দরসে হাদীছ : তিনটি শপথ ও একটি বাণী
عَنْ أَبِيْ كَبْشَةَ الأَنْمَارِىُّ أَنَّهُ سَمِعَ رَسُولَ اللهِ صلى الله عليه وسلم يَقُولُ ثَلاَثَةٌ أُقْسِمُ عَلَيْهِنَّ وَأُحَدِّثُكُمْ حَدِيثًا فَاحْفَظُوهُ. قَالَ مَا نَقَصَ مَالُ عَبْدٍ مِنْ صَدَقَةٍ وَلاَ ظُلِمَ عَبْدٌ مَظْلِمَةً فَصَبَرَ عَلَيْهَا إِلاَّ زَادَهُ اللهُ عِزًّا وَلاَ فَتَحَ عَبْدٌ بَابَ مَسْأَلَةٍ إِلاَّ فَتَحَ اللهُ عَلَيْهِ بَابَ فَقْرٍ أَوْ كَلِمَةً نَحْوَهَا وَأُحَدِّثُكُمْ حَدِيثًا فَاحْفَظُوهُ قَالَ إِنَّمَا الدُّنْيَا لأَرْبَعَةِ نَفَرٍ عَبْدٍ رَزَقَهُ اللهُ مَالاً وَعِلْمًا فَهُوَ يَتَّقِى فِيهِ رَبَّهُ وَيَصِلُ فِيهِ رَحِمَهُ وَيَعْلَمُ لِلَّهِ فِيهِ حَقًّا فَهَذَا بِأَفْضَلِ الْمَنَازِلِ وَعَبْدٍ رَزَقَهُ اللهُ عِلْمًا وَلَمْ يَرْزُقْهُ مَالاً فَهُوَ صَادِقُ النِّيَّةِ يَقُولُ لَوْ أَنَّ لِى مَالاً لَعَمِلْتُ بِعَمَلِ فُلاَنٍ فَهُوَ بِنِيَّتِهِ فَأَجْرُهُمَا سَوَاءٌ وَعَبْدٍ رَزَقَهُ اللهُ مَالاً وَلَمْ يَرْزُقْهُ عِلْمًا فَهُوَ يَخْبِطُ فِى مَالِهِ بِغَيْرِ عِلْمٍ لاَ يَتَّقِى فِيهِ رَبَّهُ وَلاَ يَصِلُ فِيهِ رَحِمَهُ وَلاَ يَعْلَمُ لِلَّهِ فِيهِ حَقًّا فَهَذَا بِأَخْبَثِ الْمَنَازِلِ وَعَبْدٍ لَمْ يَرْزُقْهُ اللهُ مَالاً وَلاَ عِلْمًا فَهُوَ يَقُولُ لَوْ أَنَّ لِى مَالاً لَعَمِلْتُ فِيهِ بِعَمَلِ فُلاَنٍ فَهُوَ بِنِيَّتِهِ فَوِزْرُهُمَا سَوَاءٌ- رَوَاهُ التِّرْمِذِيُّ-
আবু কাবশাহ আনমারী (রাঃ) বলেন, তিনি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে বলতে শুনেছেন যে, তিনটি বিষয় রয়েছে, যার উপরে আমি কসম করছি। আর আমি তোমাদের একটি হাদীছ বলব, যা তোমরা মুখস্ত রেখ। অতঃপর আমি যেগুলির উপর কসম করছি, তা এই যে, (১) ছাদাক্বার ফলে বান্দার সম্পদ হ্রাস পায় না। (২) যুলুমের শিকার হয়ে বান্দা ধৈর্য্যধারণ করলে আল্লাহ তার সম্মান বৃদ্ধি করে দেন। (৩) যে বান্দা চাওয়ার দুয়ার উন্মুক্ত করে, আল্লাহ তার অভাবের দুয়ার উন্মুক্ত করে দেন। অতঃপর তিনি বললেন, আমি যে হাদীছটি তোমাদের বলব, তা ভালভাবে স্মরণ রেখ। নিশ্চয়ই দুনিয়া মাত্র চার শ্রেণীর লোকের জন্য। (১) এমন বান্দা, যাকে আল্লাহ মাল ও ইলম দান করেছেন। আর সে তা ব্যয় করতে স্বীয় প্রতিপালককে ভয় করে (অর্থাৎ অন্যায় পথে ব্যয় করে না)। সে আত্মীয়দের সাথে সদ্ব্যবহার করে এবং তাতে আল্লাহর হক সম্পর্কে জানে (অর্থাৎ আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য যথাস্থানে ব্যয় করে)। এ ব্যক্তি হ’ল সর্বোত্তম মর্যাদার অধিকারী। (২) এমন বান্দা, যাকে আল্লাহ ইলম দিয়েছেন, কিন্তু মাল দেননি। কিন্তু সে সঠিক নিয়তে বলে যে, যদি আমার মাল থাকত, তাহ’লে আমি অমুকের ন্যায় সৎকর্মে ব্যয় করতাম। এই দুই ব্যক্তির পুরস্কার হবে সমান। (৩) এমন বান্দা, যাকে আল্লাহ মাল দিয়েছেন, কিন্তু ইলম দেননি। ইলম না থাকার দরুন সে তার সম্পদের ব্যাপারে স্বেচ্ছাচারিতায় লিপ্ত হয়। এতে সে আল্লাহকে ভয় করে না। আত্মীয়দের সাথে আর্থিক সদ্ব্যবহার রাখে না এবং নিজ সম্পদে আল্লাহর হক অনুযায়ী আচরণ করে না (অর্থাৎ হক পথে আয় ও ব্যয় করে না)। এ ব্যক্তি হ’ল নিকৃষ্টতম স্তরের অধিকারী। (৪) এমন বান্দা, যার মালও নেই, ইলমও নেই, সে আকাংখা করে বলে, যদি আমার কাছে মাল থাকত, তাহ’লে আমি তাতে অমুক ব্যক্তির মত আচরণ করতাম। এই বান্দাও তার মন্দ নিয়তের কারণে তৃতীয় ব্যক্তির ন্যায় পাপী হবে। উভয়ের পাপ সমান’।[1]
ব্যাখ্যা : অত্র হাদীছে আল্লাহর ইবাদত ও আনুগত্যপূর্ণ কাজ বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে সম্পদ বৃদ্ধির কামনা সিদ্ধ হওয়ার ব্যাপারে বর্ণিত হয়েছে। সেই সাথে এটাও বলা হয়েছে যে, নেকীর কাজে ব্যয় করার জন্য মাল-সম্পদ কামনা করলেও তাতে ছওয়াব পাওয়া যাবে, যদিও তার মাল না থাকে। পক্ষান্তরে মন্দ কাজে ব্যয়ের জন্য মালের আকাংখা করলে তাতে পাপ হবে, যদিও তার মাল না থাকে। এছাড়াও হালাল রূযী অল্প হ’লেও তার উপর সন্তুষ্ট থাকার প্রতি নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। যেটি অন্য হাদীছে স্পষ্টভাবে এসেছে যে,لَنْ تَمُوتَ نَفْسٌ حَتَّى تَسْتَوْفِيَ رِزْقَهَا، فَاتَّقُوا اللهَ وَأَجْمِلُوا فِي الطَّلَبِ، وَلاَ يَحْمِلَنَّكُمُ اسْتِبْطَاءُ الرِّزْقِ أَنْ تَطْلُبُوهُ بِمَعَاصِي اللهِ، فَإِنَّهُ لاَ يُدْرَكُ مَا عِنْدَ اللهِ إِلاَّ بِطَاعَتِهِ- ‘নিশ্চয়ই কোন প্রাণী মরবে না যতক্ষণ না সে তার রূযী পূর্ণভাবে প্রাপ্ত হবে। অতএব সাবধান! তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং সম্পদ উপার্জনে উত্তম (অর্থাৎ বৈধ) পন্থা অবলম্বন কর। প্রাপ্য রিযিক পৌঁছতে দেরী হওয়া যেন তোমাদেরকে তা অন্বেষণে অন্যায় পথ অবলম্বনে প্ররোচিত না করে। কেননা আল্লাহর নিকটে যা রয়েছে, সেটা তাঁর আনুগত্য ব্যতীত লাভ করা যায় না’।[2]
