেও দিচ্ছে, একদিন তা আমরা পারবো। আরবের নিরক্ষর মুহাম্মদ সাঃ কিভাবে এই কথা বলতে পারে?’
–
এম.এম. আলি ওরফে মোহাম্মদ মহব্বত আলি নামের এই ভদ্রলোকের চেহারা থেকে ‘আমি নাস্তিক, আমি একেবারে নির্ভুল’ টাইপ ভাবটা একেবারে উধাও হয়ে গেলো। এখন তাকে যুদ্ধাহত এক ক্লান্ত সৈনিকের মতোন দেখাচ্ছে।
সাজিদ বললো,- ‘খালু, খুব অল্প পরিমাণ বললাম। এরকম আরো শ খানেক যুক্তি দিতে পারবো, যা দিয়ে প্রমান করে দেওয়া যায়, কোরান মুহাম্মদ সাঃ এর নকল করে লেখা কোন কিতাব নয়, এটি স্রষ্টার পক্ষ থেকে আসা একটি ঐশি গ্রন্থ। যদি বলেন, মুহাম্মদ সাঃ নিজের প্রভাব বিস্তারের জন্য এই কিতাব লিখেছে, আপনাকে বলতে হয়, এই কিতাবের জন্যই মুহাম্মদ সাঃ কে বরণ করতে হয়েছে অবর্ণনীয় কষ্ট, যন্ত্রণা।
এই কিতাবের বাণী প্রচার করতে গিয়েই তিনি স্বদেশ ছাড়া হয়েছিলেন।তাকে বলা হয়েছিলো, তিনি যা প্রচার করছেন তা থেকে বিরত হলে তাকে মক্কার রাজত্ব দেওয়া হবে। তিনি তা গ্রহন করেন নি। খালু, নিজের ভালো তো পাগলও বুঝে। মুহাম্মদ সাঃ বুঝলো না কেনো? এসবই কি প্রমান করেনা কোরানের ঐশি সত্যতা?’
–
লোকটা কোন কথাই বলছেনা। সিগারেটের প্যাকেটে আর কোন সিগারেট নেই।
আমরা উঠে দাঁড়ালাম। বের হতে যাবো, অমনি সাজিদ ঘাঁড় ফিরিয়ে লোকটাকে বললো, – ‘খালু, একটি ছোট প্রশ্ন ছিলো।’
– ‘বলো।’
– ‘আপনার বাগানে লাল রঙের কোন ফুল গাছ নেই। কেনো?’
লোকটি বললো,- ‘আমি রেড কালার ব্লাইন্ড। লাল রঙ দেখি না।’
সাজিদ আমার দিকে ফিরলো। অবাক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে বললো,- ‘জ্যোতিষী আরিফ আজাদ, ইউ আর কারেক্ট।’