জাকির নায়েকের চ্যালেঞ্জের কী হবে?
প্রতিটি ধর্মবিশ্বাসকে সম্মান করা, নিজের বিশ্বাস নিয়ে আত্মপ্রত্যয়ী হওয়া সহজ নয়। তার ওপর বিশ্বাসগুলোর মধ্যে অমিল এড়িয়ে মিলগুলো দেখা আরো কঠিন কাজ। কুরআন-সুন্নাহর ওপর দখল নিয়ে অন্য বিশ্বাসগুলোর মৌলিক চিন্তা আত্মস্থ করা অধ্যবসায়ের বিষয়। এ কাজটি বেশি মানুষের পক্ষে করা সম্ভব নয়। তার ওপর যুগজিজ্ঞাসার জবাবগুলো যুক্তি, তথ্য, বিজ্ঞানসম্মত ও বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে উপস্থাপন করা, সেটাকে কুরআন-হাদিসবিধৌত করে তুলে ধরার মতো নজির বিরল। প্রায় দুই হাজার পাবলিক লেকচার এবং পুরো বিশ্বের ২০০ দেশ চষে বেড়ানোর অভিজ্ঞতাও কম মানুষের পক্ষেই সঞ্চয় করা সম্ভব।
এ সবই সম্ভব করে আলোচনার তুঙ্গে উঠেছেন যে ব্যক্তিত্ব, তার নাম ডা: জাকির আবদুল করিম নায়েক। হালকা-পাতলা গড়নের জাকির নায়েক এখন সাধারণ অর্থে একজন ইসলাম প্রচারক, তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বের গুরু। তার জন্ম ভারতের মহারাষ্ট্রের মুম্বাইয়ে, ১৮ অক্টোবর ১৯৬৫ সালে। ভারতীয় বংশোদ্ভূত এবং ভারতীয় নাগরিক ডা: নায়েক ১৯৯১ সাল থেকে ধর্ম প্রচারক হিসেবে ভূমিকা পালন করছেন। তিনি অলাভজনক প্রতিষ্ঠান ইসলামিক রিসার্চ সেন্টার ও পিস টিভির প্রতিষ্ঠাতা। একই সাথে তিনি এর প্রধান মুখপাত্র ও মুখ্য বক্তা।
আমাদের জানা মতে, ডা: জাকির নায়েক তার দাওয়াহ কাজের স্বীকৃতি পেয়েছেন অনেক প্রতিষ্ঠান থেকেই। ২০১৫ সালে তিনি ইসলামের ওপর বিশেষ অবদান রাখার জন্য মর্যাদাপূর্ণ কিং ফয়সল আন্তর্জাতিক পুরস্কার পেয়েছেন। তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বের ব্যাপারে উৎসাহী ডা: জাকির ইতোমধ্যে তার বক্তব্য নিয়ে কোটি কোটি মানুষের কাছে পৌঁছে গেছেন। কুরআন-হাদিস ছাড়াও তিনি ওল্ড টেস্টামেন্ট, বাইবেল, বেদ ও অন্যান্য মৌলিক ধর্মগ্রন্থ আত্মস্থ করার চেষ্টা করেছেন। এ ক্ষেত্রে তার অবস্থান এই মুহূর্তে অপ্রতিদ্বন্দ্বীর কাতারে। সম্ভবত দক্ষিণ আফ্রিকার মরহুম আহমদ দিদাত ছাড়া আর কারো সাথে তার মিল বা সাযুজ্য খুঁজে পাওয়া সম্ভব নয়। মাঝে মধ্যে ডা: নায়েকের বক্তব্য শোনার সুযোগ হয়েছে। বাংলায় তার বক্তব্য ডাবিং হলেও তাকে বোঝার ও তার বক্তব্য সরাসরি উপলব্ধি করার জন্য ইংরেজি বক্তৃতাই বেশি গ্রহণযোগ্য।
ব্যক্তিগতভাবে তাকে কখনো বিশেষ মতের প্রতিনিধি মনে হয়নি। কোনো বক্তব্য খণ্ডিত করে ব্যাখ্যা না করলে তাকে ভারসাম্যপূর্ণ মানুষ হিসেবেই চিহ্নিত করা সম্ভব। যারা বলেন, তিনি ভারতের সালাফি মতাদর্শের অনুসারী সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তি, তাদের বক্তব্যের সপক্ষে দলিল কী, তা জানি না। তার মতো সঠিক পথের অনুসারীরা স্বার্থবাজদের টার্গেট হবেনÑ এটাই স্বাভাবিক। তবে অন্যান্য ইসলামি ধর্মপ্রচারকের সাথে তার পার্থক্য হলো, তার বক্তৃতাগুলো পারস্পরিক আলাপচারিতা ও প্রশ্নোত্তরভিত্তিক, যা তিনি আরবি কিংবা উর্দুতে নয়, বরং ইংরেজি ভাষায় প্রদান করে থাকেন এবং সব সময়ই তিনি ধর্মীয় নেতাদের গতানুগতিক পোশাকের পরিবর্তে সুট-টাই পরিধান করেই সর্বজনীনভাবে নিজেকে উপস্থাপন করে থাকেন। এ ধরনের পোশাক পরেই তিনি ইসলামের ড্রেসকোড সম্পর্কে গ্রহণযোগ্য বক্তব্য তুলে ধরেন। যেমনটি তুলে ধরেন ইসলামসম্মত খাদ্যনীতি এবং হালাল-হারাম সম্পর্কেও। ইসলামকে উপস্থাপনের ক্ষেত্রে তিনি বাড়াবাড়ি করে ফেলেছেন কিংবা প্রতিষ্ঠিত ধারণা উপড়ে ফেলেছেনÑ এমনটি হয়েছে বলে জানি না। দু-চারজন যারা তাকে পছন্দ করেন না, তারা ইসলামকেও পছন্দ করেন না। তারা ইসলামের প্রাণশক্তিও বোঝেন না। মজ্জাগতভাবে ধর্মবিরোধীরাই তার প্রতিপক্ষ; জাকির হিন্দুকে ভালো হিন্দু হতে, খ্রিষ্টান, ইহুদি, বৌদ্ধ ও মুসলিমকে ধর্মপ্রাণ মানুষ হতে বলেন। নায়েকের মতে, ধার্মিক যে ধর্মেরই হোন, তিনি গ্রহণযোগ্য মানুষ।
পেশাগত জীবনে ডাক্তার হলেও ১৯৯১ সাল থেকে তিনি ইসলাম ধর্ম প্রচারেই মনোনিবেশ করেছেন। তার মতে, তিনি মনোজগৎ, চিন্তা ও বিশ্বাসসংক্রান্ত চিকিৎসক হতে আগ্রহী। ইসলাম এবং তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বের ওপর তার বক্তৃতাগুলো পুস্তিকা আকারে অনেকেই প্রকাশ করেছেন। ইসলামের ভেতর কোনো শ্রেণিবিভাজন আছে বলে ডা: জাকির নায়েক মানেন না। একই সাথে নিজেকে কোনো ফেরকাবন্দীও ভাবেন না; বরং নিজেকে কুরআন-হাদিসপন্থী হিসেবে উপস্থাপন করতেই দেখেছি। এই যুক্তিবাদী ও বিজ্ঞানমনস্ক মানুষটিকে তারাই বিতর্কিত করতে পারেন, যারা উম্মাহর ক্ষতি চান। তারপরও কুরআন-সুন্নাহর বাইরে ডা: নায়েকের যেকোনো বক্তব্য ও মন্তব্যের সাথে দ্বিমত পোষণের এখতিয়ার সবার আছে। সে ক্ষেত্রে ডা: জাকির সম্ভবত এতটা উদার ও গভীর উপলব্ধির মানুষ যে, তার মতো বুদ্ধিবৃত্তিক উপস্থাপকের সাথে ভিন্নমত নিয়েও মোটা দাগে একমত হওয়া সম্ভব। ডা: নায়েকই সবচেয়ে বেশি তথ্যভিত্তিক বক্তব্য দিয়ে থাকেন। প্রয়োজনীয় রেফারেন্স ছাড়া তিনি বক্তব্য দেন না। তাই নিন্দাবাদ অর্থহীন। অন্য ধর্ম সম্পর্কে যখন তিনি বক্তব্য দেন, তখনো সেই ধর্মের মৌলিক গ্রন্থের রেফারেন্স ছাড়া কোনো মন্তব্য নিজ থেকে করেন না। ডা: নায়েক সনাতন ধর্ম সম্পর্কে যা জানেন, ততটা শীর্ষ ধর্মগুরুরাও জানেন বলে মনে হয় না। তার মতে, হিন্দু বলে কোনো ধর্ম নেই। ‘হিন্দ’ মুসলিমদের দেয়া, সিন্ধু নদীর অববাহিকায় বিস্তৃত জনপদের নাম। স্থানের ভিত্তিতে জাতীয়তা নিরূপণ করতে চাইলে এই জনপদের ধর্ম নির্বিশেষে সব মানুষ হিন্দুস্তানি। সনাতন ধর্মকে তিনি একেশ্বরবাদী ধর্ম মানেন, তার মতে এটাই ‘ব্রাহ্ম সমাজের’ লোকেরা বলতে চেয়েছেন। পরে ব্রাহ্মণরাই মূর্তি আমদানি করেছেন। তাই সব ধর্মের ধর্মব্যবসায়ীরা তার প্রতি নিন্দাবাদ করতে আগ্রহী হয়ে ওঠেন।
জাকির নায়েক প্রচলিত মাদরাসার ছাত্র ছিলেন না। তিনি মুম্বাইয়ের সেন্ট পিটার্স হাইস্কুলের ছাত্র ছিলেন। স্কুল শেষে তিনি কিশিনচাঁদ চেল্লারাম কলেজে ভর্তি হন। এরপর মেডিসিনের ওপর ডিগ্রি নিতে টোপিওয়ালা ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ অ্যান্ড নাইর হসপিটালে ভর্তি হন। সবশেষে ইউনিভার্সিটি অব মুম্বাই থেকে এমবিবিএস ডিগ্রি অর্জন করেন।
ডা: জাকির মরহুম আহমেদ দিদাতের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছেন যা তিনি বহু বক্তব্যে বলেছেন, যার সাথে তিনি ১৯৮৭ সালে সাাৎ করেছেন। এ কারণে ডা: জাকিরকে ‘দিদাত প্লাস’ বলা হয়, এই উপাধি নিজে নিতেও তার কোনো দ্বিধা নেই। ইসলাম ও তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বে তিনি স্বশিক্ষিত মানুষ নন, অধ্যয়নের মাধ্যমে তিনি জ্ঞান আহরণ করেছেন। মুম্বাইয়ের ইসলামিক ইন্টারন্যাশনাল স্কুল এবং ইউনাইটেড ইসলামিক এইডের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে তিনি দরিদ্র ও অসহায় মুসলিম তরুণ-তরুণীদের বৃত্তি প্রদান করে থাকেন। ইসলামি শিক্ষা ও ত্রাণকাজে উৎসাহের কারণ তার বিশ্বাস থেকে উৎসারিত। ডা: জাকির নায়েকের স্ত্রী ফরহাত নায়েক আইআরএফের নারীদের শাখায় কাজ করেছেন। তার সন্তানেরাও দাওয়াহ কাজে সংশ্লিষ্ট রয়েছে শিশুকাল থেকেই।
জাকির নায়েক মূলত যুগজিজ্ঞাসার আলোকে ইসলাম ধর্ম সম্পর্কিত অনেক বিষয়ে বক্তব্য দিয়েছেন তার্কিকের জায়গায় দাঁড়িয়ে। সুদ, হিজাব, মিউজিক, বহুবিবাহ, অমুসলিমের অধিকার, রীতিনীতি ও শরিয়াই নিয়ে তার বক্তব্য স্পষ্ট। সব বিষয়ে মন্তব্য করেছেন জানা ও মানার অবস্থান থেকে। বক্তৃতার মাধ্যমে ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে বিভিন্ন বিষয় কুরআন ও হাদিসের আলোকে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণই তার বক্তব্যের প্রাণ। তার ভাষা আক্রমণাত্মক নয়, যুক্তি ও তথ্যের। বিভিন্ন ধর্মের তুলনামূলক বিশ্লেষণের মাধ্যমে ইসলামের অধিকতর গ্রহণযোগ্যতা প্রতিষ্ঠা করা তার