এখানে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ‘আমি কসম করছি’ বলেছেন বিষয়টির অধিকতর গুরুত্ব ও তাকীদ বুঝানোর জন্য। অর্থাৎ أُقْسِمُ عَلَيْهِمْ অর্থ أُخْبِرُكُمْ بِثَلاَثٍ أُؤَكِّدُهُنَّ بِالْقَسَمِ عَلَيْهِنَّ ‘তোমাদেরকে তিনটি বিষয়ে খবর দিচ্ছি যেগুলির উপর শপথ দ্বারা তাকীদ করার মাধ্যমে’। অতঃপর أُحَدِّثُكُمْ حَدِيثًا অর্থ أُحَدِّثُكُمْ تَحْدِيثًا عَظِيمًا ‘একটি মহতী বর্ণনা পেশ করছি’ (মিরক্বাত)।
অতঃপর যে তিনটি বিষয়ে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) কসম করে বলেছেন, তার প্রথমটি হ’ল ‘ছাদাক্বায় সম্পদ হ্রাস পায় না’। বরং বৃদ্ধি পায়। এ বিষয়ে আল্লাহ বলেন,يَمْحَقُ اللهُ الرِّبَا وَيُرْبِي الصَّدَقَاتِ وَاللهُ لَا يُحِبُّ كُلَّ كَفَّارٍ أَثِيمٍ ‘আল্লাহ সূদকে নিঃশেষ করেন ও ছাদাক্বায় প্রবৃদ্ধি দান করেন। বস্ত্ততঃ আল্লাহ কোন অবিশ্বাসী পাপীকে পসন্দ করেন না’ (বাক্বারাহ ২/২৭৬)। তিনি ব্যাখ্যা দিয়ে বলেন,الَّذِيْنَ يُنْفِقُوْنَ أَمْوَالَهُمْ فِيْ سَبِيْلِ اللهِ ثُمَّ لاَ يُتْبِعُوْنَ مَا أَنْفَقُوْا مَنًّا وَلَا أَذًى لَهُمْ أَجْرُهُمْ عِنْدَ رَبِّهِمْ وَلَا خَوْفٌ عَلَيْهِمْ وَلَا هُمْ يَحْزَنُوْنَ ‘যারা আল্লাহর পথে নিজেদের ধন-সম্পদ ব্যয় করে, অতঃপর ব্যয় করার পর খোটা দেয় না বা কষ্ট দেয় না, তাদের জন্য তাদের প্রতিপালকের নিকট রয়েছে পুরস্কার। তাদের কোন ভয় নেই এবং তারা চিন্তান্বিত হবে না’ (বাক্বারাহ ২/২৬২)।
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,مَنْ تَصَدَّقَ بِعَدْلِ تَمْرَةٍ مِنْ كَسْبٍ طَيِّبٍ، وَلاَ يَقْبَلُ اللهُ إِلاَّ الطَّيِّبَ، وَإِنَّ اللهَ يَتَقَبَّلُهَا بِيَمِينِهِ ثُمَّ يُرَبِّيهَا لِصَاحِبِهِ كَمَا يُرَبِّى أَحَدُكُمْ فَلُوَّهُ حَتَّى تَكُونَ مِثْلَ الْجَبَلِ- ‘যে ব্যক্তি স্বীয় হালাল উপার্জন হ’তে একটি খেজুর পরিমাণও দান করে। আর আল্লাহ হালাল ব্যতীত কবুল করেন না, তিনি সেটি স্বীয় ডান হাতে গ্রহণ করেন। অতঃপর সেটি লালন-পালন করেন, যেরূপভাবে তোমরা তোমাদের ঘোড়ার বাচ্চা পালন করে থাক। এভাবে তার নেকীর পরিমাণ পর্বতসম হয়ে যায়’।[3]
