সাম্প্রতিক প্রসঙ্গ

গরুর চেয়ে মানুষের প্রাণের মূল্য কম!

এটি মৌলিক লেখা নয়। ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, বিবিসি ও সিএনএন থেকে পাওয়া তথ্যগুলোর উপস্থাপনা মাত্র। জুলুম-অত্যাচার ও বঞ্চনা মানুষকে কিভাবে বিশ্বাস পাল্টে ফেলতে বাধ্য করে তার উপমা খুঁজতে এই লেখার দায়বোধ জেগেছে। একই কারণে মানুষ শান্তিকামী থেকে চরমপন্থী হওয়ার দিকে ঝুঁকে পড়ে কেন, সেটাও খতিয়ে দেখতে চেয়েছি।

মানতেই হবে ভারতীয় সমাজের একপিঠ যথেষ্ট ফকফকা। আরেক পিঠে দগদগে ক্ষত। এ ক্ষতের কারণ বঞ্চনা, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা এবং নৃতাত্ত্বিক পরিচয় ধরে রাখার প্রবল ইচ্ছা। মাওবাদী ও চারু মজুমদারেরা যে ভাষায় প্রতিবাদ করেছেÑ সেভেন সিস্টার সে পথে যায়নি। আবার কাশ্মির ও শিখ ল্যান্ডের দাবিদারদের পথ আলাদা। সবার শেষ কথা বঞ্চনা থেকে নিষ্কৃতি। শত সহস্র সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার চেহারা আরেক ধরনের। যেমন, ভারতে দলিত জনগোষ্ঠীর ওপর হিন্দুত্ববাদী ও বর্ণবাদীদের অত্যাচার থামছে না। তাই দলিত হিন্দু পরিবারের ‘একযোগে’ ধর্মান্তরিত হওয়ার প্রবণতাও বেড়েছে। সম্প্রতি মন্দিরে প্রবেশে বাধা পেয়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিলো তামিলনাড়ুর আড়াই শ’ দলিত পরিবার। স্মরণে পড়ে, ১৯৮১ সালে কেরালায় একসাথে কয়েক হাজার দলিত এক অনুষ্ঠানেই ধর্মান্তরিত হয়ে ইসলাম গ্রহণ করেছিল। এটা ভারতীয় সমাজের সাধারণ প্রবণতা। প্রতিদিন কেউ না কেউ খ্রিষ্টান কিংবা মুসলমান হচ্ছে।

মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে, ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে দলিতদের ওপর কট্টর হিন্দুত্ববাদী সংগঠনের আক্রমণ বেড়েই চলছে। গুজরাটের উনা ও তামিলনাড়ুতে এমন ঘটনার খবর প্রায়ই প্রকাশিত হচ্ছে। এর পরিণতিও হচ্ছে ভয়াবহ ও মারাত্মক। বর্ণপ্রথার এই খেসারত ভারতকে কতটা দিতে হবে জানি না।

গেলো বছর হরিয়ানায় প্রায় ১০০টি দলিত পরিবার ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিল। এমন নজির থাকা সত্ত্বেও দলিতদের ওপর নির্যাতন কমেনি। গুজরাটের উনা নামক স্থানের ঘটনা রাজনৈতিক মহলে যত শোরগোলই ফেলুক, বাস্তবের ছবিটা কিন্তু তেমন বদলায়নি। আর তাই স্বধর্মের উগ্র ও জঙ্গিবাদীদের অত্যাচার সহ্য করতে না পেরেই অন্য ধর্মের আশ্রয় গ্রহণ করতে বাধ্য হচ্ছেন নিপীড়িত অধিকারবঞ্চিত দলিতরা।

এবারের ঘটনাটি তামিলনাড়–র বেদারণ্যম ও কারুর জেলায়। দলিতদের অভিযোগ, বরাবরই তাদের প্রতি বৈষম্যমূলক ব্যবহার করা হয়। একই চিত্র কারুর জেলাতেও। স্থানীয় মহাশক্তি মন্দিরে প্রবেশের অনুমতি দেয়া হয়নি ৩৫টি দলিত পরিবারকে। কারণ তারা ‘অচ্ছুত’। দলিতরা ভাবলেন, যে ধর্মে মানুষকে মর্যাদা দেয় না, মানুষের ভেতর শ্রেণী-বিভাজন করাকে ঈশ্বরের মর্জি বলে প্রচার করা হয়, অচ্ছুত অভিহিত করে উপাসনালয়ে ঢুকতে দেয় নাÑ সেখানে পাথরের মূর্তি থাকতে পারে; ঈশ্বর বা সৃষ্টিকর্তা আছে, সেটা ভাবা অর্থহীন। তাই নেতিবাচক ভাবনা তাদের ধর্মান্তরে উৎসাহিত করেছে। সাম্য-মৈত্রীর আহ্বান পেয়েই ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হওয়ার সিদ্ধান্ত নেন দলিতরা। এটি স্বতঃস্ফূর্ততার বিষয়। অত্যাচার ও শ্রেণিবৈষম্যের বিপরীতে অবস্থান নেয়া বা আশ্রয় পাওয়ার তাগিদ এখানে গৌণ নয়। কোনো মুসলিম তাদের প্রলুব্ধ করেনি।

বর্ণবাদের শিকার শুধু দলিতরা নয়, সংখ্যালঘু মুসলিম সম্প্রদায়ও এই জুলুমের শিকার। এই জুলুমের বাইরে নেই ুদ্র নৃগোষ্ঠীর সদস্যরা। হরিজন, দলিত, অচ্ছুত, যবন-ম্লেচ্ছ, রক্তমাংসের মানুষকে এভাবে ভাগ-বিভাজন করে কিভাবে ধর্মাচার হতে পারে? রাষ্ট্রাচারও কিভাবে সম্ভব! এ প্রশ্ন সব মুক্তচিন্তার বিবেকের। আরো ভয়ানক ঘটনা হচ্ছে, ভারতের কর্নাটক রাজ্যের একটি ‘দলিত’ বা নি¤œবর্ণের হিন্দু পরিবার গরুর গোশত খেয়েছেÑ শুধু এই সন্দেহে তাদের ওপর আক্রমণ চালিয়েছে বজরঙ্গ দল নামে একটি হিন্দুত্ববাদী সংগঠন। এ দলটি নরেন্দ্র মোদির দল বিজেপির আশীর্বাদপুষ্ট। অথচ ভারত পৃথিবীজুড়ে গরুর গোশত রফতানিকারক দেশগুলোর শীর্ষে, যে রফতানি আয় ভারতের অর্থনীতিকে স্ফীত করে চলেছে। কর্নাটক রাজ্যের চিকমাগালুরে এ ঘটনা ঘটে।

সপ্তাহখানেক আগের ঘটনাটি জানা গেছে ক’দিন বিলম্বে।
বজরঙ্গ দল নামের জঙ্গিগোষ্ঠীটির প্রায় ৪০ থেকে ৫০ জন সদস্য এ আক্রমণ চালায়। এতে পরিবারটির তিনজন সদস্য গুরুতর আহত হন বলে পুলিশের কাছে দায়ের করা অভিযোগে বলা হয়েছে। কোনো মুসলিম বা ইসলামি দল নয়, কর্নাটক সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ফোরাম নামে একটি সংগঠন এ নিয়ে পুলিশের কাছে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দায়ের করে। এ ধরনের আক্রমণের বিরুদ্ধে বিােভও হয়েছে ভারতে। এ ঘটনায় কয়েকজনকে গ্রেফতার করা হলেও পরে তারা জামিনে ছাড়া পেয়ে গেছেন। কারণ রাষ্ট্রশক্তি পরিচালিত হয় বর্ণবাদীদের দ্বারাÑ যারা আক্রমণকারীদেরই পৃষ্ঠপোষক।

গত মাসে ভারতের গুজরাট রাজ্যের উনা শহরে স্বঘোষিত ‘গো-রক’ গোষ্ঠীর লোকেরা দলিত সম্প্রদায়ের চারজন ট্যানারি শ্রমিককে প্রকাশ্যে মারধর করেছে। গত বছর উত্তর প্রদেশে একটি মুসলিম পরিবারে গরুর গোশত খাওয়া এবং রাখা হয়েছে, এ গুজব ছড়ানোর পর এক ব্যক্তিকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যার ঘটনা ঘটেছে। ক্রুদ্ধ একদল হিন্দুত্ববাদী জঙ্গি মোহাম্মদ আখলাক নামের এক মুসলিমকে পিটিয়ে বাড়ি থেকে টেনে বের করে এনে হত্যা করে। গরুর গোশত খাওয়ার সন্দেহে দলিত লোকজনের বাড়িতে হামলা চালানোর আরো অনেক নজির আছে। এবার যুক্তরাষ্ট্রও এ ইস্যুতে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। আমাদের জানা নেই, পৃথিবীর আর কোথাও মানুষের প্রাণের ও মর্যাদার চেয়ে গরুর মর্যাদা এভাবে বেশি বলে নিরূপণ করা হয় কি না। যে ধর্মেরই হোক, হোক না নাস্তিকÑ মানুষ সৃষ্টির সেরা, পৃথিবীর অপরাপর সব পণ্যদ্রব্য, বস্তু ও প্রাণিসম্পদ মানুষের জন্যই। তারপরও এই বাড়াবাড়ি ও অনৈতিক উগ্রতা কিভাবে রাষ্ট্রের আনুকূল্য পেতে পারে?

সম্প্রতি বর্ণবাদীদের আচরণে ক্ষুব্ধ হয়ে একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে এক হাজার হিন্দু দলিত পরিবার ইসলাম গ্রহণের হুঁশিয়ারি দিয়েছে। ভারতের উত্তর প্রদেশের গাজিয়াবাদে বামহেটা গ্রামে দলিত সম্প্রদায়ের অষ্টম শ্রেণীর স্কুলছাত্রীকে গণপাশবিক নির্যাতন এবং পরে ওই ছাত্রীর আত্মহত্যার ঘটনাকে কেন্দ্র করে সেখানে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছে। এ ঘটনায় অভিযুক্ত যুবক বাবলু ও রাঞ্চো যাদবের পরিবারের লোকজন তিগ্রস্ত ওই দলিত পরিবারের ওপর মামলা প্রত্যাহারের জন্য চাপ সৃষ্টি করে যাচ্ছে। পরে এই বিষয়টি নিয়ে আরো উত্তেজনা ছড়ায়। সে দিন ছিল ওই ছাত্রীর ‘চৌথা’ অনুষ্ঠান। এটা সম্ভবত কোনো লোকজ কিংবা ধর্মীয় আচার। গ্রামের সাবেক প্রধান লীলা ধর ও অভিযুক্তদের পরিবারের লোকজন সেখানে যান এবং তিগ্রস্ত পরিবারের সদস্যদের মারধর করেন। স্থানীয় দলিত সম্প্রদায়ের বাসিন্দা প্রদীপের অভিযোগ, গত ২৯ মার্চ বিকেল সাড়ে ৫টা নাগাদ বাবলু ও রাঞ্চো ওই ছাত্রীকে পাশবিক নির্যাতন করেছে। এটা করার সাহস হয়েছে এ জন্য যে, ওই মেয়েটি ছিল দলিত। আর রাষ্ট্রশক্তি ছিল নির্যাতনকারীদের পক্ষেই। ওরা ভেবেছিল, এই অপকর্ম করে সহজেই পার পেয়ে যাবে। ৬ এপ্রিল যখন ওই নির্যাতিতা গায়ে আগুন ধরিয়ে আত্মহত্যা করেন, তখন ঘটনাটি ভিন্ন রূপ নেয়।

দলিত গোষ্ঠীর নেতা প্রদীপ বলেছেন, এই গ্রামে দলিতরা সংখ্যালঘু হলেও তারা সংগঠিত। গ্রামে কমপে এক হাজার দলিত পরিবার রয়েছে। গ্রামের অন্য সম্প্রদায়ের কিছু মানুষ তাদের শোষণ করছে। এই পাশবিক নির্যাতন তো একটি সূত্র মাত্র। এমনকি পুলিশও ঘুষ নিয়ে অন্য সম্প্রদায়ের প নিচ্ছে। এ ঘটনার পরে তারা সম্ভবত ইসলাম গ্রহণ করতে চলেছে। তাদের বক্তব্য, হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে আমাদের কথা শোনার মতো কেউ নেই। আমরা যদি ইসলাম গ্রহণ করি তাহলে আর যাই হোক ন্যায্য শুনানিটা পাবো।