অন্যতম কৌশল। এ ব্যাপারে তিনি অকপট। ২০০০ সালে ‘বিজ্ঞানের আলোকে কুরআন ও বাইবেল’ বিষয়ে শিকাগোয় উইলিয়াম ক্যাম্পবেলের সাথে বিতর্কে তার উপস্থাপনা ছিলÑ ইসলাম একটি কার্যকারণ ও যুক্তির ধর্ম এবং কুরআনে বিজ্ঞানবিষয়ক প্রায় এক হাজার আয়াত আছে, যা বিজ্ঞানময়তার উপমা। ডা: জাকির বিজ্ঞানের সূত্র দিয়ে কুরআনকে বিশ্বাস করার কথা বলেননি, কুরআন বোঝার একটা প্রয়াস হিসেবে দেখেছেন। শ্রী শ্রী রবিশঙ্করের সাথে ‘ইসলাম ও হিন্দু ধর্মে ঈশ্বর’ বিষয়ে ব্যাঙ্গালোরে বিতর্ক কোটি মানুষের মনোযোগ আকর্ষণ করেছে শুধু তথ্য ও যুক্তিগ্রাহ্যতার কারণে। ২০১১ সালে নায়েক ভারত থেকে সরাসরি ভিডিও লিংকের মাধ্যমে অক্সফোর্ড ইউনিয়নের সাথে কথোপকথন করেন। ২০১২ সালের শুরু থেকেই জাকির নায়েক ও তার প্রতিষ্ঠিত পিস টিভি ভারত সরকারের কোপানলে পড়ে। ২০০৭ সাল থেকে মুম্বাইতে ফিবছর শান্তি সম্মেলন তার একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ হিসেবে সবার কাছে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। অপর দিকে, ভারত সরকার এসব কাজকে পৌত্তলিকতা বা বহুত্ববাদে বিশ্বাসী বর্তমান হিন্দুত্ববাদের জন্য ক্ষতিকর ভেবেছে, একত্ববাদে বিশ্বাসীদের একতরফা বিজয় ভেবেছে। অপর দিকে সেকুলারপন্থী ও বস্তুবাদীরা ভেবেছে তাদের নৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক পরাজয় ঠেকানোর এটাই সুযোগ। তাই সবচেয়ে মডারেট ও শান্তিবাদী মানুষটিকে সন্ত্রাস ও চরমপন্থীদের উসকানিদাতা বানানোর এত কসরত। দুর্ভাগ্য, বাংলাদেশ সরকার কোনো বাছবিচার না করেই একজন মানুষ ও মিডিয়াকে গলা টিপে ধরতে চেয়েছে।
ডা: নায়েককে ২০১০ সালের জুন মাসে যুক্তরাজ্য ও কানাডায় নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। লন্ডন এবং শেফিল্ডে তার বক্তৃতা আয়োজনের পর তৎকালীন স্বরাষ্ট্র সচিব (বর্তমান প্রধানমন্ত্রী) থেরেসা মে তার যুক্তরাজ্যে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। এটাকে বিশ্ববিবেক অধিকার হরণ ও জুলুম হিসেবে দেখেছে।
ডা: জাকির তার মিশন ও ভিশন সম্পর্কে বলে থাকেন, শিতি মুসলমানেরা যারা তাদের নিজ ধর্মকে ত্রুটিপূর্ণ ও সেকেলে বলে মনে করেন, সেই হীনম্মন্যদের তিনি আত্মপ্রত্যয়ী করতে চান। তিনি মনে করেন, প্রত্যেক মুসলিমের উচিত ইসলাম সম্বন্ধে ভুল ধারণাগুলো ভেঙে দেয়া এবং পশ্চিমা মিডিয়ার ইসলামের ওপর অপপ্রচারের বিরুদ্ধে তথ্য ও যুক্তির পুঁজি নিয়ে রুখে দাঁড়ানো। নায়েক মনে করেন, তীব্র ইসলামবিরোধী প্রচারণা সত্ত্বেও বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা ও প্রাণশক্তির কারণেই ইসলাম নিজস্ব গুণে বিকশিত হবে। ২০০১ থেকে ২০০২ সালের মধ্যে ৩৪ হাজার মার্কিন নাগরিক ইসলাম গ্রহণ করেছেন। নায়েকের ভাষ্য অনুযায়ী, ইসলাম একটি কার্যকারণ ও যুক্তির ধর্ম, এবং কুরআনে বিজ্ঞানও আছে, জীবন-জিজ্ঞাসার জবাব আছে; যা তিনি পশ্চিমা ধর্মান্তরিত মুসলিমদের সংখ্যা বৃদ্ধির কারণ হিসেবে ব্যাখ্যা করার পক্ষে।
বিজ্ঞান ও কুরআনের যুক্তি দিয়ে নায়েক বলেছেন, বিবর্তনবিষয়ক তত্ত্ব একটি প্রস্তাব মাত্র এবং এটি খুব বেশি অপ্রমাণিত একটি অনুমান। তার মতে, বেশির ভাগ বিজ্ঞানী এটা সমর্থন করেন এই কারণে, এটা বাইবেলের বিরুদ্ধে যায়, এই কারণে নয় যে, এটা সত্য। নায়েক দাবি করেন, কুরআন বহু বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের ব্যাপারে ভবিষ্যদ্বাণী করেছে। উদাহরণস্বরূপ, ২০১০ সালে তিনি বলেন, কুরআনের কিছু নির্দিষ্ট আয়াতে মাতৃগর্ভে নবজাতক-ভ্রƒণের বৃদ্ধি ও ক্রমবিকাশের ধাপগুলো পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে বর্ণনা করা হয়েছে। ডা: নায়েক চলমান বিশ্বে সব তর্কিত ইস্যুর ওপর ইসলামি সমাধান খুঁজে পেয়েছেন। নারীর অধিকার ও সম্মান নিয়ে নায়েক অত্যন্ত সোচ্চার। হালাল-হারাম থেকে অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জগুলো পর্যন্ত তার বিবেচনার বিষয়। আমাদের মতে, আলেম সমাজ তাকে গ্রহণ করে তার চিন্তায় ভুল থাকলে চিহ্নিত করে দিতে পারেন। কারণ আলেম সমাজ তার কাছে সম্মানিত। তিনি কখনো আলেমদের সম্পর্কে অগ্রহণযোগ্য মন্তব্য করেননি।
স্বধর্মত্যাগীদের সম্পর্কে তার দৃষ্টিভঙ্গি হচ্ছে, কোনো মুসলিম চাইলে ইসলাম থেকে আলাদা হয়ে যেতে পারে এবং এ জন্য তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়ার বিধান নেই। কিন্তু কোনো মুসলিম যদি ইসলাম ত্যাগের পর তার নতুন ধর্মবিশ্বাস প্রচার করে এবং ইসলামের বিরুদ্ধে কথা বলে, তবে সে বিশ্বাসঘাতক বলে বিবেচিত হবে। জাকির মনে করেন, ইসলামি আইন অনুসারে তার মৃত্যুদণ্ড হওয়া উচিত, যেমনটি দেশদ্রোহীর শাস্তি হয়ে থাকে। এই বিষয়গুলোর উপসংহার টানা খানিকটা কঠিন। এগুলো উম্মাহর ঐকমত্যের বিষয়। তাই আলেম সমাজ ভিন্নমত দেয়ার সুযোগ আছে। সেটা জাকিরবিদ্বেষ নয়, ইসলাম চর্চা ও অনুশীলনে চিন্তা ও মতের স্বাধীনতার বিষয়; যা ইসলামি মতাদর্শের একটি অনুপম বৈশিষ্ট্যও।