এটির বাস্তবতা ব্যাখ্যা করে রাসূল (ছাঃ) বলেন, পূর্বকালের জনৈক ব্যক্তি বলল, আমি অবশ্যই ছাদাক্বা করব। অতঃপর তার ছাদাক্বা নিয়ে সে বের হ’ল। কিন্তু (না জেনে) এক চোরকে দিল। সকালে লোকেরা বলাবলি করতে লাগল যে, রাতে একজন চোরকে ছাদাক্বা দেওয়া হয়েছে। একথা শুনে সে বলল, হে আল্লাহ! তোমার শুকরিয়া যে, আমি চোরকে দান করতে পেরেছি। সে বলল, আমি আরেকটি ছাদাক্বা করব। অতঃপর সে তা নিয়ে বের হ’ল এবং একজন ব্যভিচারিণীকে সেটা দিল। সকালে লোকেরা বলাবলি করতে লাগল যে, রাতে একজন ব্যভিচারিণীকে ছাদাক্বা দেওয়া হয়েছে। একথা শুনে সে বলল, হে আল্লাহ তোমার শুকরিয়া যে, আমি একজন ব্যভিচারিণীকে দান করতে পেরেছি। সে বলল, আমি আরেকটি ছাদাক্বা করব। অতঃপর সে বের হ’ল এবং একজন ধনী লোকের হাতে সেটা দিল। সকালে লোকেরা বলাবলি করতে লাগল যে, রাতে একজন ধনী লোককে দান করা হয়েছে। সে বলল, হে আল্লাহ! তোমার জন্য হাযারো শুকরিয়া যে, আমি চোর, বেশ্যা ও ধনী ব্যক্তিকে দান করতে পেরেছি। অতঃপর তাকে স্বপ্নে দেখানো হয় এবং বলা হয় যে, তোমার দানের মাধ্যমে সম্ভবতঃ চোর তার চুরি থেকে, বেশ্যা তার বেশ্যাবৃত্তি থেকে বাঁচতে চেষ্টা করবে। আর ধনী ব্যক্তি হয়ত এ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করবে এবং আল্লাহ তাকে যা দান করেছেন, তা থেকে সে দান করবে’।[4]
এর দ্বারা বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে যে, দানের মাধ্যমে সম্পদ বিস্তৃত হয় এবং মানুষের ক্রয় ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। তাতে সম্পদ একস্থানে জমা না হয়ে সর্বত্র সঞ্চালিত হয় এবং ছাদাক্বার ফলে অভাবের তাড়নায় মানুষ যেসব অন্যায় করে, তা হ্রাস পায়। ব্যবসায়ীর মালামাল অধিক বিক্রি হয় এবং তাতে দাতা ছাদাক্বা দানকারী প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে তার দানের সুফল ভোগ করে। বরং সে ছাদাক্বার চেয়ে বহুগুণ ফেরৎ পায়। এভাবে ছাদাক্বার মাধ্যমে পুঁজিবাদের ধস নামে।
দুই- যুলুমের শিকার ব্যক্তি যদি ছবর করে এবং আল্লাহর উপর ভরসা করে, তাহ’লে মযলূমের সম্মান বৃদ্ধি পায়। যালেমের অত্যাচার কমে যায়। তাতে সমাজে শান্তি থাকে। অন্যদিকে আল্লাহ দুনিয়াতেই তার প্রতিশোধ নেন; কখনো অন্য যালেমের মাধ্যমে, কখনো সরাসরি গযব নাযিলের মাধ্যমে। অথবা ক্বিয়ামতের দিন তার থেকে বদলা নিয়ে মযলূমকে দিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে। অথবা দুনিয়া ও আখেরাতে দু’দিকেই তার থেকে বদলা নেন। এ বিষয়ে আল্লাহ বলেন, وَلَوْلاَ دَفْعُ اللهِ النَّاسَ بَعْضَهُمْ بِبَعْضٍ لَفَسَدَتِ الْأَرْضُ وَلَكِنَّ اللهَ ذُو فَضْلٍ عَلَى الْعَالَمِيْنَ ‘বস্ত্ততঃ আল্লাহ যদি একদলকে অন্য দল দ্বারা প্রতিহত না করতেন, তাহ’লে পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যেত। কিন্তু আল্লাহ বিশ্ববাসীর প্রতি একান্ত দয়ালু’ (বাক্বারাহ ২/২৫১)।