২০১৩ সালে এক দলিত নারীকে পাঁচ যুবক ধর্ষণ করেছিল। সে সময় তারা ভিওয়ানি শহরে বাস করত। ধর্ষিতাকে হুমকি দেয়া হলে পুরো পরিবার রোহতায় চলে আসে। কিন্তু এতেও রা পাননি ওই দলিত নারী। অপরাধীরা জামিনে মুক্তি পেয়ে ফের তাকে ধর্ষণ করেছে। টেলিভিশনে দেয়া এক সাাৎকারে ধর্ষিতা জানিয়েছেন, এক সপ্তাহ আগে কলেজ থেকে বের হওয়ার সময় ওই লোকগুলোকে আমি দেখতে পাই। তখন খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। তারা আমাকে জোর করে একটি গাড়িতে ঢুকায় এবং আমার বাবা-মাকে মেরে ফেলার হুমকি দেয়। তারপর আমার শ্বাসরোধ করার চেষ্টা করে। আমাকে প্রায় মৃত্যুমুখে ফেলে চলে যায়। কিন্তু এক পথচারী আমাকে দেখে হাসপাতালে নিয়ে আসে। চার বছর আগে দিল্লিতে ২৩ বছর বয়সী এক মেডিক্যাল ছাত্রীকে ধর্ষণের পর দেশটিতে ধর্ষণের আইন কঠোর করা হয়েছে। এমনকি কেউ ধর্ষণের দায়ে দুইবার অভিযুক্ত হলে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়ার আইন কার্যকর রয়েছে। কিন্তু পাঁচ ধর্ষক ছাড়া পেয়ে যায়। বিবিসি বলছে, এ আইন থাকা সত্ত্বেও রাষ্ট্র ধর্ষিতাকে সাহায্য করেনি।

বিশ্ব মিডিয়ার তথ্য হচ্ছে, ভারতে প্রতিদিন গড়ে একজন দলিত নারী ধর্ষণের শিকার হচ্ছেন। এ তথ্যটি উঠে এসেছে দলিত সম্প্রদায়ের দণি এশীয় আঞ্চলিক সম্মেলনে। বাংলাদেশ ছাড়াও নেপাল ও ভারতের দলিত প্রতিনিধিরা এ সম্মেলনে অংশ নেন। তারা তুলে ধরেন নিজ নিজ দেশে এই সম্প্রদায়ের অবস্থান। বাংলাদেশের রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে আয়োজিত ‘দলিত জনগোষ্ঠীর সামাজিক অন্তর্ভুক্তি এবং দলিত নারী ইস্যু বিষয়ে আঞ্চলিক অ্যাজেন্ডা নির্ধারণ’ শীর্ষক সম্মেলনে আরো অনেক স্পর্শকাতর বিষয় উঠে এসেছে।

সম্মেলনের শেষ দিনের অধিবেশনে ভারতীয় প্রতিনিধি রুথ মনোরমা বলেন, ‘সাধারণ নারীদের েেত্র নির্যাতন হলে মানুষ যেভাবে সোচ্চার হয়, দলিতদের েেত্র সেভাবে হয় না। প্রতিদিনই ভারতে কোথাও না কোথাও একজন দলিত নারী ধর্ষণের শিকার, অথচ এর কোনো প্রতিকার নেই।’ নেপালের প্রতিনিধি ইয়াম বাহাদুর কিষাণ দাবি করেন, তাদের দেশের চিত্র ভিন্ন। ‘তাদের দেশে সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে দলিতদের। শুধু তাই নয়, পার্লামেন্টে এক-তৃতীয়াংশ দলিত সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি আছেন। আর এ বিষয়টি ছিল মাওবাদীদের রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি।’

শুধু লিঙ্গবৈষম্য নয়, জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে কিভাবে অবহেলিত হচ্ছেন এই দলিতরা সেটা অনেকের জানা নেই। এ ছাড়া পড়াশোনা, চাকরি ও মানবাধিকারসহ প্রতিটি েেত্রই দলিতদের অধিকারের বিষয়টি উপেক্ষিত। কেরালা ভারতের সবচেয়ে শিতি রাজ্যগুলোর অন্যতম, আর সেখানে নির্বাচনও সামনে। দেশের সবচেয়ে শিতি সমাজেও এমন বীভৎস খুন ও ধর্ষণের ঘটনা গোটা রাজ্যকে স্তম্ভিত করে দিয়েছে। এ ঘটনা আলাদা রাজনৈতিক মাত্রাও পেয়ে গেছে।