সারা বিশ্বে জনপ্রিয় হলেও জাকির নায়েক তার বক্তব্য ও মতের জন্য বিভিন্ন স্থানে আলোচিত ও সমালোচিত হয়েছেন। সব সমালোচনাকেই তিনি গুরুত্ব দেয়ার পক্ষে নন। তথ্যগত ভ্রান্তি থাকলে সেটা তিনি মেনে নেয়ার পক্ষে। তবে একটা সীমা পর্যন্ত তার সমালোচনাও ভিন্নমতের দৃষ্টিতে দেখার অধিকার থাকা তিনি অযৌক্তিক ভাবেন না। কিছু কিছু বিষয়ে তার সমালোচনা ও ভিন্নমতকে তিনি শুধু গ্রহণ করেননি, ভুলের স্বীকৃতি দিয়ে নিজেকে সংশোধন করে নেয়ার প্রতিশ্রুতিও পূরণ করেছেন।
অনেকবার জাকির নায়েক বিব্রতকর পরিস্থিতি মোকাবেলা করেছেন। যেমনÑ বিশ্ব হিন্দু পরিষদের নেত্রী সাধ্বী প্রাচী ঘোষণা করেন, কেউ যদি জাকির নায়েকের শিরñেদ করে আনতে পারে তবে তাকে ৫০ লাখ রুপি পুরস্কার দেয়া হবে। হুসনি টাইগার নামক স্বঘোষিত দল কর্তৃক জাকির নায়েকের মাথার বিনিময়ে ১৫ লাখ রুপি পুরস্কার ঘোষণা করার এক দিন পরই এ ঘটনা ঘটে। এতে জাকির নায়েক বিচলিত না হয়ে, পুরস্কার ঘোষণাকারীদের সন্ত্রাস ছড়িয়ে দেয়া থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানিয়েছেন।
ডা: জাকির নায়েক বিভিন্ন সময় বিভিন্ন বিষয়ে বক্তব্য রেখেছেন। তার বক্তৃতায় বিভিন্ন সম্প্রদায়ের আমন্ত্রিত ও অনামন্ত্রিত শ্রোতারা অংশগ্রহণ করেন। তার উল্লেখযোগ্য বক্তৃতা পরে মূল ইংরেজিসহ একাধিক ভাষায় বই হিসেবে প্রকাশিত হয়েছে। ২০০৭ সালে সৌদি আরবের দারুস সালাম প্রকাশনী জাকির নায়েকের দু’টি বই প্রকাশ করে : ‘দি কনসেপ্ট অব গড ইন মেজর রিলিজিওনস’ এবং ‘দি কুরআন অ্যান্ড মডার্ন সায়েন্স : কম্পিটেবল অর ইনকম্পিটেবল’। বাংলাদেশেও একাধিক প্রকাশনী তার বইগুলো বাংলায় অনুবাদ করে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করেছে। জাকির নায়েকের বিরুদ্ধে সন্ত্রাস ও চরমপন্থায় উদ্বুদ্ধকরণের অভিযোগ অর্থহীন। কখনো তিনি সন্ত্রাস ও চরমপন্থাকে ধর্মাচার হিসেবে মেনে নেননি; বরং ইসলামের শান্তিবাদী নীতি প্রচার করেই তিনি খ্যাতি পেয়েছেন। এর বিপরীত কোনো তথ্য-প্রমাণ থাকলে এ ক্ষেত্রে তার চ্যালেঞ্জ বিবেচনায় নেয়াই যথেষ্ট। বাংলাদেশী পত্রপত্রিকার মন্তব্য এবং সরকারের আচরণ একেবারেই অবিবেচনাপ্রসূত। এই অজ্ঞতা জাতির জন্য এক প্রকার অভিশাপ ও লজ্জাজনক। পিস টিভি ও ডা: জাকির নায়েকের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে সরকার কোথাও সাধুবাদ পায়নি; বরং উদারনৈতিক ভাবনার অসাম্প্রদায়িক বাঙালি মুসলমানকে ছোট ও কূপমণ্ডূক প্রমাণ করার দায় নিয়েছে, যা কোনোভাবেই উচিত হয়নি। আমাদের বক্তব্য স্পষ্ট, পিস টিভির ওপর নিষেধাজ্ঞা অন্যায্য এবং দায়িত্বের সীমা অতিক্রম করা ছাড়া আর কিছুই নয়। বোধোদয় না ঘটলে চরমপন্থীরাই সুযোগ নেবে। মডারেট ও উদারনৈতিক ধারা ক্ষতিগ্রস্ত হলে সন্ত্রাস আরো জায়গা পাবে।
– মাসুদ মজুমদার