পৃথিবীর ইতিহাসে নমরূদ, ফেরাঊন, হামান, ক্বারূন প্রমুখ যালেমরা চিরদিন ধিকৃত এবং ইবরাহীম, মূসা ও ঈসা চিরদিন সম্মানিত। যুগে যুগে এটাই বাস্তব ও চিরস্তন সত্য।
তিন- যে ব্যক্তি চাইতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে, তার অভাব কখনো শেষ হয় না। সে এক সময় বঞ্চিত হয় এবং হতাশ হয়ে পড়ে। এজন্য আমাদেরকে প্রতিদিনের ছালাতে প্রতি রাক‘আতে বলতে হয়, وَإِيَّاكَ نَسْتَعِيْنُ ‘আমরা কেবল তোমারই সাহায্য প্রার্থনা করি’ (ফাতেহা ১/৫)। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) কিশোর চাচাতো ভাই আব্দুল্লাহ ইবনু আববাসকে বলেন, যখন তুমি চাইবে, আল্লাহর কাছে চাইবে। আর যখন সাহায্য চাইবে, আল্লাহর কাছেই সাহায্য চাইবে।[5] জাহেলী কবি যুহায়েব বিন আবু সুলমা বলেন,
سَألْنَا فَأَعْطَيْتُمْ وَعُدْنَا فَعُدْتُمُ * وَمَنْ أَكْثَرَ التّسْآلَ يَوْماً سَيُحْرَمِ
‘আমরা চেয়েছিলাম, তোমরা দিয়েছিলে। পুনরায় চেয়েছিলাম, তোমরা পুনরায় দিয়েছিলে। কিন্তু যে ব্যক্তি বেশী বেশী চায়,
সে একদিন বঞ্চিত হয়’।[6]
এর বিপরীতে আমরা বলি, وَمَنْ أَكْثَرَ التّسْآلَ رَبًا سَيُكْرَمِ ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর নিকট বারবার চায়, সে সম্মানিত হয়’।
অতঃপর যে হাদীছটি রাসূলুললাহ (ছাঃ) মুখস্ত রাখার জন্য তাকীদ করেছেন, সেটিতে চারটি বিষয় বলা হয়েছে। যা দু’ভাগে বিভক্ত। এক- যে ব্যক্তিকে আল্লাহ ইলম ও মাল দু’টিই দান করেছেন এবং সে ব্যক্তি তা আল্লাহর পথে ব্যয় করে। এ ব্যক্তি হ’ল সর্বোত্তম স্তরের সম্মানিত ব্যক্তি। অন্য জনকে ইলম দেওয়া হয়েছে মাল দেওয়া হয়নি। কিন্তু সে ব্যক্তি কামনা করে যে, তাকে মাল দেওয়া হ’লে সে প্রথম ব্যক্তির মত তা আল্লাহর পথে ব্যয় করবে। এ ব্যক্তিও প্রথম ব্যক্তির সমান উচ্চ মর্যাদার অধিকারী হবে। যদিও সে মাল না পায়।
দুই- এমন ব্যক্তি যাকে আল্লাহ মাল দিয়েছেন, কিন্তু ইলম দেননি। সে তার মালে স্বেচ্ছাচারিতা করে। এ ব্যক্তি হ’ল নিকৃষ্টতম স্তরের অধিকারী। অন্য জনের মালও নেই, ইলমও নেই। কিন্তু সে আকাংখা করে যে, আমার কাছে মাল থাকলে আমি তৃতীয় জনের মত স্বেচ্ছাচারিতা করতাম। উভয় ব্যক্তি সমান পাপী ও নিকৃষ্টতম স্তরের হবে। যদিও শেষোক্তজন মালের অধিকারী না হয়। কিন্তু সে তার নিয়ত অনুযায়ী মন্দ ফল পাবে। এর দ্বারা বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে যে, পাপের আকাংখা থাকলে সে পূর্ণ পাপী হবে। কিন্তু এই বক্তব্যটি বাহ্যতঃ নিম্নের হাদীছটির বিপরীত।-
عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ رضى الله عنهما عَنِ النَّبِىِّ صلى الله عليه وسلم- فِيمَا يَرْوِى عَنْ رَبِّهِ عَزَّ وَجَلَّ قَالَ قَالَ : إِنَّ اللهَ كَتَبَ الْحَسَنَاتِ وَالسَّيِّئَاتِ، ثُمَّ بَيَّنَ ذَلِكَ فَمَنْ هَمَّ بِحَسَنَةٍ فَلَمْ يَعْمَلْهَا كَتَبَهَا اللهُ لَهُ عِنْدَهُ حَسَنَةً كَامِلَةً، فَإِنْ هُوَ هَمَّ بِهَا فَعَمِلَهَا كَتَبَهَا اللهُ لَهُ عِنْدَهُ عَشْرَ حَسَنَاتٍ إِلَى سَبْعِمِائَةِ ضِعْفٍ إِلَى أَضْعَافٍ كَثِيرَةٍ، وَمَنْ هَمَّ بِسَيِّئَةٍ فَلَمْ يَعْمَلْهَا كَتَبَهَا اللهُ لَهُ عِنْدَهُ حَسَنَةً كَامِلَةً، فَإِنْ هُوَ هَمَّ بِهَا فَعَمِلَهَا كَتَبَهَا اللهُ لَهُ سَيِّئَةً وَاحِدَةً- مُتَّفَقٌ عَلَيْهِ-
আব্দুল্লাহ বিন আববাস (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) হ’তে, যা তিনি বর্ণনা করেন তাঁর মহান প্রভু হ’তে, তিনি বলেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ পুণ্য ও পাপ সমূহ লিপিবদ্ধ করেন। অতঃপর তিনি ব্যাখ্যা দেন, যে ব্যক্তি কোন নেকীর কাজের সংকল্প করে, অথচ সেটি করে না, আল্লাহ তার জন্য পূর্ণ একটি নেকী লেখেন। আর যদি সেটার সংকল্প করে ও তা বাস্তবায়ন করে, আল্লাহ তার জন্য ১০টি থেকে ৭০০ ও তার চেয়ে বহুগুণ বেশী নেকী লেখেন। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি কোন মন্দ কাজের সংকল্প করে, কিন্তু তা করে না, আল্লাহ তার জন্য একটি পূর্ণ নেকী লেখেন। আর যদি সংকল্প করে, অতঃপর সেটি করে, তাহ’লে আল্লাহ তার জন্য একটি পাপ লেখেন’।[7]
এক্ষণে উভয় হাদীছের মধ্যে সমন্বয় এই যে, পাপ চিন্তা করা সত্ত্বেও যে ব্যক্তি পাপ কাজ করেনি, যদি সে ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও স্রেফ আল্লাহর ভয়ে তা থেকে বিরত হয়, তাহ’লে তার জন্য পূর্ণ একটি নেকী লেখা হয়। যেমনটি অন্য বর্ণনায় এসেছে, وَإِنْ تَرَكَهَا مِنْ أَجْلِى فَاكْتُبُوهَا لَهُ حَسَنَةً ‘যদি সে আমার ভয়ে পাপ পরিত্যাগ করে থাকে, তাহ’লে তোমরা এর বিনিময়ে তার জন্য একটি পূর্ণ নেকী লেখ’ (বুখারী হা/৭৫০১)। অতএব মাল না পেলেও পাপের আকাংখা থাকার কারণে সে পূর্ণ পাপী হবে। কেননা সে আল্লাহর ভয়ে পাপ থেকে বিরত হওয়ার সংকল্প করেনি। যদি সেটা করত, তাহ’লে পাপী হওয়ার বদলে সে পুণ্যবান হ’ত।