ভারতের সংবিধানপ্রণেতা ড. বি আর আম্বেদকার নিজেই ছিলেন দলিত শ্রেণীর। এরপরও ভারতীয় সমাজে দলিতদের ভাগ্য পরিবর্তনে তিনি কিছুই করে যেতে পারেননি। গান্ধীজীর সাথে ১৯৩১ সালে ভারতীয় সংবিধানের মূল রূপকার ও গণপরিষদের সভাপতি ড. আম্বেদকারের প্রথম দেখা। গান্ধীজী বললেন, আপনি কংগ্রেসের প্রতি কেন এত রুষ্ট? আম্বেদকার বললেন, আমি অস্পৃশ্য। আমার তো কোনো মাতৃভূমি নেই। বঞ্চনা সহ্য করতে না পেরে আম্বেদকার ধর্মান্তরের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। তার ইচ্ছা ছিল সাম্যবাদের ধর্ম ইসলামে দীক্ষিত হবেন। গান্ধীজী খবরটি জানতে পেরে তাকে অনুরোধ করে বলেনÑ বৌদ্ধ কিংবা খ্রিষ্টান হলে প্রতিক্রিয়া কম হবে। এ ঘটনাটি ইতিহাস আশ্রয়ী। অথচ গান্ধীজী দলিতদের ‘হরিজন’ অর্থাৎ ঈশ্বরের মানুষ হিসেবে মর্যাদা দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তার ভেতরের অসঙ্গতি ভারতের দলিতদের ভাগ্য বদলায়নি। ভারতের বর্ণবাদ এখন আরো বেশি মাত্রায় হাত-পা ছড়িয়ে বসেছে। জাত-পাত, চ্যুত-অচ্ছুত ভাবনা ও সাম্প্রদায়িকতা লুকোনোর পর্যায়ে নেই।

বর্ণপ্রথার এ বিভাজন মানুষকে প্রকৃত মানুষের মর্যাদায় উঠতে দিচ্ছে না। লেখক কৃষণ চন্দরের ‘তেত্রিশ কোটি দেবতার দেশে’ মানুষকে নিয়ে এই অবজ্ঞাÑ গণতন্ত্রের ও ধর্মনিরপেক্ষতার চাদরে ঢেকে রাখা কিভাবে সম্ভব? তাই বিশ্বাস পরিবর্তনের এই হিড়িক। মানুষ বিশ্বাস ও নিজস্ব স্বাধীনতাকে হুমকির মুখে পড়তে দেখলে বিশ্বাস পাল্টায়। স্বাধীনতা খর্ব হলে প্রতিবাদী হয়। কিন্তু বঞ্চনা, শোষণ-নির্যাতন, নিপীড়ন হতে দেখলে শুধু প্রতিবাদী হয় না, প্রতিশোধকামীও হয়ে ওঠে। সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ মোকাবেলায় এ বিষয়টিও মাথায় রাখতে হবে। এক সময় যারা বলতেন, ‘কওমি মাদরাসা জঙ্গি প্রজননকেন্দ্র’, তারা এত দিনে জবাব পেয়ে গেছেন, বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িকতা নেই। দলিত ও অচ্ছুত ভাবনা গৌণ। তাই সন্ত্রাসী-জঙ্গি যে পরিবার ও যে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আসুক, তারা এ মাটির সন্তান। তারা কী চায়, কিভাবে চায় সেটার ধরন চিহ্নিত করা জরুরি। পৃথিবীজুড়ে স্বাধীনতাকামী প্রত্যেক মানুষ কখনো না কখনো অস্ত্র হাতে লড়াই করেছে, এখনো করছে। কোথাও এরা বিচ্ছিন্নতাবাদী, কোথাও চরমপন্থী। তা ছাড়া ধর্মীয় অধিকার থেকে বঞ্চিত হলে মানুষ ধর্মের প্রাণস্পর্শী মানবতাবাদ ভুলে যায়। ধর্মান্ধতার ভেতর আশ্রয় খোঁজে। ুদ্র নৃগোষ্ঠীও দীর্ঘ দিন তাদের মানবিক মর্যাদা হারিয়ে পদদলিত হয়ে থাকতে চায় না। কোনো মানুষ দাসত্ব বেশি দিন হজম করে না। দেশে দেশে এর উপমা অসংখ্য। ভারতের দলিতরা অনেক দিন প্রহর গুনবেনÑ সেটা ভাবা কি যৌক্তিক?

– মাসুদ মজুমদার / নয়া দিগন্ত

মন্তব্য করুন

Back to top button