মূলতঃ অন্তরজগতকে পাপচিন্তা থেকে বিরত রাখা এবং আল্লাহভীতি অর্জন করাই দরসে বর্ণিত হাদীছের মুখ্য উদ্দেশ্য। কেননা আত্মশুদ্ধি লাভ করাই হ’ল ইবাদতের মূল। আর খালেছ অন্তরে আল্লাহর ইবাদত ও আখেরাতভীতি মানুষকে আত্মশুদ্ধিতা অর্জনে সাহায্য করে। কুরআন ও সুন্নাহর নিয়মিত অনুশীলনের মাধ্যমে আত্মশুদ্ধিতা অর্জিত হয় ও তা বজায় থাকে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এ উদ্দেশ্যেই প্রেরিত হয়েছিলেন। যেমন আল্লাহ বলেন, هُوَ الَّذِي بَعَثَ فِي الْأُمِّيِّينَ رَسُولاً مِنْهُمْ يَتْلُو عَلَيْهِمْ آيَاتِهِ وَيُزَكِّيهِمْ وَيُعَلِّمُهُمُ الْكِتَابَ وَالْحِكْمَةَ وَإِنْ كَانُوا مِنْ قَبْلُ لَفِي ضَلاَلٍ مُبِينٍ- ‘তিনিই নিরক্ষরদের মধ্যে তাদের মধ্য থেকেই একজনকে রাসূল হিসাবে প্রেরণ করেছেন। যিনি তাদের নিকট তাঁর আয়াত সমূহ পাঠ করে শুনান। তাদেরকে পবিত্র করেন এবং কুরআন ও সুন্নাহ শিক্ষা দেন। যদিও ইতিপূর্বে তারা স্পষ্ট ভ্রান্তির মধ্যে ছিল’ (জুম‘আ ৬২/২)।
মোদ্দাকথা হ’ল, বাহ্যিকভাবে অনেকে দ্বীনদার বলে পরিচিত হ’লেও তার মনের জগত যদি রিয়া ও শ্রুতির কলুষমুক্ত না হয় এবং সেটি দুনিয়াবী উদ্দেশ্য হাছিলের ক্লেদ হ’তে পরিচ্ছন্ন না হয়, তাহ’লে তার সকল সৎকর্ম নিষ্ফল হবে।
আল্লাহ আমাদের দুনিয়াবী স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে স্রেফ আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের মহতী উদ্দেশ্যে সকল সৎকর্ম করার তাওফীক দান করুন- আমীন!
জনৈক আরবী কবি বলেন,
لَو كانَ لِلعِلمِ دُونَ التُقى شَرَفٌ
لَكانَ أشرَفُ خَلقِ اللهِ إبليسُ
‘যদি তাক্বওয়া বিহীন ইলমের কোন মর্যাদা থাকত,
তাহ’লে ইবলীস আল্লাহর সৃষ্টিকুলের সেরা বলে গণ্য হ’ত’।
– মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
[1]. তিরমিযী হা/২৩২৫; ইবনু মাজাহ হা/৪২২৮; মিশকাত হা/৫২৮৭ ‘রিক্বাক্ব’ অধ্যায় ৩ অনুচ্ছেদ ।
[2]. বায়হাক্বী শো‘আব হা/১০৩৭৬; মিশকাত হা/৫৩০০; ছহীহুল জামে‘ হা/২০৮৫; ছহীহাহ হা/২৮৬৬।
[3]. বুখারী হা/১৪১০; মুসলিম হা/১০১৪; মিশকাত হা/১৮৮৮ ‘যাকাত’ অধ্যায় ‘ছাদাক্বার মাহাত্ম্য’ অনুচ্ছেদ।
[4]. বুখারী হা/১৪২১; মুসলিম হা/১০২২; মিশকাত হা/১৮৭৬ ‘যাকাত’ অধ্যায় ‘দানের প্রশংসা ও কৃপণতার নিন্দা’ অনুচ্ছেদ।
[5]. তিরমিযী হা/২৫১৬; মিশকাত হা/৫৩০২, সনদ ছহীহ।
[6]. মু‘আল্লাক্বা যুহায়ের, সর্বশেষ ৬৪ নং লাইন।
[7]. বুখারী হা/৬৪৯১; মুসলিম হা/১৩১; মিশকাত হা/২৩৭৪।